জিয়াউদ্দীন আহমেদ
ধারণা ছিল, কংগ্রেস এবং সিনেটের এই নির্বাচনে জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক দলের ভরাডুবি হবে
সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে প্রতিনিধিদের নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু এই নির্বাচনের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোন আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি; এদেশের সবাই আগ্রহ দেখায় শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের একজন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী জো বাইডেন ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করেন। ট্রাম্প এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগ আনেন। শুধু তাই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কয়েক হাজার সমর্থক দেশটির কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলের ভেতরে ঢুকে তান্ডব চালায়, সহিংসতায় চারজন বেসামরিক ব্যক্তি ছাড়াও একজন পুলিশ অফিসার নিহত হয়েছিলেন। যখন ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ হয় তখন নির্বাচিত আইন প্রণেতারা সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয়কে অনুমোদন দেয়ার জন্য জড়ো হয়েছিলেন। ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনা তদন্তে গঠিত কংগ্রেসের কমিটিকে ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ বলে কটাক্ষ করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতলে ক্যাপিটল হিলে আক্রমণকারীদের প্রদত্ত শাস্তি তিনি মওকুফ করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।?
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অনেকে উদ্ভট চরিত্রের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তার বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি পেশীবলে সবকিছুর সমাধান করতে চেয়েছেন। বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্য তাকে পাগলাটে, দিকভ্রান্ত, বর্ণবাদী, আদর্শহীন একজন অযোগ্য রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছে মিডিয়া। ইসরাইলের প্রতি তার মাত্রাতিরিক্ত পক্ষপাতিত্বের কারণে পৃথিবীর মুসলিম সমাজ তার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। ক্ষুব্ধ ছিল বলেই প্রায় সব মুসলমান ট্রাম্পের পরাজয় কামনা করেছিল। অনেকের ধারণা ছিল, জো বাইডেন ফিলিস্তিনিদের প্রতি সদয় হবেন, কিন্তু তা হলো না। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। জো বাইডেনের আমলেই সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। জো বাইডেনের প্ররোচনায় সংঘটিত ইউক্রেন-রাশিয়ার প্রলম্বিত যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর আরোপিত একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হচ্ছে, কিংবা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ছে। এখন মনে হয়, জো বাইডেনের তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি পৃথিবীর কোথাও নতুন করে যুদ্ধ বাধাননি, বরং যুদ্ধের নিষ্পত্তি ঘটিয়েছেন। তিনি ইরাক এবং আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সৈন্য সরিয়ে নিয়েছেন, লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ইসরাইলের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোর সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমনকি নেটো থেকে আমেরিকাকে বের করে আনার কথাও তিনি কয়েকবার বলেছিলেন, ইউরোপে সৈন্যসংখ্যাও কমিয়েছিলেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে রাশিয়ার ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ বিশ্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। তেল-গ্যাস উৎপাদক দেশগুলো স্বস্তিতে থাকলেও জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। জ্বালানি তেলের দাম আর না বাড়ানোর অনুরোধ করতে জো বাইডেন সৌদি আরবে ছুটে এসেছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি, জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়ানোর ব্যাপারে সৌদি আরবসহ সব তেল উৎপাদক দেশ একমত হয়েছে এবং মূল্যবৃদ্ধি শীঘ্রই হবে। সৌদি আরব কেন জো বাইডেনের অনুরোধ রাখেনি সে ব্যাপারে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হচ্ছে। সৌদি আরব ট্রাম্পের আমলে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেছে, সাংবাদিক খাসোগীকে করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করার পরও সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের কোন অভিযোগ উঠেনি। সৌদি আরব তাই ট্রাম্পের প্রতি একটু বেশি নমনীয়, ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় আসুক তা সউদি আরব চায়।
তেলের দাম বৃদ্ধি করে জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা নষ্ট করার পরিকল্পনা হয়তো সৌদি আরবের ছিল। জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়লে বিশ্বের অর্থনীতি আরেকটি ঝাঁকুনির মধ্যে পড়বে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক বেড়ে গেছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে, ইংল্যান্ডে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর অদলবদল হয়েছে, ইউরোপ তীব্র শীত নিবারণে উত্তাপ সৃষ্টির উপকরণ তেল-গ্যাস প্রয়োজনানুযায়ী সংগ্রহ করতে পারছে না, আমেরিকা তাদের কোটি কোটি ব্যারেল মজুদ তেল সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েও বিশ্ব বাজারে সৃষ্ট জ্বালানি তেলের অস্থিরতা কমাতে পারছে না, জ্বালানি তেলের অভাবে চীন তাদের শিল্প উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। আমেরিকার মূল্যস্ফীতিও সর্বকালের সর্বোচ্চ।
