অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ
আছিয়ারা মরে নাই
আসাদ মান্নান
লক্ষণ মোটেই ভালো নয়- চারিদিকে শুধু
ভয় আর ঘনঘোর আতঙ্কের বীভৎসিত ছায়া;
অবাক হবার মতো তেমন কিছুই ঘটছে না,
বরং এটাই স্বাভাবিক; কেননা মানুষ নামে
যারা পরিচিত তারা কিন্তু জীব নয়- শুধু জন্তু,
জন্তু ছাড়া অন্য কিছু ইদানীং চোখেই পড়ে না।
মিশন সমাপ্ত হলে সারি সারি নিহত গোলাপ
রক্তমাখা মেঘ হয়ে উড়ে যাচ্ছে ফ্যাকাশে জ্যোৎস্নায়-
হিমাগারে অন্ধকার; কতিপয় হিং¯্র জানোয়ার
অবুঝ শিশুকে নিয়ে এ কেমন অশ্লীল নেশায়
মেতে ওঠে! কে দেবে উত্তর? গ-ারের চামড়া গায়ে
সভ্যতার সুশীল বাবুরা চোখ কান বন্ধ করে
মিডিয়া সেলুনে বসে পরম আনন্দে পা দুলিয়ে
তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে; আর লোম কামানোর ক্ষুরে
গোপন বাসনা বুকে ধার দিচ্ছে নাপিত মশায়।
হাটে ঘাটে দেখা যাচ্ছে গোবেচারা বণিক বেনিয়া
যদিও আগের মতো খোস মনে খুব ভালো নেই,
তবু তার কায়-কারবার ঠিকঠাক বেশ চলছে:
নিজস্ব নিয়মে নিত্যদিন সূর্য ওঠে- সূর্য ডুবছে;
যদি ভয় সর্বত্রই সারাক্ষণ ওঁৎ পেতে রয়
তবে, আল্লাহ মালুম গরিবের কী আছে কপালে!
আসন্ন মৃত্যুর গন্ধে ঝরে যাচ্ছে পলাশের কুঁড়ি-
মলিন বদনে আমাদের হতভাগী মা জননী
চোর-ডাকাতের পাশাপাশি বর্ণচোরা খুনি আর
ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে আজ নামে রাজপথে-
নিজের শিশুর জন্য সুরক্ষার মহল বানাতে
নিষ্ফলপ্রহর গুনতে গুনতে তার চোখে ঘুম নেই।
রমজানের ঈদ আসে রক্তে ভেজা চাঁদের বেদীতে;
ঈদের জ্বলন্ত চাঁদ পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে-
ভস্মীভূত ছাইয়ে মোড়া খুকুমণি আছিয়ার লাশ-
এ লাশ কবরে নেই, শুয়ে আছে প্রাণের কেল্লায়:
আছিয়ারা মরে নাই অভিমানে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমার কী বলার আছে
আবদুর রাজ্জাক
সে বলে: বাবা তুমিই বুকে হাত দিয়ে বলো ‘আমার স্বাধীনতা কে
করেছে হরণ! আমার ভেতরে কী একটা ভয় যেন প্রবেশ করেছে!’
আমি বলতে পারি না তাকে কীভাবে তার স্বাধীনতা বিনষ্ট হলো!
কীভাবে তার ভেতরে ভয়ের সঞ্চার হলো- কীভাবে তার
অবাধ স্বাধীনতা অন্তর্হীত হলো।
এখন সে শুধু ঘরেই থাকে,
থেকে থেকে মনে হয়, অগ্নিঝরা এই মার্চ বুঝি- আমার স্বাধীনতার
মার্চ নয়। রুক্ষ নিষ্ঠুর একটি প্রবল মাস।
বর্ধিত দেশ
শামীম আজাদ
হাঁটতে হাঁটতে হাঁপাচ্ছে সময়
সামর্থ্য কমে শুঁটকি হয়ে গেছে
তবু দুর্গতি দলবো বলে
কখনো উচ্ছিষ্ট, কখনো অবশিষ্ট দিয়ে
পুনরায় গড়ে নিচ্ছি আমায়।
সেই কবে থেকে সময়ের খোলে
মঁ মঁ কাঁঠালের সুবাস পেরিয়ে
এপিং বনের বাজুবন্দ-বন্দিশে,
দানিয়ুব দংশনে, এ্যাম্বার
অ্যাক্রোপোলিসের আলোয়
কোমরে ও কাঁখে হাত ডুবিয়ে
কবিতার কনকে ছাপ দিয়ে চলেছি!
