alt

উপ-সম্পাদকীয়

আপনি তো আছেন নিজের সঙ্গে

রহমান মৃধা

: রোববার, ২৮ মে ২০২৩

মানুষ অভ্যাসের দাস- এ কথা আমি এখন আর মানি না; কারণ মানুষ অভ্যাসের দাস নয় বরং অভ্যাসই মানুষের দাস। মানুষ যখন বিশ্বাস এনেছে স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টির প্রতি তখনই সে স্রষ্টার অনুসরণকারী। এক্ষেত্রে অনুসরণ করা মানে দাসত্ব নয় বরং আদেশ নির্দেশ মেনে চলা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস স্থাপন করা তার প্রভুর প্রতি।

আমি চীন ভ্রমণ করেছি ১৯৯৮ সালে। সুইডিশ টেলিফোন কোম্পানি এরিকসন সবে মোবাইলফোন চালু করেছে চীনে। চীনের মহাপ্রাচীরে দাঁড়িয়ে আমি কথা বলছি সুইডেনে। আমার থেকে একটু দূরে নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু লোক ঘিরে আছে একজন ব্যক্তিকে। হয়তো হবেন কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, তিনিও মোবাইলফোনে বেশ আনন্দঘন মনে কথা বলছেন। মজার ব্যাপার হলো তিনি আর কেউ নন, তিনি তৎকালীন আমাদের সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী। দুইজনই টেলিফোনে সুইডিশে কথা বলছি, চাইনিজ নিরাপত্তা বাহিনীসহ অন্যরা মনে মনে ভাবছেন আমরা এত কাছে অথচ কেন সরাসরি কথা না বলে টেলিফোনে কথা বলছি! একই সঙ্গে এটাও ভাবছে ভাষা এক নাও তো হতে পারে ইত্যাদি। কথা শেষ হতেই প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে এসে একটু হেসে বলেছিলেন, হঠাৎ তুমিই সুইডিশ বলছো একই সময়, কে তুমি হে? আমিও একটু হেসে বললাম ‘হোয়াট এ কোইন্সিডেন্স’। কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী বিদায় নিলেন, আমি আমার কাজে রত হলাম। আমি তখন সুইডেনের ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্টি ফার্মাসিয়াতে কাজ করি। এসেছি চীনে চাইনিজ জাতির কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে। কাজের ফাঁকে চীনের মহাপ্রচীর দেখতে এসেছি শুধুমাত্র আত্মার তৃপ্তি পেতে।

তখনই দেখেছি খুবই কর্মঠ এবং কাজ পাগলা চাইনিজ জাতিকে। অথচ তারাও শনি এবং রবি দুই দিন ছুটি কাটায় আমাদের সুইডিশদের মতো? ইচ্ছে করলে লাঞ্চের পরে ঘুমানো বা বিশ্রামের জন্য ১ ঘণ্টা সময়ও তারা পেয়ে থাকে। শুধু কি তাই? সবাই যাতে ভালোভাবে বসতে পারে তার জন্য বিশেষ ধরনের চেয়ার এবং অ্যাডজাস্টবল টেবিলের ব্যবস্থা রয়েছে যা সুইডেনে তখনও হয়নি।

মূলত জাপান, চীন, সুইডেন, ফিনল্যান্ড- এরা ভালো কোয়ালিটি এবং ক্রিয়েটিভ আউটপুট ও কর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে নানাভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকে। তবে আত্মবিশ্বাস নিজেকেই তৈরি করতে হয়। এটা অন্যের থেকে ধার নেয়া যায় না। পৃথিবীতে কেউ কাউকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে না। হতে পারে আপনাকে আপনার বন্ধু, আত্মীয় কিংবা শুভাকাক্সক্ষী আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করবে, অনুপ্রেরণা দিবে কিন্তু কখনো শতভাগ আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে পারবে না যদি না আপনি নিজ থেকে আত্মবিশ্বাসী হোন। আত্মবিশ্বাস একদিনেই অর্জন করা সম্ভব নয়। রোজ কিছু কিছু অভ্যাস চর্চার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়। আসুন জেনে নিই কিভাবে আত্মবিশ্বাসী হবেন সে সম্পর্কে।

