জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
শহীদ কাদরী, বন্ধুবরেষু- কত সহজেই না লিখতে পারি। যদি লিখতে হতো বাংলা কবিতার অন্যতম পুরুষ শহীদ কাদরী, কী লিখতে হতো কিংবদন্তির কবি শহীদ কাদরী, তাহলে তার কথা তার কবিতার কথা লেখা আমার জন্য সহজ হতো না। কাব্যরসিক সমালোচক যেমন নির্মোহ দৃষ্টিতে কাব্যস্রষ্টা ও তার সৃষ্টির আলোচনা করতে পারেন, বন্ধু তেমন পারে না। এ কারণেই।
শহীদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঢাকার অভয় দাস লেনের সমকাল অফিসে অথবা ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটে সেবাব্রত চৌধুরীর বৈঠকখানায়। তার পরনের ট্রাউজার ও ব্লেজারের রঙ এখন আর আমার চোখে ভাসে না, কিন্তু দীপ্ত তার ওই চেহারা কখনো ভুলি না। মাত্র কিছুকাল আগে মফস্বল কলেজ থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি আমি, স্বল্পভাষী আধুনিক চেহারার শহুরে তরুণ আমায় কিয়ৎ পরিমাণে নিষ্প্রভ করে দিতেই পারে। দিয়েছিলও হয়তো যদিও তখন আমি জানতাম না শহীদ কলকাতাকেও পেছনে ফেলে এসেছে। সে কবিতা লেখে সেবাব্রতর মুখে এ কথা শুনলেও বুদ্ধদেব বসু তার পত্রিকায় শহীদের কবিতা প্রকাশ করেছেন জানা ছিল না, যেমন অনুমান করি শহীদও বগুড়া আজিজুল হক কলেজ বার্ষিকীতে অথবা আজাদ, মিল্লাত ইত্যাকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত আমার গল্পাবলির কোনো খোঁজ রাখত না। ওই সময়ে ‘সমকাল’ অত্যন্ত নামি সাহিত্য পত্রিকা এবং সমকাল প্রকাশের বছরখানেক পরেই দ্বিমাসিক ‘উত্তরণ’ প্রকাশিত হলে সেটিও সমকালীন সাহিত্যাঙ্গনে সাদরে গৃহীত হয়। ‘উত্তরণ’-এর সহ-সম্পাদক হিসেবে আমার পরিচয় সর্বজনজ্ঞাত ছিল বলে আমার বিশ্বাস থাকলেও শহীদ সে কথা জানত বলে আমি মনে করি না। স্পষ্টতই ওই সময়ে আমাদের মধ্যে কোনো নিকট সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। অনিয়মিত দেখা সাক্ষাতের কথাই কেবল মনে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, উনিশ’ বাষট্টিতে সপ্তক প্রকাশের সময় থেকেই তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা। মধ্যকার সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমাদের রচনাদি প্রকাশিত হলেও এসব বিষয়ে কখনো কোনো কথাবার্তা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। কেবল মনে পড়ে সপ্তক-এ তার আসা-যাওয়া।
ষাটের দশকের পূর্ববাংলায় প্রথম লিটল ম্যাগাজিন সপ্তক। সম্পাদকবিহীন ওই অনিয়মিত সাহিত্য সংকলন সাতসুরের স্বরগ্রামের মতোই সাত নবীন কবিযশপ্রার্থীর সম্মিলনের স্বাক্ষর; তৎকালীন সাহিত্য সমাজে নিজেদের স্থানটিকে দৃশ্যমান করে তোলার প্রবল আগ্রহের ফসল। সপ্তক প্রকাশের সময় থেকেই শহীদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যেগাযোগ। আমার বিশ্বাস, এবং আমার মতো আরো অনেকেরই বিশ্বাস, আমার গল্পকার পরিচয় এবং শহীদ কাদরীর কবি পরিচয় স্পষ্ট রূপ নেয় ওই সপ্তক-এর কাল থেকেই।
সপ্তক ষাটের দশকের প্রথম ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিন। ছোটকাগজের সমস্ত চরিত্র সপ্তকের মধ্যে ছিল। সাত তরুণ মিলে এটি প্রকাশ করেছিলেন বলে নাম দেওয়া হয় সপ্তক। সেবাব্রত চৌধুরী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হুমায়ুন চৌধুরী, হায়াৎ মামুদ, শফিক খান, শহীদ কাদরী এবং দেবব্রত চৌধুরী কি আল মাহমুদ। সপ্তম সদস্যপদটি খোলা ছিল। দেবব্রত চৌধুরী কবি, সেবাব্রত তার অনুজ, আর আল মাহমুদ এসেছিলেন সেবাব্রত ও শহীদের সঙ্গে। সপ্তক-এর কোনো সম্পাদক ছিল না। সম্পাদকের দায়িত্ব পাছে কাউকে বেশি সম্মানে ঠেলে দেয় এই চিন্তাও সম্ভবত ছিল। এ কারণে সহপাঠী শফিক খান, সেই মুহূর্তে লেখালেখিতে খুব সক্রিয় না হলেও শাহজাহান প্রিন্টিং প্রেসের মালিক হওয়ার সুবাদে প্রকাশকের ভূমিকা গ্রহণ করেন।
উল্লিখিত বাক্যবন্ধ মদীয় ‘ষাট দশকের ছোট কাগজ, ছোট নয়’ রচনাটির অংশ। শহীদ কাদরীর রচনা প্রসঙ্গে এই উদ্ধৃতির প্রয়োজন এই জন্য যে শহীদ তার সৃষ্টির মানসিকতায় ষাট দশকের অত্যাধুনিক, বিদ্রোহী লেখকগোষ্ঠীর অনেক কাছাকাছি ছিল। সেকালে প্রতিষ্ঠিত কি পরিচিত লেখককুলের মানসিকতার সঙ্গে তার নৈকট্য ছিল না। সপ্তক-এর অন্যতম কবি হায়াৎ মামুদ, পরে পাঠকনন্দিত প্রাবন্ধিক-গবেষক-গদ্যশিল্পী, এখনো মনে রেখেছেন যে শহীদ কাদরী প্রায়ই ফুলতলি স্টেশনের কাছে সপ্তক-এর কার্যালয় শাহজাহান প্রিন্টিং প্রেস-এর অফিসে আসতেন।
সপ্তক-এর প্রসিদ্ধিই ছিল এস্টাব্লিশমেন্টপন্থী, গতানুগতিক প্রকাশিত সাহিত্য চিন্তার বিপরীতে অবস্থান নেয়ার জন্যে। তৎকালীন সাহিত্য সমাজ কি পাঠকসমাজ আমাদের গোষ্ঠীকে যে চোখেই দেখুন না কেন, আমরা নিজেদের সর্বাধুনিক বলে মনে করতাম। শহীদ আমাদের মানসিকতারই অংশভাক ছিল।