যেন কোনো একদিন কেউ এসে বলবে,
‘এ গভীর অনন্তে শামীম,
যখন দুঃখের দরিয়ার দেয়াল ধরে
কোনোক্রমে পিঁপড়ে হয়ে লটকে ছিলে
তুমি একা ছিলে না,
ছিলো তোমার দাউ দাউ দেশ।
সে তোমারই মেরুদ-ের শূন্যস্থানে আছে,
থাকবে বর্ধিত-বাংলাদেশের অবশেষ।
জংশন
খোরশেদ বাহার
একবার ট্রেনে উঠতেই
গন্তব্য হারিয়ে যায়
মেঘেঢাকা পাহাড়ের দেশ
পড়ন্ত বিকেলের রংধনু
লোকারণ্যে কত না শিহরন ছিল
ছিল স্বপ্নময় মানুষের ভিড়
সাথে রং-বেরঙের সংসারী ফানুস
এইসব নিয়ে গন্তব্য উধাও।
তারপর ডাকে সবুজ ঘাস, ফিরে আসি সমতলে
নদী নালা খাল বিল আর প্রকৃতির কোলে।
এখানে কদাচিৎ রংধনু দেখা যায়
তবে রঙের সে বাহার নেই, নেই জীবনের জৌলুস
আটপৌরে জীবনের নিরন্তর পাঁচালি।
আবারও তাই জংশনের খোঁজে
দুই পাহাড়ের নিচে যে হ্রদ
যেখানে ঝরনাধারায় প্লাবন বয়
রং-বেরঙের মাছেরা সাঁতার কাটে নিরুপদ্রব
সেই গন্তব্যের নেশায়
অবেলায় বসে আছি এই জংশনে।
ইঞ্জিনের শব্দকে অবিশ^াসী মনে হয়
কুয়াশা ভেদ করে আসছে যে ট্রেন
সবুজ বৃক্ষরাজির উন্মুক্ত টানেলে,
তার শব্দকে বড় ভুল মনে হয়
আবারও বুঝি ভুল ট্রেনের হুইস্ল শোনা যায়।
গর্তজীবী
চয়ন শায়েরী
নিজ-আঙুলের ছাপদোষে
নিজকণ্ঠের তাল-লয়ে ঘা মেরে
ক্রোমোজমের সুতো বেয়ে বেয়ে কোনো-একদিন
চেহারায় পিতা-মাতার ছাপছবি কাটছাঁট করে
জগৎসংসারে
এসে দেখি আমার আগেই কলোনি গড়ে তুলেছিল যারা
পৃথিবীর উদ্বর্তনের পথে
সভ্যতার বিবর্তনের পথে
আদিম সেই সায়ানোব্যাকটেরিয়ার বংশধরেরা
আমার চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে
কখন জানি আমাকে একটা নিজগন্ধও উপহার দিয়েছে
অযাচিত অনুগ্রহে
আমাকে সহজে শনাক্ত করবার জন্য;
কখনো-বা সন্দেহ হলে গন্ধ শুঁকে
কণ্ঠে কথানামাদের কত্থক নাচের ধরন দেখে
চেহারার চেকনাই চেক করে
আঙুলের ছাপ সেলুলারফোন বেপারীদের জাদুঘর থেকে নিয়ে
কিংবা ক্রোমোজমের কেরদানি ফাঁস করে দিয়ে
আমাকে যেন আন্দামান পাঠানো যায়;
আমাকে ফাঁসানোর ব্যবস্থাসব দেখে
আমি নিজে নিজেকে করছি আলাদা
কুনোব্যাঙের মতো ঘরকুনো হয়ে
সামসময়িক বুদ্ধিজীবীদের মতো গর্তজীবী হয়ে
ওজোন স্তর যে-ভাবে কালো আকাশ আড়ালে রাখে দিনে
দিন দিন কায়দা শিখছি
কীভাবে দেখেও না-দেখার ভান করা যায়
রাজনীতিক ভণিতায়
গাম্ভীর্য বজায় রেখে চেহারায়;
কেউ যেন আমাকে ধরতে না-পারে
আঙুলের ছাপে
চেহারার মাপে;
নন্দনতত্ত্ব মাখানো মন ভোলানো কবিতায় বেঁচে আছি
গর্তজীবী হয়ে
চেতনাবিরোধী চেতনায়।
চতুষ্পদী কবিতা
হাইকেল হাশমী
বন্দি
মনে হয় স্বপ্ন আর সৌরভ
দুটি একেবারেই স্বাধীন,
আমার স্বপ্ন, তোমার সুগন্ধি
তাদেরকে করা যায় না বন্দি।
চূর্ণ স্বপ্ন
ঘুমন্ত চোখ রাতে স্বপ্ন দেখে
ভোরে তা বিলীন হয়ে যায়,
বুকে থাকা কাঁচের মতো বাসনা
নিঃশ্বাস নিলে চূর্ণ হয়ে যায়।
ভোলা মন
তুমি হাসলে উজ্জ্বল আলো
চুপ থাকলে তিমির আঁধার,
কিসের দুঃখ, কেমন দুঃখ
কী বল? মনে নেই আমার।
সুপ্ত ইচ্ছে
আমাদের সুপ্ত ইচ্ছের বৃষ্টিতে
চলো আমরা সিক্ত হয়ে যাই,
দেহের পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে
চলো আত্মার তলে নেমে যাই।
মুক্তির কবিতা
মাহফুজ আল-হোসেন
এলোপাতাড়ি বিনির্দেশে বুদ্ধি-ভৃত্যকে বলতেই পারো ঝটপট এক মুক্তির কবিতা লিখে দিতে;
অথচ তার সাংখ্যিক জালে আটকানো কিম্ভূত কচ্ছপ মূহূর্তেই বদলে যাচ্ছে মৎস্যকুমারীতে!
আর মীন দর্শনের নীলচে-বেগুনি যুক্তিগুলো ডুবেও ভেসে আছে টোপাপানার উপরিভাগে;
ভ্রƒক্ষেপহীন জলাশয়ের অনতি উপরে উড্ডীন মাছরাঙাও জানে শিকার নিঃশ্বাসের দূরত্বে।
জানিনা, বেভুল মুদ্রায় নৃত্যপর ভেককুল আজ কোন চিঠি লিখে চলেছে মেঘদূত সমীপে...
শূন্যতার সীমানা
হাসানাত লোকমান
দেশের সীমানা খোঁজে না চোখের পথ,
অদৃশ্য লাইনগুলো গায় মৃত্যুর গান।
মাটি আর আকাশের মাঝে হারিয়ে যায় স্বপ্ন,
চোখের সামনে ধুলো, কোথাও নেই মানবতা।
গাছের শাখায় ঝুলে থাকে সময়ের ছায়া,
পাখিরা একে অপরকে ভুলে যায়।
যেখানে নদী আর সমুদ্র মিলতে চায়,
পথ হারিয়ে যায় সেখানে ইতিহাস।
তবু দূরে, কোনো এক বুনো হাওয়া
হঠাৎই বাজিয়ে তোলে এক অজানা সুর-
একটি আশার গান, এক অনন্ত আলো,
যা ছিন্ন করে দেয় শূন্যতার সীমানা!
