alt

উপ-সম্পাদকীয়

তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে সচেতনতা

মতিউর রহমান

: বুধবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৩

বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য উন্নতির ফলে বিশ্বব্যাপী তথ্য ওপ্রযুক্তিতে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ফলে মানুষের জীবনযাপনেও বহুমাত্রিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের ফলে মানুষ উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরহণ করলেও এর অপব্যবহারের ফলে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এটি ছাড়া একটি দিনও যাপন সম্ভব না। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১০০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৬৪ জন প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টা কোন না কোন ধরনের প্রযুক্তিগত পর্দার সামনে ব্যয় করেন। প্রযুক্তির এই অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে আমরা এটাকে আমাদের অনেক ক্ষতির কারণ বানিয়ে ফেলেছি। পৃথিবীর আয়ু যতই বাড়ছে, ততই আমাদের সামনে খুলে যাচ্ছে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি শেষ পর্যন্ত আমাদের কোন দিগন্তে নিয়ে যাবে তা কল্পনার বাইরে। ধাপে ধাপে আমরা সভ্যতার প্রতিটি স্তর অতিক্রম করছি। এর পরের স্তর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। অনেকের মতে, প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কেড়ে নিয়েছে। তবে এ কথা কেউ অস্বীকার করে না যে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের সমাজের জন্য প্রয়োজনীয়। সভ্যতার বিকাশে তথ্যপ্রযুক্তির অবদান অপরিসীম। কিন্তু প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের অবস্থানকে কত নিচে নামিয়ে দিচ্ছে তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি?

নৈতিকভাবে অজ্ঞ কিছু মানুষের দ্বারা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধের একটা বড় অংশ এখন সংগঠিত হয় তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ঘিরে। সামাজিক মাধ্যমগুলো এখন মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু বিবেকহীন ও অপদার্থ মানুষ তথ্যপ্রযুক্তিকে তাদের ভোগ-বিলাসের ক্ষেত্র বানিয়েছে। পরিসংখ্যান মতে দেশের অর্ধেকেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী টিকটক এবং লাইকির মতো অ্যাপসহ পর্নোগ্রাফিক এবং বিভিন্ন অনলাইন গেমগুলোতে ব্যয় করে। শহুরে বা স্কুলের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু আজ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। আর পর্নোগ্রাফির প্রতি এই অতিরিক্ত আসক্তি তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফল। তাই শিশুকে একটি উন্নত মোবাইল বা ট্যাব দেয়ার আগে এসবের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কেও ভাবা উচিত। তা না হলে নতুন প্রজন্মের মেধার অপচয় রোধ করা যাবে না, অপরাধও বাড়বে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে তরুণ প্রজন্ম শারীরিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি মানসিক বৈকৈল্যের শিকার হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখায় যে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ মানুষ আত্মহত্যা করে।

এছাড়া এটি বর্তমান প্রজন্মকে বেশ আসক্ত করে তুলেছে। ফলে বর্তমান প্রজন্ম বইয়ের পরিবর্তে ফেসবুক, মোবাইল ও ইন্টারনেটে সময় কাটায় বেশি। এই সর্বনাশা নেশা থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। ইন্টানটের ক্ষতিকারক সাইটগুলো বন্ধ করা উচিত বা প্রবেশাধিকার প্রতিরোধ করা উচিত। তা না হলে অচিরেই আমরা সভ্যতার উল্টো পিঠ অন্ধকারে তলিয়ে যাব। বর্তমানে ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে যারা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে। তারা খুন, নারী ও শিশু নির্যাতন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিং ইত্যাদি অপরাধ করে থাকে। এই কিশোর গ্যাং মূলত ফেসবুক, টুইটার এবং হোয়াটস অ্যাপে গ্রুপভিত্তিক অপরাধ করে থাকে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র বিভিন্ন প্রকার অপরাধ সংগঠন করে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি, অর্থ চুরি, নারী ও শিশুপাচার, অর্থপাচার, জঙ্গিবাদের বিস্তার, গুজব ছড়ানোসহ নানাবিধ অপরাধ করে থাকে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে, বিচ্ছিন্নতা, পড়াশোনায় অমনোযোগীতা এবং অসহিষ্ণুতা দ্রুত বাড়ছে। যা সব ধরনের সহিংসতার অন্যতম কারণ। সর্বত্র এখন বিবাহ বহির্ভূত প্রেম ও এ সংক্রান্ত সহিংসতা বাড়ছে। ডিজিটাল দুর্নীতি প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে। এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। পরিবার ও সমাজে ভাঙনের শব্দ জোরালো হচ্ছে যা সহিংসতা এবং ভঙ্গুর পরিবার কাঠামোকেই নির্দেশ করে।

