alt

উপ-সম্পাদকীয়

ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরা ভালো নেই

মিথুশিলাক মুরমু

: সোমবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৩

গত ২৭ জানুয়ারি ‘ন্যাশনাল খ্রিস্টিয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশ’ (এনসিএফবি) আয়োজনে রিলিজিয়াস ফ্রিডম ওয়ার্কশপ-এ অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখান থেকে জানলাম, দেশে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ভালো নেই। এ ওয়ার্কশপে মৌলভীবাজার, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, বান্দরবান, জামালপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, ঢাকা থেকে ধর্মীয়ভাবে নির্যাতিত ও অত্যাচারিত খ্রিস্টানুসারীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। এছাড়াও কর্মশালায় ধর্মীয় নেতা, আইনজীবী ও বিভিন্ন মিডিয়ায় কর্মরত খ্রিস্টান পেশাজীবীরাও উপস্থিত থেকে কর্মশালাতে মতামত ব্যক্ত করেছেন। দেশের খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্য-সাঁওতাল, খাসিয়া, গারো, ত্রিপুরা, বম, মুণ্ডা, উরাঁও, কোচ, পাংখোয়া প্রভৃতি। এনসিএফবি’র কর্মশালায় জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা হৃদয় বিদারক ঘটনাগুলোর বর্ণনা করেছেন। প্রথমত তারা ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। সেটি হোক না আদিবাসী ধর্ম থেকে কিংবা হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্ম থেকে। স্বজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়, স্বতপ্রণোদিত হয়ে তারা খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। কারো প্ররোচনায় নয়, কোনো লোভে নয়; একান্ত মানসিক প্রশান্তি ও পরজগতে স্রষ্টার সান্নিধ্য প্রাপ্তির প্রত্যাশায় তারা ধর্মান্তরিত হন। এটি একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, অভিরুচি ও মৌলিক অধিকার। ধর্ম গ্রহণের পরেই ধর্মীয়ভাবে সমাজচ্যুত করা হয়। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে কেউ-ই উঠা-বসা, লেনদেন করতে আগ্রহী হন না।

এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তান-সন্ততিদের ভর্তির জটিলতা, এনআইডি-সার্টিফিকেট সংশোধনে হয়রানি, মিথ্যা মামলা-মোকাদ্দমায় জড়িয়ে তাদেরকে হয়রানি করে সমাজেরই কেউ কেউ । হত্যার হুমকি পেতে হয়। উপর্যপুরি হামলার শিকার হয়ে তটস্ত থাকতে হয়েছে অনেককে।

দেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কেন এই হয়রানি? শুধুমাত্র কি ধর্ম গ্রহণের জন্যই? হিন্দু থেকে ইসলাম, খ্রিস্টান থেকে ইসলাম, বৌদ্ধ থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ সহজ। তবে ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধ থেকে খ্রিস্টান ধর্মে বা আদিবাসী থেকে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইসলাম ধর্ম গ্রহণে ব্যতিক্রমতা রয়েছে। বাংলাদেশের স্থপতি, সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে’।

প্রধানমন্ত্রী বারবার উল্লেখ করে থাকেন, ‘ধর্ম যার যার’। অর্থাৎ একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় হচ্ছে ধর্ম। এর ওপর কারো জোরজবস্তি করা চলবে না। আমাদের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে-ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি যেন নিজস্ব ধর্ম হৃদয় থেকে, মন দিয়ে, পরিপূর্ণতার সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতি-রেওয়াজ যথোপযুক্তভাবে পালন ও উদযাপন করতে পারে। সত্যিকারের ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি সব সময় কল্যাণ, মঙ্গলজনক ও মানুষের প্রতি দায়িত্বমূলক কাজ করে স্রষ্টার আনুকূল্য পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন।

দ্বিতীয়ত খ্রিস্টিয়ানদের অত্যাচারের পেছনে জায়গা-জমি র প্রতি লোভ-লালসা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চার্চ বা গির্জার সম্পত্তি কৌশলে করায়ত্বের জন্যে উঠে পড়ে লেগে থাকে প্রভাবশালীরা। রাজশাহী কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানার পাশে রয়েছে ‘বাংলাদেশ নর্দান ইভানজেলিক্যাল লুথারেন চার্চ’ (বিএনইএলসি)- এর ০.২৯৭৫ একর জায়গা। নাটোর-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রোডের লাগোয়া চার্চের এই জায়গা থেকে

