alt

স্বাধীনতা দিবস ২০২৫

সুপ্ত প্রেম

মো. নাহিদ পারভেজ

: বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

[পরশের শৈশব একটি ভয়াবহ ট্র্যাজেডির সাক্ষী। তার বাবা ছিলেন নিষ্ঠুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, যার রাগ এবং পাষাণ আচরণে মায়ের করুণ মৃত্যু ঘটে। বাবার মদ্যপ অবস্থায় সাইকেল কেনার কারণে মায়ের প্রতি সন্দেহ তাকে হত্যা পর্যন্ত নিয়ে যায়। মায়ের মৃত্যু ও বাবার নির্দয়তায় পরশের শৈশব বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে।

বাবার গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদ-ের পর পরশের জীবনের দায়িত্ব নেয় মহসিন কাকা। যিনি ছোটোবেলা থেকে পরশের পরিবারে থেকেছেন, তিনিই হন পরশের প্রকৃত অভিভাবক। তিনি পরশের সব প্রয়োজন পূরণ করেন, তাকে পড়াশোনার সুযোগ দেন এবং বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি আগলে রাখেন।

এক পর্যায়ে একটি চিঠিতে পরশ জানতে পারে, মহসিন এবং তার মা নাসরীনের মধ্যে একসময় গভীর ভালোবাসা ছিল। বাবার চাপে সেই সম্পর্ক শেষ হয় এবং নাসরীনকে জোরপূর্বক বিয়ে করে তার বাবা। এমনতর নানা ঘটনায় গল্পটি মানবীয় সম্পর্ক, ত্যাগ এবং ভালোবাসার এক জটিল ও করুণ অধ্যায় তুলে ধরে।]

সব মানুষের জীবনে কালো অধ্যায় থাকে। সেরকম একটা গল্প আমি আজ আপনাদের বলবো। শুনেছি নিজের জন্মে কারো হাত থাকে না। তবে কর্মে থাকে। গল্পটা বলার পর হয়তো আমার শরীরটা রেললাইনে পাওয়া যাবে। অনেক চেষ্টা করেও বহুদিন কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না এটা আত্মহত্যা নাকি নিছক দুর্ঘটনা। তারপর সবকিছু ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে। শুধু মুছে যাবে পরশ নামে কেউ পৃথিবীতে ছিল।

আমার বাবা চল্লিশ বছর ধরে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। এরকম পাষাণ মানুষ পুরো এলাকায় আর একটিও নেই! অবাক ব্যাপার হলো তারপরেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিবার তিনি নির্বাচনে জয়ী হন। বর্বরতার একটা উদাহরণ দিলে আপনাদের বিষয়টা বুঝতে একটু সহজ হবে। আমার বয়স তখন মাত্র সাত। একবার খুব ইচ্ছে হলো লাল রঙের একটা সাইকেল কিনবো। বাবাকে বলার মতো সাহস ছিল না আমার। মাকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুরোধ করছি। বিশেষ সুবিধা করতে পারছি না। অবশেষে একদিন নিজের রুম আটকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলাম। মায়ের মন বলে কথা। কাজ হয়ে গেল, আমার অবস্থা দেখে মা অবশেষে রাজি হলেন। মহসিন কাকাকে দিয়ে নতুন একটা লাল রেন্জার সাইকেল কিনে আনালেন। কিরিং কিরিং আওয়াজ হতো বেলটার। সামনে একটি আর পেছনে দুইটা লাইট। সুইচে চাপ দিলেই হ্যাজাকের মতো জ্বলতে শুরু করতো। আমি মহাখুশি।

আনন্দে কান্না শুরু করলাম। অনবরত চিৎকার করছি, মা মা মা লক্ষ্মী মা, তুমি কত ভালো মা, তুমি কত ভালো। এই জগতে তোমার মতো আর কেউ কেন ভালোবাসে না বলতে পারো!

মা বললেন, অনেক হইছে। এখন আয় ভাত খা, খেয়ে মা’কে উদ্ধার কর।

গভীর রাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন। সাইকেলের বিষয়টা শুনে হঠাৎ তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। মাকে বেধড়ক পিটুনি শুরু করলেন।

-... চুরি শুরু করছিস। এই টাকা তোর কোন ভাতারে জোগাইছে। নাকি কারো সাথে...।

চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে গোপন কামরায় নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন, তারপর আবার পিটুনি শুরু। দরজার ফুটো দিয়ে দেখলাম, মায়ের কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে।

জোরে জোরে দরজা ধাক্কানো শুরু করলাম আমি।

-দরজা খোলো বাবা, আমার সাইকেল লাগবে না। সাইকেল লাগবে না বাবা। দয়া করে দরজাটা খোলো বাবা, বাবা... বাবা!

বাবা বের হয়ে আসলেন। তার পুরো শরীর ঘর্মাক্ত। ততক্ষণে তার মদের নেশা চলে গেছে। চোখ টকটকে লাল। মায়ের ঘরটায় তালা দিয়ে হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির মাঝ আঙিনায়। আমি তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছি...

সাইকেলটা পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দিলেন। আমার ভেতরটা যেন জ্বলেপুড়ে কয়লা হয়ে গেল, মুখ দিয়ে তবু একটাও শব্দ করলাম না। মনে হলো আর যাই হোক এই লোক আমার বাপ না। সারারাত সেখানেই বসে থাকলাম। বাবা বাগানবাড়িতে গিয়ে আবারও নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে রইলেন। সেখানে আমাদের যাওয়া নিষেধ। ভোরবেলা একটা বটি নিয়ে গেলাম মায়ের রুমটায়। তালা ভাঙলাম। দেখলাম মা আমার শাড়িতে ঝুলছে! টুকটুকে লাল শাড়ি, শরীরটা একদম ধবধবে সাদা। রক্তগুলো টিপের মতো কপালে জমাট বাঁধা। চুপচাপ বসে থাকলাম সেখানে। কত সময় ঠিক মনে নেই। অনেক লোক জড়ো হয়েছিল সেদিন। দুপুরবেলা পুলিশ এসে বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। খয়েরি পোশাকের কিছু মানুষ মায়ের শরীরটাও সাদা কাপড়ে ঢেকে এম্বুলেন্স করে নিয়ে গেলেন। তিনদিন পর মা’কে কবর দেওয়া হলো, পাশের বাঁশঝাড়টায়। প্রতিরাতে জোছনার আলো যখন এসে পড়ে মায়ের কবরটায়। আমি একা দাঁড়িয়ে তখন মাকে ডাকতে থাকি।

-মা মা মা তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে মা... আমার সাইকেল লাগবে না। তবুও তুমি ফিরে এসো।

জোছনার আলো ম্লান হয়ে আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ছায়া পড়ে মায়ের কবরে। কবরটা তখন ফুলের সুরভিতে ভরে ওঠে। একসময় মহসিন কাকা এসে ঠিক ধরে নিয়ে যায়।

-খোকা তোকে কতবার বলছি। রাতেরবেলা একা একা এখানে আসবি না।

আমাদের ফাঁকা বাসাটায় আর কেউই আসে না। আগের সেই লোকজনের কোলাহল একদম নেই। শুধু আমি আর মহসিন কাকা।

-বাবাকে দেখতে যাবি খোকা?

