alt

মুক্ত আলোচনা

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

আবদুল আলীম তালুকদার

: সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪

সৌরপঞ্জি অনুসারে বাংলা মাস পালিত হতো অনেক প্রাচীনকাল থেকেই। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, উড়িষ্যা, মনিপুর, কেরালা, তামিলনাড়–, ত্রিপুরা, বঙ্গ, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই উদযাপনের রীতি ছিল।

ইতিহাসবিদদের মতে, সুপ্রাচীনকাল থেকে বাঙালিরাও বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে পালন করে আসছে। নববর্ষ বাঙালির সহ¯্র বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাই বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর হৃদয় নিংড়ানো উৎসব, মনের উৎসব, মননের উৎসব। এক কথায় পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির সর্বপ্রধান ও সার্বজনীন উৎসব। এই উৎসব পালনে যেমন জাতি-ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ থাকে না তেমনি থাকে না ছোট-বড়, ধনী-গরীবের কোনো পার্থক্য। এটি সত্যিকারার্থেই একটি সার্বজনীন উৎসব যা ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালিদের পাশাপাশি সারাবিশ্বে বসবাসরত বাঙালিরা প্রতিবছর সাড়ম্বরে উদযাপন করে থাকে। পুরনো বছরের ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, ক্লেদ-গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে মহানন্দে বরণ করে নেয় তারা সমৃদ্ধি ও সুখময় জীবন প্রাপ্তির প্রত্যাশায়।

প্রাচীনকাল থেকেই বর্ষ গণনায় প্রধানত দুটি পদ্ধতি চালু আছে। সূর্যের হিসেবে যে সাল গণনা করা হয় তাকে সৌর সাল বলে। সৌর সালের মাসগুলোর ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। হিজরী সন চান্দ্র সাল হওয়ায় এর মাসগুলো ঋতুর সাথে সম্পর্কিত নয়। তাই ভিন্ন ভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর সংস্পর্শে আসে হিজরী নববর্ষ। মানব সভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই সময়, দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর প্রভৃতি হিসাব নির্ণয় করার মননও সঞ্চারিত হয় এবং সেই মনন থেকে সূর্য পরিক্রমের হিসাবেরও যেমন উদ্ভব ঘটে, তেমনি চন্দ্র পরিক্রমেরও উদ্ভব ঘটে। সূর্য পরিক্রমের হিসাবে যে বছর গণনার পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে তা সৌর সন নামে পরিচিত হয় আর চন্দ্রের পরিক্রমের হিসাবে উদ্ভাবিত সাল চান্দ্র সন নামে পরিচিত হয়।

ভারতবর্ষে মুঘল সা¤্রাজ্য পরিচালিত হতো হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে। আর হিজরী পঞ্জিকা চাঁদের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু কৃষকদের কৃষিকাজ চাঁদের হিসাবের সাথে মিলতো না, তাই তাদের অসময়ে খাজনা আদায়ে কৃষকদের যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য মুঘল স¤্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর সিংহাসনে আরোহনের উনিশ বছরে পদার্পণ করে কৃষি কাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার তাগিদ অনুভব করেন। স¤্রাটের আদেশ অনুযায়ী তাঁর সভাসদ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে ১০ অথবা ১১ মার্চ চান্দ্রসন ও সৌর সনের সাথে মিল রেখে বাংলা সনের প্রচলন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হিজরী সনের বর্ষকে বজায় রেখে বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিনে এনে একটি নতুন সন উদ্ভাবন করেন এবং সেই সাথে তিনি নক্ষত্রের নামের সাথে মিলিয়ে বাংলা বারো মাসের নামকরণও করেন। এই সন ইলাহী সন, ফসলি সন প্রভৃতি নামে শাহী দরবারে পরিচিত হলেও বাদশাহ্ কর্তৃক গঠিত সুবা বাঙ্গালা বা বাংলা প্রদেশে এসে এই সন বাংলা সন নামে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। আর তখন থেকেই মানুষ বাংলা নববর্ষে তাদের হিসাব-নিকাশ, দেনা পরিশোধ, খাজনা পরিশোধ ও বিভিন্ন প্রকার লেনদেন সম্পাদন করে আসছে।

প্রথমে বাদশাহ্ আকবরের পঞ্জিকার নাম ছিল ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ আর ঐ পঞ্জিকায় মাসগুলো আর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর এসব নামে। এক তথ্য হতে জানা যায় যে, হিজরী সনের প্রথম মাস মুহররমকে প্রথম মাস ঠিক রেখেই বাদশাহ্ আকবর কর্তৃক গঠিত বাংলা প্রদেশ বা সুবাহ্ বাংলায় এই নতুন সন প্রতর্তিত হয়। তখন এ অঞ্চলে মুহররমে ছিল বৈশাখ মাস। তাই এখানে নতুন সনের প্রথম মাস হিসেবে স্থির করা হয় বৈশাখকেই। এই বৈশাখ মাস হচ্ছে শকাব্দের দ্বিতীয় মাস। এই বাংলা সনের সাথে শকাব্দের যে মাসগুলো সংযুক্ত করা হয় তার অধিকাংশেরই নামকরণ হয়েছে কোনো না কোনো নক্ষত্রের নামে যেমন: বিশাখা নক্ষত্রের নামে হয়েছে বৈশাখ মাস, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ মাস, আষাঢ়া নক্ষত্রের নামে আষাঢ় মাস, শ্রাবণা নক্ষত্রের নামে শ্রাবণ মাস, ভাদ্রপদা নক্ষত্রের নামে ভাদ্রমাস, অশ্বিনী নক্ষত্রের নামে আশ্বিন মাস, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামে কার্তিক মাস, পুষ্যা নক্ষত্রের নামে পৌষ মাস, মঘা নক্ষত্রের নামে মাঘ মাস, ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামে ফাল্গুন মাস এবং চৈত্রা নক্ষত্রের নামে চৈত্র মাস। তবে বাংলা সনের অষ্টম মাস অগ্রহায়নের নামকরণ কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে নববর্ষ সূচিত হতো হেমন্তকালের যে মাসটিতে সেই মাসটির নামকরণ করা হয়েছিল অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ন শব্দের অর্থ অগ্র বৎসর।

১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে। তবে সেসময়ে এটি ছিল প্রধানত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও পরবর্তীতে এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসের সংযোগ ঘটেছে। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকা-ের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সনের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।

বর্তমানের বাংলা সন এসেছে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাদেশে এই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল শুভ নববর্ষ পালন করা হয়। আর পশ্চিমবঙ্গে তা ১৫ এপ্রিল পালন করা হয়। কারণ ভারতে হিন্দু সম্প্রদায় তিথি পঞ্জিকা অনুসরণ করে থাকে। বাংলাদেশে আধুনিক বাংলা বর্ষ পঞ্জিকায় গ্রেগরীয় পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ১৪ এপ্রিল বাংলা বছরের প্রথম দিন নির্দিষ্ট করা হয়।

পকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।

দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।

বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হয়। এটি পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসবকে চাকমারা ‘বিজু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’ বলে আখ্যা দিলেও গোটা পার্বত্য এলাকায় তা ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নববর্ষ উদ্যাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারা দেশ।

সবশেষে প্রত্যাশা রইলোÑ নতুন বছর সবার জীবনে কল্যাণ বয়ে আনুক। অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির ফল্গুধারা প্রবাহিত হোক। স্বাগতম নববর্ষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ]

রিলিফ

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

আবদুল আলীম তালুকদার

সোমবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৪

সৌরপঞ্জি অনুসারে বাংলা মাস পালিত হতো অনেক প্রাচীনকাল থেকেই। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, উড়িষ্যা, মনিপুর, কেরালা, তামিলনাড়–, ত্রিপুরা, বঙ্গ, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই উদযাপনের রীতি ছিল।

ইতিহাসবিদদের মতে, সুপ্রাচীনকাল থেকে বাঙালিরাও বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে পালন করে আসছে। নববর্ষ বাঙালির সহ¯্র বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাই বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর হৃদয় নিংড়ানো উৎসব, মনের উৎসব, মননের উৎসব। এক কথায় পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির সর্বপ্রধান ও সার্বজনীন উৎসব। এই উৎসব পালনে যেমন জাতি-ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ থাকে না তেমনি থাকে না ছোট-বড়, ধনী-গরীবের কোনো পার্থক্য। এটি সত্যিকারার্থেই একটি সার্বজনীন উৎসব যা ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালিদের পাশাপাশি সারাবিশ্বে বসবাসরত বাঙালিরা প্রতিবছর সাড়ম্বরে উদযাপন করে থাকে। পুরনো বছরের ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, ক্লেদ-গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন বছরকে মহানন্দে বরণ করে নেয় তারা সমৃদ্ধি ও সুখময় জীবন প্রাপ্তির প্রত্যাশায়।

প্রাচীনকাল থেকেই বর্ষ গণনায় প্রধানত দুটি পদ্ধতি চালু আছে। সূর্যের হিসেবে যে সাল গণনা করা হয় তাকে সৌর সাল বলে। সৌর সালের মাসগুলোর ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। হিজরী সন চান্দ্র সাল হওয়ায় এর মাসগুলো ঋতুর সাথে সম্পর্কিত নয়। তাই ভিন্ন ভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর সংস্পর্শে আসে হিজরী নববর্ষ। মানব সভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই সময়, দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর প্রভৃতি হিসাব নির্ণয় করার মননও সঞ্চারিত হয় এবং সেই মনন থেকে সূর্য পরিক্রমের হিসাবেরও যেমন উদ্ভব ঘটে, তেমনি চন্দ্র পরিক্রমেরও উদ্ভব ঘটে। সূর্য পরিক্রমের হিসাবে যে বছর গণনার পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে তা সৌর সন নামে পরিচিত হয় আর চন্দ্রের পরিক্রমের হিসাবে উদ্ভাবিত সাল চান্দ্র সন নামে পরিচিত হয়।

ভারতবর্ষে মুঘল সা¤্রাজ্য পরিচালিত হতো হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে। আর হিজরী পঞ্জিকা চাঁদের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু কৃষকদের কৃষিকাজ চাঁদের হিসাবের সাথে মিলতো না, তাই তাদের অসময়ে খাজনা আদায়ে কৃষকদের যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য মুঘল স¤্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর সিংহাসনে আরোহনের উনিশ বছরে পদার্পণ করে কৃষি কাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার তাগিদ অনুভব করেন। স¤্রাটের আদেশ অনুযায়ী তাঁর সভাসদ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে ১০ অথবা ১১ মার্চ চান্দ্রসন ও সৌর সনের সাথে মিল রেখে বাংলা সনের প্রচলন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হিজরী সনের বর্ষকে বজায় রেখে বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের স্থলে ৩৬৫ দিনে এনে একটি নতুন সন উদ্ভাবন করেন এবং সেই সাথে তিনি নক্ষত্রের নামের সাথে মিলিয়ে বাংলা বারো মাসের নামকরণও করেন। এই সন ইলাহী সন, ফসলি সন প্রভৃতি নামে শাহী দরবারে পরিচিত হলেও বাদশাহ্ কর্তৃক গঠিত সুবা বাঙ্গালা বা বাংলা প্রদেশে এসে এই সন বাংলা সন নামে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। আর তখন থেকেই মানুষ বাংলা নববর্ষে তাদের হিসাব-নিকাশ, দেনা পরিশোধ, খাজনা পরিশোধ ও বিভিন্ন প্রকার লেনদেন সম্পাদন করে আসছে।

প্রথমে বাদশাহ্ আকবরের পঞ্জিকার নাম ছিল ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ আর ঐ পঞ্জিকায় মাসগুলো আর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর এসব নামে। এক তথ্য হতে জানা যায় যে, হিজরী সনের প্রথম মাস মুহররমকে প্রথম মাস ঠিক রেখেই বাদশাহ্ আকবর কর্তৃক গঠিত বাংলা প্রদেশ বা সুবাহ্ বাংলায় এই নতুন সন প্রতর্তিত হয়। তখন এ অঞ্চলে মুহররমে ছিল বৈশাখ মাস। তাই এখানে নতুন সনের প্রথম মাস হিসেবে স্থির করা হয় বৈশাখকেই। এই বৈশাখ মাস হচ্ছে শকাব্দের দ্বিতীয় মাস। এই বাংলা সনের সাথে শকাব্দের যে মাসগুলো সংযুক্ত করা হয় তার অধিকাংশেরই নামকরণ হয়েছে কোনো না কোনো নক্ষত্রের নামে যেমন: বিশাখা নক্ষত্রের নামে হয়েছে বৈশাখ মাস, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ মাস, আষাঢ়া নক্ষত্রের নামে আষাঢ় মাস, শ্রাবণা নক্ষত্রের নামে শ্রাবণ মাস, ভাদ্রপদা নক্ষত্রের নামে ভাদ্রমাস, অশ্বিনী নক্ষত্রের নামে আশ্বিন মাস, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামে কার্তিক মাস, পুষ্যা নক্ষত্রের নামে পৌষ মাস, মঘা নক্ষত্রের নামে মাঘ মাস, ফাল্গুনী নক্ষত্রের নামে ফাল্গুন মাস এবং চৈত্রা নক্ষত্রের নামে চৈত্র মাস। তবে বাংলা সনের অষ্টম মাস অগ্রহায়নের নামকরণ কোনো নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে নববর্ষ সূচিত হতো হেমন্তকালের যে মাসটিতে সেই মাসটির নামকরণ করা হয়েছিল অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ন শব্দের অর্থ অগ্র বৎসর।

১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে। তবে সেসময়ে এটি ছিল প্রধানত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও পরবর্তীতে এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসের সংযোগ ঘটেছে। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকা-ের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সনের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।

বর্তমানের বাংলা সন এসেছে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাদেশে এই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল শুভ নববর্ষ পালন করা হয়। আর পশ্চিমবঙ্গে তা ১৫ এপ্রিল পালন করা হয়। কারণ ভারতে হিন্দু সম্প্রদায় তিথি পঞ্জিকা অনুসরণ করে থাকে। বাংলাদেশে আধুনিক বাংলা বর্ষ পঞ্জিকায় গ্রেগরীয় পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ১৪ এপ্রিল বাংলা বছরের প্রথম দিন নির্দিষ্ট করা হয়।

পকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।

দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।

বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হয়। এটি পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসবকে চাকমারা ‘বিজু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’ বলে আখ্যা দিলেও গোটা পার্বত্য এলাকায় তা ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নববর্ষ উদ্যাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারা দেশ।

সবশেষে প্রত্যাশা রইলোÑ নতুন বছর সবার জীবনে কল্যাণ বয়ে আনুক। অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির ফল্গুধারা প্রবাহিত হোক। স্বাগতম নববর্ষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ]

back to top