সপ্তক প্রকাশের কিছুকালের মধ্যেই প্রকাশিত হয় স্বাক্ষর। সপ্তক-এর বাইরে থাকা আমাদের মতোই বিদ্রোহী লেখক কতিপয়ের কেউ কেউ একত্রিত হয় প্রকাশ করেন স্বাক্ষর। শোনা যায়, সপ্তককেও নাকি স্বাক্ষর গোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক বলে বিবেচনা করতেন। স্বাক্ষর-এর ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়ায় ‘সাম্প্রতিক’। তার কিছুকাল পরেই প্রকাশিত হতে থাকে কণ্ঠস্বর- নিয়মিতই। যদিও কণ্ঠস্বর লিটল ম্যাগাজিনের সমগোত্রীয় ছিল না, বরং এস্টাব্লিশমেন্টপন্থীই ছিল বলা যায়- কণ্ঠস্বর-সম্পাদক অবশ্য কোনোকালেই এ-কথা মানবেন না। শহীদ কণ্ঠস্বর-এও শামিল হয়েছিল। অবশ্য সে অনেক পরের কথা। শহীদ ততদিনে ঢাকা টেলিভিশনে কর্মরত। আমি বাংলা একাডেমি ও পাকিস্তান অবজারভার-এ কয়েক বছর কাটিয়ে সাতসমুদ্র পার হয়ে চলে এসেছি। সপ্তক-এর সদস্যের জন্যে সেটিই হয়তো ভবিতব্য ছিল। এখন লক্ষ করি সপ্তক-এর সাত সদ্যেসর মধ্যে পাঁচজনই দীর্ঘকাল বিদেশবাসী ছিলেন। আমি, শহীদ ও দেবব্রত চৌধুরী আজও বিদেশেই। হায়াৎ মামুদ ও হুমায়ুন চৌধুরীও কাটিয়েছেন বিদেশে দীর্ঘকাল। গতানুগতিকতা এড়ানোর জন্যেই সম্ভবত।
দুই
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে ১৯৫৯-এ প্রকাশিত হয়। ওই কবিতাগ্রন্থের সমুদয় রচনা একাধিকবার পড়েছিলাম তার প্রুফপাঠক হিসেবে। এ কারণে সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে আধুনিক বাংলা কবিতা তথা পূর্ববাংলার আধুনিক কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় একরকম ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে বলা যায়। পরিচিতি ঘটে তৎকালীন সর্বাধুনিক গদ্য রচনাবলির সঙ্গেও- নতুন সাহিত্য, চতুরঙ্গ, পরিচয়, নন্দন ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকা, সমকাল ও উত্তরণ-এর মাধ্যমে। বিশেষত দেশি ও বিদেশি আধুনিক ছোটগল্পের সঙ্গে গভীর পরিচয়ের ফলে ওই সময়ের নতুন আধুনিক কবিতার মতোই নতুন আধুনিক গল্প লেখার চেষ্টা করে চলি। ঊনষাট-এর কোনো একসময়ে আমার গল্প ‘পরমাত্মীয়’, উত্তরণ-এ প্রকাশিত হলে সতীর্থরা মনে করেন কবিতা ও গল্প উভয়ক্ষেত্রেই সর্বাধুনিক বাংলা রচনার পথে উঠেছি আমরা এবং সেই চিন্তা-আশ্রয়ী কর্মকা-ের ফলশ্রুতি সপ্তক ও তার কিছু পরে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন কালবেলা। তেষট্টির কোনো একসময়ই সম্ভবত সমকাল-এ আমার গল্প ‘একজন পুরুষ চাই’ প্রকাশিত হলে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে- এদেশে নতুন সাহিত্যের স্রোতটিকে বইয়ে দিতে পেরেছি। বাষট্টির কোনো একসময়ে সপ্তক প্রকাশিত হয় এবং আমার গল্প আরও কয়েকটি পুতুল-এর সঙ্গে শহীদ-এর কবিতাও প্রকাশিত হয়। শহীদের কবিতা আমাদের প্রায় বিমোহিত করে। ফলে, সপ্তক-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় উনিশশো তেষট্টির আগস্টে শহীদ কাদরীর একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হয়। আমাদের ধারণা অনুযায়ী শহীদ কাদরীর একাধিক কবিতা একসঙ্গে তার আগে কখনো প্রকাশিত হয়নি।
শহীদ কাদরীর রচনা প্রসঙ্গে সপ্তক, কালবেলা কি আমার নানা রচনার প্রাসঙ্গিকতা এই যে, আমরা মনে করি, সপ্তক-এর মধ্য দিয়েই শহীদ কাদরী ও আমিসহ কয়েকজন নতুন সাহিত্যকর্মী পাঠকসমাজের সামনে উজ্জ্বল উপস্থিতি স্পষ্ট করতে পেরেছিলাম।
সপ্তক-এর আগে শহীদ কাদরীর রচনা অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তার কবিতার প্রতি পাঠকের আগ্রহ সপ্তকই সৃষ্টি করে বলে এখনো যাঁরা সপ্তককে মনে রেখেছেন তাঁদের ধারণা।
সপ্তক-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় শহীদ কাদরীর যে ক’টি কবিতা প্রকাশিত হয় তার মধ্যে তিনটি কবিতার কথা আমার মনে পড়ে- ‘টেলিফোনে আরক্ত প্রস্তাব’, পাশের কামরার প্রেমিক’ ও ‘চন্দ্রালোকে’।
তিরিশ-চল্লিশের কবিতায় তখনও আচ্ছন্ন আমরা। পঞ্চাশের বামপন্থী কবিকুল কিঞ্চিৎ হৃদয় স্পর্শ করেছেন হয়তো, ষাটের রাগী অমিতবিক্রম কবিকুল তখনও অত প্রতাপী নন, ওই সময় শামসুর রাহমানের কবিতা কেবল নতুন কবিতার স্বাদই নয়, যেন নতুন কবিতার জগতই খুলে দেয়, অন্তত আমার সামনে। আর ঠিক তখনই শহীদ কাদরীর কবিতা পড়ি:
কালো ডায়ালে আমার আঙুলে ঐন্দ্রজালিক
ঘুরছে নম্বরগুলি-
শহরের ওপর থেকে
দূরদূর বাস গাড়ির ঘণ্টাধ্বনি তরঙ্গিত ঘাসে-ভরা
স্টেডিয়ামের ওপর থেকে
আসছে:
‘না, না, না’-কী জ্যোৎস্না কণ্ঠস্বর।
কত কাঁপন চিকন কালো তারে।
আমি ঠিক জানি চড়–ইপাখির মতো ঠোঁটজোড়া কাঁপছে
‘না, না, না’
প্রাত্যহিকতার চিত্রকল্প, সময়ের অবিকল প্রক্ষেপণ, পরিচিত মানবী আবেগের আশ্রয়ে শহীদের কবিতা অন্যসব কবিতার চাইতে যেন আলাদা মনে হয়। আরো পড়ি-
আর ঐ ডাকসাইটে লাল ঘোড়া
যদি ধরে ফেলে এই কামরায় গোধূলিকে ছত্রখান করে
‘না, না, না’
আমি জানি চড়–ইপাখির মতো ঠোঁটজোড়া কাঁপছে।
(টেলিফোনে আরক্ত প্রস্তাব)
স্পষ্ট বুঝি, এই আমাদের নতুন কবিতা। আবার পড়ি সপ্তকে প্রকাশিত তাঁর অন্য কবিতাটি:
গলা চিরে থুথু ফ্যালে দাপায় কপাট নড়বড়ে
শ্বাসকষ্ট যা পায় তা প্রেম; ঠা-া হাওয়া
হৎপি-ে বিরক্তিকর উৎকট নর্তন
অলৌকিক ইচ্ছা তার তাকে দিয়ে টেবিল বাজায়
(পাশের কামরার প্রেমিক)
তরুণ কবির অবিশ্বাস্য পরিণত নতুন কবিতা। আমরা মানি-
এ হেন অনেক কিছু, একটু আয়াসে চীনেবাদামের খোসা
ভাঙতে-ভাঙতে পার হওয়া যায় হে দীপ্ত প্রেমিক, বন্ধু ভাই
যথা শান্ত দুপুরে দেলাক্রোয়ার ক্রুদ্ধ, রুদ্ধ, মত্ত অশ্বারোহী
ট্রেনের কাটা শূকরের লালরক্ত, মৃত্যু, আর্তনাদ।
(পাশের কামরার প্রেমিক)
পরিচিত, যন্ত্রণাক্ত, অসহ্য জীবনে অপরিচিত জগতের অমিত উত্তেজনা, ক্রোধ অত সহজে তুলে আনেন যে কবি তাঁর কবিতায় তিনি আলোর বৃত্তে দাঁড়াবেনই, এ-ও আমরা ভেবেছিলাম।
অন্য কবিতার এই পঙ্ক্তি ক’টিও কখনো ভুলি না:
‘হে আমার প্রেম, নিষ্প্রাণ ময়ূরপঙ্খী কোন জলে ভাসবে না?’
