সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের সংবিধান থেকে ধর্মরিপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই দু’টি দাবি এসেছিল মুক্তির জাগ্রত আকাক্সক্ষা থেকেই। পাকিস্তান আমলে-তৈরি সাম্প্রদায়িক ও শ্রেণিগত বিভাজনকে নাকচ করে দিতে চেয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মূলনীতি দু’টি যে বিদায় করে দেয়া হলো সেটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, স্বাভাবিক ঘটনা বটে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, আমাদের ইতিহাসের একমাত্র জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধ জনতার জয় হয়েছিল। কিন্তু বিজয়ী জনতা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, ক্ষমতা আগের মতোই চলে যাচ্ছিল অল্প কিছু মানুষের হাতে। পঁচাত্তরের নৃশংস পটপরিবর্তনের পর নতুন যারা ক্ষমতায় এলো তারা শুধু ক্ষমতাই বুঝেছে, অন্য কিছু বুঝতে চায়নি। তারা জনগণের লোক নয়, জনগণের আদর্শ তাদের নয়। তাদের আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থান ছিল না। তারা তাদের আদর্শকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তারপর ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যারা ক্ষমতায় এসেছিল এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচয় দিলেও, মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাকে ধারণ করেছেন, সেটা বলা যাবে না। সঙ্গত কারণে তারাও তো সরিয়ে-দেয়া মূলনীতি দু’টি ফেরত আনেনি। ফেরত আনা পরের কথা, তারা সাংবিধানিক বৈধতাও দিয়ে দিয়েছে। এই উদাসীনতা তাৎপর্যহীন নয়। বাস্তবতা বদলে গেছে। জনগণ যে স্বপ্ন দেখেছিল তা এখন অতীতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হয়তো-বা অতীতের স্মৃতিতেই পরিণত হবে, কারো কারো হয়তো মনে এমন আশা রয়েছে।
মূল সত্যটা হচ্ছে এই যে, জনগণের কাছে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা থেকে তারা অনেক দূরে। সামরিক সরকারের আমলে দূরে ছিল, নির্বাচিত সরকারের আমলেও সেই দূরেই রয়ে গেছে। এই দূরত্ব আগামীতে বাড়বে না, বরঞ্চ কমে আসবে, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? তা তো বলা যাবে না। জনগণের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটাবার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি কই? কর্মসংস্থানের উদ্যোগ কোথায়?
রাষ্ট্রক্ষমতায় যে বড় পরিবর্তন এসেছে সেগুলো এমনি এমনি ঘটেনি, বিত্তবানদের কারণেও ঘটেনি। প্রত্যেকটির পেছনেই জনগণ ছিল। ১৯৪৬-এ সাধারণ মানুষ ভোট দিয়েছে। ১৯৭১-এ সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাতেই রাষ্ট্র বদলেছে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ; ওই স্বাধীনতায় মুক্তি এলো না। উল্টো মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়লো। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ভিন্ন প্রকারের, তার সামনে মুক্তির লক্ষ্যটা ছিল আরো স্পষ্ট, আরো প্রত্যক্ষ। কিন্তু এই স্বাধীনতা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে কি? মুক্তি এসেছে কি মানুষের? সে তো মনে হয় অনেক দূরের ব্যাপার।
মুক্তি না-আসার কারণটি হচ্ছে এই যে, সংগ্রাম জনগণই করেছে এটা ঠিক, কিন্তু নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিল না। জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ কী? জনগণ তো ব্যক্তি নয়, এক নয়, তারা বহু, অসংখ্য, কে নেতা হবে কাকে ফেলে? জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ হলো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন সংগঠনের হাতে নেতৃত্ব থাকা। স্বার্থটাই আসল কথা। আওয়াজ উঠতে পারে নানাবিধ, আওয়াজ মানুষকে উদ্বুদ্ধও করে নানাভাবে, কিন্তু ধ্বনি যথেষ্ট নয়, কার স্বার্থে ধ্বনি উঠেছে সেটাই জরুরি।
