alt

মুক্ত আলোচনা

কেউতো অপেক্ষায় নেই

আসফাক বীন রহমান

: রোববার, ০৭ এপ্রিল ২০২৪

“ আব্বা তুমি কতগুলো ট্রেনে চড়েছ ?” - মেয়ে জুঁইয়ের প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়াই । তাইতো , এই পর্যন্ত অসংখ্য গন্তব্যে পৌঁছাতে কতো না ট্রেনে চড়েছি ! ওকে বললাম, “এতো এতো ট্রেনে যতোবার চড়েছি ,সরকার ইচ্ছা করলেই আমার ট্রেনের ভাড়া দিয়েই একটি লাক্সারিয়াস বাস কিনে ফেলতে পারবে !”

ছোটবেলায় ঈদ -গ্রীষ্মের ছুটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসা- যাওয়ার জন্য উল্কা ,কর্ণফুলী, সুরমা মেইল ,চট্টগ্রাম মেইল, সিলেট মেইলে কতোবার চড়েছি তার ইয়াত্তা নাই ।পরবর্তীতে তূর্ণা নিশিথা, মহানগর (প্রভাতী ,গোধূলি, এক্সপ্রেস ),তিতাস কমিউটার,বাল্লা ,পারাবত, উপকূল,চট্টলা,নাসিরাবাদ এক্সপ্রেস ,জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে আসা-যাওয়ার হিসাব নাই ।

চাকুরীর শুরু থেকে এগারোসিন্দুর ,ঈশা খাঁ , পদ্মা, অগ্নিবীণা ,যমুনা ,নীলসাগর, তিস্তা, একতা ,সুন্দরবন, ধুমকেতু ,হাওর ,মহুয়া , ব্রহ্মপুত্র ,ভাওয়াল , সিল্কসিটি,টাঙ্গাইল কমিউটার, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, ঈশ্বরদী কমিউটারে দিনের পর দিন অফিসে যাতায়াত করেছি। প্রত্যেক ট্রেন জার্নির লক্ষ্য থাকে অফিস কিংবা ক্লাসে সময়মতো পৌঁছানো অথবা বাড়িতে ফেরা - যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন আম্মা-আব্বা, ইমন, দাদা -দাদী ,নানা -নানী ।

চোখ বুজলেই দেখি, আম্মা আজিমপুর কলোনীর দুই তলা বাসার বারান্দায় জানালার দুটি শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন - চোখে উৎকণ্ঠা । আমাকে দেখলেই মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি ।অনেক সময় স্টেশনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষারত আব্বার উদ্বিগ্ন মুখের ছবি ভেসে আসে । মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আম্মার কাছে গাঁই গুঁই করতাম ,” বন্ধুরা হাসাহাসি করে । আব্বাকে স্টেশনে যেতে মানা করেন !”

শীতের সকালে মোল্লাবাড়ীর পুকুরের উপর কুয়াশার স্তর ভেদ করা সূর্যরসশ্মির মায়া কি কম ? ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার পর দাদীর কোরআন শরীফ তেলাওয়াতের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় । চুপটি করে উনার মায়াধরা সেই তেলোয়াত শুনতে থাকি । দাদীর বিশেষ আলমারীর আশপাশ থেকে মন উদাস করা সুবাস ছড়ায় বিভিন্ন ধরনের আচার । মিষ্টি কাশ্মীরি আচার, আমের মোরব্বা ,চাল কুমড়ার মোরব্বা , স্কোয়াশ দাদির খুব পছন্দের জিনিস ; সহজে কাউকে দিতে চান না । প্রতি মৌসুমে এতো এতো আচার বানিয়ে রাখেন । আলমারির আশেপাশে ঘুরঘুর করলে মুচকি হেসে পিরিচে চামচ দিয়ে কাশ্মীরি আচার খেতে দেন । বিছানায় আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হাঁস- মুরগীর দুই তলা খোয়াড়ের দরজা খোলার আওয়াজের সঙ্গে রাজহাঁস ,পাতিহাঁস,মুরগীর সাথে সাথে ভোরের ঘোষণাকারী ক্লান্ত মোরগের বাঁধনছাড়া আনন্দের কল-কাকলীতে আর শুয়ে থাকা যায় না । দারোগা দাদার বাড়ীর পাশ দিয়ে এক লাইনে পুকুরের দিকে মার্চ করা পাতি হাঁসের দলকে কত সুন্দরই না লাগতো ।

