alt

opinion » post-editorial

মানসম্মত আধুনিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: সোমবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২২

জাতীয় মৌলিক যেসব বিষয়ে কোন পরিবর্তন হয়নি, তার মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা অন্যতম। জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টির ব্যাপারে রাষ্ট্রযন্ত্র যারা পরিচালনা করেন, যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার কলকাঠি নাড়েন, তাদের কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। অথচ কে না জানে যে, মানুষ গড়ার হাতিয়ার হলো শিক্ষাব্যবস্থা। অতি পুরাতন একটি বাক্য আমাদের মহারথীরা প্রায়ই বলেন, শিক্ষা জাতির মেরুদ-। সত্যিকারার্থে শিক্ষা শুধু মানুষ গড়ার হাতিয়ার নয়, জাতি গঠন বা নির্মাণের অপরিহার্য হাতিয়ারও বটে। একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া একটি জাতি নির্মাণ কখনো সম্ভব নয়। শিক্ষাসংকট দূর করার উদ্দেশ্যে শিক্ষাব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য দুয়েকবার চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। তবে কখনো আন্তরিকতার অভাবে বা কোথাও বা গোলামি যুগের মানসিকতার কারণে সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। শুধু যে সফল হয়নি তাই নয় বরং অবস্থা আগের চাইতে আরও জটিল এবং বিপজ্জনক করা হয়েছে।

আধুনিক শিক্ষা তাও আবার নানা ধারায় বিভক্ত, মাদ্রাসা শিক্ষা যা দুই ধারায় বিভক্ত। এমনি ধরনের নানামুখী প্রবণতার শিক্ষিত লোকরা নানা চিন্তা, নানা ধারায় বিভক্ত। মাদ্রাসা শিক্ষিত লোকরা তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিতদের প্রতি একটি মারাত্মক ধরনের বিরূপ ধারণা নিয়ে আছে। আবার স্কুল-কলেজের শিক্ষিতরা মাদ্রাসা শিক্ষিত লোকদের এক ধরনের অনুৎপাদনশীল এবং পেছনে পড়া জনশক্তি বা সমাজের জন্য বোঝা মনে করে। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে যারা ইংরেজি মাধ্যমে বা বিদেশে পড়াশোনা করে একটু ঠোঁট বাঁকা করে বিদেশি ভাষা বলতে পারে, তারা বুনিয়াদি শ্রেণী বলে নিজেদের ধরে নিয়েছে। এদেশের কিছুই তাদের ভালো লাগে না। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থতা, দেশে সন্ত্রাস, শিক্ষার নি¤œমান, খারাপ পরিবেশ ইত্যাদি অজুহাতে লাখ লাখ ছাত্র ভারতসহ বিদেশে লেখাপড়া করে। এতে দেশের অর্থ যেমন বিদেশে যাচ্ছে তেমনি একটু মেধাবী ধরনের যারা তারা আর দেশে ফিরছে না। যারা দেশে পড়াশোনায় একটু ভালো তারাও বিদেশে কোন সুযোগ পেলে বিদেশ পাড়ি জমাতে মোটেই দ্বিধা করে না। আমাদের অবশ্য জাতির জন্য প্রয়োজনীয় একটি শিক্ষাব্যবস্থা পেতে হবে। দ্বিধা-সংকোচ ও দীর্ঘসূত্রতা আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। আর ক্ষতি স্বীকার নয়, সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য একটি সাহসী পদক্ষেপ চাই।

