দিলারা হাফিজ
বিজয়ের ৫৪ বছর। রাজনীতির নানা চড়াই-উৎরাই পথে পা রেখেও অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করে গেছি আমরা ইতোমধ্যে। মনে হয় এই তো সেদিন ১৯৭১-এ সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে শেষ হলো। বিজয় অর্জিত হলো ১৬ ডিসেম্বর। একথা বাহুল্য বলা যে, তিরিশ লক্ষ বীর শহিদের আত্মত্যাগ এবং দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মধ্য দিয়ে অর্জিত এই বিজয় তিলক বাঙালি জাতির পরম অহংকার এবং জাতীয় বীরত্বের অন্যতম গৌরবগাথা।
ইতিহাসের ভয়াল রক্ত-সমুদ্র থেকে যেন উত্থিত হলো স্বপ্নের সোনালি সূর্যোদয়ে জ্যোতির্ময় এক স্বদেশ।আপামর জনতার গভীর দেশপ্রেমের অঙ্গীকার থেকেই জন্ম নিলো এমন কোমল হৃদয়ের এক বাংলাদেশ। আমাদের জনমনের সকল আনন্দ-বিষাদ,যুদ্ধের রক্ত ক্ষয় ও ক্ষতি নিমিষে একাকার হলো লাল-সবুজের সেই উড্ডীন পতাকায়। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে বিজয়ের মাস যেন হয়ে ওঠে নাক্ষত্রিক আলোর দেশ।আমাদের অস্তিত্বের সর্বত্তোম বিজয়-বাসনার প্রতিফলন। এর পেছনের রয়েছে তিরিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ ও দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম খোয়ানোর করুণ ইতিহাস। আমরা জানি, যেকোনো যুদ্ধের কৌশল হয়ে থাকে নানামুখী। সরাসরি রণক্ষেত্রের সম্মুখযুদ্ধ,অপরটি কৌশলগত যুদ্ধক্ষেত্র।
মহান মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯মাস বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কৌশলগত যুদ্ধের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন আমাদের মা-বোনেরা। এঁদেরকেই বলা হয় একাত্তরের বীরাঙ্গনা নারী।
বীরাঙ্গনা ’৭১ বলতে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী দ্বারা নির্যাতিত (ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার) নারীদের বোঝানো হয়, যাঁদেরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দিয়ে সম্মান জানান এবং পরবর্তী সময়ে সরকার তাঁদের মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দেয়, যা তাঁদের সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি। এটি ছিল সেইসব নারীদের প্রতিসম্মান, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেও দেশের জন্যে অবদান রেখে গেছেন।
২.
প্রতিবছরের মতো এবারও বিজয়ের এই মাসে অবশ্যই আমরা দেশের সেই সূর্যসন্তানদের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করবো।যাঁরা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ,স্বর্ণ অক্ষরে লেখা রবে তাঁদের আত্মদান। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে,যাদের আত্মত্যাগে এই স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছিলাম কখনো ভুলবো না তাদের- বিজয় দিবসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। বিজয়ের হতে থাকবে। এঁদের কাহিনি হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। যে বিশজন নারী যোদ্ধা তাঁদের নিজেদের কথা বলেছেন তাঁরা সবাই এখন বৃদ্ধা, ইতিমধ্যে কয়েকজন মারা গেছেন, ৪/৫ জন মৃত্যুপথযাত্রী। এঁরা চলে যাবেন, এঁদের কাহিনিও হারিয়ে যাবে; সে-জন্য কাহিনি সংগ্রহ করাটা জরুরি ছিল। এই কাহিনিগুলো আরও অসংখ্য কাহিনির প্রতিচ্ছবি ও মুখপাত্র।
নির্যাতিত মেয়েরা সকলে এক রকম নন, তাঁরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, কিন্তু নির্যাতন তাঁদেরকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে, এবং তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি একটি মহাকাহিনির অংশ হয়ে গেছে। এই মেয়েদের সঙ্গে আমাদের কোনো দিন দেখা হবে না, কিন্তু এঁরা সবাই আমাদেরই আপনজন, এবং এঁদের সকলের মুখ মিলেমিশে যেন একটি মুখচ্ছবি, সেটি বাংলাদেশের। তাঁদের ওপর ওই যে নির্যাতন, বেনামে সেটা ছিল বাংলাদেশের সকল মানুষের ওপরই নির্যাতন। পরবর্তীতে তাঁদেরকে যে অবহেলা ও অপদস্থকরণ, সেটাও আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। ইতিহাসটি কিন্তু অখ-। সেটি প্রবলের অত্যাচারের, দুর্বলের ওপর। প্রবলের পক্ষে আছে রাষ্ট্র ও সমাজ; দুর্বলের পক্ষে কেউ নেই। দুর্বল একা। একাত্তরে দুর্বলেরা এক হয়েছিল, তারা হাঁকিয়ে দিয়েছিল হানাদারদের; কিন্তু ব্যবস্থাটা তো বদলালো না, এবং না-বদলানোর সুযোগ নিয়ে নতুন শাসকেরা কর্তা হয়ে বসলো। বঞ্চিতরা দেখলো তারা যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।
নির্যাতিত মেয়েরা দেখলেন সমাজের চোখে তাঁরা অপরাধী হয়ে গেছেন। তাঁদের জন্য লুকাবার কোনো জায়গা নেই। নির্যাতনের ছাপ তাঁদের দেহে পড়েছে, অনেক অধিক পরিমাণে পড়েছে গিয়ে মনে। সেটা দুর্মোচনীয়। লোকে চিনে ফেলে, চিনিয়ে দেয়। স্বামী ঘরে তোলে না, স্বামী যদি ক্ষমা করে দেয় তো শাশুড়ি অপমান করে, স্বামীও একসময়ে মত বদলে ফেলে। মেয়েটি যেন নিজেই দায়ী তাঁর নিজের দুর্দশার জন্য।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা অসম্ভব। আমরা বলি যে ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ এবং দুই লক্ষ নারীর ইজ্জতহানির বিনিময়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। ‘বিনিময়’ কথাটা অন্যায় ও অসঙ্গত। স্বাধীনতা ক্রয় করা হয়নি, এটি বিনিময়যোগ্য কোনো পণ্য নয়, স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। এবং আত্মত্যাগ যাঁরা করেছেন তাঁদের কয়েকজনের পরিচয় এখানে পাওয়া যাচ্ছে। বলাবাহুল্য এঁরা নাম-না-জানা লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিনিধি। এঁরা কেউই বিত্তবান ছিলেন না। অধিকাংশই দরিদ্র। বাইরে কী ঘটছে সেটা তাঁরা জানতেন না। শুনেছেন কে রাজা হবেন তা নিয়ে ঝগড়া চলছে। তাতে যে উলুখাগড়াদের প্রাণ যাবে সেটা টের পেয়েছেন তখন যখন যুদ্ধ এসে একেবারে ঘাড়ের ওপর হামলে পড়েছে। কেউ তাঁদের সতর্ক করে দেয়নি, বলেনি কী ঘটতে যাচ্ছে, জানায়নি কী করণীয়। জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের চরম ব্যর্থতা এখানে। তাঁরা পালিয়ে গেছেন, জনগণকে সারমেয়দের মুখে ফেলে রেখে। মেয়েরা কেউ লড়েছেন দা বঁটি নিয়ে। কামড়ে দিয়েছেন দাঁত দিয়ে। যুদ্ধ শেষে অধিকাংশই আগের মতোই বঞ্চিত রয়ে গেছেন। কারো কারো দুর্ভোগ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধপরবর্তী চুয়ান্ন বছরের ইতিহাস এঁদের দুর্ভোগ পোহানোর বিরামহীন ইতিহাস বৈকি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কখনোই পূর্ণাঙ্গ হবে না যদি নয় মাসের সঙ্গে পরবর্তী সময়ের দুর্ভোগের কাহিনিকেও যুক্ত না করা যায়। যাঁরা মুক্তযুদ্ধকে জানতে ও বুঝতে চাইবেন, যুদ্ধ নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সাহিত্য রচনা করতে উদ্যোগ নেবেন তাঁদেরকে অবশ্যই যেতে হবে এসব কাহিনির কাছে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেকেই লিখেছেন, আত্মকথনের অভাব নেই; ওই লোকেরা সবাই সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির মানুষ, তাঁদের কাহিনি আত্মগৌরবের, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ছবি পাওয়া যাবে, কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনে যুদ্ধ কি যন্ত্রণা নিয়ে এসেছিল, নয় মাসে তাদের জীবনের উপর দিয়ে কোন প্রলয় বয়ে গিয়েছিল তার খবর পাওয়া যাবে মেয়েদের আত্মকথনে।