alt

স্বাধীনতা দিবস ২০২৫

আকাশের নীলিমায় সে এক রণক্ষেত্র

আতা সরকার

: বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

পাশ ফিরতে গিয়েই থমকে গেল ফরিদ-উজ্জামান। দৃষ্টি রানওয়ের দিকে। ভ্রু কুঁচকে গেল।

ঘটনাটা কী?

রানওয়েতে ট্যাক্সি ট্রাকের মাঝপথে বিমানটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে কেন? ক্যানোপি খুলে যাচ্ছে।

কোনো সমস্যা?

এয়ার ফোর্সের কন্ট্রোল টাওয়ারে ডিউটিতে তখন ফরিদ আর আছিম। ফরিদ বাঙালি পাইলট অফিসার। আছিম ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। অবাঙালি।

ফরিদ তাকাল আছিমের দিকে। তার চোখেমুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। বিস্ময় আছিমের চোখেও।

দিনটা জুম্মা বারের। শুক্রবার। ২০ আগস্ট ১৯৭১।

শিক্ষানবিশ পাইলট অফিসার মিনহাজ এই কিছুক্ষণ আগে সিডিউল মাফিক টি-৩৩ বিমান ওড়ানোর জন্য কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে স্ট্যান্ডার্ড ক্লিয়ারেন্স নিয়ে গিয়েছে। কন্ট্রোল টাওয়ারে এ বিমানের সাংকেতিক নাম: ব্লুবার্ড ১৬৬।

আর সেই বিমানটাকেই কিনা দেখা যাচ্ছে রানওয়েতে দাঁড়িয়ে ক্যানোপি খুলছে!

ফরিদ উদ্বিগ্ন হয়ে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল: কোনো সমস্যা? অসুবিধা হচ্ছে নাকি?

বার্ড থেকে কোনো সাড়া নেই।

হঠাৎ বিমানটি রানওয়ের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। কিছুক্ষণ আগেই একটা বিমান অবতরণ করেছিল। এখন রানওয়ে ফাঁকা।

ব্লুবার্ড আকাশে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু ওড়াটা কেন জানি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বেশ দুলছে। কাত হয়ে পড়ছে। পরপরই সোজা হচ্ছে। আবার অন্যদিকে কাত। একটু উপরে উঠছে তো আবার নিচে নেমে যাচ্ছে। দুলছে ডানে বাঁয়ে উপরে নিচে।

রানওয়ের মাত্র কয়েক ফুট উপর দিয়ে বিমানটি উড়ে গেল। খুবই ঝুঁকি নিয়ে। বিপজ্জনকভাবে।

এই মুহূর্তে উড্ডীন বিমান থেকে কন্ট্রোল টাওয়ারে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো: ব্লুবার্ড হাইজ্যাক হয়েছে।

চমকে উঠল কন্ট্রোল টাওয়ারের দুই বৈমানিকই। হতচকিত ফরিদ জানতে চাইল: হাইজ্যাক! মানে ছিনতাই! কনফার্ম করো। নিশ্চিত করে জানাও।

বিমানের বেতার তরঙ্গে ভেসে এলো দৃঢ় পরিষ্কার কণ্ঠস্বর: নিশ্চিত।

ফরিদ ও আছিম পরস্পরের দিকে সবিস্ময়ে তাকাল।

মতিউর। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের কণ্ঠস্বর চিনতে তাদের কোনোই সমস্যা হলো না।

ব্লুবার্ড অনেক নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। রাডারে যাতে বিমানের অবস্থান ধরা না পড়ে তারই চেষ্টা চলছে। বিমানের ডানাদুটোর কম্পন তখনো চোখে ধরা পড়ছে।

দেখতে না দেখতেই ব্লুবার্ড মিলিয়ে গেল দূর নীলিমায়।

কন্ট্রোলার টাওয়ারে এর মধ্যেই ধুন্ধুমার পড়ে গিয়েছে। ব্লুবার্ড ছিনতাই- আছিম দ্রুত এই খবরটা বেস কমান্ডারকে জানাল। বেস কমান্ডার তড়িঘড়ি ছুটে এলো কন্ট্রোল টাওয়ারে। দুইটি এফ-৮৬ বিমান মুহূর্তে ধাওয়া করল ব্লুবার্ডকে।

কিন্তু কোথায় ব্লুবার্ড?