সামাজিক বন্ধন ক্রমান্বয়ে শিথিল হচ্ছে। সমাজে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশের কারণে সভ্যতা আজ হুমকির মুখে। এর প্রধান শিকার যুব সমাজসহ প্রায় সমগ্র মানবসমাজ। আর এই ধারায় ভাটা পড়বে বলে মনে হয় না। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, সমাজ এখন তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধ, পরকীয়া, অসম প্রেমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। নৈতিকভাবে অশিক্ষিত মানুষের হাতে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে সমাজ, সভ্যতা আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াকে ঘিরেই অপরাধীরা তাদের বেশির ভাগ অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংগঠিত করে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো এখন মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অভাবের কারণে মানুষ তথ্য প্রযুক্তিকে তাদের ভোগ-বিলাসের ক্ষেত্র বানিয়েছে। তথ্য বিকৃতি, সমাজে ব্যক্তির ব্যক্তিগত অবমাননা, প্রতিকৃতির ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকান্ডে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও ছবি চুরি করে ব্ল্যাকমেইল করার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

বিভিন্ন অপরাধী চক্র তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য একটি গোপন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটকে বেছে নিয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যেহেতু তাদের পরিচয় গোপন রাখতে পারে, তাই কাউকে হুমকি দেয়া, মিথ্যা সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করা বা ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহূর্ত রেকর্ড করে বিভিন্ন অনলাইন সাইটে ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেয়া সহজ হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিরোধে সরকার যদিও আইন করেছে এবং সাইবার অপরাধ মানটরিং জোরদার করেছে তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব নয়। তৃণমূল পর্যন্ত মানুষকে বোঝাতে হবে যে তথ্য প্রযুক্তি শুধুমাত্র ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য। ব্যক্তি পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এই বার্তাটি পৌঁছে দেয়া এখন জরুরি। আর এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না কারণ সবাই এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন নয়। আর তাই তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে এবং এর অপব্যবহার রোধে যথেষ্ট সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে একটি সুস্থ সমাজ, জাতি ও দেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে সচেতনতা

মতিউর রহমান

বুধবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৩

বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য উন্নতির ফলে বিশ্বব্যাপী তথ্য ওপ্রযুক্তিতে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ফলে মানুষের জীবনযাপনেও বহুমাত্রিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের ফলে মানুষ উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরহণ করলেও এর অপব্যবহারের ফলে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এটি ছাড়া একটি দিনও যাপন সম্ভব না। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১০০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৬৪ জন প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টা কোন না কোন ধরনের প্রযুক্তিগত পর্দার সামনে ব্যয় করেন। প্রযুক্তির এই অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে আমরা এটাকে আমাদের অনেক ক্ষতির কারণ বানিয়ে ফেলেছি। পৃথিবীর আয়ু যতই বাড়ছে, ততই আমাদের সামনে খুলে যাচ্ছে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি শেষ পর্যন্ত আমাদের কোন দিগন্তে নিয়ে যাবে তা কল্পনার বাইরে। ধাপে ধাপে আমরা সভ্যতার প্রতিটি স্তর অতিক্রম করছি। এর পরের স্তর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। অনেকের মতে, প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কেড়ে নিয়েছে। তবে এ কথা কেউ অস্বীকার করে না যে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের সমাজের জন্য প্রয়োজনীয়। সভ্যতার বিকাশে তথ্যপ্রযুক্তির অবদান অপরিসীম। কিন্তু প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের অবস্থানকে কত নিচে নামিয়ে দিচ্ছে তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি?

নৈতিকভাবে অজ্ঞ কিছু মানুষের দ্বারা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধের একটা বড় অংশ এখন সংগঠিত হয় তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ঘিরে। সামাজিক মাধ্যমগুলো এখন মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু বিবেকহীন ও অপদার্থ মানুষ তথ্যপ্রযুক্তিকে তাদের ভোগ-বিলাসের ক্ষেত্র বানিয়েছে। পরিসংখ্যান মতে দেশের অর্ধেকেরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী টিকটক এবং লাইকির মতো অ্যাপসহ পর্নোগ্রাফিক এবং বিভিন্ন অনলাইন গেমগুলোতে ব্যয় করে। শহুরে বা স্কুলের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু আজ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। আর পর্নোগ্রাফির প্রতি এই অতিরিক্ত আসক্তি তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফল। তাই শিশুকে একটি উন্নত মোবাইল বা ট্যাব দেয়ার আগে এসবের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কেও ভাবা উচিত। তা না হলে নতুন প্রজন্মের মেধার অপচয় রোধ করা যাবে না, অপরাধও বাড়বে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে তরুণ প্রজন্ম শারীরিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি মানসিক বৈকৈল্যের শিকার হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখায় যে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ মানুষ আত্মহত্যা করে।

