alt

উপ-সম্পাদকীয়

সুস্থ জীবনের জন্য বিবাহপূর্ব সচেতনতা

নাজমুল হুদা খান

: শনিবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২২

এ বিশ্বে মানুষের জীবনে বিয়ে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মানব জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও মানব সভ্যতার বিকাশ টিকিয়ে রাখতে বিয়ে মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। মানব সভ্যতা সচল রাখতে প্রধান ভূমিকা রাখে সমাজ ও রাষ্ট্র। এ সমাজের মূল একক হচ্ছে পরিবার; আর পরিবারের মূল গাঁথুনিটি শুরু হয় বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ে সমাজের সবাই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে; সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত এ অধ্যায়ের মাধ্যমেই আগমন ঘটে পরবর্তী বংশধর সন্তান-সন্ততি। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, অন্ন, বস্ত্র প্রভৃতি মৌলিক চাহিদাসহ বেড়ে উঠা ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সবাই স্তরের উপাদান সমূহ গড়ে উঠে। এগিয়ে যায় পৃথিবী, সমাজ ও রাষ্ট্রের সভ্যতার ক্রমবিকাশ। বিয়ে এমন একটি সামাজিক বন্ধন বা চুক্তি যার মাধ্যমে দুজন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এটি একটি বৈশ্বিক সর্বজনীন সংস্কৃতিযা সাধারনত রাষ্ট্র, সংস্থা, ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীবা সম্প্রদায় কর্তৃক স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়ে থাকে।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা-জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ঘোষণাপত্র-১৬ তে বিয়েকে একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়া, অঙ্গীকার, ভালোবাসা, সম্মান, সুস্বাস্থ্য এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা হিসেবে বর্ননা করেছে। তাই সুস্থ দাম্পত্য জীবন, সুস্থ সন্তান-সন্ততি , সুস্থ্য সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে বর্তমান বিশ্বে বিবাহ পূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে দম্পতি নির্বাচনে এগিয়ে আসছে সচেতন মানুষ। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জন্মগত রোগ, রক্ত সংশ্লিষ্ট অসুস্থতা যথা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিনোপ্যাথিস, বংশগত ব্যাধি ও অসংক্রামক রোগ, যৌন রোগ ইত্যাদির সফল প্রতিরোধে এবং সুস্থ্য বংশধর বিনির্মাণে বিবাহ পূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রচলন রয়েছে। জন্মগত এবং বংশগত রোগ প্রতিরোধ, বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া এবং যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যথাÑইটালি, বাহরাইন, ইরান, জর্ডান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া, মিসর, স্পেন, পর্তুগাল, তুরস্ক, সাইপ্রাস, যুক্তরাষ্ট্রের কতক প্রদেশএবং মালয়েশিয়ায় বিবাহের পূর্বে সংশ্লিষ্ট রোগের স্ক্রিনিং আবশ্যক করার আইন রয়েছে। থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, গ্রীস, কানাডাসহ অন্যান্য দেশে বিবাহ পূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রচলন রয়েছে। সাইপ্রাস সর্বপ্রথম ১৯৭৩ সালে বিবাহপূর্ব থ্যালাসেমিয়া রোগ স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করে।

জন্মসূত্রে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়েও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বংশগত বা জন্মগত রোগসম্পন্ন সন্তান-সন্ততি জন্মে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। এসব দম্পতির সন্তানগন ৩ গুন বেশী জন্মগত স্বাস্থ্য ত্রুটি নিয়ে জন্মানোর গবেষনা তথ্য রয়েছে। শরীরের বিভিন্ন ত্রুটি যথা মিউকোপলিস্যাকারাইডস, ফিনাইল কিটোনিউরিয়া, মানসিক বৈকল্য, হাঁপানি, ডায়াবেটিস, মৃগী রোগ, বোবা কিংবা হাবাগোবা হিসেবে জন্মানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের সংখ্যা উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণ বেশি। এ সংখ্যা সৌদি আরবে ৪২-৬৭ শতাংশ, কাতারে ৫৪ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪০-৫৪ শতাংশ, জর্ডানে ২৯-৬৪ শতাংশ, মিসরে ২১-৩৩ শতাংশ, সুদানে ৪৪-৬৩ শতাংশ এবং ইয়েমেনে ৪০-৪৫ শতাংশ। বৈশ্বিক জন্মগত ত্রুটি নিয়ে এক গবেষণায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, জন্মগত ত্রুটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিশু জন্মেছে সুদানে, সৌদি আরব (২য়), ফিলিস্তিন (৫ম), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৬ষ্ঠ), ইরাক (অষ্টম), কুয়েত (নবম), ওমান (১১তম), সিরিয়া (১২তম), কাতার (১৬তম) বাহরাইন (১৭তম), জর্ডান (১৮তম), লিবিয়া (১৯তম), তিউনিসিয়া (২০তম), মরক্কো (২১তম) এবং ইয়েমেন (২২তম)। বিশ্বের ১৯৩ টি দেশেএ সমীক্ষা চালানো হয়।

