আব্দুল মান্নান খান
শিশুদের লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় আসলে ব্যয় নয়, লগ্নি। দির্ঘমেয়াদি স্থায়ী লগ্নি। মেগা প্রকল্প নিতে হবে এই খাতে। করতে হবে- ১. শতভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে সব শিশুর লেখাপড়া অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে। ২. সব শিশুর লেখাপড়া অভিন্ন কারিকুলামে হতে হবে। ৩. ব্যাপকহারে দেশে আবাসিক স্কুল গড়ে তুলতে হবে। ৪. স্কুলের অবকাঠামো খাতে বিত্তবান অভিভাবকদের ডোনেশান দিতে হবে। ৫. এলাকার নিকটতম স্কুলে সব শিশুকে পড়াতে হবে।
এবার একটু বিস্তারিত দেখা যাক-
১. সব শিশুর লেখাপড়া অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে-
এটা নবম শ্রেণী পর্যন্তও হতে পারে এবং এখানেই হতে পারে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। কেননা সবাই এর পরের ধাপে লেখাপড়া করতে যাবে না। আবার এর আগে কাউকে ছেড়েও দেয়া যাবে না। এ পর্যন্ত হলেই যে কেউ তখন একজন লেখাপড়া জানা মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারবে। গোটা জনগোষ্ঠী তখন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। এ পরীক্ষা পর্যন্ত লেখাপড়ার ভিত্তিতেই হবে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন। অর্থাৎ এর পরে সে কী করবে, উচ্চশিক্ষায় যাবে নাকি অন্য কোন পেশায় যাবে। ওই সনদ অর্জন হবে সবার জন্যই বাধ্যতামূলক। বাধ্যতামূলক মানে বাধ্যতামূলক। কোন শিশু স্কুল সময়ে স্কুলের বাইরে থাকবে না। তারপর একটা সময় আসবে যখন ওই সনদ ছাড়া কেউ কোন কাজও করতে পারবে না এবং শতভাগ দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে দেশে। উচ্চশিক্ষায় থাকবে অন্যান্য সব বিষয়ের মতো খেলাধুলা ও শিল্প-সংস্কৃতি। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করার শুপারিশ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টেও রয়েছে। এটাকে বাধ্যতামূলক করে বাস্তবায়ন করতে হবে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে।
২. সব শিশুর লেখাপড়া অভিন্ন কারিকুলামে হতে হবে-
আমরা যদি একটু প্রথম দিকে তাকাই দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করেছিলেন স্বাধীনের পরপরই। দেশ গড়তে প্রথম প্রয়োজন শিক্ষা তাই প্রাথমিক শিক্ষাকে শুরুতেই গুরুত্ব সহকারে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু যখন দেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক অবস্থা কেমন ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৫ আগস্টে সবকিছু ওলটপালট না হয়ে গেলে হয়তো দেখা যেত দেশের প্রাথমিক শিক্ষা একটা অভিন্ন কারিকুলামের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। একই ধারায় চলছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। একই ধারার মনমানসিকত নিয়ে গড়ে উঠছে দেশের সব শিশু-কিশোর। এখন সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক লেখাপড়া তা সে (পঞ্চম অষ্টম নবম) যে শ্রেণীতেই নির্ধারিত হোক না কেন, করতে হবে এখনই। এবং সেটা করতে হবে একটা অভিন্ন কারিকুলামের মাধ্যমে। অভিন্ন কারিকুলাম কাজটা কঠিন ঠিকই, আবার কঠিন নয়। জাতীয় স্বার্থে সবাইকে একমত হতে হবে এটা কঠিন, কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্ধে কোন কিছু করতে চাইলে সেটা অসম্ভব হতে পারে না। আবার কঠিন না এই অর্থে যে, বাংলাদেশ একটা ভাষারাষ্ট্র বা জাতিরাষ্ট্রে। আমরা তার নাগরিক। এ কাজ করতে এখানেই রয়েছে আমাদের সুবিধাটা। আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা যাতে জাতি চেতনাসহ একই মনমানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে সেদিকেই এগিয়ে যেতে হবে সময়ক্ষেপণ না করে।