অলসতা হতাশার পাল্লাকে ভারি করে। অজুহাত সফলতাকে বেহাত করে। অন্যের ওপর নির্ভরতা দুঃসময়কে দীর্ঘায়িত করে। তাই অলসতা, অজুহাত আর অন্যের দয়ার দিকে না তাকিয়ে নিজের দিকে তাকানো উচিত। দেখবেন সফল হওয়ার জন্য যতটুকু শক্তি, সামর্থ্য, সময় দরকার তার পুরোটাই আপনার মধ্যে এসে যাবে। তারপরও অনুভব করবেন শুধু একটা জিনিস নেই, সেটা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস তৈরি করার জন্য কোনো ওষুধ নেই, মন্ত্র নেই। কোনো ভিডিও বা মোটিভেশনাল লেখাতে যতটুকু আত্মবিশ্বাস আসবে, সেটা পড়া শেষ হওয়ার আগেই হারিয়ে যাবে।

ধরুন কোনোদিন গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেননি। খোলা মাঠেও গাড়ি চালানোর প্র্যাকটিস করেননি। হঠাৎ যদি বলি যানজট শহরের রাস্তায় আপনাকে গাড়ি চালাতে, কী কনফিডেন্স পাবেন? যে খেলোয়াড় ঘরোয়া লিগ খেলে নাই, ট্রেনিং ক্যাম্পে যায় নাই, সে বিশ্বসেরাদের এগেনিস্টে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাস পাবে না। কারণ আত্মবিশ্বাস মনের জোর না, চর্চার জোর। প্র্যাকটিস করতে হবে কারণ প্র্যাকটিস মেকস অ্যা মান পারফেক্ট। কনফিডেন্স ম্যাজিক পিল না, ডেভেলপ করা স্কিল। এটা কাজ শুরু করার ইনপুট না, আউটপুট। তাই আত্মবিশ্বাস না খুঁজে, চেষ্টা করার অভ্যাস ডেভেলপ করতে হবে। লাভ-লসের হিসাব না করে, যত বেশি লেগে থাকবেন, যত বেশি ঘাম ঝরাবেন, তত বেশি কনফিডেন্ট হবেন, তত দ্রুতগতিতে বাধার দেয়াল টপকাতে পারবেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নিজেকে জানুন এবং কীভাবে তৈরি করবেন নিজেকে, সেটা ঠিক করে ফেলুন। আর কেউ না থাকুক, আপনি তো আছেন নিজের সঙ্গে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিন। দেখবেন আপনি সফল হবেন।

আত্মবিশ্বাস নিজেকেই তৈরি করতে হয়। এটা অন্যের থেকে ধার নেয়া যায় না

খারাপ স্মৃতিগুলো ভুলতে হবে। নিজের প্রতি বিশ্বাস অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের ভুল বা খারাপ স্মৃতিগুলো অনেকাংশে দায়ী। আপনার খারাপ স্মৃতিগুলো যখন অতীত, তাই সেগুলো আর মনে করে লাভ নেই। তবে পেছনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যান।

আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য অতি কাছের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস জোগাবে। তাই নিজের প্রতি বিশ্বাস কম থাকলে আপনজনের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন।

অল্পতেই ভালো থাকুন। অনেক কিছু পাওয়ার লোভ করা থেকে বিরত থাকুন। লোভ মানুষের মনের শান্তি ও ইতিবাচক আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। নিজেকে নিখুঁত বানানোর চেষ্টা করার দরকার নেই। নিজের যা কিছু আছে, তা নিয়েই খুশি থাকুন। দেখবেন আপনার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে আত্মবিশ্বাসকে অভ্যাসে পরিণত করতে শিখুন। কারণ অভ্যাস হলো এমন একটি পছন্দ যা আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু সময়ের জন্য করি। উদাহরণস্বরূপ- সততা, সকাল সকাল ঘুমোতে যাওয়া এবং খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং বড়দের সম্মান করা ভালো অভ্যাস। অন্যদিকে ধূমপান, মদ্যপান, মাদক গ্রহণ, মিথ্যা কথা বলা, অধিক খাদ্য গ্রহণ, উৎকোচ গ্রহণ, প্রয়োজনের অধিক দ্রব ক্রয় এবং হিংসা খারাপ অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত। আমরা জানি ভালো এবং মন্দ অভ্যাসগুলো কী তারপরও কেন তাহলে একটা ভালো অভ্যাসের পরিবর্তে একটা খারাপ অভ্যাস গ্রহণ করি?

