মহিবুল আলম
আবেদুর রহমানের দড়িকান্দি গ্রামে আসার কোনো কারণেই ছিল না। এক পড়ন্ত বিকেলে তিনি প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে মুখ করা তাঁদের গোল্ড কোস্ট শহরের হোপ আইল্যান্ডের বাসার দোতলার ব্যালকনিতে বসে ‘দি অস্ট্রেলিয়ান’ সংবাদপত্র পড়ছিলেন, আর থেমে থেমে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। মাঝেমধ্যে তিনি চোখ তুলে দূরে নিঃসীম সমুদ্রের জলে সূর্যের ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতিটা দেখছিলেন। ঠিক তখনই তাঁর মেয়ে এলেক্সিয়া বাসার ভেতর থেকে ব্যালকনিতে এসে বলে, ‘বাবা, তুমি তো একবার বাংলাদেশ ঘুরে আসতে পারো’।
আবেদুর রহমান মেয়ের দিকে সরাসরি দৃষ্টিতে তাকান। জিজ্ঞেস করেন, ‘হঠাৎ এ কথা?’
এলেক্সিয়া বলে, ‘না মানে, তুমি বেশ কিছুদিন ধরে বলছিলে যে, তাই বললাম’।
আবেদুর রহমান মাথা ঝাঁকান। বলেন, ‘হুম, আসলেই তুমি আমার মনের কথাটি বলেছো, এলেক্সিয়া। শরীরের যে অবস্থা। আর কতদিন সচল থাকতে পারি, জানি না। একবার পড়ে গেলে তো আর কোনোদিন দেশে যেতে পারব না। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’
এলেক্সিয়া হেসে বলে, ‘বাবা, তোমার দেশ তুমি যাবে। আমি কী করতে যাব?
আবেদুর রহমান জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার বাবার দেশ কি তোমার দেশ না?’
এলেক্সিয়া বলে, ‘তা জানি। কিন্তু কোনোদিন বলোনি তো। মাকেও কোনোদিন নিয়ে যাওনি’।
আবেদুর রহমান বলেন, ‘সেটা ঠিক। তোমার মাকে আর কোনোদিন নেওয়া হয়নি। অবশ্য তোমার মা-ও কখনও বাংলাদেশ যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেনি।
‘তা জানি। কিন্তু বাবা, আমার তো এ মুহূর্তে যাওয়া সম্ভব নয়। নতুন ক্লিনিক সেটআপ করছি। তুমিই বরং এক সপ্তাহের জন্য ঘুরে আস’।
‘আমি একা যেতে পারব?’
‘তুমি পারবে, বাবা। আমি নিজে একজন ডাক্তার। তোমার রেগুলার চেকআপ রিপোর্ট সব আমার কাছে আছে। তুমি যথেষ্ট সুস্থ আছ। আমি টিকেট, ট্র্যাভেল ইনস্যুরেন্স, ঢাকায় হোটেল বুকিং, অলটাইম একটা গাড়ি ও ড্রাইভার রাখার সব ব্যবস্থা করে দিবো’।
আবেদুর রহমান সায় বলেন, ‘ঠিক আছে, তুমি সব ব্যবস্থা করো’।
এলেক্সিয়া পরে এক মাসের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে দেয়। ক্লিনিকের ব্যস্ততার মধ্যেও সে নিজে এসে তার বাবাকে ব্রিসবেন এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে যায়।
অবশ্য আবেদুর রহমানের দড়িকান্দি আসার কোনো কারণ না থাকলেও ভেতরে ভেতরে তিনি অনেক কারণই অনুভব করতেন। চোখ বুজলেই তিনি গ্রাম, গ্রামের মেঠোপথ ও গাছের নিস্তব্ধ ছায়া দেখতেন। মা-বাবার কবরটা সেই গ্রামে। দীর্ঘ জীবনটায় স্ত্রী-সন্তান ও ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকলেও জীবনের সায়াহ্নে এসে আজকাল অপর্ণা দি’কে তাঁর খুব মনে পড়তে শুরু করে। এখন তিনি একা। স্ত্রী সিনথিয়া হঠাৎ করেই এক বছর আগে মারা গেছে। ম্যাসিভ হার্টএটার্ক হয়েছিল। হাসপাতালে নিতে নিতেই শেষ।