-না। আর কোনদিন আমি তাকে দেখতে চাই না।

-এভাবে বলতে নেই খোকা। তোর বাবার তো সেদিন নেশার ঘোরে হুঁশ ছিল না। ক্ষমা করে দে। চল যাই একবার।

আমি আর কথা বলি না। চুপ করে থাকি। আমার চোখ লাল হয়ে ওঠে। মুখ ফুলে যায়। ঘর থেকে বের হই না, এক মুহূর্তের জন্যেও কোথাও যাই না।

মা যদি আবার ফিরে আসে! আমি জানি তিনি ফিরে আসবেন। তাকে আসতেই হবে।

দেখতে দেখতে ছয়মাস পার হয়ে গেল, চূড়ান্তরায়ের আগে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো কোর্টের এজলাসে। মহসিন কাকা আগেই বলে দিয়েছেন, কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি, আমি কিছু জানি না। সে রাতে ঘুমিয়ে পড়ছিলাম।

আমি তাকে কিছুই বলি না। কেবল চুপ থাকি। আমার মনে জমা তীব্র অভিমান। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, বাবা পরশ, সেদিন রাতে তুমি কোথায় ছিলে। তোমার মাকে শেষ কখন দেখেছিলে? তোমার কি কিছু মনে পড়ছে?

আমি দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকলাম।

বাবার উকিল বার বার জজকে বলছেন, ছেলেমানুষ স্যার। তার কী করে মনে থাকবে। সে তো তখন গভীর ঘুমে।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে এক দলা থুথু ফেললাম। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, আমার মাকে উনি মেরে ফেলেছেন। দয়া করে তাকে বলুন, আমি মায়ের কাছে যাবো। আমি মায়ের কাছে যাবো। মা মা তুমি কোথায়? মা মা মা...

অচেতন হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম।

মাসখানেক পর বাবার ফাঁসির আদেশ হলো। শুনলাম তিনি নিজেই হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। মহসিন কাকাকে দেখলেই কাঁদেন।

-পরশকে দেখে রাখিস ভাই আমার। বড় হলে বলিস আমি তাকে খুব ভালোবাসি।

বাবার সাথে সেটাই ছিল আমার শেষ দেখা। একদিন খুব ভোরে তাকে নিয়ে আসা হলো বাড়ির আঙিনায়। তিনি খাটিয়ায় শুয়ে আছেন। এক ফোঁটাও কান্না পেল না আমার। আমি দৌড়ে মায়ের কবরটার কাছে দাঁড়ালাম।

-মা মা ওঠো, দেখো আল্লাহ তোমার কাছে কি উপহার পাঠিয়েছেন।

যাবার আগে বাবা তার সম্পত্তি আমার নামে উইল করে গেছেন। মহসিন কাকাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া।

মহসিন কাকা বিয়ে করেনি। আমাকে নিয়ে তিনি প্রতিদিন স্কুলে যান।

-পরশ মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। স্কুলে শিক্ষক যা বলে, সেভাবেই চলতে হবে।

স্কুল শেষে তার সাইকেলে বাড়ি ফিরি। আমাদের তিনবেলার খাবার তিনি নিজেই তৈরি করেন। বাবার জমানো টাকায় কোনোদিন হাত দেননি। নিজেই টিউশনি করে সংসারের খরচ চালান। তিনি বাবার ফুপাতো ভাই। ছোটোবেলায় তার বাবা-মা মারা যান। আমার দাদা তখন তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। বাবা আর মহসিন কাকা বন্ধুর মতো মানুষ হয়েছেন। দুজন বিপরীত চরিত্রের মানুষ কীভাবে এত গভীর বন্ধুত্বে জড়ায় এটা আমার ঠিক মাথায় আসে না।

আজ আমার অনার্স ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট। মহসিন কাকা বাসায় মিলাদের আয়োজন করেছেন। এতিম বাচ্চাদের খাওয়ানো হবে। পোলাও, বুটের ডাল, গরুর মাংস, ডিম সেদ্ধ আর মুরগির রোস্ট। ছেলেগুলোকে তিনি নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করছেন। সবাইকে খাবার দিতে দিতে বলছেন, পেট ভরে খারে বেটা। পরশের রেজাল্ট ভালো হলে আবার খাওয়া পাবি সবাই। সারামাস তোরা কুরআন খতম দিয়ে তার জন্যে দোয়া করেছিস। আমি জানি এই দোয়া কোনোদিন বিফলে যাবে না।

সন্ধ্যায় ফোন আসলো আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। আমার খুশির চেয়ে মহসিন কাকা মহাখুশি। মাইকিং করে পুরো এলাকায় জানানো হলো পরদিন গ্রামের সবার দাওয়াত। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন।

হাত ধরে নিয়ে গেলেন মায়ের কবরে। তার পাশেই বাবা শুয়ে আছেন।

বাবাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ভাইজান, আপনার ছেলে পুরো গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমাদের বংশে সেই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। তার জন্যে আপনারা খাস দিলে দোয়া করবেন। একদিন সে বড় ব্যারিস্টার হবে, ইনশাআল্লাহ। তিনি হাউ মাউ করে কাঁদছেন। আমি তাকে ধরে বাসায় নিয়ে আসলাম।

পরদিন দুপুরে দাওয়াত শেষে আমাকে নিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন।

-আজ থেকে তোর নতুন যাত্রা শুরু। এখন থেকে নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে। নিজ ভালো মন্দ তোর নিজের কাছেই। তোর সামনে ভালো খারাপ সব পথই খোলা থাকবে। বর্ণিল পৃথিবীর সব দুয়ার একে একে খুলতে থাকবে। কিন্তু কোন দরজাটা তোর জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে তোকেই সেটার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আল্লাহ ভরসা।

ট্রেনে উঠতেই মাথায় হাত দিয়ে সুরা পড়ে দোয়া করলেন। তারপর একটা পুরানো খাম বের করলেন।

