alt

স্বাধীনতা দিবস ২০২৫

অনন্ত আকাশগ্রন্থি

মহিবুল আলম

: বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

জাভেদ আহমেদ ট্রেন থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকালেন। স্টেশনে তাকে নেওয়ার জন্য মামার বাড়ির কেউ একজন আসার কথা। তার ছোট মামা ফোনে তাই বলেছেন। ছোট মামা নিজেও আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি খুব বৃদ্ধ। ঠিকমতো নাকি হাঁটাচলা করতে পারেন না। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। তারপরও দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর তিনি আসছেন বলে ছোট মামা স্টেশনে আসার কথা বারবার বলছিলেন।

জাভেদ আহমেদ মাথা ঝাঁকালেন। ভাবলেন, হ্যাঁ, পঞ্চাশ বছর তো হবেই। শেষবার যখন দেখা হয় সেটা উনিশশো তিয়াত্তর সাল। ঢাকা গুলিস্তানের মোড়ে ছোট মামাই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তখন তিনি একটা জুতার দোকানে চাকরি করতেন। নাজ সিনেমা হলের পেছনে জুতার দোকানটা ছিল।

জুতার দোকানে জাভেদ আহমেদের কাজ ছিল ক্যাশ দেখাশোনা। উচ্চমাধ্যমিক পাস ছিলেন। দেখাশোনায়ও ভালো ছিলেন। সেই জুতার দোকানের মালিকের মেয়ে জুলেখা তার প্রেমে পড়ে। পঁচাত্তর সালে বিয়ে করেন। বিয়েটা একান্ত ঘরোয়াভাবে হয়। সাতাত্তর সালে শ্বশুরের অধীনে জুতার ব্যবসা ভালো লাগে না বলে জাপান পাড়ি দেন। জাপানে গিয়ে ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ইংরেজ মেয়ে লোরার প্রেমে পড়েন। জাপানে চার বছর থেকে লোরার সঙ্গেই তিনি অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান।

লোরার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে সবার আগে জাভেদ আহমেদ যে কাজটা করেন, তিনি বাংলাদেশে জুলেখাকে তালাকনামা পাঠিয়ে দেন। জুলেখার সঙ্গে অবশ্য তিনি জাপান যাওয়ার পরপরই যোগাযোগ শিথিল করে দিয়েছিলেন। পরে কিন্তু তিনি লোরাকেও বিয়ে করেননি। তিনি বিয়ে করেন ক্যাথারিনা নামের এক অস্ট্রেলিয়ার সাদা মেয়েকে। তিনটা ছেলেমেয়ে হওয়ার পরও কেন জানি ক্যাথারিনার সঙ্গেও তার সম্পর্কটা টিকেনি। দোষটা অবশ্য ক্যাথারিনার ছিল না। দোষ তার নিজের ছিল। একেকজনকে তিনি ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতেন। যেমন জুলেখাকে বিয়ে করেছিলেন ঢাকায় নিজের পায়ের নিচে মাটি পাওয়ার জন্য। জুলেখার বাবার টাকা খরচ করেই জাপান যান। জাপানে লোরার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য। অস্ট্রেলিয়া গিয়ে কিছুদিন পরই লোরার সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করে দেন। নতুন অবলম্বন হিসেবে ক্যাথারিনাকে ধরেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য। ক্যাথারিনার পর ফিজি ইন্ডিয়ান মেয়ে এঞ্জেলিনা। এরপর অবশ্য নানানমুখো হলেও এঞ্জেলিনার সঙ্গে কীভাবে যেন সম্পর্কটা ধরে রেখে কুইন্সল্যান্ডের ব্রিসবেনে স্থায়ী হন।

প্রথম জীবনেও জাভেদ আহমেদ ভালোবাসার নাম করে একজনের ওপর অবলম্বন গেড়েছিলেন। তাদের অনন্তপুর গ্রামেরই। আলপনা দত্ত। সেটা অবশ্য অন্যকথা।

জাভেদ আহমেদ শুধুমাত্র মানুষের ওপরই অবলম্বন করেননি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপরও করেছেন। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে জলে ফেলতেও দ্বিধা করেননি। বাংলাদেশ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস ও অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের একটা ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করে বুদ্ধির জোরে একটা প্রতিষ্ঠানের সিইইউ পর্যন্ত হয়েছিলেন।

এখন অবসরজীবনে একটা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। বিনাবেতনে উপদেষ্টা নন, রীতিমতো বেতনভুক উপদেষ্টা। এবার সেই প্রতিষ্ঠান থেকে নিজে চেয়ে নিয়েই বাংলাদেশে একটা অফিসিয়াল কাজে আসেন। অফিসিয়াল কাজটা মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হলো, এ বয়সে একবার নিজের গ্রাম ও নিজের জন্মভিটেটা দেখে যাওয়া।

দুই

নয়নপুর স্টেশনটা এমনিতেই ছোট ছিল। পঞ্চাশ বছরে খুব একটা যে পরিবর্তন হয়েছে, তা মনে হলো না। অবশ্য এখন মধ্যরাত। তার ওপর বিদ্যুৎ নেই। স্টেশনের কতদূরইবা দেখা যাচ্ছে! তবে স্টেশনের টিকেটঘরটা নতুন হয়েছে, এটা বোঝা যাচ্ছে। এছাড়া স্টেশনের দুই পাশের সারি করা টিনের টং ঘরগুলো এখনও একই রকম আছে।

নয়নপুর স্টেশনে কোনো আন্তঃনগর ট্রেনগুলো থামে না। তাই জাভেদ আহমেদকে ঢাকা থেকে কুমিল্লা আন্তঃনগর ট্রেনে এলেও কুমিল্লা থেকে নয়নপুরের উদ্দেশ্যে লোকাল ট্রেনে আসতে হলো। তিনি অবশ্য গাড়ি নিয়েও আসতে পারতেন। কিন্তু নয়নপুরের রাস্তাঘাটের অবস্থা কী, তিনি জানেন না। ছোট মামার কথা তিনি অর্ধেকই বোঝেন তো বাকি অর্ধেক বোঝেন না। বয়সের কারণে কথা কেমন জড়িয়ে আসে। এছাড়া পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার জন্যও তিনি এভাবে ট্রেনে এসেছেন।

পঞ্চাশটি বছর! জাভেদ আহমেদ মাথা নাড়লেন। ঠিক পঞ্চাশ বছর নয়, প্রায় বায়ান্ন বছর। উনিশশো একাত্তর সালের বারোই ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীনের ঠিক চারদিন আগে তিনি গ্রাম ছেড়ে পালান। রাজাকারের কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বরের বারো তারিখই নয়নপুর, হোসেনপুর, অনন্তপুরসহ কুমিল্লার এ অঞ্চল দখল করে নেয়। তিনি প্রথমে কুমিল্লা, তারপর ঢাকা পালাতে বাধ্য হন। ঢাকা যাওয়ার পর তাকে আর কে চিনে! তিনি আর কোনোদিন গ্রামে ফিরেননি।

অবশ্য গ্রামে ফেরার মতো তার কেউ ছিল না। বাবা-মা মারা যায় তার বাল্যকালে। কলেরায় সাতদিন আগে ও পরে। আর কোনো ভাইবোন ছিল না। মামার বাড়িতে খুব লাঞ্ছনায় ও অবহেলায় বেড়ে ওঠেন। তার ছোট মামাই তাকে যা একটু আদর করতেন। ছোট মামা থেকে তার বয়সের পার্থক্য ছিল পাঁচ বছরের।