বাড়ীতে এলে আমাদের ডিউটি দুটি ; সকালে দাদা এবং বাংলাঘরে থাকা চিটাগাঙের হুজুর নানার কাছে কুকিজ বিস্কিট আর চা পৌঁছে দেয়া । দাদা ইজি চেয়ারে বসে পেপার পড়তে পড়তে স্কুলের দিকে যাওয়া ছেলে-মেয়েদের লক্ষ্য করেন । স্কুল থেকে ফেরার পথে তাদের জিজ্ঞেস করেন ক্লাস কেমন হয়েছে , কি পড়িয়েছে ? চিটাগাঙের হুজুরনানার নাম মোঃ জামাল উদ্দিন । অল্প বয়সে স্ত্রী ও বাচ্চাকে হারিয়ে মনের দুঃখে বাড়ি ছাড়েন, চাকুরী ছাড়েন অভিজাত পরিবারের এই সন্তান। এক সময় আমাদের গ্রামে আসেন -আব্বার জন্মের পরপর । নবজাতকের অবস্থা ভালো না থাকায় উনার মতো বুজুর্গের কাছে দাদা , লাল মিয়া দাদা বাচ্চার জন্য দোয়া চান । আল্লাহর দয়ায় নবজাতক সুস্থ হয়ে গেলে দাদা এবং উনার বড় ভাই ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট শামসুল হুদা (লাল মিয়া )দাদা আমাদের বাংলা ঘরে উনাকে থেকে যেতে অনুরোধ করেন ।আমাদের দুই ভাইকে দেখলে খুব আনন্দিত হন । হাত ধরে বলেন, “ বাইসাব কেমন আছো ? তোমার নানা-নানী কেমন আছেন? শুনলাম তোমার নানী বলে হুঁটকি চুরী করছেন ? “ হুজুরনানা ঠা ঠা করে হাসতে থাকেন। আম্মাকে বললে জানালেন,” তোমাদের সাথে মজা করেছেন ।” উনি আমৃত্য জালশুকা গ্রামের মোল্লাবাড়ীতে কাটিয়ে দেন ।

রাতে হামান দিস্তায় দাদার পান ছেঁচে দিতে আমরা দুই ভাই কাড়াকাড়ি করি ; দাদীর কাছে শুকতারা , কালপুরুষ, সপ্তর্ষি মন্ডলের গল্প শুনি । একদিন সকালে সামনের দালানের দরজা- জানালা খোলা দেখে অবাক হই । আমরা দুই ভাই তখন পেয়ারা গাছে ওঠার কসরত করছি -দাদার উৎসাহে । কিন্তু, জানালার দিকে তাকিয়ে লিলিপুটিয়ান দাদাকে দেখে আকাশ থেকে পড়ি; উনি কিভাবে মালিবাগ থেকে এই জালশুকায় বেড়াতে চলে এলেন ? কিভাবে আমাদের দাদাবাড়ী চিনলেন ? লিলিপুটিয়ান দাদা আমাদের দেখতে পেয়েই ডাক দিলেন, ‘আয় ,আয় ।’

মালিবাগের লিলিপুটিয়ান দাদাকে আমরা দারোগা দাদাও বলি। লম্বা-চওড়া ,ঋজু দেহের রিটায়ার্ড পুলিশের ডিএসপি আব্দুল হাই (জিল্লু মিয়া) সাহেবই আমাদের লিলিপুটিয়ান দাদা ।

উনার মালিবাগের চৌধুরীপাড়ার বাসায় ছুটির দিনে বেড়াতে যাই । উনি আমাদের দেখে হাত খুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,’ আমার ভাইয়েরা চলে এসেছে !’ মালিবাগের বাসার সীমানায় ঢোকার সাথে সাথে মণি ফুপু, আনু ফুপুর বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে আম্মা খুব আনন্দিত হন । “ ভাবী, আজকে সারাদিন থাইক্যা রাতে ভাত খাইয়া তারপর যাইবা । বাইসাবরে ফোনে জানাই দিচ্ছি ।” উনাদের উচ্ছ্বাসে আম্মা বলেন , “ না রে বাচ্চাদের পড়া আছে ।” আম্মা উনাদের তুই বলেন , উনারা আম্মাকে তুমি বলেন । বিশাল শরীরের মতোই বিশাল মনের আজাদ চাচা বলেন , “ কিরে তোদের লিলিপুটিয়ান দাদার সাথে দেখা হয়েছে ? তাড়াতাড়ি যা, অপেক্ষা করছেন ।”