কার্নিশে পাঁচটি শালিক
মাসুদার রহমান
কে কবি কে কবি নয়- এই নিয়ে ছাদের কার্নিশে
জটলা করছে পাঁচটি শালিক
তারপর একজোড়া উড়ে যায় পার্লামেন্ট ভবনে
একজোড়া গিয়ে নামে
মন্ত্রী পাড়ায়, খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে ক্ষমতার দানা
বাকি যে শালিক কার্নিশে তখনো চুপচুপ
এবং একাকী
আসন্ন সন্ধ্যায় যখন সে পাখনা মেললো
পালকে আলো ফেললো নক্ষত্র ও গোধূলি
জীবনেই জীবনের
দুলাল সরকার
ভালো ভালো প্রত্যুষের জন্ম দেয় সূর্য
দিগন্ত উজার করে হাসে, মাটির উঠান
শিউলির যোগ্য হয়ে উঠে, সে জানে
বখাটে ভোরের জন্ম হলে সে তার নির্মল
শুদ্ধতা হারাবে; আলটে দূর্বার প্রচ্ছদে
লটকে থাকা ফোঁটা ফোঁটা শিশির দেখে
আর কোনো সুসন্তান জন্ম নেবে না,
অংকুরিত হবেনা সুস্থ সবল অনুভূতির;
যাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ আয়ত্ত করবে
সামুদ্রিক ঐক্যের প্রতিভা, সূর্যের মুখোমুখি
সটান দাঁড়িয়ে বলবে গাঙ্গেয় এই দ্বীপে
মানবানুশীলনে ব্যাকুল হবেই- জীবনেই
জীবনের পুনর্জন্ম হয়ে স্বেচ্ছাতারিতার
চিরাবসান হবেই- তুমি দেখে নিও।
আমাদের যুদ্ধদিন
কামরুল ইসলাম
অগ্রন্থিত হাড়গোড় নিয়ে তোমার ছায়া
উদিত হয় লাস্যময় শহরে
বঁড়শিতে গাঁথা মাছের যন্ত্রণার পাশে
কাশফুল সন্ধ্যা নামিয়ে চলে যায়
দাঁতের ব্যথা নিয়েও আমি
রাতের অন্ধকারে কামিনীর গন্ধ পাই
কারা যেন মই বেয়ে আকাশে উঠছে
আর তুমি বাজিয়ে যাচ্ছ দূরের কান্নায়
ধূসর হয়ে আসা পুরনো বেহালা
তুর পাহাড়ের ছাই দিয়ে
চোখের কোণে ঝাপসা মেঘ এঁকে বলছো-
এ-ই আমার নিজস্ব সমুদ্র
এখানে নোঙ্গর গেড়ে যে সব ইস্টিমার
রেখে গেছে স্রোতের কাহিনী
তারাই সাক্ষী আমার নিঃশব্দ সাঁতারের
রাতের সাঁকোটি আমজনতার গুঞ্জনে
বেঁকে যায়
আমার তাকানোগুলো কেঁপে ওঠে
পুরনো সাইরেনের শব্দে
দূরে মায়া হরিণীরা ছিঁড়ছে কলিজা
আমাদের যুদ্ধদিন ভাঙা পাল্কির নিচে ঘুমোয়...
পথ ও পথিক
ইকবাল হোসেন বুলবুল
পথেরা পথের মতো পথের ভিতর
পথেরা নিজের মতো নিজের ভিতর
পথেরা কাউকে দেয় না ওয়াদা
কাউকে দেখার জন্যে অথবা ছোঁয়ার জন্যে হয় না পাগল
অপেক্ষা থাকে না তার- বলার, শোনার
বাড়ি যাবো, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো শব্দগুলো পথেরা চেনে না
বাড়িহারা, দেশহারা, খেশহারা শব্দগুচ্ছ তাকে ভাবায় না
পথের দেয়ালে, পথের পকেটে, কোনো ঘড়ি নেই
ক্যালেন্ডার নেই
দিন রাত নেই
ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, নিদ্রাহীন কোনো কষ্ট নেই
পথেরা হয় না অশ্রুশিক্ত
পথিকেরা হয়
ছোটগল্পের শেষবাক্য
রকিবুল হাসান
সবুজ জমিনে উৎসব-রঙে বিষের পেয়ালা
অবিশ্বাসের বৈশাখ উড়ছে ঈশানে
তবু কোনো অভিযোগ নেই
প্রতিদিন লেখা হচ্ছে হরণের কাব্য-উপন্যাস
জীবনপাতা ছিঁড়ছে যতদূর ইচ্ছে
যেখানে যেমন ইচ্ছে।
তুমি তো ভালোই জানো এ কেমন বিষ
ধরে আছ তুমিও তো জিদের রূপশ্রী
পাঠ করে যাচ্ছ মনগড়া স্বরলিপি
লালন-হাছন নেই তাতে
নেই সেই পলিমাটিও এখন
এ যেন ছোটগল্পের শেষবাক্য ঝুলছে ঈশানে।
তবু যেও কোনোদিন
মো. আশফাকুল ইসলাম
তবু যেও কোনোদিন
প্রিয় কারু সঙ্গে
পদ্মার সেই চরে...
দেখবে পদ্মায় সোনালি জরির রোদ্দুর
কীভাবে গড়িয়ে পড়ে
আর রুপালি চাঁদ ওঠে
স্বপ্নের প্লাবন নিয়ে!
যদি পারো যেও কারু সঙ্গে...
পদ্মার এই চরে নেই কোথাও মানুষ
আছে শুধু শেয়ালের ডাকের সান্ধ্য ধ্রুপদী
শুনতে যদি চাও
এসো এখানে কোনো একদিন
প্রিয় কারু সঙ্গে...
যদি নাও মনে পড়ে আমাকে
তবু যেও একটিবার
দেখে এসো পদ্মায়
কীভাবে ভাসে চাঁদ-
কী অপরূপ রূপময়তায়!
অপেক্ষা করো না আর
এসো শুধু একবার
কোনো একদিন কারু সঙ্গে...!
আজ অমিলকে
দিলীপ কির্ত্তুনিয়া
আজ অমিলকে আমরা শত্রুর জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি
আজ বৈচিত্র্যকে আমরা নির্বাসনে পাঠাচ্ছি
তোমার কথা আমার কথা মিলবে না
তাই বলে আমরা কবিতা লিখবো না?
স্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি না
স্বকীয়তা থাকবে না বুঝি!
কেউ আমরা কারোর মতন হবো না
কেন হবো- ষড়ঋতুর এই বর্নিল দেশে!
বসন্ত আমার ভাল লাগে না- শরত ভাল লাগে।
তুমি এসে বলবে- এটা করতে হবে
তা তো হয় না ভাই-
ও আমার রাঙা ভাই কথা পাল্টাও।
আমাকে ছবি আঁকতে দাও- তুমি গান গাও।
শুধু লাল সুন্দর নয়- হলুদও সুন্দর
সবুজ এসে বলে আমিও
সকল রঙ সুন্দর- সবার কথা ভাবিও।
চিত্তদাহ
আদিত্য নজরুল
খিদে কোলে নিয়ে বসে আছেন যে মা
আমি তারই সন্তান
ধর্ষিত যে বোনটি-
সিথানে মৃত্যু নিয়ে বসে আছে
আমি তার ভাই...
চিবুক পিছলে
ঝর্নার মতোই
কান্না বয়ে যাচ্ছে যে ছেলেটির
আমি তার সহোদর!