একটু সচেতন হলেই নিজেরা সুস্থ থাকা যায়, অনাগত বংশধরদেরও সুস্থ জীবন উপহার দেয়া যায়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অসুস্থ ওকর্মক্ষমহীন জনসংখ্যার ভার হ্রাস পায়, স্বাস্থ্য সেবার খরচ ও স্বাস্থ্যখাতে চাপ কমে। কারণ জন্মগত বা বংশগত রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল। এসব রোগে শিশু মৃত্যুহার ও পরবর্তীকালে জীবনহানির ঝুঁকি বহুলাংশে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে বিটা থ্যালাসিমিয়া রোগীর চিকিৎসায় আক্রান্তের জীবদ্দশায় খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার ডলার, সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগের চিকিৎসায় খরচ ১০ হাজার ডলার। সাধারণত বংশগত রোগের চিকিৎসায় আরব বিশ্বে বছরে খরচ হয় প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। বেঁচে থাকলেও এসব রোগাক্রান্তদের গড় আয়ুষ্কাল ৪০ বছর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ICESR) এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সংস্থা (OHCHR) প্রজনন স্বাস্থ্য, যৌনবাহিত রোগ বিশেষ করে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ ও সামাজিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সুখকর ও সুস্থ জীবন, অনাগত রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ, যথাসময়ে ব্যবস্থাপনায়প্রাক বিবাহকালীন বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা সুরক্ষা ঢাল হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এ বিষয়েবিভিন্ন দেশে নিম্নোক্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলো প্রচলিত রয়েছে।

রক্তের গ্রুপ : দম্পতিগণের রক্তের গ্রুপ জানা একান্ত জরুরি। নেগেটিভ, পজেটিভ রক্তের গ্রুপের দম্পতির সন্তান ধারণে বিপত্তি দেখা দিতে পারে। রক্তের জটিলতার কারণে গর্ভে সন্তানের মৃত্যু, জন্মগত জন্ডিসে ভোগা এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়াসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সিবাই সেল ((Sickle cell trait) : এটি রক্তের লোহিত রক্ত কনিকার আকৃতিগত সমস্যা যা অনেক সময় রক্ত চলাচলের শিরা-উপশিরা বন্ধ করে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতিসাধন, স্ট্রোকসহ নানাবিধ জটিল রোগ দেখা দিতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া : রক্তের থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করা জরুরি। থ্যালাসেমিয়া রক্তের একধরনের অসুখ যা বংশগতভাবে পিতা-মাতার কাছ থেকে শিশুদের দেহে সঞ্চালিত হয়ে থাকে। প্রসূতিকালীন মায়েরা নানা ধরনের জটিলতায় ভুগে থাকেন; নবজাতক সুস্থ জন্মালেও দ্রুতই রক্তশূন্যতা, জন্ডিস, দুর্বলতা, অমনযোগীতা, প্লীহার আকৃতি বড় হয়ে যাওয়া, খাবারে অরুচিসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।

হেপাটাইটিস বি ও সি : প্রাক বিবাহ রক্তের হেপাটাইটিস বি ও সি পরীক্ষা বাঞ্ছনীয়। এ দুটি ভাইরাসই দীর্ঘমেয়াদি লিভারের রোগ সৃষ্টি করে। লিভার সিরোসিস, ফ্যাটি লিভার এবং লিভারের ক্যান্সারের জন্যও অনেকাংশে দায়ী এ ভাইরাস। রক্তের স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে এ রোগের প্রতিরোধ, প্রতিষেধক ও নিরাময় ব্যবস্থাপনা সম্ভব।

এইচআইভি/এইডস : যদিও আমাদের দেশে এ রোগে আক্রান্তের হার নগণ্য; তবে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এ মরণঘাতী রোগ নির্ণয়ে রক্তের স্ক্রিনিংয়ে এইচআইভি/এইডস টেস্ট সহায়ক।

এছাড়া বয়স, ওজন, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড হরমোন, প্রজনন স্বাস্থ্য, পুরুষদের শুক্রাণু পরীক্ষা ইত্যাদিও দম্পতি ও সন্তানদের স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