শিক্ষা ও দারিদ্র্যের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিরাজমান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দরিদ্র জনগোষ্ঠী কি অশিক্ষিতই থাকবে? দারিদ্র্য দূর করার জন্য চাই শিক্ষা। এই প্রবন্ধে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে আর্থিক ও মানসিক দারিদ্র্য দূর করার জন্য আনুষ্ঠানিক বা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রকৃত ফলপ্রসূ সম্মিলন প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষাপরবর্তী স্তরে মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার প্রচলন ও সমন্বয় সম্ভব হলে দেশকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা সম্ভব। বিশ্বায়ন এই ক্ষেত্রে বিশাল সুবিধা হিসেবে কাজ করার কথা থাকলেও, নানা কাঠামোগত বাধার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষার্থীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে চাকরি খুঁজছেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই চাকরি দরকার। অধিকাংশই চাকরি পাচ্ছেন না। এজন্য অন্যতম দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। তাই বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিযোগিতায় আমরা হেরে যাচ্ছি। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষিত বেকার তৈরি করছে। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ কর্মবাজারে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই বেকার থাকছেন। তারপরও কোনভাবেই থামছে না উচ্চশিক্ষার ঢল। প্রতিটি শিক্ষার্থীর পেছনে বিপুল রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক অর্থ ব্যয় হয়। অনেক অর্থ ও সময় ব্যয় করে একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করছেন। এত কিছু করে চাকরির বাজারে তিনি কতটুকু যোগ্য হচ্ছেন? আজকের দিনে সেটি একটি অনেক বড় প্রশ্ন। এসব বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের এখনই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ আর ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হতে হলে চাকরির চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা কারিকুলাম করতেই হবে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা স্ট্রাকচার্ডভিত্তিক। এটা মূলত লিনিয়ার এবং মনো ডিসিপ্লিনারি। এটাকেই আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ইনন্ট্রাকটিজমের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ডাইডেকটিক পেডাগোজিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়া হয়। যাতে কোলাবোরেশন, পার্সোনালাইজ লার্নিং, ডিফারেনশিয়েটেড লার্নিং ও এক্সপেরেনশিয়াল লার্নিংয়ের সুযোগ নাই। এই পদ্ধতি দিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করা কঠিন হবে। ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থায় অবশ্যই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরিবর্তনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মানুষ, প্রযুক্তি এবং প্রকৃতিÑ এ তিনটি বিষয়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি নতুন সমাজ তৈরি করবে। এ সমাজটা কেমন হবে তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে সাজাতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ভবিষ্যৎ সমাজ, ভবিষ্যৎ কাজ এবং ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এ তিনটি বিষয়ের পরিবর্তনকে ধারণ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিনির্মাণ করতে হবে। এর ফলে সমাজের তিনটি বড় জায়গায় পরিবর্তন ঘটাবে। একটি হচ্ছে ইন্টেলেকচুয়ালাইজেশন ভার্চুয়ালাইজেশন (রিয়েলিটি এবং ভার্চুয়ালিটির মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি হবে) এবং একটি হাইপার কানেকটেড সমাজ তৈরি হবে। এটাকে আমরা বলি সোসাইটি ০৫। আমরা এখন সোসাইটি ০৪-এ আছি। এটা হচ্ছে ইনফরমেশন সোসাইটি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে ধারণ করার জন্য সোসাইটি ০৫-এর প্রয়োজন হবে। যাকে আমরা বলি সুপার স্মার্ট সোসাইটি। প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের একটি সভায় বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ যেহেতু আমরা অর্জন করতে পেরেছি এখন আমরা একটা স্মার্ট দেশ তৈরি করতে চাই। এখানে আনন্দের বিষয় হচ্ছে সোসাইটি ০৫ ইতোমধ্যে আমরা ধারণ করে ফেলেছি। কিন্তু এই সোসাইটি ০৫-কে ধারণ করার জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা সেই শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে যদি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটি জায়গায় নিয়ে আসতে না পারি তাহলে অন্য বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে যাবে সেই জায়গাটিতে অংশগ্রহণ করা আমাদের জন্য একটু কঠিন হয়ে যাবে।

কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও শিক্ষার সার্বজনীনতা আসছে না। শিক্ষার দৈন্য কাটছে না। শিক্ষায় আসছে না পরিবর্তনের হাওয়া। কাজেই যুগোপযোগী ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং একটি গণমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষানীতিকে প্রাধান্য দিতে হবেÑ যার বাস্তবায়ন না হলে বাঙালির কোনকালেই অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে না। একটি সুষ্ঠু শিক্ষানীতি ও তার সফল বাস্তবায়নে বাঙালি কর্মদক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হবে এবং যথার্থ মানবসম্পদের উন্নয়নও ঘটবে। শিক্ষা ও মানবসম্পদের উন্নয়ন ব্যতিরেকে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। উন্নয়ন শুধু কাগজের ফিরিস্তি হয়েই ভেসে বেড়াবে। কাজেই প্রকৃত উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে মানবসম্পদ উন্নয়নবান্ধব পরিবেশ ও যথাযথ বিনিয়োগ এবং নীতিমালা সংযোজনের বিকল্প অন্য কিছুতে কোন সমাধান আসবে বলে আমরা মনে করতে পারি না। আসুন, একটি সুন্দর শিক্ষা নীতিমালা প্রস্তুত করে এবং দক্ষ মানবসম্পদের বিকাশ ঘটিয়ে আমাদের জাতীয় মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করি।

আমাদের শিক্ষা কতটা জীবন ও কর্মমুখী? জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া আধুনিকতায় উত্তরণ সম্ভব হবে না

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা আধুনিক ও জীবনমুখী? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা সর্বজনীন? শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বজনীনতা ছাড়া আধুনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যমুক্ত জাতি গঠন সম্ভব হবে না। আমাদের শিক্ষা কতটা জীবন ও কর্মমুখী? জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া আধুনিকতায় উত্তরণ সম্ভব হবে না। অধিকন্তু জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি। তাই এসডিজি ২০৩০ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে আধুনিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ জাতিকে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

চা-জনগোষ্ঠীর দণ্ডপূজা ও উপেক্ষিত অধিকার

মেরিটোক্রেসি: সমাজ ও রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

রম্যগদ্য: হাতের মুঠোয় বিশ্ব

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

tab

opinion » post-editorial

মানসম্মত আধুনিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

সোমবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২২

জাতীয় মৌলিক যেসব বিষয়ে কোন পরিবর্তন হয়নি, তার মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থা অন্যতম। জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টির ব্যাপারে রাষ্ট্রযন্ত্র যারা পরিচালনা করেন, যারা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার কলকাঠি নাড়েন, তাদের কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। অথচ কে না জানে যে, মানুষ গড়ার হাতিয়ার হলো শিক্ষাব্যবস্থা। অতি পুরাতন একটি বাক্য আমাদের মহারথীরা প্রায়ই বলেন, শিক্ষা জাতির মেরুদ-। সত্যিকারার্থে শিক্ষা শুধু মানুষ গড়ার হাতিয়ার নয়, জাতি গঠন বা নির্মাণের অপরিহার্য হাতিয়ারও বটে। একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া একটি জাতি নির্মাণ কখনো সম্ভব নয়। শিক্ষাসংকট দূর করার উদ্দেশ্যে শিক্ষাব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য দুয়েকবার চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। তবে কখনো আন্তরিকতার অভাবে বা কোথাও বা গোলামি যুগের মানসিকতার কারণে সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। শুধু যে সফল হয়নি তাই নয় বরং অবস্থা আগের চাইতে আরও জটিল এবং বিপজ্জনক করা হয়েছে।