(বালির তরঙ্গে তার নিতম্বের কঠিন করোটি, কোনো কান্নাই ছোঁবে না)
হে আমার প্রেম, নিষ্প্রাণ ময়ূরপঙ্খী দাঁড় পড়ে হৃৎস্পন্দনে
আমার অপেক্ষা ফুরোবে না।
(চন্দ্রালোকে)
তিন
কালবেলার তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত বৎসরাধিক সময়কালে। প্রতি সংখ্যায়ই শহীদ কাদরীর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত কালবেলা প্রকৃতই নতুন সাহিত্যের উৎসাহী পাঠককুলে সাড়া ফেলেছিল বলে আমাদের বিশ্বাস। চতুরঙ্গ ও দেশসহ নানা পত্র-পত্রিকায় ‘কালাবেলা’র অনুকূল আলোচনা প্রকাশিত হয় এবং সপ্তক থেকে কালবেলা- এই চার-পাঁচ বছর সময়কালেই ওই পত্রিকা দুটিতে প্রকাশিত প্রায় সমস্ত লেখকই বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছে যান।
ওই সময়ে এখলাসউদ্দিন আহমদ টাপুর টুপুর নামে কিশোরদের জন্যে একটি পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত হন। চট্টগ্রামের পুস্তক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ‘বইঘর’ পত্রিকাটির প্রকাশক। টাপুর টুপুর-এর লেখালেখির আঙিনায় আমরাও উঠে আসি এবং বইঘর-এর স্বত্বাধিকারী শফি আহমদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। টাপুর টুপুর-এর রচনাদি ছাড়াও তার প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ অতি মনোগ্রাহী ছিল। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সৃষ্টি সে-সব দেখলেই চিতনাম আমরা। আর অমনি করেই কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গেও আমাদের হৃদ্যতা জন্মে। কিশোর পত্রিকা হলেও টাপুর টুপুর-এ প্রতিষ্ঠিত কি নবীন সকলেই লিখতেন। কিছুকালের মধ্যেই ‘বইঘর’ কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্মের আশ্রয়ে পুস্তক প্রকাশনা শুরু করে। একসঙ্গে প্রকাশিত বইঘর-এর প্রথম তিনটি কবিতাগ্রস্থ শামসুর রাহমানের ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, আল মাহমুদের ‘কালের কলস’ ও শহীদ কাদরীর ‘উত্তরাধিকার’ কেবল যে তৎকালীন প্রকাশনা শিল্পের অভূতপূর্ব সৌকর্যের পরিচয় বহন করে তা-ই নয়, আমাদের সাহিত্যেও নতুন যুগ, নতুন পর্বের সূচনা করে। স্পষ্টতই শহীদ কাদরী তখন খ্যাতিমান কবির সারিতে উঠে এসেছেন। এবং এখন আমরা পেছনে ফিরে দেখি ওই তিন কবিই পরে আমাদের কবিতার তিন প্রধান পুরুষ রূপে পাঠকচিত্তে স্থান করে নেন।
উত্তরাধিকার-এর প্রকাশকাল ১৯৬৭। সেটি শহীদ কাদরীর প্রথম কবিতাগ্রন্থ। কিয়ৎ পরিমাণে কাকতালীয় হলেও লক্ষ্য করি আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দুর্বিনীত কাল’, তারও প্রকাশ তখনই-১৯৬৭।
শহীদের পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমার প্রকাশকাল ১৯৭৪; তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই-এর প্রকাশকাল ১৯৭৮; এবং সর্বশেষ এবং চতুর্থ কবিতাসংগ্রহ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও : অতি সাম্প্রতিক প্রকাশনা-২০১১। সাত বছর, চার বছর ও তেত্রিশ বছর- শহীদ কাদরীর কবিতাগ্রন্থসমূহের প্রকাশকালীন ব্যবধান এমনই। সময়ের এই মাপ কিছু বিস্ময়ের সৃষ্টি করতেই পারে। তবে এটি অভূতপূর্ব কিছু নয়। আমার নিজের প্রথম তিনটি গল্পসংগ্রহ এক বছর পর প্রকাশিত হয়। চতুর্থ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় কুড়ি বছর পরে। সময়ের এই উল্লম্ফন আমাদের উভয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে ঘর ছাড়ার কারণেই। আমার দেশত্যাগ ঘটে তৃতীয় গ্রন্থটি প্রকাশের পরপরই, শহীদেরও অমন-তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরই। এই তথ্য থেকে যদি এমন মনে হয় যে দেশত্যাগ ছেড়ে আসা দেশের ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির জন্যে সহায়ক নয়, হয়তো সেটি যথার্থই। এমনও যদি বলা যায়, নিজ ভূমি ত্যাগ যে-কোনো শিল্পীর শিল্প সৃষ্টিতেই বাধা সৃষ্টি করে- সেটিও হয়তো খুব অযথার্থ হবে না। যদিও আমরা জানি, কিছু শিল্পী দেশত্যাগ করেও মহৎ সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন। শহীদ কাদরীর ক্ষেত্রে উভয় ধারণাই সঠিক বলে মনে করা যায়। দেশত্যাগ-এর পরে তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থের ঔৎকর্ষের বিচার কালের হাতেই তোলা থাক।
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরে শহীদ দেশত্যাগ করেন। প্রথম স্বল্প সময়ের জন্যে, পরে পাকাপাকি। সত্তরের শেষ দিকে সে বিদেশে যায় বলে জানি, কিন্তু কিছুকাল পরেই ফিরে আসে। আমি দেশত্যাগ করি ঊনসত্তরের শেষার্ধে। তারপরে শহীদের সঙ্গে আমার দেখা প্রায় দশ বছরের বেশি কাল পরে-১৯৮০-তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে। সায়াটিকা জাতীয় কোমরের ব্যথায় চিকিৎসাধীন। ওই সামান্য সময়ের সাক্ষাতে তার কাব্যকৃতির কোনো আলোচনা করা হয়নি। করার কথাও ছিল না। উত্তরাধিকার প্রকাশের পরেই তার কবিখ্যাতি বিস্তৃতি লাভ করে। নানা পত্র-পত্রিকায় কবিতা ছাপা হতে থাকে এবং তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা প্রকাশের আগের বছরেই কবিতায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয় তাকে। তার মাত্র দু’বছর আগে ছোটগল্পে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয় আমাকেও। বাষট্টির সপ্তক যে কবি ও গল্পকারদ্বয়কে পাঠকের সম্মুখে দাঁড় করায়- মাত্র দশ বছরের ব্যবধানেই তাদের রচনা সাহিত্যসমাজের স্বীকৃতি লাভ করে।
