alt

উপ-সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধু, বাংলা ও বাঙালি

মোস্তাফা জব্বার

: সোমবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৩

১৯৭৫ সালে বাংলার মাটিকে নিজের ও পরিবারের রক্ত দিয়ে পবিত্র করে যাকে সপরিবারে শহীদ হতে হয়েছিলো তার সম্পর্কে দুটি বাক্য লিখতে কার অনুভূতি কি হয় জানি না, আমার তো হাত কাঁপে ও অন্তর কাঁপে। আমি অক্ষর হারিয়ে ফেলি-বাক্য পূর্ণ করতে পারি না। আবেগ অনুভূতির প্লাবন বয়ে যায়। কোনোভাবেই আমি তাকে নিয়ে লেখার সাহস পাই নাই। এত বড়মাপের মানুষ তাকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার মতো নগন্য একজনের থাকতেই পারে না বলে আমি মনে করি। আমি তার ভক্ত-সৈনিক। আমার চারপাশে কিংবা ইতিহাসের পাতায় কোন দেশের কোন নেতাকে তার সাথে তুলনীয় দেখি না। বাংলাদেশ তো দূরের কথা, সারা দুনিয়াতেই তিনি একজনই। তিনি কেবল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নন। তাকে আমি মনে করি একজনই বাঙালি, যার মাঝে বাঙালিত্বের পুরোটা আছে এবং সেজন্য তিনি সকল বাঙালির, সকল বাংলা ভাষাভাষীর অনুসরণীয়, অনুকরণীয় এবং পরম শ্রদ্ধার পাত্র। চারপাশে তাকে নিয়ে কোটি কোটি হরফ দেখি। খ- খ- বই লেখা হয়েছে তাকে নিয়ে। যিনি যেভাবে চান সেভাবেই তিনি বা তারা তাকে উপস্থাপন করছেন। কেন জানি মনে হচ্ছে তার নীতি, আদর্শ বা কর্মপন্থাকে আমরা এখনও সেভাবে মূল্যায়ন করি না, যেভাবে সেটি করা দরকার।

অনেক ভাবনা থেকে তার সম্পর্কে একটি ছোট নিবন্ধ লেখার সাহসও এতোদিন পাইনি। এবার যখন ৭৩ বছর পার করছি তখন মনে হলো এই মহামানব সম্পর্কে নিজের ভাবনাটা প্রকাশ করে যাওয়াটা নিজের কাছে জবাবদিহি করার মতো একটি বিষয় হতে পারে। নইলে এক সময়ে মনে হবে আমি তাকে যেমনটি ভাবি সেটিতো কাউকে বলিনি। মনে মনে ভাবছি যদি সময় পাই তবে আমি তাকে একটু বিস্তারিতভাবেই মূল্যায়ন করব। গত কয়েক বছরে সেই চেষ্টাও করেছি। তার বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা আমি করেছি। সেগুলো বিভিন্ন প্রকাশনায় প্রকাশিতও হয়েছে। এবার সাহস করে জাতি রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু নামে একটি বই প্রকাশও করেছি। ইচ্ছা আছে গ্রন্থ আকারে আরও তথ্য প্রকাশ করার। আমি নিজে তার নাম শুনেছি ৬৬ সালে, যখন ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে ছাত্রলীগ করা শুরু করি। সেখানেই ছয় দফা নামক একটি লিফলেট বিলাতে গিয়ে প্রথম জেনেছি যে বাঙালিরা তাদের প্রাপ্য পায় না। তার আগে সারাটা স্কুলজীবনে পাক সর জমিন সাদ বাদ গাওয়াইয়ে পাকিস্তানি বানাবার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি আমাকে বিরাট স্কুলের মোস্তাফা মৌলভী সাহেব উর্দু পাঠ্য করিয়েছিলেন যে বিষয়ে আমি মাত্র ৩৩ নাম্বার পেয়েছিলাম। ১৯৬৫ সাল ছিলো প্রথম যখন ঢাকা শহরে এসে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কুশপুত্তলিকা জ্বালাতে দেখেছি। ৬৬ সালে ৬ দফা পাঠ করে জীবনে প্রথম অনুভব করলাম, আমি বাঙালি এবং আমার একটি আলাদা অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, একটি আলাদা ভাষা, আলাদা সংস্কৃতি ও আলাদা ভূখ- রয়েছে। ৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে শুনলাম, বাঙালিদের একজনই নেতা তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

