image
অলঙ্করণ: সঞ্জয় দে রিপন

বিজয় দিবস ২০২৫: কবিতা

যুদ্ধের মহান কীর্তি
ফারুক মাহমুদ
তখন ছিল যুদ্ধবছর

নররক্ত, নারীরক্ত, শিশুরক্ত সব একাকার

‘যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়’

এ আপ্তবাক্যটি

কখনো কখনো পেয়ে যায় ভিন্ন পরিভাষা

একত্তরে আমাদের তা-ই হয়েছিল

কী মহান কীর্তি!

যুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা এল

জীবনপালন অধিদপ্তর
জাহিদ হায়দার
আমি বাঁচার সত্য নিয়ে বলছি,

এই শহরের আকাশে কেন নেই পারাবত?

বাতাসের জামা পরে মেঘেরা, গতি মন্থর,

আমাকে বৃষ্টিহীন রেখে ফুটপাতে ছায়া ফেলে,

এবং নিয়ে চলে যাচ্ছে।

প্রেমহীনতার উর্ধগমনে আমরা ছুঁতে পারিনি কৃষ্ণচূড়া।

আন্তরিক সীমাব্ধতায় এখনো দুজন সুদৃশ্য পোশাক।

তোমার সঙ্গ আজও সঙ্গ হলো না।

মৃত ব্রাগুলির জন্যে আমি কি শোকপ্রস্তাব দেব?

কোনো পাখি নেই।

গাছগুলি সঙ্গপ্রকাশি।

চাবিঅলার গাম্ভীর্যে স্পষ্ট,

সব দরজায় ঝুলছে নিঃসঙ্গ তালা।

গৃহবাসী কি ফসলের খোঁজে গেছে?

শুনতে হয় বলে-

যেন এক বাধ্য বাঁশিবিশেষ- শুনছি,

জীবনপালন অধিদপ্তরের কথা।

নথিপত্রে যা কিছু লেখা

হয়তো রাত্রিবেলার সমবায়।

সূর্য-আঁকা ভোর
বিমল গুহ
একদিন পাখিডাকা ভোরে- পৃথিবীর ঘুম ভাঙে।

আমাদের প্রতিবাদী দামাল ছেলেরা যেন দুরন্ত প্রাণ

বাধার পাহাড় ভেঙে দূরপথে সাহসে এগোয়-

তুচ্ছ করে কালোমেঘ অশনি তা-ব!

মৃত্যুঞ্জয়ী সেইসব প্রাণ এঁকেছিলো বুক-জুড়ে

প্রাণের কল্লোল, দিগন্তের শোভা, আকাশের নীল;

সকাল-মধ্যাহ্ন-সাঁঝ রাতের আঁধার পিছু ফেলে

সূর্যজ্বলা ভোরের প্রতীক্ষা তখন আমাদের!

সববাধা তুচ্ছ করে জেগে ওঠে পাখিডাকা ভোর-

সূর্যোদয়ের আগে আলোরেখা ছুঁয়ে দেখে

মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত দুরন্ত কিশোর

বীরদর্পে হাঁটে দূর-পথ। প্রতিঘাতে আয়ু ভাঙে

দীপ্র সাহস নিয়ে এগোয় সময় আমাদের;

