আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। পুনঃদরপত্র আহ্বানে সরকারের প্রায় ২৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে, তবে এই প্রক্রিয়ায় যে সময়ক্ষেপণ হয়েছে তাতে প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপাতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়াতে পারে। সব বই ছাপার কার্যাদেশ এখনও দিতে পারেনি সরকার। আবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পেয়ে ইতোমধ্যে বই ছাপা শুরু করেছে, যদিও এসব বই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সরবরাহের অভিযোগ করছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা। আর এনসিটিবি কর্মকর্তার বলছেন, কাগজ, কালি ও ছাপার মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই বই গ্রহণ করা হচ্ছে।
পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দায়িত্বে থাকা ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের’ (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বছরের শুরুতে পাঠ্যপুস্তক উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণের রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু সব শিক্ষার্থীর প্রথমদিন বইয়ের প্রয়োজন হয় না। নতুন শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ায় সবাই বই পেয়ে থাকে। এ কারণে ১৫ দিন বা একমাস দেরি হলে কোন সমস্যা হয় না। চলতি শিক্ষাবর্ষেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী বই নেয়নি।
চলতি শিক্ষাবর্ষে এনসিটিবি প্রায় ৩৬ কোটি বই ছেপে বিতরণ করেছে। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ৩৫ কোটির কিছু কম বই ছাপা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বাজারজাত সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান সংবাদকে বলেন, ‘এখনও মাধ্যমিকের অনেক বইয়ের কার্যাদেশ হয়নি। প্রাক-প্রাথমিকে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনে এমন একটি ভুল করা হয়েছে যে, এটি দিয়ে বই যাবেই (ছাপানো) না। অনেক আগেই প্রি-প্রাইমারির ওয়ার্ক অর্ডার (কার্যাদেশ) হয়েছে। তবে ভুল স্পেসিফিকেশনের কারণে কাগজের অনুমোদন দিচ্ছে না এনসিটিবি। কারণ তারা যে স্পেসিফিকেশন দিয়েছে, তাতে বিশে^র কোথাও কাগজ পাওয়া যাবে না।’
কার্যাদেশ পাওয়ার আগেই অগ্রণী প্রিন্টার্সের কর্ণধার রুবেল বই মুদ্রণ শুরু করেছেন-এমন অভিযোগ করে তোফায়েল খান বলেন, ‘রুবেলের বই সম্পর্কে আমাদের কাছে কিছু অভিযোগ এসেছে, সে ডিরেক্ট হোয়াইট নিউজ প্রিন্ট কাগজে বই ছাপাচ্ছে। সে ইতোমধ্যে ২৪ লাখের মতো বই ডেলিভারি (সরবরাহ) দিয়েছে। এনসিটিবি এখনও মনিটরিং টিম গঠন করেনি, সে লোকজনকে ম্যানেজ করে চলে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে আদালতে মামলা চলছে, আজকেও শুনানি হয়েছে। এনসিটিবি আদালতে এক রকম এবং আদালতের বাইরে আরেক রকম তথ্য দিচ্ছেন।’
অগ্রণী প্রিন্টার্সের কর্ণধার কাউছার জামান রুবেল সোমবার (১৮ অক্টোবর) সংবাদকে বলেন, ‘বিষয়টি হলো আমার আর এনসিটিবির, কিন্তু এটিকে আদালতে নিয়েছে অন্যরা। আমি ইতোমধ্যে ৬৫ লাখের বেশি বই ছেপে এনসিটিবির নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছি। পুরোদমে ছাপার কাজ চলছে। আমি ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই দিয়ে দেব।’
অগ্রণী প্রিন্টার্সের ছাপার কার্যক্রম এনসিটিবি ও তাদের ইন্সপেশন এজেন্ট নিয়মিত মনিটরিং করছে জানিয়ে রুবেল বলেন, ‘নোয়াখালীতে আমার ছাপাখানায় সার্বক্ষণিক জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি নিয়োজিত রয়েছেন। তারা সবকিছুই মূল্যায়ন করছেন। আমি একটি বই নিম্নমানের কাগজে ছেপেছি, কেউ দেখাতে পারবে না।’
সার্বিকভাবে পাঠ্যবই ছাপার কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না দাবি করে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘এতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা কঠিন। মাধ্যমিকের বই ছাপার নোয়া (অনাপত্তি পত্র) দেয়া হয়েছে। নোয়া দেয়ার ২৮ দিনের মধ্যে বই ছাপার চুক্তি হচ্ছে। এরপর কার্যাদেশ দেয়ার ৬০ দিনের মধ্যে বই ছেপে দিবে ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই ছাপানো সম্ভব হবে না।’