বাম্বিন আর খাট্টার রাডার স্টেশনগুলো চারপাশে খবর লাগিয়ে রিপোর্ট করল: ব্লুবার্ডের গতিবিধি বোঝাও যাচ্ছে না, ধরাও যাচ্ছে না।

২.

শান্ত সমাহিত মতিউর। মিনহাজ তাঁরই প্রশিক্ষণার্থী। সে খুব উত্তেজিত। ক্রুদ্ধও। একনাগাড়ে গালিগালাজ করে যাচ্ছে তার নিজের প্রশিক্ষককে।

মতিউরব্লুবার্ডের নিয়ন্ত্রণ নিজের মুঠোয় রাখতে ব্যস্ত। মাথাটাকে ঠা-া রাখার চেষ্টা করছেন।

বিমান ছিনতাই আপাততঃ সফল। পাকিস্তানের সব রাডারকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয়েছে-ব্লুবার্ডের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কেউ ধারণা করতে পারছে না। এখন বিমানটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে সীমান্ত পেরিয়ে। এই বিমান আর কখনোই ফিরে যাবে না করাচির মাসরুর বিমান ঘাঁটিতে। ব্লুবার্ড আর মিনহাজকে নিয়েই ঢুকে যেতে হবে ভারতের আকাশে। কাছাকাছিই গুজরাটের জামনগর। আশা করা যায়, সেখানে বিমান অবতরণ করানোর কাজ তেমন কঠিন হবে না।

মনে পড়ছে স্ত্রী মিলির মুখ। মিলিকে আজ কোনো কিছু বলে আসা হয় নাই। রাতটা কেটেছে ছটফটের মধ্য দিয়ে। ঘুম প্রায় হয়নি। সারাটা রাত পরিকল্পনাটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা মুক্তির জন্য লড়াই করছে। বাঙালি হয়ে মতিউরও নিশ্চুপ বসে থাকতে পারেন না। এই অস্থির ভাবনাই তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। একটা বিমান যদি ঐ দামাল যোদ্ধাদের হাতে তুলে দেয়া যায়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের পথে অনেকখানি এগিয়ে নেয়া যাবে। বিমানটা চাই। এই ব্লুবার্ডই।

সকালে তিনি তাঁর গাড়ি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। মিলিকে কোনো কথাই বলা হয় নাই। তাঁর কাছ থেকে বিদায়ও নেওয়া হয় নাই। এমনকি নিত্য দিনকার মতো সালাম বিনিময় হয় নাই। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তিনি মিলির দিকে তাকাতে সাহস সঞ্চয়ও করতে পারছিলেন না। প্রতিদিন বেরুনোর সময় খোদা হাফেজ বলেন। আজ তাড়াহুড়ায় তাও বলা হয় নাই। মিলি, একটি চুমুও তো তোমার পাওনা রয়ে গেল!

এখন পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ মতিউরের পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছে। কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে এসেছেন বিমান ঘাঁটিতে। অপেক্ষা করছিলেন ব্লুবার্ডের জন্য। রাশেদ মিনহাজকে তিনি জেট বিমান ওড়ানোর তালিম দেন। আজ সকালে সে বিমান নিয়ে বেরুবে। হাইজ্যাক করতে হবে বিমান আর শিক্ষার্থীকে।