ছোট মামার কথা মনে পড়তেই জাভেদ আহমেদ দৃষ্টিটা আবার দিঘল করে স্টেশনের এদিক-ওদিক তাকালেন। ছোট মামার পাঠানো সেই লোক কোথায়? এখন তার মনে হচ্ছে, কষ্ট করে হলেও স্টেশনে ছোট মামা এলেই ভালো হতো। মামা তো আসতে চেয়েছিলেন। বয়স্ক মানুষ বলে তিনিই না করেছিলেন।

ছোট মামার বয়সের কথা ভাবতে গিয়ে জাভেদ আহমেদ নিজের বয়সের কথা ভাবলেন। তারও কি বয়স কম হয়েছে? একাত্তর পেরিয়ে বাহাত্তরে পড়েছেন। যদিও তিনি চলাফেরা করেন তাগড়া জোয়ানের মতো। বিদেশে সত্তর-পঁচাত্তর বছর বয়স কোনো বয়সই না।

নয়নপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে বেশ অনেকগুলো মানুষ নামলেও স্টেশনটা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেল। টং দোকানগুলোর দু-একটা এখনও খোলা থাকলেও মধ্যরাতের ট্রেন চলে যাওয়ার পর দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে ফেলছে। দু-একটা দোকানের ঝাঁপের ফাঁক গলে হারিকেন বা কুপির আলো আসছে। স্টেশনের ছোট্ট প্ল্যাটফর্মের খানিকটা দূরে একটা লোক আগুন জ্বালিয়ে কী যেন করছে। লোকটা নিশ্চয়ই পাগল।

স্টেশন পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর জাভেদ আহমেদ বুঝলেন, তাকে কেউ নিতে আসেনি। হয়তো বিকেল ছয়টার ট্রেন মধ্যরাতে এসে পৌঁছেছে বলে মামার বাড়ি থেকে আসা লোকটা অপেক্ষা করে চলে গেছে। ট্রেনলাইনে কী একটা ঝামেলা হয়েছিল, তাই এত দেরি। কিন্তু তিনি তো ছোট মামাকে ট্রেন দেরি হওয়ার কথা আসতে আসতে ফোনে জানিয়েছেন। তাহলে?

জাভেদ আহমেদ ছোট মামাকে আবার ফোন দিবেন বলে প্যান্টের পকেটে হাত দিলেন। কিন্তু মোবাইলটা পকেটে নেই। তিনি কিছুটা আঁতকে উঠলেন। মোবাইলটা নিশ্চয়ই ট্রেন থেকে নামার সময় পকেট থেকে খোয়া গেছে। যদিও তিনি বাংলাদেশে এসে ব্যবহার করবেন বলে সস্তার একটা মোবাইল সেট নিয়েছিলেন, এতে আক্ষেপ করার কিছু নেই। কিন্তু এখন ছোট মামাকে কীভাবে ফোন দিবেন? ফোন নম্বরও তো মুখস্থ নেই।

জাভেদ আহমেদ কিছুক্ষণ মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি এখন কী করবেন বুঝতে পারলেন না। প্ল্যাটফর্মের পাশে টিকেট মাস্টারের অফিস ঘর থেকে জানালা গলে আলো আসছে। তিনি সেদিকে এগিয়ে গেলেন।

অফিসঘরের ভেতর একটা মোমবাতি জ্বলছে। টিকেট মাস্টার অফিসের ভেতরই মেঝে বিছানা পেতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। টিকেট মাস্টার খুব বেশি বয়সী নয়, বড়জোর চল্লিশের কোঠায়।

জাভেদ আহমেদ ডাকলেন, ‘এই যে শুনছেন’।

টিকেট মাস্টার খানিকটা বিরক্ত হয়ে জানালার কাছে এলেও স্যুট পরা বয়স্ক জাভেদ আহমেদকে দেখে তৎক্ষণাৎ সমীহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘জি বলুন’।

‘এখান থেকে অনন্তপুর যাওয়ার ব্যবস্থা কী?’

‘অনন্তপুর যাবেন? আগে তো রিকশা নিয়ে চলে যাওয়া যেত। সিএনজিও চলত। কিন্তু মাসখানেক আগে গোমতীর বেড়িবাঁধ ভেঙে ঢল এসে মেইন রাস্তার পাকা ব্রিজটা ভেঙে দিয়ে যায়। এখন তো নৌকা বাদে উপায় নেই’।

‘নৌকাঘাট কোথায়?’

‘ওই তো, স্টেশন থেকে টং দোকানগুলো পেরিয়ে পশ্চিমে গেলে নৌকাঘাট’।

‘এখন নৌকা পাওয়া যাবে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, পাওয়া যাবে’।

জাভেদ আহমেদ আর কথা বাড়ালেন না। টিকেটঘরের জানালা থেকে সরে এলেন। প্ল্যাটফর্ম থেকে নামতে নামতে একবার ভাবলেন, রাতটা স্টেশনেই কাটাবেন কি না। পরক্ষণ ভাবলেন, নাহ, স্টেশনে না থেকে অনন্তপুর যাওয়াটাই উত্তম। তাকে আবার সকাল দশটার ট্রেন ধরতে হবে। আগামীকাল ঢাকা না ফিরলেই নয়। এছাড়া তিনি স্টেশনেইবা কাটাবেন কেন? তিনি পঞ্চাশ বছর পর এসেছেন তো কী হয়েছে? এই নয়নপুর স্টেশন তো তার নিজের স্টেশন। অনন্তপুর গ্রাম তার নিজের গ্রাম। এই গ্রামে তার জন্ম। একুশটা বছর তিনি এই গ্রামে কাটিয়ে গেছেন!

তিন

স্টেশনের দিঘল টংঘরগুলো পেরিয়ে যেতে যেতে জাভেদ আহমেদ বাঁ হাতের গোল্ড চেইনে বাঁধানো ঘড়িটা দেখলেন। রাত প্রায় একটা বাজে। আকাশে আস্ত একটা চাঁদ। মাসটা শ্রাবণ মাস। মেঘগুলো দৌড়াচ্ছে চাঁদকে খানিকটা দূরত্বে রেখে।

জাভেদ আহমেদ ঘাটে এসে দেখলেন, একটামাত্র নৌকা বাঁধা সেখানে। তিনি আশা করেছিলেন, আরও কয়েকটা নৌকা বাঁধা থাকবে ঘাটে। তিনি পাড়ে দাঁড়িয়েই একটু জোর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই মাঝি, অনন্তপুর যাবে?’

নৌকার মাঝির গলাটা একটু খনখনে শোনালো। গলায় কেমন মেয়েলী টান। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি তো অনন্তপুর রহমান মৃধার বাড়িতে যাবেন, তাই না?’

জাভেদ আহমেদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি জানলে কীভাবে, তোমাকে ছোট মামা পাঠিয়েছেন?’