আমরা শুনেছি- ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ একজন মানুষের জীবনে অভ্যাসের গঠন সব সময় চলতে থাকে; তবে শৈশব আর কিশোর বয়সে এর গঠন হয় সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে শৈশব আর কিশোর বয়সের অভ্যাসগুলো জীবনের পরবর্তী ধাপগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কর্মজীবনে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক মূল্যবোধেরই প্রতিফলন। আবার কর্মজীবন মানুষকে নতুন অভ্যাস গঠনে সাহায্য বা বাধ্য করে, যেমন উৎকোচ গ্রহণ। আমাদের দেশে সরকারি বিভিন্ন দফতরে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে সেবা প্রদানকারীর উৎকোচ গ্রহণ বলতে গেলে একটা সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উৎকোচ গ্রহণ একটা খারাপ অভ্যাস এবং এটা মাদক গ্রহণের চেয়ে কোনোভাবেই কম নয়।

ব্যক্তির মধ্যে কিভাবে অভ্যাস গঠিত হয়? অভ্যাস গঠন প্রক্রিয়া একটা সূত্রের মতো, যা আমাদের মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে। ভালো অভ্যাসের মতো খারাপ অভ্যাসের গঠন প্রক্রিয়াও একই। একজন ব্যক্তি কৌতূহলবশত কয়েকদিন ধূমপান করলো। ধূমপান তখন তার অভ্যাসে পরিণত হবে, যখন সে ধূমপান থেকে নিয়মিত একটা প্রশান্তি পাওয়া শুরু করবে এবং ধূমপানের অভাব তাকে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবে। পরবর্তীকালে ধূমপায়ীর অভ্যাস এভাবে কাজ করবে; একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ধূমপায়ীর মস্তিষ্ক ধূমপানের জন্য ইঙ্গিত দেবে। তখন ধূমপায়ী ধূমপান (কার্যপ্রণালী) করবে এবং ধূমপান থেকে সে একটা প্রশান্তি পাবে। ব্যায়াম করা যেমন একটা ভালো অভ্যাস, তেমনি ধূমপান একটা খারাপ অভ্যাস। ভালো অভ্যাস সব সময়ই ভালো, যা গঠনে আমরা অন্যদের উৎসাহ দিয়ে থাকি। সমস্যা হল খারাপ অভ্যাস নিয়ে। একটা খারাপ অভ্যাস ব্যক্তির নিজের জন্য যেমন খারাপ, তেমনি পরিবার ও সমাজের অন্যদের জন্যও খারাপ।

একটা অভ্যাস যত দীর্ঘ সময়ের হবে, সেটা বন্ধ করাও হবে তত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অন্যদিকে ছোটবেলায় গড়ে ওঠা অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। আমি যদি দিনে শতবার ছোটবেলায় গড়ে ওঠা অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করতে ব্যর্থ হই তাতে কী আসে যায়? একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানুষের জন্য ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। আমি শতবার ব্যর্থ হলেও এই ব্যর্থতার মাঝে শত শত নতুন কিছু শিখব। আমি সত্যিই যদি প্রতিজ্ঞা করি এবং যত্নশীল হই সেটা পূর্ণ করতে এবং আমি নিজেকে যদি এইভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করি, তাহলে আমার মন সংগঠিত হবে, একবার আমার মন সংগঠিত হলে, আমার চিন্তাভাবনা এবং আবেগগুলোও সংগঠিত হবে। আমার শক্তিও একই দিকে সংগঠিত হবে।