মিনহাজ ব্লুবার্ড নিয়ে রানওয়েতে ঢোকার জন্য চার নাম্বার ট্যাক্সি ট্রাকের দিকে এগিয়ে আসছিল। টিলার আড়ালে পৌঁছতেই একটা গান তীব্র গতিতে ছুটে এসে ব্রেক কষলো। গাড়িটা ব্লুবার্ডের পিছনে এমনভাবে রাখা হলো যাত অন্য কোনো বিমান ব্লুবার্ডকে তাৎক্ষণিক ধাওয়া না করতে পারে।

গাড়ি থেকে নেমে এলেন মতিউর। মিনহাজকে ইশারা করলেন বিমান থামানোর জন্য।

বিস্মিত মিনহাজ। এখন এই সময়টাতে তো তার ট্রেইনার আসার কথা নয়! কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে সে তো বিমান ওড়ানোর জন্য ক্লিয়ারেন্স নিয়েই এসেছে।

অবশ্য এরপরও ফ্লাইট সেফটি অফিসার বিশেষ কারণে বৈমানিককে চলমান বিমানকে থামানোর অর্ডার করতে কিংবা সংকেত দিতে পারেন। অর্ডারই হোক বা সংকেতই হোক, তা মান্য করতেই হবে।

বিমানের ক্যানোপি খুলল মিনহাজ। মতিউর চট করে বিমানে উঠে বসলেন। বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিজের মুঠোয় নেয়ার জন্য হাত বাড়ালেন।

মিনহাজ বিস্মিত হয়ে বলে উঠল: এটা কী হচ্ছে?

তার দিকে হিম শীতল দৃষ্টিতে তাকালেন মতিউর। এমন চোখের ভাষা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল: ব্লুবার্ড এখন আর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান নয়। এই বিমানে এখন উড়বে স্বাধীন বাংলার পতাকা।

বাধা দিতে গেল মিনহাজ। সে প্রচ- ঝাপটা খেল। মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল: ব্লুবার্ড হাইজ্যাক হয়েছে।

অপর প্রান্ত থেকে কাঁপা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো: নিশ্চিত করে বলো তোমার বিমান হাইজ্যাক হয়েছে কিনা।

সারা পাকিস্তান কাঁপিয়ে গম্ভীর দৃঢ় কণ্ঠস্বর সুস্পষ্ট ভাষায় জানান দিল: নিশ্চিত।

৩.

এই দফায় ঘরে আর ফেরা হবে না মিলি!বারবার মিলির কথাই মনে পড়ছে মতিউরের। ভাবছেন, মিলি তাঁর শেষ চিঠিটা পাবেন কিনা যেটায় লিখে এসেছেন: এ মুহূর্তে মিলিকে আর কিছুই দেয়ার নেই স্বাধীন দেশ ছাড়া।

মিলি কি মতিউরের অভাবপ্রবল ভাবে অনুভব করবেন? তিনি তো তাঁর ঘ্রাণ রেখে এসেছেন মিলির কাছে। তাঁদের দুই মেয়ে- মাহিন ও তুহিন। মিলি, তুমি কি কখনো খেয়াল করেছ: আমাদের কন্যাদের শরীরে আমার শরীরের সূক্ষ্ম এক ধরনের ঘ্রাণ পাওয়া যায়?

মতিউর উপরে খোলা নীল আকাশের দিকে তাকালেন।

স্যালুট করলেন দূরে তাঁর ভালোবাসার দেশকে।আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ়তা ফুটে উঠল তাঁর চোখেমুখে।

আত্মগতভাবে বললেন: আমি আবার ফিরব। আমাদের স্বাধীন দেশের পতাকা বুকপকেটে নিয়ে ফিরব।

মিনহাজ আবার তার থাবা উঁচিয়ে ধরল। কেঁপে উঠল উড়ন্ত বিমান।

৪.