সহস্র প্রাণের দামে হাতে-পাওয়া

বিস্তৃত আকাশ যেন পতাকার সূর্য-আঁকা ভোর।

পতাকার অহঙ্কার
হাসান হাফিজ
মুক্তিযুদ্ধ তুমি এক মহাকাব্য।

তোমাকে সৃজন করা, পূর্ণ কান্তি অবয়ব

নিষ্ঠায় নির্মিতি দেয়া বস্তুত কঠিন।

প্রয়োজন প্রচুর সময়।

সবচেয়ে বেশি দরকারি ওতে মানুষের প্রাণ।

সে প্রাণের সঞ্জীবনী সোমরস সুধা

প্রবল নিবিড় পুষ্টি ব্যতিরেকে

দৃশ্যমান তুমি নও। ওইসব উপাদান ছাড়া

তুমি রুগ্ণ ভঙ্গুর কাঠামো।

অশক্ত, দুর্বল। টেকসই নও।

বাংলাদেশ তার প্রিয় সন্তানের

প্রাণ দিয়ে তোমাকে পেয়েছে-

স্বাধীনতা মহার্ঘ এমনই,

দুষ্প্রাপ্য দুর্লভও সে

অগণিত মানুষের প্রাণ শুষে

বিকশিত ধন্যসিক্ত হয়

মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, লাল সবুজের দীপ্র অহংকৃত-

নভোনীলে পতাকা উড্ডীন।

পরাণচুল্লির দাহকণা
আবদুর রাজ্জাক
সর্বনাশা জ্যোৎ¯œা, গনগনে মেঘ, বিশ^স্ত কোলাহল হতবিহ্বল,

দেখতে দেখতে কুড়িটি বছর, হিসেব করিনি কতটুকু পেয়েছি,

কতটুকু পাইনি! অনেক যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ হয়ে আছে

হিসেব মেলানোর প্রয়োজন হয়নি।

দূর্বাঘাসে অপূর্ব সকালের শিশির, যেন এক ফোঁটা মুক্তো

জ¦লজ¦ল করে, প্রতিদিন পাঁজরভাঙ্গা দহন আর বিধিগ্রস্ত বুক,

কুড়িটি বছর একটি মাত্র শব্দে বুঝে নিয়েছি জন্ম জন্মান্তরের

দাহ পরাণচুল্লিতে পোড়ে।

উত্থিত সংকেত, ব্রাত্যজনেরা নিঃসীম বেদনায় কাতর,

ঝড়াহত ডালে দু’টি পাখি দুই ডালে বসে, নিঃসঙ্গ লীন।

অবাধ প্রকাশে মুচড়ে ওঠা কষ্টের মতো যথাক্রমে লাল ও নীল

পুনর্বিবেচনার কোনো দায় রাখে না, মন যা জানে,

চোখ তা বিশ^াস করে না, মৃত্তিকার পেক্ষাপটে

আমার উচ্চতা নেই, আমি মাথা নিচু করে, ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটি।