দীর্ঘ আটত্রিশ বছর পর গ্রামে আসছেন তিনি। আবেদুর রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ভাবলেন, আটত্রিশটি বছর! উনিশো সাতাশি সাল থেকে দুই হাজার পঁচিশ সাল। অবশ্য সেবার তিনি তাঁর দড়িকান্দি গ্রামে এসে গ্রাম থেকে খুব সুখকর অভিজ্ঞতা নিয়ে যাননি। পাঁচ শতাংশ জায়গার ওপর তাঁর একটি ভিটে ছিল। একটি চৌচালা টিনের ঘরও ছিল। পেছনে মরডাঙ্গি খাল ঘেঁষা গোপাট। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে এই ভিটেটুকুই তাঁর ছিল। আর বাকি যা ফসলি জমি ছিল, তা তিনি বিক্রি করে ও কিছু জমানো টাকা দিয়ে উনিশো সাতাত্তর সালে পশ্চিম জার্মানি পাড়ি জমিয়েছিলেন।
কিন্তু সাতাশি সালে আবেদুর রহমান পশ্চিম জার্মানি থেকে গ্রামে ফিরে দেখেন, সেই ভিটেটুকু তাঁর এক চাচা শুধু দখলই করেননি, জোতদার বাড়ির মুস্তাক মল্লিকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। তখন তিনি ভেবেছিলেন, আদালতের দ্বারস্থ হবেন। দেওয়ানি মামলা করবেন। কিন্তু তাঁর বাল্যবন্ধু নিজু মাস্টার বারণ করে বলেন, ‘আবেদ, কোর্টকাচারি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সেটা তুমি সামাল দিতে পারবে না’।
আবেদুর রহমান জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন পারব না?’
নিজু মাস্টার বলেন, ‘তুমি তো এখানে থাকবে না। আবার জার্মানি চলে যাবে। ওখান থেকে কোর্টকাচারি চালানো কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। মাঝখান থেকে তুমি মানসিক চাপে থাকবে। তুমি বুঝতেই পারছ, তোমার ভিটেটা কিনেছে মুস্তাক মল্লিক। মল্লিক বাড়ি এখন শুধু দড়িকান্দি গ্রামটা নয়, পুরো ইউনিয়নটা চালায়’।
আবেদুর রহমান শেষপর্যন্ত সেই অন্যায়টা মেনে নেন। তিনি এটাও ভাবেন, তাঁর স্ত্রী সিনথিয়া জার্মানির। তিনি নিজেও ততদিনে জার্মানির নাগরিক হয়েছেন। ওখান থেকে কে দেশে আসবে এতটুকু সম্পত্তির জন্য?
তারপর আর তাঁর দেশে ফেরা হয়নি।
পশ্চিম জার্মানি ফিরে যাওয়ার বছর তিনেক পর উনিশশো নব্বই সালে হঠাৎ সিদ্ধান্তে আবেদুর রহমান স্ত্রী সিনথিয়াকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে অভিবাসী হন। ততদিনে দুই জার্মানি অবশ্য এক হয়ে গিয়েছিল। তিনি অস্ট্রেলিয়া এসে প্রথমে সিডনী শহরে বসবাস শুরু করেন। পরে গোল্ড কোস্টে চলে আসেন। গোল্ড কোস্টে কিচেন-জয়েনারির ব্যবসা পেতে পুরোপুরি স্থিত হন।
দুই
আবেদুর রহমান শব্দ দুটো আবার নিজে নিজে উচ্চারণ করলেন। জীবন সায়াহ্ন। শব্দ দুটো তাঁর ভালো লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভেতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। খুব ভারি দীর্ঘশ্বাস। তাঁর দৃষ্টিটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করল। ভাবলেন, সত্যি তো জীবনের সায়াহ্নে এখন তিনি।
আবেদুর রহমান একটা সময় কবিতা লিখতেন। সেই সাতষট্টি-আটষট্টি সালের দিকে। অপর্ণা দি’কে মুগ্ধ করার জন্য কবিতা লিখতে লিখতে আস্ত একটা বাঁধাই করা খাতা ভরে ফেলেছিলেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে তিনি ঢাকাতে। সত্তরের তুমুল আন্দোলন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ। সেই আটষট্টি সালের পরে তাঁর আর কবিতা লেখা হয়নি। সেই কবিতার খাতাটিই তাঁর শেষ কবিতার খাতা।
আটষট্টি সালেই অপর্ণা দি’র বিয়ে হয়ে যায়। সেই অপর্ণা দি, যিনি বিয়ের আগের দিন উঠতি রাতে ঘরে এসে বলেছিলেন, ‘আবেদ, আমার যে বিয়ে হচ্ছে, এ নিয়ে তুমি কষ্ট পেয়ো না। এ তো হবার নয় যে!’