-যেতে যেতে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়বি এটা। তোর বাবা জেলে বসে লিখে রেখে গেছেন। আমাকে বলেছেন, তুই যেদিন সব বোঝার মতো সাহস অর্জন করবি। সেদিন যেন আমি তোর হাতে এটা দেই। আমার মনে হয়, আজই সেই কাক্সিক্ষত দিন। ভালো থাক, ফিআমানিল্লাহ।

ট্রেন আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে, মহসিন কাকা হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালেন। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এই লোকটাই ছোটোবেলা থেকে আমার সবকিছু। আমার কাছে পিতা-মাতা বলতে তিনিই সব। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আসছিল। জীবনে এই প্রথম তার জন্যে কেমন যেন একটা তীব্র মায়াবোধ করলাম। খুব অস্থির লাগছিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল সেদিন।

ট্রেনের একটা পুরো কামরা আমাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু সময় বাইরের সবুজ পরিবেশটা দেখলাম। ঝিকঝিক শব্দটা নেশার মতো লাগছিল। হঠাৎ একজন এসে জানালো আমার কিছু লাগবে কি না?

মহসিন কাকা তাকে আমার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। জানালেন, কিছুক্ষণ পর তিনি আবারো আসবেন। তখনই হঠাৎ খামটার কথা মনে হলো। আস্তে আস্তে সেটা খুললাম।

অনেক বছর পর বাবার হাতের ছোঁয়া পেলাম। কিছুক্ষণ লেখাগুলোর দিকে স্থির তাকিয়ে থাকলাম। হাত দিয়ে বাবার স্পর্শ নেয়ার চেষ্টা করলাম। আমার চোখের পানি চিঠির উপর পড়তেই খেয়াল হলো ভিজে যেতে পারে। দ্রুতই চোখের জল মুছলাম।

বাবা পরশ,

এখন তুমি বড় হয়েছ। পৃথিবীর ভালো-মন্দ, আলোকিত-কুৎসিত রূপ নিশ্চয়ই বুঝতে শিখেছ। জেলখানার এই বদ্ধ ঘরটায় বসে প্রতিদিন ভাবি আগামীকাল হয়তো তুমি একবার আমায় দেখতে আসবে। পরদিন যখন দেখি তুমি নেই, তখন তোমার মায়ের ঘরে তালা দিয়ে আসার সেই দিনের স্মৃতিটা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। মনটা খুব শান্ত হয়। বুঝতে পারি, তুমি ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ। সেইদিনের পাপের শাস্তি আমাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। আমিও সেটা মেনে নিয়েছি। উকিলকে বলে নিজের শাস্তি স্বীকার করে তোমাকেও যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করেছি। কারণ আমি জানি, এই জীবনে আমার সামনাসামনি হওয়া মানেই সেই দুঃসহ স্মৃতিটা বারবার তোমার সামনে নিয়ে আসা। এর থেকে আমার চলে যাওয়াটাই বেশি ভালো।

ছোটোবেলা থেকে আমি ও মহসিন একসাথে বড় হয়েছি। পড়াশোনা ও শিক্ষাদীক্ষায় সবকিছুতেই সে আমার চেয়ে এগিয়ে ছিল। আমাদের আমলে এই এলাকায় সেই একমাত্র বিকম পাস। চাইলেই সে যে-কোনো বড় চাকরি করে সংসার করতে পারতো। কিন্তু আমাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি সে। আমরা তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। তোমার মা প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আমি সারাদিন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। মহসিন কলেজের সাহিত্য পত্রিকার দায়িত্ব নিল। তোমার মায়ের সাহিত্যের প্রতি অনেক দুর্বলতা। কীভাবে যেন তাদের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেল। এগুলোর কোনোকিছুই মহসিন আমাকে জানায়নি। খুব অল্পসময়ে তারা দুজন খুব কাছাকাছি চলে আসে। হঠাৎ একদিন ভালোবাসাবাসিও হয়ে যায়। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমি কি বোঝাতে চাইছি। একদিন কি একটা কাজে কলেজে একাই গেলাম আমি। মহসিনের সেদিন অনেক জ্বর। তোমার মা হয়তো আমাকে চিনতো। কাছে এসে বললো, আপনি কি মহসিন ভাইয়ের বন্ধু?

মেয়েদের সাথে আমার খুব বেশি মেশার সুযোগ হয়নি। তোমার মাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকলাম। সে আবারো বললো, এই যে আপনি, শুনছেন। অসুস্থ নাকি?

আর কী কী বলেছে তার কিছুই তেমন খেয়াল নেই। আমি দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। তোমার দাদা প্রভাবশালী মানুষ। তার কাছে গিয়ে সরাসরি বললাম, আব্বা আমি বিয়ে করবো।

তোমার দাদা অনেক বকাবকি করলেন। বেহায়ার বাচ্চা। নিজে চলতে পারিস না! বউকে খাওয়াবি কী?

একসময় ঠিক বুঝতে পারলেন, কিছু বলে লাভ নেই। আমি চরম জেদি ও আস্ত পাগল মানুষ। আমাকে বোঝাতে যাওয়াই চরম বোকামি।

তোমার দাদা ভাবলেন, বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে আনলে হয়তো আমি ভালো হয়ে যাবো। তিনি মহসিনকে ডেকে সবকিছু খুলে বললেন। মহসিন তখনও জানে না, পাত্রী কে! সে খুশি মনে বাবাকে বললো, একদম চিন্তা করবেন না। আমি আজই সব খবর নিয়ে আসছি।

কলেজে গিয়ে খোঁজ নিয়ে তোমার মায়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল সে। তাদের দুজনের মাথায় হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। নাসরীন কিছুতেই বিয়েতে রাজি না।

মহসিনকে বলল, দরকার হলে আমি বিষ খাবো। আপনি আমাকে যেইভাবে রাখবেন, আমি তাতেই রাজি। চলেন দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।

মহসিনের কাঁধে আমার পরিবার ও বন্ধুত্বের ঋণের বোঝা। সেই ভার থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নেই তার। তাই সে আমাকে কিছুই বলেনি। চিরদিন অভিনয় করে গেছে। দাদাকে নিয়ে তোমার মায়ের বাড়িতে হাসিমুখে গিয়ে সবকিছু ঠিক করে এসেছে। তোমার মায়ের সাথে সে আর কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি।

