মেজবাহ মুকুল
দিনের আলো দ্রুতই মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের শরীরে। এই শেষ সময়টুকু কাজে লাগাতে হবে। দ্রুত খিলগাঁও রেলগেট থেকে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছতে হবে মতিঝিল। রিকশাওয়ালাকে হাঁক দেয়ায় বেশ ছুটছে সে। ঘন ঘন ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে ভেতরের গলি পেরিয়ে মূল রাস্তার দিকে বাঁক নেবে। এই মোড়েই মতিঝিল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে কড়া এক মিষ্টি গন্ধে মাতাল হওয়ার দশা। গন্ধটা অতীতেরও চেনা বলে স্মৃতি বার্তা দিচ্ছে নাকে। শুধু স্মরণে পাচ্ছি না। আশেপাশে খুঁজছিলাম কী হতে পারে বস্তুটা। স্কুলের গেটের পাশে চোখ পড়েতই বিস্মিত হলাম। আরে ছাতিম গাছ! তাও আবার এখানে। বছরের পর বছর শহরে দালানকোঠার গন্ধে আমরা আসল গন্ধই ভুলে গেলাম! এযে ছাতিম ফুলের গন্ধ! সন্ধ্যার আলো-আঁধারীর এ সময়টাতে গাছভর্তি গুচ্ছ গুচ্ছ ঘিয়ে রঙা ছাতিম ফুল কী এক সাদার মায়া ছড়িয়ে আছে। পলকে দেখা মোহনীয় এ দৃশ্য থেকে সত্যি চোখ ফেরানো দায়।
সন্ধ্যার আলোয় ছাতিম ফুলের অসাধারণ দৃশ্য দেখার ভাগ্য হবে ভাবিনি কখনো। গাছের তলায় বড় একটা অংশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুল ভূমিকে বানিয়েছে বরণঢালা। এই না হলে হেমন্ত! ছাতিম ফুল না ফুটলে এই বাংলায় হেমন্তের সন্ধ্যার পূর্ণতা আসতো না কখনো। ছাতিমের গন্ধ নাকে এলে বুঝি এসেছে হেমন্ত। এই গন্ধটাই যেন হেমন্তেরই গায়ের গন্ধ। ছাতিম ফুল ছাড়া হেমন্তের গৌরব করার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো ফুল কমই আছে। শরৎ থেকে প্রস্তুতি নেয়া শাখা পল্লবে কলি এসে হেমন্তে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরে ছাতিম ফুল। ফুল গাছটাও বেশ সুন্দর। ওপরের দিকটা সুন্দর ছাতার মতো ছড়ানো। সম্ভবত এ কারণেই গাছের নাম ছাতিম হয়েছে। একই মূলাবর্তে চার থেকে সাতটি লম্বা লম্বা চকচকে সবুজ পাতা।খসখসে অসমতল ধূসর রঙা নরম ছাল। একাধিক শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট একটি গাছ।তবে ঢাকা শহরের মতো জায়গায় ছাতিমের দেখা আমার কাছে হীরক ভা-ার পাওয়ার মতোই এক গল্প। আমার অজানায় হয়তো ঢাকার অনেক জায়গায় আছে ছাতিম। কিন্তু ঢাকায় এটিই আমার প্রথম দেখা ছাতিম গাছ। হয়তো সংখ্যায় বেশি নয়। গ্রামেই বেশি ছাতিম গাছের ছড়াছড়ি।
এসব ভাবতে ভাবতে মুহূর্তেই চলে গেলাম আমার গ্রামের বাড়ির পুকুর ঘাটের ছাতিম গাছটির কাছে। মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলায় ছাতিম ফুলের অসহ্য মাদকতার কথাওÑ উফ! আজও মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে যে আসেছে এই উৎকট গন্ধটা। যাচ্ছে নাইবা কেন! এমনই ছিল আমার ভাবনা ঘোর। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। পাশের ঘর থেকে অনেকটা ছুটতে ছুটতে জেঠি মা এসে মায়ের কাছে পাগলের প্রলাপের মতো ছাতিমের গুণ-কীর্তন শুরু করেÑ টের পাচ্ছিস ফাতেমা ছাতিমের ঘ্রাণ। এত মিষ্টি, এত মাদকতাময় আর কোনো ফুলের ঘ্রাণ আমাকে এতটা বিমোহিত করতে পারেনি। কৈশোর থেকে আমি এ ফুলের গন্ধে পাগল। বাপের বাড়িতেই প্রথম গন্ধ পাই। সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে আমরা সকলেই জড়ো হয়ে গেলাম। আমাদের কৌতূহল বেড়ে গেল। কোথা থেকে আসছে এমন বিলাসী মাতাল গন্ধ।