ছোটখাটো উন্নয়ন প্রকল্প, বিনামূল্যে সব শিক্ষার্থীকে পাঠ্যবই বিতরণ, উপবৃত্তির টাকা কিছু টিফিন দেয়া (কোন কোন এলাকায়) এগুলো করে জাতিগত চেতনার বিকাশ ঘটানো শিক্ষিত জাতিগোষ্ঠী গড়ে তোলা কতটা সম্ভব কত দিনে সম্ভব তা ভেবে দেখতে হবে। একটি ভাষারাষ্ট্রে একটি জাতিরাষ্ট্রে শিশুদের নানা রকম কারিকুলামে নানা রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা কোন কারিকুলাম ছাড়াই যেমন খুশি পাঠদান করে ওই চেতনা আসবে না। অভিন্ন কারিকুলামে আসা আমাদের জন্য যেমন কঠিন তেমন সহজও। ধনী-গরিব বৈষম্য এ কাজে যতটা না কঠিন তার চেয়ে কঠিন ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। আবার সহজ হলো আমরা একই ভাষায় কথা বলি, আমাদের রাষ্ট্রটি একটি ভাষারাষ্ট্র। ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি। আমাদের ভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিই আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। আমাদের এই চেতনা বাস্তবায়নে আসলে কোন প্রকার ছাড় দেয়া চলে না। প্রয়োজন শুধু সাহসী পদক্ষেপ। আরেকটি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য সেটা জাতীয় স্বার্থের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য। কাজেই আমাদের শিক্ষার ভিত মজবুত করতে চাইলে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষিত জাতি গড়তে চাইলে এই অভিন্ন কারিকুলামের মধ্যে আসতেই হবে। আগেই বলেছি প্রাথমিক শিক্ষা তা সে যে শ্রেণী পর্যন্তই হোক পুরোটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে হবে। তারপর বাকিটা সরকারি-বেসরকারিভাবে চলবে এখন যেমন চলছে। সরকারকে দেখতে হবে সিলেবাসের বাইরে কোন পাঠদান বা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে কি না। আর প্রাইমারির সবকিছুই থাকতে হবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যাঁরা শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করতে চান বা করছেন, তাদের দৃষ্টি প্রাইমারি থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
এখানে অভিন্ন কারিকুলামে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠদান নিয়ে কথা। এর জন্য আগে দরকার সেই অভিন্ন কারিকুলাম তৈরি করা। দরকার ব্যাপক গবেষণা। এতে এনসিটিবির কাজ হবে কারিকুলাম নিয়ে মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে ব্যাপক গবেষণা করা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল বাস্তবায়নের সুপারিশ করা। এখন যে ব্যত্যয় ঘটছে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের দ্বারা সেটা করা যাবে না। গবেষণা হবে চলমান এবং সেটাই হওয়া উচিত হবে এনসিটিবির কাজ।
৩. ব্যাপক হারে দেশে আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে-