তারপর ১১ দফায় সেই ছয় দফা যুক্ত হয় আর রাজপথে তার মুক্তির দাবিতে মিছিল করা দিয়ে নিজের স্লোগান দেয়ার ক্ষমতাকে শাণিত করি। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগন্য একজন কর্মী হিসেবে তার সামনে যাবার কোন কারণই ছিল না। তবে যারা তার কাছে থাকতেন তাদের সাথে আমরা দিন-রাত কাটাতাম বলে তার ব্যক্তিগত ভাবনা-জীবনাচার বা রাজনৈতিক দর্শন জানতে পারতাম। তার জেষ্ঠ্য কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কয়েক মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবন সম্পর্কেও ধারণা পাই। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালকে ঢাকা কলেজ থেকে চিনতাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রাজনীতির সাথে নাট্য আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়। তার জীবন নিয়ে ইতিহাস লেখার কোন ইচ্ছাই আমার নাই। অনেকে লিখেছেন, লিখবেন এবং সারা বিশ্ব তাকে নিয়ে গবেষণা করবে, বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে এটাই স্বাভাবিক। গত ১৪ বছরে তার কন্যা বাংলার স্বর্ণকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যেখানে স্থাপন করেছেন তাতে সারা বিশ্বকে জানতেই হবে, কে এই দেশের জনক এই শেখ মুজিবুর রহমান। এক সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তলাহীন ঝুড়ির দেশ এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সামনে আদর্শ দেশ, এ রূপান্তরটা তো আমাদের জানতেই হবে।

আমাদের এই দেশটির জনক প্রথম আমাকে আকৃষ্ট করেন তার অতি সাধারণ জীবনযাপন, সহজ-সরল অভিব্যক্তি এবং স্পষ্টবাদিতায়। একবাক্যে তার বাঙালিত্বে। আমি স্মরণ করতে পারি বঙ্গবন্ধু কেবল তার রাজনৈতিক দল নয়, ছাত্র বা শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। এমনকি তাদের পারিবারিক তথ্যও মনে রাখতেন। সেই মানুষটির সাধারণ মূল্যায়ন যখন আমরা করি তখন কেবল তার বাংলাদেশ সৃষ্টির বিষয়টিকে প্রাধ্যান্য দিই। যে সময়ে ব্রিটিশরা পুরা উপমহাদেশটিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলঙ্কিত করে দুটি অদ্ভুত রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো এবং পুরো উপমহাদেশের তাবত বড় বড় রাজনীতিবিদরা সেই সাম্প্রদায়িকতাকেই মাথায় তুলে নিয়েছিলেন তখন তিনি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের বিপরীতে একটি ভাষাভিত্তিক আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের দূরদর্শী স্বপ্ন দেখেন। ভাবা যায় যে, পাকিস্তান তৈরির ৫ মাসের মাঝে জিন্নার মুখের ওপর কেউ না না চিৎকার করে নিজের মাতৃভাষার দাবিকে উত্থাপন করতে পারেন। এ অঞ্চলে ভাষা রাষ্ট্র ধারণা তখন মোটেই গুরুত্ব পায় নাই। ভারত বহুভাষিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

খুব সঙ্গত কারণেই ভারতের ধর্ম রাষ্ট্র হবারও খুব সুযোগ ছিলো না। তবুও ব্রিটিশরা ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করেছিলো। ভারতের নেতারাও সেটি প্রচ্ছন্নভাবে মেনে নিয়েছিলেন। তবে পাকিস্তান হয়ে ওঠে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু সেই মানুষ যিনি বাংলাদেশের অন্তরকে অনুভব করেন এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতা যে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং বাঙালি যে তার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সবার ওপরে ঠাঁই দেয় এবং তার এই জীবনধারায় ধর্ম যে কেবল ব্যক্তিগত বিষয় এবং রাষ্ট্রের রাজনীতির প্রধান শক্তি নয়, সেটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। আমি নিজে অভিভূত হই যখন দেখি যে তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে থেকে তার রাজনৈতিক সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি উপড়ে ফেলে দিতে পেরেছিলেন। যে মানুষটি নিজেকে স্পষ্ট করে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে পারেন যে তিনি বাঙালি, মানুষ এবং তারপরে মুসলমান, কেবল সেই মানুষটিই পাকিস্তানের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের চোখের সামনে পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে ধর্ম নিরপেক্ষ করতে পারেন!