এনসিটিবি জানিয়েছে, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার জন্য পাঁচ ভাগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) অষ্টম ও নবম শ্রেণী, ইবতেদায়ি স্তরের (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী), দাখিল স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণীর এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের ২৮০ লটের মধ্যে ৩২টি লটের বই ছাপার জন্য গত ১৪ সেপ্টেম্বর নোটিফিকেশন অফ অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) দেয়া হয়েছে।
নোয়া চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ৯৮ দিনের মধ্যে বই ছেপে মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করতে হয়। ৩২টি লটে এক কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৯৭১টি কপি বই রয়েছে। ২০৮ লটে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম, ইবতেদায়ি স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয়, দাখিল স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হয়।
তবে ২০টি লটে এক কোটি সাত লাখ ৫২ হাজার ৮৪০টি বই ছাপার নোয়া দেয়া হয় গত ৮ সেপ্টেম্বর। এতে ৭০ দিন সময় দিয়ে আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহের চুক্তি করা হয়েছে।
ওই ৩২ ও ২০টি লট ছাপা মাধ্যমিক স্তরের বাকি বই ছাপার দরপত্র নতুন করে আহ্বান করা হয়। এ কারণে বই ছাপার কাজে বিলম্ব হচ্ছে। ইতোমধ্যে মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার নোয়া দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম সোমবার সংবাদকে বলেন, ‘১১ অক্টোবর মাধ্যমিকের বই ছাপার নোয়া দেয়া শুরু হয়েছে। খুব শীঘ্রই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।’
দেরিতে নোয়া দেয়ায় ডিসেম্বর মধ্যে সব বই ছাপা সম্ভব হবে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন দেরি হলে সমস্যা হবে না। আমরা আশা করছি, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে বই ছাপার কাজ শেষ করতে পারবো।’
এবার অষ্টম ও নবম শ্রেণী, মাদ্রাসার তৃতীয় থেকে নবম শ্রেণী এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের ২৪৮ লটের বই ছাপার জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। এসব লটে দশ কোটি সাত লাখ ৫২ হাজার ৮৪০টি ছাপানো হবে।
পুনঃদরপত্রে ২৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় :
পুনঃদরপত্র আহ্বানের বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা কয়েকদিন আগে সংবাদকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা মিলে একসঙ্গে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি ব্যয় দেখিয়ে দরপত্র জমা দেয়। এ কারণে টেন্ডার বাতিল করে রি-টেন্ডার করা হয়েছে। রি-টেন্ডারে ৭০ দিনের মধ্যে বই সরবরাহের শর্ত দেয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি চুক্তি করতে পারলে ডিসেম্বরের মধ্যে বই ছাপা শেষ হবে।’
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মাধ্যমিক স্তরের সব বই ছাপাতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু মুদ্রাকররা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি ব্যয় ধরে দরপত্র আহ্বান করেছিল। এরপর পুনঃদরপত্র আহ্বানের সিন্ধান্ত নেয় এনসিটিবি।
পুণ:দরপত্রে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কম ব্যয় দেখিয়ে দরপত্রে অংশ নেয় মুদ্রাকররা। পুণ:দরপত্রে সরকারের প্রায় ২৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম।
এ বিষয়ে তোফায়েল খান বলেন, এনসিটিবির কর্মকর্তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান কাজ না পাওয়ার কারণেই রি-টেন্ডার করা হয়। এনসিটিবির দরপত্রের চেয়ে এক বা দুই শতাংশ দর বেশি দেয়ায় কাজ দেয়নি। অথচ প্রি-প্রাইমারির কাগজের জন্য অনেক বাড়তি দর দিলেও বড় টেন্ডারগুলো বাতিল করা হয়নি।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৪৮টি লটে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম এবং মাদ্রাসার প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণীর ১১ কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৫টি বই ছাপার জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয় গত ১৯ জুলাই। এসব বই ছাপার নোয়া দেয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি সদস্য প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম।