নৌকার মাঝি কিছু বলল না। হ্যাঁ বোধক মাথা ঝাঁকাল।

জাভেদ আহমেদ পাড় থেকে নৌকার দিকে নেমে এলেন। ঘাটটা বেশ পিচ্ছিল। তিনি একবার পিছলে পড়তে পড়তে সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। আরেকবার নৌকায় উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ে খুঁটি ধরে ফেললেন। নৌকার মাঝি অবশ্য তাকে এভাবে পড়তে দেখেও সাহায্য করতে এল না।

জাভেদ আহমেদ নৌকায় উঠে প্রথমে একটু মনঃক্ষুণœ হয়ে মাঝির দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি কেমন ভ্রম ঠেকল। নৌকার মাঝিকে দেখতে মেয়ে-মেয়ে লাগছে। তিনি খানিকটা অবাক হয়ে ভাবলেন, তার ছোট মামা কি তাকে নেওয়ার জন্য মেয়ে মাঝি পাঠিয়েছেন? নাকি এটা তার বয়সী চোখ, ভুল দেখছেন? এদিকে নৌকায় কোনো হারিকেন নেই। সাধারণত রাতে নৌকা চালালে খুঁটিতে একটা হারিকেন ঝুলিয়ে রাখা থাকে। মাত্র হাত কয়েক দূরত্ব হলেও শরতের হালকা কুয়াশা মেশানো জ্যোৎস্নার আলোতে মানুষটার চেহারা ঠিক স্পষ্ট হয়ে উঠছে না।

জাভেদ আহমেদ ব্যাপারটা নিয়ে আর গা করলেন না। ব্রিফকেসটা একপাশে রেখে গলুইতেই বসলেন। মাঝি যেহেতু জানে কোথায় যাবে, তাই তিনি আর কথা বাড়ালেন না।

নৌকাটা চলতে শুরু করল।

জাভেদ আহমেদ মাঝির ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিলের জলের দিকে দিঘল দৃষ্টি মেললেন। কিছুক্ষণ বিলের জলের দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার ভেতর থেকে একটা ভারি নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। ভাবলেন, আহা, সেই বরুণার বিল। লোকজন বলত বাইন্যার বিলও। এই বিলে তার কত স্মৃতি! শিশুকাল, কিশোরবেলা, তার যুবক হয়ে ওঠা।

বরুণার বিলে সুদিনে বুক চিতিয়ে উঠলেও বর্ষা বা শরতে নয়নপুর স্টেশন থেকে অনন্তপুর গ্রামে যেতে নৌকাই একমাত্র বাহন ছিল। তিনি ট্রেনে আসতে আসতে ভেবেছিলেন, পঞ্চাশ বছরে নয়নপুর স্টেশন ও অনন্তপুর গ্রামের কতই না পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আদতে নয়নপুর স্টেশনের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। অনন্তপুর গ্রামে এখনও নৌকা চলে।

নৌকাটা বিলের জলে সিঁথি কেটে নয়নপুর ঘাট পেছনে ফেলে হোসেনপুর গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। হোসেনপুর গ্রামের কোনো বাড়িতেই এখন আলো নেই। প্রকৃতির ভরাট জ্যোৎস্নায় প্রতিটি পাড়া কেমন নিস্তব্ধ সবুজ-কালি করে দাঁড়িয়ে আছে।হোসেনপুরের পরই অনন্তপুর। মাত্র দেড় কিলোমিটারের পথ। পঞ্চাশ বছর পর এলেও পথটা তার আজও কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কিছুই বদলায়নি। জলের ওপর মাথা উঁচিয়ে থাকা বোরোধান। সেই ধানক্ষেতের মাঝখানে জলের সিঁথিকাটা পথ। তিন-চারটা বাড়ি নিয়ে এখনও ছোট ছোট পাড়াগুলো দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

জাভেদ আহমেদ নৌকায় ওঠার পর নৌকার মাঝি এতক্ষণ কথা না বললেও এবার খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেমন আছ, জাভেদ?’

জাভেদ আহমেদ চমকে উঠলেন। গা-টাও কেমন কাঁটাকাঁটা দিয়ে উঠল। গলাটা খনখনে শোনালেও কণ্ঠটা কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে। তিনি গলুইতে নড়েচড়ে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি, তুমি কে?’

মাঝি বলল, ‘আমি আলপনা’।

জাভেদ আহমেদ আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলপনা, কোন আলপনা? তুমি আলপনা?’

‘হ্যাঁ, আমি আলপনা। দত্তবাড়ির আলপনা। আলপনা দত্ত’।

‘তুমি বেঁচে আছ?’

আলপনা বলল, ‘আমি তো কখনও মরিনি’।

চার

আলপনা বেঁচে আছে, এটা জাভেদ আহমেদের কাছে বেশ অবাক লাগল। সে কীভাবে বেঁচে আছে? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি, খুব সম্ভব আগস্ট মাসের দিকে সে পাকিস্তানি হানাদারের গুলিতে মারা যায় বলে তিনি জেনেছেন। তিনি অবশ্য নিজচোখে দেখেননি। তাহলে কি আলপনা সেদিন কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিল? হয়তো বেঁচে যেতেও পারে। দেশ স্বাধীনের চারদিন আগেই তো তিনি গ্রাম ছেড়ে পালান। তারপর আর কোনোদিন গ্রামে ফিরেননি। আজ প্রায় পাঁচ দশক পর ফিরছেন।

জাভেদ আহমেদের মনে আরেকটা ব্যাপার ধন্ধ ঠেকছে। এই বায়ান্ন বছর পরও আলপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই কেন? দেখতে সেই একই রকম লাগছে। অবশ্য জ্যোৎস্নার আলোতে তিনি আলপনাকে কতটুকুই বা দেখতে পারছেন? এছাড়া এখন হিসেব করলে আলপনার বয়সও তো সত্তরের মতো হবে। এ বয়সে নৌকা চালিয়ে তাকে নিতে এসেছে!

জাভেদ আহমেদ এসব ভাবতে ভাবতে কোথাও একটু ক্ষয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক তখনই নৌকাটা কোথাও একটা ধাক্কা খেল। তিনি সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখলেন, একটা দ্বীপের মতো স্থানে আলপনা নৌকাটা ভিড়াচ্ছে।

জাভেদ আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা কি চলে এসেছি?’

আলপনা বলল, ‘না’।

‘তাহলে এখানে নৌকা ভিড়ালে যে?’

‘তোমাকে জায়গাটা দেখানোর জন্য’।

‘আমাকে দেখানোর জন্য? এটা কার জায়গা?

‘এটা আমার জায়গা। এখানে আমি বসবাস করি। তুমি চিনতে পারছ না?’

জাভেদ আহমেদ এদিকওদিক তাকালেন। দেখলেন, বটগাছের মতো দেখতে বৃহৎ একটি গাছ। জ্যোৎস্নার আলোতে গাছটির তল ধূপছায়া অন্ধকার হয়ে আছে। একটি ছোট্ট শনের ঘর আছে গাছটির নিচে।

আলপনা নিজ থেকে বলল, ‘এটা পুনোয়ারার বটগাছ’।

জাভেদ আহমেদ স্থানটিকে এবার সহজেই চিনতে পারলেন। হোসেনপুর ও অনন্তপুর গ্রামের মাঝখানে বরুণার বিলের পেট বের করা এই ছোট্ট দ্বীপের মতো স্থানটায় একসময় মেলা বসত। পুনোয়ারার মেলা। স্থানটার নামেই মেলাটির নাম ছিল। কিন্তু তার এটা ভেবে আশ্চর্য ঠেকল, এতগুলো বছর পরও এই স্থানটার কোনো পরিবর্তন নেই কেন? সেই বটগাছ। সেই ছোট্ট কুড়েঘর। এই কুড়েঘরটায় তো একসময় একটা পাগল বসবাস করত। মফিজ পাগলা। বিলের জল সাঁতরে এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে চেয়ে খেত। একাত্তর সালে পাকিস্তান আর্মিরা বিনাকারণেই তাকে মেরে ফেলে।

জাভেদ আহমেদ বুঝতে পারলেন না, আলপনা তাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে? আর সে এখানে, মফিজ পাগলার ফেলে রাখা এই কুঁড়েঘরেইবা বসবাস করছে কেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলপনা, তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ কেন?’