সে সময় মেয়েদের জীবন খুব একটা স্বাধীন ছিল না। বেশিরভাগেরই পরিবারের বাইরে মতামতের ক্ষমতা ছিল না। বাধ্য হয়ে গোপন ভালোবাসাকে গলাটিপে হত্যা করলো তারা। বিয়ের রাতে মহসিনের মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট হলো। বাঁচা মরা নিয়ে টানাটানি। বাবা নিজেই পুরোটা রাত হাসপাতালে ছিলেন। ডাক্তারকে বলেছেন, আমার ছেলে। যেভাবে পারেন সারিয়ে তুলুন। সে যাত্রায় মহসিন বেঁচে যায়। কিন্তু তার অন্তরটা যেন মরে গেছে। আসলে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সে। বিয়ের কয়েকদিন পর সে যেদিন ফিরে এলো, তোমার মা নতুন একটা খবর দিল আমাকে। আমার জন্যে সেটা ছিল চরম ধাক্কা। তোমার মা সন্তানসম্ভবা। বিয়ের সবেমাত্র কয়েকদিন হয়েছে। পুরোপুরি ভেঙে পড়লো সে। একবার বলল, আপনি চাইলে আমি আত্মহত্যা করবো। আপনাকে কোনোভাবেই ধোঁকা দিতে পারবো না আমি। আপনি যদি বলেন, এই এক কাপড়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।

পুরো বিষয়টা তখন বাধ্য হয়ে চেপে গিয়েছি। কারণ ভাবলাম, মূল অন্যায়টা তো করেছি আমি। তাদের দুজনের কারোরই কোনো দোষ ছিল না। তাছাড়া তারা তো কিছু ভাবার সময়ও পায়নি। মহসিনকে আমি ছোটোবেলা থেকেই চিনি। জেনে বুঝে আমার কোনো ক্ষতি সে কোনোদিন করবে না।

একসময় তোমার মায়ের কোলজুড়ে এলে তুমি। আমাদের বংশের একমাত্র প্রদীপ। মহসিন আমাদের সাথেই থেকে গেল। হয়তো তোমার মাকে ছেড়ে যেতে তার ইচ্ছে করেনি।

এর মধ্যে একদিন জেলখানায় দেখা করতে এলো মহসিন। তার মতো সৎমানুষ কখনো দেখিনি আমি। আমার কাছে ভাইয়ের চেয়েও বেশিকিছু সে। এটুকু নিশ্চিত জানি যতদিন সে তোমার পাশে থাকবে, তোমাকে নিয়ে চিন্তার বিশেষ কোনো কারণ নেই আমার।

তাকে জানালাম, ‘উকিল দিয়ে তোমার সব দায়িত্ব আমি তাকেই দিয়ে রেখেছি এবং তুমি বড় না হওয়া পর্যন্ত বিষয় সম্পত্তির পাওয়ার তার হাতেই অর্পণ করেছি।’

শুনে অনেকক্ষণ কাঁদলো সে।

কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, কী রে বোকা কাঁদিস কেন?

-আপনার ভালোবাসার আমি যোগ্য না ভাইজান। দীর্ঘদিন ধরে একটা অনেক বড় অন্যায় আপনার কাছে গোপন করে এসেছি। এই দায়িত্বটা দয়া করে আমাকে দেবেন না।

কিছুতেই শান্ত হয় না! অবশেষে বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কী হয়েছে তোর? আমাকে খুলে বল!

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তোমার মায়ের সাথে সম্পর্কের বিষয়টা জানালো সে। ভাবলাম পরশ নিয়ে দুশ্চিন্তাটা আজ থেকে আমার দূর হলো। আমি এখন নিশ্চিন্ত। জানি, একদিন তুমি মানুষের মতো মানুষ হবে। তোমার আসল বাপ একজন প্রকৃত ভালো মানুষ। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই খারাপ পথে নিয়ে যায় তোমাকে। তোমার শরীরে আমার রক্ত থাকলেই বরং সেটা হতো অধিক চিন্তার বিষয়।

মাথায় হাত রেখে বললাম, মহসিন। ভাই আমার। আমি খারাপ মানুষ। পরশকে তুই নিজের মতো দেখে রাখিস ভাই। কথা দে, আজীবন তাকে আগলে রাখবি?

কাঁদতে শুরু করলো সে।

-থাক আর কাঁদতে হবে না। এখন যা। আমি বরং নফল নামাজ পড়ে তোদের দুজনের জন্যে শেষবারের মতো একটু দোয়া করি।

আরেকটা কথা, পারলে আমাকে তুই ক্ষমা করিস ভাই। তোর আর নাসরীনের বিষয়টা আগে জানলে আমি অবশ্যই নিজেকে বোঝাতাম। তুই এটা নিশ্চয়ই জানিস। এ জন্যেই হয়তো এত বড় বলিদানটা দিয়েছিস তুই। তোর জায়গায় আমি হলে এটা কখনোই করতে পারতাম না।

কোনো কথা না বলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে কাঁদলাম অনেকক্ষণ। তারপর কান্না লুকিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল মহসিন। মন থেকে দীর্ঘদিনের একটা পাথর যেন হঠাৎ সরে গেল!

আকাশে সেদিন অবাক করা জোছনা! দূরের চাঁদটাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম অনেকক্ষণ। তারপর নামাজ পড়ে অনেকদিন পর শান্তির একটা ঘুম দিলাম। একটু পরে আমাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হবে। গতরাতে তোমার মাকে স্বপ্নে দেখেছি। সে আমাকে হাত ধরে হলুদ সর্ষেক্ষেতে নিয়ে গিয়েছিল। তীব্র রোদে হলুদের বিস্তৃত ফসলের মাঠে অনেকক্ষণ হেঁটেছি দুজন। একসাথে সূর্যাস্তও দেখলাম। তারপর সে হঠাৎ বলল, আমার সাথে চলেন। আমি আর একা থাকতে পারবো না!

বাবা পরশ আমি তোমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও বাপ। আজীবন তোমাকে শুধু কষ্টই দিয়েছি। একটাই অনুরোধ, পিতা হিসেবে আমার নামটাই আজীবন রেখো তুমি। এই বিষয়ে কিছুই জানে না মহসিন। বলতে পারো এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।

জাযাকাল্লাহু খাইরান।

তোমার হতভাগ্য পিতা।

সারারাত একা একাই কাঁদলাম। কখন রাজশাহী পৌঁছেছি টেরই পাইনি। লোকটা এসে ডাকতেই খেয়াল হলো। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। হাতের চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললাম। জগতের সব সত্য সবার না জানাই ভালো। বৃষ্টির মধ্যেই ট্রেন থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম।

দুনিয়া কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামুক। আমার মনের সব দুঃখ ধুয়েমুছে সাথে করে নিয়ে যাক। আজ থেকে আমি শুদ্ধ মানুষ হব...