আবেদুর রহমান মূক হয়ে বসেছিলেন।
অপর্ণা দি যেতে যেতে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার বিয়েতে এসো। নাহলে আমি কষ্ট পাবো। আমি মনে মনে তোমাকে খুঁজবো!’
অপর্ণা দি’র সেই বলাটা স্বাভাবিক ছিল না। আবেদুর রহমান সেরাতে খুব কেঁদেছিলেন।
দড়িকান্দি গ্রামে যাওয়ার রাস্তাটা বেশ দিঘালো। পিচডালা পাকা রাস্তা। দিঘল তাকালে ডোবা বিলের বুকচেরা পথটা অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। রাস্তাটা খুব বেশিদিন আগে হয়নি তা বোঝা যায় পথের দুপাশের ছোটছোট গাছগুলো দেখে। বেশ দূরে দূরে দু-একটা ছনের ঘর বাদে পথের দুধারে তেমন বসতবাটি গড়ে ওঠেনি। এখনও পাড়াগুলো বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এই আটত্রিশ বছর পর পার্থক্য একটাই, আগে দড়িকান্দি গ্রামে বুকচেরা কোনো পথ ছিল না। নৌকাই একমাত্র বাহন ছিল। নৌকা যখন জলের সিঁথি কেটে কলকল শব্দ তুলে প্রতিটি পাড়ার ঘাটে গিয়ে ভিড়ত, তখন জলের দিকে ঝুঁকে থাকা চারিদিকের বড় বড় গাছের শীতল ছায়ায় মন এমনিতেই ভরে যেত। পাড়াগুলো ছিল বেশ ছোট ছোট। তিনটা-চারটা বাড়ি নিয়ে একেকটা পাড়া ছিল।
এখন দড়িকান্দি গ্রামে পাড়ার পরিধি বেড়েছে। বাড়িঘর বাড়তে বাড়তে একটা পাড়া আরেকটা পাড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এমন হয়েছে, যেন পাকা পথটার দু’ধারে দুটো সবুজ রেখা এগিয়ে গেছে সমান্তরাল করে। পাকা পথটা থেকে খানিকটা দূরে দূরে ডানে-বামে নেমে মেঠেপথ এগিয়ে গেছে প্রতিটা পাড়ার দিকে কেমন দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে। আটত্রিশ বছর আগে নৌকায় করে ডোবা বিলের বুক চিরে যেতে গিয়ে দূর থেকে মল্লিক বাড়ির দোতলা সাদা দালানটাই দেখা যেত। বাঞ্ছারামপুর থেকে দূরের দড়িকান্দি গ্রামটা চেনা যেত মল্লিক বাড়ির সেই দালানটা দিয়ে। কিন্তু এখন প্রতিটি পাড়া থেকেই একটা-দুইটা করে দোতলা-তিনতলা দালান উঁকি মেরে তাকিয়ে আছে।
আবেদুর রহমান ঢাকা এসেছেন গত পরশুদিন। একটা পাঁচতারা হোটেলে উঠেছেন। হোটেল বুকিং এলেক্সিয়াই করেছে। সঙ্গে হোটেল থেকে সর্বক্ষণের জন্য একটা গাড়ি। আবেদুর রহমানের অবশ্য এমন পাঁচতারা হোটেলে থাকার ইচ্ছে ছিল না। তাঁর মোটামুটি মানের হোটেল হলেই হতো। কিন্তু এলেক্সিয়া নাছোড়বান্দা। মেয়েটা তাঁর খুব দেখাশোনা করে। একটাই মাত্র মেয়ে। এখানে আসার পর অস্ট্রেলিয়া থেকে দিনে দুই-তিনবার ফোন দিয়ে তাঁর খবর নিচ্ছে।