দীর্ঘদিন চার্চ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছিল, বর্তমানে এটি জরাজীর্ণ হওয়ায় পরিত্যক্ত। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ করেই একদিন একটি সাইনবোর্ড দেখা যায়-সরকারি সম্পত্তি, নিম্ন তফসিলভুক্ত সম্পত্তির মালিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পক্ষে জেলা প্রশাসক, রাজশাহী। এর

কয়েকদিন পরই আরো একটি ব্যানার টাঙ্গানো হয়-অস্থায়ী কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনা...সমিতি, রাজশাহী। উল্লেখ্য যে, কৈলাস চন্দ্র স্যানাল-এর একমাত্র পুত্র দীনেশ চন্দ্র স্যানালের কাছ থেকে ২৩ এপ্রিল, ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ৭১৭৩/৫৭ নম্বর বিক্রয় কবলা দলিল মূলে রেভা. জন এন অটেশন ইস্ট পাকিস্তান মিশন অফ দি নরদান চার্চ, রাজশাহী ব্রাঞ্চ, রাজশাহী বরাবরে হস্তান্তর করিয়া দখল স্বত্ত্ব ছাড়িয়া দিয়া নিঃস্বত্ত্ব হন। তারপর রাজশাহীর কিছু এলাকায় সাম্প্রদায়িকতা দেখা দিলে মিশনের কর্মকর্তারা সাময়িকভাবে না থাকায় সরকারের নামে ভুলভাবে তা রেকর্ডভুক্ত হয়। ১৯৮২-৮৩

দেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কেন এই হয়রানি? শুধু কি ধর্ম গ্রহণের জন্যই?

খ্রস্টাব্দে ডিক্রিপ্রাপ্ত হলেও সরকার পক্ষ পুনর্বার মোকাদ্দমা করেন। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে। স্বাধীনতার পর চার্চ প্রতিষ্ঠানটি নতুন নাম ধারণ করে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে খ্রিস্টানুসারীদের সেবা দিয়ে আসছে। চার্চের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে ডিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ডিসি বলেন, সম্পত্তির মামলা চলাকালীন কেউ-ই লিজ বা ভাড়া নিতে পারে না এবং এডিসিকে ওই সম্পত্তির কাগজপত্র অধিক পর্যালোচনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত করেছেন। অদ্যাবধি এডিসি মহোদয় নীরব রয়েছেন। এরূপ ঘটনার শিকার ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার রাজাশন এবং নবাবগঞ্জের আঠার গ্রামের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও। তৃতীয়ত প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খ্রিস্টানরা সর্বদাই উন্মুখ হয়ে থাকে। সামাজিক যে কোনো কাজকর্মে বেশ সাড়া দেয় ও অংশগ্রহণ করে থাকে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরের কিংবা বৈশি^ক ধর্মীয় বিদ্দেষমূলক কোনো ঘটনায় প্রতিবেশীরা সম্প্রীতিমূলক আচরণ না করে সহিংসমূলক আচরণের শিকার হয়ে থাকে। সম্প্রতিককালে সুইডেন ও নেদারল্যাণ্ডে কোরআন শরীফ পোড়ানোর মতো ঘটনায় এ দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা, সংযুক্ততা খোঁজা ধর্মীয় মিল ছাড়া কিছুই নেই। তারপরও অতীতের ঘটনাগুলোর স্মরণে আমাদের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায় আতঙ্কিত। দৈনন্দিন জীবনে অস্বস্তিতে রয়েছে তারা। বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায় ধর্মীয় বিদ্দেষমূলক ঘটনার যেমন প্রতিবাদ করে থাকেন, তেমনি কারো কর্তৃক ধর্মীয় সহিংসতার শিকার কামনা করেন না।