আলপনা গম্ভীর গলায় বলল, ‘প্রতিশোধ নিবো বলে!’

জাভেদ আহমেদ নৌকায় ওঠার পর থেকেই কেমন ভয় পাচ্ছিলেন। পুরো পরিবেশটায় গা ছমছম করছিল। যদিও তিনি যুক্তিনির্ভর মানুষ। প্রকৃতির অস্বাভাবিক কিছু তেমন বিশ্বাস করেন না। কিন্তু নৌকায় আলপনার উপস্থিতি, এখন আলপনার এমন গম্ভীর গলা, তিনি সত্যি এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলপনা, তুমি এসব কী বলছ?’

আলপনা বলল, ‘আমি ঠিকই বলছি। এতদিন তোমার আসার অপেক্ষায় ছিলাম’।

জাভেদ আহমেদ আরও ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘কী অপেক্ষায় ছিলে?’

‘তোমাকে মারার জন্য। ঠিক এই স্থানটায়’।

‘ধ্যাৎ, বাজে বকো নাতো!’

‘বাজে নয়, ঠিকই বলছি। কারণ, তুমি দানব। শুধু দানব বললে ভুল হবে। তুমি নরপিশাচ। পাকিস্তান আর্মিরা যখন আমার বৃদ্ধ মা-বাবাকে মেরে ফেলে, কাকাকে ধরে নিয়ে যায়, তখন আমি বাড়ির পেছন থেকে কোনোমতে পালিয়ে বিলের জলে সাঁতরে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তুমি আশ্রয় দিয়েছিলে ঠিকই, কিন্তু মাস খানেক পর তুমি নিজেই আমাকে মিথ্যে কথা বলে পাকিস্তানি এক মেজরের হাতে তুলে দিয়েছিলে। মেজর দুইদিন রেখে তার জওয়ানদের হাতে আমাকে ছেড়ে দেয়। তারপর প্রতিরাতে জওয়ানরা চার-পাঁচজন করে আমার শরীরে নির্যাতন চালায়। কতবার যে মরতে মরতে বেঁচে গেছি! জাভেদ, তুমি সেদিন সেটা কী করেছিলে? কেন করেছিলে? আমি না তোমাকে ভালোবাসতাম?’

জাভেদ আহমেদ কিছু বললেন না। আসলে তিনি কিছু বলতে পারলেন না। এটা তো সত্য আলপনা দত্তকে তিনি পাকিস্তানি মেজরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি মেজরের শখ ছিল হিন্দু মেয়ে ভোগ করবে। বলেছিল, হিন্দু মেয়ে ভোগ করলে পাপ হয় না। তখন হোসেনপুর, অনন্তপুর বা গোপালপুরে কোনো হিন্দু ছিল না। সবাই ত্রিপুরা বর্ডার দিয়ে ভারতে পালিয়েছিল। যারা মাটি কামড়ে থাকবে বলে ভেবেছিল, তাদেরকেও মেরে ফেলা হয়েছিল। হাতের কাছে ছিল আলপনা। তাদের বাড়িতে আশ্রিতা।

জাভেদ আহমেদ অবশ্য প্রথমে এমনটা চাননি। আলপনাকে তিনি সত্যি ভালোবাসতেন। অনন্তপুর গ্রামের এ পাড়া আর ও পাড়া। আলপনার বাবা অশীত দত্ত তাদের গোপালপুর স্কুলের বাংলার শিক্ষক ছিলেন। তিনি তাকে স্কুলে ও কলেজে লেখাপড়ায় বেশ আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন।

জাভেদ আহমেদ অবশ্য ভালোবাসার চেয়ে অবলম্বনটাকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। তিনি আলপনাকে বরাবর অবলম্বন হিসেবেই দেখতেন, যা তিনি বাকি জীবনে অন্যদের ওপরও দেখে এসেছেন। তারপরও...! সেদিন যত ঝামেলাটা বাঁধায় আক্কাস আলী। হোসেনপুর, অনন্তপুর ও গোপালপুরের রাজাকারের কমান্ডার ছিল। জাভেদ আহমেদের বন্ধু ছিল।

জাভেদ আহমেদ সেদিন নিজেকে বাঁচাতে আলপনাকে পাকিস্তানি মেজরের হাতে তুলে দেন। পরে সেই পাকিস্তানি মেজর অবশ্য আক্কাস আলীকে সরিয়ে তাকে এ এলাকার রাজাকারের কমান্ডার বানায়। তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ বলে সেই মেজর তাকে আশ্বাস দেয়, যুদ্ধ শেষ হলে তাকে সেনাবাহিনির কমিশন দেওয়ার সব ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সেটা তো আর হয়নি। মুক্তিবাহিনীরা দেশ স্বাধীন করে ফেলে।

জাভেদ আহমেদকে চুপ হয়ে যেতে দেখে আলপনা এবার ভারি গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে ঠিক এ স্থানটায় মারতে চাই। কারণ, পাকিস্তান হানাদাররা এ এলাকা থেকে চলে যাবার আগে নৌকায় ভরে একুশজনকে এখানটায়, এই বটগাছটার নিচে গুলি করে মেরেছিল। আমি গুলি খেয়েও বাঁচার জন্য বিলের জলের দিকে দৌড় দিয়েছিলাম। তখন তোমার বন্ধু আক্কাস আলী আমাকে চুলের মুঠি ধরে চুবিয়ে ধরে। চুলের মুঠি ধরে একবার তোলে। আমি ফোঁস করে শ্বাস নেই। আবার জলের ভেতর ঠেসে ধরে...’।

জাভেদ আহমেদ অবলম্বনহীন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর?’

আলপনা বলল, ‘তারপর আর কিছু নেই। এখন তোমাকে সেই বিলের জলে চুবিয়ে মারতে এসেছি। এটাই আমার প্রতিশোধ, একমাত্র প্রতিশোধ। এ জন্যই আমি এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম’।

জাভেদ আহমেদ মিনমিন গলায় বললেন, ‘আমি তো তোমাকে মারিনি’।

আলপনা বিকট চেহারা বানিয়ে চিৎকার করে খনখনে গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে তিলে তিলে মেরেছ’।

পাঁচ

ভোরের দিকে অনন্তপুর গ্রামের সীমানার রহমত আলী ছোট্ট একটা নৌকায় বরুণার বিলে পাতা জাল তুলতে এল।

উত্তরের উজানের জল বাড়লে বরাবরই রহমত আলী একটা ছোট্ট নৌকায় করে বরুণার বিলের এদিকওদিক খাঁড়াজাল পাতে। সন্ধ্যায় জাল পেতে ভোরে দিকে তোলে। মানুষের বাড়িতে কামলা দেওয়ার পাশাপাশি পাতা জালে ধরা মাছ আড়ংয়ে বিক্রি করে সে সংসার চালায়।

রহমত আলী আজ ভোরে খাঁড়াজাল তুলতে এসে অবাক হয়ে দেখল, একটা নৌকা পুনোয়ারার বটগাছটার কাছাকাছি জলে ভাসছে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। সে প্রথমে ভাবল, হয়তো কোনো বাড়ির নৌকা খুঁটি থেকে খুলে গিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছে। সে সেই নৌকাটার দিকে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি এসেই তার চোখ বড় হয়ে গেল। সে দেখল, এক স্যুট পরা ভদ্রলোক নৌকার ঠিক মাঝখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ভদ্রলোকের সমস্ত শরীর ভেজা। নৌকাটা যেন দুলছে একটু বেসামালভাবেই।

tab

স্বাধীনতা দিবস ২০২৫

অনন্ত আকাশগ্রন্থি

মহিবুল আলম

বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

জাভেদ আহমেদ ট্রেন থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকালেন। স্টেশনে তাকে নেওয়ার জন্য মামার বাড়ির কেউ একজন আসার কথা। তার ছোট মামা ফোনে তাই বলেছেন। ছোট মামা নিজেও আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি খুব বৃদ্ধ। ঠিকমতো নাকি হাঁটাচলা করতে পারেন না। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। তারপরও দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর তিনি আসছেন বলে ছোট মামা স্টেশনে আসার কথা বারবার বলছিলেন।