তখন আব্বা সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। আমাদের কথোপকথন আঁচ করতে পেরে বললেন, ছাতিম ফুলের গন্ধ এটা। আব্বার কথা আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকলাম। রাতে গন্ধ ছড়ানোর রহস্যও উদঘাটন করে বলেন, ছাতিম ফুল তার সুবাস নিয়ে এক রহস্যময়তায় মেতে ওঠে। দিনের বেলায় কোথায় যেন লুকিয়ে ফেলে তার এই মিষ্টি সুবাস। সন্ধ্যার সাথে সাথে ছাতিম তার গন্ধ বিলানো শুরু করে। রাত যত বাড়তে থাকে ছাতিমের গন্ধ তীব্র থেকে আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বাতাসে ছড়াতে থাকে সুবাস। ভেসে চলে দূর থেকে বহু দূর। গাছের কাছে এলে গন্ধটা একটু কড়া লাগে। তবে প্রকৃত মিষ্টি সুবাস পেতে খানিক দূরে গেলে বেশ ভালোভাবেই অনুভব করা যায়, কতটা মিষ্টি মাদকতায় রাতের নিবিড় পরিবেশ মুখর করে তোলে।
জেঠি মা’র এসব গুণ-কীর্তন শুনে মেজাজ আমার সপ্তমে চড়ে গেল। যে ফুলের গন্ধে মাথা ভোঁ ভোঁ করছে সে ফুলের এত বন্দনা, এত আদর মাখা আড়ম্বরপূর্ণ গল্প, ভাল্লাগে! কিন্তু একটা সত্য অস্বীকার করতে পারলাম না যে, গাছের কাছে এলে কড়া গন্ধ লাগে। আসলেই তাই। আমাদের ঘর থেকে বড়জোর ১০ গজ হবে গাছটির দূরত্ব। এই কড়া গন্ধেই বুঝি মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। এবার আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম ছাতিম ফুল দেখব বলে। চারদিক তখন অন্ধকার আর গাছ দীর্ঘ হওয়ায় ফুলও চোখে পড়লো না। গাছ তলায় ছড়ানো ফুল দেখে ভালই লাগছে। কিন্তু গাছের ফুল গাছে দেখার বাসনা অতৃপ্ত রয়ে গেল। মনে হচ্ছে কিছুটা উঁচু কিংবা ছাদে উঠলে দেখা যাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। রিকশাওয়ালার ক্রিং ক্রিং বেলে ধ্যান ভেঙে যায়। কখন চলে এলো মতিঝিল। অথচ ছাতিমের মাদকতা এখনো আমায় মাতাল করে রেখেছে।
মেজবাহ মুকুল
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
দিনের আলো দ্রুতই মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের শরীরে। এই শেষ সময়টুকু কাজে লাগাতে হবে। দ্রুত খিলগাঁও রেলগেট থেকে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছতে হবে মতিঝিল। রিকশাওয়ালাকে হাঁক দেয়ায় বেশ ছুটছে সে। ঘন ঘন ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে ভেতরের গলি পেরিয়ে মূল রাস্তার দিকে বাঁক নেবে। এই মোড়েই মতিঝিল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এখানে কড়া এক মিষ্টি গন্ধে মাতাল হওয়ার দশা। গন্ধটা অতীতেরও চেনা বলে স্মৃতি বার্তা দিচ্ছে নাকে। শুধু স্মরণে পাচ্ছি না। আশেপাশে খুঁজছিলাম কী হতে পারে বস্তুটা। স্কুলের গেটের পাশে চোখ পড়েতই বিস্মিত হলাম। আরে ছাতিম গাছ! তাও আবার এখানে। বছরের পর বছর শহরে দালানকোঠার গন্ধে আমরা আসল গন্ধই ভুলে গেলাম! এযে ছাতিম ফুলের গন্ধ! সন্ধ্যার আলো-আঁধারীর এ সময়টাতে গাছভর্তি গুচ্ছ গুচ্ছ ঘিয়ে রঙা ছাতিম ফুল কী এক সাদার মায়া ছড়িয়ে আছে। পলকে দেখা মোহনীয় এ দৃশ্য থেকে সত্যি চোখ ফেরানো দায়।
সন্ধ্যার আলোয় ছাতিম ফুলের অসাধারণ দৃশ্য দেখার ভাগ্য হবে ভাবিনি কখনো। গাছের তলায় বড় একটা অংশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুল ভূমিকে বানিয়েছে বরণঢালা। এই না হলে হেমন্ত! ছাতিম ফুল না ফুটলে এই বাংলায় হেমন্তের সন্ধ্যার পূর্ণতা আসতো না কখনো। ছাতিমের গন্ধ নাকে এলে বুঝি এসেছে হেমন্ত। এই গন্ধটাই যেন হেমন্তেরই গায়ের গন্ধ। ছাতিম ফুল ছাড়া হেমন্তের গৌরব করার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো ফুল কমই আছে। শরৎ থেকে প্রস্তুতি নেয়া শাখা পল্লবে কলি এসে হেমন্তে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরে ছাতিম ফুল। ফুল গাছটাও বেশ সুন্দর। ওপরের দিকটা সুন্দর ছাতার মতো ছড়ানো। সম্ভবত এ কারণেই গাছের নাম ছাতিম হয়েছে। একই মূলাবর্তে চার থেকে সাতটি লম্বা লম্বা চকচকে সবুজ পাতা।