alt

মুক্ত আলোচনা

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

আমির হোসেন আমু

: বুধবার, ০২ নভেম্বর ২০২২

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে পরাজিত শক্তি যে প্রতিহিংসামূলক হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিল তারই ধারাবাহিকতা ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চারনেতার হত্যাকান্ড।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও শিশু পুত্র রাসেলসহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অনেকেই ভেবেছিল এটি একটি পরিবারকেন্দ্রিক হত্যাকান্ড। এই ভাবনায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের মন্ত্রী পরিষদের অনেক সদস্য, তৎকালীন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, রক্ষী বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর প্রধান খুনী সরকারের আনুগত্য মেনে নেয়। কিন্তু তাদের ধারণা যে ভুল তা মাত্র আড়াই মাসের মাথায় তারা বুঝতে পারে জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চারনেতা বঙ্গবন্ধুর চার ঘনিষ্ঠ সহচর শ্রদ্ধাভাজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যার পর। ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে দেশকে এগিয়ে নিতে এই চার নেতা রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। হাজার বছরের পরাধীন জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাঁর আহবানে ৩০ লাখ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছিল সেই স্বাধীন বাংলার মাটিতেই বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয় চারনেতাকে জীবন দিতে হলো জেলের ভিতরে নির্মমভাবে।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জাতীয় চারনেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় কোনো ব্যক্তিগত হত্যাকান্ড নয়, বাঙালিকে নেতৃত্বশূন্য করে স্বাধীন বাংলাদেশকে আবার নব্য পাকিস্তানে রূপান্তর করাই ছিলো স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক চক্রের মূল লক্ষ্য।

আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য জানিনা জেল হত্যাকান্ডের সময়ে আমিও ছিলাম জেলের ভিতরে। ইতিহাসের সেই নির্মম হত্যাকান্ডের বিভৎসরূপ জেলের ভিতরে বসে টের পেয়েছি। এখনো শরীর শিউরে উঠে সেই বেদনার স্মৃতি মনে পড়লে।

আমার মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধু যেদিন সপরিবারে নিহত হলেন, সকলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শেখ মণি ও রব সেরনিয়াবাতের বাসভবনে বার বার ফোন দিয়েও কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না, তখন বেশ ঘাবড়ে গেলাম। এমন সময় আলুর বাজার আমার খালার বাসার নিচে এসে বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সালাম নামের এক ছাত্রলীগ নেতা আমাকে ডাক দিল। আমি বারান্দায় আসার পর বললো নিচে আসেন। আমি নিচে আসার পর তাদের বললাম বঙ্গবন্ধু, রব সেরনিয়াবাত সবার বাসায় ফোন দিচ্ছি কেন সাড়া পেলাম না? তারা বললো সব শেষ! আমি নানককে বললাম কেরানীগঞ্জ শেখ মণির ট্রেনিং সেন্টারে ওনার একটা খবর নেয়া যেতে পারে ।নানক জানালো তিনিও নেই! আমি মুষড়ে পড়লাম কথা বলতে বলতে ইকবাল হলের পাশে রেল গেট হয়ে হাঁটার সময় হলের দিকে তাকিয়ে বললাম এখান থেকে কিছু করা যায় কিনা? নানক জানালো চারদিকে তাকিয়ে দেখেন এই পরিস্থিতিতে কিছুই করা সম্ভব নয়।

এখন অনেকে বলেন সেদিন কিছু হলো না!! আসলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের ঘটনা এমন পরিকল্পিত ছিল যে কোথাও যেন কোনো আওয়াজ না ওঠে। বঙ্গবন্ধু আমাকে গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন। আমাদের ট্রেনিং চলছিল ঢাকায়। এমনকি বঙ্গবন্ধু জেলাব্যাপী ৫ সদস্য বিশিষ্ট বাকশালের যে কমিটি ঘোষণা করেছিলেন তাদেরকেও রাজনৈতিক ট্রেনিং এর জন্য ঢাকায় জড়ো করা হয়েছিল। জেলাগুলোকে নেতৃত্বশুন্য করা হয়েছিল, যেনো জেলা পর্যায়ে প্রতিবাদে কোনো আওয়াজ না ওঠে, যা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

নানক ও সালামকে বিদায় দিয়ে আমি আজিমপুরে আমার নিজ আত্মীয়ের বাসায় উঠলাম। পরের দিন শুক্রবার নামাজ পড়ে চারদিকের কোনো খোঁজ-খবর না পেয়ে অত্যন্ত সাহস নিয়ে ফনি মজুমদার এর বাসায় চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে নোয়াখালী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক সাহেবের দেখা পেলাম। তিনি বললেন এখানে কোনো খবর নেই। এসবির লোক চারদিকে ঘোরাঘুরি করছে। তুমি চলে যাও। আমি ভিতরে ফনিদার সাথে দেখা করলে তিনি কতক্ষণ আমার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। বললেন তোমাকে জানানের মতো কোনো খবর নেই। থাকলে জানাবো। আমি চলে আসলাম।

আমি একেক দিন একেক আত্মীয়ের বাসা পাল্টাতে থাকলাম। আমাকে এসবির লোকজন ফলো করতে ছিল। কয়েকদিন পর ৭ সেপ্টেম্বর আমার এক ভগ্নিপতির বাসা থেকে রাতে গ্রেফতার করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় রেডিও স্টেশনে। যেখান থেকে কেউ ফিরে আাসে না। আমি দোয়া দুরুদ পড়তে থাকলাম। ছয়জন যেখানে বসা আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। একজন বললো কে আনতে বলেছে তাকে? শাহরিয়ার বললো আমি, তার কাছে অনেক খবর থাকতে পারে। ডালিম বললো ওনাকে ঐ রুমে নিয়ে বসাও। এরপর আমাকে একটি কাচের গ্লাসের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। বাইরে থেকে লোকজন হাঁটাচলা করলে দেখা যায়। সেখানে দেখতে পেলাম সঙ্গীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ কাইয়ুমকে। ইশারা পেয়ে আমার কাছে আসলে তাকে আমার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ফোন নম্বর দেই এবং সে যোগাযোগ করে।

পরবর্তীকালে একঘণ্টা পরে আমাকে অনেক চার্জ করা হয়।পরের দিন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় রেসকোর্সের কন্ট্রোল রুমে। সেখানে আমাকে পৌঁছে দেয় ক্যাপ্টেন আলম। কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে ছিলেন ইন্সপেক্টর রশিদ।তিনি আমাকে দেখে চিনেছিলেন, কারণ তার বাড়ি ছিল পটুয়াখালী। তিনি আমাকে বললেন আমার রিস্ক আছে, তারপরেও আপনাকে ফোনটা দিলাম, আপনার যেখানে যেখানে প্রয়োজন যোগাযোগ করতে পারেন। কারণ আপনার সময় মাত্র সন্ধ্যা পর্যন্ত। ওনারা যে এন্ট্রি করছে তাতে ফেরত যাওয়ার কথা না। আমি ঘাবড়ে গেলাম। তখন আমি বরিশালের আমার বন্ধু এসপি মামুন সাহেবকে ফোন দিলাম।তিনি জানালেন আমাদের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে , আমরা পাঠিয়েছি , পরবর্তী সময়ে কিছু আসলে জানাবো। তখন আইজি ছিলেন নুরুল ইসলাম সাহেব। আর এসএস-১ ছিলেন মোরশেদ সাহেব। মোরশেদ সাহেব ফোনে জানান আমরা একটি মিটিং করেছি। আপনাকে জয়েন্টইন্টারগেশন সেলে নিয়ে আসার। এছাড়া বাঁচানোর আর কোনো পথ নেই। আমরা আপনাকে এরেস্ট করে নিয়ে যাবো কিন্তু ছাড়া পেতে অনেক দিন লাগবে।

পরে এরেস্ট করে আমাকে যে রুমে নিয়ে আসা হলো। সেই রুমের প্রতিটি দেয়ালে রক্তের ছাপ। ছিল ইলেকট্রিক চেয়ার। মৃত্যুর আগে ভয় দেখানোর নানা সরঞ্জাম। মনে অনেক ধরনের আশংকা জাগলো। সেদিন ছিল প্রথম রোজা। আমি এক নাগারে জোহর ও আছর নামাজ পড়ে যখন সেজদায়, তখন খসখস শব্দ- স্যার উঠেন, স্যার উঠেন সময় নেই। আমি আবার ঘাবড়ে গেলাম। চেয়ে দেখি রমনা থানার ওসি আনোয়ার। তিনি আমাকে জীপে করে রমনা থানায় নিয়ে এসে ডিটেনশন এর কাগজপত্র তৈরি করে আমাকে নিয়ে সেন্ট্রাল জেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। পথে তাকে আমি বললাম জেলে অনেক নকশাল থাকে। আমাকে যেন আমাদের নেতৃবৃন্দ যেখানে আছেন, সেখানে রাখা হয়। তিনি সেন্ট্রাল জেলে পৌঁছে আমাদের যে সকল মন্ত্রী- এমপিরা আছেন তাদের সাথেই রাখতে বলে চলে যান। পরে দেখি সে আমাদের জন্য অনেক ইফতার নিয়ে এসেছে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

এরপর আমি নিউজেলে ঢুকলাম। সেখানে রুম ছিল ৪ টি। ৩টি একসাথে। আর একটা ছিল বাম পাশ সোজা হল রুমের মতো।সেল রুমের ১নং সেলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ২ নং সেলে কামরুজ্জামান সাহেব আর ৩ নং সেলে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদ ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেন সাহেব। ডিভিশন পাওয়ার কারণে আমিও খাট পেলাম, চকি পেলাম। আমার খাট ছিল ঠিক মনসুর আলী সাহেবের উল্টোপাশে। দোয়া দুরুদ আর নামাজ পড়ে আমাদের দিন কাটতো। মাঝে মাঝে আমরা বসে সিদ্ধান্তও নিতাম।

প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার এশার নামাজের পর আমরা মিলাদ শরীফ পড়তাম। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে ২ নভেম্বর সেদিন ছিল রোববার। মনসুর আলী সাহেব এশার নামাজ পড়ে বললেন, আমার শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছে। আমি আজ নিচে নামবো না। উপরে বসেই মোনাজাত করবো। তখন তাঁর মাথায় টুপি, পড়নে ছিল লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। আমরা রাতের খাওয়া শেষ করে ১ টার পরে ঘুমাতে গেলাম। এর আগে সাত/আট দিন ধরে জেলখানায় একটা গুজব ছিল জাতীয় চার নেতার সাথে সরকারের সমঝোতা বা আলোচনা হতে পারে। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামসুল হক সাহেব রাশিয়ায় যাওয়ার আগে তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে দেখা করতে এসেও এমন কথা জানিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমেদ সাহেব বিষয়টি আমাদের বলেছেন ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না বরং মুখটা ছিল অন্ধকার।

ঐ দিন রাত পৌঁনে দুইটার দিকে চারদিকে পায়ের আওয়াজ, আর খটখট শব্দ। প্রথমে ২ নম্বর রুমের গেট খোলার আওয়াজ পেলাম। আমরা জেলে প্রায় না ঘুমিয়ে কাটাতাম। এরপর আমাদের গেট খুলে মনসুর আলী সাহেবকে বললো স্যার যেতে হবে। আলোচনা আছে। ওনারাও থাকবেন । আমি বললাম সরকারের সাথে যদি আলোচনাই হয় তবে এত রাতে কেন? অনেকে আবার ভাবলেন, আলোচনার নামে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে চোখ বেঁধে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে তাদেরকেও হয়তো সেভাবে সরিয়ে দেয়া হতে পারে।

ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে যাওয়ার পর রাত ২.২০ মিনিটে প্রথম ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ পেলাম। এর ১০ মিনিট পর আবারও ব্রাশ ফায়ারের শব্দ। আমরা হতভম্ব হয়ে পড়লাম।বুঝতে পারলাম আমাদের নেতাদের কোন অঘটন ঘটেছে । সকালে নিশ্চিত হলাম জাতীয় চারনেতার কেউ আর বেঁচে নেই। জানতে পারলাম প্রথম ব্রাশ ফায়ারে মনসুর আলী সাহেব মরেননি। তিনি গোংড়ানি দিচ্ছিলেন। পরে ঘাতকরা আবার ফিরে এসে তাকে গুলি করে এবং বেয়োনেট চার্জ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। অনেকে বলেন তাজউদ্দীন আহমেদকে এভাবে হত্যা নিশ্চিত করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড যে স্বাধীনতা বিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের প্রতি বিপ্লব ছিল তার দ্বিতীয় ধাপ তারা পূরণ করলো জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে।

জাতীয় চার নেতাকে হারানোর একদিন পরে আমাদের কাছে আরেকটি ক্যু এর খবর এলো,। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেছেন। আমাদের অনেকে ভেবেছিল এবার বুঝি আমরা মুক্তি পাবো। ৫ তারিখ যায় , ৬ তারিখ যায় কোনো খবর নাই। আমি বললাম ক্যু আমাদের পক্ষে হয়নি। তাহলে আমাদের মুক্তি পেতে এত সময় লাগার কথা নয়।

এরপর ৭ তারিখ পাল্টা ক্যুর খবর আসলো। খালেদ মোশাররফ, আমার খালাতো ভাই কর্ণেল হুদা, হায়দার সাহেবরা মারা গেলেন। এভাবে একটার পর একটা দুংসবাদ আসতে থাকলো। আমরা তখন প্রতি মূহুর্তে দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। কখন আবার সামাদ সাহেব কিংবা সৈয়দ হোসেন সাহেবকে নিয়ে যেতে জেলখানায় আসে। তখনও গাজীপুরের এমপি গাজী মোজাম্মেল, তেজগাঁও’র এমপি শামীম মেসের, বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাভারের এমপি আনোয়ার জং, নারায়ণগঞ্জের এমপি তোহা সাহেব এবং কিছুদিনের জন্য জিল্লুর রহমান সাহেবকেও এই জেলে আনা হয়েছিল। আমরা অনেকে জেলে দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছি। তখন আমরা কেউ রাতে খাটে থাকতাম না। গুলি লাগার আশংকায়। সারারাত অনেক সময় জেগেই কাটিয়ে দিতাম। ১৫ আগস্ট থেকে এভাবে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত আড়াই মাস এক দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে। যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করতে পারে তাদের কাছে জাতীয় চারনেতা কোনো বিষয় নয়, কিন্তু জাতির কাছে তারা অনেক কিছু। বাঙালি জাতির জীবনে তাদের ঋণ শোধ হবার নয়।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করে তারা মূলত বাঙালির আশা-আকাঙ্খা , মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে হত্যা করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশকে তারা নব্য পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র করেছিল। মহান স্রষ্টার অশেষ কৃপায় তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মধ্যদিয়ে। শেখ হাসিনা যেহেতু ১৫ আগস্ট দেশে ছিলেন না, তাই তাকে হত্যার বার বার চেষ্টা করে খুনি চক্র। বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে থাকার কারণে আজকে ঘাতক চক্রের পরাজয় হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল্যবোধকে আবার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পিতার নির্দেশিত পথে হেঁটে দুঃখী বাঙালির মুখে হাসি ফুটিয়েছেন।তাঁর যোগ্য নেতৃত্বেই সকল সংকট উত্তরণ করে উন্নয়ন আর অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ।

[লেখক: আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

বিশ্ব শিক্ষক দিবস : শিক্ষা পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জ

tab

মুক্ত আলোচনা

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

আমির হোসেন আমু

বুধবার, ০২ নভেম্বর ২০২২

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে পরাজিত শক্তি যে প্রতিহিংসামূলক হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিল তারই ধারাবাহিকতা ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চারনেতার হত্যাকান্ড।

বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও শিশু পুত্র রাসেলসহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অনেকেই ভেবেছিল এটি একটি পরিবারকেন্দ্রিক হত্যাকান্ড। এই ভাবনায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের মন্ত্রী পরিষদের অনেক সদস্য, তৎকালীন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, রক্ষী বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর প্রধান খুনী সরকারের আনুগত্য মেনে নেয়। কিন্তু তাদের ধারণা যে ভুল তা মাত্র আড়াই মাসের মাথায় তারা বুঝতে পারে জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চারনেতা বঙ্গবন্ধুর চার ঘনিষ্ঠ সহচর শ্রদ্ধাভাজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যার পর। ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে দেশকে এগিয়ে নিতে এই চার নেতা রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। হাজার বছরের পরাধীন জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাঁর আহবানে ৩০ লাখ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছিল সেই স্বাধীন বাংলার মাটিতেই বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয় চারনেতাকে জীবন দিতে হলো জেলের ভিতরে নির্মমভাবে।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জাতীয় চারনেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় কোনো ব্যক্তিগত হত্যাকান্ড নয়, বাঙালিকে নেতৃত্বশূন্য করে স্বাধীন বাংলাদেশকে আবার নব্য পাকিস্তানে রূপান্তর করাই ছিলো স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক চক্রের মূল লক্ষ্য।

আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য জানিনা জেল হত্যাকান্ডের সময়ে আমিও ছিলাম জেলের ভিতরে। ইতিহাসের সেই নির্মম হত্যাকান্ডের বিভৎসরূপ জেলের ভিতরে বসে টের পেয়েছি। এখনো শরীর শিউরে উঠে সেই বেদনার স্মৃতি মনে পড়লে।

আমার মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধু যেদিন সপরিবারে নিহত হলেন, সকলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শেখ মণি ও রব সেরনিয়াবাতের বাসভবনে বার বার ফোন দিয়েও কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না, তখন বেশ ঘাবড়ে গেলাম। এমন সময় আলুর বাজার আমার খালার বাসার নিচে এসে বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সালাম নামের এক ছাত্রলীগ নেতা আমাকে ডাক দিল। আমি বারান্দায় আসার পর বললো নিচে আসেন। আমি নিচে আসার পর তাদের বললাম বঙ্গবন্ধু, রব সেরনিয়াবাত সবার বাসায় ফোন দিচ্ছি কেন সাড়া পেলাম না? তারা বললো সব শেষ! আমি নানককে বললাম কেরানীগঞ্জ শেখ মণির ট্রেনিং সেন্টারে ওনার একটা খবর নেয়া যেতে পারে ।নানক জানালো তিনিও নেই! আমি মুষড়ে পড়লাম কথা বলতে বলতে ইকবাল হলের পাশে রেল গেট হয়ে হাঁটার সময় হলের দিকে তাকিয়ে বললাম এখান থেকে কিছু করা যায় কিনা? নানক জানালো চারদিকে তাকিয়ে দেখেন এই পরিস্থিতিতে কিছুই করা সম্ভব নয়।

এখন অনেকে বলেন সেদিন কিছু হলো না!! আসলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের ঘটনা এমন পরিকল্পিত ছিল যে কোথাও যেন কোনো আওয়াজ না ওঠে। বঙ্গবন্ধু আমাকে গভর্নর নিয়োগ করেছিলেন। আমাদের ট্রেনিং চলছিল ঢাকায়। এমনকি বঙ্গবন্ধু জেলাব্যাপী ৫ সদস্য বিশিষ্ট বাকশালের যে কমিটি ঘোষণা করেছিলেন তাদেরকেও রাজনৈতিক ট্রেনিং এর জন্য ঢাকায় জড়ো করা হয়েছিল। জেলাগুলোকে নেতৃত্বশুন্য করা হয়েছিল, যেনো জেলা পর্যায়ে প্রতিবাদে কোনো আওয়াজ না ওঠে, যা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

নানক ও সালামকে বিদায় দিয়ে আমি আজিমপুরে আমার নিজ আত্মীয়ের বাসায় উঠলাম। পরের দিন শুক্রবার নামাজ পড়ে চারদিকের কোনো খোঁজ-খবর না পেয়ে অত্যন্ত সাহস নিয়ে ফনি মজুমদার এর বাসায় চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে নোয়াখালী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক সাহেবের দেখা পেলাম। তিনি বললেন এখানে কোনো খবর নেই। এসবির লোক চারদিকে ঘোরাঘুরি করছে। তুমি চলে যাও। আমি ভিতরে ফনিদার সাথে দেখা করলে তিনি কতক্ষণ আমার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। বললেন তোমাকে জানানের মতো কোনো খবর নেই। থাকলে জানাবো। আমি চলে আসলাম।

আমি একেক দিন একেক আত্মীয়ের বাসা পাল্টাতে থাকলাম। আমাকে এসবির লোকজন ফলো করতে ছিল। কয়েকদিন পর ৭ সেপ্টেম্বর আমার এক ভগ্নিপতির বাসা থেকে রাতে গ্রেফতার করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় রেডিও স্টেশনে। যেখান থেকে কেউ ফিরে আাসে না। আমি দোয়া দুরুদ পড়তে থাকলাম। ছয়জন যেখানে বসা আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। একজন বললো কে আনতে বলেছে তাকে? শাহরিয়ার বললো আমি, তার কাছে অনেক খবর থাকতে পারে। ডালিম বললো ওনাকে ঐ রুমে নিয়ে বসাও। এরপর আমাকে একটি কাচের গ্লাসের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। বাইরে থেকে লোকজন হাঁটাচলা করলে দেখা যায়। সেখানে দেখতে পেলাম সঙ্গীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ কাইয়ুমকে। ইশারা পেয়ে আমার কাছে আসলে তাকে আমার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ফোন নম্বর দেই এবং সে যোগাযোগ করে।

পরবর্তীকালে একঘণ্টা পরে আমাকে অনেক চার্জ করা হয়।পরের দিন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় রেসকোর্সের কন্ট্রোল রুমে। সেখানে আমাকে পৌঁছে দেয় ক্যাপ্টেন আলম। কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে ছিলেন ইন্সপেক্টর রশিদ।তিনি আমাকে দেখে চিনেছিলেন, কারণ তার বাড়ি ছিল পটুয়াখালী। তিনি আমাকে বললেন আমার রিস্ক আছে, তারপরেও আপনাকে ফোনটা দিলাম, আপনার যেখানে যেখানে প্রয়োজন যোগাযোগ করতে পারেন। কারণ আপনার সময় মাত্র সন্ধ্যা পর্যন্ত। ওনারা যে এন্ট্রি করছে তাতে ফেরত যাওয়ার কথা না। আমি ঘাবড়ে গেলাম। তখন আমি বরিশালের আমার বন্ধু এসপি মামুন সাহেবকে ফোন দিলাম।তিনি জানালেন আমাদের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে , আমরা পাঠিয়েছি , পরবর্তী সময়ে কিছু আসলে জানাবো। তখন আইজি ছিলেন নুরুল ইসলাম সাহেব। আর এসএস-১ ছিলেন মোরশেদ সাহেব। মোরশেদ সাহেব ফোনে জানান আমরা একটি মিটিং করেছি। আপনাকে জয়েন্টইন্টারগেশন সেলে নিয়ে আসার। এছাড়া বাঁচানোর আর কোনো পথ নেই। আমরা আপনাকে এরেস্ট করে নিয়ে যাবো কিন্তু ছাড়া পেতে অনেক দিন লাগবে।

পরে এরেস্ট করে আমাকে যে রুমে নিয়ে আসা হলো। সেই রুমের প্রতিটি দেয়ালে রক্তের ছাপ। ছিল ইলেকট্রিক চেয়ার। মৃত্যুর আগে ভয় দেখানোর নানা সরঞ্জাম। মনে অনেক ধরনের আশংকা জাগলো। সেদিন ছিল প্রথম রোজা। আমি এক নাগারে জোহর ও আছর নামাজ পড়ে যখন সেজদায়, তখন খসখস শব্দ- স্যার উঠেন, স্যার উঠেন সময় নেই। আমি আবার ঘাবড়ে গেলাম। চেয়ে দেখি রমনা থানার ওসি আনোয়ার। তিনি আমাকে জীপে করে রমনা থানায় নিয়ে এসে ডিটেনশন এর কাগজপত্র তৈরি করে আমাকে নিয়ে সেন্ট্রাল জেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। পথে তাকে আমি বললাম জেলে অনেক নকশাল থাকে। আমাকে যেন আমাদের নেতৃবৃন্দ যেখানে আছেন, সেখানে রাখা হয়। তিনি সেন্ট্রাল জেলে পৌঁছে আমাদের যে সকল মন্ত্রী- এমপিরা আছেন তাদের সাথেই রাখতে বলে চলে যান। পরে দেখি সে আমাদের জন্য অনেক ইফতার নিয়ে এসেছে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

এরপর আমি নিউজেলে ঢুকলাম। সেখানে রুম ছিল ৪ টি। ৩টি একসাথে। আর একটা ছিল বাম পাশ সোজা হল রুমের মতো।সেল রুমের ১নং সেলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ২ নং সেলে কামরুজ্জামান সাহেব আর ৩ নং সেলে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদ ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেন সাহেব। ডিভিশন পাওয়ার কারণে আমিও খাট পেলাম, চকি পেলাম। আমার খাট ছিল ঠিক মনসুর আলী সাহেবের উল্টোপাশে। দোয়া দুরুদ আর নামাজ পড়ে আমাদের দিন কাটতো। মাঝে মাঝে আমরা বসে সিদ্ধান্তও নিতাম।

প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার এশার নামাজের পর আমরা মিলাদ শরীফ পড়তাম। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে ২ নভেম্বর সেদিন ছিল রোববার। মনসুর আলী সাহেব এশার নামাজ পড়ে বললেন, আমার শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছে। আমি আজ নিচে নামবো না। উপরে বসেই মোনাজাত করবো। তখন তাঁর মাথায় টুপি, পড়নে ছিল লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। আমরা রাতের খাওয়া শেষ করে ১ টার পরে ঘুমাতে গেলাম। এর আগে সাত/আট দিন ধরে জেলখানায় একটা গুজব ছিল জাতীয় চার নেতার সাথে সরকারের সমঝোতা বা আলোচনা হতে পারে। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামসুল হক সাহেব রাশিয়ায় যাওয়ার আগে তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে দেখা করতে এসেও এমন কথা জানিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমেদ সাহেব বিষয়টি আমাদের বলেছেন ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না বরং মুখটা ছিল অন্ধকার।

ঐ দিন রাত পৌঁনে দুইটার দিকে চারদিকে পায়ের আওয়াজ, আর খটখট শব্দ। প্রথমে ২ নম্বর রুমের গেট খোলার আওয়াজ পেলাম। আমরা জেলে প্রায় না ঘুমিয়ে কাটাতাম। এরপর আমাদের গেট খুলে মনসুর আলী সাহেবকে বললো স্যার যেতে হবে। আলোচনা আছে। ওনারাও থাকবেন । আমি বললাম সরকারের সাথে যদি আলোচনাই হয় তবে এত রাতে কেন? অনেকে আবার ভাবলেন, আলোচনার নামে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে চোখ বেঁধে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে তাদেরকেও হয়তো সেভাবে সরিয়ে দেয়া হতে পারে।

ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে যাওয়ার পর রাত ২.২০ মিনিটে প্রথম ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ পেলাম। এর ১০ মিনিট পর আবারও ব্রাশ ফায়ারের শব্দ। আমরা হতভম্ব হয়ে পড়লাম।বুঝতে পারলাম আমাদের নেতাদের কোন অঘটন ঘটেছে । সকালে নিশ্চিত হলাম জাতীয় চারনেতার কেউ আর বেঁচে নেই। জানতে পারলাম প্রথম ব্রাশ ফায়ারে মনসুর আলী সাহেব মরেননি। তিনি গোংড়ানি দিচ্ছিলেন। পরে ঘাতকরা আবার ফিরে এসে তাকে গুলি করে এবং বেয়োনেট চার্জ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। অনেকে বলেন তাজউদ্দীন আহমেদকে এভাবে হত্যা নিশ্চিত করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড যে স্বাধীনতা বিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের প্রতি বিপ্লব ছিল তার দ্বিতীয় ধাপ তারা পূরণ করলো জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে।

জাতীয় চার নেতাকে হারানোর একদিন পরে আমাদের কাছে আরেকটি ক্যু এর খবর এলো,। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেছেন। আমাদের অনেকে ভেবেছিল এবার বুঝি আমরা মুক্তি পাবো। ৫ তারিখ যায় , ৬ তারিখ যায় কোনো খবর নাই। আমি বললাম ক্যু আমাদের পক্ষে হয়নি। তাহলে আমাদের মুক্তি পেতে এত সময় লাগার কথা নয়।

এরপর ৭ তারিখ পাল্টা ক্যুর খবর আসলো। খালেদ মোশাররফ, আমার খালাতো ভাই কর্ণেল হুদা, হায়দার সাহেবরা মারা গেলেন। এভাবে একটার পর একটা দুংসবাদ আসতে থাকলো। আমরা তখন প্রতি মূহুর্তে দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। কখন আবার সামাদ সাহেব কিংবা সৈয়দ হোসেন সাহেবকে নিয়ে যেতে জেলখানায় আসে। তখনও গাজীপুরের এমপি গাজী মোজাম্মেল, তেজগাঁও’র এমপি শামীম মেসের, বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাভারের এমপি আনোয়ার জং, নারায়ণগঞ্জের এমপি তোহা সাহেব এবং কিছুদিনের জন্য জিল্লুর রহমান সাহেবকেও এই জেলে আনা হয়েছিল। আমরা অনেকে জেলে দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছি। তখন আমরা কেউ রাতে খাটে থাকতাম না। গুলি লাগার আশংকায়। সারারাত অনেক সময় জেগেই কাটিয়ে দিতাম। ১৫ আগস্ট থেকে এভাবে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত আড়াই মাস এক দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে। যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করতে পারে তাদের কাছে জাতীয় চারনেতা কোনো বিষয় নয়, কিন্তু জাতির কাছে তারা অনেক কিছু। বাঙালি জাতির জীবনে তাদের ঋণ শোধ হবার নয়।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করে তারা মূলত বাঙালির আশা-আকাঙ্খা , মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে হত্যা করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশকে তারা নব্য পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র করেছিল। মহান স্রষ্টার অশেষ কৃপায় তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মধ্যদিয়ে। শেখ হাসিনা যেহেতু ১৫ আগস্ট দেশে ছিলেন না, তাই তাকে হত্যার বার বার চেষ্টা করে খুনি চক্র। বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে থাকার কারণে আজকে ঘাতক চক্রের পরাজয় হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল্যবোধকে আবার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পিতার নির্দেশিত পথে হেঁটে দুঃখী বাঙালির মুখে হাসি ফুটিয়েছেন।তাঁর যোগ্য নেতৃত্বেই সকল সংকট উত্তরণ করে উন্নয়ন আর অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ।

[লেখক: আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র]

back to top