আজ তার মৃত্যুর এত বছর পর আমাদের আইনমন্ত্রীকে বলতে হয় যে, আমরা অবশ্যই ৭২ সালের সংবিধানে ফেরৎ যাবো। তিনি নিজেই অনুভব করেন যে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আমরা ফেরৎ যেতে পারিনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা দেশটিকে যেভাবে পাকিস্তানের দূরবর্তী অঙ্গরাজ্য বানিয়েছিলো, সেটির সংবিধান আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো করে ফিরে পেতে পারিনি। ভাবুন দেখি, তিনি তার দলের নাম থেকে কেবল মুসলিম শব্দ বর্জন করেননি, মুসলমানদের রাষ্ট্র পাকিস্তানকে পরাজিত করে সেখানে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। আমার জানা মতে, তার হাতে তৈরি ৭২ সালের সংবিধানটি হচ্ছে দুনিয়ার অন্যতম সেরা সংবিধান যার সাথে তুলনা করার মতো কোন সংবিধান অন্তত এ অঞ্চলে পাওয়া যায় না। এই সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে জিয়া ও এরশাদ কেবল যে সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত করে তাই নয়, এর গণতান্ত্রিক চরিত্রও বিনষ্ট করে। আমাদের জন্য দুঃখজনক যে ৭৫ থেকে ৯৬ অবধি দেশে এমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি গড়ে তোলা হয় যে বঙ্গবন্ধুর কন্যার পক্ষেও এখন ৭২-এর সংবিধানের পরিপূর্ণ মূল চরিত্রে ফেরৎ যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখন যদি তিনি সেই কাজটি করেন তবে রাজনীতির ছকটাকে উল্টানোর অপচেষ্টা করা হবে এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতোই সাম্প্রদায়িক, জঙ্গি ও একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার রাজনীতি প্রবলভাবে জোরদার করা হবে। সংবিধানকে নিয়েই মুসলিম আবেগ জোরদার করা হবে এবং এর জন্য যতো রকমের ষড়যন্ত্র করা যায় সেটি করাই হবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর সময়কালের বিশ্ব পরিস্থিতি এখন আর বিরাজ করে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ দুর্বল হবার পর পুঁজিবাদের একতরফা বিকাশ, চীনের আপোসকামিতা ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবার ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হুবহু যেতে পারছি না। আজকের তরুণরা বঙ্গবন্ধুকে সেভাবে বুঝবেন না, যেভাবে আমরা তাকে চিনি। বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্ব, তার প্রতি একনিষ্ঠতা এবং জাতিসত্তা বিষয়ে অত্যন্ত ষ্পষ্ট নীতিমালা আমার মতো লাখো লাখো তরুণকে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র গঠনে জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

যারা এখন মনে করেন যে, পাকিস্তান আমাদের ঠকিয়েছে, ন্যায্য পাওনা দেয়নি এবং বনিবনা হয়নি বলে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে তারা বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে পুরোটা বুঝতেই পারেন না। কোন সন্দেহ নাই যে, তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এমনভাবে গড়ে তুলেন যে সারা দুনিয়ার কাছে আমরা এটি প্রমাণ করেছি যে, আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ৪৮ সালেই তিন এটি বুঝেছিলেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাঙালিদের নয় এবং বাঙালিদের একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেজন্য তিনি একদিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন; অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতিও গড়ে তুলেছেন। তিনি একদিকে নির্বাচন করেছেন, অন্যদিকে আমাদের কণ্ঠে বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর সেই স্লোগানও তুলে দিয়েছেন।

বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বুঝতে হলে তার তৈরি করা ৭২-এর সংবিধান বুঝতে হবে। তার ৭২ সালের সংবিধানের মূলমন্ত্র ছিলো চারটি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপক্ষেতা ও জাতীয়তাবাদ। ধীরে ধীরে আমরা সেই চার নীতির গণতন্ত্র ছাড়া বাকি সবগুলোই এড়িয়ে চলেছি। আজকের বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র শব্দটি কেউ উচ্চারণ করে না; কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে সমাজতন্ত্র ছাড়া মুক্তির কোন পথ নেই। হয়তো কার্লমার্ক্সের সমাজতন্ত্র ডিজিটাল যুগে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে ডিজিটাল যুগের সমাজতন্ত্র ও তার ধারণা কাজে লাগানো ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। এক সময়ে কায়িক শ্রমনির্ভর মালিক শ্রমিক কাঠামোটি দিনে দিনে মেধা শ্রমভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে শ্রেণি-চরিত্র বা শ্রেণি-সংগ্রামের সংজ্ঞা বদলাচ্ছে। কোন এক মার্ক্সকে নতুন করে সমাজতন্ত্রের কথা বর্ণনা করতে হবে- ব্যাখ্যা করতে হবে মালিক-শ্রমিক ও উৎপাদন ব্যবস্থা। শিল্পযুগের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের ব্যবস্থা শিল্প বিপ্লবের চতুর্থ বা পঞ্চম স্তরে চলতে পারে না।

অন্যদিকে পুঁজিবাদের রূপান্তরে তার মূল্যায়নও অন্যভাবেই করতে হবে। চীন একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়েও পুঁজিবাদের ধারণাকে ভিন্নভাবে প্রয়োগ করে নতুন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ধারণা তুলে ধরেছে। তবে সমাজতন্ত্র যে বৈষম্যহীনতার ধারণাকে জন্ম দিয়েছে সেটি দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে না। বরং সমাজতন্ত্রের ডিজিটাল ধারাটির জন্য সারা দুনিয়ায় নতুন করে লড়াই চলবে। অন্যদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য বাংলাদেশকে আবার লড়াই করতে হচ্ছে। জিয়া-এরশাদ-খালেদা বাংলাদেশকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার অপচেষ্টা করেছে এবং সারা দুনিয়ার ধর্ম পরিস্থিতি যেমনটা তাতে বাংলাদেশের জন্য ধর্মনিরপেক্ষেতা বজায় রাখাকেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। একই কারণে বাঙালির জাতিসত্তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে।