লিলিপুটিয়ান দাদার হাত থেকে আপেল খেতে খেতে বলি , “ আপনি আমাদের গ্রামে বেড়াতে এসেছেন, খুব ভালো লাগছে । আমাদের দাদার সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিবো ।” উনাকে হাতে ধরে আমাদের দাদার ইজি চেয়ারের কাছে নিয়ে আসি । বলি,” দাদা , ইনি আমাদের মালিবাগের লিলিপুটিয়ান দাদা ।” দাদী হাসতে হাসতে বলেন, “তোরা আজকে যখন খাবার ছাতুকে ধানের কুড়া বলেছিস তখনই মনে হয়েছিল ,তোরা দুইটা বেক্কল ! আরে, এই জিল্লু মিয়া হচ্ছে তোদের দাদার আপন ছোট ভাই । “ বড় বড় চোখে দুই দাদাকে দেখে বুঝতে পারি ,চেহারায় তো অনেক মিল ! নবীন দুই ভাইয়ের সরলতায় প্রবীণ দুই ভাই উচ্চ স্বরে হাসতে থাকেন ।

আমাদের পথের দিকে ঘোমটা টানা দাদীর আকুতি ভরা চোখ , বাংলা ঘরের সামনে দাদার পায়চারি মনে করিয়ে দেয় আমরা উনাদের কাছে কতটা আরাধ্য। নানা বাড়িতে কিছুক্ষণ পর নানার জিজ্ঞাস্য “ওরা ছাদে উঠে নাই তো ?” বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে নানীর জড়িয়ে ধরে বলা , “ কাল সকালে নাস্তায় তোমাদের কি পিঠা খাওয়াবো ভাইয়া ?” -কোথায় হারিয়ে গেলো?

ছেলে-মেয়ে খুব করে ধরেছে এবারের ঈদ জালশুকায় আমাদের বাড়িতে করার জন্য । অফিসে ট্রেনে করে যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই মনে হলো, আমাদের জন্যতো কেউ আর অপেক্ষা করে না ; যাদের উদ্বিগ্ন চোখ আমাদের দেখে হাসিতে চিক চিক করে উঠবে । কদাচিৎ স্বার্থহীন কোন মানুষ হয়তো আমাদের বাড়ি ফেরার কথা ভাবে । ফিডব্যাকের মাকসুদের মতোই --

হয়তো কারো পড়বে মনে একলা একা

ধল পহরের প্রথম আলোয় হঠাৎ দেখা ।।

-- আচমকা মনে ঘাঁই দেয় হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের মুখ ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]

রিলিফ

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

tab

মুক্ত আলোচনা

কেউতো অপেক্ষায় নেই

আসফাক বীন রহমান

রোববার, ০৭ এপ্রিল ২০২৪

“ আব্বা তুমি কতগুলো ট্রেনে চড়েছ ?” - মেয়ে জুঁইয়ের প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়াই । তাইতো , এই পর্যন্ত অসংখ্য গন্তব্যে পৌঁছাতে কতো না ট্রেনে চড়েছি ! ওকে বললাম, “এতো এতো ট্রেনে যতোবার চড়েছি ,সরকার ইচ্ছা করলেই আমার ট্রেনের ভাড়া দিয়েই একটি লাক্সারিয়াস বাস কিনে ফেলতে পারবে !”

ছোটবেলায় ঈদ -গ্রীষ্মের ছুটিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসা- যাওয়ার জন্য উল্কা ,কর্ণফুলী, সুরমা মেইল ,চট্টগ্রাম মেইল, সিলেট মেইলে কতোবার চড়েছি তার ইয়াত্তা নাই ।পরবর্তীতে তূর্ণা নিশিথা, মহানগর (প্রভাতী ,গোধূলি, এক্সপ্রেস ),তিতাস কমিউটার,বাল্লা ,পারাবত, উপকূল,চট্টলা,নাসিরাবাদ এক্সপ্রেস ,জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে আসা-যাওয়ার হিসাব নাই ।

চাকুরীর শুরু থেকে এগারোসিন্দুর ,ঈশা খাঁ , পদ্মা, অগ্নিবীণা ,যমুনা ,নীলসাগর, তিস্তা, একতা ,সুন্দরবন, ধুমকেতু ,হাওর ,মহুয়া , ব্রহ্মপুত্র ,ভাওয়াল , সিল্কসিটি,টাঙ্গাইল কমিউটার, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, ঈশ্বরদী কমিউটারে দিনের পর দিন অফিসে যাতায়াত করেছি। প্রত্যেক ট্রেন জার্নির লক্ষ্য থাকে অফিস কিংবা ক্লাসে সময়মতো পৌঁছানো অথবা বাড়িতে ফেরা - যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন আম্মা-আব্বা, ইমন, দাদা -দাদী ,নানা -নানী ।

চোখ বুজলেই দেখি, আম্মা আজিমপুর কলোনীর দুই তলা বাসার বারান্দায় জানালার দুটি শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন - চোখে উৎকণ্ঠা । আমাকে দেখলেই মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি ।অনেক সময় স্টেশনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষারত আব্বার উদ্বিগ্ন মুখের ছবি ভেসে আসে । মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আম্মার কাছে গাঁই গুঁই করতাম ,” বন্ধুরা হাসাহাসি করে । আব্বাকে স্টেশনে যেতে মানা করেন !”

শীতের সকালে মোল্লাবাড়ীর পুকুরের উপর কুয়াশার স্তর ভেদ করা সূর্যরসশ্মির মায়া কি কম ? ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার পর দাদীর কোরআন শরীফ তেলাওয়াতের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় । চুপটি করে উনার মায়াধরা সেই তেলোয়াত শুনতে থাকি । দাদীর বিশেষ আলমারীর আশপাশ থেকে মন উদাস করা সুবাস ছড়ায় বিভিন্ন ধরনের আচার । মিষ্টি কাশ্মীরি আচার, আমের মোরব্বা ,চাল কুমড়ার মোরব্বা , স্কোয়াশ দাদির খুব পছন্দের জিনিস ; সহজে কাউকে দিতে চান না । প্রতি মৌসুমে এতো এতো আচার বানিয়ে রাখেন । আলমারির আশেপাশে ঘুরঘুর করলে মুচকি হেসে পিরিচে চামচ দিয়ে কাশ্মীরি আচার খেতে দেন । বিছানায় আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হাঁস- মুরগীর দুই তলা খোয়াড়ের দরজা খোলার আওয়াজের সঙ্গে রাজহাঁস ,পাতিহাঁস,মুরগীর সাথে সাথে ভোরের ঘোষণাকারী ক্লান্ত মোরগের বাঁধনছাড়া আনন্দের কল-কাকলীতে আর শুয়ে থাকা যায় না । দারোগা দাদার বাড়ীর পাশ দিয়ে এক লাইনে পুকুরের দিকে মার্চ করা পাতি হাঁসের দলকে কত সুন্দরই না লাগতো ।

বাড়ীতে এলে আমাদের ডিউটি দুটি ; সকালে দাদা এবং বাংলাঘরে থাকা চিটাগাঙের হুজুর নানার কাছে কুকিজ বিস্কিট আর চা পৌঁছে দেয়া । দাদা ইজি চেয়ারে বসে পেপার পড়তে পড়তে স্কুলের দিকে যাওয়া ছেলে-মেয়েদের লক্ষ্য করেন । স্কুল থেকে ফেরার পথে তাদের জিজ্ঞেস করেন ক্লাস কেমন হয়েছে , কি পড়িয়েছে ? চিটাগাঙের হুজুরনানার নাম মোঃ জামাল উদ্দিন । অল্প বয়সে স্ত্রী ও বাচ্চাকে হারিয়ে মনের দুঃখে বাড়ি ছাড়েন, চাকুরী ছাড়েন অভিজাত পরিবারের এই সন্তান। এক সময় আমাদের গ্রামে আসেন -আব্বার জন্মের পরপর । নবজাতকের অবস্থা ভালো না থাকায় উনার মতো বুজুর্গের কাছে দাদা , লাল মিয়া দাদা বাচ্চার জন্য দোয়া চান । আল্লাহর দয়ায় নবজাতক সুস্থ হয়ে গেলে দাদা এবং উনার বড় ভাই ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট শামসুল হুদা (লাল মিয়া )দাদা আমাদের বাংলা ঘরে উনাকে থেকে যেতে অনুরোধ করেন ।আমাদের দুই ভাইকে দেখলে খুব আনন্দিত হন । হাত ধরে বলেন, “ বাইসাব কেমন আছো ? তোমার নানা-নানী কেমন আছেন? শুনলাম তোমার নানী বলে হুঁটকি চুরী করছেন ? “ হুজুরনানা ঠা ঠা করে হাসতে থাকেন। আম্মাকে বললে জানালেন,” তোমাদের সাথে মজা করেছেন ।” উনি আমৃত্য জালশুকা গ্রামের মোল্লাবাড়ীতে কাটিয়ে দেন ।

রাতে হামান দিস্তায় দাদার পান ছেঁচে দিতে আমরা দুই ভাই কাড়াকাড়ি করি ; দাদীর কাছে শুকতারা , কালপুরুষ, সপ্তর্ষি মন্ডলের গল্প শুনি । একদিন সকালে সামনের দালানের দরজা- জানালা খোলা দেখে অবাক হই । আমরা দুই ভাই তখন পেয়ারা গাছে ওঠার কসরত করছি -দাদার উৎসাহে । কিন্তু, জানালার দিকে তাকিয়ে লিলিপুটিয়ান দাদাকে দেখে আকাশ থেকে পড়ি; উনি কিভাবে মালিবাগ থেকে এই জালশুকায় বেড়াতে চলে এলেন ? কিভাবে আমাদের দাদাবাড়ী চিনলেন ? লিলিপুটিয়ান দাদা আমাদের দেখতে পেয়েই ডাক দিলেন, ‘আয় ,আয় ।’

মালিবাগের লিলিপুটিয়ান দাদাকে আমরা দারোগা দাদাও বলি। লম্বা-চওড়া ,ঋজু দেহের রিটায়ার্ড পুলিশের ডিএসপি আব্দুল হাই (জিল্লু মিয়া) সাহেবই আমাদের লিলিপুটিয়ান দাদা ।

উনার মালিবাগের চৌধুরীপাড়ার বাসায় ছুটির দিনে বেড়াতে যাই । উনি আমাদের দেখে হাত খুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,’ আমার ভাইয়েরা চলে এসেছে !’ মালিবাগের বাসার সীমানায় ঢোকার সাথে সাথে মণি ফুপু, আনু ফুপুর বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে আম্মা খুব আনন্দিত হন । “ ভাবী, আজকে সারাদিন থাইক্যা রাতে ভাত খাইয়া তারপর যাইবা । বাইসাবরে ফোনে জানাই দিচ্ছি ।” উনাদের উচ্ছ্বাসে আম্মা বলেন , “ না রে বাচ্চাদের পড়া আছে ।” আম্মা উনাদের তুই বলেন , উনারা আম্মাকে তুমি বলেন । বিশাল শরীরের মতোই বিশাল মনের আজাদ চাচা বলেন , “ কিরে তোদের লিলিপুটিয়ান দাদার সাথে দেখা হয়েছে ? তাড়াতাড়ি যা, অপেক্ষা করছেন ।”

লিলিপুটিয়ান দাদার হাত থেকে আপেল খেতে খেতে বলি , “ আপনি আমাদের গ্রামে বেড়াতে এসেছেন, খুব ভালো লাগছে । আমাদের দাদার সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিবো ।” উনাকে হাতে ধরে আমাদের দাদার ইজি চেয়ারের কাছে নিয়ে আসি । বলি,” দাদা , ইনি আমাদের মালিবাগের লিলিপুটিয়ান দাদা ।” দাদী হাসতে হাসতে বলেন, “তোরা আজকে যখন খাবার ছাতুকে ধানের কুড়া বলেছিস তখনই মনে হয়েছিল ,তোরা দুইটা বেক্কল ! আরে, এই জিল্লু মিয়া হচ্ছে তোদের দাদার আপন ছোট ভাই । “ বড় বড় চোখে দুই দাদাকে দেখে বুঝতে পারি ,চেহারায় তো অনেক মিল ! নবীন দুই ভাইয়ের সরলতায় প্রবীণ দুই ভাই উচ্চ স্বরে হাসতে থাকেন ।

আমাদের পথের দিকে ঘোমটা টানা দাদীর আকুতি ভরা চোখ , বাংলা ঘরের সামনে দাদার পায়চারি মনে করিয়ে দেয় আমরা উনাদের কাছে কতটা আরাধ্য। নানা বাড়িতে কিছুক্ষণ পর নানার জিজ্ঞাস্য “ওরা ছাদে উঠে নাই তো ?” বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে নানীর জড়িয়ে ধরে বলা , “ কাল সকালে নাস্তায় তোমাদের কি পিঠা খাওয়াবো ভাইয়া ?” -কোথায় হারিয়ে গেলো?

ছেলে-মেয়ে খুব করে ধরেছে এবারের ঈদ জালশুকায় আমাদের বাড়িতে করার জন্য । অফিসে ট্রেনে করে যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই মনে হলো, আমাদের জন্যতো কেউ আর অপেক্ষা করে না ; যাদের উদ্বিগ্ন চোখ আমাদের দেখে হাসিতে চিক চিক করে উঠবে । কদাচিৎ স্বার্থহীন কোন মানুষ হয়তো আমাদের বাড়ি ফেরার কথা ভাবে । ফিডব্যাকের মাকসুদের মতোই --

হয়তো কারো পড়বে মনে একলা একা

ধল পহরের প্রথম আলোয় হঠাৎ দেখা ।।

-- আচমকা মনে ঘাঁই দেয় হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের মুখ ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর]

back to top