এম জি নিয়োগী
আমার নাম রসনাবাদ। উপকূলের লবণাক্ত এলাকায় আমার বাস। লবণাক্ত এলাকা বলে আমার সমাদর অনেক কম। সবাই আমাকে কেমন যেন তাচ্ছিল করে। অবহেলার চোখে দেখে। আমন মৌসুম আসলে আমার কদর একটু বাড়ে। পুরুষ মানুষগুলো তখন আমার প্রতি একটু নজর দেয়। মই দিয়ে আমার জমিনটাকে সমান করে। আমন ধানের চারা লাগায়। এরপর একটু-আকটু যত্ন করে। এক সময় ফসল হয়। ফসল পাকে। ধান কাটার উৎসব শুরু হয়। আমার নারী-পুরুষ, বুড়া-বুড়ি, বাচ্চা-কাচ্চা তখন যে কি খুশি। আমার তা দেখে পরান জুড়ায়।
আমার গরু-মহিষগুলোও তখন আমার বুকের উপর চষে বেড়ায়। পেট ভরে খড় খায়। ঘাস খায়। তাদের চেহারাগুলো তখন নাদুস-নুদুস হয়ে ওঠে। আমার কি যে ভালো লাগে তখন। এরপর থেকেই আমার কপালে আর সুখ থাকে না। আমার জমিগুলো শুকাতে থাকে। আস্তে আস্তে জমিগুলোতে নোনা বাড়তে থাকে। নোনা ধরা আমার জমিগুলোর দিকে তখন কেউ আর ফিরেও তাকায় না। পুরুষরা কাজের খোজে অন্য কোথাও চলে যায়। নারীরা সংসারের কাজ শেষে পিঁড়ি নিয়ে উঠানে বসে এক দৃষ্টিতে আমার তখন দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার তখন খুব কষ্ট লাগে। চারিদিকে বিরান ভূমি। ধুধু মাঠ। মাঠের পর মাঠ জমিগুলো পতিত পড়ে থাকে। এ দৃশ্য তো দেখা যায় না। সহ্য করা যায় না। বছরের বাকী সময়গুলো ওদের চোখের জল দেখতে দেখতে বছর পার হয়ে যায়।
এভাবেই শুকনা মৌসুমে প্রতিদিন ফসলহীন ধুধু মাঠ দেখছি। আর নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি। শুনছি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমার নোনা ধরা জমিতে নাকি দিনকে দিন আরো বেশি নোনা ধরবে। তখন যে কি হবে। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। দুঃসহ প্রতিকুল পরিবেশে হঠাৎ করেই একদিন দেখি আমার জমিতে অনেকগুলো বিদেশি মানুষ। ওরা নাকি অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী। কৃষি নিয়ে গবেষণা করেন। সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরাও আছেন। তো ওরা এখানে কেনো। এই নোনা-খাওয়া জমিতেই বা কি করবে এই মানুষগুলো। যে কল্পনা-নমিতারা উঠানে বসে কাজের অবসরে আমার দিকে তাকিয়ে সারাদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলতো তারা দেখি বিদেশী মেহমানদের অর্ভ্যথনা জানাচ্ছে, গ্রামের নোনা জমিগুলো ওদের দেখাচ্ছে। তাদের সমস্যার কথা বলছে। সমাধান কি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করছে।
কি আর্শ্চয্য। ধান কাটার উৎসব শেষ হতে না হতেই একদিন দেখি শীতের সাত-সকালে আমার অনিতা-ডলি-জোসনা-গৌরীরা সবাই দল বেঁধে মাঠে নামছে। ওরা নাকি আগাম মুগডাল চাষ করবে। বিজ্ঞানীদের নাকি এই রকম পরামর্শ। দিপাালী-সাধনা-বিনোদিনীরা সবাই নাকি গবেষনা করবে। আমার চোখ তো সত্যি ছানাবড়া। বিদেশি লোকগুলো এসে কি আমার মেয়েদের মাথা খারাপ করে ফেলছে। শীতের মধ্যে মুগডাল হয় কখনো। যত সব উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা। সত্যি সত্যিই পুতুল-নন্দিতারা সবাই মিলে শীতের মধ্যে মুগডাল বুনে ফেললো। পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রামের মামুন-শহিদুলকে তো দেখছি প্রায় প্রতিদিন আগাম মুগডাল ক্ষেতে আসছে। পরামর্শ দিচ্ছে। কি পরামর্শ দিচ্ছে আল্লাহই জানে। মিরা-তানিয়ারা এখন আর উঠানে বসে আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে না। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে।