চতুর্থত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ৩য় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ‘খ্রিস্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ প্রণীত হলেও আদৌ খ্রিস্টান শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাদান নিশ্চিত সম্ভবপর হয়নি। জরিপে দেখা গেছে, প্রটেস্ট্যান্ট ছেলেমেয়েরা জেএসসি, এসএসসি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষায় শুধুমাত্র খ্রিস্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার জন্যে জিপিএ-৫ পেতে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষা জীবনের এই স্তরগুলোতে খ্রিষ্ট ধর্মের শিক্ষক বা সহায়ককারী না থাকায় উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় চার্চগুলোর পুরোহিতরা বিদ্যালয়গুলোতে সহযোগিতা প্রদান বা প্রত্যাশায় প্রধান শিক্ষকগদের সঙ্গে আলোচনার লক্ষ্যে গমন করলে, পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ আচরণ লক্ষ্যণীয়। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর নিজ নিজ ধর্ম অধ্যয়ন ও পরীক্ষা দেয়ার অধিকার রয়েছে, এক্ষেত্রে স্থানীয় শিক্ষা অফিসারসহ প্রশাসনের অগ্রণী ভূমিকা প্রত্যাশা করি। দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায় সর্বদা রাষ্ট্রের কল্যাণে নিরলসভাবে নিয়োজিত রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়নে সুনাম ছড়িয়েছে; অন্যান্য ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই। দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ নিদর্শন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। তাদের অবদান স্বীকার্য। স্বাধীনতার সব সংগ্রামে পাশে থেকেছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়। বাইবেলে খ্রিস্টানুসারীদের বলা হয়েছে, লবণ ও আলো স্বরূপ হতে। লবণ খাবারকে স্বাদযুক্ত করে আর আলো দূর করে অন্ধকারকে। খ্রিস্টান সম্প্রদায় চিন্তা-চেতনায়, কর্মে- বিশ্বাসে বাংলাদেশকে ভালোবাসে। খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা, বৈষম্যহীনতা ও ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে।

[লেখক: কলামিস্ট]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টানরা ভালো নেই

মিথুশিলাক মুরমু

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৩

গত ২৭ জানুয়ারি ‘ন্যাশনাল খ্রিস্টিয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশ’ (এনসিএফবি) আয়োজনে রিলিজিয়াস ফ্রিডম ওয়ার্কশপ-এ অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখান থেকে জানলাম, দেশে বসবাসরত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ভালো নেই। এ ওয়ার্কশপে মৌলভীবাজার, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, বান্দরবান, জামালপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, ঢাকা থেকে ধর্মীয়ভাবে নির্যাতিত ও অত্যাচারিত খ্রিস্টানুসারীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। এছাড়াও কর্মশালায় ধর্মীয় নেতা, আইনজীবী ও বিভিন্ন মিডিয়ায় কর্মরত খ্রিস্টান পেশাজীবীরাও উপস্থিত থেকে কর্মশালাতে মতামত ব্যক্ত করেছেন। দেশের খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সদস্য-সাঁওতাল, খাসিয়া, গারো, ত্রিপুরা, বম, মুণ্ডা, উরাঁও, কোচ, পাংখোয়া প্রভৃতি। এনসিএফবি’র কর্মশালায় জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা হৃদয় বিদারক ঘটনাগুলোর বর্ণনা করেছেন। প্রথমত তারা ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। সেটি হোক না আদিবাসী ধর্ম থেকে কিংবা হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্ম থেকে। স্বজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়, স্বতপ্রণোদিত হয়ে তারা খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। কারো প্ররোচনায় নয়, কোনো লোভে নয়; একান্ত মানসিক প্রশান্তি ও পরজগতে স্রষ্টার সান্নিধ্য প্রাপ্তির প্রত্যাশায় তারা ধর্মান্তরিত হন। এটি একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, অভিরুচি ও মৌলিক অধিকার। ধর্ম গ্রহণের পরেই ধর্মীয়ভাবে সমাজচ্যুত করা হয়। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে কেউ-ই উঠা-বসা, লেনদেন করতে আগ্রহী হন না।

এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তান-সন্ততিদের ভর্তির জটিলতা, এনআইডি-সার্টিফিকেট সংশোধনে হয়রানি, মিথ্যা মামলা-মোকাদ্দমায় জড়িয়ে তাদেরকে হয়রানি করে সমাজেরই কেউ কেউ । হত্যার হুমকি পেতে হয়। উপর্যপুরি হামলার শিকার হয়ে তটস্ত থাকতে হয়েছে অনেককে।

দেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কেন এই হয়রানি? শুধুমাত্র কি ধর্ম গ্রহণের জন্যই? হিন্দু থেকে ইসলাম, খ্রিস্টান থেকে ইসলাম, বৌদ্ধ থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ সহজ। তবে ইসলাম-হিন্দু-বৌদ্ধ থেকে খ্রিস্টান ধর্মে বা আদিবাসী থেকে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইসলাম ধর্ম গ্রহণে ব্যতিক্রমতা রয়েছে। বাংলাদেশের স্থপতি, সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে’।

প্রধানমন্ত্রী বারবার উল্লেখ করে থাকেন, ‘ধর্ম যার যার’। অর্থাৎ একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় হচ্ছে ধর্ম। এর ওপর কারো জোরজবস্তি করা চলবে না। আমাদের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে-ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি যেন নিজস্ব ধর্ম হৃদয় থেকে, মন দিয়ে, পরিপূর্ণতার সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতি-রেওয়াজ যথোপযুক্তভাবে পালন ও উদযাপন করতে পারে। সত্যিকারের ধর্ম গ্রহণকারী ব্যক্তি সব সময় কল্যাণ, মঙ্গলজনক ও মানুষের প্রতি দায়িত্বমূলক কাজ করে স্রষ্টার আনুকূল্য পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন।

দ্বিতীয়ত খ্রিস্টিয়ানদের অত্যাচারের পেছনে জায়গা-জমি র প্রতি লোভ-লালসা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চার্চ বা গির্জার সম্পত্তি কৌশলে করায়ত্বের জন্যে উঠে পড়ে লেগে থাকে প্রভাবশালীরা। রাজশাহী কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানার পাশে রয়েছে ‘বাংলাদেশ নর্দান ইভানজেলিক্যাল লুথারেন চার্চ’ (বিএনইএলসি)- এর ০.২৯৭৫ একর জায়গা। নাটোর-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রোডের লাগোয়া চার্চের এই জায়গা থেকে

দীর্ঘদিন চার্চ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছিল, বর্তমানে এটি জরাজীর্ণ হওয়ায় পরিত্যক্ত। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ করেই একদিন একটি সাইনবোর্ড দেখা যায়-সরকারি সম্পত্তি, নিম্ন তফসিলভুক্ত সম্পত্তির মালিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পক্ষে জেলা প্রশাসক, রাজশাহী। এর

কয়েকদিন পরই আরো একটি ব্যানার টাঙ্গানো হয়-অস্থায়ী কার্যালয়, বিভাগীয় কমিশনা...সমিতি, রাজশাহী। উল্লেখ্য যে, কৈলাস চন্দ্র স্যানাল-এর একমাত্র পুত্র দীনেশ চন্দ্র স্যানালের কাছ থেকে ২৩ এপ্রিল, ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ৭১৭৩/৫৭ নম্বর বিক্রয় কবলা দলিল মূলে রেভা. জন এন অটেশন ইস্ট পাকিস্তান মিশন অফ দি নরদান চার্চ, রাজশাহী ব্রাঞ্চ, রাজশাহী বরাবরে হস্তান্তর করিয়া দখল স্বত্ত্ব ছাড়িয়া দিয়া নিঃস্বত্ত্ব হন। তারপর রাজশাহীর কিছু এলাকায় সাম্প্রদায়িকতা দেখা দিলে মিশনের কর্মকর্তারা সাময়িকভাবে না থাকায় সরকারের নামে ভুলভাবে তা রেকর্ডভুক্ত হয়। ১৯৮২-৮৩

দেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কেন এই হয়রানি? শুধু কি ধর্ম গ্রহণের জন্যই?