জাভেদ আহমেদ মাথা ঝাঁকালেন। ভাবলেন, হ্যাঁ, পঞ্চাশ বছর তো হবেই। শেষবার যখন দেখা হয় সেটা উনিশশো তিয়াত্তর সাল। ঢাকা গুলিস্তানের মোড়ে ছোট মামাই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তখন তিনি একটা জুতার দোকানে চাকরি করতেন। নাজ সিনেমা হলের পেছনে জুতার দোকানটা ছিল।

জুতার দোকানে জাভেদ আহমেদের কাজ ছিল ক্যাশ দেখাশোনা। উচ্চমাধ্যমিক পাস ছিলেন। দেখাশোনায়ও ভালো ছিলেন। সেই জুতার দোকানের মালিকের মেয়ে জুলেখা তার প্রেমে পড়ে। পঁচাত্তর সালে বিয়ে করেন। বিয়েটা একান্ত ঘরোয়াভাবে হয়। সাতাত্তর সালে শ্বশুরের অধীনে জুতার ব্যবসা ভালো লাগে না বলে জাপান পাড়ি দেন। জাপানে গিয়ে ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ইংরেজ মেয়ে লোরার প্রেমে পড়েন। জাপানে চার বছর থেকে লোরার সঙ্গেই তিনি অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান।

লোরার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে সবার আগে জাভেদ আহমেদ যে কাজটা করেন, তিনি বাংলাদেশে জুলেখাকে তালাকনামা পাঠিয়ে দেন। জুলেখার সঙ্গে অবশ্য তিনি জাপান যাওয়ার পরপরই যোগাযোগ শিথিল করে দিয়েছিলেন। পরে কিন্তু তিনি লোরাকেও বিয়ে করেননি। তিনি বিয়ে করেন ক্যাথারিনা নামের এক অস্ট্রেলিয়ার সাদা মেয়েকে। তিনটা ছেলেমেয়ে হওয়ার পরও কেন জানি ক্যাথারিনার সঙ্গেও তার সম্পর্কটা টিকেনি। দোষটা অবশ্য ক্যাথারিনার ছিল না। দোষ তার নিজের ছিল। একেকজনকে তিনি ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতেন। যেমন জুলেখাকে বিয়ে করেছিলেন ঢাকায় নিজের পায়ের নিচে মাটি পাওয়ার জন্য। জুলেখার বাবার টাকা খরচ করেই জাপান যান। জাপানে লোরার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য। অস্ট্রেলিয়া গিয়ে কিছুদিন পরই লোরার সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করে দেন। নতুন অবলম্বন হিসেবে ক্যাথারিনাকে ধরেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য। ক্যাথারিনার পর ফিজি ইন্ডিয়ান মেয়ে এঞ্জেলিনা। এরপর অবশ্য নানানমুখো হলেও এঞ্জেলিনার সঙ্গে কীভাবে যেন সম্পর্কটা ধরে রেখে কুইন্সল্যান্ডের ব্রিসবেনে স্থায়ী হন।

প্রথম জীবনেও জাভেদ আহমেদ ভালোবাসার নাম করে একজনের ওপর অবলম্বন গেড়েছিলেন। তাদের অনন্তপুর গ্রামেরই। আলপনা দত্ত। সেটা অবশ্য অন্যকথা।

জাভেদ আহমেদ শুধুমাত্র মানুষের ওপরই অবলম্বন করেননি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপরও করেছেন। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে জলে ফেলতেও দ্বিধা করেননি। বাংলাদেশ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস ও অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের একটা ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করে বুদ্ধির জোরে একটা প্রতিষ্ঠানের সিইইউ পর্যন্ত হয়েছিলেন।

এখন অবসরজীবনে একটা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। বিনাবেতনে উপদেষ্টা নন, রীতিমতো বেতনভুক উপদেষ্টা। এবার সেই প্রতিষ্ঠান থেকে নিজে চেয়ে নিয়েই বাংলাদেশে একটা অফিসিয়াল কাজে আসেন। অফিসিয়াল কাজটা মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হলো, এ বয়সে একবার নিজের গ্রাম ও নিজের জন্মভিটেটা দেখে যাওয়া।

দুই

নয়নপুর স্টেশনটা এমনিতেই ছোট ছিল। পঞ্চাশ বছরে খুব একটা যে পরিবর্তন হয়েছে, তা মনে হলো না। অবশ্য এখন মধ্যরাত। তার ওপর বিদ্যুৎ নেই। স্টেশনের কতদূরইবা দেখা যাচ্ছে! তবে স্টেশনের টিকেটঘরটা নতুন হয়েছে, এটা বোঝা যাচ্ছে। এছাড়া স্টেশনের দুই পাশের সারি করা টিনের টং ঘরগুলো এখনও একই রকম আছে।

নয়নপুর স্টেশনে কোনো আন্তঃনগর ট্রেনগুলো থামে না। তাই জাভেদ আহমেদকে ঢাকা থেকে কুমিল্লা আন্তঃনগর ট্রেনে এলেও কুমিল্লা থেকে নয়নপুরের উদ্দেশ্যে লোকাল ট্রেনে আসতে হলো। তিনি অবশ্য গাড়ি নিয়েও আসতে পারতেন। কিন্তু নয়নপুরের রাস্তাঘাটের অবস্থা কী, তিনি জানেন না। ছোট মামার কথা তিনি অর্ধেকই বোঝেন তো বাকি অর্ধেক বোঝেন না। বয়সের কারণে কথা কেমন জড়িয়ে আসে। এছাড়া পঞ্চাশ বছর আগের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার জন্যও তিনি এভাবে ট্রেনে এসেছেন।

পঞ্চাশটি বছর! জাভেদ আহমেদ মাথা নাড়লেন। ঠিক পঞ্চাশ বছর নয়, প্রায় বায়ান্ন বছর। উনিশশো একাত্তর সালের বারোই ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীনের ঠিক চারদিন আগে তিনি গ্রাম ছেড়ে পালান। রাজাকারের কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বরের বারো তারিখই নয়নপুর, হোসেনপুর, অনন্তপুরসহ কুমিল্লার এ অঞ্চল দখল করে নেয়। তিনি প্রথমে কুমিল্লা, তারপর ঢাকা পালাতে বাধ্য হন। ঢাকা যাওয়ার পর তাকে আর কে চিনে! তিনি আর কোনোদিন গ্রামে ফিরেননি।

অবশ্য গ্রামে ফেরার মতো তার কেউ ছিল না। বাবা-মা মারা যায় তার বাল্যকালে। কলেরায় সাতদিন আগে ও পরে। আর কোনো ভাইবোন ছিল না। মামার বাড়িতে খুব লাঞ্ছনায় ও অবহেলায় বেড়ে ওঠেন। তার ছোট মামাই তাকে যা একটু আদর করতেন। ছোট মামা থেকে তার বয়সের পার্থক্য ছিল পাঁচ বছরের।