তিনি জানান, এনসিটিবি ছাপাখানার সক্ষমতা যাচাই করেই কার্যাদেশ দিচ্ছে। বিগত বছরে একটি প্রেস প্রাথমিকে বই ছাপার সঙ্গে মাধ্যমিকের কাজ করতো। এবার সে সুযোগ নেই। এ কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছে বলেও জানান ফরহাদুল ইসলাম।
প্রাথমিকের বই ছাপা :
প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের জন্য ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৯২ হাজার ২৮৮টি বই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দুই লাখ ৩৬৪টি বই রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকের বই ও টিচিং প্যাকেজ ছাপানোর জন্য ছয়টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৬০ লাখ বই ও টিচিং প্যাকেজ মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে আগামী শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রমে বই ছাপার পরিকল্পনা থাকায় কিছুটা বিলম্বে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার জন্য ৯৮টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ৪৬টি লট এনসিটিবি নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরপত্র জমা দেয়ায় নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
বাকি ৫২টি লটের বই ছাপার জন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে গত ১২ সেপ্টেম্বর চুক্তি করে এনসিটিবি, যার মধ্যে এক ব্যক্তিই ৪৬টি লটের কাজ পেয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৮৪ দিন অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই স্কুল পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার শর্ত রয়েছে। কিন্তু ৪৬টি লটের দরপত্র বিলম্বে আহ্বান করায় ১ জানুয়ারির আগে বই সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে।
সোমবার, ১৮ অক্টোবর ২০২১
আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। পুনঃদরপত্র আহ্বানে সরকারের প্রায় ২৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে, তবে এই প্রক্রিয়ায় যে সময়ক্ষেপণ হয়েছে তাতে প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপাতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়াতে পারে। সব বই ছাপার কার্যাদেশ এখনও দিতে পারেনি সরকার। আবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পেয়ে ইতোমধ্যে বই ছাপা শুরু করেছে, যদিও এসব বই পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সরবরাহের অভিযোগ করছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা। আর এনসিটিবি কর্মকর্তার বলছেন, কাগজ, কালি ও ছাপার মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই বই গ্রহণ করা হচ্ছে।
পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দায়িত্বে থাকা ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের’ (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বছরের শুরুতে পাঠ্যপুস্তক উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণের রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু সব শিক্ষার্থীর প্রথমদিন বইয়ের প্রয়োজন হয় না। নতুন শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ায় সবাই বই পেয়ে থাকে। এ কারণে ১৫ দিন বা একমাস দেরি হলে কোন সমস্যা হয় না। চলতি শিক্ষাবর্ষেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী বই নেয়নি।
চলতি শিক্ষাবর্ষে এনসিটিবি প্রায় ৩৬ কোটি বই ছেপে বিতরণ করেছে। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ৩৫ কোটির কিছু কম বই ছাপা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বাজারজাত সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান সংবাদকে বলেন, ‘এখনও মাধ্যমিকের অনেক বইয়ের কার্যাদেশ হয়নি। প্রাক-প্রাথমিকে টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনে এমন একটি ভুল করা হয়েছে যে, এটি দিয়ে বই যাবেই (ছাপানো) না। অনেক আগেই প্রি-প্রাইমারির ওয়ার্ক অর্ডার (কার্যাদেশ) হয়েছে। তবে ভুল স্পেসিফিকেশনের কারণে কাগজের অনুমোদন দিচ্ছে না এনসিটিবি। কারণ তারা যে স্পেসিফিকেশন দিয়েছে, তাতে বিশে^র কোথাও কাগজ পাওয়া যাবে না।’