খসখসে অসমতল ধূসর রঙা নরম ছাল। একাধিক শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট একটি গাছ।তবে ঢাকা শহরের মতো জায়গায় ছাতিমের দেখা আমার কাছে হীরক ভা-ার পাওয়ার মতোই এক গল্প। আমার অজানায় হয়তো ঢাকার অনেক জায়গায় আছে ছাতিম। কিন্তু ঢাকায় এটিই আমার প্রথম দেখা ছাতিম গাছ। হয়তো সংখ্যায় বেশি নয়। গ্রামেই বেশি ছাতিম গাছের ছড়াছড়ি।
এসব ভাবতে ভাবতে মুহূর্তেই চলে গেলাম আমার গ্রামের বাড়ির পুকুর ঘাটের ছাতিম গাছটির কাছে। মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলায় ছাতিম ফুলের অসহ্য মাদকতার কথাওÑ উফ! আজও মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে যে আসেছে এই উৎকট গন্ধটা। যাচ্ছে নাইবা কেন! এমনই ছিল আমার ভাবনা ঘোর। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। পাশের ঘর থেকে অনেকটা ছুটতে ছুটতে জেঠি মা এসে মায়ের কাছে পাগলের প্রলাপের মতো ছাতিমের গুণ-কীর্তন শুরু করেÑ টের পাচ্ছিস ফাতেমা ছাতিমের ঘ্রাণ। এত মিষ্টি, এত মাদকতাময় আর কোনো ফুলের ঘ্রাণ আমাকে এতটা বিমোহিত করতে পারেনি। কৈশোর থেকে আমি এ ফুলের গন্ধে পাগল। বাপের বাড়িতেই প্রথম গন্ধ পাই। সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে আমরা সকলেই জড়ো হয়ে গেলাম। আমাদের কৌতূহল বেড়ে গেল। কোথা থেকে আসছে এমন বিলাসী মাতাল গন্ধ।
তখন আব্বা সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। আমাদের কথোপকথন আঁচ করতে পেরে বললেন, ছাতিম ফুলের গন্ধ এটা। আব্বার কথা আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকলাম। রাতে গন্ধ ছড়ানোর রহস্যও উদঘাটন করে বলেন, ছাতিম ফুল তার সুবাস নিয়ে এক রহস্যময়তায় মেতে ওঠে। দিনের বেলায় কোথায় যেন লুকিয়ে ফেলে তার এই মিষ্টি সুবাস। সন্ধ্যার সাথে সাথে ছাতিম তার গন্ধ বিলানো শুরু করে। রাত যত বাড়তে থাকে ছাতিমের গন্ধ তীব্র থেকে আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বাতাসে ছড়াতে থাকে সুবাস। ভেসে চলে দূর থেকে বহু দূর। গাছের কাছে এলে গন্ধটা একটু কড়া লাগে। তবে প্রকৃত মিষ্টি সুবাস পেতে খানিক দূরে গেলে বেশ ভালোভাবেই অনুভব করা যায়, কতটা মিষ্টি মাদকতায় রাতের নিবিড় পরিবেশ মুখর করে তোলে।
জেঠি মা’র এসব গুণ-কীর্তন শুনে মেজাজ আমার সপ্তমে চড়ে গেল। যে ফুলের গন্ধে মাথা ভোঁ ভোঁ করছে সে ফুলের এত বন্দনা, এত আদর মাখা আড়ম্বরপূর্ণ গল্প, ভাল্লাগে! কিন্তু একটা সত্য অস্বীকার করতে পারলাম না যে, গাছের কাছে এলে কড়া গন্ধ লাগে। আসলেই তাই। আমাদের ঘর থেকে বড়জোর ১০ গজ হবে গাছটির দূরত্ব। এই কড়া গন্ধেই বুঝি মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। এবার আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম ছাতিম ফুল দেখব বলে। চারদিক তখন অন্ধকার আর গাছ দীর্ঘ হওয়ায় ফুলও চোখে পড়লো না। গাছ তলায় ছড়ানো ফুল দেখে ভালই লাগছে। কিন্তু গাছের ফুল গাছে দেখার বাসনা অতৃপ্ত রয়ে গেল। মনে হচ্ছে কিছুটা উঁচু কিংবা ছাদে উঠলে দেখা যাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। রিকশাওয়ালার ক্রিং ক্রিং বেলে ধ্যান ভেঙে যায়। কখন চলে এলো মতিঝিল। অথচ ছাতিমের মাদকতা এখনো আমায় মাতাল করে রেখেছে।