alt

মুক্ত আলোচনা

ডিঙ্গাপোতা হাওরের হাতছানি

লায়লা আরজুমান

: বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১

প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি হাওর। হাওর, এক বিশাল জলাশয় যা বর্ষাকালে সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। পানি প্রায় পাঁচ- ছয় মাস থাকার পর শুকিয়ে বিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে পরিণত হয়। চারিদিকে তখন সবুজ আর সবুজ ধানক্ষেত। যখন পানি অল্প থাকে তখন পানির নিচে থাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে এবং গাড়িতেও চলাচল করা যায়। তখন দৃশ্যটা দূর থেকে বেশ বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে । মনে হয়, গাড়ি আর নৌকা পাশাপাশি হাওরে ভেসে ভেসে চলছে। আবার আস্তে আস্তে পানি বৃদ্ধি পেয়ে চারদিক অথৈ পানিতে তলিয়ে গেলে, জলযানই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠে।

নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় বিশাল ‘ডিঙ্গাপোতা’ হাওরের অবস্থান। এই হাওরের সৌন্দর্য্যের কথা অনেক শোনা যায়। হাওরটির মোট আয়তন প্রায় ৮৫০০ হেক্টর। এখানে প্রায় পাচঁ-ছয় (জ্যৈষ্ঠ-কার্তিক) মাস পানি থাকে। একদিন মনস্হির করলাম স্বামী, ছোট ছেলে সাবাবসহ অকৃত্রিম সুন্দর ডিঙ্গাপোতা হাওরটি দেখতে যাবো। আশ্বিন মাসের রৌদ্রজ্জ্বল এক দুপুরে সুন্দর সেই ডিঙ্গাপোতা হাওরটি দেখার উদ্দেশ্যে মোহনগঞ্জ সদর থেকে গাড়ি যোগে রওনা হলাম। যাত্রাপথের দুইপাশে ঘন সবুজ গাছ আর মাঝে মাঝে সবুজ ধানের ক্ষেত। কিছুদূর পর পর চারিদিকে পানি আর গাছপালায় ঘেরা বাড়িঘরগুলিকে দ্বীপের মতো লাগছিল। রাস্তার দু’ধার দিয়ে হাওরের সৌন্দর্য্য ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে থাকে। কিছু বড় বড় গাছ অর্ধেক পানির নিচে ডুবে থেকে অনেকটা ম্যানগ্রোভের বনের মত মনে হচ্ছিল। কোথাওবা গাছের মাথায় সাদা বক লম্বা পায়ের উপর ভর দিয়ে যেন গভীর ধ্যানে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপরই ঘুঘুর ডাক এর সাথে দু’পাশে কাশফুলগুলো স্নিগ্ধতা মাখা বাতাসে দুলে দুলে শরতের আগমনী বার্তা জানিয়ে দিচ্ছিল। সাদা কাশফুলগুলো যেন হেসে হেসে বলছে, “শরৎ এসে গেছে,শরৎ এসে গেছে।" নীল আকাশে খন্ড খন্ড শুভ্র মেঘের উড়োউড়ি আর আশ্বিনের সোনালী রোদে চারিদিক ঝলমল। মনে পড়ে গেল, কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন -

"এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল

ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;

আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ"