ঐক্যের জয়
মঈনউদ্দিন মুনশী
নির্ভীক হৃদয়গুলো হাতে হাত রেখে যুক্ত

প্রতিটি কণ্ঠস্বর এক বৃহৎ সমস্বরে সিক্ত

শৌর্য প্রবাহিত যেন প্রসারিত নদী

একত্রে আমরা স্থির পাশাপাশি।

আমাদের শক্তি এক প্রবল প্রতাপী

অধীনতা জানে না

অনুরণিত হয় রণভূমি ব্যাপি

ঐক্যের স্ফুলিঙ্গে উজ্জ্বল অগ্নিশিখা।

বিজয়প্রস্ফুটিত হয় চারিদিকে

যখন আমরা অংশভাগী হই জন্মভূমির নামে।

সব স্থবির হয়ে আছে
খালেদ হোসাইন
সবকিছু পাথর।

বইছে তবু বসন্তের বাতাস

শেষবারের মতো।

রূপকথার সেই রাজ্যে

ঢুকে পড়েছি।

এখানে সোনার গাছে

হিরের ফল ধরতো

ঝরনার জলে ঝিকমিক করতো

সূর্যের আলো

পাখিরা উড়তো, ঘুরতো

গাইতো মর্মসঙ্গীত।

আকাশে মেঘ চলাচল করতো

মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হতো

সবুজ ফসলের জমি

হয়ে উঠতো সোনালি।

এইখানে সবাইখানা ছিল

ওইখানে জলসত্র

এখানে বাজার আর

দিনরাত্রির কলহাস্য।

সব স্থবির হয়ে আছে।

সব পাথরের মূর্তি।

এত মূর্তি ভাঙা সহজ নয়।

তাই হাতুড়ি-বাটাল হাতে

স্তম্ভিত হয়ে আছি

অহল্যার মতো অভিশপ্ত।

আইজদ্দি ও চার ছায়ামূর্তি
মাহফুজ আল-হোসেন
কুয়াশাকীর্ণ বিজয়ের রাতে

আলোর শরীর ভেঙে হঠাৎ ভেসে ওঠে

এক অদৃশ্য মানচিত্র-

আইজদ্দি দেখে, তার চার সহযোদ্ধা

রাইফেল কাঁধ থেকে নামিয়ে

সেই মানচিত্রের ভাঁজ খুলে

ফিরে এসেছে কেবল ছায়া হয়ে।

তাদের ছড়ে যাওয়া হাঁটুর ক্ষতে

জমে থাকে মৃত নদীর স্বপ্ন,

আর খুবলে খাওয়া চোখের খোদলে

লেপ্টে আছে হারানো ইতিহাসের

গোপন লালচিহ্ন।

শহরজুড়ে ভৌতিক এলইডি আলোকসজ্জা,

যেন ভুলে যাওয়া রক্তের দগদগে স্মৃতিচিহ্ন

আর কষ্টে থাকা আইজদ্দির

রিক্সার প্যাডেলে থমকে আছে বিজয়োৎসব!

চার ছায়ামূর্তি তার মুখোমুখি ঠায় দাঁড়িয়ে,

অথচ অস্ত্র তোলে না-

বরং আওয়াজ তোলে সমস্বরে:

কোন আলো তোমাদের?

কোন অন্ধকার আমাদের?

বিজয় দিবস
হাইকেল হাশমী
দীর্ঘ নয় মাসের

অবিরাম, কৃষ্ণ অন্ধকারের শেষে

পূর্ব দিগন্তে উদিত হলো এক লাল সূর্য-

আশ্চর্য হয়ে দেখল,

একটি জাতি শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকেও

আত্মায় অটুট, মাথা নত করেনি।

অত্যাচারীরা চেয়েছিল

মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার প্রদীপ নিভিয়ে দিতে;