এমনি করেই একদিন দেখছি দিপালী-কল্পনা-নমিতারা সবাই নোনা জমিতে আগাম মুগডালের ছেঁই তুলছে। ডলি রানীর গান ভেসে আসছে। সবাই গান গাচ্ছে আর ছেঁই তুলছে। আমি তো অবাক। আবার শুনলাম আমার পাশেই পাখীমারা বাজারে অস্ট্রেলিয়া থেকে মুগডাল ভাঙ্গানো মেশিন বসিয়েছে। আমার মেয়েরা নাকি সেখান থেকে মুগডাল ভাঙ্গিয়ে ভালো দামে কিছু বিক্রি করবে। কিছু খাবে। আর কিছু আত্মীয়-স্বজনকে দিবে। শুনে আমার কি যে আনন্দ। একদিন আবারো অস্ট্রেলিয়া থেকে অনেক নারী-পুরুষ এলো। সংখ্যায় ১৫-২০ জন। এত বিদেশী মেহমান একসঙ্গে তো কোনদিন দেখিনি। সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী। আমার মেয়েরা বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে, নেচে-গেয়ে ওদের বরন করে নিল। তারা নোনা জমিতে আগাম মুগডাল দেখলো। কি খুশি তারা। খুশিতে বিদেশী মেয়েরা আমার মেয়েদের জড়িয়ে ধরলো। বাহবা দিল। আমার চোখে তখন আনন্দাশ্রু।
এতদিন দুঃখে কেঁদেছি, এখন যে সুখে কাঁদছি। শুনছি আমার জমিতেই সফল আগাম মুগডাল গবেষনাটি সারা উপকূলের পতিত জমিতে ছড়িয়ে দেয়া হবে। সারা উপকূলের মানুষ আমার নাম করে বলবে - রসনাবাদের সফল গবেষনা। নমিতা-কল্পনাদের সফল গবেষনা। পতিত জমিতে আগাম মুগডালের সফল গবেষনা। সত্যিই আমি অভিভূত। সার্থক জনম আমার।
[লেখক : স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২১ প্রাপ্ত বিজ্ঞানী; ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া]
এম জি নিয়োগী
বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩
আমার নাম রসনাবাদ। উপকূলের লবণাক্ত এলাকায় আমার বাস। লবণাক্ত এলাকা বলে আমার সমাদর অনেক কম। সবাই আমাকে কেমন যেন তাচ্ছিল করে। অবহেলার চোখে দেখে। আমন মৌসুম আসলে আমার কদর একটু বাড়ে। পুরুষ মানুষগুলো তখন আমার প্রতি একটু নজর দেয়। মই দিয়ে আমার জমিনটাকে সমান করে। আমন ধানের চারা লাগায়। এরপর একটু-আকটু যত্ন করে। এক সময় ফসল হয়। ফসল পাকে। ধান কাটার উৎসব শুরু হয়। আমার নারী-পুরুষ, বুড়া-বুড়ি, বাচ্চা-কাচ্চা তখন যে কি খুশি। আমার তা দেখে পরান জুড়ায়।
আমার গরু-মহিষগুলোও তখন আমার বুকের উপর চষে বেড়ায়। পেট ভরে খড় খায়। ঘাস খায়। তাদের চেহারাগুলো তখন নাদুস-নুদুস হয়ে ওঠে। আমার কি যে ভালো লাগে তখন। এরপর থেকেই আমার কপালে আর সুখ থাকে না। আমার জমিগুলো শুকাতে থাকে। আস্তে আস্তে জমিগুলোতে নোনা বাড়তে থাকে। নোনা ধরা আমার জমিগুলোর দিকে তখন কেউ আর ফিরেও তাকায় না। পুরুষরা কাজের খোজে অন্য কোথাও চলে যায়। নারীরা সংসারের কাজ শেষে পিঁড়ি নিয়ে উঠানে বসে এক দৃষ্টিতে আমার তখন দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার তখন খুব কষ্ট লাগে। চারিদিকে বিরান ভূমি। ধুধু মাঠ। মাঠের পর মাঠ জমিগুলো পতিত পড়ে থাকে। এ দৃশ্য তো দেখা যায় না। সহ্য করা যায় না। বছরের বাকী সময়গুলো ওদের চোখের জল দেখতে দেখতে বছর পার হয়ে যায়।