প্রকৃতির শোভামন্ডিত সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে হাওরের কাছাকাছি পৌঁছাই। উপজেলা সদর থেকে এখানে আসতে সময় লেগেছে প্রায় বিশ মিনিটের মত। প্রবহমান হাওরের সৌন্দর্য্যের দিকে চেয়ে দেখি, কী চিত্তাকর্ষক দৃশ্য ! হাওরের এই অপরূপ দৃশ্যপট যে কোন ভ্রমনপিপাসুর মন ছুঁয়ে যাবে। চারিদিকে দোয়েল, শালিক, শ্যামা, মাছরাঙা, চড়ুইসহ নাম না জানা হরেক রকম পাখিদের কলকাকলি। ফড়িং এর ছুটোছুটি। বাতাসে হঠাৎ ভেসে আসে শেফালী ফুলের সুবাস। বোঝাই যায়, আশেপাশে কারো আঙিনায় শেফালিফুল গাছ সাদা সাদা ফুলে সজ্জিত হয়ে আছে। ডিঙাপোতা হাওরের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাই। খোলা হাওয়ায় বেশ ভালো লাগছে। স্পিডবোট যোগে বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাওরে ঘুরে সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম। রৌদ্রস্নাত দিন। হালকা বাতাস হাওরে নিয়ে আসে শীতল আমেজ। দিনের উজ্জ্বলতায় প্রকৃতি যেন আরো রূপময় হয়ে উঠেছে। হাওরের পানির দিক তাকিয়ে বহুল প্রচলিত কয়েকটি চরণ বারবার মনে হতে থাকে -

"আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে

পূবালী বাতাসে-

বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি"

গানগুলির রচয়িতা বিখ্যাত বাউল সাধক মরহুম উকিল মুন্সি। মরহুম উকিল মুন্সির সমাধিস্থল মোহনগঞ্জের জৈনপুর গ্রামে। বর্ষায় এই ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ি দিয়েই উকিল মুন্সির সমাধিস্হলে যেতে হয়। জৈনপুর গ্রামে প্রতিবছরই এই বাউল সাধকের স্মরণে উকিল মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

আমি কই যাই এই সন্ধ্যাকালে , আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, ঘরের মালিকরে দুয়ারে ভিখারী খাড়া -সহ অনেক জনপ্রিয় গান সৃষ্টি করেছেন বিখ্যাত বাউল সাধক উকিল মুন্সি। আমাদের মতো আরো অনেককে দেখি হাওরের সৌন্দর্য্য দেখতে এসেছে। সবাই নিজের মত করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছবি তুলছে, আনন্দ করছে। চকিতে দেখি, একটা পাখি হাওর থেকে ছোট একটা মাছ মুখে নিয়ে তীব্র গতিতে উপরে উড়ে গেল। চারদিকে প্রাণবন্ত পরিবেশ। মনে মনে ভাবছিলাম, কী রহস্যময় ঋতুবৈচিত্র্যের খেলা ! একই স্হানে, এক ঋতুতে সবুজ শ্যামল প্রান্তর, অন্য ঋতুতে আপন মনে বয়ে চলে পানি আর পানি। প্রকৃতি তার বৈচিত্র্যময় কারুকাজ দিয়ে দুই ঋতুতে দুই সাজে সজ্জিত হয়ে সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে দিয়েছে। এখানে শুকনো মৌসুমে চারিদিক অন্য এক অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যে রূপ ধারণ করে। বর্ষার শেষে ভেসে উঠতে থাকে উর্বর জমি। চাষাবাদ নিয়ে শুরু হয়ে যায় কৃষকের ব্যস্ততা।

নীল আকাশের নীচে শ্যামল প্রান্তরে কখনো ফুটবল, ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠে উচ্ছল কিশোরের দল। ছক্কা, চার, আউট কিংবা গোল শব্দে মুখরিত হয় এই প্রান্তর। কোনো কোনো জায়গায়, অস্থায়ী জমজমাট হাটবাজারও বসে। শুকনো মৌসুমে এখানে বিশাল জায়গা জুড়ে জেগে উঠে অনিন্দ্য সুন্দর হিজলবন। জানতে পারলাম, স্থানীয়রা এই বনকে ভালবেসে "অক্সিজেন পার্ক" বলে। হিজল ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য্যে চারিদিক থাকে মাতোয়ারা। ফুলগুলোকে শৈল্পিক কারুকার্যে সাজিয়ে গাছগুলো ধারণ করে থাকে । এখানে হিজলের সঙ্গে যেন সই পেতে মিশে থাকে বটগাছ আর করচ গাছ। তৃণভূমিতে উদ্ভিদ, প্রাণী মিলে এক মায়াময় ভুবন গড়ে তোলে হিজলবন।