তথাকথিত শিক্ষিত লোকরা বিয়ের কার্ডটাতেও বাংলা হরফ ব্যবহার করে না। এই হীনমন্য জাতির ভবিষ্যৎ কী? যে ভাষা রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন সেখান থেকে সরে গিয়ে আমরা কোন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলছি-

নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল কথাগুলো তুলে ধরা হয়নি বলে এখন তরুণরা ইসলামী জঙ্গিতে রূপান্তরিত হয়। অথচ বঙ্গবন্ধুকে তো বটেই পুরো বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানিরা অমুসলিম বানাতে চেষ্টা করেও সফল হয়নি। একাত্তরে তারা স্পষ্ট করেই বলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা মুসলমান নয়। আমরা পাকিস্তানিদের পরাজিত করে এর জবাব দিয়েছি।

বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার চোখের পানি আসে আরও একটি বিশাল কারণে। তাকে ছাড়া আমি নিজেকে অসহায় মনে করছি। আমার নিজের মতে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রয়োগ করার অনন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি, যে মুজিব অপটিমা মুনীর টাইপ রাইটার বানিয়েছিলেন। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি যিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার আগেই বলেছিলেন, ভুল হোক শুদ্ধ হোক আমরা সরকারি কাজে বাংলাই লিখবো। কালক্রমে জিয়া এরশাদ ও খালেদা সেই মুজিবের আদর্শ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সরানোর চেষ্টা করেছে। ভাষার কথাই বলি। বাংলাদেশের বেসরকারি অফিসে বাংলা বর্ণমালাই নেই। সরকারের কাজে-কর্মে বাংলা ভাষা বিরাজ করে। কিন্তু যখনই আমরা এর ডিজিটাল রূপান্তর করছি তখন বাংলা অবহেলার বিষয় হয়ে ওঠছে।

বস্তুত ডিজিটাল করার নামে বাংলা হরফকে অনেক ক্ষেত্রেই বিদায় করা হয়। উচ্চ আদালতে ও উচ্চশিক্ষায় বাংলা নেই। যে মানুষটি ৫২ সালে চীনে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলায় ভাষণ দেন এবং যিনি সদ্যোজাত দেশের পক্ষে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরেছিলেন সেই মানুষটির দেশে এখন চারপাশে রোমান হরফের রাজত্ব দেখি। একটি সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল বলছে, ফেসবুকে শতকরা মাত্র ৮ ভাগ বাঙালি বাংলা ব্যবহার করে। কী ভয়ংকর একটি চিত্র এতে প্রকাশিত হয়। আমি চাই না আমার অনুমান সত্য হোক, কিন্তু মনে হচ্ছে এক সময়ে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বা গ্রামের মানুষ ছাড়া বাংলা হরফই আমরা দেখবো না। আপনি চারপাশে খোঁজ নিলেই দেখবেন, তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা বিয়ের কার্ডটাতেও বাংলা হরফ ব্যবহার করে না। এই হীনমন্য জাতির ভবিষ্যৎ কী? যে ভাষা রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন সেখানে থেকে সরে গিয়ে আমরা কোন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলছি- সেটি আমি মোটেই বুঝি না। আসুন না সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষা রাষ্ট্রটাকেই বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করি। আসুন সকল ক্ষেত্রে সেই একজন বাঙালিকেই অনুসরণ করি যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী]

আদিবাসীদের মাতৃভাষা রক্ষার লড়াই

মালাকারটোলা গণহত্যা : দুঃসহ স্মৃতি

ছবি

স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা

ছবি

বঙ্গবন্ধুর দর্শন থেকে উৎসারিত স্বাধীনতা ও মুক্তির চেতনা

ছবি

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা

সিপিআই (এম)-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার নেতৃত্বের মূল্যায়ন

ছবি

অরক্ষিত নন ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ব্যাংক ও মানুষের আস্থা

চাই ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাবার

ছবি

তিতাস অববাহিকার বিপন্ন কৃষিজমিন

প্রিয়েমশন মামলা সম্পর্কিত আইনি সমস্যা ও সমাধান

ছবি

স্মরণ : মাস্টার’দা সূর্যসেন

আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা

খাদ্য পর্যটন : নবদিগন্তের হাতছানি

ধূপখোলা মাঠ রক্ষা করতে হবে

হজ বাণিজ্যিক পণ্য নয়

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব

পশ্চিম বাংলায় নির্বাচন হোক রক্তপাতহীন

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কালক্ষেপণ নয়

ছবি

কৃষিজমি সুরক্ষায় সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন

ঢালচর বনের ঢাল কারা?