একবার আমার মন, মস্তিষ্ক, আবেগ, শক্তি সংগঠিত হলে আমাকে কোনো কিছুই ঠেকাতে বা বাধা দিতে পারবে না, আমার ফোকাস করার ক্ষমতা এত শক্তিশালী হবে যে আমি আমার মনকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হব। মনের মধ্যে স্বপ্ন তৈরি করুন কারণ স্বপ্ন প্রেরণা দেয় বাঁচার। উদ্যোগী হওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে দ্বার উন্মোচনের পথ দেখায়। স্বপ্নীল জীবনের সূত্রপাত হয় স্বপ্ন দেখা থেকেই। আর বাঁচার জন্য স্বপ্ন যেহেতু দেখতেই হবে, তাহলে বড় স্বপ্ন দেখাই শ্রেয় এবং আত্মবিশ্বাস থাকলে সবই সম্ভব। আমাদের সবার জীবন ভালো অভ্যাসে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।

[লেখক : সাবেক পরিচালক , ফাইজার, সুইডেন]

গ্যাং কালচারের সমাধান কোথায়

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শিশুদের সংকট বাড়ছে

ডিজিটাল শিল্পযুগ

জলবায়ু ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে, কী করছি আমরা?

পথশিশু : পথই তাদের সব

ভিসানীতিতে আমরা কেন বিচলিত নই

মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে

প্রবীণদের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা

একটি সুন্দর সমাজের আকুতি

বাংলাদেশের নির্বাচন ও আমেরিকার ভিসানীতি

কূটনীতি : তখন আর এখন

সেতু-কালভার্টে নদীপথে বাড়ছে সংকট

প্রসঙ্গ : দ্রব্যমূল্য

সম্ভাবনাময় ইকোট্যুরিজম

পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা

হিন্দু কন্যা সন্তানদের সমানাধিকার প্রসঙ্গে

ছবি

রাজনীতির দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য প্রক্রিয়া

নারী শিক্ষার গুরুত্ব

জমি জটিলতা ও ভূমি বিভাগ

ভরত থেকে ভারতবর্ষ অতঃপর হিন্দুস্তান ইন্ডিয়া হয়ে ভারত

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স

রপ্তানি বহুমুখীকরণে তথ্যপ্রযুক্তি খাত

আদিবাসীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা ও পুলিশের ভূমিকা

ছবি

ডেঙ্গু রোধে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার

ছবি

পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা

অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটনের সম্ভাবনা

ছবি

নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না কেন

ছবি

বায়ুদূষণের ক্ষতি

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আর প্রয়োজন আছে কি

জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যাবে অগোচরে

বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস

ছবি

দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট জনজীবন

বৈষম্যমুক্ত নিরাপদ সমাজ গঠন কেন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি

কষ্টে আছে নিম্নবিত্ত মানুষ

কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে ভুল ধারণা

ছবি

কৃষির রূপান্তর : প্রাপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তিও আছে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আপনি তো আছেন নিজের সঙ্গে

রহমান মৃধা

রোববার, ২৮ মে ২০২৩

মানুষ অভ্যাসের দাস- এ কথা আমি এখন আর মানি না; কারণ মানুষ অভ্যাসের দাস নয় বরং অভ্যাসই মানুষের দাস। মানুষ যখন বিশ্বাস এনেছে স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টির প্রতি তখনই সে স্রষ্টার অনুসরণকারী। এক্ষেত্রে অনুসরণ করা মানে দাসত্ব নয় বরং আদেশ নির্দেশ মেনে চলা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস স্থাপন করা তার প্রভুর প্রতি।

আমি চীন ভ্রমণ করেছি ১৯৯৮ সালে। সুইডিশ টেলিফোন কোম্পানি এরিকসন সবে মোবাইলফোন চালু করেছে চীনে। চীনের মহাপ্রাচীরে দাঁড়িয়ে আমি কথা বলছি সুইডেনে। আমার থেকে একটু দূরে নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু লোক ঘিরে আছে একজন ব্যক্তিকে। হয়তো হবেন কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, তিনিও মোবাইলফোনে বেশ আনন্দঘন মনে কথা বলছেন। মজার ব্যাপার হলো তিনি আর কেউ নন, তিনি তৎকালীন আমাদের সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী। দুইজনই টেলিফোনে সুইডিশে কথা বলছি, চাইনিজ নিরাপত্তা বাহিনীসহ অন্যরা মনে মনে ভাবছেন আমরা এত কাছে অথচ কেন সরাসরি কথা না বলে টেলিফোনে কথা বলছি! একই সঙ্গে এটাও ভাবছে ভাষা এক নাও তো হতে পারে ইত্যাদি। কথা শেষ হতেই প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে এসে একটু হেসে বলেছিলেন, হঠাৎ তুমিই সুইডিশ বলছো একই সময়, কে তুমি হে? আমিও একটু হেসে বললাম ‘হোয়াট এ কোইন্সিডেন্স’। কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী বিদায় নিলেন, আমি আমার কাজে রত হলাম। আমি তখন সুইডেনের ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্টি ফার্মাসিয়াতে কাজ করি। এসেছি চীনে চাইনিজ জাতির কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে। কাজের ফাঁকে চীনের মহাপ্রচীর দেখতে এসেছি শুধুমাত্র আত্মার তৃপ্তি পেতে।

তখনই দেখেছি খুবই কর্মঠ এবং কাজ পাগলা চাইনিজ জাতিকে। অথচ তারাও শনি এবং রবি দুই দিন ছুটি কাটায় আমাদের সুইডিশদের মতো? ইচ্ছে করলে লাঞ্চের পরে ঘুমানো বা বিশ্রামের জন্য ১ ঘণ্টা সময়ও তারা পেয়ে থাকে। শুধু কি তাই? সবাই যাতে ভালোভাবে বসতে পারে তার জন্য বিশেষ ধরনের চেয়ার এবং অ্যাডজাস্টবল টেবিলের ব্যবস্থা রয়েছে যা সুইডেনে তখনও হয়নি।

মূলত জাপান, চীন, সুইডেন, ফিনল্যান্ড- এরা ভালো কোয়ালিটি এবং ক্রিয়েটিভ আউটপুট ও কর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে নানাভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকে। তবে আত্মবিশ্বাস নিজেকেই তৈরি করতে হয়। এটা অন্যের থেকে ধার নেয়া যায় না। পৃথিবীতে কেউ কাউকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে না। হতে পারে আপনাকে আপনার বন্ধু, আত্মীয় কিংবা শুভাকাক্সক্ষী আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করবে, অনুপ্রেরণা দিবে কিন্তু কখনো শতভাগ আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে পারবে না যদি না আপনি নিজ থেকে আত্মবিশ্বাসী হোন। আত্মবিশ্বাস একদিনেই অর্জন করা সম্ভব নয়। রোজ কিছু কিছু অভ্যাস চর্চার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়। আসুন জেনে নিই কিভাবে আত্মবিশ্বাসী হবেন সে সম্পর্কে।

অলসতা হতাশার পাল্লাকে ভারি করে। অজুহাত সফলতাকে বেহাত করে। অন্যের ওপর নির্ভরতা দুঃসময়কে দীর্ঘায়িত করে। তাই অলসতা, অজুহাত আর অন্যের দয়ার দিকে না তাকিয়ে নিজের দিকে তাকানো উচিত। দেখবেন সফল হওয়ার জন্য যতটুকু শক্তি, সামর্থ্য, সময় দরকার তার পুরোটাই আপনার মধ্যে এসে যাবে। তারপরও অনুভব করবেন শুধু একটা জিনিস নেই, সেটা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস তৈরি করার জন্য কোনো ওষুধ নেই, মন্ত্র নেই। কোনো ভিডিও বা মোটিভেশনাল লেখাতে যতটুকু আত্মবিশ্বাস আসবে, সেটা পড়া শেষ হওয়ার আগেই হারিয়ে যাবে।