এই হিজলবন দুই ঋতুতে দুই সাজে সজ্জিত হয়ে প্রকৃতির অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য সর্বত্র ছড়িয়ে দেয় । বর্ষাকালে হিজল গাছগুলির প্রায় অর্ধেক পানির নিচে ডুবে থাকে। গাছের অগ্রভাগ পানির উপরে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। হাওরের পানির স্পর্শে গাছের পাতাগুলি যেন আরো সতেজ হয়ে উঠে। এই অপরূপ দৃশ্য যে কোন মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। বর্ষায় অথৈ হাওরের জলরাশিতে নৌকায় ঘুরে ঘুরে এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। আবার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে হেঁটে হেঁটে নান্দনিক হিজল বনের বিরল সৌন্দর্য্য অনুভব করা যায়।

এই স্থান দেখলে বোঝাই যায় না, বর্ষাকালে পানিতে এতো টইটুম্বুর থাকে। চতুর্দিকে তাকিয়ে মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি দেয়; কোথা থেকে এই পানি আসে, কীভাবে আসে ? আবার কোথায় যায়। তাকিয়ে দেখি, নীল আকাশের নীচে হাওরের পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস ভেসে চলেছে। ঢেউগুলো আপন মনে নিরবে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছন্দে ছন্দে ছুটে প্রকৃতিকে কাব্যময় করে তুলেছে। বহমান ঢেউগুলোকে মনে হচ্ছে আলপনা। দূরে ঘন সবুজ গাছে ঘেরা সহজ সরল গ্রামীণ বসতি। হাওরের আশেপাশের গ্রামগুলো দেখে বারবার মনে হচ্ছিলো, হাওর পাড়ের মানুষগুলো কীভাবে জীবন সংগ্রাম করে জীবন অতিবাহিত করছে। নৌপথেই তাদের একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নৌকা করেই স্কুলে যাতায়াত করতে হয়।

হাওরবাসীদের বৈরী আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। আবার তাদের আনন্দ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল ফলন, আর মাছ সংগ্রহ করা। হাওরবাসীরা বোয়াল, আইর, পুটি, কালবাউশ, টেংরা, পাবদা, মেনি, শোল, টাকী, বাতাসি, মলা, ঢেলা, চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করতে পারে। সেই সাথে আছে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যে ভরপুর হাওর। তখন দূর দূরান্ত থেকে হাওরাঞ্চল দেখতে অনেক পর্যটক আসে। তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে সমগ্র হাওর অঞ্চল। রোদের তীব্রতা কমে আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। শেষ বিকেলের আলোয় পানি যেন ঝলমল করছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।

নীরব সন্ধ্যায় আলো-আঁধারিতে নতুন এক মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে হাওরাঞ্চল। ইতোমধ্যে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে লাল টকটকে সূর্য । মনে হচ্ছে, নীল আকাশের কপালে কে যেন সযত্নে লাল টিপ পরিয়ে দিয়েছে। সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে আকাশ লাল নীল রঙে একাকার। আকাশের নিচে ধূসর সন্ধ্যায় হাওর আরো মায়াবী হয়ে উঠে। দূরের গৃহগুলোতে আস্তে আস্তে সন্ধ্যার বাতি জ্বলে উঠছে। সাঁঝবেলায় ধুসর মেঘের নীচে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ছুটে চলেছে নীড়ের সন্ধানে। এদিকে আমাদের ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। পেছন ফিরে আবার আমরা ডিঙাপুতা হাওরের দিকে তাকাই। অপার সৌন্দর্য্য নীরবে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নিঝুম নিঃস্তব্ধ অপরূপ হাওর ছেড়ে আস্তে আস্তে কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক শহরের দিকে এগিয়ে চললাম। সাথে নিয়ে এলাম, মনের ক্যানভাসে আঁকা অপূর্ব ডিঙ্গাপুতা হাওর ভ্রমণের এক মুগ্ধতার চিত্র ।