ওই হাসপাতালের পরে শহীদের সঙ্গে আমার দেখা হয় লন্ডনে ১৯৮৩-তে। লন্ডনবাসী কবি দেবব্রত চৌধুরী আমাকে শহীদের কাছে নিয়ে যান ‘সুরমা’ পত্রিকার অফিসে। ‘সুরমা’য় কর্মরত শহীদ তখন। লন্ডনে আমার বড়ভাইয়ের বাড়িতে আসে শহীদ। তখনই তার মুখে শুনি তার যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার কথা। মাত্র কয়েক মাস পরেই।
চার
যাবিত জীবনের কিছু ছায়া লেখকের রচনায় পড়ে- এ কথা জানা। লেখকের আপন জীবনই তার রচনার সর্বোৎকৃষ্ট উপাদান। এ-কথাও অনেকে বলেন। সময়, সমাজ, স্বদেশ, দূরদেশ, পরিপার্শ্ব, পরিবেশ এইসব নিয়েও কথা হয়- লেখকের রচনায় কী পরিমাণ প্রভাব ফেলে ওইসব। কিন্তু সময়, সমাজ, স্বদেশ, দূরদেশ, পরিপার্শ্ব পরিবেশ ইত্যাকার বিষয় যে লেখককে রচনাবিমুখও করে তার কথা বেশি শোনা যায় না।
দেশ-বিদেশের অনেক লেখকের কথাই আমরা জানি যাঁরা ক্ষীণপ্রজ অথচ রচনার ঔৎকর্ষে সর্বদাই লোকমুখে থাকেন। আবার দেখা যায়, অনেক লেখক প্রথম জীবনে প্রচুর গুণান্বিত রচনার পরে আর বেশি লেখেন না, বা লেখেনই না, এবং পরবর্তীতে রচনাসমূহ তেমন সমৃদ্ধও হয় না। শহীদ কাদরীর রচনা ও তার জীবন অনুমান করি- ওই উভয় ধারণার পরিপ্রেক্ষিতেই বোঝার চেষ্টা করা যায়।
শহীদের কাব্যকর্ম তার কৈশোরকালেই শুরু বলা যায়। স্পন্দন-এ তার কবিতা প্রকাশিত হয় উনিশশো পঞ্চান্নর দিকে, কবিতায় প্রকাশিত হয় উনিশশো ছাপ্পান্নয়। শহীদ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসে বাহান্নর শুরুতে, তখন তার বয়স বারো-তেরো। স্পন্দন কি কবিতায় রচনা প্রকাশের কালে তার বয়স পনেরো-ষোলো ছিল বলা যায়। পরবর্তী কয়েক বছর নিশ্চয়ই সে কবিতা লিখেছে, প্রকাশিত হয়েছে, তার পরিমাণ নিঃসন্দেহে বিপুল নয়। তাই সপ্তক প্রকাশকালে সহজেই আমরা তাকে আমাদের সদ্য তরুণ বিদ্রোহী আধুনিক নবীন লেখককুলে মেশাতে পারি। আমার নিজের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় বগুড়া আজিজুল হক কলেজ বার্ষিকীতে-১৯৫৬ সালে। শহীদের সমকালেই প্রায়।
সপ্তক ও কালবেলা পর্বের পরে শহীদের রচনার পরিমাণে ভাঁটা পড়ে। স্পষ্টই সেটি বোঝা যায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’-এ। এ গ্রন্থের কবিতা সংখ্যা চল্লিশটি। প্রকাশকাল ১৯৬৭। এগারো-বারো বছরে চল্লিশটি কবিতা। যদি ধরে নেওয়া যায় উত্তরাধিকার-এর বাইরেও তার কিছু কবিতা ছিল ওই কালে, তবুও বছরে গড়ে চারটির বেশি কবিতার হিসাব পাওয়া যায় না। সাত বছর পরে প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমায় কবিতার সংখ্যা একত্রিশটি। গড় হিসাব এই একই থাকে- বছরে চারটি। অথচ বছরে গড়ে চারটি করে কবিতা লেখার কবিই ১৯৭৩-এ কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। শহীদ কাদরীর কবিতার বৈভব ওই সামান্য পরিমাণ ও সময়েই কাব্যরসিক পাঠককুলকে মোহিত করেছিল।
তার তৃতীয় গ্রন্থ ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ ধারণ করে আছে পঁয়ত্রিশটি কবিতা। দ্বিতীয় গ্রন্থ থেকে চার বছর পরে প্রকাশিত। এবারে যেন তার কবিতা রচনায় উৎসাহ সঞ্চারিত হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে বছরে প্রায় আটটি করে কবিতা। চতুর্থ গ্রন্থ আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও ছত্রিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বত্রিশ বছর পরে। বোঝাই যায়, দীর্ঘকাল কবিতা রচনায় বিরত ছিল সে। ক্বচিৎ কখনো একটি দু’টি কবিতা লিখেছে হয়তো।
স্বভাবতই তাঁর জীবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কবিতার অতি ধীর গতির, কি কখনো থামার কখনো চলার ধরনটিকে অনেকেই বুঝতে চাইবেন। আমি নিজেও বোঝার চেষ্টা করছি। সম্ভবত এ-কারণে আরও বেশি যে, আমারও প্রথম তিনটি গল্পগ্রন্থ পরপর প্রকাশিত হয় ১৯৬৭-৬৯ সময়কালে। চতুর্থ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় কুড়ি বছর পরে ১৯৮৯-এ। আমার লেখার কালে আঠারো বছরের একটি বিরতি ছিল। পরে ১৯৮৭ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি, অতি ধীরগতিতেও হলেও, লেখার স্রোতটি বহমান আছে- একেবারে শুকোয়নি এখনো। শহীদের লেখক-জীবনের সঙ্গে আমার লেখক জীবনের বহিরঙ্গের এই মিল- চাই কি কিয়ৎ পরিমাণে যাপিত জীবনের সঙ্গেও, সম্ভবত কাকতালীয়ই, তবুও লক্ষ্যযোগ্য। যদিও শহীদের যাপিত জীবনের তাবৎ কাহিনি আমার জানা নেই, বিশেষত ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত সময়টিকে আমাদের সম্পর্কের অন্ধকারের যুগই বলা যায়- পৃথিবীর দুইপ্রান্তে দুইজনের বসবাসের কারণেই। যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন ছিল। লন্ডনে ১৯৮৩-তে দেখা হওয়ার পরেই সম্পর্কটি পুনঃস্থাপিত হয়। তাই শহীদের যাপিত জীবন ও লেখক-জীবনকে বোঝার আমার চেষ্টাটি যথেষ্ট পরিশীলিত নয় ভাবলে ভুল হবে না। (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪
শহীদ কাদরী, বন্ধুবরেষু- কত সহজেই না লিখতে পারি। যদি লিখতে হতো বাংলা কবিতার অন্যতম পুরুষ শহীদ কাদরী, কী লিখতে হতো কিংবদন্তির কবি শহীদ কাদরী, তাহলে তার কথা তার কবিতার কথা লেখা আমার জন্য সহজ হতো না। কাব্যরসিক সমালোচক যেমন নির্মোহ দৃষ্টিতে কাব্যস্রষ্টা ও তার সৃষ্টির আলোচনা করতে পারেন, বন্ধু তেমন পারে না। এ কারণেই।
শহীদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঢাকার অভয় দাস লেনের সমকাল অফিসে অথবা ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটে সেবাব্রত চৌধুরীর বৈঠকখানায়। তার পরনের ট্রাউজার ও ব্লেজারের রঙ এখন আর আমার চোখে ভাসে না, কিন্তু দীপ্ত তার ওই চেহারা কখনো ভুলি না। মাত্র কিছুকাল আগে মফস্বল কলেজ থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি আমি, স্বল্পভাষী আধুনিক চেহারার শহুরে তরুণ আমায় কিয়ৎ পরিমাণে নিষ্প্রভ করে দিতেই পারে। দিয়েছিলও হয়তো যদিও তখন আমি জানতাম না শহীদ কলকাতাকেও পেছনে ফেলে এসেছে। সে কবিতা লেখে সেবাব্রতর মুখে এ কথা শুনলেও বুদ্ধদেব বসু তার পত্রিকায় শহীদের কবিতা প্রকাশ করেছেন জানা ছিল না, যেমন অনুমান করি শহীদও বগুড়া আজিজুল হক কলেজ বার্ষিকীতে অথবা আজাদ, মিল্লাত ইত্যাকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত আমার গল্পাবলির কোনো খোঁজ রাখত না। ওই সময়ে ‘সমকাল’ অত্যন্ত নামি সাহিত্য পত্রিকা এবং সমকাল প্রকাশের বছরখানেক পরেই দ্বিমাসিক ‘উত্তরণ’ প্রকাশিত হলে সেটিও সমকালীন সাহিত্যাঙ্গনে সাদরে গৃহীত হয়। ‘উত্তরণ’-এর সহ-সম্পাদক হিসেবে আমার পরিচয় সর্বজনজ্ঞাত ছিল বলে আমার বিশ্বাস থাকলেও শহীদ সে কথা জানত বলে আমি মনে করি না। স্পষ্টতই ওই সময়ে আমাদের মধ্যে কোনো নিকট সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। অনিয়মিত দেখা সাক্ষাতের কথাই কেবল মনে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, উনিশ’ বাষট্টিতে সপ্তক প্রকাশের সময় থেকেই তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা। মধ্যকার সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমাদের রচনাদি প্রকাশিত হলেও এসব বিষয়ে কখনো কোনো কথাবার্তা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। কেবল মনে পড়ে সপ্তক-এ তার আসা-যাওয়া।
ষাটের দশকের পূর্ববাংলায় প্রথম লিটল ম্যাগাজিন সপ্তক। সম্পাদকবিহীন ওই অনিয়মিত সাহিত্য সংকলন সাতসুরের স্বরগ্রামের মতোই সাত নবীন কবিযশপ্রার্থীর সম্মিলনের স্বাক্ষর; তৎকালীন সাহিত্য সমাজে নিজেদের স্থানটিকে দৃশ্যমান করে তোলার প্রবল আগ্রহের ফসল। সপ্তক প্রকাশের সময় থেকেই শহীদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যেগাযোগ। আমার বিশ্বাস, এবং আমার মতো আরো অনেকেরই বিশ্বাস, আমার গল্পকার পরিচয় এবং শহীদ কাদরীর কবি পরিচয় স্পষ্ট রূপ নেয় ওই সপ্তক-এর কাল থেকেই।
সপ্তক ষাটের দশকের প্রথম ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিন। ছোটকাগজের সমস্ত চরিত্র সপ্তকের মধ্যে ছিল। সাত তরুণ মিলে এটি প্রকাশ করেছিলেন বলে নাম দেওয়া হয় সপ্তক। সেবাব্রত চৌধুরী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হুমায়ুন চৌধুরী, হায়াৎ মামুদ, শফিক খান, শহীদ কাদরী এবং দেবব্রত চৌধুরী কি আল মাহমুদ। সপ্তম সদস্যপদটি খোলা ছিল। দেবব্রত চৌধুরী কবি, সেবাব্রত তার অনুজ, আর আল মাহমুদ এসেছিলেন সেবাব্রত ও শহীদের সঙ্গে। সপ্তক-এর কোনো সম্পাদক ছিল না। সম্পাদকের দায়িত্ব পাছে কাউকে বেশি সম্মানে ঠেলে দেয় এই চিন্তাও সম্ভবত ছিল। এ কারণে সহপাঠী শফিক খান, সেই মুহূর্তে লেখালেখিতে খুব সক্রিয় না হলেও শাহজাহান প্রিন্টিং প্রেসের মালিক হওয়ার সুবাদে প্রকাশকের ভূমিকা গ্রহণ করেন।
উল্লিখিত বাক্যবন্ধ মদীয় ‘ষাট দশকের ছোট কাগজ, ছোট নয়’ রচনাটির অংশ। শহীদ কাদরীর রচনা প্রসঙ্গে এই উদ্ধৃতির প্রয়োজন এই জন্য যে শহীদ তার সৃষ্টির মানসিকতায় ষাট দশকের অত্যাধুনিক, বিদ্রোহী লেখকগোষ্ঠীর অনেক কাছাকাছি ছিল। সেকালে প্রতিষ্ঠিত কি পরিচিত লেখককুলের মানসিকতার সঙ্গে তার নৈকট্য ছিল না। সপ্তক-এর অন্যতম কবি হায়াৎ মামুদ, পরে পাঠকনন্দিত প্রাবন্ধিক-গবেষক-গদ্যশিল্পী, এখনো মনে রেখেছেন যে শহীদ কাদরী প্রায়ই ফুলতলি স্টেশনের কাছে সপ্তক-এর কার্যালয় শাহজাহান প্রিন্টিং প্রেস-এর অফিসে আসতেন।
সপ্তক-এর প্রসিদ্ধিই ছিল এস্টাব্লিশমেন্টপন্থী, গতানুগতিক প্রকাশিত সাহিত্য চিন্তার বিপরীতে অবস্থান নেয়ার জন্যে। তৎকালীন সাহিত্য সমাজ কি পাঠকসমাজ আমাদের গোষ্ঠীকে যে চোখেই দেখুন না কেন, আমরা নিজেদের সর্বাধুনিক বলে মনে করতাম। শহীদ আমাদের মানসিকতারই অংশভাক ছিল।
সপ্তক প্রকাশের কিছুকালের মধ্যেই প্রকাশিত হয় স্বাক্ষর। সপ্তক-এর বাইরে থাকা আমাদের মতোই বিদ্রোহী লেখক কতিপয়ের কেউ কেউ একত্রিত হয় প্রকাশ করেন স্বাক্ষর। শোনা যায়, সপ্তককেও নাকি স্বাক্ষর গোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক বলে বিবেচনা করতেন। স্বাক্ষর-এর ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়ায় ‘সাম্প্রতিক’। তার কিছুকাল পরেই প্রকাশিত হতে থাকে কণ্ঠস্বর- নিয়মিতই। যদিও কণ্ঠস্বর লিটল ম্যাগাজিনের সমগোত্রীয় ছিল না, বরং এস্টাব্লিশমেন্টপন্থীই ছিল বলা যায়- কণ্ঠস্বর-সম্পাদক অবশ্য কোনোকালেই এ-কথা মানবেন না। শহীদ কণ্ঠস্বর-এও শামিল হয়েছিল। অবশ্য সে অনেক পরের কথা। শহীদ ততদিনে ঢাকা টেলিভিশনে কর্মরত। আমি বাংলা একাডেমি ও পাকিস্তান অবজারভার-এ কয়েক বছর কাটিয়ে সাতসমুদ্র পার হয়ে চলে এসেছি। সপ্তক-এর সদস্যের জন্যে সেটিই হয়তো ভবিতব্য ছিল। এখন লক্ষ করি সপ্তক-এর সাত সদ্যেসর মধ্যে পাঁচজনই দীর্ঘকাল বিদেশবাসী ছিলেন। আমি, শহীদ ও দেবব্রত চৌধুরী আজও বিদেশেই। হায়াৎ মামুদ ও হুমায়ুন চৌধুরীও কাটিয়েছেন বিদেশে দীর্ঘকাল। গতানুগতিকতা এড়ানোর জন্যেই সম্ভবত।