যে মেয়েটি
ফুলের সুঘ্রাণের মতোই
গোপন রাখতে
পারছেনা কান্না
আমি তার অসহায় পিতা;
এই দু-হাত
তুলেছি প্রভু জালিমের বিরুদ্ধে
মেয়েটি
লুৎফুন নাহার লোপা
শৈশব পেরোনোর আগেই
মেয়েটির আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লো উঠোনে।
তার শরীরজুড়ে স্নিগ্ধ সবুজের বদলে
বেড়ে উঠলো রাজ্যের অন্ধকার।
জানা গেলো বুনো শুয়োরের দল
কেড়ে নিয়ে গেছে তার চিরকালের বসন্ত।
কেউ কেউ খোঁজ নিতে গেল সেদিকে,
কেউবা তাকালো নিজ কন্যার দিকে,
কেউবা এক বুক শূন্যতা নিয়ে
ঢুকে গেলো সেই কান্নার ভেতর।
তারপর দিনশেষে ঘুমন্ত উদ্যানে
হয়ে গেলো সত্য মিথ্যের চালাচালি।
নিজের সকল সত্তা স্বাধীনতা ভেঙে
ধীরে ধীরে,
আমরা আবারও ভুলে গেলাম
বসন্তের রাতে মেয়েটি কেঁদেছিল যেভাবে।
স্বাধীনতা আমার
আদ্যনাথ ঘোষ
তুমি যখন আলোর শরীর থেকে
আরো আলোর অনন্য ডানাগুলো
একটু একটু করে খুলে ফেলেছিলে;
আড়াল সরে গিয়ে আরো আড়ালের ভেতর থেকে
আরও আলোর ফিনকি সবুজ ফসলের মাঠে
উদ্দাম বাতাসের কোলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আমি তখন উদ্বেলিত হাওয়ায়
আকাশের আলোকিত মঞ্চ ও
সবুজ ফসলের তৃষ্ণার্ত বাগানজুড়ে
বাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমার প্রত্যাশিত দুটি হাত।
তখন তুমি অন্ধকারের কোলাহল ভেঙে
সবুজ ফসলের ঝলকিত উৎসবে
অবারিত সুখ নিয়ে আছড়ে পড়েছিলে
আমাদের চোখ ও মুখের খোলা জানালায়।
তবু কেন আমার অন্তর আজ খুঁজে ফেরে তোমার পরাণ!
দড়ি
ফারুক আফিনদী
তোমাকে
চৈত্রের আমের ডালে
দুলুনি বানিয়ে ঝুুলে থাকি
দড়ি ধরে-
মোলায়েম। বাদামি দড়ি-
নরম। ঘিআভ-
মোহন ও সম্মোহনি
গন্ধ লেগে আছে
গন্ধ আছে লেগে
পাতা ও ঘিয়ের
ছায়া, মায়া-
হয়ে চলে
মাথার ওপরে-
সদা। সদা দড়ি-
ভূখণ্ড ও স্বাধীনতা
চামেলী বসু
শূন্য গুনে যেটুকু সমাধান
সমতার চিহ্ন ঘিরে প্রখর বাহানা-
সীমিত মুখাগ্নি শেষে উড়–ক এবার মিলিত ডানা
এই জন্মেই ঘুচে যাক বিভেদরেখা।
এই মৃত্যু মিছিল থেকে উঠে এসো মুষ্টিবদ্ধ হাত
দীপ্ত কণ্ঠে তোল বিদীর্ণ আওয়াজ-
কেবল ভূখ-ের স্বাধীনতা নয়
স্বাধীন হোক জীবিত মানুষের মৃত আত্মা!
অস্তিত্ব
চরু হক
দিখ-িত করেছো তুমি আমাকে বারবার
আমি জেনে যাই আমি বুঝে যাই এই অসার সংসার
আমি খুঁজছি তোমাকে পথে প্রান্তরে খুঁজছি মনের ভিড়ে
প্রিয় তোমার নামটি বুকে ধরে আমি পুড়ে হই অঙ্গার।
মৌলিক অধিকার
তানজীনা ফেরদৌস
বিড়ালপাড়ায় মহা সমাবেশ- মিছিল আর মিটিং
শিকারে ব্যর্থ বিড়ালগুলো কষ্টে কুপোকাত,
যারা মূলত মাছপাগল-
মাছের লোভকে ঢোক গিলে ঢেকে রেখে
মিটিংয়ের একমাত্র বিষয় হয়ে এলো ইঁদুর।
সিদ্ধান্ত- যে মাপের আর প্রজাতির
ইঁদুর শিকার হোক না কেন,
সব নিয়ে হাজিরা হবে হুলো বিড়ালের সমীপে
তিনিই রাখেন স্বাদ নেয়ার অধিকার সবার আগে...