গাজীপুরের সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ

ছবি

আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে বিতর্ক

ছবি

প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার নৈহাটি মডেল

ছবি

কে কিভাবে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানবে?

প্লাস্টিক দূষণ : উদ্বিগ্ন বিশ্ব

ছবি

কাঁদে নদ-নদী

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

বাঁকখালী নদীর মুক্তি ও ন্যায়বিচার

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও আদিবাসী

আগুন আর ভূমিকম্পের বিপদ

নারীর ক্ষমতায়ন ও টেকসই উন্নয়ন

নগর স্থবির, গ্রামে শুরু কর্মচাঞ্চল্য

ছবি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব

নারীর কর্মদক্ষতায় আইসিটি ও স্টেম শিক্ষা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধু, বাংলা ও বাঙালি

মোস্তাফা জব্বার

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৩

১৯৭৫ সালে বাংলার মাটিকে নিজের ও পরিবারের রক্ত দিয়ে পবিত্র করে যাকে সপরিবারে শহীদ হতে হয়েছিলো তার সম্পর্কে দুটি বাক্য লিখতে কার অনুভূতি কি হয় জানি না, আমার তো হাত কাঁপে ও অন্তর কাঁপে। আমি অক্ষর হারিয়ে ফেলি-বাক্য পূর্ণ করতে পারি না। আবেগ অনুভূতির প্লাবন বয়ে যায়। কোনোভাবেই আমি তাকে নিয়ে লেখার সাহস পাই নাই। এত বড়মাপের মানুষ তাকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমার মতো নগন্য একজনের থাকতেই পারে না বলে আমি মনে করি। আমি তার ভক্ত-সৈনিক। আমার চারপাশে কিংবা ইতিহাসের পাতায় কোন দেশের কোন নেতাকে তার সাথে তুলনীয় দেখি না। বাংলাদেশ তো দূরের কথা, সারা দুনিয়াতেই তিনি একজনই। তিনি কেবল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নন। তাকে আমি মনে করি একজনই বাঙালি, যার মাঝে বাঙালিত্বের পুরোটা আছে এবং সেজন্য তিনি সকল বাঙালির, সকল বাংলা ভাষাভাষীর অনুসরণীয়, অনুকরণীয় এবং পরম শ্রদ্ধার পাত্র। চারপাশে তাকে নিয়ে কোটি কোটি হরফ দেখি। খ- খ- বই লেখা হয়েছে তাকে নিয়ে। যিনি যেভাবে চান সেভাবেই তিনি বা তারা তাকে উপস্থাপন করছেন। কেন জানি মনে হচ্ছে তার নীতি, আদর্শ বা কর্মপন্থাকে আমরা এখনও সেভাবে মূল্যায়ন করি না, যেভাবে সেটি করা দরকার।

অনেক ভাবনা থেকে তার সম্পর্কে একটি ছোট নিবন্ধ লেখার সাহসও এতোদিন পাইনি। এবার যখন ৭৩ বছর পার করছি তখন মনে হলো এই মহামানব সম্পর্কে নিজের ভাবনাটা প্রকাশ করে যাওয়াটা নিজের কাছে জবাবদিহি করার মতো একটি বিষয় হতে পারে। নইলে এক সময়ে মনে হবে আমি তাকে যেমনটি ভাবি সেটিতো কাউকে বলিনি। মনে মনে ভাবছি যদি সময় পাই তবে আমি তাকে একটু বিস্তারিতভাবেই মূল্যায়ন করব। গত কয়েক বছরে সেই চেষ্টাও করেছি। তার বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা আমি করেছি। সেগুলো বিভিন্ন প্রকাশনায় প্রকাশিতও হয়েছে। এবার সাহস করে জাতি রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু নামে একটি বই প্রকাশও করেছি। ইচ্ছা আছে গ্রন্থ আকারে আরও তথ্য প্রকাশ করার। আমি নিজে তার নাম শুনেছি ৬৬ সালে, যখন ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে ছাত্রলীগ করা শুরু করি। সেখানেই ছয় দফা নামক একটি লিফলেট বিলাতে গিয়ে প্রথম জেনেছি যে বাঙালিরা তাদের প্রাপ্য পায় না। তার আগে সারাটা স্কুলজীবনে পাক সর জমিন সাদ বাদ গাওয়াইয়ে পাকিস্তানি বানাবার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি আমাকে বিরাট স্কুলের মোস্তাফা মৌলভী সাহেব উর্দু পাঠ্য করিয়েছিলেন যে বিষয়ে আমি মাত্র ৩৩ নাম্বার পেয়েছিলাম। ১৯৬৫ সাল ছিলো প্রথম যখন ঢাকা শহরে এসে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর কুশপুত্তলিকা জ্বালাতে দেখেছি। ৬৬ সালে ৬ দফা পাঠ করে জীবনে প্রথম অনুভব করলাম, আমি বাঙালি এবং আমার একটি আলাদা অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, একটি আলাদা ভাষা, আলাদা সংস্কৃতি ও আলাদা ভূখ- রয়েছে। ৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে শুনলাম, বাঙালিদের একজনই নেতা তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