এছাড়া এটি বর্তমান প্রজন্মকে বেশ আসক্ত করে তুলেছে। ফলে বর্তমান প্রজন্ম বইয়ের পরিবর্তে ফেসবুক, মোবাইল ও ইন্টারনেটে সময় কাটায় বেশি। এই সর্বনাশা নেশা থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। ইন্টানটের ক্ষতিকারক সাইটগুলো বন্ধ করা উচিত বা প্রবেশাধিকার প্রতিরোধ করা উচিত। তা না হলে অচিরেই আমরা সভ্যতার উল্টো পিঠ অন্ধকারে তলিয়ে যাব। বর্তমানে ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে যারা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে। তারা খুন, নারী ও শিশু নির্যাতন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিং ইত্যাদি অপরাধ করে থাকে। এই কিশোর গ্যাং মূলত ফেসবুক, টুইটার এবং হোয়াটস অ্যাপে গ্রুপভিত্তিক অপরাধ করে থাকে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র বিভিন্ন প্রকার অপরাধ সংগঠন করে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি, অর্থ চুরি, নারী ও শিশুপাচার, অর্থপাচার, জঙ্গিবাদের বিস্তার, গুজব ছড়ানোসহ নানাবিধ অপরাধ করে থাকে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে, বিচ্ছিন্নতা, পড়াশোনায় অমনোযোগীতা এবং অসহিষ্ণুতা দ্রুত বাড়ছে। যা সব ধরনের সহিংসতার অন্যতম কারণ। সর্বত্র এখন বিবাহ বহির্ভূত প্রেম ও এ সংক্রান্ত সহিংসতা বাড়ছে। ডিজিটাল দুর্নীতি প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে। এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। পরিবার ও সমাজে ভাঙনের শব্দ জোরালো হচ্ছে যা সহিংসতা এবং ভঙ্গুর পরিবার কাঠামোকেই নির্দেশ করে।

সামাজিক বন্ধন ক্রমান্বয়ে শিথিল হচ্ছে। সমাজে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশের কারণে সভ্যতা আজ হুমকির মুখে। এর প্রধান শিকার যুব সমাজসহ প্রায় সমগ্র মানবসমাজ। আর এই ধারায় ভাটা পড়বে বলে মনে হয় না। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, সমাজ এখন তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধ, পরকীয়া, অসম প্রেমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। নৈতিকভাবে অশিক্ষিত মানুষের হাতে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে সমাজ, সভ্যতা আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াকে ঘিরেই অপরাধীরা তাদের বেশির ভাগ অপরাধমূলক কর্মকান্ড সংগঠিত করে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো এখন মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অভাবের কারণে মানুষ তথ্য প্রযুক্তিকে তাদের ভোগ-বিলাসের ক্ষেত্র বানিয়েছে। তথ্য বিকৃতি, সমাজে ব্যক্তির ব্যক্তিগত অবমাননা, প্রতিকৃতির ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকান্ডে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও ছবি চুরি করে ব্ল্যাকমেইল করার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

বিভিন্ন অপরাধী চক্র তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য একটি গোপন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটকে বেছে নিয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যেহেতু তাদের পরিচয় গোপন রাখতে পারে, তাই কাউকে হুমকি দেয়া, মিথ্যা সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করা বা ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহূর্ত রেকর্ড করে বিভিন্ন অনলাইন সাইটে ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেয়া সহজ হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিরোধে সরকার যদিও আইন করেছে এবং সাইবার অপরাধ মানটরিং জোরদার করেছে তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব নয়। তৃণমূল পর্যন্ত মানুষকে বোঝাতে হবে যে তথ্য প্রযুক্তি শুধুমাত্র ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য। ব্যক্তি পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে এই বার্তাটি পৌঁছে দেয়া এখন জরুরি। আর এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না কারণ সবাই এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন নয়। আর তাই তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে এবং এর অপব্যবহার রোধে যথেষ্ট সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে একটি সুস্থ সমাজ, জাতি ও দেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top