জনগণের পক্ষে অনেক সংগঠনই কথা বলেছে বলে মনে হয়েছে। এখনও মনে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ সাড়াও দিয়েছে তাদের ডাকে; কিন্তু পরে যখন ক্ষমতা হাতে এসেছে তখন সংগঠনগুলো জনগণের স্বার্থ দেখেনি, স্বার্থ দেখেছে নিজেদের। সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখবার কথা বামপন্থিদের। আমাদের দেশ বলে নয়, সবদেশেই আজকের যুগে সামাজিক বিপ্লব বামপন্থি আন্দোলনের দ্বারাই সম্ভবপর, দক্ষিণপন্থিরা ওই কাজ করবে না। সমগ্র জনগণের স্বার্থ দেখবার কথা বামপন্থিদেরই, কেননা তারা শ্রেণির নয়, তারা শ্রেণিচ্যুত। কন্তু বাংলাদেশে বামপন্থিরা জনগণকে সঙ্গে নিতে পারেনি। যে জন্য তারা শক্তিশালী হয়নি। জনগণের আস্থা তাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাদের এই ব্যর্থতার কারণ জনগণের মেজাজ, ভাষা, কল্পনা তারা আত্মস্থ করতে পারেনি এবং একই সঙ্গে জনগণের সঙ্গে কখন কার প্রধান দ্বন্দ্ব সেটা অনুধাবনেও তারা অপরাগ হয়েছে। ১৯৪৭ সালেই বামপন্থিরা আওয়াজ তুলেছিল, ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়। বক্তব্যটা একেবারেই সঠিক ছিল। মানুষ অভুক্ত রয়েছে। স্বাধীনতা কোথায়? স্বাধীনতা যে ভুয়া ছিল তা মানুষ পরে বুজেছে, বুঝে নতুন করে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছে, কিন্তু সাতচল্লিশে তারা প্রস্তুত ছিল না নতুন করে আন্দোলন করতে। তাদের চোখে তখনও স্বপ্নের ঘোর এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার নির্মম স্মৃতি। জনগণ সাড়া দেয়নি। শাসকেরা সুযোগটা নিলো, তারা বামপন্থি দমনে তৎপর হয়ে উঠলো। ব্যর্থ হয়ে বামপন্থিরা রণকৌশল বদল করা দরকার মনে করলো। এবার চলে গেলো তারা উল্টো মেরুতে, ঠিক করলো কাজ করতে হবে ধীরে ধীরে, পরিচয় লুকিয়ে, উঠতি মধ্যবিত্তের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক দলের ছাত্রছায়ায় থেকে।
কিন্তু শাসকেরা তো জানে তাদের আসল শত্রু কারা। আসল শত্রু আসলে জনগণ, যাদের তারা শোষণ করে এবং সে-জন্য ভয় করে। জনগণের পক্ষে যে সংগঠন দাঁড়াবে স্বভাবতই শাসক তাদের শত্রুজ্ঞান করবে। তখনকার পাকিস্তানে তারা তাই অন্য রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেনি, নিষিদ্ধ করেছে কমিউনিস্ট পার্টিকে। যাদের সঙ্গে তাদের ভোটযুদ্ধ, অর্থাৎ ক্ষমতা ভাগাভাগির লড়াই, তাদেরকেও নানাভাবে জব্দ করেছে ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়নি; নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে বামপন্থিদেরকে, জাতশত্রু জ্ঞান করে।
তারপরেও বাম আন্দোলন ছিল। ছিল তারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে, ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। জনগণের স্বার্থে কথা তারাই মূলত বলেছে। কিন্তু তারা নিজেরা গেছে নানা ধারায় বিভক্ত হয়ে। জনতা বিভক্ত নয়, জনতার পক্ষের লোকেরা বিভক্ত। বামপন্থিরা সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি, সেটা হচ্ছে জাতিসত্তার নিপীড়ন-বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্ব। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা জাতিগত প্রশ্নের মীমাংসা না করলে শ্রেণিগত প্রশ্নটি যে স্পষ্ট হবে না এটা তারা খেয়াল করেনি। সঠিকভাবে ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুধাবন করলে স্বাধীনতার যুদ্ধ তাদের নেতৃত্বেই হতো এবং তার পরিণতি হতো ভিন্ন রকমের, মুক্তিযুদ্ধ আরো এগিয়ে যেতো, সমাজ এগুতো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অভিমুখে।
বামপন্থিদের কোনো কোনো অংশ অবশ্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা যে প্রথম দরকার সেটা বুঝেছিল। কিন্তু তারা সংগঠিত হতে পারেনি। তাছাড়া জনগণের ভাষা তারা জানতো না। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের দ্বন্দ্বকে কীভাবে জাজ্বল্যমান করে তুলতে হবে তা তাদের ধারণার মধ্যে ছিল না। জাতিগত দ্বন্দ্বের বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন না থাকায় বামপন্থিদের অংশবিশেষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা পর্যন্ত করেছে।