কিন্তু তাদের প্রতিটি আঘাতআরও প্রজ্বলিত করেছে

মুক্তির অগ্নিশিখা।

বঙ্গোপসাগরের বুকে জমেছিল এক ঘূর্ণিঝড়-

স্লোগানের গর্জনে সৃষ্ট বজ্র,

যুবকদের বুকে বিদ্যুতে গড়া সাহস,

আর কৃষক, মাঝি, শ্রমিকের

অটল হৃদয়ে প্রচ- ঘৃণার প্লাবন।

সাধারণ মানুষের অসাধারণ সংকল্প,

হয়ে উঠেছিল মুক্তির অগ্রদূত।

তারপর এক আলো-ভরা প্রভাতে,

স্বাধীনতার লাল সূর্যটি ছিনিয়ে আনলো তারা

স্বৈরাচারী শাসকের রক্তমাখা মুঠো থেকে।

বিজয় দিবস তাদের-

এই মাটির সাহসী সন্তানদের,

নির্ভীক যুবকদের,

সাধারণ জনগণের,

আর সেই শহীদদের- যাদের রক্ত হয়ে উঠেছে

আমাদের স্বাধীনতার স্বাক্ষর।

সংগ্রামে ও প্রার্থনায়
তাপস গায়েন
হেমন্তের ঝরাপাতা জড়ো করে

আমি হব দাবানল, আমি হব বিজয়ের উৎসব-

প্রতিরোধের অহংকারে রাতের অবতলে জেগে আছে পেঁচা

ঈগলের চোখে ব্যাপ্ত দিনের সকল প্রত্যয়

বিস্তৃত রাজপথে পিপীলিকার মিছিল, ভ্রান্তিহীন

হাতির দখলে নিয়েছি নগরীর সব সড়কপ্রধান

পৃথিবীর শান্তিকামী সব মানুষের সংগ্রাম যেমন আমার,

আর আমার প্রতিরোধে তারাও আজ সোচ্চার

আমার স্বদেশকে পাহারা দেবে

তিমি, জলফড়িঙ, আর শত শত শুশুক

কবরস্থান থেকে জেগে উঠুক শতসহ¯্র মুক্তিযুদ্ধের শহীদ

শ্মশানের ভস্ম থেকে উদ্ভূত হোক মানুষের প্রত্যয়

আমি আছি বিশ্বমানবের মুক্তির আকাক্সক্ষায়, আর আছি

এই বাংলায়- সংগ্রামে ও প্রার্থনায়

সান্নিধ্য
তুষার গায়েন
আমরা হাঁটছি দুটো আত্মা, মানুষের রূপ ধরে

জানি না কীভাবে দেখা হলো দৈহিক দেখার আগে

আলোর তরঙ্গে ভেসে আসে রূপ-লাবণ্য তোমার

হাসি, গান, সৃজন উৎসব হতে- পৃথিবীর

অপর গোলার্ধে যেখানে নিঃসঙ্গ বসে থাকি

আমি হৃদয়ের দোলাচলে। অন্তরে অভেদ যদি

বহিরঙ্গে বহু ব্যবধান- সে সব পেরিয়ে যেতে

তাড়া করে দ্বিধার সঙ্কট!বার্তা পাঠিয়ে দেখেছি

সরাসরি পাইনি উত্তর; মনে হয় পরোক্ষ জবাব

এসেছে আড়ালে কুয়াশার... সে সবে ভরসা করে

পুনর্বার বার্তা দিতে দ্বিধান্বিত মন, তবু কাব্য উৎসারিত

প্রাণ পেতে চায় সান্নিধ্য তোমার!

বিজয় যেন-বা ছিল এক
অসমাপ্ত স্বাধীনতা
চয়ন শায়েরী
উত্থান-পতন থাকে জাতীয় জীবনে, সংসারেও- অগ্রজের ভুল শোধরাতে চায় অন্য প্রজন্মের তরুণেরা- বিজয় যেন-বা ছিল এক অসমাপ্ত স্বাধীনতা;

অষুধ কীভাবে কাজ করে দেখো দেহের ভেতরে, অনুধ্যান সহকারে বোঝো নাই?- গ্রাফে আঁকো নাই বায়ো-অ্যাভাইবিলিটি?- কীভাবে গ্রাফ উপরে ওঠে, এরপর নেমে যায়, দেখো নাই?

পুঁজিবাজারের সূচকের উত্থানের গল্পের কথা শোনো নাই?- এরপর পতনের গ্রাফ দেখো নাই?

হৃদয়ের ব্যথা ইসিজি’র গ্রাফে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখো নাই?- কীভাবে জীবন্ত মানুষের হার্টের হৃদম গ্রাফ তৈরি করে উত্থানে-পতনে;

মৃত মানুষের গ্রাফ সরলরেখায় চলে- সিসিইউ মনিটরে তুমি দেখো নাই?- আনে তিক্ত অভিজ্ঞতাও।

উত্থান-পতনে জাতি আর্থিক মুক্তির পথ খোঁজে- পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে চায় যুগে যুগে প্রতিটা বিজয়, প্রতিটা বিপ্লবীও- প্রতিটা বিজয় ছিল এক অসমাপ্ত স্বাধীনতা।

এতটা সসীম আকাশ
ওবায়েদ আকাশ
এতটা সসীম আকাশ!

বিজয় উল্লাসে নাচে জন্মভূমি

দীর্ঘশ্বাস পরিয়ে দিয়েছে বাতাসের বিষণœ প্রতাপ

করুণ আহ্লাদে খসে পড়ছে সকল ঝরাপাতা

ভাবি, গবাদিপশুদের ডাকে এখনো কত মায়া!

ব্রিজের নিচে অতিথিশালায় বনভোজন

জন্মভূমি জানে, এখানে প্রাচীন নিমন্ত্রণ!

ব্রিজের গায়ে শোভা পাচ্ছে চড়ামূল্যের লাইভ জ্যাকেট

এবং নীলাভ সানগ্লাসে হারানো দিনের ক্রোধ

লাফ দিয়ে পড়তে গিয়ে শূন্যে ভেসে যাই

পাখিদের বিশ^াসযোগ্যতা ছাড়া আর কোনো

অহঙ্কার নাই আমার! ডানার ক্ষমতা আজ পক্ষিকুলে

সংরক্ষিত অভিধান

নিশ^াসকে বোঝাতে বোঝাতে বলি:

ভালে যা থাকে, এসব তাই!