স্মরণকালের সবচেয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আমেরিকায় সম্প্রতি সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদের মধ্যবর্তী নির্বাচন হলো। মার্কিন কংগ্রেস দুই কক্ষে বিভক্ত- একটি হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদ এবং অন্যটি সিনেট। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নির্বাচন মূলত দুই বছর অন্তর হয়ে থাকে। অন্যদিকে প্রতি ছয় বছরের জন্য একজন সিনেটর নির্বাচিত হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় প্রতি চার বছর অন্তর। যখন একজন প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালের ভেতর মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচন হয় তখন তাকে আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন বলা হয়ে থাকে। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের অর্ধেক মেয়াদে এসে এই নির্বাচন হয় বিধায় এই নির্বাচনকে প্রেসিডেন্টের পক্ষে-বিপক্ষে এক ধরনের গণভোট হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। মার্কিন রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই বছর পর মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনের চলমান বিভিন্ন নীতি-কৌশল, অর্থনৈতিক কর্মসূচি, বিদেশনীতি, বৈশ্বিক বাণিজ্য ইত্যাদির প্রতি ভোটারদের আস্থা ও অনাস্থার চিত্র দৃশ্যমান হয়।
সবার ধারণা ছিল, কংগ্রেস এবং সিনেটের এই নির্বাচনে জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক দলের ভরাডুবি হবে। অতীতে বেশিরভাগ মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদে কিছু সিট হারায়। ২০১০ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বারাক ওবামা উভয় কক্ষে হারান ৬৯টি আসন এবং ২০১৪ সালে হারান ২১টি আসন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিনেটে দুটি আসন পেলেও প্রতিনিধি পরিষদে ৪১টি আসন হারান। এই বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অনেক কম আসন হারিয়েছেন, ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের বড় ধরনের পরাজয় ঠেকানো গেছে। জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও সিনেটে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। আগের সিনেটের মতোই সমানসংখ্যক আসন হবে দুই দলের; এই অবস্থায় সিনেটের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্ধারণী ভোট দিতে পারবেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ডেমোক্র্যাটদের বড় পরাজয় ঠেকিয়ে দিল গর্ভপাতের ইস্যুটি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকানরা চায় গর্ভপাত বন্ধ হোক, কারণ ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। অন্যদিকে জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটরা মনে করে, শরীর যার সিদ্ধান্তও তার। একজন মহিলা গর্ভধারণ করবে কী করবে না তা একান্তই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপের সামিল। রিপাবলিকান প্রভাবিত আদালত গর্ভপাতবিরোধী রায় প্রদান করায় নারী ভোটার ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়েছে। মার্কিন জনগণ মনে হচ্ছে যুদ্ধ এবং বাইবেলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব মানুষ চায় এই মুহূর্তেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের অবসান হোক, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চাচ্ছেন যুদ্ধ প্রলম্বিত হোক যাতে তেল আর অস্ত্র বিক্রি করে তিনি আমেরিকার অর্থনীতিতে গতি আনতে পারেন। ইউক্রেনকে যোগান দেয়া অস্ত্র নিশ্চয়ই অনুদান নয়, ঋণ হিসেবেই গণ্য হবে।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
ধারণা ছিল, কংগ্রেস এবং সিনেটের এই নির্বাচনে জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক দলের ভরাডুবি হবে
শনিবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২২
সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসে প্রতিনিধিদের নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু এই নির্বাচনের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোন আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি; এদেশের সবাই আগ্রহ দেখায় শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের একজন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রার্থী জো বাইডেন ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করেন। ট্রাম্প এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগ আনেন। শুধু তাই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কয়েক হাজার সমর্থক দেশটির কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলের ভেতরে ঢুকে তান্ডব চালায়, সহিংসতায় চারজন বেসামরিক ব্যক্তি ছাড়াও একজন পুলিশ অফিসার নিহত হয়েছিলেন। যখন ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ হয় তখন নির্বাচিত আইন প্রণেতারা সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয়কে অনুমোদন দেয়ার জন্য জড়ো হয়েছিলেন। ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনা তদন্তে গঠিত কংগ্রেসের কমিটিকে ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ বলে কটাক্ষ করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতলে ক্যাপিটল হিলে আক্রমণকারীদের প্রদত্ত শাস্তি তিনি মওকুফ করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।?