অপরিকল্পিত দাম্পত্য জীবন যেমন সুখের হয় না; তেমনি পরিবার পরিকল্পনা, সন্তান ধারণ, প্রসূতিকালীন বিভিন্ন ধরনের অসুখ বিসুখের সৃষ্টি হয়। প্রসূতিকালীন রক্তশূন্যতা, প্রসূতিজনিত ডায়াবেটিস, থাইরয়েড হরমোন জটিলতা, একলাম্পশিয়া প্রভৃতি রোগে ভুগতে হয় মাকে। এছাড়া গর্ভপাত, মিস কারেজ, প্রিটার্ম ডেলিভারির মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সংঘটিত হয়। নবজাতকের বৃদ্ধি হ্রাস, বেটে, কথা বলতে দেরি হওয়া, কথা বলতে ও শুনতে না পারা ইত্যাদি জটিলতা প্রায়ই দেখা যায়।

প্রাক বিবাহ হেলথ স্ক্রিনিং বিশ্বব্যাপী একটি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রম। দেশে দেশে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। ধর্মীয় কুসংস্কার, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, শিক্ষা ও সচেতনতা অনেক ক্ষেত্রে এ বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতায় ব্যত্যয় ঘটে। তবে বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ক গবেষণায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রায় ৭০%-৯০% প্রাক বিবাহ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রক্ত সম্পর্কের নিকটাত্মীয়দের মধ্যকার বিয়ে না করার বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা ও পোষণ করেছেন।

প্রাকবিবাহকালীন কয়েকটি রক্ত পরীক্ষাও সাধারণ কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের যাত্রা শুরু করা সম্ভব। একটু সচেতন হলেই নিজেদের এবং অনাগত সন্তানদের মধ্যে বিভিন্ন জটিল রোগ প্রতিরোধ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সহজতর হয়। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর প্রাক বৈবাহিক কাউন্সেলিং বিষয়ক গাইডবুকে বিস্তারিত তথ্য ও নির্দেশনা প্রকাশ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কিছু কিছু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক এবং অনেক দেশে এসব স্বাস্থ্য কার্যক্রম প্রচলন রয়েছে। আমাদের একটু সচেতনতাই পারে সুস্থ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এবং সর্বোপরি একটি সুস্থ পৃথিবী বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে। আমরা সচেতন হই, সুস্থ জীবন গড়ে তুলি।

[লেখক : প্রাক্তন সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সুস্থ জীবনের জন্য বিবাহপূর্ব সচেতনতা

নাজমুল হুদা খান

শনিবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২২

এ বিশ্বে মানুষের জীবনে বিয়ে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মানব জীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও মানব সভ্যতার বিকাশ টিকিয়ে রাখতে বিয়ে মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। মানব সভ্যতা সচল রাখতে প্রধান ভূমিকা রাখে সমাজ ও রাষ্ট্র। এ সমাজের মূল একক হচ্ছে পরিবার; আর পরিবারের মূল গাঁথুনিটি শুরু হয় বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ে সমাজের সবাই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে; সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত এ অধ্যায়ের মাধ্যমেই আগমন ঘটে পরবর্তী বংশধর সন্তান-সন্ততি। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, অন্ন, বস্ত্র প্রভৃতি মৌলিক চাহিদাসহ বেড়ে উঠা ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সবাই স্তরের উপাদান সমূহ গড়ে উঠে। এগিয়ে যায় পৃথিবী, সমাজ ও রাষ্ট্রের সভ্যতার ক্রমবিকাশ। বিয়ে এমন একটি সামাজিক বন্ধন বা চুক্তি যার মাধ্যমে দুজন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এটি একটি বৈশ্বিক সর্বজনীন সংস্কৃতিযা সাধারনত রাষ্ট্র, সংস্থা, ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীবা সম্প্রদায় কর্তৃক স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়ে থাকে।

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা-জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ঘোষণাপত্র-১৬ তে বিয়েকে একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়া, অঙ্গীকার, ভালোবাসা, সম্মান, সুস্বাস্থ্য এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা হিসেবে বর্ননা করেছে। তাই সুস্থ দাম্পত্য জীবন, সুস্থ সন্তান-সন্ততি , সুস্থ্য সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে বর্তমান বিশ্বে বিবাহ পূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে দম্পতি নির্বাচনে এগিয়ে আসছে সচেতন মানুষ। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জন্মগত রোগ, রক্ত সংশ্লিষ্ট অসুস্থতা যথা থ্যালাসেমিয়া, হিমোগ্লোবিনোপ্যাথিস, বংশগত ব্যাধি ও অসংক্রামক রোগ, যৌন রোগ ইত্যাদির সফল প্রতিরোধে এবং সুস্থ্য বংশধর বিনির্মাণে বিবাহ পূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রচলন রয়েছে। জন্মগত এবং বংশগত রোগ প্রতিরোধ, বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া এবং যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যথাÑইটালি, বাহরাইন, ইরান, জর্ডান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া, মিসর, স্পেন, পর্তুগাল, তুরস্ক, সাইপ্রাস, যুক্তরাষ্ট্রের কতক প্রদেশএবং মালয়েশিয়ায় বিবাহের পূর্বে সংশ্লিষ্ট রোগের স্ক্রিনিং আবশ্যক করার আইন রয়েছে। থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, গ্রীস, কানাডাসহ অন্যান্য দেশে বিবাহ পূর্ব স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রচলন রয়েছে। সাইপ্রাস সর্বপ্রথম ১৯৭৩ সালে বিবাহপূর্ব থ্যালাসেমিয়া রোগ স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করে।