দুই
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে ১৯৫৯-এ প্রকাশিত হয়। ওই কবিতাগ্রন্থের সমুদয় রচনা একাধিকবার পড়েছিলাম তার প্রুফপাঠক হিসেবে। এ কারণে সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে আধুনিক বাংলা কবিতা তথা পূর্ববাংলার আধুনিক কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় একরকম ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে বলা যায়। পরিচিতি ঘটে তৎকালীন সর্বাধুনিক গদ্য রচনাবলির সঙ্গেও- নতুন সাহিত্য, চতুরঙ্গ, পরিচয়, নন্দন ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকা, সমকাল ও উত্তরণ-এর মাধ্যমে। বিশেষত দেশি ও বিদেশি আধুনিক ছোটগল্পের সঙ্গে গভীর পরিচয়ের ফলে ওই সময়ের নতুন আধুনিক কবিতার মতোই নতুন আধুনিক গল্প লেখার চেষ্টা করে চলি। ঊনষাট-এর কোনো একসময়ে আমার গল্প ‘পরমাত্মীয়’, উত্তরণ-এ প্রকাশিত হলে সতীর্থরা মনে করেন কবিতা ও গল্প উভয়ক্ষেত্রেই সর্বাধুনিক বাংলা রচনার পথে উঠেছি আমরা এবং সেই চিন্তা-আশ্রয়ী কর্মকা-ের ফলশ্রুতি সপ্তক ও তার কিছু পরে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন কালবেলা। তেষট্টির কোনো একসময়ই সম্ভবত সমকাল-এ আমার গল্প ‘একজন পুরুষ চাই’ প্রকাশিত হলে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে- এদেশে নতুন সাহিত্যের স্রোতটিকে বইয়ে দিতে পেরেছি। বাষট্টির কোনো একসময়ে সপ্তক প্রকাশিত হয় এবং আমার গল্প আরও কয়েকটি পুতুল-এর সঙ্গে শহীদ-এর কবিতাও প্রকাশিত হয়। শহীদের কবিতা আমাদের প্রায় বিমোহিত করে। ফলে, সপ্তক-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় উনিশশো তেষট্টির আগস্টে শহীদ কাদরীর একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হয়। আমাদের ধারণা অনুযায়ী শহীদ কাদরীর একাধিক কবিতা একসঙ্গে তার আগে কখনো প্রকাশিত হয়নি।
শহীদ কাদরীর রচনা প্রসঙ্গে সপ্তক, কালবেলা কি আমার নানা রচনার প্রাসঙ্গিকতা এই যে, আমরা মনে করি, সপ্তক-এর মধ্য দিয়েই শহীদ কাদরী ও আমিসহ কয়েকজন নতুন সাহিত্যকর্মী পাঠকসমাজের সামনে উজ্জ্বল উপস্থিতি স্পষ্ট করতে পেরেছিলাম।
সপ্তক-এর আগে শহীদ কাদরীর রচনা অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও তার কবিতার প্রতি পাঠকের আগ্রহ সপ্তকই সৃষ্টি করে বলে এখনো যাঁরা সপ্তককে মনে রেখেছেন তাঁদের ধারণা।
সপ্তক-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় শহীদ কাদরীর যে ক’টি কবিতা প্রকাশিত হয় তার মধ্যে তিনটি কবিতার কথা আমার মনে পড়ে- ‘টেলিফোনে আরক্ত প্রস্তাব’, পাশের কামরার প্রেমিক’ ও ‘চন্দ্রালোকে’।
তিরিশ-চল্লিশের কবিতায় তখনও আচ্ছন্ন আমরা। পঞ্চাশের বামপন্থী কবিকুল কিঞ্চিৎ হৃদয় স্পর্শ করেছেন হয়তো, ষাটের রাগী অমিতবিক্রম কবিকুল তখনও অত প্রতাপী নন, ওই সময় শামসুর রাহমানের কবিতা কেবল নতুন কবিতার স্বাদই নয়, যেন নতুন কবিতার জগতই খুলে দেয়, অন্তত আমার সামনে। আর ঠিক তখনই শহীদ কাদরীর কবিতা পড়ি:
কালো ডায়ালে আমার আঙুলে ঐন্দ্রজালিক
ঘুরছে নম্বরগুলি-
শহরের ওপর থেকে
দূরদূর বাস গাড়ির ঘণ্টাধ্বনি তরঙ্গিত ঘাসে-ভরা
স্টেডিয়ামের ওপর থেকে
আসছে:
‘না, না, না’-কী জ্যোৎস্না কণ্ঠস্বর।
কত কাঁপন চিকন কালো তারে।
আমি ঠিক জানি চড়–ইপাখির মতো ঠোঁটজোড়া কাঁপছে
‘না, না, না’
প্রাত্যহিকতার চিত্রকল্প, সময়ের অবিকল প্রক্ষেপণ, পরিচিত মানবী আবেগের আশ্রয়ে শহীদের কবিতা অন্যসব কবিতার চাইতে যেন আলাদা মনে হয়। আরো পড়ি-
আর ঐ ডাকসাইটে লাল ঘোড়া
যদি ধরে ফেলে এই কামরায় গোধূলিকে ছত্রখান করে
‘না, না, না’
আমি জানি চড়–ইপাখির মতো ঠোঁটজোড়া কাঁপছে।
(টেলিফোনে আরক্ত প্রস্তাব)
স্পষ্ট বুঝি, এই আমাদের নতুন কবিতা। আবার পড়ি সপ্তকে প্রকাশিত তাঁর অন্য কবিতাটি:
গলা চিরে থুথু ফ্যালে দাপায় কপাট নড়বড়ে
শ্বাসকষ্ট যা পায় তা প্রেম; ঠা-া হাওয়া
হৎপি-ে বিরক্তিকর উৎকট নর্তন
অলৌকিক ইচ্ছা তার তাকে দিয়ে টেবিল বাজায়
(পাশের কামরার প্রেমিক)
তরুণ কবির অবিশ্বাস্য পরিণত নতুন কবিতা। আমরা মানি-
এ হেন অনেক কিছু, একটু আয়াসে চীনেবাদামের খোসা
ভাঙতে-ভাঙতে পার হওয়া যায় হে দীপ্ত প্রেমিক, বন্ধু ভাই
যথা শান্ত দুপুরে দেলাক্রোয়ার ক্রুদ্ধ, রুদ্ধ, মত্ত অশ্বারোহী
ট্রেনের কাটা শূকরের লালরক্ত, মৃত্যু, আর্তনাদ।
(পাশের কামরার প্রেমিক)
পরিচিত, যন্ত্রণাক্ত, অসহ্য জীবনে অপরিচিত জগতের অমিত উত্তেজনা, ক্রোধ অত সহজে তুলে আনেন যে কবি তাঁর কবিতায় তিনি আলোর বৃত্তে দাঁড়াবেনই, এ-ও আমরা ভেবেছিলাম।
অন্য কবিতার এই পঙ্ক্তি ক’টিও কখনো ভুলি না:
‘হে আমার প্রেম, নিষ্প্রাণ ময়ূরপঙ্খী কোন জলে ভাসবে না?’