স্বাধীনতার পরে বামপন্থিদের কাছ থেকে এটা প্রত্যাশিত ছিল যে, সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে তারা ঐক্যবদ্ধ হবে। তারা তা হয়নি। বরঞ্চ তাদের বিভাজন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংগঠিত করবে। কিন্তু পুঁজিবাদের সর্বাত্মক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বুর্জোয়া পাওয়া যায়নি, লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়ারাই কর্তৃত্ব করেছে। এরা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাই বিশ্ব পুঁজিবাদের আগ্রাসনের মুখে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করতেও তারা প্রস্তুত থেকেছে। লুণ্ঠনকারীরা সেটাই করে; মুফতে-পাওয়া সম্পত্তির প্রতি তাদের কোনো মায়া, মমতা থাকে না। বাম উগ্রপন্থিদের কেউ কেউ আবার বলতে চেয়েছে যে, স্বাধীনতা আসেনি, রুশ-ভারত অক্ষশক্তি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে মাত্র। এসব বিচ্ছেদ ও বিভ্রান্তির কারণে জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে এমন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হতে পারেনি।
একাত্তরের পরে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়েছিল তাদের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল। তাদের দলীয় তরুণদের একাংশ দেখছিল তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পারছে না, অপরাংশের তুলনায় তারা সুবিচার পাচ্ছে না। হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে তারা বের হয়ে এসে নতুন সংগঠন গড়েছে, নাম দিয়েছে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তাদেরকেও যেহেতু শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন ছিল এবং এই শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার কাছ থেকে পাবে বলে আশা করা যাচ্ছিল না তাই তারা জনগণের কাছে গেল। জানতো তারা যে জনগণ পুরাতন আওয়াজে আর সাড়া দেবে না। তাই নতুন রণধ্বনি তুললো সমাজতন্ত্রের এবং হাজার হাজার তরুণ, যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছিল, যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কিন্তু মুক্তির পথ দেখতে পায়নি তারা তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়েছে, যোগ দিয়েছে ওই দলে। ওই দলের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ এখনো সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগুতে চাইছে, কিন্তু মূল দলসহ বাদবাকিরা ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও মাত্রায় বিলীন হয়ে গেছে।
রাজাকারেরা ফিরে এসেছে। মৌলবাদ শক্তিশালী হয়েছে। এর মূল কারণ ওই একটাই, সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি। সমাজ একটা ধাক্কা খেয়েছে, সে নড়ে উঠেছে, কিন্তু এমনভাবে আধুনিক হয়নি যে রাজাকার ও মৌলবাদ অতীতের প্রাণি বলে চিহ্নিত হবে, পরিণত হবে এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতে। ক্ষমতায় যারা যাতায়াত করে রাজাকার ও মৌলবাদ তাদের কাছে যথার্থ অর্থে দূরের নয়। কারো জন্য খুব কাছের, কারো জন্য ততটা কাছের নয়, ব্যবধান এইটুকুই, সেটা মাত্রাগত, গুণগত নয়। সমাজে বৈপ্লবিক রূপান্তরের চেষ্টা যদি চলতো তাহলে এরা প্রশ্রয় পেতো না। শাসকশ্রেণি ধর্মকে ব্যবহার করে চলেছে, দুই কারণে। এক, জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েছে তাদেরকে নিজেদের রাজনৈতিক দলের কাছে নিয়ে আসার অভিপ্রায়ে। দুই, নিজেরাই যেসব অন্যায় করছে তার দরুন তৈরি অপরাধবোধ থেকে অব্যাহতি পাবার আশায়।