tab

স্বাধীনতা দিবস ২০২৫

সুপ্ত প্রেম

মো. নাহিদ পারভেজ

বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

[পরশের শৈশব একটি ভয়াবহ ট্র্যাজেডির সাক্ষী। তার বাবা ছিলেন নিষ্ঠুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, যার রাগ এবং পাষাণ আচরণে মায়ের করুণ মৃত্যু ঘটে। বাবার মদ্যপ অবস্থায় সাইকেল কেনার কারণে মায়ের প্রতি সন্দেহ তাকে হত্যা পর্যন্ত নিয়ে যায়। মায়ের মৃত্যু ও বাবার নির্দয়তায় পরশের শৈশব বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে।

বাবার গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদ-ের পর পরশের জীবনের দায়িত্ব নেয় মহসিন কাকা। যিনি ছোটোবেলা থেকে পরশের পরিবারে থেকেছেন, তিনিই হন পরশের প্রকৃত অভিভাবক। তিনি পরশের সব প্রয়োজন পূরণ করেন, তাকে পড়াশোনার সুযোগ দেন এবং বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি আগলে রাখেন।

এক পর্যায়ে একটি চিঠিতে পরশ জানতে পারে, মহসিন এবং তার মা নাসরীনের মধ্যে একসময় গভীর ভালোবাসা ছিল। বাবার চাপে সেই সম্পর্ক শেষ হয় এবং নাসরীনকে জোরপূর্বক বিয়ে করে তার বাবা। এমনতর নানা ঘটনায় গল্পটি মানবীয় সম্পর্ক, ত্যাগ এবং ভালোবাসার এক জটিল ও করুণ অধ্যায় তুলে ধরে।]

সব মানুষের জীবনে কালো অধ্যায় থাকে। সেরকম একটা গল্প আমি আজ আপনাদের বলবো। শুনেছি নিজের জন্মে কারো হাত থাকে না। তবে কর্মে থাকে। গল্পটা বলার পর হয়তো আমার শরীরটা রেললাইনে পাওয়া যাবে। অনেক চেষ্টা করেও বহুদিন কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না এটা আত্মহত্যা নাকি নিছক দুর্ঘটনা। তারপর সবকিছু ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে। শুধু মুছে যাবে পরশ নামে কেউ পৃথিবীতে ছিল।

আমার বাবা চল্লিশ বছর ধরে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। এরকম পাষাণ মানুষ পুরো এলাকায় আর একটিও নেই! অবাক ব্যাপার হলো তারপরেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রতিবার তিনি নির্বাচনে জয়ী হন। বর্বরতার একটা উদাহরণ দিলে আপনাদের বিষয়টা বুঝতে একটু সহজ হবে। আমার বয়স তখন মাত্র সাত। একবার খুব ইচ্ছে হলো লাল রঙের একটা সাইকেল কিনবো। বাবাকে বলার মতো সাহস ছিল না আমার। মাকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুরোধ করছি। বিশেষ সুবিধা করতে পারছি না। অবশেষে একদিন নিজের রুম আটকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলাম। মায়ের মন বলে কথা। কাজ হয়ে গেল, আমার অবস্থা দেখে মা অবশেষে রাজি হলেন। মহসিন কাকাকে দিয়ে নতুন একটা লাল রেন্জার সাইকেল কিনে আনালেন। কিরিং কিরিং আওয়াজ হতো বেলটার। সামনে একটি আর পেছনে দুইটা লাইট। সুইচে চাপ দিলেই হ্যাজাকের মতো জ্বলতে শুরু করতো। আমি মহাখুশি।

আনন্দে কান্না শুরু করলাম। অনবরত চিৎকার করছি, মা মা মা লক্ষ্মী মা, তুমি কত ভালো মা, তুমি কত ভালো। এই জগতে তোমার মতো আর কেউ কেন ভালোবাসে না বলতে পারো!

মা বললেন, অনেক হইছে। এখন আয় ভাত খা, খেয়ে মা’কে উদ্ধার কর।

গভীর রাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন। সাইকেলের বিষয়টা শুনে হঠাৎ তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। মাকে বেধড়ক পিটুনি শুরু করলেন।

-... চুরি শুরু করছিস। এই টাকা তোর কোন ভাতারে জোগাইছে। নাকি কারো সাথে...।

চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে গোপন কামরায় নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন, তারপর আবার পিটুনি শুরু। দরজার ফুটো দিয়ে দেখলাম, মায়ের কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে।

জোরে জোরে দরজা ধাক্কানো শুরু করলাম আমি।

-দরজা খোলো বাবা, আমার সাইকেল লাগবে না। সাইকেল লাগবে না বাবা। দয়া করে দরজাটা খোলো বাবা, বাবা... বাবা!

বাবা বের হয়ে আসলেন। তার পুরো শরীর ঘর্মাক্ত। ততক্ষণে তার মদের নেশা চলে গেছে। চোখ টকটকে লাল। মায়ের ঘরটায় তালা দিয়ে হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির মাঝ আঙিনায়। আমি তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছি...

সাইকেলটা পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দিলেন। আমার ভেতরটা যেন জ্বলেপুড়ে কয়লা হয়ে গেল, মুখ দিয়ে তবু একটাও শব্দ করলাম না। মনে হলো আর যাই হোক এই লোক আমার বাপ না। সারারাত সেখানেই বসে থাকলাম। বাবা বাগানবাড়িতে গিয়ে আবারও নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে রইলেন। সেখানে আমাদের যাওয়া নিষেধ। ভোরবেলা একটা বটি নিয়ে গেলাম মায়ের রুমটায়। তালা ভাঙলাম। দেখলাম মা আমার শাড়িতে ঝুলছে! টুকটুকে লাল শাড়ি, শরীরটা একদম ধবধবে সাদা। রক্তগুলো টিপের মতো কপালে জমাট বাঁধা। চুপচাপ বসে থাকলাম সেখানে। কত সময় ঠিক মনে নেই। অনেক লোক জড়ো হয়েছিল সেদিন। দুপুরবেলা পুলিশ এসে বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। খয়েরি পোশাকের কিছু মানুষ মায়ের শরীরটাও সাদা কাপড়ে ঢেকে এম্বুলেন্স করে নিয়ে গেলেন। তিনদিন পর মা’কে কবর দেওয়া হলো, পাশের বাঁশঝাড়টায়। প্রতিরাতে জোছনার আলো যখন এসে পড়ে মায়ের কবরটায়। আমি একা দাঁড়িয়ে তখন মাকে ডাকতে থাকি।

-মা মা মা তুমি কোথায় হারিয়ে গেলে মা... আমার সাইকেল লাগবে না। তবুও তুমি ফিরে এসো।

জোছনার আলো ম্লান হয়ে আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ছায়া পড়ে মায়ের কবরে। কবরটা তখন ফুলের সুরভিতে ভরে ওঠে। একসময় মহসিন কাকা এসে ঠিক ধরে নিয়ে যায়।

-খোকা তোকে কতবার বলছি। রাতেরবেলা একা একা এখানে আসবি না।

আমাদের ফাঁকা বাসাটায় আর কেউই আসে না। আগের সেই লোকজনের কোলাহল একদম নেই। শুধু আমি আর মহসিন কাকা।

-বাবাকে দেখতে যাবি খোকা?

-না। আর কোনদিন আমি তাকে দেখতে চাই না।

-এভাবে বলতে নেই খোকা। তোর বাবার তো সেদিন নেশার ঘোরে হুঁশ ছিল না। ক্ষমা করে দে। চল যাই একবার।

আমি আর কথা বলি না। চুপ করে থাকি। আমার চোখ লাল হয়ে ওঠে। মুখ ফুলে যায়। ঘর থেকে বের হই না, এক মুহূর্তের জন্যেও কোথাও যাই না।

মা যদি আবার ফিরে আসে! আমি জানি তিনি ফিরে আসবেন। তাকে আসতেই হবে।

দেখতে দেখতে ছয়মাস পার হয়ে গেল, চূড়ান্তরায়ের আগে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো কোর্টের এজলাসে। মহসিন কাকা আগেই বলে দিয়েছেন, কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি, আমি কিছু জানি না। সে রাতে ঘুমিয়ে পড়ছিলাম।

আমি তাকে কিছুই বলি না। কেবল চুপ থাকি। আমার মনে জমা তীব্র অভিমান। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, বাবা পরশ, সেদিন রাতে তুমি কোথায় ছিলে। তোমার মাকে শেষ কখন দেখেছিলে? তোমার কি কিছু মনে পড়ছে?

আমি দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকলাম।

বাবার উকিল বার বার জজকে বলছেন, ছেলেমানুষ স্যার। তার কী করে মনে থাকবে। সে তো তখন গভীর ঘুমে।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে এক দলা থুথু ফেললাম। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, আমার মাকে উনি মেরে ফেলেছেন। দয়া করে তাকে বলুন, আমি মায়ের কাছে যাবো। আমি মায়ের কাছে যাবো। মা মা তুমি কোথায়? মা মা মা...

অচেতন হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লাম।

মাসখানেক পর বাবার ফাঁসির আদেশ হলো। শুনলাম তিনি নিজেই হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। মহসিন কাকাকে দেখলেই কাঁদেন।

-পরশকে দেখে রাখিস ভাই আমার। বড় হলে বলিস আমি তাকে খুব ভালোবাসি।

বাবার সাথে সেটাই ছিল আমার শেষ দেখা। একদিন খুব ভোরে তাকে নিয়ে আসা হলো বাড়ির আঙিনায়। তিনি খাটিয়ায় শুয়ে আছেন। এক ফোঁটাও কান্না পেল না আমার। আমি দৌড়ে মায়ের কবরটার কাছে দাঁড়ালাম।

-মা মা ওঠো, দেখো আল্লাহ তোমার কাছে কি উপহার পাঠিয়েছেন।

যাবার আগে বাবা তার সম্পত্তি আমার নামে উইল করে গেছেন। মহসিন কাকাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া।

মহসিন কাকা বিয়ে করেনি। আমাকে নিয়ে তিনি প্রতিদিন স্কুলে যান।

-পরশ মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। স্কুলে শিক্ষক যা বলে, সেভাবেই চলতে হবে।

স্কুল শেষে তার সাইকেলে বাড়ি ফিরি। আমাদের তিনবেলার খাবার তিনি নিজেই তৈরি করেন। বাবার জমানো টাকায় কোনোদিন হাত দেননি। নিজেই টিউশনি করে সংসারের খরচ চালান। তিনি বাবার ফুপাতো ভাই। ছোটোবেলায় তার বাবা-মা মারা যান। আমার দাদা তখন তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। বাবা আর মহসিন কাকা বন্ধুর মতো মানুষ হয়েছেন। দুজন বিপরীত চরিত্রের মানুষ কীভাবে এত গভীর বন্ধুত্বে জড়ায় এটা আমার ঠিক মাথায় আসে না।

আজ আমার অনার্স ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট। মহসিন কাকা বাসায় মিলাদের আয়োজন করেছেন। এতিম বাচ্চাদের খাওয়ানো হবে। পোলাও, বুটের ডাল, গরুর মাংস, ডিম সেদ্ধ আর মুরগির রোস্ট। ছেলেগুলোকে তিনি নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করছেন। সবাইকে খাবার দিতে দিতে বলছেন, পেট ভরে খারে বেটা। পরশের রেজাল্ট ভালো হলে আবার খাওয়া পাবি সবাই। সারামাস তোরা কুরআন খতম দিয়ে তার জন্যে দোয়া করেছিস। আমি জানি এই দোয়া কোনোদিন বিফলে যাবে না।

সন্ধ্যায় ফোন আসলো আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। আমার খুশির চেয়ে মহসিন কাকা মহাখুশি। মাইকিং করে পুরো এলাকায় জানানো হলো পরদিন গ্রামের সবার দাওয়াত। খুব লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন।

হাত ধরে নিয়ে গেলেন মায়ের কবরে। তার পাশেই বাবা শুয়ে আছেন।

বাবাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ভাইজান, আপনার ছেলে পুরো গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমাদের বংশে সেই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। তার জন্যে আপনারা খাস দিলে দোয়া করবেন। একদিন সে বড় ব্যারিস্টার হবে, ইনশাআল্লাহ। তিনি হাউ মাউ করে কাঁদছেন। আমি তাকে ধরে বাসায় নিয়ে আসলাম।

পরদিন দুপুরে দাওয়াত শেষে আমাকে নিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন।

-আজ থেকে তোর নতুন যাত্রা শুরু। এখন থেকে নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হবে। নিজ ভালো মন্দ তোর নিজের কাছেই। তোর সামনে ভালো খারাপ সব পথই খোলা থাকবে। বর্ণিল পৃথিবীর সব দুয়ার একে একে খুলতে থাকবে। কিন্তু কোন দরজাটা তোর জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে তোকেই সেটার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আল্লাহ ভরসা।

ট্রেনে উঠতেই মাথায় হাত দিয়ে সুরা পড়ে দোয়া করলেন। তারপর একটা পুরানো খাম বের করলেন।

-যেতে যেতে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়বি এটা। তোর বাবা জেলে বসে লিখে রেখে গেছেন। আমাকে বলেছেন, তুই যেদিন সব বোঝার মতো সাহস অর্জন করবি। সেদিন যেন আমি তোর হাতে এটা দেই। আমার মনে হয়, আজই সেই কাক্সিক্ষত দিন। ভালো থাক, ফিআমানিল্লাহ।

ট্রেন আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে, মহসিন কাকা হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালেন। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এই লোকটাই ছোটোবেলা থেকে আমার সবকিছু। আমার কাছে পিতা-মাতা বলতে তিনিই সব। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আসছিল। জীবনে এই প্রথম তার জন্যে কেমন যেন একটা তীব্র মায়াবোধ করলাম। খুব অস্থির লাগছিল। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল সেদিন।

ট্রেনের একটা পুরো কামরা আমাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু সময় বাইরের সবুজ পরিবেশটা দেখলাম। ঝিকঝিক শব্দটা নেশার মতো লাগছিল। হঠাৎ একজন এসে জানালো আমার কিছু লাগবে কি না?

মহসিন কাকা তাকে আমার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। জানালেন, কিছুক্ষণ পর তিনি আবারো আসবেন। তখনই হঠাৎ খামটার কথা মনে হলো। আস্তে আস্তে সেটা খুললাম।

অনেক বছর পর বাবার হাতের ছোঁয়া পেলাম। কিছুক্ষণ লেখাগুলোর দিকে স্থির তাকিয়ে থাকলাম। হাত দিয়ে বাবার স্পর্শ নেয়ার চেষ্টা করলাম। আমার চোখের পানি চিঠির উপর পড়তেই খেয়াল হলো ভিজে যেতে পারে। দ্রুতই চোখের জল মুছলাম।

বাবা পরশ,

এখন তুমি বড় হয়েছ। পৃথিবীর ভালো-মন্দ, আলোকিত-কুৎসিত রূপ নিশ্চয়ই বুঝতে শিখেছ। জেলখানার এই বদ্ধ ঘরটায় বসে প্রতিদিন ভাবি আগামীকাল হয়তো তুমি একবার আমায় দেখতে আসবে। পরদিন যখন দেখি তুমি নেই, তখন তোমার মায়ের ঘরে তালা দিয়ে আসার সেই দিনের স্মৃতিটা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। মনটা খুব শান্ত হয়। বুঝতে পারি, তুমি ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ। সেইদিনের পাপের শাস্তি আমাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। আমিও সেটা মেনে নিয়েছি। উকিলকে বলে নিজের শাস্তি স্বীকার করে তোমাকেও যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করেছি। কারণ আমি জানি, এই জীবনে আমার সামনাসামনি হওয়া মানেই সেই দুঃসহ স্মৃতিটা বারবার তোমার সামনে নিয়ে আসা। এর থেকে আমার চলে যাওয়াটাই বেশি ভালো।

ছোটোবেলা থেকে আমি ও মহসিন একসাথে বড় হয়েছি। পড়াশোনা ও শিক্ষাদীক্ষায় সবকিছুতেই সে আমার চেয়ে এগিয়ে ছিল। আমাদের আমলে এই এলাকায় সেই একমাত্র বিকম পাস। চাইলেই সে যে-কোনো বড় চাকরি করে সংসার করতে পারতো। কিন্তু আমাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি সে। আমরা তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। তোমার মা প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আমি সারাদিন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। মহসিন কলেজের সাহিত্য পত্রিকার দায়িত্ব নিল। তোমার মায়ের সাহিত্যের প্রতি অনেক দুর্বলতা। কীভাবে যেন তাদের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেল। এগুলোর কোনোকিছুই মহসিন আমাকে জানায়নি। খুব অল্পসময়ে তারা দুজন খুব কাছাকাছি চলে আসে। হঠাৎ একদিন ভালোবাসাবাসিও হয়ে যায়। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমি কি বোঝাতে চাইছি। একদিন কি একটা কাজে কলেজে একাই গেলাম আমি। মহসিনের সেদিন অনেক জ্বর। তোমার মা হয়তো আমাকে চিনতো। কাছে এসে বললো, আপনি কি মহসিন ভাইয়ের বন্ধু?

মেয়েদের সাথে আমার খুব বেশি মেশার সুযোগ হয়নি। তোমার মাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে কেবল তাকিয়ে থাকলাম। সে আবারো বললো, এই যে আপনি, শুনছেন। অসুস্থ নাকি?

আর কী কী বলেছে তার কিছুই তেমন খেয়াল নেই। আমি দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলাম। তোমার দাদা প্রভাবশালী মানুষ। তার কাছে গিয়ে সরাসরি বললাম, আব্বা আমি বিয়ে করবো।

তোমার দাদা অনেক বকাবকি করলেন। বেহায়ার বাচ্চা। নিজে চলতে পারিস না! বউকে খাওয়াবি কী?

একসময় ঠিক বুঝতে পারলেন, কিছু বলে লাভ নেই। আমি চরম জেদি ও আস্ত পাগল মানুষ। আমাকে বোঝাতে যাওয়াই চরম বোকামি।

তোমার দাদা ভাবলেন, বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে আনলে হয়তো আমি ভালো হয়ে যাবো। তিনি মহসিনকে ডেকে সবকিছু খুলে বললেন। মহসিন তখনও জানে না, পাত্রী কে! সে খুশি মনে বাবাকে বললো, একদম চিন্তা করবেন না। আমি আজই সব খবর নিয়ে আসছি।

কলেজে গিয়ে খোঁজ নিয়ে তোমার মায়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল সে। তাদের দুজনের মাথায় হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। নাসরীন কিছুতেই বিয়েতে রাজি না।

মহসিনকে বলল, দরকার হলে আমি বিষ খাবো। আপনি আমাকে যেইভাবে রাখবেন, আমি তাতেই রাজি। চলেন দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।

মহসিনের কাঁধে আমার পরিবার ও বন্ধুত্বের ঋণের বোঝা। সেই ভার থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নেই তার। তাই সে আমাকে কিছুই বলেনি। চিরদিন অভিনয় করে গেছে। দাদাকে নিয়ে তোমার মায়ের বাড়িতে হাসিমুখে গিয়ে সবকিছু ঠিক করে এসেছে। তোমার মায়ের সাথে সে আর কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি।