তারপর ১১ দফায় সেই ছয় দফা যুক্ত হয় আর রাজপথে তার মুক্তির দাবিতে মিছিল করা দিয়ে নিজের স্লোগান দেয়ার ক্ষমতাকে শাণিত করি। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগন্য একজন কর্মী হিসেবে তার সামনে যাবার কোন কারণই ছিল না। তবে যারা তার কাছে থাকতেন তাদের সাথে আমরা দিন-রাত কাটাতাম বলে তার ব্যক্তিগত ভাবনা-জীবনাচার বা রাজনৈতিক দর্শন জানতে পারতাম। তার জেষ্ঠ্য কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কয়েক মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুবাদে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবন সম্পর্কেও ধারণা পাই। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালকে ঢাকা কলেজ থেকে চিনতাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রাজনীতির সাথে নাট্য আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়। তার জীবন নিয়ে ইতিহাস লেখার কোন ইচ্ছাই আমার নাই। অনেকে লিখেছেন, লিখবেন এবং সারা বিশ্ব তাকে নিয়ে গবেষণা করবে, বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে এটাই স্বাভাবিক। গত ১৪ বছরে তার কন্যা বাংলার স্বর্ণকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যেখানে স্থাপন করেছেন তাতে সারা বিশ্বকে জানতেই হবে, কে এই দেশের জনক এই শেখ মুজিবুর রহমান। এক সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তলাহীন ঝুড়ির দেশ এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সামনে আদর্শ দেশ, এ রূপান্তরটা তো আমাদের জানতেই হবে।

আমাদের এই দেশটির জনক প্রথম আমাকে আকৃষ্ট করেন তার অতি সাধারণ জীবনযাপন, সহজ-সরল অভিব্যক্তি এবং স্পষ্টবাদিতায়। একবাক্যে তার বাঙালিত্বে। আমি স্মরণ করতে পারি বঙ্গবন্ধু কেবল তার রাজনৈতিক দল নয়, ছাত্র বা শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। এমনকি তাদের পারিবারিক তথ্যও মনে রাখতেন। সেই মানুষটির সাধারণ মূল্যায়ন যখন আমরা করি তখন কেবল তার বাংলাদেশ সৃষ্টির বিষয়টিকে প্রাধ্যান্য দিই। যে সময়ে ব্রিটিশরা পুরা উপমহাদেশটিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলঙ্কিত করে দুটি অদ্ভুত রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো এবং পুরো উপমহাদেশের তাবত বড় বড় রাজনীতিবিদরা সেই সাম্প্রদায়িকতাকেই মাথায় তুলে নিয়েছিলেন তখন তিনি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের বিপরীতে একটি ভাষাভিত্তিক আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের দূরদর্শী স্বপ্ন দেখেন। ভাবা যায় যে, পাকিস্তান তৈরির ৫ মাসের মাঝে জিন্নার মুখের ওপর কেউ না না চিৎকার করে নিজের মাতৃভাষার দাবিকে উত্থাপন করতে পারেন। এ অঞ্চলে ভাষা রাষ্ট্র ধারণা তখন মোটেই গুরুত্ব পায় নাই। ভারত বহুভাষিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

খুব সঙ্গত কারণেই ভারতের ধর্ম রাষ্ট্র হবারও খুব সুযোগ ছিলো না। তবুও ব্রিটিশরা ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করেছিলো। ভারতের নেতারাও সেটি প্রচ্ছন্নভাবে মেনে নিয়েছিলেন। তবে পাকিস্তান হয়ে ওঠে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু সেই মানুষ যিনি বাংলাদেশের অন্তরকে অনুভব করেন এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতা যে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং বাঙালি যে তার ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সবার ওপরে ঠাঁই দেয় এবং তার এই জীবনধারায় ধর্ম যে কেবল ব্যক্তিগত বিষয় এবং রাষ্ট্রের রাজনীতির প্রধান শক্তি নয়, সেটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। আমি নিজে অভিভূত হই যখন দেখি যে তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে থেকে তার রাজনৈতিক সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি উপড়ে ফেলে দিতে পেরেছিলেন। যে মানুষটি নিজেকে স্পষ্ট করে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে পারেন যে তিনি বাঙালি, মানুষ এবং তারপরে মুসলমান, কেবল সেই মানুষটিই পাকিস্তানের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের চোখের সামনে পাকিস্তানের কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে ধর্ম নিরপেক্ষ করতে পারেন!