ছোট মামার কথা মনে পড়তেই জাভেদ আহমেদ দৃষ্টিটা আবার দিঘল করে স্টেশনের এদিক-ওদিক তাকালেন। ছোট মামার পাঠানো সেই লোক কোথায়? এখন তার মনে হচ্ছে, কষ্ট করে হলেও স্টেশনে ছোট মামা এলেই ভালো হতো। মামা তো আসতে চেয়েছিলেন। বয়স্ক মানুষ বলে তিনিই না করেছিলেন।

ছোট মামার বয়সের কথা ভাবতে গিয়ে জাভেদ আহমেদ নিজের বয়সের কথা ভাবলেন। তারও কি বয়স কম হয়েছে? একাত্তর পেরিয়ে বাহাত্তরে পড়েছেন। যদিও তিনি চলাফেরা করেন তাগড়া জোয়ানের মতো। বিদেশে সত্তর-পঁচাত্তর বছর বয়স কোনো বয়সই না।

নয়নপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে বেশ অনেকগুলো মানুষ নামলেও স্টেশনটা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেল। টং দোকানগুলোর দু-একটা এখনও খোলা থাকলেও মধ্যরাতের ট্রেন চলে যাওয়ার পর দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে ফেলছে। দু-একটা দোকানের ঝাঁপের ফাঁক গলে হারিকেন বা কুপির আলো আসছে। স্টেশনের ছোট্ট প্ল্যাটফর্মের খানিকটা দূরে একটা লোক আগুন জ্বালিয়ে কী যেন করছে। লোকটা নিশ্চয়ই পাগল।

স্টেশন পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর জাভেদ আহমেদ বুঝলেন, তাকে কেউ নিতে আসেনি। হয়তো বিকেল ছয়টার ট্রেন মধ্যরাতে এসে পৌঁছেছে বলে মামার বাড়ি থেকে আসা লোকটা অপেক্ষা করে চলে গেছে। ট্রেনলাইনে কী একটা ঝামেলা হয়েছিল, তাই এত দেরি। কিন্তু তিনি তো ছোট মামাকে ট্রেন দেরি হওয়ার কথা আসতে আসতে ফোনে জানিয়েছেন। তাহলে?

জাভেদ আহমেদ ছোট মামাকে আবার ফোন দিবেন বলে প্যান্টের পকেটে হাত দিলেন। কিন্তু মোবাইলটা পকেটে নেই। তিনি কিছুটা আঁতকে উঠলেন। মোবাইলটা নিশ্চয়ই ট্রেন থেকে নামার সময় পকেট থেকে খোয়া গেছে। যদিও তিনি বাংলাদেশে এসে ব্যবহার করবেন বলে সস্তার একটা মোবাইল সেট নিয়েছিলেন, এতে আক্ষেপ করার কিছু নেই। কিন্তু এখন ছোট মামাকে কীভাবে ফোন দিবেন? ফোন নম্বরও তো মুখস্থ নেই।

জাভেদ আহমেদ কিছুক্ষণ মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি এখন কী করবেন বুঝতে পারলেন না। প্ল্যাটফর্মের পাশে টিকেট মাস্টারের অফিস ঘর থেকে জানালা গলে আলো আসছে। তিনি সেদিকে এগিয়ে গেলেন।

অফিসঘরের ভেতর একটা মোমবাতি জ্বলছে। টিকেট মাস্টার অফিসের ভেতরই মেঝে বিছানা পেতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। টিকেট মাস্টার খুব বেশি বয়সী নয়, বড়জোর চল্লিশের কোঠায়।

জাভেদ আহমেদ ডাকলেন, ‘এই যে শুনছেন’।

টিকেট মাস্টার খানিকটা বিরক্ত হয়ে জানালার কাছে এলেও স্যুট পরা বয়স্ক জাভেদ আহমেদকে দেখে তৎক্ষণাৎ সমীহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘জি বলুন’।

‘এখান থেকে অনন্তপুর যাওয়ার ব্যবস্থা কী?’

‘অনন্তপুর যাবেন? আগে তো রিকশা নিয়ে চলে যাওয়া যেত। সিএনজিও চলত। কিন্তু মাসখানেক আগে গোমতীর বেড়িবাঁধ ভেঙে ঢল এসে মেইন রাস্তার পাকা ব্রিজটা ভেঙে দিয়ে যায়। এখন তো নৌকা বাদে উপায় নেই’।

‘নৌকাঘাট কোথায়?’

‘ওই তো, স্টেশন থেকে টং দোকানগুলো পেরিয়ে পশ্চিমে গেলে নৌকাঘাট’।

‘এখন নৌকা পাওয়া যাবে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, পাওয়া যাবে’।

জাভেদ আহমেদ আর কথা বাড়ালেন না। টিকেটঘরের জানালা থেকে সরে এলেন। প্ল্যাটফর্ম থেকে নামতে নামতে একবার ভাবলেন, রাতটা স্টেশনেই কাটাবেন কি না। পরক্ষণ ভাবলেন, নাহ, স্টেশনে না থেকে অনন্তপুর যাওয়াটাই উত্তম। তাকে আবার সকাল দশটার ট্রেন ধরতে হবে। আগামীকাল ঢাকা না ফিরলেই নয়। এছাড়া তিনি স্টেশনেইবা কাটাবেন কেন? তিনি পঞ্চাশ বছর পর এসেছেন তো কী হয়েছে? এই নয়নপুর স্টেশন তো তার নিজের স্টেশন। অনন্তপুর গ্রাম তার নিজের গ্রাম। এই গ্রামে তার জন্ম। একুশটা বছর তিনি এই গ্রামে কাটিয়ে গেছেন!

তিন

স্টেশনের দিঘল টংঘরগুলো পেরিয়ে যেতে যেতে জাভেদ আহমেদ বাঁ হাতের গোল্ড চেইনে বাঁধানো ঘড়িটা দেখলেন। রাত প্রায় একটা বাজে। আকাশে আস্ত একটা চাঁদ। মাসটা শ্রাবণ মাস। মেঘগুলো দৌড়াচ্ছে চাঁদকে খানিকটা দূরত্বে রেখে।

জাভেদ আহমেদ ঘাটে এসে দেখলেন, একটামাত্র নৌকা বাঁধা সেখানে। তিনি আশা করেছিলেন, আরও কয়েকটা নৌকা বাঁধা থাকবে ঘাটে। তিনি পাড়ে দাঁড়িয়েই একটু জোর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই মাঝি, অনন্তপুর যাবে?’

নৌকার মাঝির গলাটা একটু খনখনে শোনালো। গলায় কেমন মেয়েলী টান। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি তো অনন্তপুর রহমান মৃধার বাড়িতে যাবেন, তাই না?’

জাভেদ আহমেদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি জানলে কীভাবে, তোমাকে ছোট মামা পাঠিয়েছেন?’

নৌকার মাঝি কিছু বলল না। হ্যাঁ বোধক মাথা ঝাঁকাল।

জাভেদ আহমেদ পাড় থেকে নৌকার দিকে নেমে এলেন। ঘাটটা বেশ পিচ্ছিল। তিনি একবার পিছলে পড়তে পড়তে সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। আরেকবার নৌকায় উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ে খুঁটি ধরে ফেললেন। নৌকার মাঝি অবশ্য তাকে এভাবে পড়তে দেখেও সাহায্য করতে এল না।

জাভেদ আহমেদ নৌকায় উঠে প্রথমে একটু মনঃক্ষুণœ হয়ে মাঝির দিকে তাকালেন। তার দৃষ্টি কেমন ভ্রম ঠেকল। নৌকার মাঝিকে দেখতে মেয়ে-মেয়ে লাগছে। তিনি খানিকটা অবাক হয়ে ভাবলেন, তার ছোট মামা কি তাকে নেওয়ার জন্য মেয়ে মাঝি পাঠিয়েছেন? নাকি এটা তার বয়সী চোখ, ভুল দেখছেন? এদিকে নৌকায় কোনো হারিকেন নেই। সাধারণত রাতে নৌকা চালালে খুঁটিতে একটা হারিকেন ঝুলিয়ে রাখা থাকে। মাত্র হাত কয়েক দূরত্ব হলেও শরতের হালকা কুয়াশা মেশানো জ্যোৎস্নার আলোতে মানুষটার চেহারা ঠিক স্পষ্ট হয়ে উঠছে না।

জাভেদ আহমেদ ব্যাপারটা নিয়ে আর গা করলেন না। ব্রিফকেসটা একপাশে রেখে গলুইতেই বসলেন। মাঝি যেহেতু জানে কোথায় যাবে, তাই তিনি আর কথা বাড়ালেন না।

নৌকাটা চলতে শুরু করল।

জাভেদ আহমেদ মাঝির ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিলের জলের দিকে দিঘল দৃষ্টি মেললেন। কিছুক্ষণ বিলের জলের দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার ভেতর থেকে একটা ভারি নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। ভাবলেন, আহা, সেই বরুণার বিল। লোকজন বলত বাইন্যার বিলও। এই বিলে তার কত স্মৃতি! শিশুকাল, কিশোরবেলা, তার যুবক হয়ে ওঠা।

বরুণার বিলে সুদিনে বুক চিতিয়ে উঠলেও বর্ষা বা শরতে নয়নপুর স্টেশন থেকে অনন্তপুর গ্রামে যেতে নৌকাই একমাত্র বাহন ছিল। তিনি ট্রেনে আসতে আসতে ভেবেছিলেন, পঞ্চাশ বছরে নয়নপুর স্টেশন ও অনন্তপুর গ্রামের কতই না পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আদতে নয়নপুর স্টেশনের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। অনন্তপুর গ্রামে এখনও নৌকা চলে।

নৌকাটা বিলের জলে সিঁথি কেটে নয়নপুর ঘাট পেছনে ফেলে হোসেনপুর গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। হোসেনপুর গ্রামের কোনো বাড়িতেই এখন আলো নেই। প্রকৃতির ভরাট জ্যোৎস্নায় প্রতিটি পাড়া কেমন নিস্তব্ধ সবুজ-কালি করে দাঁড়িয়ে আছে।হোসেনপুরের পরই অনন্তপুর। মাত্র দেড় কিলোমিটারের পথ। পঞ্চাশ বছর পর এলেও পথটা তার আজও কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কিছুই বদলায়নি। জলের ওপর মাথা উঁচিয়ে থাকা বোরোধান। সেই ধানক্ষেতের মাঝখানে জলের সিঁথিকাটা পথ। তিন-চারটা বাড়ি নিয়ে এখনও ছোট ছোট পাড়াগুলো দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

জাভেদ আহমেদ নৌকায় ওঠার পর নৌকার মাঝি এতক্ষণ কথা না বললেও এবার খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেমন আছ, জাভেদ?’

জাভেদ আহমেদ চমকে উঠলেন। গা-টাও কেমন কাঁটাকাঁটা দিয়ে উঠল। গলাটা খনখনে শোনালেও কণ্ঠটা কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে। তিনি গলুইতে নড়েচড়ে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি, তুমি কে?’

মাঝি বলল, ‘আমি আলপনা’।

জাভেদ আহমেদ আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলপনা, কোন আলপনা? তুমি আলপনা?’

‘হ্যাঁ, আমি আলপনা। দত্তবাড়ির আলপনা। আলপনা দত্ত’।

‘তুমি বেঁচে আছ?’

আলপনা বলল, ‘আমি তো কখনও মরিনি’।

চার

আলপনা বেঁচে আছে, এটা জাভেদ আহমেদের কাছে বেশ অবাক লাগল। সে কীভাবে বেঁচে আছে? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি, খুব সম্ভব আগস্ট মাসের দিকে সে পাকিস্তানি হানাদারের গুলিতে মারা যায় বলে তিনি জেনেছেন। তিনি অবশ্য নিজচোখে দেখেননি। তাহলে কি আলপনা সেদিন কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিল? হয়তো বেঁচে যেতেও পারে। দেশ স্বাধীনের চারদিন আগেই তো তিনি গ্রাম ছেড়ে পালান। তারপর আর কোনোদিন গ্রামে ফিরেননি। আজ প্রায় পাঁচ দশক পর ফিরছেন।

জাভেদ আহমেদের মনে আরেকটা ব্যাপার ধন্ধ ঠেকছে। এই বায়ান্ন বছর পরও আলপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই কেন? দেখতে সেই একই রকম লাগছে। অবশ্য জ্যোৎস্নার আলোতে তিনি আলপনাকে কতটুকুই বা দেখতে পারছেন? এছাড়া এখন হিসেব করলে আলপনার বয়সও তো সত্তরের মতো হবে। এ বয়সে নৌকা চালিয়ে তাকে নিতে এসেছে!

জাভেদ আহমেদ এসব ভাবতে ভাবতে কোথাও একটু ক্ষয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক তখনই নৌকাটা কোথাও একটা ধাক্কা খেল। তিনি সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখলেন, একটা দ্বীপের মতো স্থানে আলপনা নৌকাটা ভিড়াচ্ছে।

জাভেদ আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা কি চলে এসেছি?’

আলপনা বলল, ‘না’।

‘তাহলে এখানে নৌকা ভিড়ালে যে?’

‘তোমাকে জায়গাটা দেখানোর জন্য’।

‘আমাকে দেখানোর জন্য? এটা কার জায়গা?

‘এটা আমার জায়গা। এখানে আমি বসবাস করি। তুমি চিনতে পারছ না?’

জাভেদ আহমেদ এদিকওদিক তাকালেন। দেখলেন, বটগাছের মতো দেখতে বৃহৎ একটি গাছ। জ্যোৎস্নার আলোতে গাছটির তল ধূপছায়া অন্ধকার হয়ে আছে। একটি ছোট্ট শনের ঘর আছে গাছটির নিচে।

আলপনা নিজ থেকে বলল, ‘এটা পুনোয়ারার বটগাছ’।

জাভেদ আহমেদ স্থানটিকে এবার সহজেই চিনতে পারলেন। হোসেনপুর ও অনন্তপুর গ্রামের মাঝখানে বরুণার বিলের পেট বের করা এই ছোট্ট দ্বীপের মতো স্থানটায় একসময় মেলা বসত। পুনোয়ারার মেলা। স্থানটার নামেই মেলাটির নাম ছিল। কিন্তু তার এটা ভেবে আশ্চর্য ঠেকল, এতগুলো বছর পরও এই স্থানটার কোনো পরিবর্তন নেই কেন? সেই বটগাছ। সেই ছোট্ট কুড়েঘর। এই কুড়েঘরটায় তো একসময় একটা পাগল বসবাস করত। মফিজ পাগলা। বিলের জল সাঁতরে এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে চেয়ে খেত। একাত্তর সালে পাকিস্তান আর্মিরা বিনাকারণেই তাকে মেরে ফেলে।

জাভেদ আহমেদ বুঝতে পারলেন না, আলপনা তাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে? আর সে এখানে, মফিজ পাগলার ফেলে রাখা এই কুঁড়েঘরেইবা বসবাস করছে কেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলপনা, তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ কেন?’