বাংলাদেশের জন্য গ্রামই ছিল ভরসা। আন্দোলনে গ্রাম না এলে জয় আসেনি। বিপদের সময় গ্রাম যদি আশ্রয় না দিতো তবে বিপদ ভয়াবহ হতো। গ্রামেই রয়েছে উৎপাদক শক্তি। গ্রামবাসীর শ্রমে তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য লুণ্ঠন করেই ধনীরা ধনী হয়েছে। এখনও গ্রাম কাজে লাগছে বিদেশ থেকে সাহায্য, ঋণ, দান ইত্যাদি এনে তার সিংহভাগ আত্মসাৎ করার অজুহাত ও অবলম্বন হিসেবে।
একাত্তরে আমারা গ্রামে গেছি। বাড়িঘর, মজা পুকুর, হারিয়ে-যাওয়া ক্ষেত, মৃতপ্রায় গাছপালা-এসবের খোঁজখবর করেছি। শহর তখন চলে গেছে শত্রুর কবলে, যাকগে, আমরা গ্রামেই থাকবো-এই সিদ্ধান্ত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। শহরের পতন ঘটেছে সর্বাগ্রে, গ্রামের ঘটেনি, যদি ঘটতো তাহলে আমাদের পক্ষে অত দ্রুত জেতা সম্ভব হতো না।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র গ্রামে যারা গিয়েছিল তারা যত দ্রুতগতিতে গেছে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে ফেরত চলে এসেছে। পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর, কারখানা, অফিস, পদ, গাড়ি যে যেটা পেরেছে লুণ্ঠন করেছে। পাকিস্তানিরা অব্যাহতভাবে লুণ্ঠন করেছিল ২৪ বছর, বিশেষ করে নয় মাসে তাদের তৎপরতা সীমাহীন হয়ে পড়েছিল, তারা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল সবকিছু। স্বাধীনতার পরে সুবিধাভোগীরা শোধ নিয়েছে। লুটপাট করেছে স্বাধীনভাবে। এখনও করছে।
গ্রাম রইলো সেখানেই যেখানে ছিল। বস্তুত খারাপই হলো তার অবস্থা। পাকিস্তানিরা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সব করেছে। ঘর পুড়িয়েছে, ফসল জ্বালিয়েছে। স্বাধীনতার পরে গ্রামবাসী পুরাতন জীবন ফিরে পায়নি। অবকাঠামো গিয়েছিল ভেঙে। বন্যা এলো। এলো দুর্ভিক্ষ। বিপুলসংখ্যক মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়লো।
গ্রাম এখন ধেয়ে আসছে শহরের দিকে। আশ্রয়দাতা হিসেবে নয়, আসছে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। তার হাত দু’টি মুক্তিযোদ্ধার নয়, হাত তার ভিখারীর। ফলে শহর এখন বিপন্ন মনে করছে নিজেকে। ভাবছে আবার তার পতন ঘটবে- এবার পাকিস্তানিদের হাতে নয়, গরিব বাংলাদেশিদের হাতে। মনে হচ্ছে আবারও একটা মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হবে।
না, তেমন যুদ্ধ ঘটবে না। কেননা মুক্তিযুদ্ধ তো চলছেই কোনো না কোনোভাবে। মানুষ যে মুক্ত হয়নি সেটা কারো কাছেই অস্পষ্ট নয়। ওই যুদ্ধকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা শাসকশ্রেণির দল করবে না। তার জন্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন হবে। ডানদিকের নয়, বামদিকের।
বলা হয়, গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে সংখ্যাগুরুর শাসন। কিন্তু আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা, অর্থাৎ ধনীরা শাসন করে সংখ্যাগুরুকে, অর্থাৎ গরিবকে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ব্যবস্থা চলা উচিত নয়। এটা চলবেও না। এই জন্য যে সংখ্যাগুরু সচেতন ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে। তারা মুক্তি চায়। পরিবর্তন একটা ঘটবেই। প্রশ্ন হলো, কবে এবং কীভাবে। স্বাধীনতা ওই বড় পরিবর্তনের জন্যই প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নিজেই দুর্বল হয়ে পড়বে যদি জাতীয় মুক্তি না আসে।