এসব কিছু বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে দেশে ব্যাপক হারে আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা। এখান থেকেই শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কিছু কাজ শিখে বেরিয়ে আসবে। যে শিক্ষার্থীর যেদিকে শেখার ঝোক থাকবে সেটায় সে হাতে-কলমে শিখে বেব হবে। সবাই তো আর উচ্চশিক্ষায় যাবে না কাজ করে খাবে। তাই নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাটা হলে খালো হবে। বয়সটাও একটু কাজ করে খাওয়ার উপযুক্ত হবে। গ্রামগঞ্জে অনগ্রসর এলাকায় সবখানে গড়ে তুলতে হবে আবাসিক স্কুল। এতে শহরের ওপর চাপ কমবে। শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করার সুযোগ কমে যাবে। বায়ুদূষণের হাত থেতে শিশুরা রক্ষা পাবে।
৪. স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়নে বিত্তবান অভিভাবকদের ডোনেশান দিতে হবে-এখন কথা হলো বিত্তবান কারা। এই ইস্যুতে বিত্তবানদের শনাক্ত করা কোন কঠিন কাজ না। সবাই চেনে তাদের। এর একটা কালিকাও ইউনিয়ন/ওয়ার্ড পর্যায়ে করে নেয়া যেতে পারে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেয়া হচ্ছে সবশিক্ষার্থীকে। এর একটা ভালো দিক আছে। পাঠদানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারছে না অসাধু ব্যবসায়ীরা। মজুত গড়ে তুলে বা নানা কারসাজিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেউ। এখানে বহু বছর আগে কলকাতা বেতার থেকে শোনা একটা গল্প মনে পড়ল। বাজারে শিশুতোষ পাওয়া যাচ্ছে না। একখানা শিশুতোষের অভাবে ছোট্ট খুকুমণি স্কুলে যেতে পারছে না। রোজ তার বাবা অফিসে যাবার সময় বলে যায় আজ ঠিকই শিশুতোষ নিয়ে আসবেন কিন্তু পারেন না। ব্যর্থ হয়ে শেষে তিনি রাত করে অফিস থেকে ফেরা শুরু করেন যখন শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে। এমন করেই দিন যায়। শেষে এক দিন খুকুমণি স্বপ্নে দেখে দেবী স্বরসতীকে। খুকুমণি শুনেছে স্বরসতী বিদ্যার দেবী। সে একটু ভেবে নিয়ে বললে, আমাকে একখানা শিশুতোষ জোগাড় করে দাও না মা স্বরসতী। দেবী তখন বললেন, সেটা তো আমি পারবো না তবে তুমি মন খারাপ করো না আমি তোমাকে একটা বর দিতে পারি যাতে তোমাকে আর শিশুতোষ পড়তে না হয়। তখন খুকুমণি খুশি হয়ে বললো, আচ্ছা তুমি তাই দাও। পরের দিন বাবা-মা দেখলেন তাদের মেয়েটি সেজেগুজে কলেজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তারা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ী করতে লাগলেন। দেখলেন তাদের বয়সও ২০ বছর করে বেড়ে গেছে।
এরবম পরিস্থিতির হাত থেকে আমরা বেঁচে গেছি বিনামূল্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে যথা সময়ে পাঠ্যপুস্তক তুলে দিতে পেরে। এখানে যে অনিয়মটা করা হচ্ছে তা হলো সচ্ছ্বল বিত্তবান অভিভাবকদের সন্তানদের হাতে বিনামূল্যের বই তুলে দেয়া হচ্ছে, এটা কেন করা হবে। একটা স্কুল চালাতে সমর্থ যে অভিভাবক তার সন্তানও পাচ্ছে বিনামূল্যে বই এটা কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষণ নয়। এই টাকাটা দিয়ে অনেক গরিব শিশুর শিক্ষার জন্য কত কিছইু করা যেতে পারত। তারপরও এটাকে আমরা স্বাগত জানাই্। এখন সচ্ছ্বল সমর্থবান বিত্তবান অভিভাবকদের কাছ থেকে যদি উন্নয়ন তহবিলে টাকা নেয়া হয় সেটা অযৌক্তিক হতে পারে না। প্রত্যেকেই চাইবেন তার সন্তান যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করবে সেটা ভালোভাবে সুচারুরূপে চলুক। এই যে নোট-গাইড কোচিং সহায়ক গ্রন্থ প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা এ রকম নানাভাবে যদি কোন অভিভাবককে টাকা ঢালতে না হয় তার সন্তানের লেখাপড়ার জন্য তাহলে স্কুলে ডোনেট করা তার জন্য কোন ব্যাপারই না।
৫. এলাকার নিকটতম স্কুলে সব শিশুকে পড়াতে হবে-