ইঁদুরের স্বাদে মত্ত বিড়াল ভুলে যায়
মহাকালে আঁটকে পড়া রাতগুলো কেটে গেলে-
ঠিকই দিন আসবে বিড়ালপাড়ায়।
আর সেদিন সংবিধানে সংযুক্ত হবে ইঁদুর আর বিড়ালের
মৌলিক অধিকার।
পানতুম
রোখসানা ইয়াসমিন মণি
যেতে চায় না মন যে আমার এই পৃথিবী ছেড়ে
চারিদিকে দেখি শুধু রৌদ্র জলের খেলা,
বসে থাকি মুনির মতো বিষম যজ্ঞাগারে
বুকের ভেতর দস্যু খেলে মায়ার লীলাখেলা।
চারিদিকে দেখি শুধু রৌদ্রজলের খেলা
লাজুক গল্পের শিশিরকণা যজ্ঞের মন্ত্র পড়ে,
বুকের ভেতর দস্যু খেলে মায়ার লীলাখেলা
কয়েক ফোঁটা আমার ধ্যানে পাতার মতো ঝরে।
লাজুক গল্পের শিশিরকণা যজ্ঞের মন্ত্র পড়ে
রত্নাকরের তপস্যাতে করে লুটোপুটি,
কয়েকফোঁটা আমার ধ্যানে পাতার মতো ঝরে
তাইযে অসীম মায়ার জগত দেয়নি আমায় ছুটি।
রত্নাকরের তপস্যাতে করে লুটোপুটি
সাধের জীবন পৃথিবীতে শুধুই ঘুরেফিরে,
তাই যে অসীম মায়ার জগত দেয়নি আমায় ছুটি
যেতে চায় না মন যে আমার এই পৃথিবী ছেড়ে।
অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ
বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫
আছিয়ারা মরে নাই
আসাদ মান্নান
লক্ষণ মোটেই ভালো নয়- চারিদিকে শুধু
ভয় আর ঘনঘোর আতঙ্কের বীভৎসিত ছায়া;
অবাক হবার মতো তেমন কিছুই ঘটছে না,
বরং এটাই স্বাভাবিক; কেননা মানুষ নামে
যারা পরিচিত তারা কিন্তু জীব নয়- শুধু জন্তু,
জন্তু ছাড়া অন্য কিছু ইদানীং চোখেই পড়ে না।
মিশন সমাপ্ত হলে সারি সারি নিহত গোলাপ
রক্তমাখা মেঘ হয়ে উড়ে যাচ্ছে ফ্যাকাশে জ্যোৎস্নায়-
হিমাগারে অন্ধকার; কতিপয় হিং¯্র জানোয়ার
অবুঝ শিশুকে নিয়ে এ কেমন অশ্লীল নেশায়
মেতে ওঠে! কে দেবে উত্তর? গ-ারের চামড়া গায়ে
সভ্যতার সুশীল বাবুরা চোখ কান বন্ধ করে
মিডিয়া সেলুনে বসে পরম আনন্দে পা দুলিয়ে
তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে; আর লোম কামানোর ক্ষুরে
গোপন বাসনা বুকে ধার দিচ্ছে নাপিত মশায়।
হাটে ঘাটে দেখা যাচ্ছে গোবেচারা বণিক বেনিয়া
যদিও আগের মতো খোস মনে খুব ভালো নেই,
তবু তার কায়-কারবার ঠিকঠাক বেশ চলছে:
নিজস্ব নিয়মে নিত্যদিন সূর্য ওঠে- সূর্য ডুবছে;
যদি ভয় সর্বত্রই সারাক্ষণ ওঁৎ পেতে রয়
তবে, আল্লাহ মালুম গরিবের কী আছে কপালে!
আসন্ন মৃত্যুর গন্ধে ঝরে যাচ্ছে পলাশের কুঁড়ি-
মলিন বদনে আমাদের হতভাগী মা জননী
চোর-ডাকাতের পাশাপাশি বর্ণচোরা খুনি আর
ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে আজ নামে রাজপথে-
নিজের শিশুর জন্য সুরক্ষার মহল বানাতে
নিষ্ফলপ্রহর গুনতে গুনতে তার চোখে ঘুম নেই।
রমজানের ঈদ আসে রক্তে ভেজা চাঁদের বেদীতে;
ঈদের জ্বলন্ত চাঁদ পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে-
ভস্মীভূত ছাইয়ে মোড়া খুকুমণি আছিয়ার লাশ-
এ লাশ কবরে নেই, শুয়ে আছে প্রাণের কেল্লায়:
আছিয়ারা মরে নাই অভিমানে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমার কী বলার আছে
আবদুর রাজ্জাক
সে বলে: বাবা তুমিই বুকে হাত দিয়ে বলো ‘আমার স্বাধীনতা কে
করেছে হরণ! আমার ভেতরে কী একটা ভয় যেন প্রবেশ করেছে!’
আমি বলতে পারি না তাকে কীভাবে তার স্বাধীনতা বিনষ্ট হলো!
কীভাবে তার ভেতরে ভয়ের সঞ্চার হলো- কীভাবে তার
অবাধ স্বাধীনতা অন্তর্হীত হলো।
এখন সে শুধু ঘরেই থাকে,
থেকে থেকে মনে হয়, অগ্নিঝরা এই মার্চ বুঝি- আমার স্বাধীনতার
মার্চ নয়। রুক্ষ নিষ্ঠুর একটি প্রবল মাস।
বর্ধিত দেশ
শামীম আজাদ
হাঁটতে হাঁটতে হাঁপাচ্ছে সময়
সামর্থ্য কমে শুঁটকি হয়ে গেছে
তবু দুর্গতি দলবো বলে
কখনো উচ্ছিষ্ট, কখনো অবশিষ্ট দিয়ে
পুনরায় গড়ে নিচ্ছি আমায়।
সেই কবে থেকে সময়ের খোলে
মঁ মঁ কাঁঠালের সুবাস পেরিয়ে
এপিং বনের বাজুবন্দ-বন্দিশে,
দানিয়ুব দংশনে, এ্যাম্বার
অ্যাক্রোপোলিসের আলোয়
কোমরে ও কাঁখে হাত ডুবিয়ে
কবিতার কনকে ছাপ দিয়ে চলেছি!