আবেদুর রহমান বাংলাদেশে মাত্র সাতদিন থাকবেন। এরই মধ্যে দুইদিন চলে গেছে। গতকাল তিনি ঢাকা শহর দেখতে বের হয়েছিলেন। ঢাকা শহর এমন ব্যস্ততম শহর হয়ে উঠেছে, তিনি ভাবতে পারেননি। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। আর যানবাহনের তো কোনো লাগাম নেই। যানজটের কারণে মাঝেমধ্যে গাড়ি এক ইঞ্চিও এগোয় না। এই ঢাকা শহরকে তিনি একেবারেই চিনতে পারছিলেন না। অথচ তিনি ঢাকা শহরে সেই আটষট্টি সালে যখন প্রথম আসেন, তখন শহরটা কী নিরিবিলি ছিল! যদিও তখন জেনারেল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ঢাকা শহর মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু শহরটায় এত লোকজন ও যানজট ছিল না।
আবেদুর রহমানের আটষট্টি সালে ঢাকা আসার পেছনে একটাই কারণ ছিল অপর্ণা দি’র বিয়ে। তিনি যেন তখন দড়িকান্দি গ্রাম ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচেন। এরই মধ্যে তিনি আই.এ. পাস করেছিলেন। একদিন ভোরে কাউকে না বলে দূরসম্পর্কের এক মামার ঠিকানা হাতে নিয়ে বাঞ্চারামপুর থেকে লঞ্চ ধরেন। ঢাকা সদরঘাটে নেমে তাঁর মামার কায়েতটুলীর বাসায় এসে ওঠেন। মামার জুতার দোকান ছিল গুলিস্তানে। সেই দোকানে তিনি বিকেল থেকে রাত দশটা অব্ধি বসতেন, আর সকালবেলা জগন্নাথ কলেজে ডিগ্রি পড়তেন। জগন্নাথ কলেজে পড়তে পড়তেই তাঁর উনসত্তরের গণআন্দোলনের মিছিলে যাওয়া। নিজেকে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা। তারপর একাত্তর সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। উনিশশো সাতাশি সালে যখন তিনি পশ্চিম জার্মানি থেকে দেশে আসেন, তখনও ঢাকা শহরকে এতটা ব্যস্ত শহর মনে হয়নি।
আজ ভোরে উঠেই আবেদুর রহমান দড়িকান্দির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। গাড়ির ড্রাইভার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। বাঞ্চারামপুর ও এর আশেপাশের গ্রামগুলো ভালো করেই চেনে। হোটেল থেকেই তাঁর জন্য এমন একজন ড্রাইভার রাখা হয়েছে যাতে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এলেক্সিয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে হোটেলে ফোন করে সেই ব্যবস্থা করেছে।
এখন সবে দুপুর হয়ে এসেছে। মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় আবেদুর রহমান দড়িকান্দি গ্রামে চলে এসেছেন। ঢাকা শহর যানজটের শহর হলেও ঢাকার বাইরে অন্য শহরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। আগে তো দড়িকান্দি গ্রামে থেকে দেড়দিন লাগত ঢাকা শহরে যেতে। বাঞ্ছারামপুর থেকে লঞ্চে বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বাসে একই হাল ছিল।
বিকেল হওয়ার আগেই আবেদুর রহমান ঢাকার দিকে ফিরে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছেন। এখন আপাতত নিজু মাস্টারকে পেলেই হয়। যদিও তিনি জানেন না, নিজু মাস্টার বেঁচে আছেন কি নেই। সেই সাতাশি সালের পর তাঁর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। এতগুলো বছর! এই নিজু মাস্টার তাঁর বাল্যবন্ধু ও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সহযোদ্ধা ছিলেন।
অবশ্য নিজু মাস্টারকে মাথায় নিয়ে আবেদুর রহমান যে তাঁর দড়িকান্দি গ্রামে এসেছেন, তা নয়। তিনি গ্রামে এসেছেন বাবা-মা’র কবরটা একবার দেখে যেতে ও গ্রামের কিছু স্মৃতি রোমন্থন করতে। নিজু মাস্টারকে যদি পেয়ে যান, তাঁর এই আসাটা তখন আরও সার্থক হবে।
আবেদুর রহমান ভাবতে ভাবতে গাড়ির জানালা গলে এদিক-ওদিক তাকালেন। সকালের দিকে খানিকটা মেঘলা করে এলেও এখন রোদ যেন আকাশ থেকে গলে গলে পড়ছে। ইংরেজি মাসের পাশাপাশি বাংলা মাসটা তিনি জানেন। এখন চৈত্রমাস চলছে। শীতকালের শুরু থেকে চৈত্র-বৈশাখ মাস পর্যন্ত সময়টাকে এখানকার লোকজন সুদিন মাস বলে। এই সুদিন মাসে দড়িকান্দি, খাল্লা, ছয়ফুল্লাকান্দি ও বিশারার ডোবা বিল ও ডেপার বিলে একেবারে জল থাকে না। মরডাঙ্গি খালটাও শুকিয়ে যায়।
আবেদুর রহমান দূরে তাকিয়ে দেখলেন, ডোবা বিল ও ডেপার বিলে এখন সত্যি সত্যি জল নেই। বিলের ভেতর বিরানভূমি। তিনি চোখ বাড়িয়ে উত্তরে মরডাঙ্গি খালটা খুঁজতে শুরু করলেন। তিনি খালটার একটি সরু রেখা খুঁজে পেলেন। মরডাঙ্গি খাল ধরে উত্তরে গেলেই তাঁদের উত্তর পাড়া। উত্তর পাড়ার শেষ মাথার বাড়িটা তাঁদের ছিল।
উত্তর পাড়ার প্রথম বাড়িটা ছিল নিজু মাস্টারদের।
আবেদুর রহমান পাকা রাস্তার একপাশে গাড়িটা থামিয়ে সরু মেঠোপথটা ধরে হেঁটে আন্দাজে উত্তর পাড়া ঢুকতেই নিজু মাস্টারের বাড়িটা পেয়ে গেলেন। আগে নৌকা দিয়ে এলে খানিকটা দূর থেকেই নিজু মাস্টারদের চকচকে চৌচালা টিনের ঘরটা দেখা যেত। বেড়াগুলো টিনের ছিল। এখনও নিজু মাস্টারের সেই টিনের ঘরটাই আছে। তবে স্থানে স্থানে জং ধরা টিন। দু-একবার টিনের বেড়ায় যে সবুজ রং করা হয়েছিল তা বোঝা যায় জং ধরা টিনের স্থানে স্থানে ছোপ ছোপ সবুজ রং দেখে। ঘরের সামনের বরই গাছটা এখনও বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে।
বাড়িটা একেবারে নিরিবিলি। একটা কাকপক্ষীর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হচ্ছে না। দুপুরের নিঃসীমতা উঠোনের সবুজাভ শেওলায় যেন জমে আছে। তবে ঘরের কপাট খোলা।
আবেদুর রহমান সেই চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের পুরোনো অভ্যাসমতো হাঁক দিলেন, ‘নিজামুদ্দিন, ও নিজামুদ্দিন’।
নিজু মাস্টারের পুরো নাম নিজামুদ্দিন শেখ। দড়িকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন বলে গ্রামের সবাই তাঁকে নিজু মাস্টার ডাকলেও আবেদুর রহমান নিজামুদ্দিন বলেই ডাকতেন।
এক ডাকেই ঘরের ভেতর থেকে কেউ একজন সাড়া এল, ‘কেডা?’
আবেদুর রহমান আবেগের গলায় বললেন, ‘আমি আবেদ!’ (পরবর্তী সংবাদ সাময়িকীতে পড়–ন)