মাস্ক খোলো, জীবনটা মেলে ধরো এই আসমানের ওপর

আড়ালে, সংগোপনে

মেরুদ- বাঁকা করে নিজেই এক বিশ^স্ত প্রতিরক্ষা হয়ে যাও

অতীতে তাকাও, চারপাশে, সুশৃঙ্খল বর্তমানে

জন্মভূমির আর্তনাদ ছাড়া আর কোনো প্রতিধ্বনি নাই

নিশ্চয়তাকে বলি, পৃথিবীতে প্রতিটি অরক্ষিত আয়ুর ওপর

ঘুম পাড়িয়ে দাও নির্ভরতার সনদ

কয়েকজন মৃত মানুষের অস্থির ইশারা
কামরুল ইসলাম
একটি অসমাপ্ত চোখ সাথে নিয়ে ঘুরছি-

চোখের কেন্দ্রবিন্দুতে বাতাসের প্রবাহ গেছে থেমে

তবু দেখতে পাই নদীর ওপারের কোনো অচেনা গ্রামের

ফুল-ঝরা উঠোনে তুমি দাঁড়িয়ে আছো বিকেলের রোদে-

পাতার ভিড় ঠেলে উড়তে উড়তে কিছু কিছু দুঃখ

পাতা হয়ে যায়, সেই পাতার স্তূপে জেগে আছে

কয়েকজন মৃত মানুষের অস্থির ইশারা। তোমার বুক জড়িয়ে

ঘুমিয়ে আছে পাতিলেবুর কিশোরী ফুলেরা,

কুড়িয়ে পাওয়া ময়ূরীর পালক থেকে বৃষ্টির মতো

ঝরে পড়ছে তোমার অশ্রুবিন্দুর তন্দ্রাহত কথামালা-

যে পাখিরা খুব বেশি উড়তে পারে না তাদের পাশে

দাঁড়িয়ে দেখলাম- তোমার অন্ধ দরজা সরে যাচ্ছে দূরে,

সমুদ্র থেকে ফিরে আসা পাখিদের ডানায় জড়িয়ে আছে

ঝাউবনের প্রেতাত্মাদের চাহনি, শীতরাত্রির মনোলগ

আমি সেইখানে খুঁজি তোমার ঢেউমাখা দেহের উপমা-

একটি দেশের ভেতরে একটি অনুচ্চারিত দেশ থাকে

আমি সেই দেশের পাখিদের কিচিরমিচির শব্দের মধ্যে

তোমার বন্ধ চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রর দিকে তাকাই,

এদিকে আমার অসমাপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আছে

হাঁটু জলে পড়ে থাকা ভাঙা নৌকার মরচেপড়া ছায়ারা-

বিজয়ের আগে
মুমির সরকার
এখানে এখন বানভাসী জোয়ারের মতোই

পলাশ-শিমুল-গুচ্ছে-অথৈ আগুন,

সম্পর্কে কে কাহার-

দিশেহারা লাজশরম!

কচি পাতায় হাওয়ারা ফিরে পেয়েছে প্রেম,

দোয়েল-শালিক-ফিঙে-পুচ্ছে লেগে আছে

তা’রি- রেশমি আলো।

এইতো পেরিয়ে এলাম স্নিগ্ধ সতেজ সকাল,

প্রভাতফেরির মতো আদরিনী বেলা।

ধনেখেত ধেয়ে আসা হাওয়ায় দম-বন্ধে বুঝি

এখনই বাজবে অবিনাশী বাঁশির গান;

অতঃপর সব চুপচাপ!

এভাবেই এখানে কেটে গেছে যে

কতকাল!

অথচ তুমি যখন এ পথটুকু মাড়িয়ে যাবে

তুমি যা চাও-

ঘরে-ঘরে-প্রতিঘরে, হারমোনিয়ামে তার-ই সুর ভেসে-ভেসে আসবে;

আর যখন জোৎস্নার আবছায়া পেরিয়ে ভিটে-আঙিনায় দাঁড়াবে,

মিশ্র ফুলের ঘ্রাণ-

দেখ সেই তোমাকেই জড়িয়ে ধরবে!

অথচ শূন্য ভিটের আঙিনায় ঘুঙুরহারা-

ময়ূরী নেচেছে আর চাঁদ ওঠে ক্লান্ত হয়ে-হয়ে মাদুরে

বসেও জলখাবার চায়নি এতটুকুন!