সে সময় মেয়েদের জীবন খুব একটা স্বাধীন ছিল না। বেশিরভাগেরই পরিবারের বাইরে মতামতের ক্ষমতা ছিল না। বাধ্য হয়ে গোপন ভালোবাসাকে গলাটিপে হত্যা করলো তারা। বিয়ের রাতে মহসিনের মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট হলো। বাঁচা মরা নিয়ে টানাটানি। বাবা নিজেই পুরোটা রাত হাসপাতালে ছিলেন। ডাক্তারকে বলেছেন, আমার ছেলে। যেভাবে পারেন সারিয়ে তুলুন। সে যাত্রায় মহসিন বেঁচে যায়। কিন্তু তার অন্তরটা যেন মরে গেছে। আসলে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সে। বিয়ের কয়েকদিন পর সে যেদিন ফিরে এলো, তোমার মা নতুন একটা খবর দিল আমাকে। আমার জন্যে সেটা ছিল চরম ধাক্কা। তোমার মা সন্তানসম্ভবা। বিয়ের সবেমাত্র কয়েকদিন হয়েছে। পুরোপুরি ভেঙে পড়লো সে। একবার বলল, আপনি চাইলে আমি আত্মহত্যা করবো। আপনাকে কোনোভাবেই ধোঁকা দিতে পারবো না আমি। আপনি যদি বলেন, এই এক কাপড়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।

পুরো বিষয়টা তখন বাধ্য হয়ে চেপে গিয়েছি। কারণ ভাবলাম, মূল অন্যায়টা তো করেছি আমি। তাদের দুজনের কারোরই কোনো দোষ ছিল না। তাছাড়া তারা তো কিছু ভাবার সময়ও পায়নি। মহসিনকে আমি ছোটোবেলা থেকেই চিনি। জেনে বুঝে আমার কোনো ক্ষতি সে কোনোদিন করবে না।

একসময় তোমার মায়ের কোলজুড়ে এলে তুমি। আমাদের বংশের একমাত্র প্রদীপ। মহসিন আমাদের সাথেই থেকে গেল। হয়তো তোমার মাকে ছেড়ে যেতে তার ইচ্ছে করেনি।

এর মধ্যে একদিন জেলখানায় দেখা করতে এলো মহসিন। তার মতো সৎমানুষ কখনো দেখিনি আমি। আমার কাছে ভাইয়ের চেয়েও বেশিকিছু সে। এটুকু নিশ্চিত জানি যতদিন সে তোমার পাশে থাকবে, তোমাকে নিয়ে চিন্তার বিশেষ কোনো কারণ নেই আমার।

তাকে জানালাম, ‘উকিল দিয়ে তোমার সব দায়িত্ব আমি তাকেই দিয়ে রেখেছি এবং তুমি বড় না হওয়া পর্যন্ত বিষয় সম্পত্তির পাওয়ার তার হাতেই অর্পণ করেছি।’

শুনে অনেকক্ষণ কাঁদলো সে।

কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, কী রে বোকা কাঁদিস কেন?

-আপনার ভালোবাসার আমি যোগ্য না ভাইজান। দীর্ঘদিন ধরে একটা অনেক বড় অন্যায় আপনার কাছে গোপন করে এসেছি। এই দায়িত্বটা দয়া করে আমাকে দেবেন না।

কিছুতেই শান্ত হয় না! অবশেষে বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কী হয়েছে তোর? আমাকে খুলে বল!

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তোমার মায়ের সাথে সম্পর্কের বিষয়টা জানালো সে। ভাবলাম পরশ নিয়ে দুশ্চিন্তাটা আজ থেকে আমার দূর হলো। আমি এখন নিশ্চিন্ত। জানি, একদিন তুমি মানুষের মতো মানুষ হবে। তোমার আসল বাপ একজন প্রকৃত ভালো মানুষ। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই খারাপ পথে নিয়ে যায় তোমাকে। তোমার শরীরে আমার রক্ত থাকলেই বরং সেটা হতো অধিক চিন্তার বিষয়।

মাথায় হাত রেখে বললাম, মহসিন। ভাই আমার। আমি খারাপ মানুষ। পরশকে তুই নিজের মতো দেখে রাখিস ভাই। কথা দে, আজীবন তাকে আগলে রাখবি?

কাঁদতে শুরু করলো সে।

-থাক আর কাঁদতে হবে না। এখন যা। আমি বরং নফল নামাজ পড়ে তোদের দুজনের জন্যে শেষবারের মতো একটু দোয়া করি।

আরেকটা কথা, পারলে আমাকে তুই ক্ষমা করিস ভাই। তোর আর নাসরীনের বিষয়টা আগে জানলে আমি অবশ্যই নিজেকে বোঝাতাম। তুই এটা নিশ্চয়ই জানিস। এ জন্যেই হয়তো এত বড় বলিদানটা দিয়েছিস তুই। তোর জায়গায় আমি হলে এটা কখনোই করতে পারতাম না।

কোনো কথা না বলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে কাঁদলাম অনেকক্ষণ। তারপর কান্না লুকিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল মহসিন। মন থেকে দীর্ঘদিনের একটা পাথর যেন হঠাৎ সরে গেল!

আকাশে সেদিন অবাক করা জোছনা! দূরের চাঁদটাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম অনেকক্ষণ। তারপর নামাজ পড়ে অনেকদিন পর শান্তির একটা ঘুম দিলাম। একটু পরে আমাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হবে। গতরাতে তোমার মাকে স্বপ্নে দেখেছি। সে আমাকে হাত ধরে হলুদ সর্ষেক্ষেতে নিয়ে গিয়েছিল। তীব্র রোদে হলুদের বিস্তৃত ফসলের মাঠে অনেকক্ষণ হেঁটেছি দুজন। একসাথে সূর্যাস্তও দেখলাম। তারপর সে হঠাৎ বলল, আমার সাথে চলেন। আমি আর একা থাকতে পারবো না!

বাবা পরশ আমি তোমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও বাপ। আজীবন তোমাকে শুধু কষ্টই দিয়েছি। একটাই অনুরোধ, পিতা হিসেবে আমার নামটাই আজীবন রেখো তুমি। এই বিষয়ে কিছুই জানে না মহসিন। বলতে পারো এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।

জাযাকাল্লাহু খাইরান।

তোমার হতভাগ্য পিতা।

সারারাত একা একাই কাঁদলাম। কখন রাজশাহী পৌঁছেছি টেরই পাইনি। লোকটা এসে ডাকতেই খেয়াল হলো। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। হাতের চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললাম। জগতের সব সত্য সবার না জানাই ভালো। বৃষ্টির মধ্যেই ট্রেন থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম।

দুনিয়া কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামুক। আমার মনের সব দুঃখ ধুয়েমুছে সাথে করে নিয়ে যাক। আজ থেকে আমি শুদ্ধ মানুষ হব...

back to top