যেন কোনো একদিন কেউ এসে বলবে,
‘এ গভীর অনন্তে শামীম,
যখন দুঃখের দরিয়ার দেয়াল ধরে
কোনোক্রমে পিঁপড়ে হয়ে লটকে ছিলে
তুমি একা ছিলে না,
ছিলো তোমার দাউ দাউ দেশ।
সে তোমারই মেরুদ-ের শূন্যস্থানে আছে,
থাকবে বর্ধিত-বাংলাদেশের অবশেষ।
জংশন
খোরশেদ বাহার
একবার ট্রেনে উঠতেই
গন্তব্য হারিয়ে যায়
মেঘেঢাকা পাহাড়ের দেশ
পড়ন্ত বিকেলের রংধনু
লোকারণ্যে কত না শিহরন ছিল
ছিল স্বপ্নময় মানুষের ভিড়
সাথে রং-বেরঙের সংসারী ফানুস
এইসব নিয়ে গন্তব্য উধাও।
তারপর ডাকে সবুজ ঘাস, ফিরে আসি সমতলে
নদী নালা খাল বিল আর প্রকৃতির কোলে।
এখানে কদাচিৎ রংধনু দেখা যায়
তবে রঙের সে বাহার নেই, নেই জীবনের জৌলুস
আটপৌরে জীবনের নিরন্তর পাঁচালি।
আবারও তাই জংশনের খোঁজে
দুই পাহাড়ের নিচে যে হ্রদ
যেখানে ঝরনাধারায় প্লাবন বয়
রং-বেরঙের মাছেরা সাঁতার কাটে নিরুপদ্রব
সেই গন্তব্যের নেশায়
অবেলায় বসে আছি এই জংশনে।
ইঞ্জিনের শব্দকে অবিশ^াসী মনে হয়
কুয়াশা ভেদ করে আসছে যে ট্রেন
সবুজ বৃক্ষরাজির উন্মুক্ত টানেলে,
তার শব্দকে বড় ভুল মনে হয়
আবারও বুঝি ভুল ট্রেনের হুইস্ল শোনা যায়।
গর্তজীবী
চয়ন শায়েরী
নিজ-আঙুলের ছাপদোষে
নিজকণ্ঠের তাল-লয়ে ঘা মেরে
ক্রোমোজমের সুতো বেয়ে বেয়ে কোনো-একদিন
চেহারায় পিতা-মাতার ছাপছবি কাটছাঁট করে
জগৎসংসারে
এসে দেখি আমার আগেই কলোনি গড়ে তুলেছিল যারা
পৃথিবীর উদ্বর্তনের পথে
সভ্যতার বিবর্তনের পথে
আদিম সেই সায়ানোব্যাকটেরিয়ার বংশধরেরা
আমার চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে
কখন জানি আমাকে একটা নিজগন্ধও উপহার দিয়েছে
অযাচিত অনুগ্রহে
আমাকে সহজে শনাক্ত করবার জন্য;
কখনো-বা সন্দেহ হলে গন্ধ শুঁকে
কণ্ঠে কথানামাদের কত্থক নাচের ধরন দেখে
চেহারার চেকনাই চেক করে
আঙুলের ছাপ সেলুলারফোন বেপারীদের জাদুঘর থেকে নিয়ে
কিংবা ক্রোমোজমের কেরদানি ফাঁস করে দিয়ে
আমাকে যেন আন্দামান পাঠানো যায়;
আমাকে ফাঁসানোর ব্যবস্থাসব দেখে
আমি নিজে নিজেকে করছি আলাদা
কুনোব্যাঙের মতো ঘরকুনো হয়ে
সামসময়িক বুদ্ধিজীবীদের মতো গর্তজীবী হয়ে
ওজোন স্তর যে-ভাবে কালো আকাশ আড়ালে রাখে দিনে
দিন দিন কায়দা শিখছি
কীভাবে দেখেও না-দেখার ভান করা যায়
রাজনীতিক ভণিতায়
গাম্ভীর্য বজায় রেখে চেহারায়;
কেউ যেন আমাকে ধরতে না-পারে
আঙুলের ছাপে
চেহারার মাপে;
নন্দনতত্ত্ব মাখানো মন ভোলানো কবিতায় বেঁচে আছি
গর্তজীবী হয়ে
চেতনাবিরোধী চেতনায়।
চতুষ্পদী কবিতা
হাইকেল হাশমী
বন্দি
মনে হয় স্বপ্ন আর সৌরভ
দুটি একেবারেই স্বাধীন,
আমার স্বপ্ন, তোমার সুগন্ধি
তাদেরকে করা যায় না বন্দি।
চূর্ণ স্বপ্ন
ঘুমন্ত চোখ রাতে স্বপ্ন দেখে
ভোরে তা বিলীন হয়ে যায়,
বুকে থাকা কাঁচের মতো বাসনা
নিঃশ্বাস নিলে চূর্ণ হয়ে যায়।
ভোলা মন
তুমি হাসলে উজ্জ্বল আলো
চুপ থাকলে তিমির আঁধার,
কিসের দুঃখ, কেমন দুঃখ
কী বল? মনে নেই আমার।
সুপ্ত ইচ্ছে
আমাদের সুপ্ত ইচ্ছের বৃষ্টিতে
চলো আমরা সিক্ত হয়ে যাই,
দেহের পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে
চলো আত্মার তলে নেমে যাই।
মুক্তির কবিতা
মাহফুজ আল-হোসেন
এলোপাতাড়ি বিনির্দেশে বুদ্ধি-ভৃত্যকে বলতেই পারো ঝটপট এক মুক্তির কবিতা লিখে দিতে;
অথচ তার সাংখ্যিক জালে আটকানো কিম্ভূত কচ্ছপ মূহূর্তেই বদলে যাচ্ছে মৎস্যকুমারীতে!
আর মীন দর্শনের নীলচে-বেগুনি যুক্তিগুলো ডুবেও ভেসে আছে টোপাপানার উপরিভাগে;
ভ্রƒক্ষেপহীন জলাশয়ের অনতি উপরে উড্ডীন মাছরাঙাও জানে শিকার নিঃশ্বাসের দূরত্বে।
জানিনা, বেভুল মুদ্রায় নৃত্যপর ভেককুল আজ কোন চিঠি লিখে চলেছে মেঘদূত সমীপে...
শূন্যতার সীমানা
হাসানাত লোকমান
দেশের সীমানা খোঁজে না চোখের পথ,
অদৃশ্য লাইনগুলো গায় মৃত্যুর গান।
মাটি আর আকাশের মাঝে হারিয়ে যায় স্বপ্ন,
চোখের সামনে ধুলো, কোথাও নেই মানবতা।
গাছের শাখায় ঝুলে থাকে সময়ের ছায়া,
পাখিরা একে অপরকে ভুলে যায়।
যেখানে নদী আর সমুদ্র মিলতে চায়,
পথ হারিয়ে যায় সেখানে ইতিহাস।
তবু দূরে, কোনো এক বুনো হাওয়া
হঠাৎই বাজিয়ে তোলে এক অজানা সুর-
একটি আশার গান, এক অনন্ত আলো,
যা ছিন্ন করে দেয় শূন্যতার সীমানা!