সেই বুঝি এলেই, তবে

এতকাল কোথায় ছিলে?

আগুন-চুলা-খাবার-শিঁকে-রাঁধুনি,

হারিয়ে গেছে।

ফুরিয়ে গেছে।

বিজয়ের আগে।

সূর্যকুসুম
পারভেজ আহসান
১.

হেমন্তবিকেলে উঁকি দেয় ঘুম-

কুসুমের বিভায় আরক্ত গোলাপ-

পাপড়িতে থাকা পতঙ্গ শোনে

মৈন্তীর গান।

২.

সাম্পানের গলুইয়ে সূর্যকুসুম-

দিকচক্রবাল ছাড়িয়ে গাঙচিল-

ঝিনুকের কান্না শুনছে পর্যটক

বিজয়হাওয়া
বিনয় বর্মন
সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা

বনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম

কোনো গাছে কোনো পাতা নেই

কা-শাখা পোকায় খাওয়া

গোড়ায় উইয়ের ঢিবি

অথচ এখানে বইছে বিজয়হাওয়া

চাঁদ আর সূর্যের নিত্য আসা-যাওয়া

হঠকারিতার মহোৎসব

শীতে কাঁপছে পাখিগুলো

তাদের কোনো আশ্রয় নেই

কত পর্বত পার হয়ে আসতে হয় ত্রিভুজতরঙ্গে

কত ছাই মাখতে হয় ভস্ম হওয়ার আগে

এখানে স্বাধীনতা বড় সস্তা

বস্তাবন্দি লাশ, উদ্ভট উল্লাস

বইছে উথালপাতাল বিজয়হাওয়া।

আছি, যাপিত পাথর
জাফর সাদেক
পিতার জন্মের আগে এ-শহরে এসেছে সংগীত

পিতামহের আগে এই শহর লালনের

তুমি জন্মে পেয়েছ এ-জনপদ শাহ আব্দুল করিমের

কোন আবর্তন রেখায় জন্ম হয়েছিল আমার

মনে নেই মাতৃবৃক্ষের তীব্র আর্তনাদ

মনে আছে কেবল

কোনও ধূসর মুখ মুছে যাওয়ার আগে

শরৎ মেঘের শুভ্র আঁচল ওই সাঁওতাল রমণীর

মেঘের চোখে সরোবর আঁকার আগে

পেয়েছি চৈতন্যে বিভোর হবার শিক্ষা সমুদ্রের কাছে

সেই থেকে বৃষ্টির ঘোরে আমার আবর্তনে- আমিই পথ

মগ্নতার ভোরে আমিই নগ্ন আদিম পূর্বপুরুষ

পাথরের শরীর খুঁড়ে পেয়েছি আগুন

আগুনের নিদ্রাকালে আছি যাপিত পাথর

আঙুলে জড়ানো শাড়ির আঁচল
রকিবুল হাসান
সেই কবে ছোটবেলা তুলতুলে নরম হাতে মায়ের আঁচল