মুক্তির প্রশ্নটি এখন আর আঞ্চলিক নয়। দ্বন্দ্ব এখন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের নয়, প্রশ্নটি এখন শ্রেণিগত, দ্বন্দ্ব এখন বাঙালি ধনীর সঙ্গে বাঙালি গরিবের। বিষয়টা এমন পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পেত না বাংলাদেশ যদি স্বাধীন না হতো। স্বাধীনতা আমাদের খুবই জরুরি ছিল, সমষ্টিগত অগ্রগতির পথে প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের সংবিধান থেকে ধর্মরিপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই দু’টি দাবি এসেছিল মুক্তির জাগ্রত আকাক্সক্ষা থেকেই। পাকিস্তান আমলে-তৈরি সাম্প্রদায়িক ও শ্রেণিগত বিভাজনকে নাকচ করে দিতে চেয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মূলনীতি দু’টি যে বিদায় করে দেয়া হলো সেটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, স্বাভাবিক ঘটনা বটে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, আমাদের ইতিহাসের একমাত্র জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধ জনতার জয় হয়েছিল। কিন্তু বিজয়ী জনতা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, ক্ষমতা আগের মতোই চলে যাচ্ছিল অল্প কিছু মানুষের হাতে। পঁচাত্তরের নৃশংস পটপরিবর্তনের পর নতুন যারা ক্ষমতায় এলো তারা শুধু ক্ষমতাই বুঝেছে, অন্য কিছু বুঝতে চায়নি। তারা জনগণের লোক নয়, জনগণের আদর্শ তাদের নয়। তাদের আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থান ছিল না। তারা তাদের আদর্শকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তারপর ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যারা ক্ষমতায় এসেছিল এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচয় দিলেও, মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাকে ধারণ করেছেন, সেটা বলা যাবে না। সঙ্গত কারণে তারাও তো সরিয়ে-দেয়া মূলনীতি দু’টি ফেরত আনেনি। ফেরত আনা পরের কথা, তারা সাংবিধানিক বৈধতাও দিয়ে দিয়েছে। এই উদাসীনতা তাৎপর্যহীন নয়। বাস্তবতা বদলে গেছে। জনগণ যে স্বপ্ন দেখেছিল তা এখন অতীতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হয়তো-বা অতীতের স্মৃতিতেই পরিণত হবে, কারো কারো হয়তো মনে এমন আশা রয়েছে।
মূল সত্যটা হচ্ছে এই যে, জনগণের কাছে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা থেকে তারা অনেক দূরে। সামরিক সরকারের আমলে দূরে ছিল, নির্বাচিত সরকারের আমলেও সেই দূরেই রয়ে গেছে। এই দূরত্ব আগামীতে বাড়বে না, বরঞ্চ কমে আসবে, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? তা তো বলা যাবে না। জনগণের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটাবার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি কই? কর্মসংস্থানের উদ্যোগ কোথায়?
রাষ্ট্রক্ষমতায় যে বড় পরিবর্তন এসেছে সেগুলো এমনি এমনি ঘটেনি, বিত্তবানদের কারণেও ঘটেনি। প্রত্যেকটির পেছনেই জনগণ ছিল। ১৯৪৬-এ সাধারণ মানুষ ভোট দিয়েছে। ১৯৭১-এ সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাতেই রাষ্ট্র বদলেছে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ; ওই স্বাধীনতায় মুক্তি এলো না। উল্টো মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়লো। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ভিন্ন প্রকারের, তার সামনে মুক্তির লক্ষ্যটা ছিল আরো স্পষ্ট, আরো প্রত্যক্ষ। কিন্তু এই স্বাধীনতা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে কি? মুক্তি এসেছে কি মানুষের? সে তো মনে হয় অনেক দূরের ব্যাপার।
মুক্তি না-আসার কারণটি হচ্ছে এই যে, সংগ্রাম জনগণই করেছে এটা ঠিক, কিন্তু নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিল না। জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ কী? জনগণ তো ব্যক্তি নয়, এক নয়, তারা বহু, অসংখ্য, কে নেতা হবে কাকে ফেলে? জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ হলো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন সংগঠনের হাতে নেতৃত্ব থাকা। স্বার্থটাই আসল কথা। আওয়াজ উঠতে পারে নানাবিধ, আওয়াজ মানুষকে উদ্বুদ্ধও করে নানাভাবে, কিন্তু ধ্বনি যথেষ্ট নয়, কার স্বার্থে ধ্বনি উঠেছে সেটাই জরুরি।