(বালির তরঙ্গে তার নিতম্বের কঠিন করোটি, কোনো কান্নাই ছোঁবে না)
হে আমার প্রেম, নিষ্প্রাণ ময়ূরপঙ্খী দাঁড় পড়ে হৃৎস্পন্দনে
আমার অপেক্ষা ফুরোবে না।
(চন্দ্রালোকে)
তিন
কালবেলার তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল সম্ভবত বৎসরাধিক সময়কালে। প্রতি সংখ্যায়ই শহীদ কাদরীর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত কালবেলা প্রকৃতই নতুন সাহিত্যের উৎসাহী পাঠককুলে সাড়া ফেলেছিল বলে আমাদের বিশ্বাস। চতুরঙ্গ ও দেশসহ নানা পত্র-পত্রিকায় ‘কালাবেলা’র অনুকূল আলোচনা প্রকাশিত হয় এবং সপ্তক থেকে কালবেলা- এই চার-পাঁচ বছর সময়কালেই ওই পত্রিকা দুটিতে প্রকাশিত প্রায় সমস্ত লেখকই বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছে যান।
ওই সময়ে এখলাসউদ্দিন আহমদ টাপুর টুপুর নামে কিশোরদের জন্যে একটি পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে নিয়োজিত হন। চট্টগ্রামের পুস্তক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ‘বইঘর’ পত্রিকাটির প্রকাশক। টাপুর টুপুর-এর লেখালেখির আঙিনায় আমরাও উঠে আসি এবং বইঘর-এর স্বত্বাধিকারী শফি আহমদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। টাপুর টুপুর-এর রচনাদি ছাড়াও তার প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ অতি মনোগ্রাহী ছিল। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সৃষ্টি সে-সব দেখলেই চিতনাম আমরা। আর অমনি করেই কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গেও আমাদের হৃদ্যতা জন্মে। কিশোর পত্রিকা হলেও টাপুর টুপুর-এ প্রতিষ্ঠিত কি নবীন সকলেই লিখতেন। কিছুকালের মধ্যেই ‘বইঘর’ কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্মের আশ্রয়ে পুস্তক প্রকাশনা শুরু করে। একসঙ্গে প্রকাশিত বইঘর-এর প্রথম তিনটি কবিতাগ্রস্থ শামসুর রাহমানের ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, আল মাহমুদের ‘কালের কলস’ ও শহীদ কাদরীর ‘উত্তরাধিকার’ কেবল যে তৎকালীন প্রকাশনা শিল্পের অভূতপূর্ব সৌকর্যের পরিচয় বহন করে তা-ই নয়, আমাদের সাহিত্যেও নতুন যুগ, নতুন পর্বের সূচনা করে। স্পষ্টতই শহীদ কাদরী তখন খ্যাতিমান কবির সারিতে উঠে এসেছেন। এবং এখন আমরা পেছনে ফিরে দেখি ওই তিন কবিই পরে আমাদের কবিতার তিন প্রধান পুরুষ রূপে পাঠকচিত্তে স্থান করে নেন।
উত্তরাধিকার-এর প্রকাশকাল ১৯৬৭। সেটি শহীদ কাদরীর প্রথম কবিতাগ্রন্থ। কিয়ৎ পরিমাণে কাকতালীয় হলেও লক্ষ্য করি আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দুর্বিনীত কাল’, তারও প্রকাশ তখনই-১৯৬৭।
শহীদের পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমার প্রকাশকাল ১৯৭৪; তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই-এর প্রকাশকাল ১৯৭৮; এবং সর্বশেষ এবং চতুর্থ কবিতাসংগ্রহ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও : অতি সাম্প্রতিক প্রকাশনা-২০১১। সাত বছর, চার বছর ও তেত্রিশ বছর- শহীদ কাদরীর কবিতাগ্রন্থসমূহের প্রকাশকালীন ব্যবধান এমনই। সময়ের এই মাপ কিছু বিস্ময়ের সৃষ্টি করতেই পারে। তবে এটি অভূতপূর্ব কিছু নয়। আমার নিজের প্রথম তিনটি গল্পসংগ্রহ এক বছর পর প্রকাশিত হয়। চতুর্থ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় কুড়ি বছর পরে। সময়ের এই উল্লম্ফন আমাদের উভয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে ঘর ছাড়ার কারণেই। আমার দেশত্যাগ ঘটে তৃতীয় গ্রন্থটি প্রকাশের পরপরই, শহীদেরও অমন-তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরই। এই তথ্য থেকে যদি এমন মনে হয় যে দেশত্যাগ ছেড়ে আসা দেশের ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির জন্যে সহায়ক নয়, হয়তো সেটি যথার্থই। এমনও যদি বলা যায়, নিজ ভূমি ত্যাগ যে-কোনো শিল্পীর শিল্প সৃষ্টিতেই বাধা সৃষ্টি করে- সেটিও হয়তো খুব অযথার্থ হবে না। যদিও আমরা জানি, কিছু শিল্পী দেশত্যাগ করেও মহৎ সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন। শহীদ কাদরীর ক্ষেত্রে উভয় ধারণাই সঠিক বলে মনে করা যায়। দেশত্যাগ-এর পরে তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থের ঔৎকর্ষের বিচার কালের হাতেই তোলা থাক।
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরে শহীদ দেশত্যাগ করেন। প্রথম স্বল্প সময়ের জন্যে, পরে পাকাপাকি। সত্তরের শেষ দিকে সে বিদেশে যায় বলে জানি, কিন্তু কিছুকাল পরেই ফিরে আসে। আমি দেশত্যাগ করি ঊনসত্তরের শেষার্ধে। তারপরে শহীদের সঙ্গে আমার দেখা প্রায় দশ বছরের বেশি কাল পরে-১৯৮০-তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে। সায়াটিকা জাতীয় কোমরের ব্যথায় চিকিৎসাধীন। ওই সামান্য সময়ের সাক্ষাতে তার কাব্যকৃতির কোনো আলোচনা করা হয়নি। করার কথাও ছিল না। উত্তরাধিকার প্রকাশের পরেই তার কবিখ্যাতি বিস্তৃতি লাভ করে। নানা পত্র-পত্রিকায় কবিতা ছাপা হতে থাকে এবং তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা প্রকাশের আগের বছরেই কবিতায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয় তাকে। তার মাত্র দু’বছর আগে ছোটগল্পে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয় আমাকেও। বাষট্টির সপ্তক যে কবি ও গল্পকারদ্বয়কে পাঠকের সম্মুখে দাঁড় করায়- মাত্র দশ বছরের ব্যবধানেই তাদের রচনা সাহিত্যসমাজের স্বীকৃতি লাভ করে।