ধরেছি দু’হাতে ঢেউয়ের মতো হিসাবহীন ঢেউখেলা জীবন

আজ আর মনে নেই- যেন ধরে আছি সেই শাড়ির আঁচল

মা আমার কত দূরের এখন- কেউ বলে আকাশের

দূর তারা- কেউ বলে ঘুমের দেশের ঘুমপরি- আমি যেন

এখনো হাতের আঙুলে জড়িয়ে নিয়ে আছি আঁচলের ঘ্রাণ

কয়াগ্রামের কাদামাটি পথের শরীর এখনো আমি দু’হাতে

ধরে রাখি- এ তো মায়েরই দু’দ- শান্তির নিখাদ আঁচল

জড়িয়ে রয়েছে কী যে গভীর মমতায়- মাটির আঁচল আমাকে

কী ব্যাকুল হয়ে টানে- কেঁদে ওঠে তৃষ্ণানদী ভেতর আমার

দু’হাত ছড়িয়ে আমি শুয়ে পড়ি বুক বেঁধে মাটির শাড়িতে

এ যেন মায়ের কোমল বুকে ঘুমিয়ে পড়া দুগ্ধতৃষ্ণায়

অবুঝ দোয়েল

গড়াই নদীটি কী যে বাঁক খেয়ে কতভাবে ছুটে যায়

সেই যে শৈশবে দু’হাতে জড়িয়ে আছি

স্রোতের রুপালি আঁচল- এখনো প্রবল প্রগাঢ় টানে ছুটে যাই

এ তো আমার মায়েরই মমতা মধুর অপ্রতিরোধ্য টান

অগ্নিতৃষ্ণায় পুড়তে থাকে আমার বুক- আমার হাতের

আঙুলে জড়ানো শাড়ির আঁচল- ফেরায় আমাকে

প্রকৃত আমার কাছে

বিজয়ের পঙ্ক্তিমালা
আদ্যনাথ ঘোষ
কোনো কোনো ভোর ঢেলে দেয় আলোঝরা দিন।

কোনো কোনো ফুল ফোটে

শহিদের রক্তের মতোন।

ভালোবাসা নাকি দুঃখের পাথরে ঘসে নিতে হয়।

ভালোবাসা নাকি শহিদদের রক্তের টগবগে রঙ।

কেউ কেউ হাসি মুখে মৃত কোনো স্বপ্নকে

সবুজে ভাসায়।

পৃথিবীও তাকিয়ে রয়

মা ও মাটির সুখের হাওয়ায়।

শহিদেরা বীজ বোনে,

বিজয়ের সূর্য ওঠে, ফাগুনে বাতাস বয়,

ঢেলে দেয় হাজার লক্ষ কোটি নতুন পঙ্ক্তিমালা।

বিজয়ের উদারনীতি
আমিরুল হাছান
অভিযানে বিজয় অভিমানে বিজয় মানচিত্রে বিজয়

শব্দের সাথে শব্দের কৌশলে শক্তির বিজয়

ফিরে আসে বারবার বঙ্গের বিজয়

তেপান্তরের প্রান্তে নীল আকাশে লাল সবুজের জ্যামিতিক পতাকা

বিতরণ হয় ফুলের, আদান প্রদানে নক্ষত্রের না দেখা শ্রদ্ধাঞ্জলি।

স্বাভাবিক হয়ে ভাবি, মুখ বন্ধ করে ভাবি,মন কেন কাঁদে;

চর্ম চোখে তাকিয়ে থাকি ইতিহাসের পাতায়

বিজয়ের উদারনীতি উদারতা হারাচ্ছে।

অক্ষরগুলি অক্ষম হয়ে যাচ্ছে নাকি আমি অক্ষম;

যতœটা যতটা করি, অভিনয় তার চেয়ে বেশি করি

আফসোস আমি পতাকার বুকে চোখের জলে হাসতে পারিনা।

আমি কেন্দ্রীয় মনে উল্লাসে বলিনা হায় আমার মানচিত্র বিজয়ের মানচিত্র।

১৬ ডিসেম্বর ঘুমিয়ে থাকা বিজয় নয়। রণকৌশলের বিজয়।

বাংলা প্রেমের বিজয়।

ফিরতি পথে বিরতি দিয়ে আবার তাকাই আমার মানচিত্রে।

আমার তর্জনী খুঁজে বেড়ায় তর্জনীকে।

আমি কি ঘুণ পোকা? আমি কেন চিৎকারের গলায় চিৎকার দেখি

সাহস করে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিবো কোন পথে। আমি মুক্ত ঘরে মুক্ত মন পাইনা।

তারপরও ভালো থেকো আমার বাংলার বিজয়।

রক্ত মথিত তোমাকে
দিলীপ কির্ত্তুনিয়া
রক্তমথিত তোমাকে কত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে!

ইজ্জত লুণ্ঠিত তোমাকে কত কিছু শুনতে হচ্ছে!

হে মৃত্যু সংখ্যা তোমাকে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন হিসাব।

হে জয়যুক্ত তোমার কি মনে হচ্ছে

পরাজিত হলে ভালো ছিল!

যোদ্ধার হাত তোমার কি মনে হয়

ভুল করেছো সেদিন!

হে সত্য, তোমার কি মনে হয়

সর্বৈব মিথ্যে দিয়ে তোমাকে

ঢেকে দেয়া যাবে!

তোমার কি নতুন কথা শুনে

কষ্ট হচ্ছে- খারাপ লাগছে!

চোখের পলক তুমি তাকিয়ে আছো

সবুজ রাঙা পতাকায়।

হে শক্তি, হে দেহের বল

তোমরা দেখো এই স্বাধীনতা যেন

মিথ্যে হয়ে না যায়!

১৯৭১
অদ্বৈত মারুত
হৃদয়ে নিশ্চুপ ভোরের আকাশ

মাটির গন্ধের সাথে মেশানো রক্তের শিহরন

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নদী যায় একান্তে- নিঃশব্দে

মাটি কাঁপে- কখনও দৃশ্যে, কখনও অদৃশ্যে।

টের পাই অসংখ্য যোদ্ধার ধূলিমিশ্রিত পায়ের ছাপ

পেছনে হাত বাড়িয়ে ধরছে আমাদের হাত

কুয়াশায় না-মিলিয়েই।

বৃষ্টিহীন বাতাসে ভাসছে অচেনা বারুদ-

জন্মাচ্ছে আগুনপ্রপাত।

ঘাসের ডগায় শিশির- শিশুর প্রথম চিৎকার।

মায়ের বুক ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকে সে চুপচাপ।

পতাকা দুলছে নরম হাওয়ায় লাল-সবুজে

সূর্যের কোমল আলো নাচে নদীর ঢেউয়ে।

অন্ধকারে শহীদ মিনারে আলোর উৎসব

চোখের জলে ভেজে একাত্তরের চিঠি।

যুদ্ধস্মৃতি বাতাসে ভাসে- জন্ম নেয় বিমূর্ত বোধ

শহীদের আত্মার স্পন্দন।

আমরা স্মৃতির সাথে হাঁটি

বৃক্ষ-নদী জানে, একাত্তরের দিনগুলি।

একাত্তরের এলবাম
খৈয়াম কাদের
বিজয় এসেছে বলেই মিলেছে আত্মপরিচয়

বিজয় পেয়েছি বলেই জেনেছি

স্বাধীনতা কারে কয়,

বিজয়ের এই মহান মুহূর্তক্ষণে

আনমনে আমি তাই

স্মৃতির গহীনে ডুবে যাই;

লাখো শহীদের রক্তের অক্ষরে লেখা

আমার সোনার বাংলা খুঁজে পাই।

বীরাঙ্গনা মায়েদের শ্রেষ্ঠতর ত্যাগ

বীরাঙ্গনা বোনেদের

শুভ্র বিসর্জন, আর

অগণিত মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাথা-

সব নিয়ে একান্ত আবেগে আমি

আমার বর্ণমালার গান গাই।

বিজয়ের যোগফল
বেনজির শিকদার
বিজয়ের কথা ভুলে যাবো জেনে পরাজয়ে রাখি মন;

জয়-পরাজয় ঘিরে থাকে শুধু বেদনার আয়োজন।

বেদনার বাড়ি অদূর গ্রামেই কাছাকাছি শহরের;

বুনোলতাগুলো নেমে আসে ধীরে জীবনের গানে ফের।

চোখের জানালা খুলিনি তখনো মনের দ্বারও তোলা;

সংগ্রামে নেমে লক্ষ্য ভুলেছি পথহীন পথভোলা।

পথের দু’ধারে মানুষ ছিল কি? মানুষের মাঝে মন?

জয়-পরাজয় ঘিরে থাকে শুধু বেদনার আয়োজন।

পরাজিত ঘ্রাণে বিজয়ের সুর মুখের আড়ালে মায়া;

পরিতাপ যেন পরিহাসপ্রিয় দীর্ঘভ্রমের ছায়া।

বিজিতের বীজে অঙ্কুর ফলে ম্লান লাগে তবু মুখ;

ভালোবাসা হলে স্বর্গ-সোহাগী হেরে যেতে লাগে সুখ।

বারবার তাই হেরে গেছি শুধু জয়ের আঁচলতলে;

বিয়োগ দিলেও আরাধ্য আমি বিজয়ের যোগফলে।

সম্প্রতি