জন্মসূত্রে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়েও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বংশগত বা জন্মগত রোগসম্পন্ন সন্তান-সন্ততি জন্মে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। এসব দম্পতির সন্তানগন ৩ গুন বেশী জন্মগত স্বাস্থ্য ত্রুটি নিয়ে জন্মানোর গবেষনা তথ্য রয়েছে। শরীরের বিভিন্ন ত্রুটি যথা মিউকোপলিস্যাকারাইডস, ফিনাইল কিটোনিউরিয়া, মানসিক বৈকল্য, হাঁপানি, ডায়াবেটিস, মৃগী রোগ, বোবা কিংবা হাবাগোবা হিসেবে জন্মানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের সংখ্যা উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণ বেশি। এ সংখ্যা সৌদি আরবে ৪২-৬৭ শতাংশ, কাতারে ৫৪ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪০-৫৪ শতাংশ, জর্ডানে ২৯-৬৪ শতাংশ, মিসরে ২১-৩৩ শতাংশ, সুদানে ৪৪-৬৩ শতাংশ এবং ইয়েমেনে ৪০-৪৫ শতাংশ। বৈশ্বিক জন্মগত ত্রুটি নিয়ে এক গবেষণায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, জন্মগত ত্রুটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিশু জন্মেছে সুদানে, সৌদি আরব (২য়), ফিলিস্তিন (৫ম), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৬ষ্ঠ), ইরাক (অষ্টম), কুয়েত (নবম), ওমান (১১তম), সিরিয়া (১২তম), কাতার (১৬তম) বাহরাইন (১৭তম), জর্ডান (১৮তম), লিবিয়া (১৯তম), তিউনিসিয়া (২০তম), মরক্কো (২১তম) এবং ইয়েমেন (২২তম)। বিশ্বের ১৯৩ টি দেশেএ সমীক্ষা চালানো হয়।

একটু সচেতন হলেই নিজেরা সুস্থ থাকা যায়, অনাগত বংশধরদেরও সুস্থ জীবন উপহার দেয়া যায়। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অসুস্থ ওকর্মক্ষমহীন জনসংখ্যার ভার হ্রাস পায়, স্বাস্থ্য সেবার খরচ ও স্বাস্থ্যখাতে চাপ কমে। কারণ জন্মগত বা বংশগত রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল। এসব রোগে শিশু মৃত্যুহার ও পরবর্তীকালে জীবনহানির ঝুঁকি বহুলাংশে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে বিটা থ্যালাসিমিয়া রোগীর চিকিৎসায় আক্রান্তের জীবদ্দশায় খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার ডলার, সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগের চিকিৎসায় খরচ ১০ হাজার ডলার। সাধারণত বংশগত রোগের চিকিৎসায় আরব বিশ্বে বছরে খরচ হয় প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। বেঁচে থাকলেও এসব রোগাক্রান্তদের গড় আয়ুষ্কাল ৪০ বছর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ICESR) এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সংস্থা (OHCHR) প্রজনন স্বাস্থ্য, যৌনবাহিত রোগ বিশেষ করে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ ও সামাজিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সুখকর ও সুস্থ জীবন, অনাগত রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ, যথাসময়ে ব্যবস্থাপনায়প্রাক বিবাহকালীন বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা সুরক্ষা ঢাল হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এ বিষয়েবিভিন্ন দেশে নিম্নোক্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষাগুলো প্রচলিত রয়েছে।