রিলিফ

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

tab

মুক্ত আলোচনা

ডিঙ্গাপোতা হাওরের হাতছানি

লায়লা আরজুমান

বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন ২০২১

প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি হাওর। হাওর, এক বিশাল জলাশয় যা বর্ষাকালে সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। পানি প্রায় পাঁচ- ছয় মাস থাকার পর শুকিয়ে বিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে পরিণত হয়। চারিদিকে তখন সবুজ আর সবুজ ধানক্ষেত। যখন পানি অল্প থাকে তখন পানির নিচে থাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে এবং গাড়িতেও চলাচল করা যায়। তখন দৃশ্যটা দূর থেকে বেশ বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে । মনে হয়, গাড়ি আর নৌকা পাশাপাশি হাওরে ভেসে ভেসে চলছে। আবার আস্তে আস্তে পানি বৃদ্ধি পেয়ে চারদিক অথৈ পানিতে তলিয়ে গেলে, জলযানই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠে।

নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় বিশাল ‘ডিঙ্গাপোতা’ হাওরের অবস্থান। এই হাওরের সৌন্দর্য্যের কথা অনেক শোনা যায়। হাওরটির মোট আয়তন প্রায় ৮৫০০ হেক্টর। এখানে প্রায় পাচঁ-ছয় (জ্যৈষ্ঠ-কার্তিক) মাস পানি থাকে। একদিন মনস্হির করলাম স্বামী, ছোট ছেলে সাবাবসহ অকৃত্রিম সুন্দর ডিঙ্গাপোতা হাওরটি দেখতে যাবো। আশ্বিন মাসের রৌদ্রজ্জ্বল এক দুপুরে সুন্দর সেই ডিঙ্গাপোতা হাওরটি দেখার উদ্দেশ্যে মোহনগঞ্জ সদর থেকে গাড়ি যোগে রওনা হলাম। যাত্রাপথের দুইপাশে ঘন সবুজ গাছ আর মাঝে মাঝে সবুজ ধানের ক্ষেত। কিছুদূর পর পর চারিদিকে পানি আর গাছপালায় ঘেরা বাড়িঘরগুলিকে দ্বীপের মতো লাগছিল। রাস্তার দু’ধার দিয়ে হাওরের সৌন্দর্য্য ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে থাকে। কিছু বড় বড় গাছ অর্ধেক পানির নিচে ডুবে থেকে অনেকটা ম্যানগ্রোভের বনের মত মনে হচ্ছিল। কোথাওবা গাছের মাথায় সাদা বক লম্বা পায়ের উপর ভর দিয়ে যেন গভীর ধ্যানে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপরই ঘুঘুর ডাক এর সাথে দু’পাশে কাশফুলগুলো স্নিগ্ধতা মাখা বাতাসে দুলে দুলে শরতের আগমনী বার্তা জানিয়ে দিচ্ছিল। সাদা কাশফুলগুলো যেন হেসে হেসে বলছে, “শরৎ এসে গেছে,শরৎ এসে গেছে।" নীল আকাশে খন্ড খন্ড শুভ্র মেঘের উড়োউড়ি আর আশ্বিনের সোনালী রোদে চারিদিক ঝলমল। মনে পড়ে গেল, কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন -

"এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল

ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;

আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ"

প্রকৃতির শোভামন্ডিত সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে হাওরের কাছাকাছি পৌঁছাই। উপজেলা সদর থেকে এখানে আসতে সময় লেগেছে প্রায় বিশ মিনিটের মত। প্রবহমান হাওরের সৌন্দর্য্যের দিকে চেয়ে দেখি, কী চিত্তাকর্ষক দৃশ্য ! হাওরের এই অপরূপ দৃশ্যপট যে কোন ভ্রমনপিপাসুর মন ছুঁয়ে যাবে। চারিদিকে দোয়েল, শালিক, শ্যামা, মাছরাঙা, চড়ুইসহ নাম না জানা হরেক রকম পাখিদের কলকাকলি। ফড়িং এর ছুটোছুটি। বাতাসে হঠাৎ ভেসে আসে শেফালী ফুলের সুবাস। বোঝাই যায়, আশেপাশে কারো আঙিনায় শেফালিফুল গাছ সাদা সাদা ফুলে সজ্জিত হয়ে আছে। ডিঙাপোতা হাওরের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাই। খোলা হাওয়ায় বেশ ভালো লাগছে। স্পিডবোট যোগে বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাওরে ঘুরে সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম। রৌদ্রস্নাত দিন। হালকা বাতাস হাওরে নিয়ে আসে শীতল আমেজ। দিনের উজ্জ্বলতায় প্রকৃতি যেন আরো রূপময় হয়ে উঠেছে। হাওরের পানির দিক তাকিয়ে বহুল প্রচলিত কয়েকটি চরণ বারবার মনে হতে থাকে -

"আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে

পূবালী বাতাসে-

বাদাম দেইখ্যা, চাইয়া থাকি"

গানগুলির রচয়িতা বিখ্যাত বাউল সাধক মরহুম উকিল মুন্সি। মরহুম উকিল মুন্সির সমাধিস্থল মোহনগঞ্জের জৈনপুর গ্রামে। বর্ষায় এই ডিঙ্গাপোতা হাওর পাড়ি দিয়েই উকিল মুন্সির সমাধিস্হলে যেতে হয়। জৈনপুর গ্রামে প্রতিবছরই এই বাউল সাধকের স্মরণে উকিল মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

আমি কই যাই এই সন্ধ্যাকালে , আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, ঘরের মালিকরে দুয়ারে ভিখারী খাড়া -সহ অনেক জনপ্রিয় গান সৃষ্টি করেছেন বিখ্যাত বাউল সাধক উকিল মুন্সি। আমাদের মতো আরো অনেককে দেখি হাওরের সৌন্দর্য্য দেখতে এসেছে। সবাই নিজের মত করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছবি তুলছে, আনন্দ করছে। চকিতে দেখি, একটা পাখি হাওর থেকে ছোট একটা মাছ মুখে নিয়ে তীব্র গতিতে উপরে উড়ে গেল। চারদিকে প্রাণবন্ত পরিবেশ। মনে মনে ভাবছিলাম, কী রহস্যময় ঋতুবৈচিত্র্যের খেলা ! একই স্হানে, এক ঋতুতে সবুজ শ্যামল প্রান্তর, অন্য ঋতুতে আপন মনে বয়ে চলে পানি আর পানি। প্রকৃতি তার বৈচিত্র্যময় কারুকাজ দিয়ে দুই ঋতুতে দুই সাজে সজ্জিত হয়ে সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে দিয়েছে। এখানে শুকনো মৌসুমে চারিদিক অন্য এক অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যে রূপ ধারণ করে। বর্ষার শেষে ভেসে উঠতে থাকে উর্বর জমি। চাষাবাদ নিয়ে শুরু হয়ে যায় কৃষকের ব্যস্ততা।

নীল আকাশের নীচে শ্যামল প্রান্তরে কখনো ফুটবল, ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠে উচ্ছল কিশোরের দল। ছক্কা, চার, আউট কিংবা গোল শব্দে মুখরিত হয় এই প্রান্তর। কোনো কোনো জায়গায়, অস্থায়ী জমজমাট হাটবাজারও বসে। শুকনো মৌসুমে এখানে বিশাল জায়গা জুড়ে জেগে উঠে অনিন্দ্য সুন্দর হিজলবন। জানতে পারলাম, স্থানীয়রা এই বনকে ভালবেসে "অক্সিজেন পার্ক" বলে। হিজল ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য্যে চারিদিক থাকে মাতোয়ারা। ফুলগুলোকে শৈল্পিক কারুকার্যে সাজিয়ে গাছগুলো ধারণ করে থাকে । এখানে হিজলের সঙ্গে যেন সই পেতে মিশে থাকে বটগাছ আর করচ গাছ। তৃণভূমিতে উদ্ভিদ, প্রাণী মিলে এক মায়াময় ভুবন গড়ে তোলে হিজলবন।

এই হিজলবন দুই ঋতুতে দুই সাজে সজ্জিত হয়ে প্রকৃতির অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য সর্বত্র ছড়িয়ে দেয় । বর্ষাকালে হিজল গাছগুলির প্রায় অর্ধেক পানির নিচে ডুবে থাকে। গাছের অগ্রভাগ পানির উপরে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। হাওরের পানির স্পর্শে গাছের পাতাগুলি যেন আরো সতেজ হয়ে উঠে। এই অপরূপ দৃশ্য যে কোন মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। বর্ষায় অথৈ হাওরের জলরাশিতে নৌকায় ঘুরে ঘুরে এই সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। আবার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে হেঁটে হেঁটে নান্দনিক হিজল বনের বিরল সৌন্দর্য্য অনুভব করা যায়।

এই স্থান দেখলে বোঝাই যায় না, বর্ষাকালে পানিতে এতো টইটুম্বুর থাকে। চতুর্দিকে তাকিয়ে মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি দেয়; কোথা থেকে এই পানি আসে, কীভাবে আসে ? আবার কোথায় যায়। তাকিয়ে দেখি, নীল আকাশের নীচে হাওরের পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস ভেসে চলেছে। ঢেউগুলো আপন মনে নিরবে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছন্দে ছন্দে ছুটে প্রকৃতিকে কাব্যময় করে তুলেছে। বহমান ঢেউগুলোকে মনে হচ্ছে আলপনা। দূরে ঘন সবুজ গাছে ঘেরা সহজ সরল গ্রামীণ বসতি। হাওরের আশেপাশের গ্রামগুলো দেখে বারবার মনে হচ্ছিলো, হাওর পাড়ের মানুষগুলো কীভাবে জীবন সংগ্রাম করে জীবন অতিবাহিত করছে। নৌপথেই তাদের একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নৌকা করেই স্কুলে যাতায়াত করতে হয়।

হাওরবাসীদের বৈরী আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। আবার তাদের আনন্দ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল ফলন, আর মাছ সংগ্রহ করা। হাওরবাসীরা বোয়াল, আইর, পুটি, কালবাউশ, টেংরা, পাবদা, মেনি, শোল, টাকী, বাতাসি, মলা, ঢেলা, চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংগ্রহ করতে পারে। সেই সাথে আছে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যে ভরপুর হাওর। তখন দূর দূরান্ত থেকে হাওরাঞ্চল দেখতে অনেক পর্যটক আসে। তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে সমগ্র হাওর অঞ্চল। রোদের তীব্রতা কমে আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। শেষ বিকেলের আলোয় পানি যেন ঝলমল করছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।

নীরব সন্ধ্যায় আলো-আঁধারিতে নতুন এক মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে হাওরাঞ্চল। ইতোমধ্যে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে লাল টকটকে সূর্য । মনে হচ্ছে, নীল আকাশের কপালে কে যেন সযত্নে লাল টিপ পরিয়ে দিয়েছে। সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে আকাশ লাল নীল রঙে একাকার। আকাশের নিচে ধূসর সন্ধ্যায় হাওর আরো মায়াবী হয়ে উঠে। দূরের গৃহগুলোতে আস্তে আস্তে সন্ধ্যার বাতি জ্বলে উঠছে। সাঁঝবেলায় ধুসর মেঘের নীচে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ছুটে চলেছে নীড়ের সন্ধানে। এদিকে আমাদের ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। পেছন ফিরে আবার আমরা ডিঙাপুতা হাওরের দিকে তাকাই। অপার সৌন্দর্য্য নীরবে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নিঝুম নিঃস্তব্ধ অপরূপ হাওর ছেড়ে আস্তে আস্তে কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক শহরের দিকে এগিয়ে চললাম। সাথে নিয়ে এলাম, মনের ক্যানভাসে আঁকা অপূর্ব ডিঙ্গাপুতা হাওর ভ্রমণের এক মুগ্ধতার চিত্র ।

back to top