বিকালে খবর এলো: সিন্ধুর খাট্টার কাছে বিধ্বস্তহয়েছে একটি বিমান। আরোহী দুই বৈমানিক ঘটনাস্থলেই নিহত।

tab

স্বাধীনতা দিবস ২০২৫

আকাশের নীলিমায় সে এক রণক্ষেত্র

আতা সরকার

বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

পাশ ফিরতে গিয়েই থমকে গেল ফরিদ-উজ্জামান। দৃষ্টি রানওয়ের দিকে। ভ্রু কুঁচকে গেল।

ঘটনাটা কী?

রানওয়েতে ট্যাক্সি ট্রাকের মাঝপথে বিমানটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে কেন? ক্যানোপি খুলে যাচ্ছে।

কোনো সমস্যা?

এয়ার ফোর্সের কন্ট্রোল টাওয়ারে ডিউটিতে তখন ফরিদ আর আছিম। ফরিদ বাঙালি পাইলট অফিসার। আছিম ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। অবাঙালি।

ফরিদ তাকাল আছিমের দিকে। তার চোখেমুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। বিস্ময় আছিমের চোখেও।

দিনটা জুম্মা বারের। শুক্রবার। ২০ আগস্ট ১৯৭১।

শিক্ষানবিশ পাইলট অফিসার মিনহাজ এই কিছুক্ষণ আগে সিডিউল মাফিক টি-৩৩ বিমান ওড়ানোর জন্য কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে স্ট্যান্ডার্ড ক্লিয়ারেন্স নিয়ে গিয়েছে। কন্ট্রোল টাওয়ারে এ বিমানের সাংকেতিক নাম: ব্লুবার্ড ১৬৬।

আর সেই বিমানটাকেই কিনা দেখা যাচ্ছে রানওয়েতে দাঁড়িয়ে ক্যানোপি খুলছে!

ফরিদ উদ্বিগ্ন হয়ে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল: কোনো সমস্যা? অসুবিধা হচ্ছে নাকি?

বার্ড থেকে কোনো সাড়া নেই।

হঠাৎ বিমানটি রানওয়ের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। কিছুক্ষণ আগেই একটা বিমান অবতরণ করেছিল। এখন রানওয়ে ফাঁকা।

ব্লুবার্ড আকাশে উঠে যাচ্ছে। কিন্তু ওড়াটা কেন জানি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বেশ দুলছে। কাত হয়ে পড়ছে। পরপরই সোজা হচ্ছে। আবার অন্যদিকে কাত। একটু উপরে উঠছে তো আবার নিচে নেমে যাচ্ছে। দুলছে ডানে বাঁয়ে উপরে নিচে।

রানওয়ের মাত্র কয়েক ফুট উপর দিয়ে বিমানটি উড়ে গেল। খুবই ঝুঁকি নিয়ে। বিপজ্জনকভাবে।

এই মুহূর্তে উড্ডীন বিমান থেকে কন্ট্রোল টাওয়ারে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো: ব্লুবার্ড হাইজ্যাক হয়েছে।

চমকে উঠল কন্ট্রোল টাওয়ারের দুই বৈমানিকই। হতচকিত ফরিদ জানতে চাইল: হাইজ্যাক! মানে ছিনতাই! কনফার্ম করো। নিশ্চিত করে জানাও।

বিমানের বেতার তরঙ্গে ভেসে এলো দৃঢ় পরিষ্কার কণ্ঠস্বর: নিশ্চিত।

ফরিদ ও আছিম পরস্পরের দিকে সবিস্ময়ে তাকাল।

মতিউর। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের কণ্ঠস্বর চিনতে তাদের কোনোই সমস্যা হলো না।

ব্লুবার্ড অনেক নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। রাডারে যাতে বিমানের অবস্থান ধরা না পড়ে তারই চেষ্টা চলছে। বিমানের ডানাদুটোর কম্পন তখনো চোখে ধরা পড়ছে।

দেখতে না দেখতেই ব্লুবার্ড মিলিয়ে গেল দূর নীলিমায়।

কন্ট্রোলার টাওয়ারে এর মধ্যেই ধুন্ধুমার পড়ে গিয়েছে। ব্লুবার্ড ছিনতাই- আছিম দ্রুত এই খবরটা বেস কমান্ডারকে জানাল। বেস কমান্ডার তড়িঘড়ি ছুটে এলো কন্ট্রোল টাওয়ারে। দুইটি এফ-৮৬ বিমান মুহূর্তে ধাওয়া করল ব্লুবার্ডকে।

কিন্তু কোথায় ব্লুবার্ড?