জনগণের পক্ষে অনেক সংগঠনই কথা বলেছে বলে মনে হয়েছে। এখনও মনে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ সাড়াও দিয়েছে তাদের ডাকে; কিন্তু পরে যখন ক্ষমতা হাতে এসেছে তখন সংগঠনগুলো জনগণের স্বার্থ দেখেনি, স্বার্থ দেখেছে নিজেদের। সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখবার কথা বামপন্থিদের। আমাদের দেশ বলে নয়, সবদেশেই আজকের যুগে সামাজিক বিপ্লব বামপন্থি আন্দোলনের দ্বারাই সম্ভবপর, দক্ষিণপন্থিরা ওই কাজ করবে না। সমগ্র জনগণের স্বার্থ দেখবার কথা বামপন্থিদেরই, কেননা তারা শ্রেণির নয়, তারা শ্রেণিচ্যুত। কন্তু বাংলাদেশে বামপন্থিরা জনগণকে সঙ্গে নিতে পারেনি। যে জন্য তারা শক্তিশালী হয়নি। জনগণের আস্থা তাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাদের এই ব্যর্থতার কারণ জনগণের মেজাজ, ভাষা, কল্পনা তারা আত্মস্থ করতে পারেনি এবং একই সঙ্গে জনগণের সঙ্গে কখন কার প্রধান দ্বন্দ্ব সেটা অনুধাবনেও তারা অপরাগ হয়েছে। ১৯৪৭ সালেই বামপন্থিরা আওয়াজ তুলেছিল, ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়। বক্তব্যটা একেবারেই সঠিক ছিল। মানুষ অভুক্ত রয়েছে। স্বাধীনতা কোথায়? স্বাধীনতা যে ভুয়া ছিল তা মানুষ পরে বুজেছে, বুঝে নতুন করে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছে, কিন্তু সাতচল্লিশে তারা প্রস্তুত ছিল না নতুন করে আন্দোলন করতে। তাদের চোখে তখনও স্বপ্নের ঘোর এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার নির্মম স্মৃতি। জনগণ সাড়া দেয়নি। শাসকেরা সুযোগটা নিলো, তারা বামপন্থি দমনে তৎপর হয়ে উঠলো। ব্যর্থ হয়ে বামপন্থিরা রণকৌশল বদল করা দরকার মনে করলো। এবার চলে গেলো তারা উল্টো মেরুতে, ঠিক করলো কাজ করতে হবে ধীরে ধীরে, পরিচয় লুকিয়ে, উঠতি মধ্যবিত্তের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক দলের ছাত্রছায়ায় থেকে।
কিন্তু শাসকেরা তো জানে তাদের আসল শত্রু কারা। আসল শত্রু আসলে জনগণ, যাদের তারা শোষণ করে এবং সে-জন্য ভয় করে। জনগণের পক্ষে যে সংগঠন দাঁড়াবে স্বভাবতই শাসক তাদের শত্রুজ্ঞান করবে। তখনকার পাকিস্তানে তারা তাই অন্য রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেনি, নিষিদ্ধ করেছে কমিউনিস্ট পার্টিকে। যাদের সঙ্গে তাদের ভোটযুদ্ধ, অর্থাৎ ক্ষমতা ভাগাভাগির লড়াই, তাদেরকেও নানাভাবে জব্দ করেছে ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়নি; নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে বামপন্থিদেরকে, জাতশত্রু জ্ঞান করে।
তারপরেও বাম আন্দোলন ছিল। ছিল তারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে, ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। জনগণের স্বার্থে কথা তারাই মূলত বলেছে। কিন্তু তারা নিজেরা গেছে নানা ধারায় বিভক্ত হয়ে। জনতা বিভক্ত নয়, জনতার পক্ষের লোকেরা বিভক্ত। বামপন্থিরা সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি, সেটা হচ্ছে জাতিসত্তার নিপীড়ন-বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্ব। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা জাতিগত প্রশ্নের মীমাংসা না করলে শ্রেণিগত প্রশ্নটি যে স্পষ্ট হবে না এটা তারা খেয়াল করেনি। সঠিকভাবে ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুধাবন করলে স্বাধীনতার যুদ্ধ তাদের নেতৃত্বেই হতো এবং তার পরিণতি হতো ভিন্ন রকমের, মুক্তিযুদ্ধ আরো এগিয়ে যেতো, সমাজ এগুতো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অভিমুখে।
বামপন্থিদের কোনো কোনো অংশ অবশ্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা যে প্রথম দরকার সেটা বুঝেছিল। কিন্তু তারা সংগঠিত হতে পারেনি। তাছাড়া জনগণের ভাষা তারা জানতো না। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের দ্বন্দ্বকে কীভাবে জাজ্বল্যমান করে তুলতে হবে তা তাদের ধারণার মধ্যে ছিল না। জাতিগত দ্বন্দ্বের বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন না থাকায় বামপন্থিদের অংশবিশেষ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা পর্যন্ত করেছে।