ওই হাসপাতালের পরে শহীদের সঙ্গে আমার দেখা হয় লন্ডনে ১৯৮৩-তে। লন্ডনবাসী কবি দেবব্রত চৌধুরী আমাকে শহীদের কাছে নিয়ে যান ‘সুরমা’ পত্রিকার অফিসে। ‘সুরমা’য় কর্মরত শহীদ তখন। লন্ডনে আমার বড়ভাইয়ের বাড়িতে আসে শহীদ। তখনই তার মুখে শুনি তার যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার কথা। মাত্র কয়েক মাস পরেই।
চার
যাবিত জীবনের কিছু ছায়া লেখকের রচনায় পড়ে- এ কথা জানা। লেখকের আপন জীবনই তার রচনার সর্বোৎকৃষ্ট উপাদান। এ-কথাও অনেকে বলেন। সময়, সমাজ, স্বদেশ, দূরদেশ, পরিপার্শ্ব, পরিবেশ এইসব নিয়েও কথা হয়- লেখকের রচনায় কী পরিমাণ প্রভাব ফেলে ওইসব। কিন্তু সময়, সমাজ, স্বদেশ, দূরদেশ, পরিপার্শ্ব পরিবেশ ইত্যাকার বিষয় যে লেখককে রচনাবিমুখও করে তার কথা বেশি শোনা যায় না।
দেশ-বিদেশের অনেক লেখকের কথাই আমরা জানি যাঁরা ক্ষীণপ্রজ অথচ রচনার ঔৎকর্ষে সর্বদাই লোকমুখে থাকেন। আবার দেখা যায়, অনেক লেখক প্রথম জীবনে প্রচুর গুণান্বিত রচনার পরে আর বেশি লেখেন না, বা লেখেনই না, এবং পরবর্তীতে রচনাসমূহ তেমন সমৃদ্ধও হয় না। শহীদ কাদরীর রচনা ও তার জীবন অনুমান করি- ওই উভয় ধারণার পরিপ্রেক্ষিতেই বোঝার চেষ্টা করা যায়।
শহীদের কাব্যকর্ম তার কৈশোরকালেই শুরু বলা যায়। স্পন্দন-এ তার কবিতা প্রকাশিত হয় উনিশশো পঞ্চান্নর দিকে, কবিতায় প্রকাশিত হয় উনিশশো ছাপ্পান্নয়। শহীদ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসে বাহান্নর শুরুতে, তখন তার বয়স বারো-তেরো। স্পন্দন কি কবিতায় রচনা প্রকাশের কালে তার বয়স পনেরো-ষোলো ছিল বলা যায়। পরবর্তী কয়েক বছর নিশ্চয়ই সে কবিতা লিখেছে, প্রকাশিত হয়েছে, তার পরিমাণ নিঃসন্দেহে বিপুল নয়। তাই সপ্তক প্রকাশকালে সহজেই আমরা তাকে আমাদের সদ্য তরুণ বিদ্রোহী আধুনিক নবীন লেখককুলে মেশাতে পারি। আমার নিজের প্রথম রচনা প্রকাশিত হয় বগুড়া আজিজুল হক কলেজ বার্ষিকীতে-১৯৫৬ সালে। শহীদের সমকালেই প্রায়।
সপ্তক ও কালবেলা পর্বের পরে শহীদের রচনার পরিমাণে ভাঁটা পড়ে। স্পষ্টই সেটি বোঝা যায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’-এ। এ গ্রন্থের কবিতা সংখ্যা চল্লিশটি। প্রকাশকাল ১৯৬৭। এগারো-বারো বছরে চল্লিশটি কবিতা। যদি ধরে নেওয়া যায় উত্তরাধিকার-এর বাইরেও তার কিছু কবিতা ছিল ওই কালে, তবুও বছরে গড়ে চারটির বেশি কবিতার হিসাব পাওয়া যায় না। সাত বছর পরে প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমায় কবিতার সংখ্যা একত্রিশটি। গড় হিসাব এই একই থাকে- বছরে চারটি। অথচ বছরে গড়ে চারটি করে কবিতা লেখার কবিই ১৯৭৩-এ কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। শহীদ কাদরীর কবিতার বৈভব ওই সামান্য পরিমাণ ও সময়েই কাব্যরসিক পাঠককুলকে মোহিত করেছিল।
তার তৃতীয় গ্রন্থ ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ ধারণ করে আছে পঁয়ত্রিশটি কবিতা। দ্বিতীয় গ্রন্থ থেকে চার বছর পরে প্রকাশিত। এবারে যেন তার কবিতা রচনায় উৎসাহ সঞ্চারিত হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে বছরে প্রায় আটটি করে কবিতা। চতুর্থ গ্রন্থ আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও ছত্রিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বত্রিশ বছর পরে। বোঝাই যায়, দীর্ঘকাল কবিতা রচনায় বিরত ছিল সে। ক্বচিৎ কখনো একটি দু’টি কবিতা লিখেছে হয়তো।
স্বভাবতই তাঁর জীবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কবিতার অতি ধীর গতির, কি কখনো থামার কখনো চলার ধরনটিকে অনেকেই বুঝতে চাইবেন। আমি নিজেও বোঝার চেষ্টা করছি। সম্ভবত এ-কারণে আরও বেশি যে, আমারও প্রথম তিনটি গল্পগ্রন্থ পরপর প্রকাশিত হয় ১৯৬৭-৬৯ সময়কালে। চতুর্থ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় কুড়ি বছর পরে ১৯৮৯-এ। আমার লেখার কালে আঠারো বছরের একটি বিরতি ছিল। পরে ১৯৮৭ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি, অতি ধীরগতিতেও হলেও, লেখার স্রোতটি বহমান আছে- একেবারে শুকোয়নি এখনো। শহীদের লেখক-জীবনের সঙ্গে আমার লেখক জীবনের বহিরঙ্গের এই মিল- চাই কি কিয়ৎ পরিমাণে যাপিত জীবনের সঙ্গেও, সম্ভবত কাকতালীয়ই, তবুও লক্ষ্যযোগ্য। যদিও শহীদের যাপিত জীবনের তাবৎ কাহিনি আমার জানা নেই, বিশেষত ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত সময়টিকে আমাদের সম্পর্কের অন্ধকারের যুগই বলা যায়- পৃথিবীর দুইপ্রান্তে দুইজনের বসবাসের কারণেই। যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন ছিল। লন্ডনে ১৯৮৩-তে দেখা হওয়ার পরেই সম্পর্কটি পুনঃস্থাপিত হয়। তাই শহীদের যাপিত জীবন ও লেখক-জীবনকে বোঝার আমার চেষ্টাটি যথেষ্ট পরিশীলিত নয় ভাবলে ভুল হবে না। (বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)