এভাবেই শুকনা মৌসুমে প্রতিদিন ফসলহীন ধুধু মাঠ দেখছি। আর নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি। শুনছি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমার নোনা ধরা জমিতে নাকি দিনকে দিন আরো বেশি নোনা ধরবে। তখন যে কি হবে। ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। দুঃসহ প্রতিকুল পরিবেশে হঠাৎ করেই একদিন দেখি আমার জমিতে অনেকগুলো বিদেশি মানুষ। ওরা নাকি অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী। কৃষি নিয়ে গবেষণা করেন। সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরাও আছেন। তো ওরা এখানে কেনো। এই নোনা-খাওয়া জমিতেই বা কি করবে এই মানুষগুলো। যে কল্পনা-নমিতারা উঠানে বসে কাজের অবসরে আমার দিকে তাকিয়ে সারাদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলতো তারা দেখি বিদেশী মেহমানদের অর্ভ্যথনা জানাচ্ছে, গ্রামের নোনা জমিগুলো ওদের দেখাচ্ছে। তাদের সমস্যার কথা বলছে। সমাধান কি হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করছে।
কি আর্শ্চয্য। ধান কাটার উৎসব শেষ হতে না হতেই একদিন দেখি শীতের সাত-সকালে আমার অনিতা-ডলি-জোসনা-গৌরীরা সবাই দল বেঁধে মাঠে নামছে। ওরা নাকি আগাম মুগডাল চাষ করবে। বিজ্ঞানীদের নাকি এই রকম পরামর্শ। দিপাালী-সাধনা-বিনোদিনীরা সবাই নাকি গবেষনা করবে। আমার চোখ তো সত্যি ছানাবড়া। বিদেশি লোকগুলো এসে কি আমার মেয়েদের মাথা খারাপ করে ফেলছে। শীতের মধ্যে মুগডাল হয় কখনো। যত সব উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা। সত্যি সত্যিই পুতুল-নন্দিতারা সবাই মিলে শীতের মধ্যে মুগডাল বুনে ফেললো। পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রামের মামুন-শহিদুলকে তো দেখছি প্রায় প্রতিদিন আগাম মুগডাল ক্ষেতে আসছে। পরামর্শ দিচ্ছে। কি পরামর্শ দিচ্ছে আল্লাহই জানে। মিরা-তানিয়ারা এখন আর উঠানে বসে আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে না। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে।
এমনি করেই একদিন দেখছি দিপালী-কল্পনা-নমিতারা সবাই নোনা জমিতে আগাম মুগডালের ছেঁই তুলছে। ডলি রানীর গান ভেসে আসছে। সবাই গান গাচ্ছে আর ছেঁই তুলছে। আমি তো অবাক। আবার শুনলাম আমার পাশেই পাখীমারা বাজারে অস্ট্রেলিয়া থেকে মুগডাল ভাঙ্গানো মেশিন বসিয়েছে। আমার মেয়েরা নাকি সেখান থেকে মুগডাল ভাঙ্গিয়ে ভালো দামে কিছু বিক্রি করবে। কিছু খাবে। আর কিছু আত্মীয়-স্বজনকে দিবে। শুনে আমার কি যে আনন্দ। একদিন আবারো অস্ট্রেলিয়া থেকে অনেক নারী-পুরুষ এলো। সংখ্যায় ১৫-২০ জন। এত বিদেশী মেহমান একসঙ্গে তো কোনদিন দেখিনি। সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী। আমার মেয়েরা বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে, নেচে-গেয়ে ওদের বরন করে নিল। তারা নোনা জমিতে আগাম মুগডাল দেখলো। কি খুশি তারা। খুশিতে বিদেশী মেয়েরা আমার মেয়েদের জড়িয়ে ধরলো। বাহবা দিল। আমার চোখে তখন আনন্দাশ্রু।
এতদিন দুঃখে কেঁদেছি, এখন যে সুখে কাঁদছি। শুনছি আমার জমিতেই সফল আগাম মুগডাল গবেষনাটি সারা উপকূলের পতিত জমিতে ছড়িয়ে দেয়া হবে। সারা উপকূলের মানুষ আমার নাম করে বলবে - রসনাবাদের সফল গবেষনা। নমিতা-কল্পনাদের সফল গবেষনা। পতিত জমিতে আগাম মুগডালের সফল গবেষনা। সত্যিই আমি অভিভূত। সার্থক জনম আমার।
[লেখক : স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২১ প্রাপ্ত বিজ্ঞানী; ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া]