স্বাধীনতার পরে বামপন্থিদের কাছ থেকে এটা প্রত্যাশিত ছিল যে, সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে তারা ঐক্যবদ্ধ হবে। তারা তা হয়নি। বরঞ্চ তাদের বিভাজন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংগঠিত করবে। কিন্তু পুঁজিবাদের সর্বাত্মক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বুর্জোয়া পাওয়া যায়নি, লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়ারাই কর্তৃত্ব করেছে। এরা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাই বিশ্ব পুঁজিবাদের আগ্রাসনের মুখে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করতেও তারা প্রস্তুত থেকেছে। লুণ্ঠনকারীরা সেটাই করে; মুফতে-পাওয়া সম্পত্তির প্রতি তাদের কোনো মায়া, মমতা থাকে না। বাম উগ্রপন্থিদের কেউ কেউ আবার বলতে চেয়েছে যে, স্বাধীনতা আসেনি, রুশ-ভারত অক্ষশক্তি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে মাত্র। এসব বিচ্ছেদ ও বিভ্রান্তির কারণে জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে এমন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হতে পারেনি।
একাত্তরের পরে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়েছিল তাদের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল। তাদের দলীয় তরুণদের একাংশ দেখছিল তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পারছে না, অপরাংশের তুলনায় তারা সুবিচার পাচ্ছে না। হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে তারা বের হয়ে এসে নতুন সংগঠন গড়েছে, নাম দিয়েছে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তাদেরকেও যেহেতু শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন ছিল এবং এই শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার কাছ থেকে পাবে বলে আশা করা যাচ্ছিল না তাই তারা জনগণের কাছে গেল। জানতো তারা যে জনগণ পুরাতন আওয়াজে আর সাড়া দেবে না। তাই নতুন রণধ্বনি তুললো সমাজতন্ত্রের এবং হাজার হাজার তরুণ, যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছিল, যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কিন্তু মুক্তির পথ দেখতে পায়নি তারা তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়েছে, যোগ দিয়েছে ওই দলে। ওই দলের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ এখনো সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগুতে চাইছে, কিন্তু মূল দলসহ বাদবাকিরা ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও মাত্রায় বিলীন হয়ে গেছে।
রাজাকারেরা ফিরে এসেছে। মৌলবাদ শক্তিশালী হয়েছে। এর মূল কারণ ওই একটাই, সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি। সমাজ একটা ধাক্কা খেয়েছে, সে নড়ে উঠেছে, কিন্তু এমনভাবে আধুনিক হয়নি যে রাজাকার ও মৌলবাদ অতীতের প্রাণি বলে চিহ্নিত হবে, পরিণত হবে এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতে। ক্ষমতায় যারা যাতায়াত করে রাজাকার ও মৌলবাদ তাদের কাছে যথার্থ অর্থে দূরের নয়। কারো জন্য খুব কাছের, কারো জন্য ততটা কাছের নয়, ব্যবধান এইটুকুই, সেটা মাত্রাগত, গুণগত নয়। সমাজে বৈপ্লবিক রূপান্তরের চেষ্টা যদি চলতো তাহলে এরা প্রশ্রয় পেতো না। শাসকশ্রেণি ধর্মকে ব্যবহার করে চলেছে, দুই কারণে। এক, জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েছে তাদেরকে নিজেদের রাজনৈতিক দলের কাছে নিয়ে আসার অভিপ্রায়ে। দুই, নিজেরাই যেসব অন্যায় করছে তার দরুন তৈরি অপরাধবোধ থেকে অব্যাহতি পাবার আশায়।