কার্নিশে পাঁচটি শালিক
মাসুদার রহমান
কে কবি কে কবি নয়- এই নিয়ে ছাদের কার্নিশে
জটলা করছে পাঁচটি শালিক
তারপর একজোড়া উড়ে যায় পার্লামেন্ট ভবনে
একজোড়া গিয়ে নামে
মন্ত্রী পাড়ায়, খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে ক্ষমতার দানা
বাকি যে শালিক কার্নিশে তখনো চুপচুপ
এবং একাকী
আসন্ন সন্ধ্যায় যখন সে পাখনা মেললো
পালকে আলো ফেললো নক্ষত্র ও গোধূলি
জীবনেই জীবনের
দুলাল সরকার
ভালো ভালো প্রত্যুষের জন্ম দেয় সূর্য
দিগন্ত উজার করে হাসে, মাটির উঠান
শিউলির যোগ্য হয়ে উঠে, সে জানে
বখাটে ভোরের জন্ম হলে সে তার নির্মল
শুদ্ধতা হারাবে; আলটে দূর্বার প্রচ্ছদে
লটকে থাকা ফোঁটা ফোঁটা শিশির দেখে
আর কোনো সুসন্তান জন্ম নেবে না,
অংকুরিত হবেনা সুস্থ সবল অনুভূতির;
যাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ আয়ত্ত করবে
সামুদ্রিক ঐক্যের প্রতিভা, সূর্যের মুখোমুখি
সটান দাঁড়িয়ে বলবে গাঙ্গেয় এই দ্বীপে
মানবানুশীলনে ব্যাকুল হবেই- জীবনেই
জীবনের পুনর্জন্ম হয়ে স্বেচ্ছাতারিতার
চিরাবসান হবেই- তুমি দেখে নিও।
আমাদের যুদ্ধদিন
কামরুল ইসলাম
অগ্রন্থিত হাড়গোড় নিয়ে তোমার ছায়া
উদিত হয় লাস্যময় শহরে
বঁড়শিতে গাঁথা মাছের যন্ত্রণার পাশে
কাশফুল সন্ধ্যা নামিয়ে চলে যায়
দাঁতের ব্যথা নিয়েও আমি
রাতের অন্ধকারে কামিনীর গন্ধ পাই
কারা যেন মই বেয়ে আকাশে উঠছে
আর তুমি বাজিয়ে যাচ্ছ দূরের কান্নায়
ধূসর হয়ে আসা পুরনো বেহালা
তুর পাহাড়ের ছাই দিয়ে
চোখের কোণে ঝাপসা মেঘ এঁকে বলছো-
এ-ই আমার নিজস্ব সমুদ্র
এখানে নোঙ্গর গেড়ে যে সব ইস্টিমার
রেখে গেছে স্রোতের কাহিনী
তারাই সাক্ষী আমার নিঃশব্দ সাঁতারের
রাতের সাঁকোটি আমজনতার গুঞ্জনে
বেঁকে যায়
আমার তাকানোগুলো কেঁপে ওঠে
পুরনো সাইরেনের শব্দে
দূরে মায়া হরিণীরা ছিঁড়ছে কলিজা
আমাদের যুদ্ধদিন ভাঙা পাল্কির নিচে ঘুমোয়...
পথ ও পথিক
ইকবাল হোসেন বুলবুল
পথেরা পথের মতো পথের ভিতর
পথেরা নিজের মতো নিজের ভিতর
পথেরা কাউকে দেয় না ওয়াদা
কাউকে দেখার জন্যে অথবা ছোঁয়ার জন্যে হয় না পাগল
অপেক্ষা থাকে না তার- বলার, শোনার
বাড়ি যাবো, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো শব্দগুলো পথেরা চেনে না
বাড়িহারা, দেশহারা, খেশহারা শব্দগুচ্ছ তাকে ভাবায় না
পথের দেয়ালে, পথের পকেটে, কোনো ঘড়ি নেই
ক্যালেন্ডার নেই
দিন রাত নেই
ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, নিদ্রাহীন কোনো কষ্ট নেই
পথেরা হয় না অশ্রুশিক্ত
পথিকেরা হয়
ছোটগল্পের শেষবাক্য
রকিবুল হাসান
সবুজ জমিনে উৎসব-রঙে বিষের পেয়ালা
অবিশ্বাসের বৈশাখ উড়ছে ঈশানে
তবু কোনো অভিযোগ নেই
প্রতিদিন লেখা হচ্ছে হরণের কাব্য-উপন্যাস
জীবনপাতা ছিঁড়ছে যতদূর ইচ্ছে
যেখানে যেমন ইচ্ছে।
তুমি তো ভালোই জানো এ কেমন বিষ
ধরে আছ তুমিও তো জিদের রূপশ্রী
পাঠ করে যাচ্ছ মনগড়া স্বরলিপি
লালন-হাছন নেই তাতে
নেই সেই পলিমাটিও এখন
এ যেন ছোটগল্পের শেষবাক্য ঝুলছে ঈশানে।
তবু যেও কোনোদিন
মো. আশফাকুল ইসলাম
তবু যেও কোনোদিন
প্রিয় কারু সঙ্গে
পদ্মার সেই চরে...
দেখবে পদ্মায় সোনালি জরির রোদ্দুর
কীভাবে গড়িয়ে পড়ে
আর রুপালি চাঁদ ওঠে
স্বপ্নের প্লাবন নিয়ে!
যদি পারো যেও কারু সঙ্গে...
পদ্মার এই চরে নেই কোথাও মানুষ
আছে শুধু শেয়ালের ডাকের সান্ধ্য ধ্রুপদী
শুনতে যদি চাও
এসো এখানে কোনো একদিন
প্রিয় কারু সঙ্গে...
যদি নাও মনে পড়ে আমাকে
তবু যেও একটিবার
দেখে এসো পদ্মায়
কীভাবে ভাসে চাঁদ-
কী অপরূপ রূপময়তায়!
অপেক্ষা করো না আর
এসো শুধু একবার
কোনো একদিন কারু সঙ্গে...!
আজ অমিলকে
দিলীপ কির্ত্তুনিয়া
আজ অমিলকে আমরা শত্রুর জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি
আজ বৈচিত্র্যকে আমরা নির্বাসনে পাঠাচ্ছি
তোমার কথা আমার কথা মিলবে না
তাই বলে আমরা কবিতা লিখবো না?
স্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্ব দিচ্ছি না
স্বকীয়তা থাকবে না বুঝি!
কেউ আমরা কারোর মতন হবো না
কেন হবো- ষড়ঋতুর এই বর্নিল দেশে!
বসন্ত আমার ভাল লাগে না- শরত ভাল লাগে।
তুমি এসে বলবে- এটা করতে হবে
তা তো হয় না ভাই-
ও আমার রাঙা ভাই কথা পাল্টাও।
আমাকে ছবি আঁকতে দাও- তুমি গান গাও।
শুধু লাল সুন্দর নয়- হলুদও সুন্দর
সবুজ এসে বলে আমিও
সকল রঙ সুন্দর- সবার কথা ভাবিও।
চিত্তদাহ
আদিত্য নজরুল
খিদে কোলে নিয়ে বসে আছেন যে মা
আমি তারই সন্তান
ধর্ষিত যে বোনটি-
সিথানে মৃত্যু নিয়ে বসে আছে
আমি তার ভাই...
চিবুক পিছলে
ঝর্নার মতোই
কান্না বয়ে যাচ্ছে যে ছেলেটির
আমি তার সহোদর!