বাম্বিন আর খাট্টার রাডার স্টেশনগুলো চারপাশে খবর লাগিয়ে রিপোর্ট করল: ব্লুবার্ডের গতিবিধি বোঝাও যাচ্ছে না, ধরাও যাচ্ছে না।

২.

শান্ত সমাহিত মতিউর। মিনহাজ তাঁরই প্রশিক্ষণার্থী। সে খুব উত্তেজিত। ক্রুদ্ধও। একনাগাড়ে গালিগালাজ করে যাচ্ছে তার নিজের প্রশিক্ষককে।

মতিউরব্লুবার্ডের নিয়ন্ত্রণ নিজের মুঠোয় রাখতে ব্যস্ত। মাথাটাকে ঠা-া রাখার চেষ্টা করছেন।

বিমান ছিনতাই আপাততঃ সফল। পাকিস্তানের সব রাডারকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয়েছে-ব্লুবার্ডের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কেউ ধারণা করতে পারছে না। এখন বিমানটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে সীমান্ত পেরিয়ে। এই বিমান আর কখনোই ফিরে যাবে না করাচির মাসরুর বিমান ঘাঁটিতে। ব্লুবার্ড আর মিনহাজকে নিয়েই ঢুকে যেতে হবে ভারতের আকাশে। কাছাকাছিই গুজরাটের জামনগর। আশা করা যায়, সেখানে বিমান অবতরণ করানোর কাজ তেমন কঠিন হবে না।

মনে পড়ছে স্ত্রী মিলির মুখ। মিলিকে আজ কোনো কিছু বলে আসা হয় নাই। রাতটা কেটেছে ছটফটের মধ্য দিয়ে। ঘুম প্রায় হয়নি। সারাটা রাত পরিকল্পনাটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা মুক্তির জন্য লড়াই করছে। বাঙালি হয়ে মতিউরও নিশ্চুপ বসে থাকতে পারেন না। এই অস্থির ভাবনাই তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। একটা বিমান যদি ঐ দামাল যোদ্ধাদের হাতে তুলে দেয়া যায়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের পথে অনেকখানি এগিয়ে নেয়া যাবে। বিমানটা চাই। এই ব্লুবার্ডই।

সকালে তিনি তাঁর গাড়ি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। মিলিকে কোনো কথাই বলা হয় নাই। তাঁর কাছ থেকে বিদায়ও নেওয়া হয় নাই। এমনকি নিত্য দিনকার মতো সালাম বিনিময় হয় নাই। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তিনি মিলির দিকে তাকাতে সাহস সঞ্চয়ও করতে পারছিলেন না। প্রতিদিন বেরুনোর সময় খোদা হাফেজ বলেন। আজ তাড়াহুড়ায় তাও বলা হয় নাই। মিলি, একটি চুমুও তো তোমার পাওনা রয়ে গেল!

এখন পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ মতিউরের পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছে। কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে এসেছেন বিমান ঘাঁটিতে। অপেক্ষা করছিলেন ব্লুবার্ডের জন্য। রাশেদ মিনহাজকে তিনি জেট বিমান ওড়ানোর তালিম দেন। আজ সকালে সে বিমান নিয়ে বেরুবে। হাইজ্যাক করতে হবে বিমান আর শিক্ষার্থীকে।