বাংলাদেশের জন্য গ্রামই ছিল ভরসা। আন্দোলনে গ্রাম না এলে জয় আসেনি। বিপদের সময় গ্রাম যদি আশ্রয় না দিতো তবে বিপদ ভয়াবহ হতো। গ্রামেই রয়েছে উৎপাদক শক্তি। গ্রামবাসীর শ্রমে তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য লুণ্ঠন করেই ধনীরা ধনী হয়েছে। এখনও গ্রাম কাজে লাগছে বিদেশ থেকে সাহায্য, ঋণ, দান ইত্যাদি এনে তার সিংহভাগ আত্মসাৎ করার অজুহাত ও অবলম্বন হিসেবে।
একাত্তরে আমারা গ্রামে গেছি। বাড়িঘর, মজা পুকুর, হারিয়ে-যাওয়া ক্ষেত, মৃতপ্রায় গাছপালা-এসবের খোঁজখবর করেছি। শহর তখন চলে গেছে শত্রুর কবলে, যাকগে, আমরা গ্রামেই থাকবো-এই সিদ্ধান্ত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। শহরের পতন ঘটেছে সর্বাগ্রে, গ্রামের ঘটেনি, যদি ঘটতো তাহলে আমাদের পক্ষে অত দ্রুত জেতা সম্ভব হতো না।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র গ্রামে যারা গিয়েছিল তারা যত দ্রুতগতিতে গেছে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে ফেরত চলে এসেছে। পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর, কারখানা, অফিস, পদ, গাড়ি যে যেটা পেরেছে লুণ্ঠন করেছে। পাকিস্তানিরা অব্যাহতভাবে লুণ্ঠন করেছিল ২৪ বছর, বিশেষ করে নয় মাসে তাদের তৎপরতা সীমাহীন হয়ে পড়েছিল, তারা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল সবকিছু। স্বাধীনতার পরে সুবিধাভোগীরা শোধ নিয়েছে। লুটপাট করেছে স্বাধীনভাবে। এখনও করছে।
গ্রাম রইলো সেখানেই যেখানে ছিল। বস্তুত খারাপই হলো তার অবস্থা। পাকিস্তানিরা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সব করেছে। ঘর পুড়িয়েছে, ফসল জ্বালিয়েছে। স্বাধীনতার পরে গ্রামবাসী পুরাতন জীবন ফিরে পায়নি। অবকাঠামো গিয়েছিল ভেঙে। বন্যা এলো। এলো দুর্ভিক্ষ। বিপুলসংখ্যক মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়লো।
গ্রাম এখন ধেয়ে আসছে শহরের দিকে। আশ্রয়দাতা হিসেবে নয়, আসছে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। তার হাত দু’টি মুক্তিযোদ্ধার নয়, হাত তার ভিখারীর। ফলে শহর এখন বিপন্ন মনে করছে নিজেকে। ভাবছে আবার তার পতন ঘটবে- এবার পাকিস্তানিদের হাতে নয়, গরিব বাংলাদেশিদের হাতে। মনে হচ্ছে আবারও একটা মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হবে।
না, তেমন যুদ্ধ ঘটবে না। কেননা মুক্তিযুদ্ধ তো চলছেই কোনো না কোনোভাবে। মানুষ যে মুক্ত হয়নি সেটা কারো কাছেই অস্পষ্ট নয়। ওই যুদ্ধকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা শাসকশ্রেণির দল করবে না। তার জন্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন হবে। ডানদিকের নয়, বামদিকের।
বলা হয়, গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে সংখ্যাগুরুর শাসন। কিন্তু আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা, অর্থাৎ ধনীরা শাসন করে সংখ্যাগুরুকে, অর্থাৎ গরিবকে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ব্যবস্থা চলা উচিত নয়। এটা চলবেও না। এই জন্য যে সংখ্যাগুরু সচেতন ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে। তারা মুক্তি চায়। পরিবর্তন একটা ঘটবেই। প্রশ্ন হলো, কবে এবং কীভাবে। স্বাধীনতা ওই বড় পরিবর্তনের জন্যই প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নিজেই দুর্বল হয়ে পড়বে যদি জাতীয় মুক্তি না আসে।
মুক্তির প্রশ্নটি এখন আর আঞ্চলিক নয়। দ্বন্দ্ব এখন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের নয়, প্রশ্নটি এখন শ্রেণিগত, দ্বন্দ্ব এখন বাঙালি ধনীর সঙ্গে বাঙালি গরিবের। বিষয়টা এমন পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পেত না বাংলাদেশ যদি স্বাধীন না হতো। স্বাধীনতা আমাদের খুবই জরুরি ছিল, সমষ্টিগত অগ্রগতির পথে প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে।