alt

মুক্ত আলোচনা

মনমাঝি

আসফাক বীন রহমান

: সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

‘ মস্তু ,সামালকো। তরাতরী হালডা ধর, ’ কলিমুদ্দিন ভাইয়ের সতর্ক আর্তনাদ। ঢেউয়ে নৌকার অবস্থা টাল-মাটাল । যখন নানাবাড়ি থেকে রওনা দেই , তখনই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো । এক ঘন্টা হলো আমরা বিলে আছি । হঠাৎ উঁচু উঁচু ঢেউয়ে নৌকার দুলুনীতে আম্মা আমাদেরকে ধরে দোয়া পড়ছেন । “ বাবী , ডরাইন না । কুস্তা অইতো না ” ,মস্তু কাকা হাল সামলাতে সামলাতে আমাদের সাহস দেন ।

কলিমুদ্দিন ভাই আর মস্তু কাকা সম্পর্কে বাবা আর ছেলে । বাবাকে আমরা দুই ভাই বলি ভাই আর ওনার ছেলেকে বলি কাকা । দুজনে দাদার ব্যক্তিগত পানসি নৌকার পেইড মাঝি । দাদা রউফ সাহেব শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রিটায়ার করে সরাসরি গ্রামের পৈতৃক বাড়ীতে চলে আসেন । একটি সুন্দর ছইঅলা পানসি নৌকা তৈরি করেন । নৌকাটি এত সুন্দর ! গলুই এবং পিছনের হালের অংশটি বেশ উঁচু । গলুই এবং এর পাশ থেকে সাদা জমিনের উপর ময়ূরের চোখ এবং দুই দিকে বডির সাইডের অংশ ও পিছন দিকটা এমন ভাবে কারুকার্য করা যেন একটি ময়ূর নদীতে ভাসছে । হালটি বেশ বড় এবং সাদা ,সবুজ ও লাল নকশা করা । অত্যন্ত ভারী এই নৌকাটি নিয়মিত আলকাতরা ও মেরামতের মাধ্যমে ঝকঝকে রাখায় এটা আমাদের পরিবারের অন্যরকম আইডেন্টিটি দিয়েছে । ছৈটি বেশ মজবুত । বেত, বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি ছৈয়ের সামনের দিকে মাঝখানে একটি দরজা আর দুই পাশে দুটি ছোট জানালা । জানালার সামনের দিকটা সাদা জমিনের উপর ফুল ,নদী , উদীয়মান লাল সূর্য আর নীল মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ রং । জানালার ভেতর দিকে রয়েছে শিকের গ্রিল এবং দুটি হুক । ছৈ এর ভিতরে জানালার পাশে একটি নারকোলের কালো খোলওয়ালা হুক্কা দড়িতে ঝুলছে । টিক্কা আর তামুক রয়েছে পাটাতনের এক পাশে একটি কাঠের বাক্সে ।

কলিমুদ্দিন ভাই দ্রুত হাতে ছৈয়ের উপরের পাল গুটিয়ে আনছেন । বিলে নৌকা পড়ার পর এই সুন্দর বাদামী পালটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন । পালের মাঝখানে দুটি কমলা রঙের তাপ্পি । পালে বাতাস লেগে বিশাল বপুর মানুষের ভূড়ির মতো ফুলে উঠেছিল। পাল টানানোর পরপরই নৌকার গতি বাড়তে থাকে ; এতে কলিমুদ্দিন ভাইদের কষ্টটা কমে আসে ।

দুপুরের আগেই নানাবাড়ীর পিছন দিকে খালের গেটে মস্তু কাকাদের নৌকা ভিড়ে । দাদী সুন্দর করে তোষক , পরিষ্কার বিছানার চাদর আর বালিশ নৌকার পাটাতনে বিছিয়ে দিতে বলেছেন । সাথে দিয়েছেন টিফিন ক্যারিয়ারভর্তি ভাত, কৈ মাছের দোঁপেয়াজি , একটি টক জাতীয় তরকারি ,শাক, ডাল ও ভর্তা । এটা নৌকায় বসে আমাদের দুপুরের লাঞ্চ ।

কিন্তু নানাবাড়ীতে মস্তু কাকাকে দেখেই নানা-নানী দুজনেই উনাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেছেন । কলিমুদ্দিন ভাই আম্মার সাথে দেখা না করেই থানাঘাটের দিকে চলে গেছেন তিতাসের পাড় থেকে বড় আইর / বোয়াল বা কাতলা মাছ কিনে আনার জন্য । এটা দাদার নির্দেশ -বেয়াইবাড়ীর জন্য আনতেই হবে । নানী উনাদের প্রবল আপত্তিতে কোন রকম কান না গলিয়ে গরম গরম পোলাও মুরগির তরকারী দিয়ে খেতে বসিয়েছেন । পাশের ইজি-চেয়ারে বসে নানা তদারকী করছেন । কলিমুদ্দিন ভাইদের প্রতি নানা-নানীর অসীম স্নেহ । নানী প্রায়ই বলেন ,“ওরা বাপ- ছেলে এতো ভদ্র ,সৎ - বিশ্বাসী ও ভালো মানুষ ; এই যুগে দেখা যায় না ।”

থানাঘাট থেকে একটি খাল শহরের ভেতর মৌলভীপাড়া , কাজীপাড়া, মধ্যপাড়া ,ছয়বাড়িয়া হয়ে গোকর্ণঘাটে তিতাসের অপর অংশকে যুক্ত করেছে । বর্ষাকালে খালে থাকে টৈ-টম্বুর পানি । থানাঘাট থেকে গয়না নৌকা গোকর্ণঘাট , গোঁসাইপুর , থানাকান্দি পর্যন্ত যাতায়াত করে । আমরা বর্ষায় নানাবাড়ীতে এলে ছাদে বা সীমানা প্রাচীরের দুই দিকে পা ঝুলিয়ে বসে বসে চলে যাওয়া নৌকা দেখি । পাশের পাক্কার পুলটি থেকে দুরন্ত ছেলের দল খালে ঝাঁপ দেয় । পুলটি মৌলভীপাড়াকে কাজীপাড়ার সাথে যুক্ত করেছে । এর পূর্ব দিকের রেলিঙে দুই মানুষ সমান উঁচু করে টিনের বেড়া দেয়া হয়েছে নানার ব্যক্তিগত আগ্রহে এবং বাসার আব্রুর জন্য ।

আম্মার তাগাদায় আমরা তাড়াতাড়ি দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে নৌকায় উঠি । আম্মা খাননি ; দাদীর হাতের তরকারী দিয়ে মজা করে খাবেন বলে । খালে তীব্র পশ্চিমমুখী স্রোতে নৌকাকে শুধুমাত্র দিক নিয়ন্ত্রণে চইড়(লগি) ব্যবহার করছেন কলিমুদ্দিন ভাইয়েরা । মাঝে মাঝে কাজীপাড়ার দুষ্টু ছেলের দল লগি বা হাল ধরে নৌকায় ওঠার চেষ্টা করলেই ‘ দূর বেত্তমিজ ’ বলে কলিমুদ্দিন ভাই তাদের থামানোর চেষ্টা করে যান । পৈরতলা রেলওয়ে ব্রীজের নীচে এসে স্রোতের তীব্রতা কমে যাওয়া উনাদের ‘চইড় মারতে ’ হয় । আরেকটু সামনে গিয়েই আড়াআড়ি গ্রামের ভিতর ক্ষেতের উপরে উঠে যাওয়া পানির উপর দিয়ে নৌকা চালাতে শুরু করেন । কালিসীমার বিলের ওপর নৌকা আসতেই আম্মা খাবার বেড়ে খেতে ডাকেন । নৌকার দুলুনী ,শোঁ শোঁ বাতাস , পানির সোঁদা গন্ধে আমাদের আবার খিদে পেয়ে যায় ।

মস্তু কাকা আমাকে ইশারা করে হুঁক্কাটি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন । ছৈয়ের এক পাশে দরজা আর অন্যপাশের ফাঁকা জায়গাটি একটি পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে । সমানে নৌকার গলুই থেকে ছৈ পর্যন্ত একপাশ থেকে মস্তু কাকা আর অন্যপাশ থেকে কলিমুদ্দিন ভাই লগি ফেলে নৌকা টেনে যাচ্ছেন । নিয়মিত বিরতিতে ঘট ঘট করে লগির সাথে নৌকার বডিতে আঘাতের আওয়াজ , পানিতে ঝপ করে লগি ফেলার আওয়াজ আর লগি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পাটাতনে পড়ে যাওয়া পানির আওয়াজে একসময় চোখে তন্দ্রা পেয়ে যায় ।

ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ইমন কলিমুদ্দিন ভাইকে অনুরোধ করে লগিটি হাতে দিতে ; নৌকা বাইবার জন্য । উনি হাঃ হাঃ করে হেসে উঠেন ,“ আর কদ্দুরা বড় হও ”। মস্তু কাকা তামুক -টিক্কা ধরিয়ে দুই তিনটি টান দিয়ে কলিমুদ্দিন ভাইয়ের হাতে হুঁকাটি চালান দেন । আম্মাকে বাবা -ছেলের একসাথে হুঁকা টানার কথা বলতেই চোখ পাকিয়ে বললেন ,“ গ্রামে ঠান্ডায় , পরিশ্রমের কাজের ফাঁকে ফাঁকে লোকজন হুঁকা খায় ।”

গোকর্ণঘাট থেকে চর গোঁসাইপুর পর্যন্ত একটা ভাঙাচোরা মাটির সড়ক আছে। সেটার বিরাট একটা অংশ বর্ষায় তলিয়ে যায় । সড়কটি শুধু শীতের দিনে পায়দলে রাস্তা হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না ,বর্ষায় তিতাস নদী ও বিলের প্রবল ঢেউ থেকে বিরামপুর , গাছতলা , বাগমারা , সাদেকপুর , ভারসিলা গ্রামকেও রক্ষা করে । লোকজন ঢেউ থেকে বাড়িঘর বাঁচাতে নদী থেকে টেনে কচুরিপানা সড়ক বরাবর জমিয়ে রাখে । বাঁশ গেঁড়ে , দড়ি দিয়ে এই পানা যাতে ভেসে না যায় সেই চেষ্টাও করে ।এটাকে আরো পোক্ত করতে কলমীলতা, হেলেঞ্চার ঝোপকে এর সাথে ট্যাগ করেন। হঠাৎ করে মস্তু কাকা “ আইস্ সব্বোনাশ, আব্বা পানা কেমনে বাড়ছে দেখছোনি!” কলিমুদ্দিন ভাই গাছতলা গ্রাম বরাবর কচুরিপানার আগ্রাসন দেখে “ মস্তু, তরাতরি কর! হাইন্জার আগেই জালশুকায় ঢুকতে অইবো ” বলে তৎপর হন ।

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর ইমনকে ছৈয়ের উপর উঠতে দেখে কলিমুদ্দিন ভাই “ ইলা দাদার মতো সাহসী” বলে প্রশংসা করায় আমি মনে মনে হিংসায় জ্বলে উঠে শপথ করলাম, জালশুকায় এবার অনেক দূরণ্তপনা করে আমার সাহস দেখাবো !

আম্মা মস্তুকাকাকে কচুরিপানার কি সমস্যা জানতে চাইলে, জবাব দেন কলিমুদ্দিন ভাই “ যেইদিকে এই পানা আটকায় ২/৩ রাইতেই বাড়তে থাকে, দুই হপ্তায় দ্বিগুণ হয় ; গেরামে ঢুকার পথ বন্ধ হইয়া যায় । গেরামের লোকজন এইডারে জার্মানি কয় ।” পরে দাদার কাছে শুনেছি ১৯৩৭ সনের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে শুধুমাত্র কচুরিপানার আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে জলাভূমিকে কচুরিপানার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য অঙ্গীকার করা হয়েছিল । ১৯৩৬ সালে বাংলার ‘জলাভূমি আইন’ যেটা ‘কচুরিপানা আইন ’ নামেও পরিচিত ছিল,পাশ হয় । এমনকি কাজী নজরুল ইসলাম এই পানা নিয়ে কবিতা লিখেছেন -

‘ ধ্বংস করো এই কচুরিপানা!

(এরা )লতা নয় ,পরদেশি অসুরছানা ।। ’

(কচুরিপানা)

এত সুন্দর নীলচে- বেগুনী ফুলের কচুরিপানার বদনাম শুনে আম্মা বলেন , “ গরুকে তো পানা খেতে দেয় ; এটা শুকিয়ে চুলা জ্বালাতেও দেখেছি ”।

বিলের উপর দিয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ দেখি মস্তু কাকা পানিতে নেমে হালের চারপাশ থেকে বিভিন্ন জলজ লতা টেনে টেনে সরিয়ে হালটাকে হালকা করলেন । এখানে উনার বুক সমান পানি । ইমন পানিতে নামতে চাইলে আম্মা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ফিউজ হয়ে যায় । পানির উপর স্রোত নেই বললেই চলে । উপর থেকে নীচের চলন্ত মাছ , কাঁচ-পোকা , জলজ উদ্ভিদ দেখা যাচ্ছে । কিছুটা সামনেই হালকা লাল , সাদা , নীল শাপলা ফুল দেখতেই আমি চিৎকার করে ইমনকে দেখালাম । আমাদের উচ্ছ্বাস দেখে উনারা বাবা- ছেলে হাসতে লাগলেন । শাপলার বড় বড় গোলাকার পাতার উপর দিয়ে হাট্টিটি , ডাহুক পাখি হেঁটে বেড়াচ্ছে । বেশ কয়টি বড় ডাঁটাসহ শাপলা ফুল ,সাথে গোল ঢেপফল দিয়ে মস্তু কাকা বললেন “এইটা খাইতে পারো ।” ভেতরের কালচে বীজগুলো পানসে লাগায় ‘ওয়াক থু ’ বলে আমরা ফেলে দেই । আম্মা, “ মস্তুর বাপ , ঢেপের খৈ হয় না ?” বলে কলিমুদ্দিন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে উচ্ছ্বসিত মস্তু কাকা ঢেপের খৈ , মোয়া ইত্যাদি আমাদেরকে খাওয়াবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন । “ হালুক খাইছোনি ?” কলিমুদ্দিন ভাইয়ের এই কথায় আমরা বলি ‘ শালুক দেখি নাই ’। এক ফাঁকে আলুর মতো কালো শাপলার মূল উঠিয়ে আমাদের হাতে দেন; এটা পুড়িয়ে খেলে নাকি খুব মজা লাগে !

চারপাশে দূরে দূরে অসংখ্য লাল ,নীল , হলুদ পালতোলা নৌকা দেখতে পেয়ে আমরা উনাদের আমাদের পালটা টানিয়ে দিতে অনুরোধ করি । কিন্তু, বিলে বাতাস না থাকায় লগি ঠেলে নৌকা এগিয়ে নেয়াটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে । বাপ- বেটা মিলে লম্বা একটা বাঁশের টুকরোর এক মাথায় দড়ি বেঁধে অন্য মাথাটি পাল টানানোর লম্বা বাঁশের মাথায় বেঁধে গুণ টানার প্রস্তুতি শেষ করেন । মস্তু কাকা বিলের গলা পানিতে নেমে আস্তে আস্তে তীরের দিকে এগোতে থাকেন । আমরা দুইজন গলুই-এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উনাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতে থাকি । তীরে ওঠে নৌকার সামনের দিকে ঘাড়ে দড়িসহ বাঁশের টুকরোটি ধরে মস্ত কাকা টানতে থাকেন । দড়িটা টানটান হয়ে নৌকা চলতে লাগলো । পেশীবহুল মস্তু কাকাকে দেখতে রোমান বীর স্পার্টাকাস এর মত মনে হচ্ছে । আম্মা উনাদের তীব্র শারীরিক পরিশ্রম দেখে আফসোস করতে লাগলেন ।

সন্ধ্যায় বাংলাঘর থেকে পূর্ব -দক্ষিণ দিকে সাত/ আট কিলোমিটার দূরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হলদে লাইটগুলো দেখে আমরা আশাবাদী হবার চেষ্টা করি , একদিন আমাদের গ্রামেও বিদ্যুৎ আসবে । কোনদিন হালকা বৃষ্টি আবার কোনদিন ভারী বৃষ্টির মাঝে মাঝে পরিষ্কার আকাশে সন্ধ্যায় সন্ধ্যাতারা দেখতে পেয়ে আমরা দাদীকে ধরি গল্প বলার জন্য । বিদ্যুৎ না থাকায় সন্ধ্যায় মশার উৎপাত আর গরমে আম্মাকে জ্বালাতন করতে থাকি হাত পাখার বাতাস করার জন্য । দাদী আম্মাকে রিলিফ দেয়ার জন্য আমাদেরকে উঠানে মাদুর পেতে বসতে বলেন। দাদার জন্য হামাণদিস্তায় পান ছেঁচতে ছেঁচতে দাদী সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং কোরআন শরীফ পড়ার জন্য আমাদের তাগিদ দেন । আশেপাশে ইমন রিনা ,রিপা, অপেলের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে চোর পলান্তি খেলছে। গল্পের গন্ধ পেয়ে ওরাও আমাদের সাথে শামিল হয় । উনার শুরু করা গল্প “ এক দেশে ছিলো একজন বাদশাহ- ” কোনদিন পুরোটা শোনা হয় না ; চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে । মাঝে মাঝে পরহেজগার, নির্লোভ দাদীকে উনার ছোটবেলার কথা জিজ্ঞেস করলে হাসতে হাসতে মোসাম্মৎ উম্মিয়া খাতুন ছোটবেলার জাঁকজমকপূর্ণ দিনগুলোতে ফিরে যান । উনার পিতা আব্দুল গনি মৃধা আশুগঞ্জের পাশে তালশহরে বিশাল বড় বাড়িতে ছয়টি কন্যা সন্তান নিয়ে আনন্দময় জীবন যাপন করেছেন । বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল গনি মৃধা প্রচুর স্থাবর সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের শিক্ষিত ও বিনয়ী হবার শিক্ষা দেন । আমরা দাদীকে মাঝে মাঝে ঢাকার আজিমপুর কলোনির ফেলে আসা বাসার কথা জিজ্ঞেস করে কোন আফসোস হয় কিনা জানতে চাইলে উনি হাসতে হাসতে বলেন ,“এই জীবন কয়দিনের ? সামনে অনন্তকালের জীবনের জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে ; লোভ করা যাবে না । তোদের দাদাও নির্লোভ মানুষ , সারাটি জীবন চাকুরীর কারণে ইউরোপ- আমেরিকায় কাটিয়ে এই বিদ্যুৎহীন গ্রামে চলে এসেছেন মানুষের ভালবাসার টানে । যে কেউ এসে কোন কিছু চাইলেই বিনা ওজরে দিয়ে দেন । ” আসলেই তো তাই । বাড়িতে প্রায়ই লোকজন এসে বলে ‘ দাদা , অমুকের মা খুব অসুস্থ। একটা ডাব খাইতে ইচ্ছা করছে ।’ দাদা বলেন ডাব পেড়ে নিয়ে যা ; কয়টি পাড়লো দেখতেও আসেন না । “তোর দাদা আমেরিকার অরিগন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ‘ গভর্নর অফ অরিগন স্টেট ’ উনাকে ‘এম্বাস্যাডার টু পাকিস্তান’ নির্বাচিত করেছিল ”, দাদী ।

ছুটি শেষে কলিমুদ্দিন ভাই আমাদের আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছে দিবেন । দাদা-দাদীকে ছেড়ে চলে যাওয়াটা খুব কষ্টকর । উনারা ঢাকায় যাবেন - থাকতে নয় ; ১০-১৫ দিন এর জন্য বেড়াতে বা ডাক্তার দেখাতে । চলে আসার দিন সকাল থেকে দাদা চুপ করে ইজি চেয়ারে বসে থাকেন , শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন । নৌকা ছেড়ে যাবার পর যতক্ষণ দেখা যায় দাদী বাংলা ঘরের কোনায় পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন । দাদীর ঘিয়ে রঙের শাড়ীতে চোখ মোছার হৃদয় নিংড়ানো বিদায়টা আজও জালশুকা থেকে ফেরত আসার সময় মানস চোখে দেখতে পাই ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্প কারখানার পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এনভায়রনমেন্টাল ইন্জিনিয়ারিং

অসুর: এক পরাজিত বিপ্লবী

অসুর জাতির ইতিহাস

বিশ্ব শিক্ষক দিবস : শিক্ষা পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদের চ্যালেঞ্জ

tab

মুক্ত আলোচনা

মনমাঝি

আসফাক বীন রহমান

সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

‘ মস্তু ,সামালকো। তরাতরী হালডা ধর, ’ কলিমুদ্দিন ভাইয়ের সতর্ক আর্তনাদ। ঢেউয়ে নৌকার অবস্থা টাল-মাটাল । যখন নানাবাড়ি থেকে রওনা দেই , তখনই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো । এক ঘন্টা হলো আমরা বিলে আছি । হঠাৎ উঁচু উঁচু ঢেউয়ে নৌকার দুলুনীতে আম্মা আমাদেরকে ধরে দোয়া পড়ছেন । “ বাবী , ডরাইন না । কুস্তা অইতো না ” ,মস্তু কাকা হাল সামলাতে সামলাতে আমাদের সাহস দেন ।

কলিমুদ্দিন ভাই আর মস্তু কাকা সম্পর্কে বাবা আর ছেলে । বাবাকে আমরা দুই ভাই বলি ভাই আর ওনার ছেলেকে বলি কাকা । দুজনে দাদার ব্যক্তিগত পানসি নৌকার পেইড মাঝি । দাদা রউফ সাহেব শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রিটায়ার করে সরাসরি গ্রামের পৈতৃক বাড়ীতে চলে আসেন । একটি সুন্দর ছইঅলা পানসি নৌকা তৈরি করেন । নৌকাটি এত সুন্দর ! গলুই এবং পিছনের হালের অংশটি বেশ উঁচু । গলুই এবং এর পাশ থেকে সাদা জমিনের উপর ময়ূরের চোখ এবং দুই দিকে বডির সাইডের অংশ ও পিছন দিকটা এমন ভাবে কারুকার্য করা যেন একটি ময়ূর নদীতে ভাসছে । হালটি বেশ বড় এবং সাদা ,সবুজ ও লাল নকশা করা । অত্যন্ত ভারী এই নৌকাটি নিয়মিত আলকাতরা ও মেরামতের মাধ্যমে ঝকঝকে রাখায় এটা আমাদের পরিবারের অন্যরকম আইডেন্টিটি দিয়েছে । ছৈটি বেশ মজবুত । বেত, বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি ছৈয়ের সামনের দিকে মাঝখানে একটি দরজা আর দুই পাশে দুটি ছোট জানালা । জানালার সামনের দিকটা সাদা জমিনের উপর ফুল ,নদী , উদীয়মান লাল সূর্য আর নীল মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ রং । জানালার ভেতর দিকে রয়েছে শিকের গ্রিল এবং দুটি হুক । ছৈ এর ভিতরে জানালার পাশে একটি নারকোলের কালো খোলওয়ালা হুক্কা দড়িতে ঝুলছে । টিক্কা আর তামুক রয়েছে পাটাতনের এক পাশে একটি কাঠের বাক্সে ।

কলিমুদ্দিন ভাই দ্রুত হাতে ছৈয়ের উপরের পাল গুটিয়ে আনছেন । বিলে নৌকা পড়ার পর এই সুন্দর বাদামী পালটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন । পালের মাঝখানে দুটি কমলা রঙের তাপ্পি । পালে বাতাস লেগে বিশাল বপুর মানুষের ভূড়ির মতো ফুলে উঠেছিল। পাল টানানোর পরপরই নৌকার গতি বাড়তে থাকে ; এতে কলিমুদ্দিন ভাইদের কষ্টটা কমে আসে ।

দুপুরের আগেই নানাবাড়ীর পিছন দিকে খালের গেটে মস্তু কাকাদের নৌকা ভিড়ে । দাদী সুন্দর করে তোষক , পরিষ্কার বিছানার চাদর আর বালিশ নৌকার পাটাতনে বিছিয়ে দিতে বলেছেন । সাথে দিয়েছেন টিফিন ক্যারিয়ারভর্তি ভাত, কৈ মাছের দোঁপেয়াজি , একটি টক জাতীয় তরকারি ,শাক, ডাল ও ভর্তা । এটা নৌকায় বসে আমাদের দুপুরের লাঞ্চ ।

কিন্তু নানাবাড়ীতে মস্তু কাকাকে দেখেই নানা-নানী দুজনেই উনাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেছেন । কলিমুদ্দিন ভাই আম্মার সাথে দেখা না করেই থানাঘাটের দিকে চলে গেছেন তিতাসের পাড় থেকে বড় আইর / বোয়াল বা কাতলা মাছ কিনে আনার জন্য । এটা দাদার নির্দেশ -বেয়াইবাড়ীর জন্য আনতেই হবে । নানী উনাদের প্রবল আপত্তিতে কোন রকম কান না গলিয়ে গরম গরম পোলাও মুরগির তরকারী দিয়ে খেতে বসিয়েছেন । পাশের ইজি-চেয়ারে বসে নানা তদারকী করছেন । কলিমুদ্দিন ভাইদের প্রতি নানা-নানীর অসীম স্নেহ । নানী প্রায়ই বলেন ,“ওরা বাপ- ছেলে এতো ভদ্র ,সৎ - বিশ্বাসী ও ভালো মানুষ ; এই যুগে দেখা যায় না ।”

থানাঘাট থেকে একটি খাল শহরের ভেতর মৌলভীপাড়া , কাজীপাড়া, মধ্যপাড়া ,ছয়বাড়িয়া হয়ে গোকর্ণঘাটে তিতাসের অপর অংশকে যুক্ত করেছে । বর্ষাকালে খালে থাকে টৈ-টম্বুর পানি । থানাঘাট থেকে গয়না নৌকা গোকর্ণঘাট , গোঁসাইপুর , থানাকান্দি পর্যন্ত যাতায়াত করে । আমরা বর্ষায় নানাবাড়ীতে এলে ছাদে বা সীমানা প্রাচীরের দুই দিকে পা ঝুলিয়ে বসে বসে চলে যাওয়া নৌকা দেখি । পাশের পাক্কার পুলটি থেকে দুরন্ত ছেলের দল খালে ঝাঁপ দেয় । পুলটি মৌলভীপাড়াকে কাজীপাড়ার সাথে যুক্ত করেছে । এর পূর্ব দিকের রেলিঙে দুই মানুষ সমান উঁচু করে টিনের বেড়া দেয়া হয়েছে নানার ব্যক্তিগত আগ্রহে এবং বাসার আব্রুর জন্য ।

আম্মার তাগাদায় আমরা তাড়াতাড়ি দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে নৌকায় উঠি । আম্মা খাননি ; দাদীর হাতের তরকারী দিয়ে মজা করে খাবেন বলে । খালে তীব্র পশ্চিমমুখী স্রোতে নৌকাকে শুধুমাত্র দিক নিয়ন্ত্রণে চইড়(লগি) ব্যবহার করছেন কলিমুদ্দিন ভাইয়েরা । মাঝে মাঝে কাজীপাড়ার দুষ্টু ছেলের দল লগি বা হাল ধরে নৌকায় ওঠার চেষ্টা করলেই ‘ দূর বেত্তমিজ ’ বলে কলিমুদ্দিন ভাই তাদের থামানোর চেষ্টা করে যান । পৈরতলা রেলওয়ে ব্রীজের নীচে এসে স্রোতের তীব্রতা কমে যাওয়া উনাদের ‘চইড় মারতে ’ হয় । আরেকটু সামনে গিয়েই আড়াআড়ি গ্রামের ভিতর ক্ষেতের উপরে উঠে যাওয়া পানির উপর দিয়ে নৌকা চালাতে শুরু করেন । কালিসীমার বিলের ওপর নৌকা আসতেই আম্মা খাবার বেড়ে খেতে ডাকেন । নৌকার দুলুনী ,শোঁ শোঁ বাতাস , পানির সোঁদা গন্ধে আমাদের আবার খিদে পেয়ে যায় ।

মস্তু কাকা আমাকে ইশারা করে হুঁক্কাটি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন । ছৈয়ের এক পাশে দরজা আর অন্যপাশের ফাঁকা জায়গাটি একটি পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে । সমানে নৌকার গলুই থেকে ছৈ পর্যন্ত একপাশ থেকে মস্তু কাকা আর অন্যপাশ থেকে কলিমুদ্দিন ভাই লগি ফেলে নৌকা টেনে যাচ্ছেন । নিয়মিত বিরতিতে ঘট ঘট করে লগির সাথে নৌকার বডিতে আঘাতের আওয়াজ , পানিতে ঝপ করে লগি ফেলার আওয়াজ আর লগি বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পাটাতনে পড়ে যাওয়া পানির আওয়াজে একসময় চোখে তন্দ্রা পেয়ে যায় ।

ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ইমন কলিমুদ্দিন ভাইকে অনুরোধ করে লগিটি হাতে দিতে ; নৌকা বাইবার জন্য । উনি হাঃ হাঃ করে হেসে উঠেন ,“ আর কদ্দুরা বড় হও ”। মস্তু কাকা তামুক -টিক্কা ধরিয়ে দুই তিনটি টান দিয়ে কলিমুদ্দিন ভাইয়ের হাতে হুঁকাটি চালান দেন । আম্মাকে বাবা -ছেলের একসাথে হুঁকা টানার কথা বলতেই চোখ পাকিয়ে বললেন ,“ গ্রামে ঠান্ডায় , পরিশ্রমের কাজের ফাঁকে ফাঁকে লোকজন হুঁকা খায় ।”

গোকর্ণঘাট থেকে চর গোঁসাইপুর পর্যন্ত একটা ভাঙাচোরা মাটির সড়ক আছে। সেটার বিরাট একটা অংশ বর্ষায় তলিয়ে যায় । সড়কটি শুধু শীতের দিনে পায়দলে রাস্তা হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না ,বর্ষায় তিতাস নদী ও বিলের প্রবল ঢেউ থেকে বিরামপুর , গাছতলা , বাগমারা , সাদেকপুর , ভারসিলা গ্রামকেও রক্ষা করে । লোকজন ঢেউ থেকে বাড়িঘর বাঁচাতে নদী থেকে টেনে কচুরিপানা সড়ক বরাবর জমিয়ে রাখে । বাঁশ গেঁড়ে , দড়ি দিয়ে এই পানা যাতে ভেসে না যায় সেই চেষ্টাও করে ।এটাকে আরো পোক্ত করতে কলমীলতা, হেলেঞ্চার ঝোপকে এর সাথে ট্যাগ করেন। হঠাৎ করে মস্তু কাকা “ আইস্ সব্বোনাশ, আব্বা পানা কেমনে বাড়ছে দেখছোনি!” কলিমুদ্দিন ভাই গাছতলা গ্রাম বরাবর কচুরিপানার আগ্রাসন দেখে “ মস্তু, তরাতরি কর! হাইন্জার আগেই জালশুকায় ঢুকতে অইবো ” বলে তৎপর হন ।

বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর ইমনকে ছৈয়ের উপর উঠতে দেখে কলিমুদ্দিন ভাই “ ইলা দাদার মতো সাহসী” বলে প্রশংসা করায় আমি মনে মনে হিংসায় জ্বলে উঠে শপথ করলাম, জালশুকায় এবার অনেক দূরণ্তপনা করে আমার সাহস দেখাবো !

আম্মা মস্তুকাকাকে কচুরিপানার কি সমস্যা জানতে চাইলে, জবাব দেন কলিমুদ্দিন ভাই “ যেইদিকে এই পানা আটকায় ২/৩ রাইতেই বাড়তে থাকে, দুই হপ্তায় দ্বিগুণ হয় ; গেরামে ঢুকার পথ বন্ধ হইয়া যায় । গেরামের লোকজন এইডারে জার্মানি কয় ।” পরে দাদার কাছে শুনেছি ১৯৩৭ সনের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে শুধুমাত্র কচুরিপানার আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে জলাভূমিকে কচুরিপানার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য অঙ্গীকার করা হয়েছিল । ১৯৩৬ সালে বাংলার ‘জলাভূমি আইন’ যেটা ‘কচুরিপানা আইন ’ নামেও পরিচিত ছিল,পাশ হয় । এমনকি কাজী নজরুল ইসলাম এই পানা নিয়ে কবিতা লিখেছেন -

‘ ধ্বংস করো এই কচুরিপানা!

(এরা )লতা নয় ,পরদেশি অসুরছানা ।। ’

(কচুরিপানা)

এত সুন্দর নীলচে- বেগুনী ফুলের কচুরিপানার বদনাম শুনে আম্মা বলেন , “ গরুকে তো পানা খেতে দেয় ; এটা শুকিয়ে চুলা জ্বালাতেও দেখেছি ”।

বিলের উপর দিয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ দেখি মস্তু কাকা পানিতে নেমে হালের চারপাশ থেকে বিভিন্ন জলজ লতা টেনে টেনে সরিয়ে হালটাকে হালকা করলেন । এখানে উনার বুক সমান পানি । ইমন পানিতে নামতে চাইলে আম্মা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ফিউজ হয়ে যায় । পানির উপর স্রোত নেই বললেই চলে । উপর থেকে নীচের চলন্ত মাছ , কাঁচ-পোকা , জলজ উদ্ভিদ দেখা যাচ্ছে । কিছুটা সামনেই হালকা লাল , সাদা , নীল শাপলা ফুল দেখতেই আমি চিৎকার করে ইমনকে দেখালাম । আমাদের উচ্ছ্বাস দেখে উনারা বাবা- ছেলে হাসতে লাগলেন । শাপলার বড় বড় গোলাকার পাতার উপর দিয়ে হাট্টিটি , ডাহুক পাখি হেঁটে বেড়াচ্ছে । বেশ কয়টি বড় ডাঁটাসহ শাপলা ফুল ,সাথে গোল ঢেপফল দিয়ে মস্তু কাকা বললেন “এইটা খাইতে পারো ।” ভেতরের কালচে বীজগুলো পানসে লাগায় ‘ওয়াক থু ’ বলে আমরা ফেলে দেই । আম্মা, “ মস্তুর বাপ , ঢেপের খৈ হয় না ?” বলে কলিমুদ্দিন ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে উচ্ছ্বসিত মস্তু কাকা ঢেপের খৈ , মোয়া ইত্যাদি আমাদেরকে খাওয়াবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন । “ হালুক খাইছোনি ?” কলিমুদ্দিন ভাইয়ের এই কথায় আমরা বলি ‘ শালুক দেখি নাই ’। এক ফাঁকে আলুর মতো কালো শাপলার মূল উঠিয়ে আমাদের হাতে দেন; এটা পুড়িয়ে খেলে নাকি খুব মজা লাগে !

চারপাশে দূরে দূরে অসংখ্য লাল ,নীল , হলুদ পালতোলা নৌকা দেখতে পেয়ে আমরা উনাদের আমাদের পালটা টানিয়ে দিতে অনুরোধ করি । কিন্তু, বিলে বাতাস না থাকায় লগি ঠেলে নৌকা এগিয়ে নেয়াটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে । বাপ- বেটা মিলে লম্বা একটা বাঁশের টুকরোর এক মাথায় দড়ি বেঁধে অন্য মাথাটি পাল টানানোর লম্বা বাঁশের মাথায় বেঁধে গুণ টানার প্রস্তুতি শেষ করেন । মস্তু কাকা বিলের গলা পানিতে নেমে আস্তে আস্তে তীরের দিকে এগোতে থাকেন । আমরা দুইজন গলুই-এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উনাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতে থাকি । তীরে ওঠে নৌকার সামনের দিকে ঘাড়ে দড়িসহ বাঁশের টুকরোটি ধরে মস্ত কাকা টানতে থাকেন । দড়িটা টানটান হয়ে নৌকা চলতে লাগলো । পেশীবহুল মস্তু কাকাকে দেখতে রোমান বীর স্পার্টাকাস এর মত মনে হচ্ছে । আম্মা উনাদের তীব্র শারীরিক পরিশ্রম দেখে আফসোস করতে লাগলেন ।

সন্ধ্যায় বাংলাঘর থেকে পূর্ব -দক্ষিণ দিকে সাত/ আট কিলোমিটার দূরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হলদে লাইটগুলো দেখে আমরা আশাবাদী হবার চেষ্টা করি , একদিন আমাদের গ্রামেও বিদ্যুৎ আসবে । কোনদিন হালকা বৃষ্টি আবার কোনদিন ভারী বৃষ্টির মাঝে মাঝে পরিষ্কার আকাশে সন্ধ্যায় সন্ধ্যাতারা দেখতে পেয়ে আমরা দাদীকে ধরি গল্প বলার জন্য । বিদ্যুৎ না থাকায় সন্ধ্যায় মশার উৎপাত আর গরমে আম্মাকে জ্বালাতন করতে থাকি হাত পাখার বাতাস করার জন্য । দাদী আম্মাকে রিলিফ দেয়ার জন্য আমাদেরকে উঠানে মাদুর পেতে বসতে বলেন। দাদার জন্য হামাণদিস্তায় পান ছেঁচতে ছেঁচতে দাদী সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং কোরআন শরীফ পড়ার জন্য আমাদের তাগিদ দেন । আশেপাশে ইমন রিনা ,রিপা, অপেলের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে চোর পলান্তি খেলছে। গল্পের গন্ধ পেয়ে ওরাও আমাদের সাথে শামিল হয় । উনার শুরু করা গল্প “ এক দেশে ছিলো একজন বাদশাহ- ” কোনদিন পুরোটা শোনা হয় না ; চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে । মাঝে মাঝে পরহেজগার, নির্লোভ দাদীকে উনার ছোটবেলার কথা জিজ্ঞেস করলে হাসতে হাসতে মোসাম্মৎ উম্মিয়া খাতুন ছোটবেলার জাঁকজমকপূর্ণ দিনগুলোতে ফিরে যান । উনার পিতা আব্দুল গনি মৃধা আশুগঞ্জের পাশে তালশহরে বিশাল বড় বাড়িতে ছয়টি কন্যা সন্তান নিয়ে আনন্দময় জীবন যাপন করেছেন । বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল গনি মৃধা প্রচুর স্থাবর সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের শিক্ষিত ও বিনয়ী হবার শিক্ষা দেন । আমরা দাদীকে মাঝে মাঝে ঢাকার আজিমপুর কলোনির ফেলে আসা বাসার কথা জিজ্ঞেস করে কোন আফসোস হয় কিনা জানতে চাইলে উনি হাসতে হাসতে বলেন ,“এই জীবন কয়দিনের ? সামনে অনন্তকালের জীবনের জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে ; লোভ করা যাবে না । তোদের দাদাও নির্লোভ মানুষ , সারাটি জীবন চাকুরীর কারণে ইউরোপ- আমেরিকায় কাটিয়ে এই বিদ্যুৎহীন গ্রামে চলে এসেছেন মানুষের ভালবাসার টানে । যে কেউ এসে কোন কিছু চাইলেই বিনা ওজরে দিয়ে দেন । ” আসলেই তো তাই । বাড়িতে প্রায়ই লোকজন এসে বলে ‘ দাদা , অমুকের মা খুব অসুস্থ। একটা ডাব খাইতে ইচ্ছা করছে ।’ দাদা বলেন ডাব পেড়ে নিয়ে যা ; কয়টি পাড়লো দেখতেও আসেন না । “তোর দাদা আমেরিকার অরিগন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ‘ গভর্নর অফ অরিগন স্টেট ’ উনাকে ‘এম্বাস্যাডার টু পাকিস্তান’ নির্বাচিত করেছিল ”, দাদী ।

ছুটি শেষে কলিমুদ্দিন ভাই আমাদের আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছে দিবেন । দাদা-দাদীকে ছেড়ে চলে যাওয়াটা খুব কষ্টকর । উনারা ঢাকায় যাবেন - থাকতে নয় ; ১০-১৫ দিন এর জন্য বেড়াতে বা ডাক্তার দেখাতে । চলে আসার দিন সকাল থেকে দাদা চুপ করে ইজি চেয়ারে বসে থাকেন , শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন । নৌকা ছেড়ে যাবার পর যতক্ষণ দেখা যায় দাদী বাংলা ঘরের কোনায় পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন । দাদীর ঘিয়ে রঙের শাড়ীতে চোখ মোছার হৃদয় নিংড়ানো বিদায়টা আজও জালশুকা থেকে ফেরত আসার সময় মানস চোখে দেখতে পাই ।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]

back to top