যে মেয়েটি
ফুলের সুঘ্রাণের মতোই
গোপন রাখতে
পারছেনা কান্না
আমি তার অসহায় পিতা;
এই দু-হাত
তুলেছি প্রভু জালিমের বিরুদ্ধে
মেয়েটি
লুৎফুন নাহার লোপা
শৈশব পেরোনোর আগেই
মেয়েটির আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লো উঠোনে।
তার শরীরজুড়ে স্নিগ্ধ সবুজের বদলে
বেড়ে উঠলো রাজ্যের অন্ধকার।
জানা গেলো বুনো শুয়োরের দল
কেড়ে নিয়ে গেছে তার চিরকালের বসন্ত।
কেউ কেউ খোঁজ নিতে গেল সেদিকে,
কেউবা তাকালো নিজ কন্যার দিকে,
কেউবা এক বুক শূন্যতা নিয়ে
ঢুকে গেলো সেই কান্নার ভেতর।
তারপর দিনশেষে ঘুমন্ত উদ্যানে
হয়ে গেলো সত্য মিথ্যের চালাচালি।
নিজের সকল সত্তা স্বাধীনতা ভেঙে
ধীরে ধীরে,
আমরা আবারও ভুলে গেলাম
বসন্তের রাতে মেয়েটি কেঁদেছিল যেভাবে।
স্বাধীনতা আমার
আদ্যনাথ ঘোষ
তুমি যখন আলোর শরীর থেকে
আরো আলোর অনন্য ডানাগুলো
একটু একটু করে খুলে ফেলেছিলে;
আড়াল সরে গিয়ে আরো আড়ালের ভেতর থেকে
আরও আলোর ফিনকি সবুজ ফসলের মাঠে
উদ্দাম বাতাসের কোলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আমি তখন উদ্বেলিত হাওয়ায়
আকাশের আলোকিত মঞ্চ ও
সবুজ ফসলের তৃষ্ণার্ত বাগানজুড়ে
বাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমার প্রত্যাশিত দুটি হাত।
তখন তুমি অন্ধকারের কোলাহল ভেঙে
সবুজ ফসলের ঝলকিত উৎসবে
অবারিত সুখ নিয়ে আছড়ে পড়েছিলে
আমাদের চোখ ও মুখের খোলা জানালায়।
তবু কেন আমার অন্তর আজ খুঁজে ফেরে তোমার পরাণ!
দড়ি
ফারুক আফিনদী
তোমাকে
চৈত্রের আমের ডালে
দুলুনি বানিয়ে ঝুুলে থাকি
দড়ি ধরে-
মোলায়েম। বাদামি দড়ি-
নরম। ঘিআভ-
মোহন ও সম্মোহনি
গন্ধ লেগে আছে
গন্ধ আছে লেগে
পাতা ও ঘিয়ের
ছায়া, মায়া-
হয়ে চলে
মাথার ওপরে-
সদা। সদা দড়ি-
ভূখণ্ড ও স্বাধীনতা
চামেলী বসু
শূন্য গুনে যেটুকু সমাধান
সমতার চিহ্ন ঘিরে প্রখর বাহানা-
সীমিত মুখাগ্নি শেষে উড়–ক এবার মিলিত ডানা
এই জন্মেই ঘুচে যাক বিভেদরেখা।
এই মৃত্যু মিছিল থেকে উঠে এসো মুষ্টিবদ্ধ হাত
দীপ্ত কণ্ঠে তোল বিদীর্ণ আওয়াজ-
কেবল ভূখ-ের স্বাধীনতা নয়
স্বাধীন হোক জীবিত মানুষের মৃত আত্মা!
অস্তিত্ব
চরু হক
দিখ-িত করেছো তুমি আমাকে বারবার
আমি জেনে যাই আমি বুঝে যাই এই অসার সংসার
আমি খুঁজছি তোমাকে পথে প্রান্তরে খুঁজছি মনের ভিড়ে
প্রিয় তোমার নামটি বুকে ধরে আমি পুড়ে হই অঙ্গার।
মৌলিক অধিকার
তানজীনা ফেরদৌস
বিড়ালপাড়ায় মহা সমাবেশ- মিছিল আর মিটিং
শিকারে ব্যর্থ বিড়ালগুলো কষ্টে কুপোকাত,
যারা মূলত মাছপাগল-
মাছের লোভকে ঢোক গিলে ঢেকে রেখে
মিটিংয়ের একমাত্র বিষয় হয়ে এলো ইঁদুর।
সিদ্ধান্ত- যে মাপের আর প্রজাতির
ইঁদুর শিকার হোক না কেন,
সব নিয়ে হাজিরা হবে হুলো বিড়ালের সমীপে
তিনিই রাখেন স্বাদ নেয়ার অধিকার সবার আগে...
ইঁদুরের স্বাদে মত্ত বিড়াল ভুলে যায়
মহাকালে আঁটকে পড়া রাতগুলো কেটে গেলে-
ঠিকই দিন আসবে বিড়ালপাড়ায়।
আর সেদিন সংবিধানে সংযুক্ত হবে ইঁদুর আর বিড়ালের
মৌলিক অধিকার।
পানতুম
রোখসানা ইয়াসমিন মণি
যেতে চায় না মন যে আমার এই পৃথিবী ছেড়ে
চারিদিকে দেখি শুধু রৌদ্র জলের খেলা,
বসে থাকি মুনির মতো বিষম যজ্ঞাগারে
বুকের ভেতর দস্যু খেলে মায়ার লীলাখেলা।
চারিদিকে দেখি শুধু রৌদ্রজলের খেলা
লাজুক গল্পের শিশিরকণা যজ্ঞের মন্ত্র পড়ে,
বুকের ভেতর দস্যু খেলে মায়ার লীলাখেলা
কয়েক ফোঁটা আমার ধ্যানে পাতার মতো ঝরে।
লাজুক গল্পের শিশিরকণা যজ্ঞের মন্ত্র পড়ে
রত্নাকরের তপস্যাতে করে লুটোপুটি,
কয়েকফোঁটা আমার ধ্যানে পাতার মতো ঝরে
তাইযে অসীম মায়ার জগত দেয়নি আমায় ছুটি।
রত্নাকরের তপস্যাতে করে লুটোপুটি
সাধের জীবন পৃথিবীতে শুধুই ঘুরেফিরে,
তাই যে অসীম মায়ার জগত দেয়নি আমায় ছুটি
যেতে চায় না মন যে আমার এই পৃথিবী ছেড়ে।