ধরুন কোনোদিন গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেননি। খোলা মাঠেও গাড়ি চালানোর প্র্যাকটিস করেননি। হঠাৎ যদি বলি যানজট শহরের রাস্তায় আপনাকে গাড়ি চালাতে, কী কনফিডেন্স পাবেন? যে খেলোয়াড় ঘরোয়া লিগ খেলে নাই, ট্রেনিং ক্যাম্পে যায় নাই, সে বিশ্বসেরাদের এগেনিস্টে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাস পাবে না। কারণ আত্মবিশ্বাস মনের জোর না, চর্চার জোর। প্র্যাকটিস করতে হবে কারণ প্র্যাকটিস মেকস অ্যা মান পারফেক্ট। কনফিডেন্স ম্যাজিক পিল না, ডেভেলপ করা স্কিল। এটা কাজ শুরু করার ইনপুট না, আউটপুট। তাই আত্মবিশ্বাস না খুঁজে, চেষ্টা করার অভ্যাস ডেভেলপ করতে হবে। লাভ-লসের হিসাব না করে, যত বেশি লেগে থাকবেন, যত বেশি ঘাম ঝরাবেন, তত বেশি কনফিডেন্ট হবেন, তত দ্রুতগতিতে বাধার দেয়াল টপকাতে পারবেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নিজেকে জানুন এবং কীভাবে তৈরি করবেন নিজেকে, সেটা ঠিক করে ফেলুন। আর কেউ না থাকুক, আপনি তো আছেন নিজের সঙ্গে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিন। দেখবেন আপনি সফল হবেন।

আত্মবিশ্বাস নিজেকেই তৈরি করতে হয়। এটা অন্যের থেকে ধার নেয়া যায় না

খারাপ স্মৃতিগুলো ভুলতে হবে। নিজের প্রতি বিশ্বাস অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের ভুল বা খারাপ স্মৃতিগুলো অনেকাংশে দায়ী। আপনার খারাপ স্মৃতিগুলো যখন অতীত, তাই সেগুলো আর মনে করে লাভ নেই। তবে পেছনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যান।

আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য অতি কাছের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস জোগাবে। তাই নিজের প্রতি বিশ্বাস কম থাকলে আপনজনের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন।

অল্পতেই ভালো থাকুন। অনেক কিছু পাওয়ার লোভ করা থেকে বিরত থাকুন। লোভ মানুষের মনের শান্তি ও ইতিবাচক আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। নিজেকে নিখুঁত বানানোর চেষ্টা করার দরকার নেই। নিজের যা কিছু আছে, তা নিয়েই খুশি থাকুন। দেখবেন আপনার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে আত্মবিশ্বাসকে অভ্যাসে পরিণত করতে শিখুন। কারণ অভ্যাস হলো এমন একটি পছন্দ যা আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু সময়ের জন্য করি। উদাহরণস্বরূপ- সততা, সকাল সকাল ঘুমোতে যাওয়া এবং খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং বড়দের সম্মান করা ভালো অভ্যাস। অন্যদিকে ধূমপান, মদ্যপান, মাদক গ্রহণ, মিথ্যা কথা বলা, অধিক খাদ্য গ্রহণ, উৎকোচ গ্রহণ, প্রয়োজনের অধিক দ্রব ক্রয় এবং হিংসা খারাপ অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত। আমরা জানি ভালো এবং মন্দ অভ্যাসগুলো কী তারপরও কেন তাহলে একটা ভালো অভ্যাসের পরিবর্তে একটা খারাপ অভ্যাস গ্রহণ করি?