মিনহাজ ব্লুবার্ড নিয়ে রানওয়েতে ঢোকার জন্য চার নাম্বার ট্যাক্সি ট্রাকের দিকে এগিয়ে আসছিল। টিলার আড়ালে পৌঁছতেই একটা গান তীব্র গতিতে ছুটে এসে ব্রেক কষলো। গাড়িটা ব্লুবার্ডের পিছনে এমনভাবে রাখা হলো যাত অন্য কোনো বিমান ব্লুবার্ডকে তাৎক্ষণিক ধাওয়া না করতে পারে।

গাড়ি থেকে নেমে এলেন মতিউর। মিনহাজকে ইশারা করলেন বিমান থামানোর জন্য।

বিস্মিত মিনহাজ। এখন এই সময়টাতে তো তার ট্রেইনার আসার কথা নয়! কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে সে তো বিমান ওড়ানোর জন্য ক্লিয়ারেন্স নিয়েই এসেছে।

অবশ্য এরপরও ফ্লাইট সেফটি অফিসার বিশেষ কারণে বৈমানিককে চলমান বিমানকে থামানোর অর্ডার করতে কিংবা সংকেত দিতে পারেন। অর্ডারই হোক বা সংকেতই হোক, তা মান্য করতেই হবে।

বিমানের ক্যানোপি খুলল মিনহাজ। মতিউর চট করে বিমানে উঠে বসলেন। বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিজের মুঠোয় নেয়ার জন্য হাত বাড়ালেন।

মিনহাজ বিস্মিত হয়ে বলে উঠল: এটা কী হচ্ছে?

তার দিকে হিম শীতল দৃষ্টিতে তাকালেন মতিউর। এমন চোখের ভাষা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল: ব্লুবার্ড এখন আর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান নয়। এই বিমানে এখন উড়বে স্বাধীন বাংলার পতাকা।

বাধা দিতে গেল মিনহাজ। সে প্রচ- ঝাপটা খেল। মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল: ব্লুবার্ড হাইজ্যাক হয়েছে।

অপর প্রান্ত থেকে কাঁপা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো: নিশ্চিত করে বলো তোমার বিমান হাইজ্যাক হয়েছে কিনা।

সারা পাকিস্তান কাঁপিয়ে গম্ভীর দৃঢ় কণ্ঠস্বর সুস্পষ্ট ভাষায় জানান দিল: নিশ্চিত।

৩.

এই দফায় ঘরে আর ফেরা হবে না মিলি!বারবার মিলির কথাই মনে পড়ছে মতিউরের। ভাবছেন, মিলি তাঁর শেষ চিঠিটা পাবেন কিনা যেটায় লিখে এসেছেন: এ মুহূর্তে মিলিকে আর কিছুই দেয়ার নেই স্বাধীন দেশ ছাড়া।

মিলি কি মতিউরের অভাবপ্রবল ভাবে অনুভব করবেন? তিনি তো তাঁর ঘ্রাণ রেখে এসেছেন মিলির কাছে। তাঁদের দুই মেয়ে- মাহিন ও তুহিন। মিলি, তুমি কি কখনো খেয়াল করেছ: আমাদের কন্যাদের শরীরে আমার শরীরের সূক্ষ্ম এক ধরনের ঘ্রাণ পাওয়া যায়?

মতিউর উপরে খোলা নীল আকাশের দিকে তাকালেন।

স্যালুট করলেন দূরে তাঁর ভালোবাসার দেশকে।আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ়তা ফুটে উঠল তাঁর চোখেমুখে।

আত্মগতভাবে বললেন: আমি আবার ফিরব। আমাদের স্বাধীন দেশের পতাকা বুকপকেটে নিয়ে ফিরব।

মিনহাজ আবার তার থাবা উঁচিয়ে ধরল। কেঁপে উঠল উড়ন্ত বিমান।

৪.

বিকালে খবর এলো: সিন্ধুর খাট্টার কাছে বিধ্বস্তহয়েছে একটি বিমান। আরোহী দুই বৈমানিক ঘটনাস্থলেই নিহত।

back to top