সাদ কামালী
বিকেলের ভূতুড়ে আলোয়
কবিকে মানুষ ভেবে কেউ কেউ ভুল করে খুব
রাখাল! এই পরিচয়টা কেন হারিয়ে গেল! শুধু ময়নার কাছে আমার নাম মন। রাখাল নামটি অন্য দুনিয়ার জন্য ছিল। অথবা রাখাল কোনো পরিচয় হয়তো নয়, যেভাবে কবি হতে পারে পরিচয়ের স্মারক। রাখালের পরিচয় এখন কবি বা খুনি। শুধু রাখাল হলেই ভালো লাগতো, বিকেলের ভূতুড়ে আলোয়/ কবিকে মানুষ ভেবে কেউ কেউ ভুল করে খুব। আমার প্রতি বাবা দু’টি সুবিচার করেছেন, তাঁর আর সব অপরাধ আর অকালমৃত্যুর দোষ আমি ক্ষমা করে দিই। এক, তিনি তাঁর নিজের রূপ সৌন্দর্য আমার কাঠামোয় দিতে পেরেছেন। জানি এ তাঁর কৃতি নয়, তবুও, দুই এই অসাধারণ নামটা। এই নামটাই আমাকে কবি করেছে। এই নামটাই বোধহয় আমাকে বিজ্ঞান পড়তে উৎসাহী করে না, যতটা করে সাহিত্য পড়তে। না হলে, কেন ভালো রেজাল্ট নিয়ে বাংলা বিভাগে পড়তে গিয়েছিলাম! এও আমার কৃতি বা ইচ্ছা নয়। যেমন আমি ইচ্ছা ক’রে স্বপ্ন দেখি না, কেউ দেখতে পারে না, হতে পারে ময়নার প্রভাব। ময়নার ছায়া আমার চোখে শরীরে পড়েছিল। তখন আমার চার দেয়ালের চুন সুরকি খসে গেল, কাঠামো কেমন হাওয়ায় দুলে উঠল। এখন সেই হাওয়া নেই, ক্ষারে আর নুনে আমার দেয়াল রঙহীন হয়ে উঠতে চায়। আবার স্বপ্নে স্বপ্নে ময়নার ছায়া মনের চল্টা-ওঠা রঙে তুলি বুলিয়ে দেয়, আঙুলের তুলিতে রঙ, কত রঙ! ক্ষারে নুনে জ্বলা আমার দেহ তখন রঙে ভাসে, হায়, গোবরও একদিন ঘুঁটে হয়ে জ্বলে বৈকি।
আমার বাবা গোবরে ফোটা গোলাপ হয়তো, কিন্তু ঘুঁটে হয়ে জ্বলতে পারেননি। বাবা শুনেছি রাজাকার ছিল, মুসলিম লীগ করতো। যুদ্ধের সময় কলকাতায় যেয়ে আমোদ করেছে। আর নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছে রাজাকার মন্নুকে; বাবা কোনো কাজেই লাগল না, না আমার না তাঁর নিজের জন্য। শুধু রতি বিলাসিতা ছাড়া তাঁর আর কিছু ছিল না। তবে একটা ব্যবসা ছিল, জমি বিক্রির ব্যবসা। একমাত্র ছেলে হিসেবে গ্রামের অনেক জমির সে একাই উত্তরাধিকারী। শহরের কিছু জমি ও স্থাপনারও। সব কিছুরই দিনে দিনে দাম বেড়ে যায়। আমার বাবা এই অনার্জিত সম্পত্তি বিক্রি ক’রে ক’রে নিজে শুধু দামহীন হয়ে ওঠেন। আমার মা বিবাহের নামে বাবার বাঁধা থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন মেয়েদের শরীর ছিল বাবার নিত্য গমনের জায়গা। মা তাঁর সঙ্গীত ক্ষুধা মেটাতেন, কামুক লোকটি নাকি সঙ্গীতের ভালো ভক্ত ছিলেন। রাগ টোড়ি তাঁর পছন্দ। মা সেই রাগ করবেন, আর তার আলাপ বিস্তার ঠাঁট বাবার শরীরে কামভাব জাগিয়ে তুলবে। গানের গহন থেকে উঠি আসে রমণীর মুখ।... ফর্সা গ্রীবা/ সুর আর রঙ ওঠানামা করে...। আমার জন্মের পর মা বেশিদিন বাঁচেননি। আত্মহত্যাই হয়তো, কিন্তু একটা অসুখের অজুহাত তিনি তৈরি করেছিলেন। বাবা মরলেন বেশ পরে, যখন মরতে না চাইলেও তার অন্য বিকল্প ছিল না। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। আমার তেমন কোনো কৈশোর ছিল না, বলতেও পারি না- পথের কাছে পাখিকে দেখে মনে পড়েছিল আমার হারানো কৈশোর!
লেক সার্কাসের বাড়িতে থাকি, যদিও এই বাড়ি বিশেষ শর্তে বাঁধা, টাকা পরিশোধ করতে না পারলে দলিল ক’রে দিতে হবে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে। সেই দিন শেষ হয়েছে, বাধ্য হয়ে দলিল করেও দিতে হলো, এখন কোথায় যাবেন ওই সুদর্শন কামার্ত শরীর নিয়ে! আমি কিছু না বলে বন্ধু সিজারের বাসায় গিয়ে উঠি। বাবা পাঁচতলা থেকে নামার সিঁড়ি খুঁজে পান না। ছাদ থেকে নামার সিঁড়ি পান না। কিন্তু তাঁকে তো নামতে হবে। সিঁড়ি হারিয়ে যেভাবে নামা যায় নামলেন, আর কোনোদিন উঠতে হলো না এমনি করে নামালেন ভদ্রলোক। লোকে বলে জানালার কার্নিশে মাথা-বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়েন যতদূর তার থেকেও দূরে পাকা রাস্তায় মগজ ছিটকে পড়েছিল। ভোগে ভোগে জীবনটা তাঁর ভালোই কেটেছে। অসুখে ভুগতে হলো না। মা’র মতো অসুখের বাহানায় মরতে হয়নি। শুধুমাত্র সিঁড়ি ভুলে যাওয়া। মন্দ কী!
আমিও কোনো সিঁড়ি দেখতে পাই না, না-ওঠার, না-নামার। আমি শুধু ভেসে চলি, স্বপ্নে স্বপ্নে ঘুরি। আমার নিজের জন্য মা-বাবার গল্প এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। বিস্তারিত ভাবা আমার জন্য সম্ভব নয়, মা আমার স্মৃতিতেও নেই, বাবাকে দেখেও কিছু দেখিনি। ওইটুকু না দেখলে হয়তো আরও দেখা যেতো, তখন বিস্তার করা যেতো। বাবা-মা’র প্রসঙ্গ আমার জন্য ও আমার মনে এইটুকুই। এর চেয়ে বেশি নয়। কোনো কোনো বৃক্ষের সহস্র পাতা থাকে, কোনো বৃক্ষশ্রেণির কয়েকটি পাতা। আমার বাবা-বৃক্ষের ছিল একটি পাতা, অন্তত আমার কাছে। ওই পাতাটি আমি স্বপ্নেও দেখি না। দেখলে আমার ঘুম ভেঙে যেত, আর ঘুমাতে পারতাম না। আমি এখন স্বপ্নে আমাকে দেখি। ময়নাকে দেখি। অনেককে দেখি, দেখে দেখে শান্ত মনে ঘুমাই। ঘুম থেকে উঠলে কিছু কিছু মনে থাকে, তা নিয়েই আমার দিনযাত্রা, বলা যায় স্বপ্নযাত্রাও।
অনেকদিন শিউলিকে স্বপ্নে দেখি না। স্বপ্নে না যাওয়া হলে আর যাওয়া হবে না। তবু ময়নার আঙুলগুলি কী ক’রে যেন ওর হাতে গজিয়ে উঠে আমাকে শুধু ডাকে। সে-রকম ডাকে আবার যাবো। যেয়ে মদ খাবো, চা খাবো, যা পাই, আমার লক্ষ্য ওর আঙুল। ওর বুকের নরম উষ্ণতায় মাথা রেখে আঙুল ধরে থাকবো। সেদিন অনেকটা মদ খেয়ে আসার পর অনেক দিন হলো যাওয়া হচ্ছে না। কেন যেন ওকে স্বপ্নেও দেখছি না। স্বপ্নে না দেখলে চোখে দেখব কী ক’রে! আমার চোখ তো স্বপ্ন-দুনিয়ায় গাঁথা।
ময়নার মৃত কলিজায় বিষ প্রয়োগের মোক্ষম প্রমাণ ফরেনসিক বিভাগ আবিষ্কার করেছিল। বিষ প্রয়োগের অভিযোগে আমি খুনি হলাম। খুনি হয়েও যেন খুনি হতে পারছি না। লোকে আমাকে আবার কবিও বলে। উল্লুকেরা জানে না রেজর কখনও সেফটি হয় না। কবিরা খুনী হয় শুধু নিজেকে খুন করে। ময়না খুন হওয়ার আগে আমি ছিলাম রাখাল। খুন হওয়ার পর হলাম খুনি ও কবি। খুনি হলেও ময়নার বাবা মলম চৌধুরী মা মরমী বেগমের কাছের একজন আমি, দূরের কেউ নই, শত্রু নই, একমাত্র সন্তানের হন্তারক হিসেবে ঘৃণিতও নই, বরং আরও কাছের হয়ে উঠি, নিকটজন হয়ে উঠি। এখন তো মরমী বেগমের বাড়িই আমার আবাস। ক্ষমতা আর টাকার পাবনে থানা থেকে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে আসে তাদের এই নিরালা ভিলায়। সহজ সরল এবং সুদর্শন আমাকে দেখে নাকি মরমী বেগমের মতো মলম চৌধুরীর কাছেও বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল। তারা আমাকে ভুল বুঝেছিল, আবার ঠিকও বুঝেছে। আমি কিছুই বুঝিনি। শেষ পর্যন্ত স্বপ্নের শিকার হয়ে গেলাম, এই ভালো, দায়হীন, দিকহীন ভেসে বেড়ানো।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা কেবল শেষ করেছি। তখনো সহপাঠি সিজারের বাড়িতে থাকি। এর মধ্যে তাদের ড্রাইভার আমাকে নিয়ে আসে নিরালা ভিলায়। মরমী বেগমের মেয়ে ময়নাকে পড়াতে হবে। আমার সহপাঠি সিজারের বাবা মোসলেম শিকদার বড় ব্যবসা সূত্রে মলম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ। আমার খোঁজ এভাবেই মিলল। আমি নাকি খুবই ভালো ছেলে, ভালো ছাত্র, সিজার আমার সঙ্গে থেকে সবসময় ভালো রেজাল্ট করছে। একই ক্লাসের ছাত্র হলেও আমাকে পড়াতে হতো। আমি সিজারের বন্ধু ও গৃহশিক্ষক। সিজারের সঙ্গে এখন আমার যোগাযোগ নেই। শুধু মনে পড়ে ওর রুগ্ণ হাতের জেগে ওঠা নীল শিরা, কান চিবুকের পাশ থেকে জেগে থাকা শিরা আর ওর দু’টি সাদা চোখ। কী অসুখ ছিল জানি না, তবে খুব দুর্বল, আমার থেকে বয়সে কয়েক মাস বড় হলেও ভারে ধারে সে আমার অর্ধেকও নয়। ফর্সা সরু সিজারকে আমার ছোটভাইয়ের মতো লাগে। আমি তাকে অনুজের মতো ¯েœহ করেছি। সিজারের শরীরে কিছু ছিল না, কিন্তু তার বিশাল হৃদয়ের খবর কারো অজানা নয়। বাসার ড্রাইভার, কাজের লোক সবাই সিজার ভাইয়ার জন্য পাগল। কারণ তার বাবার কাছে শুধু একটাই আব্দার ছিল, সবাইকে যেন সুখে রাখা হয়। সবার জন্য ভালো বেতন, ভালো পোশাক, ভালো খাবারের নিশ্চয়তা সিজার বাবার কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল। হয়তো একই কারণে আমার প্রতিও কোনো অবহেলা ছিল না। বাবা-মা মরা এতিম ছেলেটির প্রতি তাঁদের দায়িত্ব পালনকে কখনো করুণা বলে মনে হয়নি। আসলে তো করুণাই। করুণা ছাড়া কী!
সিজার আর আমি একই ঘরে থাকতাম। গোসল শেষ করে একদিন পোশাক বদল করছি, নিজের বিছানা থেকে সিজার আমাকে দেখছিল। আমরা তখন কলেজে ২য় বর্ষের ছাত্র। সিজার হঠাৎ স্বগোতক্তির মতো বলে, আমি কখনো বিয়ে করতে পারব না।
আমি ঘুরে দেখি- ওর দৃষ্টি কোথাও হারানো। বলি, বিয়ের কথা ভাবছ নাকি?
সিজার কিছু বলে না, লম্বা শ্বাস ফেলে। আমি বলি, যাও তৈরি হও, সময় বেশি নেই।
জানো আমার পিনাস এখনো ছোটবেলার মতো, কখনো ইরেকশন হয় না। শরীরে কোনো যৌবন অনুভূতিও তৈরি হয় না।
তৈরি হবে, শরীর ভালো হলেই সব তৈরি হয়ে যাবে।
প্রায় তিন মাসের ইমম্যাচিউর বর্ন, বাঁচার কথা ছিল না, ইন্কুইবেটারে বেড়ে উঠি। আমি তো তোমাদের মতো নর্মাল চাইল্ড ছিলাম না। অবশ্য ডাক্তারদের মতে সবই হবে, অন্যদের মতো করে নয়, সময় লাগবে। যেহেতু ব্রেনের ডেভেলপমেন্ট নর্মাল, তাই তারা মনে করে খাওয়া ভালো ক’রে করতে পারলে গ্রোথ হবেই।
সিজার আমার খুব প্রিয় বন্ধু শুরু থেকেই। কিন্তু এতদিনেও জানি না ওর এই প্রিম্যাচিউর জন্মের কথা। কখনো কৌতূহলও হয়নি ওর শরীর বিষয়ে। এবার আমার লম্বা শ্বাস পড়ে। কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরি। বলি, যাও ভাই, তৈরি হয়ে আসো, ক্লাসে লেট করতে চাই না। ঘরের ছায়া ছায়া আলোয় শান্ত পায়ে ও বাথরুমে ঢোকে। দরজা না লাগিয়েই পায়জামা ছেড়ে পায়ের কাছে রাখে। এই প্রথম ও মুহূর্তের জন্য ওর শরীর চোখে পড়ল অন্যরকমভাবে, বুকের ভিতর কেমন ক’রে ওঠে। সত্যিই কষ্ট হলো। আঠারো বছরের সিজার যেন আট-নয় বছরের বালক। দুনিয়ায় সময়ের আগে এসেও পিছনে পড়ে রইলো। বয়স কোনো বিষয় নয়, ফর্সা জ্যোৎ¯œা যেমন দিন নয়। এমন জ্যোৎ¯œায় লীলাপ্রিয় গিরিবাজ আকাশে ওড়ে না। জ্যোৎ¯œা রাতেরই এক রূপ, দিনের নয়