আজ তার মৃত্যুর এত বছর পর আমাদের আইনমন্ত্রীকে বলতে হয় যে, আমরা অবশ্যই ৭২ সালের সংবিধানে ফেরৎ যাবো। তিনি নিজেই অনুভব করেন যে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আমরা ফেরৎ যেতে পারিনি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা দেশটিকে যেভাবে পাকিস্তানের দূরবর্তী অঙ্গরাজ্য বানিয়েছিলো, সেটির সংবিধান আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো করে ফিরে পেতে পারিনি। ভাবুন দেখি, তিনি তার দলের নাম থেকে কেবল মুসলিম শব্দ বর্জন করেননি, মুসলমানদের রাষ্ট্র পাকিস্তানকে পরাজিত করে সেখানে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। আমার জানা মতে, তার হাতে তৈরি ৭২ সালের সংবিধানটি হচ্ছে দুনিয়ার অন্যতম সেরা সংবিধান যার সাথে তুলনা করার মতো কোন সংবিধান অন্তত এ অঞ্চলে পাওয়া যায় না। এই সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে জিয়া ও এরশাদ কেবল যে সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত করে তাই নয়, এর গণতান্ত্রিক চরিত্রও বিনষ্ট করে। আমাদের জন্য দুঃখজনক যে ৭৫ থেকে ৯৬ অবধি দেশে এমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি গড়ে তোলা হয় যে বঙ্গবন্ধুর কন্যার পক্ষেও এখন ৭২-এর সংবিধানের পরিপূর্ণ মূল চরিত্রে ফেরৎ যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখন যদি তিনি সেই কাজটি করেন তবে রাজনীতির ছকটাকে উল্টানোর অপচেষ্টা করা হবে এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতোই সাম্প্রদায়িক, জঙ্গি ও একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার রাজনীতি প্রবলভাবে জোরদার করা হবে। সংবিধানকে নিয়েই মুসলিম আবেগ জোরদার করা হবে এবং এর জন্য যতো রকমের ষড়যন্ত্র করা যায় সেটি করাই হবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর সময়কালের বিশ্ব পরিস্থিতি এখন আর বিরাজ করে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপ দুর্বল হবার পর পুঁজিবাদের একতরফা বিকাশ, চীনের আপোসকামিতা ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবার ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হুবহু যেতে পারছি না। আজকের তরুণরা বঙ্গবন্ধুকে সেভাবে বুঝবেন না, যেভাবে আমরা তাকে চিনি। বঙ্গবন্ধুর বাঙালিত্ব, তার প্রতি একনিষ্ঠতা এবং জাতিসত্তা বিষয়ে অত্যন্ত ষ্পষ্ট নীতিমালা আমার মতো লাখো লাখো তরুণকে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র গঠনে জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

যারা এখন মনে করেন যে, পাকিস্তান আমাদের ঠকিয়েছে, ন্যায্য পাওনা দেয়নি এবং বনিবনা হয়নি বলে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে তারা বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শকে পুরোটা বুঝতেই পারেন না। কোন সন্দেহ নাই যে, তিনি পাকিস্তানের কাঠামোতে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এমনভাবে গড়ে তুলেন যে সারা দুনিয়ার কাছে আমরা এটি প্রমাণ করেছি যে, আমাদের সশস্ত্র যুদ্ধের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ৪৮ সালেই তিন এটি বুঝেছিলেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাঙালিদের নয় এবং বাঙালিদের একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেজন্য তিনি একদিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন; অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতিও গড়ে তুলেছেন। তিনি একদিকে নির্বাচন করেছেন, অন্যদিকে আমাদের কণ্ঠে বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর সেই স্লোগানও তুলে দিয়েছেন।

বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বুঝতে হলে তার তৈরি করা ৭২-এর সংবিধান বুঝতে হবে। তার ৭২ সালের সংবিধানের মূলমন্ত্র ছিলো চারটি। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপক্ষেতা ও জাতীয়তাবাদ। ধীরে ধীরে আমরা সেই চার নীতির গণতন্ত্র ছাড়া বাকি সবগুলোই এড়িয়ে চলেছি। আজকের বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র শব্দটি কেউ উচ্চারণ করে না; কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে সমাজতন্ত্র ছাড়া মুক্তির কোন পথ নেই। হয়তো কার্লমার্ক্সের সমাজতন্ত্র ডিজিটাল যুগে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করতে ডিজিটাল যুগের সমাজতন্ত্র ও তার ধারণা কাজে লাগানো ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। এক সময়ে কায়িক শ্রমনির্ভর মালিক শ্রমিক কাঠামোটি দিনে দিনে মেধা শ্রমভিত্তিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে শ্রেণি-চরিত্র বা শ্রেণি-সংগ্রামের সংজ্ঞা বদলাচ্ছে। কোন এক মার্ক্সকে নতুন করে সমাজতন্ত্রের কথা বর্ণনা করতে হবে- ব্যাখ্যা করতে হবে মালিক-শ্রমিক ও উৎপাদন ব্যবস্থা। শিল্পযুগের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের ব্যবস্থা শিল্প বিপ্লবের চতুর্থ বা পঞ্চম স্তরে চলতে পারে না।