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অনেকে উদ্ভট চরিত্রের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তার বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি পেশীবলে সবকিছুর সমাধান করতে চেয়েছেন। বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্য তাকে পাগলাটে, দিকভ্রান্ত, বর্ণবাদী, আদর্শহীন একজন অযোগ্য রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছে মিডিয়া। ইসরাইলের প্রতি তার মাত্রাতিরিক্ত পক্ষপাতিত্বের কারণে পৃথিবীর মুসলিম সমাজ তার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। ক্ষুব্ধ ছিল বলেই প্রায় সব মুসলমান ট্রাম্পের পরাজয় কামনা করেছিল। অনেকের ধারণা ছিল, জো বাইডেন ফিলিস্তিনিদের প্রতি সদয় হবেন, কিন্তু তা হলো না। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। জো বাইডেনের আমলেই সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। জো বাইডেনের প্ররোচনায় সংঘটিত ইউক্রেন-রাশিয়ার প্রলম্বিত যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর আরোপিত একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হচ্ছে, কিংবা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ছে। এখন মনে হয়, জো বাইডেনের তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি পৃথিবীর কোথাও নতুন করে যুদ্ধ বাধাননি, বরং যুদ্ধের নিষ্পত্তি ঘটিয়েছেন। তিনি ইরাক এবং আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সৈন্য সরিয়ে নিয়েছেন, লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ইসরাইলের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোর সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমনকি নেটো থেকে আমেরিকাকে বের করে আনার কথাও তিনি কয়েকবার বলেছিলেন, ইউরোপে সৈন্যসংখ্যাও কমিয়েছিলেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে রাশিয়ার ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ বিশ্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। তেল-গ্যাস উৎপাদক দেশগুলো স্বস্তিতে থাকলেও জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। জ্বালানি তেলের দাম আর না বাড়ানোর অনুরোধ করতে জো বাইডেন সৌদি আরবে ছুটে এসেছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি, জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়ানোর ব্যাপারে সৌদি আরবসহ সব তেল উৎপাদক দেশ একমত হয়েছে এবং মূল্যবৃদ্ধি শীঘ্রই হবে। সৌদি আরব কেন জো বাইডেনের অনুরোধ রাখেনি সে ব্যাপারে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হচ্ছে। সৌদি আরব ট্রাম্পের আমলে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেছে, সাংবাদিক খাসোগীকে করাত দিয়ে টুকরো টুকরো করার পরও সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের কোন অভিযোগ উঠেনি। সৌদি আরব তাই ট্রাম্পের প্রতি একটু বেশি নমনীয়, ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় আসুক তা সউদি আরব চায়।
তেলের দাম বৃদ্ধি করে জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা নষ্ট করার পরিকল্পনা হয়তো সৌদি আরবের ছিল। জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়লে বিশ্বের অর্থনীতি আরেকটি ঝাঁকুনির মধ্যে পড়বে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক বেড়ে গেছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে, ইংল্যান্ডে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর অদলবদল হয়েছে, ইউরোপ তীব্র শীত নিবারণে উত্তাপ সৃষ্টির উপকরণ তেল-গ্যাস প্রয়োজনানুযায়ী সংগ্রহ করতে পারছে না, আমেরিকা তাদের কোটি কোটি ব্যারেল মজুদ তেল সরবরাহ করার ঘোষণা দিয়েও বিশ্ব বাজারে সৃষ্ট জ্বালানি তেলের অস্থিরতা কমাতে পারছে না, জ্বালানি তেলের অভাবে চীন তাদের শিল্প উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে, আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। আমেরিকার মূল্যস্ফীতিও সর্বকালের সর্বোচ্চ।