মূল কথা হবে কোন স্বুল খারাপ না। তারপরও স্বুলের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার সব শিশু যখন এক স্কুলে পড়বে তখন আর খারাপ স্কুল বলে যে ধারণাটা তা উবে যাবে। থাকবে না। তখন এর সুফল ছড়িয়ে পড়বে সমাজের সব স্তরে। শিশু একা বা পাড়ামগল্লার শিশুরা মিলে পায়ে গেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে। গাড়িঘোড়ায় চড়ার হয়রানি আর ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে। কেউ তার সন্তানকে বসবাসের নিকটতম স্কুলে পড়াতে না চাইলে যেখানে পড়াতে চাইবেন সেখানে গিয়ে তাকে বসবাস করতে হবে।
কাজ অনেকটাই এগিয়ে আছে। এখন এমন-গ্রাম মহল্লা নেই যেখানে সরকারি স্কুল নেই। এখন মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে কেবল এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমান স্কুলগুলো আবাসিক করতে হবে ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে নতুন স্কুল করতে হবে।
সবার জন্য লেখাপড়া, দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, মেধা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া এসব আমরা সবাই চাই। আর চাই বলেই প্রয়োজন এরকম মেগা প্রকল্প যেখানে শতভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে সব শিশুর লেখাপড়া অষ্টম বা নবম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক হবে। দেশের সব শিশু অভিন্ন কারিকুলামে লেখাপড়া করবে। ব্যাপকহারে দেশে আবাসিক স্কুল গড়ে উঠবে। স্কুলের অবকাঠামো খাতে বিত্তবান অভিভাবকরা ডোনেশান দেবেন। বসবাসের নিকটতম স্কুলে সব শিশু লেখাপড়া করবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
আব্দুল মান্নান খান
বুধবার, ০৫ অক্টোবর ২০২২
শিশুদের লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় আসলে ব্যয় নয়, লগ্নি। দির্ঘমেয়াদি স্থায়ী লগ্নি। মেগা প্রকল্প নিতে হবে এই খাতে। করতে হবে- ১. শতভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে সব শিশুর লেখাপড়া অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে। ২. সব শিশুর লেখাপড়া অভিন্ন কারিকুলামে হতে হবে। ৩. ব্যাপকহারে দেশে আবাসিক স্কুল গড়ে তুলতে হবে। ৪. স্কুলের অবকাঠামো খাতে বিত্তবান অভিভাবকদের ডোনেশান দিতে হবে। ৫. এলাকার নিকটতম স্কুলে সব শিশুকে পড়াতে হবে।
এবার একটু বিস্তারিত দেখা যাক-
১. সব শিশুর লেখাপড়া অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করতে হবে-
এটা নবম শ্রেণী পর্যন্তও হতে পারে এবং এখানেই হতে পারে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। কেননা সবাই এর পরের ধাপে লেখাপড়া করতে যাবে না। আবার এর আগে কাউকে ছেড়েও দেয়া যাবে না। এ পর্যন্ত হলেই যে কেউ তখন একজন লেখাপড়া জানা মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারবে। গোটা জনগোষ্ঠী তখন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। এ পরীক্ষা পর্যন্ত লেখাপড়ার ভিত্তিতেই হবে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন। অর্থাৎ এর পরে সে কী করবে, উচ্চশিক্ষায় যাবে নাকি অন্য কোন পেশায় যাবে। ওই সনদ অর্জন হবে সবার জন্যই বাধ্যতামূলক। বাধ্যতামূলক মানে বাধ্যতামূলক। কোন শিশু স্কুল সময়ে স্কুলের বাইরে থাকবে না। তারপর একটা সময় আসবে যখন ওই সনদ ছাড়া কেউ কোন কাজও করতে পারবে না এবং শতভাগ দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে দেশে। উচ্চশিক্ষায় থাকবে অন্যান্য সব বিষয়ের মতো খেলাধুলা ও শিল্প-সংস্কৃতি। প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করার শুপারিশ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টেও রয়েছে। এটাকে বাধ্যতামূলক করে বাস্তবায়ন করতে হবে মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে।
২. সব শিশুর লেখাপড়া অভিন্ন কারিকুলামে হতে হবে-
আমরা যদি একটু প্রথম দিকে তাকাই দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করেছিলেন স্বাধীনের পরপরই। দেশ গড়তে প্রথম প্রয়োজন শিক্ষা তাই প্রাথমিক শিক্ষাকে শুরুতেই গুরুত্ব সহকারে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু যখন দেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক অবস্থা কেমন ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৫ আগস্টে সবকিছু ওলটপালট না হয়ে গেলে হয়তো দেখা যেত দেশের প্রাথমিক শিক্ষা একটা অভিন্ন কারিকুলামের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। একই ধারায় চলছে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। একই ধারার মনমানসিকত নিয়ে গড়ে উঠছে দেশের সব শিশু-কিশোর। এখন সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক লেখাপড়া তা সে (পঞ্চম অষ্টম নবম) যে শ্রেণীতেই নির্ধারিত হোক না কেন, করতে হবে এখনই। এবং সেটা করতে হবে একটা অভিন্ন কারিকুলামের মাধ্যমে। অভিন্ন কারিকুলাম কাজটা কঠিন ঠিকই, আবার কঠিন নয়। জাতীয় স্বার্থে সবাইকে একমত হতে হবে এটা কঠিন, কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্ধে কোন কিছু করতে চাইলে সেটা অসম্ভব হতে পারে না। আবার কঠিন না এই অর্থে যে, বাংলাদেশ একটা ভাষারাষ্ট্র বা জাতিরাষ্ট্রে। আমরা তার নাগরিক। এ কাজ করতে এখানেই রয়েছে আমাদের সুবিধাটা। আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা যাতে জাতি চেতনাসহ একই মনমানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠতে পারে সেদিকেই এগিয়ে যেতে হবে সময়ক্ষেপণ না করে।
ছোটখাটো উন্নয়ন প্রকল্প, বিনামূল্যে সব শিক্ষার্থীকে পাঠ্যবই বিতরণ, উপবৃত্তির টাকা কিছু টিফিন দেয়া (কোন কোন এলাকায়) এগুলো করে জাতিগত চেতনার বিকাশ ঘটানো শিক্ষিত জাতিগোষ্ঠী গড়ে তোলা কতটা সম্ভব কত দিনে সম্ভব তা ভেবে দেখতে হবে। একটি ভাষারাষ্ট্রে একটি জাতিরাষ্ট্রে শিশুদের নানা রকম কারিকুলামে নানা রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা কোন কারিকুলাম ছাড়াই যেমন খুশি পাঠদান করে ওই চেতনা আসবে না। অভিন্ন কারিকুলামে আসা আমাদের জন্য যেমন কঠিন তেমন সহজও। ধনী-গরিব বৈষম্য এ কাজে যতটা না কঠিন তার চেয়ে কঠিন ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। আবার সহজ হলো আমরা একই ভাষায় কথা বলি, আমাদের রাষ্ট্রটি একটি ভাষারাষ্ট্র। ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি। আমাদের ভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিই আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। আমাদের এই চেতনা বাস্তবায়নে আসলে কোন প্রকার ছাড় দেয়া চলে না। প্রয়োজন শুধু সাহসী পদক্ষেপ। আরেকটি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য সেটা জাতীয় স্বার্থের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য। কাজেই আমাদের শিক্ষার ভিত মজবুত করতে চাইলে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষিত জাতি গড়তে চাইলে এই অভিন্ন কারিকুলামের মধ্যে আসতেই হবে। আগেই বলেছি প্রাথমিক শিক্ষা তা সে যে শ্রেণী পর্যন্তই হোক পুরোটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে হবে। তারপর বাকিটা সরকারি-বেসরকারিভাবে চলবে এখন যেমন চলছে। সরকারকে দেখতে হবে সিলেবাসের বাইরে কোন পাঠদান বা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে কি না। আর প্রাইমারির সবকিছুই থাকতে হবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যাঁরা শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করতে চান বা করছেন, তাদের দৃষ্টি প্রাইমারি থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
এখানে অভিন্ন কারিকুলামে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠদান নিয়ে কথা। এর জন্য আগে দরকার সেই অভিন্ন কারিকুলাম তৈরি করা। দরকার ব্যাপক গবেষণা। এতে এনসিটিবির কাজ হবে কারিকুলাম নিয়ে মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে ব্যাপক গবেষণা করা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল বাস্তবায়নের সুপারিশ করা। এখন যে ব্যত্যয় ঘটছে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের দ্বারা সেটা করা যাবে না। গবেষণা হবে চলমান এবং সেটাই হওয়া উচিত হবে এনসিটিবির কাজ।
৩. ব্যাপক হারে দেশে আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে-
এসব কিছু বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে দেশে ব্যাপক হারে আবাসিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা। এখান থেকেই শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কিছু কাজ শিখে বেরিয়ে আসবে। যে শিক্ষার্থীর যেদিকে শেখার ঝোক থাকবে সেটায় সে হাতে-কলমে শিখে বেব হবে। সবাই তো আর উচ্চশিক্ষায় যাবে না কাজ করে খাবে। তাই নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাটা হলে খালো হবে। বয়সটাও একটু কাজ করে খাওয়ার উপযুক্ত হবে। গ্রামগঞ্জে অনগ্রসর এলাকায় সবখানে গড়ে তুলতে হবে আবাসিক স্কুল। এতে শহরের ওপর চাপ কমবে। শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করার সুযোগ কমে যাবে। বায়ুদূষণের হাত থেতে শিশুরা রক্ষা পাবে।
৪. স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়নে বিত্তবান অভিভাবকদের ডোনেশান দিতে হবে-এখন কথা হলো বিত্তবান কারা। এই ইস্যুতে বিত্তবানদের শনাক্ত করা কোন কঠিন কাজ না। সবাই চেনে তাদের। এর একটা কালিকাও ইউনিয়ন/ওয়ার্ড পর্যায়ে করে নেয়া যেতে পারে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেয়া হচ্ছে সবশিক্ষার্থীকে। এর একটা ভালো দিক আছে। পাঠদানে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারছে না অসাধু ব্যবসায়ীরা। মজুত গড়ে তুলে বা নানা কারসাজিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেউ। এখানে বহু বছর আগে কলকাতা বেতার থেকে শোনা একটা গল্প মনে পড়ল। বাজারে শিশুতোষ পাওয়া যাচ্ছে না। একখানা শিশুতোষের অভাবে ছোট্ট খুকুমণি স্কুলে যেতে পারছে না। রোজ তার বাবা অফিসে যাবার সময় বলে যায় আজ ঠিকই শিশুতোষ নিয়ে আসবেন কিন্তু পারেন না। ব্যর্থ হয়ে শেষে তিনি রাত করে অফিস থেকে ফেরা শুরু করেন যখন শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে। এমন করেই দিন যায়। শেষে এক দিন খুকুমণি স্বপ্নে দেখে দেবী স্বরসতীকে। খুকুমণি শুনেছে স্বরসতী বিদ্যার দেবী। সে একটু ভেবে