আধুনিক শিক্ষা তাও আবার নানা ধারায় বিভক্ত, মাদ্রাসা শিক্ষা যা দুই ধারায় বিভক্ত। এমনি ধরনের নানামুখী প্রবণতার শিক্ষিত লোকরা নানা চিন্তা, নানা ধারায় বিভক্ত। মাদ্রাসা শিক্ষিত লোকরা তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিতদের প্রতি একটি মারাত্মক ধরনের বিরূপ ধারণা নিয়ে আছে। আবার স্কুল-কলেজের শিক্ষিতরা মাদ্রাসা শিক্ষিত লোকদের এক ধরনের অনুৎপাদনশীল এবং পেছনে পড়া জনশক্তি বা সমাজের জন্য বোঝা মনে করে। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে যারা ইংরেজি মাধ্যমে বা বিদেশে পড়াশোনা করে একটু ঠোঁট বাঁকা করে বিদেশি ভাষা বলতে পারে, তারা বুনিয়াদি শ্রেণী বলে নিজেদের ধরে নিয়েছে। এদেশের কিছুই তাদের ভালো লাগে না। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থতা, দেশে সন্ত্রাস, শিক্ষার নি¤œমান, খারাপ পরিবেশ ইত্যাদি অজুহাতে লাখ লাখ ছাত্র ভারতসহ বিদেশে লেখাপড়া করে। এতে দেশের অর্থ যেমন বিদেশে যাচ্ছে তেমনি একটু মেধাবী ধরনের যারা তারা আর দেশে ফিরছে না। যারা দেশে পড়াশোনায় একটু ভালো তারাও বিদেশে কোন সুযোগ পেলে বিদেশ পাড়ি জমাতে মোটেই দ্বিধা করে না। আমাদের অবশ্য জাতির জন্য প্রয়োজনীয় একটি শিক্ষাব্যবস্থা পেতে হবে। দ্বিধা-সংকোচ ও দীর্ঘসূত্রতা আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। আর ক্ষতি স্বীকার নয়, সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য একটি সাহসী পদক্ষেপ চাই।

শিক্ষা ও দারিদ্র্যের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিরাজমান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দরিদ্র জনগোষ্ঠী কি অশিক্ষিতই থাকবে? দারিদ্র্য দূর করার জন্য চাই শিক্ষা। এই প্রবন্ধে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে আর্থিক ও মানসিক দারিদ্র্য দূর করার জন্য আনুষ্ঠানিক বা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রকৃত ফলপ্রসূ সম্মিলন প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষাপরবর্তী স্তরে মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার প্রচলন ও সমন্বয় সম্ভব হলে দেশকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা সম্ভব। বিশ্বায়ন এই ক্ষেত্রে বিশাল সুবিধা হিসেবে কাজ করার কথা থাকলেও, নানা কাঠামোগত বাধার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষার্থীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে চাকরি খুঁজছেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই চাকরি দরকার। অধিকাংশই চাকরি পাচ্ছেন না। এজন্য অন্যতম দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। তাই বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিযোগিতায় আমরা হেরে যাচ্ছি। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষিত বেকার তৈরি করছে। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ কর্মবাজারে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই বেকার থাকছেন। তারপরও কোনভাবেই থামছে না উচ্চশিক্ষার ঢল। প্রতিটি শিক্ষার্থীর পেছনে বিপুল রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক অর্থ ব্যয় হয়। অনেক অর্থ ও সময় ব্যয় করে একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করছেন। এত কিছু করে চাকরির বাজারে তিনি কতটুকু যোগ্য হচ্ছেন? আজকের দিনে সেটি একটি অনেক বড় প্রশ্ন। এসব বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের এখনই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ আর ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হতে হলে চাকরির চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা কারিকুলাম করতেই হবে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা স্ট্রাকচার্ডভিত্তিক। এটা মূলত লিনিয়ার এবং মনো ডিসিপ্লিনারি। এটাকেই আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ইনন্ট্রাকটিজমের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ডাইডেকটিক পেডাগোজিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়া হয়। যাতে কোলাবোরেশন, পার্সোনালাইজ লার্নিং, ডিফারেনশিয়েটেড লার্নিং ও এক্সপেরেনশিয়াল লার্নিংয়ের সুযোগ নাই। এই পদ্ধতি দিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করা কঠিন হবে। ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থায় অবশ্যই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরিবর্তনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মানুষ, প্রযুক্তি এবং প্রকৃতিÑ এ তিনটি বিষয়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি নতুন সমাজ তৈরি করবে। এ সমাজটা কেমন হবে তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে সাজাতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ভবিষ্যৎ সমাজ, ভবিষ্যৎ কাজ এবং ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এ তিনটি বিষয়ের পরিবর্তনকে ধারণ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিনির্মাণ করতে হবে। এর ফলে সমাজের তিনটি বড় জায়গায় পরিবর্তন ঘটাবে। একটি হচ্ছে ইন্টেলেকচুয়ালাইজেশন ভার্চুয়ালাইজেশন (রিয়েলিটি এবং ভার্চুয়ালিটির মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি হবে) এবং একটি হাইপার কানেকটেড সমাজ তৈরি হবে। এটাকে আমরা বলি সোসাইটি ০৫। আমরা এখন সোসাইটি ০৪-এ আছি। এটা হচ্ছে ইনফরমেশন সোসাইটি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে ধারণ করার জন্য সোসাইটি ০৫-এর প্রয়োজন হবে। যাকে আমরা বলি সুপার স্মার্ট সোসাইটি। প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের একটি সভায় বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ যেহেতু আমরা অর্জন করতে পেরেছি এখন আমরা একটা স্মার্ট দেশ তৈরি করতে চাই। এখানে আনন্দের বিষয় হচ্ছে সোসাইটি ০৫ ইতোমধ্যে আমরা ধারণ করে ফেলেছি। কিন্তু এই সোসাইটি ০৫-কে ধারণ করার জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা সেই শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে যদি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটি জায়গায় নিয়ে আসতে না পারি তাহলে অন্য বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে যাবে সেই জায়গাটিতে অংশগ্রহণ করা আমাদের জন্য একটু কঠিন হয়ে যাবে।

কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও শিক্ষার সার্বজনীনতা আসছে না। শিক্ষার দৈন্য কাটছে না। শিক্ষায় আসছে না পরিবর্তনের হাওয়া। কাজেই যুগোপযোগী ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং একটি গণমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষানীতিকে প্রাধান্য দিতে হবেÑ যার বাস্তবায়ন না হলে বাঙালির কোনকালেই অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে না। একটি সুষ্ঠু শিক্ষানীতি ও তার সফল বাস্তবায়নে বাঙালি কর্মদক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হবে এবং যথার্থ মানবসম্পদের উন্নয়নও ঘটবে। শিক্ষা ও মানবসম্পদের উন্নয়ন ব্যতিরেকে আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। উন্নয়ন শুধু কাগজের ফিরিস্তি হয়েই ভেসে বেড়াবে। কাজেই প্রকৃত উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে মানবসম্পদ উন্নয়নবান্ধব পরিবেশ ও যথাযথ বিনিয়োগ এবং নীতিমালা সংযোজনের বিকল্প অন্য কিছুতে কোন সমাধান আসবে বলে আমরা মনে করতে পারি না। আসুন, একটি সুন্দর শিক্ষা নীতিমালা প্রস্তুত করে এবং দক্ষ মানবসম্পদের বিকাশ ঘটিয়ে আমাদের জাতীয় মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করি।

আমাদের শিক্ষা কতটা জীবন ও কর্মমুখী? জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া আধুনিকতায় উত্তরণ সম্ভব হবে না

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা আধুনিক ও জীবনমুখী? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা সর্বজনীন? শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বজনীনতা ছাড়া আধুনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যমুক্ত জাতি গঠন সম্ভব হবে না। আমাদের শিক্ষা কতটা জীবন ও কর্মমুখী? জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া আধুনিকতায় উত্তরণ সম্ভব হবে না। অধিকন্তু জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষা হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি। তাই এসডিজি ২০৩০ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে আধুনিক শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ জাতিকে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

[লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top