আলপনা গম্ভীর গলায় বলল, ‘প্রতিশোধ নিবো বলে!’

জাভেদ আহমেদ নৌকায় ওঠার পর থেকেই কেমন ভয় পাচ্ছিলেন। পুরো পরিবেশটায় গা ছমছম করছিল। যদিও তিনি যুক্তিনির্ভর মানুষ। প্রকৃতির অস্বাভাবিক কিছু তেমন বিশ্বাস করেন না। কিন্তু নৌকায় আলপনার উপস্থিতি, এখন আলপনার এমন গম্ভীর গলা, তিনি সত্যি এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলপনা, তুমি এসব কী বলছ?’

আলপনা বলল, ‘আমি ঠিকই বলছি। এতদিন তোমার আসার অপেক্ষায় ছিলাম’।

জাভেদ আহমেদ আরও ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘কী অপেক্ষায় ছিলে?’

‘তোমাকে মারার জন্য। ঠিক এই স্থানটায়’।

‘ধ্যাৎ, বাজে বকো নাতো!’

‘বাজে নয়, ঠিকই বলছি। কারণ, তুমি দানব। শুধু দানব বললে ভুল হবে। তুমি নরপিশাচ। পাকিস্তান আর্মিরা যখন আমার বৃদ্ধ মা-বাবাকে মেরে ফেলে, কাকাকে ধরে নিয়ে যায়, তখন আমি বাড়ির পেছন থেকে কোনোমতে পালিয়ে বিলের জলে সাঁতরে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তুমি আশ্রয় দিয়েছিলে ঠিকই, কিন্তু মাস খানেক পর তুমি নিজেই আমাকে মিথ্যে কথা বলে পাকিস্তানি এক মেজরের হাতে তুলে দিয়েছিলে। মেজর দুইদিন রেখে তার জওয়ানদের হাতে আমাকে ছেড়ে দেয়। তারপর প্রতিরাতে জওয়ানরা চার-পাঁচজন করে আমার শরীরে নির্যাতন চালায়। কতবার যে মরতে মরতে বেঁচে গেছি! জাভেদ, তুমি সেদিন সেটা কী করেছিলে? কেন করেছিলে? আমি না তোমাকে ভালোবাসতাম?’

জাভেদ আহমেদ কিছু বললেন না। আসলে তিনি কিছু বলতে পারলেন না। এটা তো সত্য আলপনা দত্তকে তিনি পাকিস্তানি মেজরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি মেজরের শখ ছিল হিন্দু মেয়ে ভোগ করবে। বলেছিল, হিন্দু মেয়ে ভোগ করলে পাপ হয় না। তখন হোসেনপুর, অনন্তপুর বা গোপালপুরে কোনো হিন্দু ছিল না। সবাই ত্রিপুরা বর্ডার দিয়ে ভারতে পালিয়েছিল। যারা মাটি কামড়ে থাকবে বলে ভেবেছিল, তাদেরকেও মেরে ফেলা হয়েছিল। হাতের কাছে ছিল আলপনা। তাদের বাড়িতে আশ্রিতা।

জাভেদ আহমেদ অবশ্য প্রথমে এমনটা চাননি। আলপনাকে তিনি সত্যি ভালোবাসতেন। অনন্তপুর গ্রামের এ পাড়া আর ও পাড়া। আলপনার বাবা অশীত দত্ত তাদের গোপালপুর স্কুলের বাংলার শিক্ষক ছিলেন। তিনি তাকে স্কুলে ও কলেজে লেখাপড়ায় বেশ আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন।

জাভেদ আহমেদ অবশ্য ভালোবাসার চেয়ে অবলম্বনটাকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। তিনি আলপনাকে বরাবর অবলম্বন হিসেবেই দেখতেন, যা তিনি বাকি জীবনে অন্যদের ওপরও দেখে এসেছেন। তারপরও...! সেদিন যত ঝামেলাটা বাঁধায় আক্কাস আলী। হোসেনপুর, অনন্তপুর ও গোপালপুরের রাজাকারের কমান্ডার ছিল। জাভেদ আহমেদের বন্ধু ছিল।

জাভেদ আহমেদ সেদিন নিজেকে বাঁচাতে আলপনাকে পাকিস্তানি মেজরের হাতে তুলে দেন। পরে সেই পাকিস্তানি মেজর অবশ্য আক্কাস আলীকে সরিয়ে তাকে এ এলাকার রাজাকারের কমান্ডার বানায়। তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ বলে সেই মেজর তাকে আশ্বাস দেয়, যুদ্ধ শেষ হলে তাকে সেনাবাহিনির কমিশন দেওয়ার সব ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সেটা তো আর হয়নি। মুক্তিবাহিনীরা দেশ স্বাধীন করে ফেলে।

জাভেদ আহমেদকে চুপ হয়ে যেতে দেখে আলপনা এবার ভারি গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে ঠিক এ স্থানটায় মারতে চাই। কারণ, পাকিস্তান হানাদাররা এ এলাকা থেকে চলে যাবার আগে নৌকায় ভরে একুশজনকে এখানটায়, এই বটগাছটার নিচে গুলি করে মেরেছিল। আমি গুলি খেয়েও বাঁচার জন্য বিলের জলের দিকে দৌড় দিয়েছিলাম। তখন তোমার বন্ধু আক্কাস আলী আমাকে চুলের মুঠি ধরে চুবিয়ে ধরে। চুলের মুঠি ধরে একবার তোলে। আমি ফোঁস করে শ্বাস নেই। আবার জলের ভেতর ঠেসে ধরে...’।

জাভেদ আহমেদ অবলম্বনহীন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর?’

আলপনা বলল, ‘তারপর আর কিছু নেই। এখন তোমাকে সেই বিলের জলে চুবিয়ে মারতে এসেছি। এটাই আমার প্রতিশোধ, একমাত্র প্রতিশোধ। এ জন্যই আমি এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম’।

জাভেদ আহমেদ মিনমিন গলায় বললেন, ‘আমি তো তোমাকে মারিনি’।

আলপনা বিকট চেহারা বানিয়ে চিৎকার করে খনখনে গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে তিলে তিলে মেরেছ’।

পাঁচ

ভোরের দিকে অনন্তপুর গ্রামের সীমানার রহমত আলী ছোট্ট একটা নৌকায় বরুণার বিলে পাতা জাল তুলতে এল।

উত্তরের উজানের জল বাড়লে বরাবরই রহমত আলী একটা ছোট্ট নৌকায় করে বরুণার বিলের এদিকওদিক খাঁড়াজাল পাতে। সন্ধ্যায় জাল পেতে ভোরে দিকে তোলে। মানুষের বাড়িতে কামলা দেওয়ার পাশাপাশি পাতা জালে ধরা মাছ আড়ংয়ে বিক্রি করে সে সংসার চালায়।

রহমত আলী আজ ভোরে খাঁড়াজাল তুলতে এসে অবাক হয়ে দেখল, একটা নৌকা পুনোয়ারার বটগাছটার কাছাকাছি জলে ভাসছে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। সে প্রথমে ভাবল, হয়তো কোনো বাড়ির নৌকা খুঁটি থেকে খুলে গিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছে। সে সেই নৌকাটার দিকে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি এসেই তার চোখ বড় হয়ে গেল। সে দেখল, এক স্যুট পরা ভদ্রলোক নৌকার ঠিক মাঝখানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ভদ্রলোকের সমস্ত শরীর ভেজা। নৌকাটা যেন দুলছে একটু বেসামালভাবেই।

back to top