রক্তের গ্রুপ : দম্পতিগণের রক্তের গ্রুপ জানা একান্ত জরুরি। নেগেটিভ, পজেটিভ রক্তের গ্রুপের দম্পতির সন্তান ধারণে বিপত্তি দেখা দিতে পারে। রক্তের জটিলতার কারণে গর্ভে সন্তানের মৃত্যু, জন্মগত জন্ডিসে ভোগা এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়াসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সিবাই সেল ((Sickle cell trait) : এটি রক্তের লোহিত রক্ত কনিকার আকৃতিগত সমস্যা যা অনেক সময় রক্ত চলাচলের শিরা-উপশিরা বন্ধ করে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতিসাধন, স্ট্রোকসহ নানাবিধ জটিল রোগ দেখা দিতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া : রক্তের থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করা জরুরি। থ্যালাসেমিয়া রক্তের একধরনের অসুখ যা বংশগতভাবে পিতা-মাতার কাছ থেকে শিশুদের দেহে সঞ্চালিত হয়ে থাকে। প্রসূতিকালীন মায়েরা নানা ধরনের জটিলতায় ভুগে থাকেন; নবজাতক সুস্থ জন্মালেও দ্রুতই রক্তশূন্যতা, জন্ডিস, দুর্বলতা, অমনযোগীতা, প্লীহার আকৃতি বড় হয়ে যাওয়া, খাবারে অরুচিসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।

হেপাটাইটিস বি ও সি : প্রাক বিবাহ রক্তের হেপাটাইটিস বি ও সি পরীক্ষা বাঞ্ছনীয়। এ দুটি ভাইরাসই দীর্ঘমেয়াদি লিভারের রোগ সৃষ্টি করে। লিভার সিরোসিস, ফ্যাটি লিভার এবং লিভারের ক্যান্সারের জন্যও অনেকাংশে দায়ী এ ভাইরাস। রক্তের স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে এ রোগের প্রতিরোধ, প্রতিষেধক ও নিরাময় ব্যবস্থাপনা সম্ভব।

এইচআইভি/এইডস : যদিও আমাদের দেশে এ রোগে আক্রান্তের হার নগণ্য; তবে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এ মরণঘাতী রোগ নির্ণয়ে রক্তের স্ক্রিনিংয়ে এইচআইভি/এইডস টেস্ট সহায়ক।

এছাড়া বয়স, ওজন, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড হরমোন, প্রজনন স্বাস্থ্য, পুরুষদের শুক্রাণু পরীক্ষা ইত্যাদিও দম্পতি ও সন্তানদের স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

অপরিকল্পিত দাম্পত্য জীবন যেমন সুখের হয় না; তেমনি পরিবার পরিকল্পনা, সন্তান ধারণ, প্রসূতিকালীন বিভিন্ন ধরনের অসুখ বিসুখের সৃষ্টি হয়। প্রসূতিকালীন রক্তশূন্যতা, প্রসূতিজনিত ডায়াবেটিস, থাইরয়েড হরমোন জটিলতা, একলাম্পশিয়া প্রভৃতি রোগে ভুগতে হয় মাকে। এছাড়া গর্ভপাত, মিস কারেজ, প্রিটার্ম ডেলিভারির মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সংঘটিত হয়। নবজাতকের বৃদ্ধি হ্রাস, বেটে, কথা বলতে দেরি হওয়া, কথা বলতে ও শুনতে না পারা ইত্যাদি জটিলতা প্রায়ই দেখা যায়।

প্রাক বিবাহ হেলথ স্ক্রিনিং বিশ্বব্যাপী একটি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রম। দেশে দেশে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। ধর্মীয় কুসংস্কার, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, শিক্ষা ও সচেতনতা অনেক ক্ষেত্রে এ বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতায় ব্যত্যয় ঘটে। তবে বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ক গবেষণায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রায় ৭০%-৯০% প্রাক বিবাহ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রক্ত সম্পর্কের নিকটাত্মীয়দের মধ্যকার বিয়ে না করার বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা ও পোষণ করেছেন।

প্রাকবিবাহকালীন কয়েকটি রক্ত পরীক্ষাও সাধারণ কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবনের যাত্রা শুরু করা সম্ভব। একটু সচেতন হলেই নিজেদের এবং অনাগত সন্তানদের মধ্যে বিভিন্ন জটিল রোগ প্রতিরোধ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সহজতর হয়। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর প্রাক বৈবাহিক কাউন্সেলিং বিষয়ক গাইডবুকে বিস্তারিত তথ্য ও নির্দেশনা প্রকাশ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কিছু কিছু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক এবং অনেক দেশে এসব স্বাস্থ্য কার্যক্রম প্রচলন রয়েছে। আমাদের একটু সচেতনতাই পারে সুস্থ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এবং সর্বোপরি একটি সুস্থ পৃথিবী বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে। আমরা সচেতন হই, সুস্থ জীবন গড়ে তুলি।

[লেখক : প্রাক্তন সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল]

back to top