নিয়ে বললে, আমাকে একখানা শিশুতোষ জোগাড় করে দাও না মা স্বরসতী। দেবী তখন বললেন, সেটা তো আমি পারবো না তবে তুমি মন খারাপ করো না আমি তোমাকে একটা বর দিতে পারি যাতে তোমাকে আর শিশুতোষ পড়তে না হয়। তখন খুকুমণি খুশি হয়ে বললো, আচ্ছা তুমি তাই দাও। পরের দিন বাবা-মা দেখলেন তাদের মেয়েটি সেজেগুজে কলেজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তারা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ী করতে লাগলেন। দেখলেন তাদের বয়সও ২০ বছর করে বেড়ে গেছে।
এরবম পরিস্থিতির হাত থেকে আমরা বেঁচে গেছি বিনামূল্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে যথা সময়ে পাঠ্যপুস্তক তুলে দিতে পেরে। এখানে যে অনিয়মটা করা হচ্ছে তা হলো সচ্ছ্বল বিত্তবান অভিভাবকদের সন্তানদের হাতে বিনামূল্যের বই তুলে দেয়া হচ্ছে, এটা কেন করা হবে। একটা স্কুল চালাতে সমর্থ যে অভিভাবক তার সন্তানও পাচ্ছে বিনামূল্যে বই এটা কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষণ নয়। এই টাকাটা দিয়ে অনেক গরিব শিশুর শিক্ষার জন্য কত কিছইু করা যেতে পারত। তারপরও এটাকে আমরা স্বাগত জানাই্। এখন সচ্ছ্বল সমর্থবান বিত্তবান অভিভাবকদের কাছ থেকে যদি উন্নয়ন তহবিলে টাকা নেয়া হয় সেটা অযৌক্তিক হতে পারে না। প্রত্যেকেই চাইবেন তার সন্তান যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করবে সেটা ভালোভাবে সুচারুরূপে চলুক। এই যে নোট-গাইড কোচিং সহায়ক গ্রন্থ প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা এ রকম নানাভাবে যদি কোন অভিভাবককে টাকা ঢালতে না হয় তার সন্তানের লেখাপড়ার জন্য তাহলে স্কুলে ডোনেট করা তার জন্য কোন ব্যাপারই না।
৫. এলাকার নিকটতম স্কুলে সব শিশুকে পড়াতে হবে-
মূল কথা হবে কোন স্বুল খারাপ না। তারপরও স্বুলের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার সব শিশু যখন এক স্কুলে পড়বে তখন আর খারাপ স্কুল বলে যে ধারণাটা তা উবে যাবে। থাকবে না। তখন এর সুফল ছড়িয়ে পড়বে সমাজের সব স্তরে। শিশু একা বা পাড়ামগল্লার শিশুরা মিলে পায়ে গেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতে পারবে। গাড়িঘোড়ায় চড়ার হয়রানি আর ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে। কেউ তার সন্তানকে বসবাসের নিকটতম স্কুলে পড়াতে না চাইলে যেখানে পড়াতে চাইবেন সেখানে গিয়ে তাকে বসবাস করতে হবে।
কাজ অনেকটাই এগিয়ে আছে। এখন এমন-গ্রাম মহল্লা নেই যেখানে সরকারি স্কুল নেই। এখন মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে কেবল এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমান স্কুলগুলো আবাসিক করতে হবে ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে নতুন স্কুল করতে হবে।
সবার জন্য লেখাপড়া, দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, মেধা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া এসব আমরা সবাই চাই। আর চাই বলেই প্রয়োজন এরকম মেগা প্রকল্প যেখানে শতভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে সব শিশুর লেখাপড়া অষ্টম বা নবম শ্রেণী পর্যন্ত বাধ্যতামূলক হবে। দেশের সব শিশু অভিন্ন কারিকুলামে লেখাপড়া করবে। ব্যাপকহারে দেশে আবাসিক স্কুল গড়ে উঠবে। স্কুলের অবকাঠামো খাতে বিত্তবান অভিভাবকরা ডোনেশান দেবেন। বসবাসের নিকটতম স্কুলে সব শিশু লেখাপড়া করবে।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]