স্মরণকালের সবচেয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আমেরিকায় সম্প্রতি সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদের মধ্যবর্তী নির্বাচন হলো। মার্কিন কংগ্রেস দুই কক্ষে বিভক্ত- একটি হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদ এবং অন্যটি সিনেট। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নির্বাচন মূলত দুই বছর অন্তর হয়ে থাকে। অন্যদিকে প্রতি ছয় বছরের জন্য একজন সিনেটর নির্বাচিত হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় প্রতি চার বছর অন্তর। যখন একজন প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালের ভেতর মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচন হয় তখন তাকে আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন বলা হয়ে থাকে। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের অর্ধেক মেয়াদে এসে এই নির্বাচন হয় বিধায় এই নির্বাচনকে প্রেসিডেন্টের পক্ষে-বিপক্ষে এক ধরনের গণভোট হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। মার্কিন রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই বছর পর মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনের চলমান বিভিন্ন নীতি-কৌশল, অর্থনৈতিক কর্মসূচি, বিদেশনীতি, বৈশ্বিক বাণিজ্য ইত্যাদির প্রতি ভোটারদের আস্থা ও অনাস্থার চিত্র দৃশ্যমান হয়।
সবার ধারণা ছিল, কংগ্রেস এবং সিনেটের এই নির্বাচনে জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক দলের ভরাডুবি হবে। অতীতে বেশিরভাগ মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদে কিছু সিট হারায়। ২০১০ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বারাক ওবামা উভয় কক্ষে হারান ৬৯টি আসন এবং ২০১৪ সালে হারান ২১টি আসন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিনেটে দুটি আসন পেলেও প্রতিনিধি পরিষদে ৪১টি আসন হারান। এই বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অনেক কম আসন হারিয়েছেন, ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটদের বড় ধরনের পরাজয় ঠেকানো গেছে। জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও সিনেটে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। আগের সিনেটের মতোই সমানসংখ্যক আসন হবে দুই দলের; এই অবস্থায় সিনেটের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্ধারণী ভোট দিতে পারবেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ডেমোক্র্যাটদের বড় পরাজয় ঠেকিয়ে দিল গর্ভপাতের ইস্যুটি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকানরা চায় গর্ভপাত বন্ধ হোক, কারণ ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। অন্যদিকে জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটরা মনে করে, শরীর যার সিদ্ধান্তও তার। একজন মহিলা গর্ভধারণ করবে কী করবে না তা একান্তই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপের সামিল। রিপাবলিকান প্রভাবিত আদালত গর্ভপাতবিরোধী রায় প্রদান করায় নারী ভোটার ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়েছে। মার্কিন জনগণ মনে হচ্ছে যুদ্ধ এবং বাইবেলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব মানুষ চায় এই মুহূর্তেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের অবসান হোক, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চাচ্ছেন যুদ্ধ প্রলম্বিত হোক যাতে তেল আর অস্ত্র বিক্রি করে তিনি আমেরিকার অর্থনীতিতে গতি আনতে পারেন। ইউক্রেনকে যোগান দেয়া অস্ত্র নিশ্চয়ই অনুদান নয়, ঋণ হিসেবেই গণ্য হবে।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন]