alt

মুক্ত আলোচনা

হিজল-করচ-আড়াংবন

আসফাক বীন রহমান

: শনিবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৩

‘ আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে- পূবালী বাতাসে ,

বাদাম দেইখ্যা , চাইয়া থাকি,

আমার নি কেউ আসে রে। ’

---হাওরের পানিতে ভাসতে ভাসতে কোত্থেকে এই বুক মোচড়ানো গান আসছে ? একবার সাউন্ড বাড়ে ,একবার কমে; মনে হচ্ছে তরঙ্গের উঠানামা । শ্রাবণ মাসের বৃষ্টির সাথে প্রচণ্ড বাতাস আর হাওরের ঢেউ পাড়ি দিয়ে দুঃখী এক গাঁয়ের বধুর কষ্টের গানটি কে গাইছেন ? কে লিখেছেন ? দুপুরের পর থেকেই মোটামুটি আমরা ফ্রী । সন্ধ্যায় হাওরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখি, পালের নৌকা দেখি, মাইক বাজানো বিয়ের সাজানো নৌকা দেখি , দূরে দ্বীপের মত বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা --আরো অনেক দূরে দিগন্তের কাছে হবিগঞ্জের আজমিরীগন্জের বৈদ্যুতিক আলোকমালা দেখি ।

জয়েন করার সময় যে ধনু নদীকে দেখেছিলাম , সেটা এখন একাকার হয়ে গেছে হাওরের আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানির সাথে । সন্ধ্যায় হালকা হলদে বাল্বের টিমটিমে আলো বাড়ে আর কমে , তারপর টুপ করে লোডশেডিং । বিকেলে নাস্তার পর দীর্ঘ রাতের জন্য ফ্লাক্স ভর্তি চা , কলা- বিস্কিটের মওজুদ নিয়ে ডরমেটরিতে ফিরি । এই একতলা ঝুরঝুরে প্রায় পরিত্যক্ত কোয়ার্টারটি ইটনা বাজারের পিছনে ,হাসপাতাল থেকে প্রায় এক মাইল দূরে । সন্ধ্যার পর পর বারান্দার গ্রিলে তালা দিয়ে দরজা- জানালা সব বন্ধ করে দিতে হয় নিরাপত্তার খাতিরে । পুরো কোয়ার্টারটি অনেকগুলো বিশাল সেগুন গাছ দিয়ে ঘেরা । পাশের কোয়ার্টারটি শিড়িষ গাছ দিয়ে ঘেরাও করা ।

সন্ধ্যায় প্রতিদিন আমাদের খোঁজ-খবর নিতে আসেন সিনিয়র স্টাফ নার্স জাহাঙ্গীর , সাথে আসেন হাসপাতালের আনিস- আকরাম সাহেব । মাঝে মাঝে এলাকার বিশিষ্ট মানুষজন কলে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যেতে আসেন । কলে বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে যাওয়া একটা বিশাল স্ট্যাটাসের ব্যাপার ; এজন্য তদবির পার্টিও আসে । এই অপরিচিত লোকজনের সাথে বেড়ুনো রিস্কি। কখন ধাক্কা দিয়ে অন্ধকার হাওরে ফেলে দেয় , ঠিক ঠিকানা নাই ।

আধা মাইল পরপরই পানি । নৌকা ছাড়া অন্য কোন বাহন নাই । এখানে ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে গিয়ে ম্যানেজার সাহেবের রুমে উনাকে না পেয়ে কিছুটা সময় বসে আবার নক করি। আগে থেকেই রুমে থাকা লুঙ্গি পরিহিত সুখী চেহারার ভদ্রলোকটি বললেন আমিই ম্যানেজার । উনার রুমে দুজন পুরুষ স্টাফকে ডেকে আমার অ্যাকাউন্ট নাম্বার খুলে দেওয়ার তাগিদ দিতে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন , হাসপাতালের নতুন ডাক্তারসাহেব । ওমা ! এরাও দেখি লুঙ্গি পড়া ; পায়ে প্লাস্টিকের পাম্প সু ! এখানের স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন ঠাকুর সাহেবকে বিকেলে বা সন্ধ্যায় যখনি দেখেছি খালি পায়ে ঘোরাঘুরি করেন । বিষয়টি নিয়ে একদিন ইন্ডিকেট করতেই , হোঃ হোঃ করে হেসে বলেন- ‘দুই মিনিট পরপর প্যাঁক-পানি , স্যান্ডেল- জুতা পরলে অসুবিধা । ’

জাহাঙ্গীর সাহেবকে ঐ গানের ব্যাপারে জানতে চাইলে , জানান উকিল মুন্সির এই গানটি ডঃ হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় বারী সিদ্দিকী গেয়েছেন । আমরা অপেক্ষায় থাকি ,কখন ভোর হবে ? প্রায় রাতেই পার্শ্ববর্তী ঋষি পাড়ায় কীর্তন,ঢোল- করতালের আওয়াজে মনে হয় আমাদের আশেপাশে লোকজন আছে । আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যেই শুনশান নীরবতা । এটা এক দিক থেকে আমাদের জন্য ভালই - পোস্ট গ্রাজুয়েশন ভর্তির জন্য পড়াশোনা করার উপযুক্ত ঠান্ডা পরিবেশ ।

টিএইচএফপিও সাহেব হাসপাতাল থেকে জানালা দিয়ে সর্বোচ্চ বিশ ফুট দূরের হাওরে প্রায় সময়ই উদাস হয়ে কি যেন দেখেন ! জানালা দিয়ে ঝকঝকে সাদা আকাশ আর নীল পানিতে অর্ধ- বৃত্তাকারে বিশাল ঢেউ তুলে এগিয়ে আসা স্পিডবোট দেখে মনে হয় টিভিতে দেখা মায়ামী বিচ । আমরা মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দূরের বালুর বার্জ,ট্রলার,লঞ্চ,বড় বড় বাঁশের ভেলা(মাচালি) দেখে প্রশংসা করলে স্যার আমাদেরকে ধমক দেন, “ তুমরার কপালে শনি আছে ! এই হাওরের মায়ায় পড়লে শিকড় গজাইবো ? আর বাইর হইতে পারবা না । কাইলকা কোন সাবজেক্ট পড়ছো ? পড়া দেও !” স্যার আরো বলেন , “নো ডিগ্রী, নো প্রমোশন ; উপজেলায় পইচ্চা মরতে হইবো ।” টিএইচএফপিও খালেক তালুকদার স্যার প্রায়ই আমাদের পড়াশোনার খোঁজ নেন -দ্রুত কোন একটি কোর্সে ভর্তি হবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টার কথা বলেন । স্যার ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এমবিবিএস পাস করার পরও নিজের অপ্রাপ্তির কথা বলেন । চাকুরীর প্রথমেই প্র্যাকটিসের মোহে পড়লে ডিগ্রী করাটা কঠিন হয়ে যাবে ।এজন্য যেকোনো পোস্ট গ্রাজুয়েশন পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ছুটি চাইলেই মঞ্জুর করেন ।

‘ প্রতিদিন মাছ খেতে খেতে আর ভালো লাগছে না , এখানে পোলাও- বিরিয়ানীর ব্যবস্থা নাই ?’-অপু ভাইয়ের এই আকুতি আমারও । হাসপাতালের পোর্টার আলী মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে , “ চলেন স্যার , আমি জানি কোন হডেলে পোলাও -বিরানি পাওয়া যায়।” ইটনা বাজারে বৃষ্টির মধ্যে আয়াত আলি বোর্ডিঙের আশেপাশে ঘুরিয়ে একটি ভাতের হোটেলে বসিয়ে বলে , “ স্যার আইজকা পোলাও- বিরানি রান্দে নাই। এরা মুড়িঘন্ট খুব ভালা বানায়।” ভদ্রতার খাতিরে এটা খেয়েই ফেরত আসি । গরীব মানুষের কাছে হোটেলের পোলাও -বিরিয়ানী বা মুড়িঘন্ট সবই প্রচন্ড উপাদেয় ।

বিকেলের নাস্তায় ভেরিয়েশন আনতে ডাঃ পাহাড়ী একেবারে হাওরের সীমানার বাঁশের টং মার্কা হোটেলে নিয়ে আসে ।

হাওরের তাজা মাছের গরম গরম হলুদ- লবণ মাখানো ফ্রাই খেয়ে ডাঃ অপুর মতো পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুঁত খুঁত করা মানুষও জানতে চান , আর কী কী মাছের ফ্রাই তৈরি হয় । “এই টাটহা মাছের ভাজি ঢাহায় কই পাইবেন স্যার ?” হোটেল ম্যানেজারের কথায় আমরা তিনজনই সায় দেই । হোটেলওয়ালা পাশের চায়ের দোকান থেকে গরম গরম দুধ, লবণ মিশিয়ে এনে আমাদেরকে খেতে দেন । আমি আর অপু ভাই মুখ চাওয়া -চাওয়ি করলেও পাহাড়ী বিনা দ্বিধায় গ্লাসটি নেয়,আমাদেরকেও অনুরোধ করে গরম দুধ খেয়ে ফেলার জন্য । দুধের দাম দিতে গেলে ম্যানেজার অস্বীকৃতি জানিয়ে আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান , তার ভাঙ্গাচোরা বাঁশের টংয়ের হোটেলে বসে খাবার জন্য । অপু ভাই বলেন,“ তিন তিন জন সরকারি ডাক্তার এইখানে বসে খেয়েছে এটাই তার স্ট্যাটাস বাড়িয়ে দিবে ।” দুধ দিয়ে আপ্যায়নের মাধ্যমে মেহমানদের সম্মানিত করেন তারা ।

ঢাকায় পোস্ট গ্রাজুয়েশন পরীক্ষার ফরম ফিলাপের জন্য ছুটিতে যাচ্ছি । এখানের বিশেষ কি জিনিস ঢাকায় আব্বা- আম্মার জন্য নিয়ে যেতে পারি ,এই পরামর্শ চাইলে আনিস সাহেব বলেন, “হাওরের তাজা মাছ ”। ভোরে ঘাটের পল্টুনের কাছে জাহাঙ্গীর সাহেবকে নিয়ে দাঁড়াতেই জীবন্ত কাইক্যা আর গলদা চিংড়ির অসংখ্য টুকরি দেখে মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড় । এই গলদা ঢাকার নিউ মার্কেটের মাছের বাজারে অনেক দাম ; তাও কয় দিনের বরফ দেয়া কে জানে ? বিক্রেতাকে জানালাম , “কাল ভোরে রওনা দিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত বারোটা সাড়ে বারোটা বাজবে ,গলদা টেকানো যাবে?” “ কী কইন স্যার? ককশিটের বাক্সে বরফ দিয়া প্যাকেট কইরা দিলে দুইদিনেও কুছতা হইতো না ।” জাহাঙ্গীর সাহেব আমাকে লোভ দেখান, শীত নামলেই অষ্টগ্রামের তাজা পনির টুকরি করে ব্যাপারীরা বিক্রি করতে আসেন । পার্শ্ববর্তী অষ্টগ্রাম পনিরের জন্য বিখ্যাত ।

হাসপাতালে রোগী দেখতে গিয়ে আমার অবজার্ভেশন অপু ভাইকে জানালাম । এখানের পুরুষ মানুষেরা প্রায় সবাই সুস্বাস্থ্যবান ও লম্বা চওড়া । কিন্তু, গরীব-ধনী সবার ঠোঁটের কোনে ঘাঁ- এন্গুলার স্টোমাটাইটিস। ব্যাখ্যা কী ? তাদের নিয়মিত খাবার তালিকায় ভাত- মাছ প্রধান উপাদান। বছরের প্রায় ছয় মাস পানিতে দ্বীপের মতো উঁচিয়ে থাকে গ্রামগুলো । বছরে একটাই ফসল ধান ; গোলা ভরে যায় । যে ধানের খড় আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া- নরসিংদীতে দেখেছি বাড়িতে এনে সংরক্ষণ করে, বিক্রি করে ; সেই খড় এখানের মানুষজন মাইলের পর মাইল জমিতে ফেলে আসে । ফসল কাটার মৌসুমে ক্ষেতের উপর টংঘর তৈরি করে থাকে , সেখানেই ধান সংগ্রহ করে নৌকায় করে বাড়িতে নিয়ে আসে । সব্জির অপ্রাপ্তিতে নির্দিষ্ট কিছু ভিটামিনের অভাবে ঠোঁটের কোণায় ঘাঁ ।

বর্ষায় তাদের লেইজার টাইম- বিনোদনের সময় । প্রায় সবাই তখন মাছ ধরে ,বিয়ে-শাদী ,পূজা-পার্বণ , মুসলমানী,বিভিন্ন সামাজিক -সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,নৌকা বাইচ এগুলো করে তারা সময় কাটায় । কিছুটা ধনী মানুষেরা মাছের ঘের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন । জল মহালের ইজারা নিয়ে ঘেরকেন্দ্রিক মারামারিতে হাসপাতালে জখমের রোগীরা আসেন । অস্ত্র -- সাড়ে তিন ফুট থেকে সাড়ে চার ফুট লম্বা রামদা, বল্লম।

স্থানীয় এক এনজিও কর্মকর্তার সাথে পরিচয় । উনি বেশ কয়েক বছর এখানে চাকুরি করছেন । আমাদের অনেক জিজ্ঞাস্য। বললাম , “ ভাই এই যে হাওরের মাঝে মাঝে বেশ কিছু গাছ দেখা যায় , ওগুলোর নাম কি ?” এনজিও কর্মকর্তা,“ বড় বড় ৩০ থেকে ৩৫ ফুট গাছ গুলো হিজল আর কিছুটা ছোটগুলো করচ গাছ ।” হিজল-করচ একটানা ছয়- সাত মাস পানিতে ডুবে থাকলেও মরে না । এখানের মানুষের জন্য আল্লাহর দান।বর্ষায় হাওরের পানির প্রচণ্ড ঢেউ আফাল মোকাবেলায় প্রাকৃতিক ঢাল হিজল-করচ। হিজল গাছে শীতকালে অতিথি পাখির আবাস ,বর্ষায় এর গোড়ায় হাওরের পানিতে মাছ পাওয়া যায় । লম্বা পুষ্পদন্ডের মাঝে অসংখ্য গোলাপী ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে । খুব সুগন্ধযুক্ত ফুলগুলো রাতে ফোটে, সকালে ঝরে যায় । ডায়রিয়ায় এর পাতার রস হাওরের লোকজন ব্যবহার করে । ঝোপালো দ্রুত বর্ধনশীল করচ গাছ আফাল থেকে বাড়ি ঘরের ভাঙ্গন ঠেকাতে বিরাট ভূমিকা রাখে । এটাও প্রায় ২৫-৩০ফুট হয় । একসাথে কলোনির মতো জন্মায় । বাত- চর্মরোগে এটা হাওরে ব্যবহৃত হয় । এটাকে হাওরের বায়োডিজেল বলে । এক ধরনের তেল পাওয়া যায় বলে ব্যাপকভাবে এই গাছ নিধন করা হচ্ছে । হাওরে একটা কথা চালু আছে---

‘হিজল- করচ- আড়াং বন

-হাওরের মূলধন ।’

এনজিও কর্মকর্তা হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বললেন ,“ হাওরে আফালের পাল্লায় পড়েছেন? ” শুনে গা শিউরে উঠলো । কয়দিন আগে চামড়া বন্দরে আকাশে কালো রং দেখে পরপর দুই ঘন্টায় দুটি ট্রলার যাত্রা বাতিল করে । তৃতীয় ট্রলারটি যখন ঘাট ছাড়ে ,বড়িবাড়ীর কাছে উথাল পাথাল ঢেউয়ে পড়ে একবার নিচে আরেকবার উপরে উঠে আধাঘন্টায় যে তাণ্ডবে পড়েছিল সেটা আজীবন মনে থাকবে । হাওরের সাহসী সহযাত্রীদের অনেকে ভয় পেয়ে “ আইজ নাও ডুববো ” বলে আহাজারী করছিলেন ।লাইফ জ্যাকেট পড়া আমাকে যেকোন মূল্যে নৌকা আঁকড়ে থাকার জন্য সবাই পরামর্শ দেন। সবাই ছইয়ের উপর উঠে গিয়েছিল ।

ঢাকায় আব্বা-আম্মার সাথে কথা বলার জন্য টিএইচএফপিও সাহেবের টেলিফোন ব্যবহারের অনুমতি চাইলে স্যার আকাশ থেকে পড়েন , “ আরে তুমি এইডা কি কও ? কই আগরতলা আর কই চৌকিরতলা ?টেলিফোনডা দেখছো ?” বিশাল টেলিফোনের পাশে চাবির মতো একটা হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে এক্সচেঞ্জে জানাতে হয় । এক্সচেঞ্জ অপরদিকের গ্রাহককে যুক্ত করে । পুরো ইটনায় এই রকম তিন পিস টেলিফোন - হাসপাতাল, থানা আর উপজেলা সদরে । ভরসা মোবাইল ফোন । কিন্তু, আশেপাশে টাওয়ার না থাকায় পকেটে মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরে কোন লাভ নেই। ইটনা বাজারের বাহার মিয়া-মন্নাফ মিয়ার দোকানে দুটি বাঁশ জোড়া দিয়ে এন্টেনা লাগানো আছে । আপাতত সেটাই ভরসা ।

“ স্যার , আমার ময়না হাগে না ” ,রোগীর এটেনডেন্টের কথা শুনে টিএইচএফপিও সাহেব শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করতে বলেন । “ না ,আপনেরেই দেখাইবাম ” রোগীর এটেনডেন্টের এই আবদারে স্যার বললেন , “ ময়নার বয়স কতো ? সমস্যা কয়দিনের ?” দুই দিন পায়খানা না হওয়ায় টিএইচএফপিও সাহেব দরজা থেকেই সরাসরি ইমারজেন্সিতে নিয়ে ঢুশ দেয়ার পরামর্শ দেন । রোগীর এটেনডেন্ট “ ইতা কিতা কইন ,স্যার?”বলে খাঁচাসহ সত্যিকারের ময়না পাখি প্রদর্শন করায় টিএইচএফপিও সাহেবের রাগে দুঃখে রিভলবিং চেয়ার থেকে পড়ে যাবার জোগাড় ! আমার হাতের চা মাটিতে পড়ে যায় । আমরা তিনজন একযোগে ময়না ,এটেনডেন্ট এবং স্যারের প্রতিক্রিয়ায় হাসি চাপতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে যাই । বেশ কিছুক্ষণ পর স্যার ঠান্ডা হয়ে আমাদেরকে আবার ওনার রুমে চা -বিস্কিট খাবার জন্য আমন্ত্রণ জানান । স্যার হাসতে হাসতে বলেন, “দেখছো কারবার !কোন মুল্লুকে ডাক্তারি করতে আইছো ?” স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অল্প দূরে পশু হাসপাতাল , সেখানকার ডাক্তার না থাকায় আজ এই অবস্থা ।

আকরাম সাহেব সামনের ঈদটা কিশোরগঞ্জে করার জন্য আমন্ত্রণ জানান । বলেন ,“ শোলাকিয়া ঈদগায় প্রায় তিন লাখ মানুষের জামাত হয় ”। নরসুন্দা নদীর পাড়ে শোলাকিয়া ‘সাহেব বাড়ি’র পূর্বপুরুষ সৈয়দ সূফি আহমেদ নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে ঈদ জামাতের আয়োজন করেন । এই নামের পিছনে মুসল্লিদের প্রাচুর্যতা প্রকাশে সওয়া লাখ কথাটি ব্যবহার করেন । আবার অনেকের ধারণা সোয়া লক্ষ মুসল্লির জমায়েতের কারণে এই নামটি এসেছে । কেউ কেউ বলেন মোগল আমলে এই পরগনার রাজস্ব সোয়া লাখ টাকা থেকেই নামটি এসেছে । ঢাকা,নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিশেষ ট্রেন , বাস,ট্রলারে করে ঈদের দুই-তিন দিন আগে থেকেই মুসল্লীরা জমায়েত হয়ে ঈদ উৎসবকে আরো বর্ণময় করে তোলেন।

হঠাৎ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার রুমে জরুরি তলবে আমরা তিনজনই একযোগে হাজির হই । বুকে ব্যথা নিয়ে এক ভদ্রলোক কষ্ট পাচ্ছেন। শুধু চাকুরির প্রয়োজনে এই ভাটি অঞ্চলে আছেন । সাথে উনার কলিগ । অপু ভাই পরীক্ষা করে জরুরী ভিত্তিতে ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতাল বা নিদেনপক্ষে কিশোরগঞ্জের সদর হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তাগাদা দেন । নিঃসঙ্গ , আত্মীয় পরিজনহীন মানুষটিকে ট্রলার রিজার্ভ করে নিতে নিতে বিকাল হয়ে যায় । এখানে বিকাল চারটার পরে আর কোন ট্রলার চলে না ডাকাতের ভয়ে । রাত নয়টার দিকে ঘাটে অনেক মানুষের কলগুঞ্জনে খবর পাই হাওরের মাঝখানে সেই নিঃসঙ্গ মানুষটি ইন্তেকাল করেছেন । সকাল এগারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কলিগদের কে এগিয়ে আসবেন , কিভাবে কিশোরগঞ্জে নিবেন এই ডিসিশনে আসতে আসতেই সব শেষ । খুব কষ্ট পেয়ে জাহাঙ্গীরকে বললাম সরাসরি রাস্তার ব্যবস্থা থাকলে এই দুর্গতি হয়তো হতো না । জাহাঙ্গীর জানায় , “ সাবমারসিবল রোড তৈরি হচ্ছে ।” এটা বর্ষাকালে ডুবে থাকবে শীতকালে গাড়ি চলবে । তবে ,হাওরের উপর দিয়ে উঁচু করে কোন রাস্তার ব্যবস্থা থাকলে অনেক মৃত্যু পথযাত্রী রোগীকে বাঁচানো যাবে । পুরো ইটনা শহরের দুই থেকে তিন কিলোমিটার পাকা রাস্তায় মাত্র আট দশটি রিকশা চলে ।

ঢাকায় ছুটিতে যাবার সময় প্রথম মহিলা বাঙালি কবি ‘ চন্দ্রাবতী’র বাড়ি এই কিশোরগঞ্জে জানতে পারি । বাসে সহযাত্রীকে উনার বাড়ি কিশোরগঞ্জ -করিমগঞ্জ সড়কের কোথায় জানতে চাইলে ফুলেশ্বরী বা ফুলিয়া নদীর তীরে পাতুয়াইর গ্রামে বলে জানান। সেখানে উনার তৈরী একটি শিব মন্দির এখনও আছে । ষোড়শ শতকের ‘মনসামঙ্গল’এর কবি দ্বিজবংশী দাসের মেয়ে চন্দ্রাবতী - মলুয়া ,দস্যু কেনারামের পালা, রামায়ণের একটা বিরাট অংশ লিখেছিলেন । কবি তাঁর প্রাণের মানুষ ধর্মান্তরিত জয়ানন্দ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে শিব পূজায় মন দেন । পরবর্তীতে আত্মগ্লানীতে জয়ানন্দ ফেরত আসলেও তাদের মিলন হয়নি । জয়ানন্দের আত্মাহুতিতে চন্দ্রাবতীও ফুলেশ্বরীতে ঝাঁপ দেন ।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার মধ্যে বিস্তৃত হাওর পাড়ের মানুষ সিলেট-ময়মনসিংহ-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিক্সড ভাষায় কথা বলেন ; আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশও এক। বাসে বসে অদেখা কিন্ত অসংখ্যবার নাম শোনা ‘চন্দ্রাবতী’ আর যোগাযোগের দূর্গমতার জন্য হাওরপাড়ের অসংখ্য মানুষের বিভিন্ন দুর্গতির কথা ভাবতে ভাবতে মনটাই খারাপ হয়ে যায় ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

বিশ্ব শিক্ষক দিবস : শিক্ষা পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জ

tab

মুক্ত আলোচনা

হিজল-করচ-আড়াংবন

আসফাক বীন রহমান

শনিবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৩

‘ আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে- পূবালী বাতাসে ,

বাদাম দেইখ্যা , চাইয়া থাকি,

আমার নি কেউ আসে রে। ’

---হাওরের পানিতে ভাসতে ভাসতে কোত্থেকে এই বুক মোচড়ানো গান আসছে ? একবার সাউন্ড বাড়ে ,একবার কমে; মনে হচ্ছে তরঙ্গের উঠানামা । শ্রাবণ মাসের বৃষ্টির সাথে প্রচণ্ড বাতাস আর হাওরের ঢেউ পাড়ি দিয়ে দুঃখী এক গাঁয়ের বধুর কষ্টের গানটি কে গাইছেন ? কে লিখেছেন ? দুপুরের পর থেকেই মোটামুটি আমরা ফ্রী । সন্ধ্যায় হাওরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখি, পালের নৌকা দেখি, মাইক বাজানো বিয়ের সাজানো নৌকা দেখি , দূরে দ্বীপের মত বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা --আরো অনেক দূরে দিগন্তের কাছে হবিগঞ্জের আজমিরীগন্জের বৈদ্যুতিক আলোকমালা দেখি ।

জয়েন করার সময় যে ধনু নদীকে দেখেছিলাম , সেটা এখন একাকার হয়ে গেছে হাওরের আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানির সাথে । সন্ধ্যায় হালকা হলদে বাল্বের টিমটিমে আলো বাড়ে আর কমে , তারপর টুপ করে লোডশেডিং । বিকেলে নাস্তার পর দীর্ঘ রাতের জন্য ফ্লাক্স ভর্তি চা , কলা- বিস্কিটের মওজুদ নিয়ে ডরমেটরিতে ফিরি । এই একতলা ঝুরঝুরে প্রায় পরিত্যক্ত কোয়ার্টারটি ইটনা বাজারের পিছনে ,হাসপাতাল থেকে প্রায় এক মাইল দূরে । সন্ধ্যার পর পর বারান্দার গ্রিলে তালা দিয়ে দরজা- জানালা সব বন্ধ করে দিতে হয় নিরাপত্তার খাতিরে । পুরো কোয়ার্টারটি অনেকগুলো বিশাল সেগুন গাছ দিয়ে ঘেরা । পাশের কোয়ার্টারটি শিড়িষ গাছ দিয়ে ঘেরাও করা ।

সন্ধ্যায় প্রতিদিন আমাদের খোঁজ-খবর নিতে আসেন সিনিয়র স্টাফ নার্স জাহাঙ্গীর , সাথে আসেন হাসপাতালের আনিস- আকরাম সাহেব । মাঝে মাঝে এলাকার বিশিষ্ট মানুষজন কলে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যেতে আসেন । কলে বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে যাওয়া একটা বিশাল স্ট্যাটাসের ব্যাপার ; এজন্য তদবির পার্টিও আসে । এই অপরিচিত লোকজনের সাথে বেড়ুনো রিস্কি। কখন ধাক্কা দিয়ে অন্ধকার হাওরে ফেলে দেয় , ঠিক ঠিকানা নাই ।

আধা মাইল পরপরই পানি । নৌকা ছাড়া অন্য কোন বাহন নাই । এখানে ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে গিয়ে ম্যানেজার সাহেবের রুমে উনাকে না পেয়ে কিছুটা সময় বসে আবার নক করি। আগে থেকেই রুমে থাকা লুঙ্গি পরিহিত সুখী চেহারার ভদ্রলোকটি বললেন আমিই ম্যানেজার । উনার রুমে দুজন পুরুষ স্টাফকে ডেকে আমার অ্যাকাউন্ট নাম্বার খুলে দেওয়ার তাগিদ দিতে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন , হাসপাতালের নতুন ডাক্তারসাহেব । ওমা ! এরাও দেখি লুঙ্গি পড়া ; পায়ে প্লাস্টিকের পাম্প সু ! এখানের স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন ঠাকুর সাহেবকে বিকেলে বা সন্ধ্যায় যখনি দেখেছি খালি পায়ে ঘোরাঘুরি করেন । বিষয়টি নিয়ে একদিন ইন্ডিকেট করতেই , হোঃ হোঃ করে হেসে বলেন- ‘দুই মিনিট পরপর প্যাঁক-পানি , স্যান্ডেল- জুতা পরলে অসুবিধা । ’

জাহাঙ্গীর সাহেবকে ঐ গানের ব্যাপারে জানতে চাইলে , জানান উকিল মুন্সির এই গানটি ডঃ হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় বারী সিদ্দিকী গেয়েছেন । আমরা অপেক্ষায় থাকি ,কখন ভোর হবে ? প্রায় রাতেই পার্শ্ববর্তী ঋষি পাড়ায় কীর্তন,ঢোল- করতালের আওয়াজে মনে হয় আমাদের আশেপাশে লোকজন আছে । আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যেই শুনশান নীরবতা । এটা এক দিক থেকে আমাদের জন্য ভালই - পোস্ট গ্রাজুয়েশন ভর্তির জন্য পড়াশোনা করার উপযুক্ত ঠান্ডা পরিবেশ ।

টিএইচএফপিও সাহেব হাসপাতাল থেকে জানালা দিয়ে সর্বোচ্চ বিশ ফুট দূরের হাওরে প্রায় সময়ই উদাস হয়ে কি যেন দেখেন ! জানালা দিয়ে ঝকঝকে সাদা আকাশ আর নীল পানিতে অর্ধ- বৃত্তাকারে বিশাল ঢেউ তুলে এগিয়ে আসা স্পিডবোট দেখে মনে হয় টিভিতে দেখা মায়ামী বিচ । আমরা মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে দূরের বালুর বার্জ,ট্রলার,লঞ্চ,বড় বড় বাঁশের ভেলা(মাচালি) দেখে প্রশংসা করলে স্যার আমাদেরকে ধমক দেন, “ তুমরার কপালে শনি আছে ! এই হাওরের মায়ায় পড়লে শিকড় গজাইবো ? আর বাইর হইতে পারবা না । কাইলকা কোন সাবজেক্ট পড়ছো ? পড়া দেও !” স্যার আরো বলেন , “নো ডিগ্রী, নো প্রমোশন ; উপজেলায় পইচ্চা মরতে হইবো ।” টিএইচএফপিও খালেক তালুকদার স্যার প্রায়ই আমাদের পড়াশোনার খোঁজ নেন -দ্রুত কোন একটি কোর্সে ভর্তি হবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টার কথা বলেন । স্যার ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ড করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এমবিবিএস পাস করার পরও নিজের অপ্রাপ্তির কথা বলেন । চাকুরীর প্রথমেই প্র্যাকটিসের মোহে পড়লে ডিগ্রী করাটা কঠিন হয়ে যাবে ।এজন্য যেকোনো পোস্ট গ্রাজুয়েশন পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ছুটি চাইলেই মঞ্জুর করেন ।

‘ প্রতিদিন মাছ খেতে খেতে আর ভালো লাগছে না , এখানে পোলাও- বিরিয়ানীর ব্যবস্থা নাই ?’-অপু ভাইয়ের এই আকুতি আমারও । হাসপাতালের পোর্টার আলী মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে , “ চলেন স্যার , আমি জানি কোন হডেলে পোলাও -বিরানি পাওয়া যায়।” ইটনা বাজারে বৃষ্টির মধ্যে আয়াত আলি বোর্ডিঙের আশেপাশে ঘুরিয়ে একটি ভাতের হোটেলে বসিয়ে বলে , “ স্যার আইজকা পোলাও- বিরানি রান্দে নাই। এরা মুড়িঘন্ট খুব ভালা বানায়।” ভদ্রতার খাতিরে এটা খেয়েই ফেরত আসি । গরীব মানুষের কাছে হোটেলের পোলাও -বিরিয়ানী বা মুড়িঘন্ট সবই প্রচন্ড উপাদেয় ।

বিকেলের নাস্তায় ভেরিয়েশন আনতে ডাঃ পাহাড়ী একেবারে হাওরের সীমানার বাঁশের টং মার্কা হোটেলে নিয়ে আসে ।

হাওরের তাজা মাছের গরম গরম হলুদ- লবণ মাখানো ফ্রাই খেয়ে ডাঃ অপুর মতো পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুঁত খুঁত করা মানুষও জানতে চান , আর কী কী মাছের ফ্রাই তৈরি হয় । “এই টাটহা মাছের ভাজি ঢাহায় কই পাইবেন স্যার ?” হোটেল ম্যানেজারের কথায় আমরা তিনজনই সায় দেই । হোটেলওয়ালা পাশের চায়ের দোকান থেকে গরম গরম দুধ, লবণ মিশিয়ে এনে আমাদেরকে খেতে দেন । আমি আর অপু ভাই মুখ চাওয়া -চাওয়ি করলেও পাহাড়ী বিনা দ্বিধায় গ্লাসটি নেয়,আমাদেরকেও অনুরোধ করে গরম দুধ খেয়ে ফেলার জন্য । দুধের দাম দিতে গেলে ম্যানেজার অস্বীকৃতি জানিয়ে আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান , তার ভাঙ্গাচোরা বাঁশের টংয়ের হোটেলে বসে খাবার জন্য । অপু ভাই বলেন,“ তিন তিন জন সরকারি ডাক্তার এইখানে বসে খেয়েছে এটাই তার স্ট্যাটাস বাড়িয়ে দিবে ।” দুধ দিয়ে আপ্যায়নের মাধ্যমে মেহমানদের সম্মানিত করেন তারা ।

ঢাকায় পোস্ট গ্রাজুয়েশন পরীক্ষার ফরম ফিলাপের জন্য ছুটিতে যাচ্ছি । এখানের বিশেষ কি জিনিস ঢাকায় আব্বা- আম্মার জন্য নিয়ে যেতে পারি ,এই পরামর্শ চাইলে আনিস সাহেব বলেন, “হাওরের তাজা মাছ ”। ভোরে ঘাটের পল্টুনের কাছে জাহাঙ্গীর সাহেবকে নিয়ে দাঁড়াতেই জীবন্ত কাইক্যা আর গলদা চিংড়ির অসংখ্য টুকরি দেখে মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড় । এই গলদা ঢাকার নিউ মার্কেটের মাছের বাজারে অনেক দাম ; তাও কয় দিনের বরফ দেয়া কে জানে ? বিক্রেতাকে জানালাম , “কাল ভোরে রওনা দিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত বারোটা সাড়ে বারোটা বাজবে ,গলদা টেকানো যাবে?” “ কী কইন স্যার? ককশিটের বাক্সে বরফ দিয়া প্যাকেট কইরা দিলে দুইদিনেও কুছতা হইতো না ।” জাহাঙ্গীর সাহেব আমাকে লোভ দেখান, শীত নামলেই অষ্টগ্রামের তাজা পনির টুকরি করে ব্যাপারীরা বিক্রি করতে আসেন । পার্শ্ববর্তী অষ্টগ্রাম পনিরের জন্য বিখ্যাত ।

হাসপাতালে রোগী দেখতে গিয়ে আমার অবজার্ভেশন অপু ভাইকে জানালাম । এখানের পুরুষ মানুষেরা প্রায় সবাই সুস্বাস্থ্যবান ও লম্বা চওড়া । কিন্তু, গরীব-ধনী সবার ঠোঁটের কোনে ঘাঁ- এন্গুলার স্টোমাটাইটিস। ব্যাখ্যা কী ? তাদের নিয়মিত খাবার তালিকায় ভাত- মাছ প্রধান উপাদান। বছরের প্রায় ছয় মাস পানিতে দ্বীপের মতো উঁচিয়ে থাকে গ্রামগুলো । বছরে একটাই ফসল ধান ; গোলা ভরে যায় । যে ধানের খড় আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া- নরসিংদীতে দেখেছি বাড়িতে এনে সংরক্ষণ করে, বিক্রি করে ; সেই খড় এখানের মানুষজন মাইলের পর মাইল জমিতে ফেলে আসে । ফসল কাটার মৌসুমে ক্ষেতের উপর টংঘর তৈরি করে থাকে , সেখানেই ধান সংগ্রহ করে নৌকায় করে বাড়িতে নিয়ে আসে । সব্জির অপ্রাপ্তিতে নির্দিষ্ট কিছু ভিটামিনের অভাবে ঠোঁটের কোণায় ঘাঁ ।

বর্ষায় তাদের লেইজার টাইম- বিনোদনের সময় । প্রায় সবাই তখন মাছ ধরে ,বিয়ে-শাদী ,পূজা-পার্বণ , মুসলমানী,বিভিন্ন সামাজিক -সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,নৌকা বাইচ এগুলো করে তারা সময় কাটায় । কিছুটা ধনী মানুষেরা মাছের ঘের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন । জল মহালের ইজারা নিয়ে ঘেরকেন্দ্রিক মারামারিতে হাসপাতালে জখমের রোগীরা আসেন । অস্ত্র -- সাড়ে তিন ফুট থেকে সাড়ে চার ফুট লম্বা রামদা, বল্লম।

স্থানীয় এক এনজিও কর্মকর্তার সাথে পরিচয় । উনি বেশ কয়েক বছর এখানে চাকুরি করছেন । আমাদের অনেক জিজ্ঞাস্য। বললাম , “ ভাই এই যে হাওরের মাঝে মাঝে বেশ কিছু গাছ দেখা যায় , ওগুলোর নাম কি ?” এনজিও কর্মকর্তা,“ বড় বড় ৩০ থেকে ৩৫ ফুট গাছ গুলো হিজল আর কিছুটা ছোটগুলো করচ গাছ ।” হিজল-করচ একটানা ছয়- সাত মাস পানিতে ডুবে থাকলেও মরে না । এখানের মানুষের জন্য আল্লাহর দান।বর্ষায় হাওরের পানির প্রচণ্ড ঢেউ আফাল মোকাবেলায় প্রাকৃতিক ঢাল হিজল-করচ। হিজল গাছে শীতকালে অতিথি পাখির আবাস ,বর্ষায় এর গোড়ায় হাওরের পানিতে মাছ পাওয়া যায় । লম্বা পুষ্পদন্ডের মাঝে অসংখ্য গোলাপী ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে । খুব সুগন্ধযুক্ত ফুলগুলো রাতে ফোটে, সকালে ঝরে যায় । ডায়রিয়ায় এর পাতার রস হাওরের লোকজন ব্যবহার করে । ঝোপালো দ্রুত বর্ধনশীল করচ গাছ আফাল থেকে বাড়ি ঘরের ভাঙ্গন ঠেকাতে বিরাট ভূমিকা রাখে । এটাও প্রায় ২৫-৩০ফুট হয় । একসাথে কলোনির মতো জন্মায় । বাত- চর্মরোগে এটা হাওরে ব্যবহৃত হয় । এটাকে হাওরের বায়োডিজেল বলে । এক ধরনের তেল পাওয়া যায় বলে ব্যাপকভাবে এই গাছ নিধন করা হচ্ছে । হাওরে একটা কথা চালু আছে---

‘হিজল- করচ- আড়াং বন

-হাওরের মূলধন ।’

এনজিও কর্মকর্তা হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বললেন ,“ হাওরে আফালের পাল্লায় পড়েছেন? ” শুনে গা শিউরে উঠলো । কয়দিন আগে চামড়া বন্দরে আকাশে কালো রং দেখে পরপর দুই ঘন্টায় দুটি ট্রলার যাত্রা বাতিল করে । তৃতীয় ট্রলারটি যখন ঘাট ছাড়ে ,বড়িবাড়ীর কাছে উথাল পাথাল ঢেউয়ে পড়ে একবার নিচে আরেকবার উপরে উঠে আধাঘন্টায় যে তাণ্ডবে পড়েছিল সেটা আজীবন মনে থাকবে । হাওরের সাহসী সহযাত্রীদের অনেকে ভয় পেয়ে “ আইজ নাও ডুববো ” বলে আহাজারী করছিলেন ।লাইফ জ্যাকেট পড়া আমাকে যেকোন মূল্যে নৌকা আঁকড়ে থাকার জন্য সবাই পরামর্শ দেন। সবাই ছইয়ের উপর উঠে গিয়েছিল ।

ঢাকায় আব্বা-আম্মার সাথে কথা বলার জন্য টিএইচএফপিও সাহেবের টেলিফোন ব্যবহারের অনুমতি চাইলে স্যার আকাশ থেকে পড়েন , “ আরে তুমি এইডা কি কও ? কই আগরতলা আর কই চৌকিরতলা ?টেলিফোনডা দেখছো ?” বিশাল টেলিফোনের পাশে চাবির মতো একটা হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে এক্সচেঞ্জে জানাতে হয় । এক্সচেঞ্জ অপরদিকের গ্রাহককে যুক্ত করে । পুরো ইটনায় এই রকম তিন পিস টেলিফোন - হাসপাতাল, থানা আর উপজেলা সদরে । ভরসা মোবাইল ফোন । কিন্তু, আশেপাশে টাওয়ার না থাকায় পকেটে মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরে কোন লাভ নেই। ইটনা বাজারের বাহার মিয়া-মন্নাফ মিয়ার দোকানে দুটি বাঁশ জোড়া দিয়ে এন্টেনা লাগানো আছে । আপাতত সেটাই ভরসা ।

“ স্যার , আমার ময়না হাগে না ” ,রোগীর এটেনডেন্টের কথা শুনে টিএইচএফপিও সাহেব শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করতে বলেন । “ না ,আপনেরেই দেখাইবাম ” রোগীর এটেনডেন্টের এই আবদারে স্যার বললেন , “ ময়নার বয়স কতো ? সমস্যা কয়দিনের ?” দুই দিন পায়খানা না হওয়ায় টিএইচএফপিও সাহেব দরজা থেকেই সরাসরি ইমারজেন্সিতে নিয়ে ঢুশ দেয়ার পরামর্শ দেন । রোগীর এটেনডেন্ট “ ইতা কিতা কইন ,স্যার?”বলে খাঁচাসহ সত্যিকারের ময়না পাখি প্রদর্শন করায় টিএইচএফপিও সাহেবের রাগে দুঃখে রিভলবিং চেয়ার থেকে পড়ে যাবার জোগাড় ! আমার হাতের চা মাটিতে পড়ে যায় । আমরা তিনজন একযোগে ময়না ,এটেনডেন্ট এবং স্যারের প্রতিক্রিয়ায় হাসি চাপতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে যাই । বেশ কিছুক্ষণ পর স্যার ঠান্ডা হয়ে আমাদেরকে আবার ওনার রুমে চা -বিস্কিট খাবার জন্য আমন্ত্রণ জানান । স্যার হাসতে হাসতে বলেন, “দেখছো কারবার !কোন মুল্লুকে ডাক্তারি করতে আইছো ?” স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অল্প দূরে পশু হাসপাতাল , সেখানকার ডাক্তার না থাকায় আজ এই অবস্থা ।

আকরাম সাহেব সামনের ঈদটা কিশোরগঞ্জে করার জন্য আমন্ত্রণ জানান । বলেন ,“ শোলাকিয়া ঈদগায় প্রায় তিন লাখ মানুষের জামাত হয় ”। নরসুন্দা নদীর পাড়ে শোলাকিয়া ‘সাহেব বাড়ি’র পূর্বপুরুষ সৈয়দ সূফি আহমেদ নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে ঈদ জামাতের আয়োজন করেন । এই নামের পিছনে মুসল্লিদের প্রাচুর্যতা প্রকাশে সওয়া লাখ কথাটি ব্যবহার করেন । আবার অনেকের ধারণা সোয়া লক্ষ মুসল্লির জমায়েতের কারণে এই নামটি এসেছে । কেউ কেউ বলেন মোগল আমলে এই পরগনার রাজস্ব সোয়া লাখ টাকা থেকেই নামটি এসেছে । ঢাকা,নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিশেষ ট্রেন , বাস,ট্রলারে করে ঈদের দুই-তিন দিন আগে থেকেই মুসল্লীরা জমায়েত হয়ে ঈদ উৎসবকে আরো বর্ণময় করে তোলেন।

হঠাৎ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার রুমে জরুরি তলবে আমরা তিনজনই একযোগে হাজির হই । বুকে ব্যথা নিয়ে এক ভদ্রলোক কষ্ট পাচ্ছেন। শুধু চাকুরির প্রয়োজনে এই ভাটি অঞ্চলে আছেন । সাথে উনার কলিগ । অপু ভাই পরীক্ষা করে জরুরী ভিত্তিতে ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতাল বা নিদেনপক্ষে কিশোরগঞ্জের সদর হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তাগাদা দেন । নিঃসঙ্গ , আত্মীয় পরিজনহীন মানুষটিকে ট্রলার রিজার্ভ করে নিতে নিতে বিকাল হয়ে যায় । এখানে বিকাল চারটার পরে আর কোন ট্রলার চলে না ডাকাতের ভয়ে । রাত নয়টার দিকে ঘাটে অনেক মানুষের কলগুঞ্জনে খবর পাই হাওরের মাঝখানে সেই নিঃসঙ্গ মানুষটি ইন্তেকাল করেছেন । সকাল এগারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কলিগদের কে এগিয়ে আসবেন , কিভাবে কিশোরগঞ্জে নিবেন এই ডিসিশনে আসতে আসতেই সব শেষ । খুব কষ্ট পেয়ে জাহাঙ্গীরকে বললাম সরাসরি রাস্তার ব্যবস্থা থাকলে এই দুর্গতি হয়তো হতো না । জাহাঙ্গীর জানায় , “ সাবমারসিবল রোড তৈরি হচ্ছে ।” এটা বর্ষাকালে ডুবে থাকবে শীতকালে গাড়ি চলবে । তবে ,হাওরের উপর দিয়ে উঁচু করে কোন রাস্তার ব্যবস্থা থাকলে অনেক মৃত্যু পথযাত্রী রোগীকে বাঁচানো যাবে । পুরো ইটনা শহরের দুই থেকে তিন কিলোমিটার পাকা রাস্তায় মাত্র আট দশটি রিকশা চলে ।

ঢাকায় ছুটিতে যাবার সময় প্রথম মহিলা বাঙালি কবি ‘ চন্দ্রাবতী’র বাড়ি এই কিশোরগঞ্জে জানতে পারি । বাসে সহযাত্রীকে উনার বাড়ি কিশোরগঞ্জ -করিমগঞ্জ সড়কের কোথায় জানতে চাইলে ফুলেশ্বরী বা ফুলিয়া নদীর তীরে পাতুয়াইর গ্রামে বলে জানান। সেখানে উনার তৈরী একটি শিব মন্দির এখনও আছে । ষোড়শ শতকের ‘মনসামঙ্গল’এর কবি দ্বিজবংশী দাসের মেয়ে চন্দ্রাবতী - মলুয়া ,দস্যু কেনারামের পালা, রামায়ণের একটা বিরাট অংশ লিখেছিলেন । কবি তাঁর প্রাণের মানুষ ধর্মান্তরিত জয়ানন্দ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে শিব পূজায় মন দেন । পরবর্তীতে আত্মগ্লানীতে জয়ানন্দ ফেরত আসলেও তাদের মিলন হয়নি । জয়ানন্দের আত্মাহুতিতে চন্দ্রাবতীও ফুলেশ্বরীতে ঝাঁপ দেন ।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার মধ্যে বিস্তৃত হাওর পাড়ের মানুষ সিলেট-ময়মনসিংহ-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিক্সড ভাষায় কথা বলেন ; আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশও এক। বাসে বসে অদেখা কিন্ত অসংখ্যবার নাম শোনা ‘চন্দ্রাবতী’ আর যোগাযোগের দূর্গমতার জন্য হাওরপাড়ের অসংখ্য মানুষের বিভিন্ন দুর্গতির কথা ভাবতে ভাবতে মনটাই খারাপ হয়ে যায় ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]

back to top