alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ব মন্দায় বাংলাদেশের শক্তি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: শনিবার, ০৬ আগস্ট ২০২২

ইউরোপের দেশগুলোর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘরে জ্বালানি চাহিদা পূরণের সবচেয়ে বড় উৎস রাশিয়ার গ্যাস। ইতোমধ্যে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, এর ফলে সারা ইউরোপ বিশেষ করে জার্মানিতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘর গরম রাখার জন্য শীতকালে পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রচুর গ্যাসের চাহিদা থাকে। ইতোমধ্যে ইউরোপ পাঁচটি ভাসমান টার্মিনাল কিনে নিয়েছে যাতে তারা কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি করতে পারে। তবে কাতারের পক্ষে ইউরোপের এত বিরাট চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না বলে তারা জানিয়ে দিয়েছে। রাশিয়া যদি সত্যি সত্যি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে গ্যাসের দাম পুনরায় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। গ্যাসের দাম গত বছরের এই সময়ের চেয়ে ইতোমধ্যে ৪৫০ শতাংশ বেশি। দাম আরও বাড়লে সারা পৃথিবীতে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে এবং জিনিসপত্রের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। এতে দেশে দেশে গণবিক্ষোভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

করোনা মহামারীর উত্তর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পর্যালোচনা অনুযায়ী আরও কিছু দেশ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এই সব পর্যালোচনায় দেউলিয়া হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিমুক্ত নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির ঝুঁকির মাত্রা নির্ভর করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের স্থায়ীত্বের ওপর। যুদ্ধ এবং পারস্পরিক অর্থনৈতিক অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক উন্নত দেশেরও দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২১ সনে বিশ্ব প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫. ৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২২ সনে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়াবে ৩. ১ শতাংশ এবং ২০২৩ সনে তা আরও কমে হতে পারে ২. ৯ শতাংশ।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে ইতোমধ্যে আমাদের রিজার্ভে টান পড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৮৭.৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৬৫.৫৫ বিলিয়ন ডলার; ফলে আমদানি ব্যয় ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে আমাদের রপ্তানি আয় ৩৪. ৩৮ শতাংশ বাড়লেও তা দিয়ে আমদানি খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, রপ্তানি আয় ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার এবং প্রবাসীদের প্রেরিত ২১.০৩ বিলিয়ন ডলার যোগ করেও আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়নি। কারণ, রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ৭৩.১১ বিলিয়ন ডলার, অথচ বিগত বছরে আমদানি হয়েছে ৮৭.৮৭ বিলিয়ন ডলার। ফলে এই ঘাটতি পূরণে রিজার্ভে টান পড়ছে। রপ্তানি আয় বাড়লেও এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ আসে শুধু পোশাক রপ্তানি থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অবরোধ-নিষেধাজ্ঞায় গার্মেন্টস আমদানিকারক দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদায় সঙ্কট সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। রিজার্ভে টান পড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বিগত অর্থবছরের তুলনায় ১৫.১১ শতাংশ রেমিট্যান্স কম হয়েছে। এতসব বিপর্যয় থাকা সত্বেও বাংলাদেশের ভালভাবে টিকে থাকার কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেলেও এখনো আতঙ্কিত হওয়ার সময় আসেনি। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমছে। কোন দেশের আর্থিক অবস্থা বিচার্যে রিজার্ভ একমাত্র মাপকাঠি নয়। চীন, সুইজারল্যান্ড, রাশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশের রিজার্ভ আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশি, এমন কি ছোট দেশ তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়েও আমেরিকার রিজার্ভ কম। কিন্তু তাই বলে বলা যাবে না, আমেরিকার চেয়ে ওই সব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল। আফগানিস্তানের রিজার্ভ পাকিস্তানের চেয়ে বেশি, এর মানে এই নয় যে, আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা পাকিস্তানের চেয়ে ভালো। পাকিস্তানের রিজার্ভ ইতোমধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। ২০০১-০২ অর্থবছরেও আমাদের রিজার্ভ ছিল মাত্র ১.৫৮ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। যেদিন ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় সেদিন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ সাভারে একটি রিসোর্টে কেক কেটে তা উদযাপন করে, এই উদ্যাপনে আমিও ছিলাম। কিছুদিন আগেও অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, রিজার্ভের পাহাড় গড়ে তোলা অর্থহীন, রিজার্ভের অর্থ খরচ করে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে।

শুধু রিজার্ভ শূন্য হওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়নি, শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে তাদের কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাওয়াতে এবং রাজস্ব আদায়ে ধস নামার কারণে। রিজার্ভ শূন্য হওয়ার প্রধান কারণ হলো, শ্রীলঙ্কার রপ্তানি ও পর্যটন খাতে আয় প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে বেশির ভাগ তামিল, সিভিল ওয়ারে তামিলদের নির্মম এবং নিষ্ঠুর পন্থায় নির্মূল করায় তারা শ্রীলঙ্কায় অর্থ প্রেরণ বন্ধ করে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা এক সময় খাদ্য রপ্তানি করত, কিন্তু এখন প্রায় পুরো চাহিদার খাবার তাদের আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা সন্তোষজনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মাছ, মাংস, আলু, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। সম্প্রতি জানতে পারলাম, পেট্রোলও আমাদের আমদানি করতে হয় না। চাল উৎপাদনেও আমরা মাঝেমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাই, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা টেকসই হয় না। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশ রপ্তানির ক্ষেত্রে রেকর্ড গড়েছে। এখন পৃথিবীর কোন দেশ কঠিন শর্তেও শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, অন্যদিকে বাংলাদেশ এখনো অনুকূল শর্তের ভিত্তিতে ঋণ নিচ্ছে, কম সুদ হারে আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকেও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ আরও ঋণ নিলেও তা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হবে না, কারণ বাংলাদেশের জিডিপি ও বিদেশি ঋণের অনুপাত নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমার অনেক নিচে।

আমাদের গৃহীত বিদেশি ঋণের বেশির ভাগ দীর্ঘমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধে গ্রেস বা রেয়াতি সময় পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয়া হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য, ১১ বিলিয়ন ডলার, ৩০ বছরের মধ্যে ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে। এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সনের মার্চ মাস থেকে। জাপানের জাইকার সঙ্গে সম্পাদিত ঋণচুক্তি অনুযায়ী মেট্রোরেলের জন্য গৃহীত ঋণ ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য গৃহীত ২.৬৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধে ৬ বছর রেয়াত পাওয়া যাবে, সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরের মধ্যে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের এক্সিম ব্যাংক ১.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরে। প্রতিটি ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে। তাই ঋণ পরিশোধে এখনই রিজার্ভের ওপর কোন চাপ পড়বে বলে মনে হয় না। আমাদের গৃহীত ঋণের গড় সুদহার শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের চেয়ে অনেক কম। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের গড় সুদহার যেখানে ৬ শতাংশ সেখানে আমাদের বৈদেশিক ঋণের গড় সুদহার ২ শতাংশের চেয়েও কম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া কিছু পোস্ট পর্যালোচনা করলে মনে হয়, বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি শ্রীলঙ্কার অবস্থানে পৌঁছে ততই উত্তম। বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা দেখতে কিছু লোক অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া কিছু পোস্ট পর্যালোচনা করলে মনে হয়, বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি শ্রীলঙ্কার অবস্থানে পৌঁছে ততই উত্তম। বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা দেখতে কিছু লোক অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে। তবে বিরোধী দল এবং বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্ট আতঙ্ক সরকারের জন্য ইতিবাচক। তাদের আতঙ্ক সৃষ্টির কারণে জনগণ সচেতন হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে, লোডশেডিং কেন হচ্ছে, তা জনগণ বোঝার চেষ্টা করছে। কৃচ্ছ্রসাধনে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাদি পরিপালনে বিরোধী দলের সমর্থক ছাড়া সাধারণ জনগণের মধ্যে কোন ক্ষোভ নেই। কারণ জনগণ চায় না বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাক। সরকারও সতর্ক হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে কিছু কিছু পণ্যের দামও কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয় কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপরও প্রলম্বিত যুদ্ধ আর অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে সব হিসাব-নিকাশ ভুল হয়ে যেতে পারে। ভ-ুল হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বহু দেশ মারাত্মক সংকটে পড়বে, দেউলিয়া হয়ে যাবে। ইত্যবসরে আরও একটি দুর্যোগের উদ্ভব হয়েছে। তাইওয়ানে আমেরিকার কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির ভ্রমণ নিয়ে চীন এবং আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, চীন তাইওয়ানের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, শিগগিরই তাইওয়ানের আশেপাশে সামরিক মহড়া শুরু করতে যাচ্ছে। তাই কৃচ্ছ্রসাধনে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণকে প্রয়োজনে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

জলবায়ু ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে, কী করছি আমরা?

পথশিশু : পথই তাদের সব

ভিসানীতিতে আমরা কেন বিচলিত নই

মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে

প্রবীণদের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা

একটি সুন্দর সমাজের আকুতি

বাংলাদেশের নির্বাচন ও আমেরিকার ভিসানীতি

কূটনীতি : তখন আর এখন

সেতু-কালভার্টে নদীপথে বাড়ছে সংকট

প্রসঙ্গ : দ্রব্যমূল্য

সম্ভাবনাময় ইকোট্যুরিজম

পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা

হিন্দু কন্যা সন্তানদের সমানাধিকার প্রসঙ্গে

ছবি

রাজনীতির দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য প্রক্রিয়া

নারী শিক্ষার গুরুত্ব

জমি জটিলতা ও ভূমি বিভাগ

ভরত থেকে ভারতবর্ষ অতঃপর হিন্দুস্তান ইন্ডিয়া হয়ে ভারত

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স

রপ্তানি বহুমুখীকরণে তথ্যপ্রযুক্তি খাত

আদিবাসীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা ও পুলিশের ভূমিকা

ছবি

ডেঙ্গু রোধে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার

ছবি

পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের সম্ভাবনা

ছবি

নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না কেন

ছবি

বায়ুদূষণের ক্ষতি

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আর প্রয়োজন আছে কি

জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যাবে অগোচরে

বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস

ছবি

দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট জনজীবন

বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ সমাজ গঠন কেন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

কষ্টে আছে নিম্নবিত্ত মানুষ

কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে ভুল ধারণা

ছবি

কৃষির রূপান্তর : প্রাপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তিও আছে

শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়

হরিনামের মায়াময় আবেদন

ছবি

হাওর অর্থনীতি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিশ্ব মন্দায় বাংলাদেশের শক্তি

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শনিবার, ০৬ আগস্ট ২০২২

ইউরোপের দেশগুলোর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘরে জ্বালানি চাহিদা পূরণের সবচেয়ে বড় উৎস রাশিয়ার গ্যাস। ইতোমধ্যে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে, এর ফলে সারা ইউরোপ বিশেষ করে জার্মানিতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘর গরম রাখার জন্য শীতকালে পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রচুর গ্যাসের চাহিদা থাকে। ইতোমধ্যে ইউরোপ পাঁচটি ভাসমান টার্মিনাল কিনে নিয়েছে যাতে তারা কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানি করতে পারে। তবে কাতারের পক্ষে ইউরোপের এত বিরাট চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না বলে তারা জানিয়ে দিয়েছে। রাশিয়া যদি সত্যি সত্যি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে গ্যাসের দাম পুনরায় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। গ্যাসের দাম গত বছরের এই সময়ের চেয়ে ইতোমধ্যে ৪৫০ শতাংশ বেশি। দাম আরও বাড়লে সারা পৃথিবীতে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে এবং জিনিসপত্রের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। এতে দেশে দেশে গণবিক্ষোভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

করোনা মহামারীর উত্তর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গেছে এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পর্যালোচনা অনুযায়ী আরও কিছু দেশ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এই সব পর্যালোচনায় দেউলিয়া হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকিমুক্ত নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির ঝুঁকির মাত্রা নির্ভর করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের স্থায়ীত্বের ওপর। যুদ্ধ এবং পারস্পরিক অর্থনৈতিক অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক উন্নত দেশেরও দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে এবং ভবিষ্যতে আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২১ সনে বিশ্ব প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫. ৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২২ সনে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়াবে ৩. ১ শতাংশ এবং ২০২৩ সনে তা আরও কমে হতে পারে ২. ৯ শতাংশ।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে ইতোমধ্যে আমাদের রিজার্ভে টান পড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৮৭.৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৬৫.৫৫ বিলিয়ন ডলার; ফলে আমদানি ব্যয় ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে আমাদের রপ্তানি আয় ৩৪. ৩৮ শতাংশ বাড়লেও তা দিয়ে আমদানি খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, রপ্তানি আয় ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার এবং প্রবাসীদের প্রেরিত ২১.০৩ বিলিয়ন ডলার যোগ করেও আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়নি। কারণ, রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ৭৩.১১ বিলিয়ন ডলার, অথচ বিগত বছরে আমদানি হয়েছে ৮৭.৮৭ বিলিয়ন ডলার। ফলে এই ঘাটতি পূরণে রিজার্ভে টান পড়ছে। রপ্তানি আয় বাড়লেও এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ আসে শুধু পোশাক রপ্তানি থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অবরোধ-নিষেধাজ্ঞায় গার্মেন্টস আমদানিকারক দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদায় সঙ্কট সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। রিজার্ভে টান পড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বিগত অর্থবছরের তুলনায় ১৫.১১ শতাংশ রেমিট্যান্স কম হয়েছে। এতসব বিপর্যয় থাকা সত্বেও বাংলাদেশের ভালভাবে টিকে থাকার কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেলেও এখনো আতঙ্কিত হওয়ার সময় আসেনি। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমছে। কোন দেশের আর্থিক অবস্থা বিচার্যে রিজার্ভ একমাত্র মাপকাঠি নয়। চীন, সুইজারল্যান্ড, রাশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশের রিজার্ভ আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশি, এমন কি ছোট দেশ তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়েও আমেরিকার রিজার্ভ কম। কিন্তু তাই বলে বলা যাবে না, আমেরিকার চেয়ে ওই সব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল। আফগানিস্তানের রিজার্ভ পাকিস্তানের চেয়ে বেশি, এর মানে এই নয় যে, আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা পাকিস্তানের চেয়ে ভালো। পাকিস্তানের রিজার্ভ ইতোমধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। ২০০১-০২ অর্থবছরেও আমাদের রিজার্ভ ছিল মাত্র ১.৫৮ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। যেদিন ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় সেদিন তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ সাভারে একটি রিসোর্টে কেক কেটে তা উদযাপন করে, এই উদ্যাপনে আমিও ছিলাম। কিছুদিন আগেও অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, রিজার্ভের পাহাড় গড়ে তোলা অর্থহীন, রিজার্ভের অর্থ খরচ করে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে।

শুধু রিজার্ভ শূন্য হওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়নি, শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে তাদের কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাওয়াতে এবং রাজস্ব আদায়ে ধস নামার কারণে। রিজার্ভ শূন্য হওয়ার প্রধান কারণ হলো, শ্রীলঙ্কার রপ্তানি ও পর্যটন খাতে আয় প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে বেশির ভাগ তামিল, সিভিল ওয়ারে তামিলদের নির্মম এবং নিষ্ঠুর পন্থায় নির্মূল করায় তারা শ্রীলঙ্কায় অর্থ প্রেরণ বন্ধ করে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা এক সময় খাদ্য রপ্তানি করত, কিন্তু এখন প্রায় পুরো চাহিদার খাবার তাদের আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা সন্তোষজনক। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মাছ, মাংস, আলু, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। সম্প্রতি জানতে পারলাম, পেট্রোলও আমাদের আমদানি করতে হয় না। চাল উৎপাদনেও আমরা মাঝেমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাই, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা টেকসই হয় না। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশ রপ্তানির ক্ষেত্রে রেকর্ড গড়েছে। এখন পৃথিবীর কোন দেশ কঠিন শর্তেও শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, অন্যদিকে বাংলাদেশ এখনো অনুকূল শর্তের ভিত্তিতে ঋণ নিচ্ছে, কম সুদ হারে আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকেও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ আরও ঋণ নিলেও তা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হবে না, কারণ বাংলাদেশের জিডিপি ও বিদেশি ঋণের অনুপাত নির্ধারিত সর্বোচ্চ সীমার অনেক নিচে।

আমাদের গৃহীত বিদেশি ঋণের বেশির ভাগ দীর্ঘমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধে গ্রেস বা রেয়াতি সময় পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয়া হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য, ১১ বিলিয়ন ডলার, ৩০ বছরের মধ্যে ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে। এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সনের মার্চ মাস থেকে। জাপানের জাইকার সঙ্গে সম্পাদিত ঋণচুক্তি অনুযায়ী মেট্রোরেলের জন্য গৃহীত ঋণ ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য গৃহীত ২.৬৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধে ৬ বছর রেয়াত পাওয়া যাবে, সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরের মধ্যে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের এক্সিম ব্যাংক ১.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরে। প্রতিটি ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে। তাই ঋণ পরিশোধে এখনই রিজার্ভের ওপর কোন চাপ পড়বে বলে মনে হয় না। আমাদের গৃহীত ঋণের গড় সুদহার শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের চেয়ে অনেক কম। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের গড় সুদহার যেখানে ৬ শতাংশ সেখানে আমাদের বৈদেশিক ঋণের গড় সুদহার ২ শতাংশের চেয়েও কম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া কিছু পোস্ট পর্যালোচনা করলে মনে হয়, বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি শ্রীলঙ্কার অবস্থানে পৌঁছে ততই উত্তম। বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা দেখতে কিছু লোক অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া কিছু পোস্ট পর্যালোচনা করলে মনে হয়, বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি শ্রীলঙ্কার অবস্থানে পৌঁছে ততই উত্তম। বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা দেখতে কিছু লোক অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে। তবে বিরোধী দল এবং বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্ট আতঙ্ক সরকারের জন্য ইতিবাচক। তাদের আতঙ্ক সৃষ্টির কারণে জনগণ সচেতন হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে, লোডশেডিং কেন হচ্ছে, তা জনগণ বোঝার চেষ্টা করছে। কৃচ্ছ্রসাধনে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাদি পরিপালনে বিরোধী দলের সমর্থক ছাড়া সাধারণ জনগণের মধ্যে কোন ক্ষোভ নেই। কারণ জনগণ চায় না বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাক। সরকারও সতর্ক হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে কিছু কিছু পণ্যের দামও কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয় কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপরও প্রলম্বিত যুদ্ধ আর অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে সব হিসাব-নিকাশ ভুল হয়ে যেতে পারে। ভ-ুল হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বহু দেশ মারাত্মক সংকটে পড়বে, দেউলিয়া হয়ে যাবে। ইত্যবসরে আরও একটি দুর্যোগের উদ্ভব হয়েছে। তাইওয়ানে আমেরিকার কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির ভ্রমণ নিয়ে চীন এবং আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, চীন তাইওয়ানের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, শিগগিরই তাইওয়ানের আশেপাশে সামরিক মহড়া শুরু করতে যাচ্ছে। তাই কৃচ্ছ্রসাধনে বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণকে প্রয়োজনে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

back to top