কার্যাদেশ পাওয়ার আগেই অগ্রণী প্রিন্টার্সের কর্ণধার রুবেল বই মুদ্রণ শুরু করেছেন-এমন অভিযোগ করে তোফায়েল খান বলেন, ‘রুবেলের বই সম্পর্কে আমাদের কাছে কিছু অভিযোগ এসেছে, সে ডিরেক্ট হোয়াইট নিউজ প্রিন্ট কাগজে বই ছাপাচ্ছে। সে ইতোমধ্যে ২৪ লাখের মতো বই ডেলিভারি (সরবরাহ) দিয়েছে। এনসিটিবি এখনও মনিটরিং টিম গঠন করেনি, সে লোকজনকে ম্যানেজ করে চলে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে আদালতে মামলা চলছে, আজকেও শুনানি হয়েছে। এনসিটিবি আদালতে এক রকম এবং আদালতের বাইরে আরেক রকম তথ্য দিচ্ছেন।’
অগ্রণী প্রিন্টার্সের কর্ণধার কাউছার জামান রুবেল সোমবার (১৮ অক্টোবর) সংবাদকে বলেন, ‘বিষয়টি হলো আমার আর এনসিটিবির, কিন্তু এটিকে আদালতে নিয়েছে অন্যরা। আমি ইতোমধ্যে ৬৫ লাখের বেশি বই ছেপে এনসিটিবির নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছি। পুরোদমে ছাপার কাজ চলছে। আমি ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই দিয়ে দেব।’
অগ্রণী প্রিন্টার্সের ছাপার কার্যক্রম এনসিটিবি ও তাদের ইন্সপেশন এজেন্ট নিয়মিত মনিটরিং করছে জানিয়ে রুবেল বলেন, ‘নোয়াখালীতে আমার ছাপাখানায় সার্বক্ষণিক জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি নিয়োজিত রয়েছেন। তারা সবকিছুই মূল্যায়ন করছেন। আমি একটি বই নিম্নমানের কাগজে ছেপেছি, কেউ দেখাতে পারবে না।’
সার্বিকভাবে পাঠ্যবই ছাপার কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না দাবি করে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, ‘এতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা কঠিন। মাধ্যমিকের বই ছাপার নোয়া (অনাপত্তি পত্র) দেয়া হয়েছে। নোয়া দেয়ার ২৮ দিনের মধ্যে বই ছাপার চুক্তি হচ্ছে। এরপর কার্যাদেশ দেয়ার ৬০ দিনের মধ্যে বই ছেপে দিবে ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই ছাপানো সম্ভব হবে না।’
এনসিটিবি জানিয়েছে, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার জন্য পাঁচ ভাগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) অষ্টম ও নবম শ্রেণী, ইবতেদায়ি স্তরের (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী), দাখিল স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণীর এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের ২৮০ লটের মধ্যে ৩২টি লটের বই ছাপার জন্য গত ১৪ সেপ্টেম্বর নোটিফিকেশন অফ অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) দেয়া হয়েছে।
নোয়া চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ৯৮ দিনের মধ্যে বই ছেপে মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করতে হয়। ৩২টি লটে এক কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৯৭১টি কপি বই রয়েছে। ২০৮ লটে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম, ইবতেদায়ি স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয়, দাখিল স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হয়।
তবে ২০টি লটে এক কোটি সাত লাখ ৫২ হাজার ৮৪০টি বই ছাপার নোয়া দেয়া হয় গত ৮ সেপ্টেম্বর। এতে ৭০ দিন সময় দিয়ে আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহের চুক্তি করা হয়েছে।
ওই ৩২ ও ২০টি লট ছাপা মাধ্যমিক স্তরের বাকি বই ছাপার দরপত্র নতুন করে আহ্বান করা হয়। এ কারণে বই ছাপার কাজে বিলম্ব হচ্ছে। ইতোমধ্যে মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার নোয়া দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম সোমবার সংবাদকে বলেন, ‘১১ অক্টোবর মাধ্যমিকের বই ছাপার নোয়া দেয়া শুরু হয়েছে। খুব শীঘ্রই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।’
দেরিতে নোয়া দেয়ায় ডিসেম্বর মধ্যে সব বই ছাপা সম্ভব হবে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন দেরি হলে সমস্যা হবে না। আমরা আশা করছি, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে বই ছাপার কাজ শেষ করতে পারবো।’
এবার অষ্টম ও নবম শ্রেণী, মাদ্রাসার তৃতীয় থেকে নবম শ্রেণী এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের ২৪৮ লটের বই ছাপার জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। এসব লটে দশ কোটি সাত লাখ ৫২ হাজার ৮৪০টি ছাপানো হবে।
পুনঃদরপত্রে ২৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় :
পুনঃদরপত্র আহ্বানের বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা কয়েকদিন আগে সংবাদকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা মিলে একসঙ্গে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি ব্যয় দেখিয়ে দরপত্র জমা দেয়। এ কারণে টেন্ডার বাতিল করে রি-টেন্ডার করা হয়েছে। রি-টেন্ডারে ৭০ দিনের মধ্যে বই সরবরাহের শর্ত দেয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি চুক্তি করতে পারলে ডিসেম্বরের মধ্যে বই ছাপা শেষ হবে।’
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মাধ্যমিক স্তরের সব বই ছাপাতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। কিন্তু মুদ্রাকররা প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি ব্যয় ধরে দরপত্র আহ্বান করেছিল। এরপর পুনঃদরপত্র আহ্বানের সিন্ধান্ত নেয় এনসিটিবি।
পুণ:দরপত্রে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কম ব্যয় দেখিয়ে দরপত্রে অংশ নেয় মুদ্রাকররা। পুণ:দরপত্রে সরকারের প্রায় ২৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম।
এ বিষয়ে তোফায়েল খান বলেন, এনসিটিবির কর্মকর্তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান কাজ না পাওয়ার কারণেই রি-টেন্ডার করা হয়। এনসিটিবির দরপত্রের চেয়ে এক বা দুই শতাংশ দর বেশি দেয়ায় কাজ দেয়নি। অথচ প্রি-প্রাইমারির কাগজের জন্য অনেক বাড়তি দর দিলেও বড় টেন্ডারগুলো বাতিল করা হয়নি।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৪৮টি লটে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম এবং মাদ্রাসার প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণীর ১১ কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৫টি বই ছাপার জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয় গত ১৯ জুলাই। এসব বই ছাপার নোয়া দেয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি সদস্য প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম।
তিনি জানান, এনসিটিবি ছাপাখানার সক্ষমতা যাচাই করেই কার্যাদেশ দিচ্ছে। বিগত বছরে একটি প্রেস প্রাথমিকে বই ছাপার সঙ্গে মাধ্যমিকের কাজ করতো। এবার সে সুযোগ নেই। এ কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছে বলেও জানান ফরহাদুল ইসলাম।
প্রাথমিকের বই ছাপা :
প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের জন্য ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৯২ হাজার ২৮৮টি বই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দুই লাখ ৩৬৪টি বই রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকের বই ও টিচিং প্যাকেজ ছাপানোর জন্য ছয়টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৬০ লাখ বই ও টিচিং প্যাকেজ মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে বলে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে আগামী শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রমে বই ছাপার পরিকল্পনা থাকায় কিছুটা বিলম্বে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার জন্য ৯৮টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ৪৬টি লট এনসিটিবি নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরপত্র জমা দেয়ায় নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
বাকি ৫২টি লটের বই ছাপার জন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে গত ১২ সেপ্টেম্বর চুক্তি করে এনসিটিবি, যার মধ্যে এক ব্যক্তিই ৪৬টি লটের কাজ পেয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৮৪ দিন অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই স্কুল পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার শর্ত রয়েছে। কিন্তু ৪৬টি লটের দরপত্র বিলম্বে আহ্বান করায় ১ জানুয়ারির আগে বই সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে।