image
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

একাত্তরের লাঞ্ছিত নিপীড়িত অপরাজিতাগণ

আনোয়ার মল্লিক

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বাঙালির অকুতোভয় সংগ্রাম, অগণিত শহিদের আত্মবিসর্জন,লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষের সীমাহীন ত্যাগে আমরা মুক্ত স্বাধীন স্বদেশ পেয়েছি। আমাদের এই মুক্তিরজন্য পুরুষের সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি নারীদের যে লাঞ্ছনা এবং অপমান সইতে হয়েছে, সেই বেদনার ভার ইতিহাস নীরবে বয়ে চলেছে। কিন্তুআমরা, মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকেরাকি তাদেরমনে রেখেছি?সত্যি বলতে রাখিনি।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনবাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। কিন্তু বিজয়ের গৌরব বিষাদে ছেয়েযায় যখন পাকিস্তানি পরিত্যক্ত সামরিক ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে উলঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ, নির্যাতিতা বাঙালি নারীর মিছিল। এই অভাবনীয় বেদনার ভার সইবার ক্ষমতা কারও ছিল না। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর সদ্য স্বাধীন দেশের সরকার মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হওয়া এইসব নারীদের আত্মত্যাগের সম্মানার্থে বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করে। তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বক্তৃতায় এইবীরাঙ্গনদের ব্যাপারে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কোনো অংশে কম নয়, বরং কয়েক ধাপ উপরে,যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেইসব স্বামী আর পিতাদের উদ্দেশ্যে আমি বলছি, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর, স্বামী বা পিতা হয়েছেন।”

১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্যাতিত নারীদের জন্য মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্রগঠন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে সারাদেশে কত নারী ধর্ষিত বা নির্যাতিত হয়েছিল তার কোনো নির্ভুলপরিসংখ্যান নেই। সরকারি এক হিসেবে এই সংখ্যা দুই লক্ষ। তবে সে সময়ের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ীএই সংখ্যা ১০ লাখের কাছাকাছি। ইতিহাসবিদ ড.মুনতাসীর মামুন তাঁর “বীরাঙ্গনা-১৯৭১” শীর্ষক গবেষণায় এই সংখ্যাকে ৬ লক্ষের কাছাকাছি বলে উল্লেখ করেছেন। অস্ট্রেলিয়ানডাক্তারজিওফ্রে ডেভিস, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের সেবাদানের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন, দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, “মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা চার লাখের কম নয়।অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই ২ লাখ। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের মধ্যে দেড় থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার মহিলার গর্ভপাত করানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি মিলিটারি তাদেরএদেশীয় দোসরদের সহায়তায় বাঙালি নারীদের পাশবিক ও অশ্লীল নির্যাতন করেছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। পাক মিলিটারি কোনো গ্রামে ঢুকলে গ্রামের যুবতী-কিশোরী সবাই লুকিয়ে পড়তো। মিলিটারির হাত থেকে বাঁচার জন্য বৃদ্ধ মহিলারা ঘরের দরজার সামনে পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করতে বসতেন। তবুও তাদের হাত থেকে কেউ নিস্তার পায় নাই।

১৩-১৪ বছরের এক কিশোরীর কথা জানা যায়। তাকে মিলিটারি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে আটকে রেখে তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। এবং নরপশু পাক মিলিটারি মেয়েটিকে শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার সারাশরীর কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। বেয়নেট দিয়ে তার শরীর খোঁচাতে খোঁচাতে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ জানতে চায়।পরিশেষে কোনো তথ্য না পেয়ে হাতপা বেঁধে পুকুরে ফেলে দেয় তাকে।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেয়েদের ধরে এনে সেনা ক্যাম্পেআটকে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা ছিলো নিত্য ঘটনা। এবং ধর্ষিতাযেন ফাঁসি নিয়েআত্মহত্যাকরতে না পারে সেজন্য দিন রাত তাদের উলঙ্গ করে রাখাহতো। উপর্যুপরি ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ফলে বহু নারী মৃত্যুবরণ করেছেন।এসব মেয়েদের লাশ অন্যদের সামনে ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভর্তি করে অন্যত্র ফেলে দেয়া হতো। স্বাধীনতার পরে সমাজ এবং লোকলজ্জার ভয়ে এসব মেয়েকেতাদের পরিবার এমনকি জন্মদাতা পিতাও গ্রহণ করতেরাজি হননি। মান সম্মান হারিয়ে বহু নারী আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। লজ্জা, ভয়ে, ঘৃণায়অনেককে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহত্যার পথ। অনেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে পাগলের বেশে। ১৬ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পূর্বে কিছু সংখ্যক মেয়েকে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা হয়।

১৯৭২ সালে অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক জিওফ্রে ডেভিস ধর্ষিতা নারীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্লিনিক স্থাপন করেন। এসব ক্লিনিকে ধর্ষণের ফলেগর্ভবতীবীরাঙ্গনাদের চিকিৎসা করা হয়। এবং অনেক নারীর সন্তান প্রসবও করানো হয়েছিলো। কিন্তু এইসব যুদ্ধ-শিশুদের নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন বীরাঙ্গনানারীরা। কমসংখ্যক মা এসব সন্তান গ্রহণ করেছেন। অনেকে এসব শিশুকেবিদেশিদের কাছে দত্তক দিয়েছেন। যুদ্ধ শিশুদের প্রতিপালন ও পরিচর্যার জন্যমাদার তেরেসা ইসলামপুরের আম পট্টিতে বেবি হোম নামে কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। এছাড়া সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানডপ্যারেন্টহুড সংস্থা ঢাকায় একটি গর্ভপাত কেন্দ্র চালু করে। এই কেন্দ্রে জন্ম নেয়া শিশুদের পরিচর্যার জন্য মাদার তেরেসার বেবি হোমে তুলে দেয়া হতো। এভাবে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশুর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার।ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, তেজগাঁও চালু হওয়ার পরে ১৯ শে জুলাই ১৯৭২ কানাডায় নতুন আশ্রয়ের পথে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে চড়ে বাংলাদেশ ছেড়ে যায় ১৫টি যুদ্ধশিশু। মাদার তেরেসা হোমএবং সহযোগী আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগেযুদ্ধশিশুদের প্রথম দলটি কানাডিয়ান মানব হিতৈষী প্রতিষ্ঠান ফ্যামিলিস ফর চিলড্রেনের সৌজন্যে টরেন্টোও মন্ট্রিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সেখানে এই প্রতিষ্ঠান কর্তৃকপূর্ব নির্বাচিত ১৪টি পরিবারের কাছে দত্তক হিসেবে এসব শিশুকে হস্তান্তর করা হয়।

বীর প্রতীককাকন বিবি একজন ভাগ্য বিড়ম্বিত বীরাঙ্গনা।ভারতের মেঘালয় রাজ্যের নত্রাই খাসিয়া পল্লীতে জন্মগ্রহণ তিনিকরেন। পিতা-মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার মূল নাম কাঁতেক নিয়তা।ডাকনাম কাকন। তবে তিনি কাকন বিবি নামেই পরিচিত ছিলেন। তাদের পরিবার ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। শিশু বয়সেইতিনি পিতৃ-মাতৃ হারা হন।১৫ বছর বয়সে আব্দুল মজিদ খান নামে এক পাঞ্জাবি ইপিআর সৈনিকের সঙ্গে তারবিয়ে হয়। এক পর্যায়ে মজিদ খান কাকন বিবিকে ফেলে ইপিআই-এর অন্য ক্যাম্পে বদলি হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এরূপ অবস্থায় সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শহিদ আলী নামে এক কৃষকের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তখন থেকে তার নাম রাখা হয় নুরজাহান বেগম। কিন্তু তার এই বিয়েও বেশি দিন টেকেনি। এরপর কাকন পূর্বের স্বামীর খোঁজে পাকিস্তানি এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পেছুটেযান। জুন মাসে স্বামীর খোঁজে সিলেটের দোয়ার বাজার সীমান্ত এলাকায় এলে তিনি পাক হানাদারবাহিনীর নজরে পড়েন। নরপিচাশরা তাকে আটক করেবাঙ্কারে রেখে তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। কয়েকদিন পর তাকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনায় বদলে যায় কাকন বিবির জীবন। প্রতিশোধের আগুন তার অন্তরের দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। এরপর ৫ নং সেক্টরের কমান্ডার মীর শওকত আলী তাকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে শত্রু শিবিরের খবর সংগ্রহের জন্য গুপ্তচরবৃত্তিরদায়িত্ব দেন। কাকন বিবি অত্যন্তসাহসিকতা এবং বিশ্বস্ততার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। সে ক্ষেত্রে কখনো তিনি ভিক্ষুকের বেশ ধারণ করতেন। পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে খবর নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার তথ্য মতো বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করত। এবং বহু ক্ষেত্রে সফল হতো।এরূপ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি দোয়ারবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাক বাহিনীর হাতে পুনরায় ধরা পড়েন। এবার তাঁর ওপর একনাগাড়ে সাত দিন চরম শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে গরম ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লে মৃত ভেবে হানাদার মিলিটারিতাদের ক্যাম্প থেকে কিছু দূরে তাকে ফেলে রেখে আসে। মুমূর্ষ অবস্থায় গ্রামেরকিছু লোকতাঁকে উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্তবর্তী বালাট ক্যাম্পে পৌঁছে দেন। সেখানে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিছুদিন পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। এবার তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এর পূর্বে তিনি অস্ত্রপরিচালনার প্রশিক্ষণ নেন। পাঁচনং সেক্টরের বিভিন্ন রণাঙ্গনে একাধিক সম্মুখযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। অক্টোবর মাসে আমবাড়িযুদ্ধে ছোড়া গুলি তার পায়ে বিদ্ধ হলে তিনি আহত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাকন বিবি সুনামগঞ্জের দোয়াবাজার উপজেলার লক্ষ¥ীপুর ইউনিয়নেরঝিরাগাঁও গ্রামে শহিদ আলীর বাড়িতে এক কুঁড়েঘরে মেয়ে ছকিনাসহ আশ্রয় নেন।এ বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন লোকচক্ষুরঅন্তরালে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে এক সাংবাদিকের মাধ্যমে তার সন্ধান মিলে।সারাদেশে হৈচৈ পড়ে যায় এবং সরকার তাকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে।তৎকালীনপ্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত জমির ওপর নির্মিত একটি কুঁড়েঘরে তিনিবসবাস করে আসছিলেন। দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় ভুগে অবশেষে ২০১৮ সালের একুশে মার্চ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বীরাঙ্গনা চেন্দাউ মারমা একজননির্যাতিতা আদিবাসী নারী। বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলায়। যুদ্ধের প্রথম দিকেই পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতেতিনি ধরা পড়েন।প্রথমে তাকে একটি নির্জন স্থানে রাখা হয়। সেখানে তিনি বহুদিন গণধর্ষণেরশিকার হন। অনেকদিন তিনি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। এরপর তিনি এক পাক মেজরের নজরে পড়েন। ওই মেজর তাকে তার কাছে নিয়ে যায়। এভাবেপুরো যুদ্ধকালীন সময় তিনি আটক থাকেন।দেশ স্বাধীন হলে তিনি ছাড়া পান। ছাড়া পাওয়ার পর পিতার বাড়ি বাস্বামীর বাড়ি কোথাও আশ্রয় মেলেনি তাঁর। তখন তিনি চলে যান নির্জন এক পাহাড়ে। সেখানে লতাপাতা দিয়ে তৈরি ডেরার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকেন। বাবা বা স্বামীর বাড়িতে তাঁর ঠাঁই হয়নি, শুধু এটাই নয়; এলাকার পরিচিতজনদের মাঝেও তাঁর স্থান হয়নি। ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমানে তিনি আশ্রয় নেন পাহাড়ে। বিভিন্ন কাজকর্ম করে দিন কাটাতেন। তারপরশেষ বয়সে কাজ করতে না পারলে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তাঁর। লোকালয় ছেড়েএমন নির্জন জায়গায় তিনি থাকতেন- যা কোনো মানুষের পক্ষে ভাবাও দুষ্কর।

বীরাঙ্গনা আফিয়া খাতুন খঞ্জনীরজীবনের করুণ ইতিহাস আমাদের অশ্রুসিক্ত করে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সোনাপুর গ্রামের মেয়ে তিনি। ’৭১ সালের জুন মাসে রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী জোরপূর্বক দুই সন্তানের মা আখিয়া খাতুন খঞ্জনীকে স্থানীয় জগন্নাথদীঘি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়।হানাদারক্যাম্পে বন্দী থেকেও বহু পরিবারকে গোপনে খবর পাঠাতেন খঞ্জনি। তার কারণেই রক্ষা পায় এলাকার অনেক নারী। জানা যায়, খঞ্জনীকেএক পাকিস্তানি হাবিলদার জোর করে বিয়ে করেছিল। জুলাই মাসে চিওড়া রাস্তার মাথায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি এমবুশে পড়ে খঞ্জনীর সেই কথিত স্বামী নিহত হন। তারপরও খঞ্জনী ওই ক্যাম্পে দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বন্দি অবস্থায় ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খঞ্জনীবাড়িতে ফিরে আসেন। কিন্তু খঞ্জনীরশাশুড়ি সন্তানদের নিজের কাছে রেখে তাঁকে তাড়িয়ে দেয়। খঞ্জনীরএকমাত্র পুত্র সন্তান ১৯৭২ সালে অর্ধাহারে-অনাহারে মারা যায়। হানাদারদের ক্যাম্পে থেকে তিনি যাদের জীবনরক্ষা করেছেন, সেসব মানুষের তাড়া খেয়ে খঞ্জনী নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ভিক্ষা আর মানুষেরবাসায় কাজ করে ফুটপাত ও বিভিন্ন রেলস্টেশনে ২৭ বছর কাটিয়ে পরবর্তীতে আশ্রয় পান ভাই আব্দুর রহমানের বাড়িতে। খঞ্জনী তাঁর ভাইয়ের বাড়িতেও সকলের ঘৃণার পাত্র হয়ে জীবন কাটাচ্ছিলেন।এক পর্যায়েসাংবাদিকরা তাঁর পরিচয় পাওয়ার পর বিভিন্ন দৈনিকে তাঁর সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ফলে খঞ্জনী সরকারের দৃষ্টিতে আসেন। এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়ে যান।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে বীরাঙ্গনা নারীদের যে ত্যাগ, দীর্ঘদিন আমরা তার মূল্যায়ন করি নাই। অবশেষে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো ৪৩জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশিত হয়। ২০২৪ সাল পর্যন্ত বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০৪ জন। কিন্তু এ সংখ্যাপর্যাপ্ত নয়। এদেশের অজস্রনারী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নির্যাতিত হয়ে তাদের সর্বস্ব হারিয়েছে। এবংবিভিন্নভাবে তারা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে। তাদের সকলের অবদান স্বীকৃতি পাওয়া উচিত।

সম্প্রতি