আমরা শুনেছি- ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ একজন মানুষের জীবনে অভ্যাসের গঠন সব সময় চলতে থাকে; তবে শৈশব আর কিশোর বয়সে এর গঠন হয় সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে শৈশব আর কিশোর বয়সের অভ্যাসগুলো জীবনের পরবর্তী ধাপগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কর্মজীবনে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক মূল্যবোধেরই প্রতিফলন। আবার কর্মজীবন মানুষকে নতুন অভ্যাস গঠনে সাহায্য বা বাধ্য করে, যেমন উৎকোচ গ্রহণ। আমাদের দেশে সরকারি বিভিন্ন দফতরে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে সেবা প্রদানকারীর উৎকোচ গ্রহণ বলতে গেলে একটা সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উৎকোচ গ্রহণ একটা খারাপ অভ্যাস এবং এটা মাদক গ্রহণের চেয়ে কোনোভাবেই কম নয়।

ব্যক্তির মধ্যে কিভাবে অভ্যাস গঠিত হয়? অভ্যাস গঠন প্রক্রিয়া একটা সূত্রের মতো, যা আমাদের মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে। ভালো অভ্যাসের মতো খারাপ অভ্যাসের গঠন প্রক্রিয়াও একই। একজন ব্যক্তি কৌতূহলবশত কয়েকদিন ধূমপান করলো। ধূমপান তখন তার অভ্যাসে পরিণত হবে, যখন সে ধূমপান থেকে নিয়মিত একটা প্রশান্তি পাওয়া শুরু করবে এবং ধূমপানের অভাব তাকে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবে। পরবর্তীকালে ধূমপায়ীর অভ্যাস এভাবে কাজ করবে; একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ধূমপায়ীর মস্তিষ্ক ধূমপানের জন্য ইঙ্গিত দেবে। তখন ধূমপায়ী ধূমপান (কার্যপ্রণালী) করবে এবং ধূমপান থেকে সে একটা প্রশান্তি পাবে। ব্যায়াম করা যেমন একটা ভালো অভ্যাস, তেমনি ধূমপান একটা খারাপ অভ্যাস। ভালো অভ্যাস সব সময়ই ভালো, যা গঠনে আমরা অন্যদের উৎসাহ দিয়ে থাকি। সমস্যা হল খারাপ অভ্যাস নিয়ে। একটা খারাপ অভ্যাস ব্যক্তির নিজের জন্য যেমন খারাপ, তেমনি পরিবার ও সমাজের অন্যদের জন্যও খারাপ।

একটা অভ্যাস যত দীর্ঘ সময়ের হবে, সেটা বন্ধ করাও হবে তত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অন্যদিকে ছোটবেলায় গড়ে ওঠা অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। আমি যদি দিনে শতবার ছোটবেলায় গড়ে ওঠা অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করতে ব্যর্থ হই তাতে কী আসে যায়? একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানুষের জন্য ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। আমি শতবার ব্যর্থ হলেও এই ব্যর্থতার মাঝে শত শত নতুন কিছু শিখব। আমি সত্যিই যদি প্রতিজ্ঞা করি এবং যত্নশীল হই সেটা পূর্ণ করতে এবং আমি নিজেকে যদি এইভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করি, তাহলে আমার মন সংগঠিত হবে, একবার আমার মন সংগঠিত হলে, আমার চিন্তাভাবনা এবং আবেগগুলোও সংগঠিত হবে। আমার শক্তিও একই দিকে সংগঠিত হবে।

একবার আমার মন, মস্তিষ্ক, আবেগ, শক্তি সংগঠিত হলে আমাকে কোনো কিছুই ঠেকাতে বা বাধা দিতে পারবে না, আমার ফোকাস করার ক্ষমতা এত শক্তিশালী হবে যে আমি আমার মনকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হব। মনের মধ্যে স্বপ্ন তৈরি করুন কারণ স্বপ্ন প্রেরণা দেয় বাঁচার। উদ্যোগী হওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে দ্বার উন্মোচনের পথ দেখায়। স্বপ্নীল জীবনের সূত্রপাত হয় স্বপ্ন দেখা থেকেই। আর বাঁচার জন্য স্বপ্ন যেহেতু দেখতেই হবে, তাহলে বড় স্বপ্ন দেখাই শ্রেয় এবং আত্মবিশ্বাস থাকলে সবই সম্ভব। আমাদের সবার জীবন ভালো অভ্যাসে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।

[লেখক : সাবেক পরিচালক , ফাইজার, সুইডেন]

back to top