অন্যদিকে পুঁজিবাদের রূপান্তরে তার মূল্যায়নও অন্যভাবেই করতে হবে। চীন একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়েও পুঁজিবাদের ধারণাকে ভিন্নভাবে প্রয়োগ করে নতুন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ধারণা তুলে ধরেছে। তবে সমাজতন্ত্র যে বৈষম্যহীনতার ধারণাকে জন্ম দিয়েছে সেটি দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে না। বরং সমাজতন্ত্রের ডিজিটাল ধারাটির জন্য সারা দুনিয়ায় নতুন করে লড়াই চলবে। অন্যদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য বাংলাদেশকে আবার লড়াই করতে হচ্ছে। জিয়া-এরশাদ-খালেদা বাংলাদেশকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার অপচেষ্টা করেছে এবং সারা দুনিয়ার ধর্ম পরিস্থিতি যেমনটা তাতে বাংলাদেশের জন্য ধর্মনিরপেক্ষেতা বজায় রাখাকেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। একই কারণে বাঙালির জাতিসত্তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে।

তথাকথিত শিক্ষিত লোকরা বিয়ের কার্ডটাতেও বাংলা হরফ ব্যবহার করে না। এই হীনমন্য জাতির ভবিষ্যৎ কী? যে ভাষা রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন সেখান থেকে সরে গিয়ে আমরা কোন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলছি-

নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল কথাগুলো তুলে ধরা হয়নি বলে এখন তরুণরা ইসলামী জঙ্গিতে রূপান্তরিত হয়। অথচ বঙ্গবন্ধুকে তো বটেই পুরো বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানিরা অমুসলিম বানাতে চেষ্টা করেও সফল হয়নি। একাত্তরে তারা স্পষ্ট করেই বলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা মুসলমান নয়। আমরা পাকিস্তানিদের পরাজিত করে এর জবাব দিয়েছি।

বঙ্গবন্ধুর জন্য আমার চোখের পানি আসে আরও একটি বিশাল কারণে। তাকে ছাড়া আমি নিজেকে অসহায় মনে করছি। আমার নিজের মতে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রয়োগ করার অনন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি, যে মুজিব অপটিমা মুনীর টাইপ রাইটার বানিয়েছিলেন। আমি সেই মুজিবের কথা ভাবি যিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার আগেই বলেছিলেন, ভুল হোক শুদ্ধ হোক আমরা সরকারি কাজে বাংলাই লিখবো। কালক্রমে জিয়া এরশাদ ও খালেদা সেই মুজিবের আদর্শ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সরানোর চেষ্টা করেছে। ভাষার কথাই বলি। বাংলাদেশের বেসরকারি অফিসে বাংলা বর্ণমালাই নেই। সরকারের কাজে-কর্মে বাংলা ভাষা বিরাজ করে। কিন্তু যখনই আমরা এর ডিজিটাল রূপান্তর করছি তখন বাংলা অবহেলার বিষয় হয়ে ওঠছে।

বস্তুত ডিজিটাল করার নামে বাংলা হরফকে অনেক ক্ষেত্রেই বিদায় করা হয়। উচ্চ আদালতে ও উচ্চশিক্ষায় বাংলা নেই। যে মানুষটি ৫২ সালে চীনে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলায় ভাষণ দেন এবং যিনি সদ্যোজাত দেশের পক্ষে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরেছিলেন সেই মানুষটির দেশে এখন চারপাশে রোমান হরফের রাজত্ব দেখি। একটি সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল বলছে, ফেসবুকে শতকরা মাত্র ৮ ভাগ বাঙালি বাংলা ব্যবহার করে। কী ভয়ংকর একটি চিত্র এতে প্রকাশিত হয়। আমি চাই না আমার অনুমান সত্য হোক, কিন্তু মনে হচ্ছে এক সময়ে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বা গ্রামের মানুষ ছাড়া বাংলা হরফই আমরা দেখবো না। আপনি চারপাশে খোঁজ নিলেই দেখবেন, তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা বিয়ের কার্ডটাতেও বাংলা হরফ ব্যবহার করে না। এই হীনমন্য জাতির ভবিষ্যৎ কী? যে ভাষা রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন সেখানে থেকে সরে গিয়ে আমরা কোন জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলছি- সেটি আমি মোটেই বুঝি না। আসুন না সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষা রাষ্ট্রটাকেই বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করি। আসুন সকল ক্ষেত্রে সেই একজন বাঙালিকেই অনুসরণ করি যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী]

back to top