জহির চৌধুরী
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে গত ১১ মে রাজধানীতে ‘কোভিড ১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসএমই খাতের উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মশালায় শিল্পপ্রতিমন্ত্রী কামাল আহমদ মজুমদার বলেছেন, ‘অর্থনীতি ও বাজার- এ দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের দাম বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মানুষ বাজার করতে গিয়ে এখন কাঁদছে। এই সিন্ডিকেট ধরতে এবং ভাঙতে না পারলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দায়িত্বে থাকা উচিত নয়। দেশ এগিয়ে চলছে, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। তারপরও দেশে আজ যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, ব্যবসার নামে আজকে যে লুটপাট হচ্ছে, মানুষের পকেট কাটা যাচ্ছে, এগুলো সাংবাদিকদের আরো জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে; এগুলো আরো ফোকাস করতে হবে। আজকে আমরা দেখছি, যে ব্যক্তি লুটপাট করে বড়লোক হচ্ছে তাকে আরো সুযোগ দিচ্ছি। ফলে কিছু ব্যক্তির হাতে ব্যাংক থেকে শুরু করে গোটা অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে। এই সিন্ডিকেট আমাদের ভাঙতে হবে।’
দেশে অতিলোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট গড়ে সাধারণ মানুষ তথা ভোক্তার পকেট প্রকারান্তরে ডাকাতি দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যেই চলছে। বাংলাদেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যেভাবে ভোক্তার পকেট প্রকারান্তরে ডাকাতি করে বা করছে তা দুনিয়ায় নজিরবিহীন। যদি বলা হয়, বাংলাদেশ অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বেপরোয়া লুটপাটের জায়গায় পরিণত হয়েছে তা হলে অত্যুক্তি হবে না। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের ‘চিনিতে প্রতিদিন লুট ১৭ কোটি টাকা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে চিনি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকার নির্ধারিত মূল্য থোরাই কেয়ার করে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। দেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের রাম রাজত্ব দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বলেছেন, ‘পাঁচ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে চিনির দাম বাড়াচ্ছে।’
সংবাদ মাধ্যমের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে মাত্র দেড় মাসে চার ধাপে মূল্য বাড়িয়ে পোঁয়াজ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রায় ২০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তেলের দর বাড়িয়ে কমবেশি এক মাসের মধ্যে প্রায় ১ হাজার কোটি কামিয়েছে। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন হিসাব কষে দেখিয়েছে পোল্ট্রি খাতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট মাত্র ৫২ দিনে কিভাবে ভোক্তার পকেট থেকে ৯৩৬ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। গত বছর যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংবাদ সম্মেলনে প্রতিদিন গণপরিবহনে যাত্রীর পকেট থেকে ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের তথ্য দিয়েছে।
দেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের লুটপাট অদম্য-অপ্রতিরোধ্য বলা যায়। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দাপট-দৌরাত্ম্যে মনে হয় এদের দমনের কেউ নেই, এদের কাছে সরকারও অসহায়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা অনেকেই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দমনের কথা বিভিন্ন সময় শুনিয়েছেন।
‘জাতীয় রপ্তানি ট্রফি-২০১৭-১৮’ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরূদ্ধে কঠোর হতে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। দমন এবং বিচারের আওতায় আনার কাজটি করতে দেখা যায় না। গত বছরের মাঝামাঝি ডিম ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ডিমের দামবৃদ্ধি করে মাত্র ১৪/১৫ দিনে ৫ শতাধিক কোটি টাকা ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ ডিমের মূল্য রকেট গতিতে বৃদ্ধি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মতবিনিময় সভায় বিষয়টি আলোচনা হয়।
মতবিনিমিয় সভায় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেছেন, ‘যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে বড় বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কারণে ডিমের দাম বেড়েছে।’ ধানের ভরা মৌসুমে চালের দাম কমা প্রথা। সাস্প্রতিক বছরগুলোতে ধানের ভরা মৌসুমেও চালের মূল্যবৃদ্ধি লক্ষণীয়। চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ধানের ভরা মৌসুমেও খেয়াল-খুশিমতো চালের মূল্যবৃদ্ধি করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশের ৬টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান চাল মজুত করে বেশি দামে চাল বিক্রি করেছে। দেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বেপরোয়া দাপট-দৌরাত্ম্য, পরিচয়, প্রভাব অনবগুণ্ঠিতই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)-এর ‘বাংলাদেশে চাল, আলু ও পেঁয়াজের প্রাপ্যতা ও দামে অস্থিরতা : একটি আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদন ২০২০’-এ বলা হয়েছে, ‘সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতায় দাম বাড়ে নিত্যপণ্যের।’
অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে, দমাতে সরকারে ভূমিকা আশানুরূপ নয়, কেন আশানুরূপ নয় তা বিরাট প্রশ্ন। অভিযোগ আছে, সরকারের একটি প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যোগসাজশের। সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, ঋণখেলাপিসহ স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে বলতে গিয়ে শিল্প প্রতিমন্ত্রী একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, ‘মন্ত্রীদের ভেতরে একটা সিন্ডিকেট আছে।’
সহজেই অনুমেয় যে, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের খুঁটির জোর বেশ শক্ত। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নেপথ্যের শক্তি কে বা কারা সে প্রশ্নের চেয়ে রাষ্ট্র কেন অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে, দমাতে ব্যর্থ হবে বা হচ্ছে সে প্রশ্ন দেশের আপামর মানুষের। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দেশের মানুষের পকেট লুটছে, দেশের মানুষকে নিঃস্ব-রিক্ত করছে। বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স স্টাডিজ (বিআইজিডি)-এর গত বছরের ১৪ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত চালানো যৌথ জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২১ লাখ মানুষ।
চোখের সামনেই দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে লুণ্ঠন চলছে, লুণ্ঠনে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এমতাবস্থায় রাষ্ট্র নির্বিকার থাকতে পারে না। ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। নাগরিকদের ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ইচ্ছামতো পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়বে, দেশের সাধারণ মানুষ মূল্য সন্ত্রাসের জুলুমের প্রতিকার পাবে না- এটা অবিচার।
অতিরিক্ত মূল্যের জুলুমে সাধারণ মানুষ কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মূল্যের জুলুম থেকে রেহাই পেতে সাধারণ মানুষ সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে। সাধারণ মানুষকে অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মূল্যের জুলুম থেকে রক্ষায় সরকার এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ মানুষ যদি অসাধু ব্যবসায়ীদের মূল্যসন্ত্রাসের জুলুম থেকে রক্ষা পেতে সরকারকে পাশে না পায় তাহলে আহকামুল হাকিমের দরবারে ফরিয়াদ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মূল্যবৃদ্ধির জুলুমে সাধারণ মানুষ চিঁড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছে, নিঃস্ব হচ্ছে, আর্তনাদ করছে, কাঁদছে- এর অবসান জরুরি।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]
জহির চৌধুরী
সোমবার, ২২ মে ২০২৩
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে গত ১১ মে রাজধানীতে ‘কোভিড ১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসএমই খাতের উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কর্মশালায় শিল্পপ্রতিমন্ত্রী কামাল আহমদ মজুমদার বলেছেন, ‘অর্থনীতি ও বাজার- এ দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের দাম বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মানুষ বাজার করতে গিয়ে এখন কাঁদছে। এই সিন্ডিকেট ধরতে এবং ভাঙতে না পারলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দায়িত্বে থাকা উচিত নয়। দেশ এগিয়ে চলছে, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। তারপরও দেশে আজ যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, ব্যবসার নামে আজকে যে লুটপাট হচ্ছে, মানুষের পকেট কাটা যাচ্ছে, এগুলো সাংবাদিকদের আরো জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে; এগুলো আরো ফোকাস করতে হবে। আজকে আমরা দেখছি, যে ব্যক্তি লুটপাট করে বড়লোক হচ্ছে তাকে আরো সুযোগ দিচ্ছি। ফলে কিছু ব্যক্তির হাতে ব্যাংক থেকে শুরু করে গোটা অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে। এই সিন্ডিকেট আমাদের ভাঙতে হবে।’
দেশে অতিলোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট গড়ে সাধারণ মানুষ তথা ভোক্তার পকেট প্রকারান্তরে ডাকাতি দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যেই চলছে। বাংলাদেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যেভাবে ভোক্তার পকেট প্রকারান্তরে ডাকাতি করে বা করছে তা দুনিয়ায় নজিরবিহীন। যদি বলা হয়, বাংলাদেশ অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বেপরোয়া লুটপাটের জায়গায় পরিণত হয়েছে তা হলে অত্যুক্তি হবে না। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের ‘চিনিতে প্রতিদিন লুট ১৭ কোটি টাকা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে চিনি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকার নির্ধারিত মূল্য থোরাই কেয়ার করে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। দেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের রাম রাজত্ব দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বলেছেন, ‘পাঁচ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে চিনির দাম বাড়াচ্ছে।’
সংবাদ মাধ্যমের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে মাত্র দেড় মাসে চার ধাপে মূল্য বাড়িয়ে পোঁয়াজ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রায় ২০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তেলের দর বাড়িয়ে কমবেশি এক মাসের মধ্যে প্রায় ১ হাজার কোটি কামিয়েছে। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন হিসাব কষে দেখিয়েছে পোল্ট্রি খাতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট মাত্র ৫২ দিনে কিভাবে ভোক্তার পকেট থেকে ৯৩৬ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। গত বছর যাত্রী কল্যাণ সমিতি সংবাদ সম্মেলনে প্রতিদিন গণপরিবহনে যাত্রীর পকেট থেকে ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের তথ্য দিয়েছে।
দেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের লুটপাট অদম্য-অপ্রতিরোধ্য বলা যায়। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দাপট-দৌরাত্ম্যে মনে হয় এদের দমনের কেউ নেই, এদের কাছে সরকারও অসহায়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা অনেকেই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দমনের কথা বিভিন্ন সময় শুনিয়েছেন।
‘জাতীয় রপ্তানি ট্রফি-২০১৭-১৮’ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরূদ্ধে কঠোর হতে এবং তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। দমন এবং বিচারের আওতায় আনার কাজটি করতে দেখা যায় না। গত বছরের মাঝামাঝি ডিম ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ডিমের দামবৃদ্ধি করে মাত্র ১৪/১৫ দিনে ৫ শতাধিক কোটি টাকা ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ ডিমের মূল্য রকেট গতিতে বৃদ্ধি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মতবিনিময় সভায় বিষয়টি আলোচনা হয়।
মতবিনিমিয় সভায় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেছেন, ‘যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে বড় বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কারণে ডিমের দাম বেড়েছে।’ ধানের ভরা মৌসুমে চালের দাম কমা প্রথা। সাস্প্রতিক বছরগুলোতে ধানের ভরা মৌসুমেও চালের মূল্যবৃদ্ধি লক্ষণীয়। চাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ধানের ভরা মৌসুমেও খেয়াল-খুশিমতো চালের মূল্যবৃদ্ধি করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশের ৬টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান চাল মজুত করে বেশি দামে চাল বিক্রি করেছে। দেশে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বেপরোয়া দাপট-দৌরাত্ম্য, পরিচয়, প্রভাব অনবগুণ্ঠিতই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)-এর ‘বাংলাদেশে চাল, আলু ও পেঁয়াজের প্রাপ্যতা ও দামে অস্থিরতা : একটি আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদন ২০২০’-এ বলা হয়েছে, ‘সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতায় দাম বাড়ে নিত্যপণ্যের।’
অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে, দমাতে সরকারে ভূমিকা আশানুরূপ নয়, কেন আশানুরূপ নয় তা বিরাট প্রশ্ন। অভিযোগ আছে, সরকারের একটি প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের যোগসাজশের। সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, ঋণখেলাপিসহ স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে বলতে গিয়ে শিল্প প্রতিমন্ত্রী একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, ‘মন্ত্রীদের ভেতরে একটা সিন্ডিকেট আছে।’
সহজেই অনুমেয় যে, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের খুঁটির জোর বেশ শক্ত। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নেপথ্যের শক্তি কে বা কারা সে প্রশ্নের চেয়ে রাষ্ট্র কেন অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে, দমাতে ব্যর্থ হবে বা হচ্ছে সে প্রশ্ন দেশের আপামর মানুষের। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দেশের মানুষের পকেট লুটছে, দেশের মানুষকে নিঃস্ব-রিক্ত করছে। বেসরকারি সংগঠন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভন্যান্স স্টাডিজ (বিআইজিডি)-এর গত বছরের ১৪ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত চালানো যৌথ জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২১ লাখ মানুষ।
চোখের সামনেই দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে লুণ্ঠন চলছে, লুণ্ঠনে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এমতাবস্থায় রাষ্ট্র নির্বিকার থাকতে পারে না। ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। নাগরিকদের ন্যায্যমূল্যে পণ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ইচ্ছামতো পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়বে, দেশের সাধারণ মানুষ মূল্য সন্ত্রাসের জুলুমের প্রতিকার পাবে না- এটা অবিচার।
অতিরিক্ত মূল্যের জুলুমে সাধারণ মানুষ কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মূল্যের জুলুম থেকে রেহাই পেতে সাধারণ মানুষ সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে। সাধারণ মানুষকে অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মূল্যের জুলুম থেকে রক্ষায় সরকার এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ মানুষ যদি অসাধু ব্যবসায়ীদের মূল্যসন্ত্রাসের জুলুম থেকে রক্ষা পেতে সরকারকে পাশে না পায় তাহলে আহকামুল হাকিমের দরবারে ফরিয়াদ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মূল্যবৃদ্ধির জুলুমে সাধারণ মানুষ চিঁড়ে চ্যাপ্টা হচ্ছে, নিঃস্ব হচ্ছে, আর্তনাদ করছে, কাঁদছে- এর অবসান জরুরি।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]