খ্রস্টাব্দে ডিক্রিপ্রাপ্ত হলেও সরকার পক্ষ পুনর্বার মোকাদ্দমা করেন। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে। স্বাধীনতার পর চার্চ প্রতিষ্ঠানটি নতুন নাম ধারণ করে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে খ্রিস্টানুসারীদের সেবা দিয়ে আসছে। চার্চের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে ডিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ডিসি বলেন, সম্পত্তির মামলা চলাকালীন কেউ-ই লিজ বা ভাড়া নিতে পারে না এবং এডিসিকে ওই সম্পত্তির কাগজপত্র অধিক পর্যালোচনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত করেছেন। অদ্যাবধি এডিসি মহোদয় নীরব রয়েছেন। এরূপ ঘটনার শিকার ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার রাজাশন এবং নবাবগঞ্জের আঠার গ্রামের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও। তৃতীয়ত প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খ্রিস্টানরা সর্বদাই উন্মুখ হয়ে থাকে। সামাজিক যে কোনো কাজকর্মে বেশ সাড়া দেয় ও অংশগ্রহণ করে থাকে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরের কিংবা বৈশি^ক ধর্মীয় বিদ্দেষমূলক কোনো ঘটনায় প্রতিবেশীরা সম্প্রীতিমূলক আচরণ না করে সহিংসমূলক আচরণের শিকার হয়ে থাকে। সম্প্রতিককালে সুইডেন ও নেদারল্যাণ্ডে কোরআন শরীফ পোড়ানোর মতো ঘটনায় এ দেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা, সংযুক্ততা খোঁজা ধর্মীয় মিল ছাড়া কিছুই নেই। তারপরও অতীতের ঘটনাগুলোর স্মরণে আমাদের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায় আতঙ্কিত। দৈনন্দিন জীবনে অস্বস্তিতে রয়েছে তারা। বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায় ধর্মীয় বিদ্দেষমূলক ঘটনার যেমন প্রতিবাদ করে থাকেন, তেমনি কারো কর্তৃক ধর্মীয় সহিংসতার শিকার কামনা করেন না।

চতুর্থত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ৩য় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ‘খ্রিস্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা’ প্রণীত হলেও আদৌ খ্রিস্টান শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাদান নিশ্চিত সম্ভবপর হয়নি। জরিপে দেখা গেছে, প্রটেস্ট্যান্ট ছেলেমেয়েরা জেএসসি, এসএসসি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষায় শুধুমাত্র খ্রিস্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার জন্যে জিপিএ-৫ পেতে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষা জীবনের এই স্তরগুলোতে খ্রিষ্ট ধর্মের শিক্ষক বা সহায়ককারী না থাকায় উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় চার্চগুলোর পুরোহিতরা বিদ্যালয়গুলোতে সহযোগিতা প্রদান বা প্রত্যাশায় প্রধান শিক্ষকগদের সঙ্গে আলোচনার লক্ষ্যে গমন করলে, পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ আচরণ লক্ষ্যণীয়। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর নিজ নিজ ধর্ম অধ্যয়ন ও পরীক্ষা দেয়ার অধিকার রয়েছে, এক্ষেত্রে স্থানীয় শিক্ষা অফিসারসহ প্রশাসনের অগ্রণী ভূমিকা প্রত্যাশা করি। দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায় সর্বদা রাষ্ট্রের কল্যাণে নিরলসভাবে নিয়োজিত রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়নে সুনাম ছড়িয়েছে; অন্যান্য ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই। দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ নিদর্শন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। তাদের অবদান স্বীকার্য। স্বাধীনতার সব সংগ্রামে পাশে থেকেছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়। বাইবেলে খ্রিস্টানুসারীদের বলা হয়েছে, লবণ ও আলো স্বরূপ হতে। লবণ খাবারকে স্বাদযুক্ত করে আর আলো দূর করে অন্ধকারকে। খ্রিস্টান সম্প্রদায় চিন্তা-চেতনায়, কর্মে- বিশ্বাসে বাংলাদেশকে ভালোবাসে। খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা, বৈষম্যহীনতা ও ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে।

[লেখক: কলামিস্ট]

back to top