alt

সাময়িকী

প্রতুল মুখোপাধ্যায়

‘আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন’

ওবায়েদ আকাশ

: শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

প্রতুল মুখোপাধ্যায় / ২৫ জুন ১৯৪২; মৃত্যু: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের বরিশালের সন্তান। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের একই আকাশ, একই জলবায়ু আর প্রায় একই কৃষ্টি-আচারে অভ্যস্ত জীবন কাটান। সঙ্গীতাঙ্গনে তাঁর মতো এমন নিবেদিত, সাহসী, কমিটেড, বিপ্লবী, নিয়ত পরিবর্তনে বিশ্বাসী আর প্রচলিত গৎবাঁধা জীবনের উজান ঠেলে চলা মানুষের সংখ্যা তো সব সময় হাতেগোনা কয়েকজনই। নমস্য এই কিংবদন্তি শিল্পী যখন এই শ্যামল বাংলার ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে- এই বাংলার নদী মাঠ আর বনবনানীর চোখে চোখ রেখে কণ্ঠে তোলেন-

আমি বাংলায় গান গাই

আমি বাংলার গান গাই

আমি আমার আমিকে চিরদিন

এই বাংলায় খুঁজে পাই।

আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন

আমি বাংলায় বাঁধি সুর

আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে

হেঁটেছি এতটা দূর।

বাংলা আমার জীবনানন্দ

বাংলা প্রাণের সুখ

আমি একবার দেখি

বারবার দেখি

দেখি বাংলার মুখ

আমি বাংলায় কথা কই

আমি বাংলার কথা কই

আমি বাংলায় ভাসি

বাংলায় হাসি

বাংলায় জেগে রই...

তখন তিনি হয়ে ওঠেন প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির প্রাণের আত্মীয়। তাঁর কণ্ঠের এমন মায়াবী সুর বলে দেয় কিংবদন্তি এই মানুষটি ঠিক কতটুকু ভালোবেসে ফেলেন এই বাংলাকে।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গীতে নিয়ত ভাঙচুর করেন। বদলে দেন শিল্পের ভাষা, সুরের ভাষা, কণ্ঠের ভাষা। আর এভাবে তিনি নিজেকেও বদলে নিতে নিতে করে তোলেন সময়োপযোগী। শুধু তাঁর কমিটমেন্ট, নিরাপোশী জীবনযাপন আর সত্য-ন্যায়ের পতাকা দৃঢ় হাতে ধরে রাখতে অবিচল তিনি। তাঁর নিরন্তর পরিশ্রম দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন সঙ্গীতকে, দেশপ্রেমকে। বিলাসী জীবনযাপনের চাকচিক্য একটুও স্পর্শ করেনি তাঁকে। নিজের বাহ্যিক জীবনাচারকে তুচ্ছ জ্ঞান করে অতি থেকে অতি সাধারণ জীবন কাটান আজও এই বৃদ্ধ বয়সে। প্রবলভাবে ভালোবাসেন লিটল ম্যাগাজিন-কর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতে। হয়তো সেই থেকেই এস্টাবলিশমেন্টের প্রতি তাঁর অনিহা। তিনি জানেন এই সব লিটল ম্যাগাজিনের মানুষরাই বিভিন্ন মাধ্যমে স্রোতের উজানে ঠেলে নিতে পারে তাঁদের চিন্তার প্রবহমানতাকে। কোনো তথাকথিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষ নন এই শিল্পী, কখনো প্রতিষ্ঠানের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, অবক্ষয়িত মূল্যবোধের কাছে মাথা নোয়াননি বলে আজও মানুষটিকে দেখলে যে কোনো সত্যিকারের বাঙালির মাথা নুয়ে আসে শ্রদ্ধায়।

২০০৯ সাল। এই প্রথম সৌভাগ্য হলো মানুষটিকে এত কাছ থেকে দেখার। শুধু দেখা নয়, তাঁর বুকে বুক মেলাবার, তাঁকে জড়িয়ে ধরবার, পাশাপাশি বসবার, হাসবার, গল্প করবার। এ বছর ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার’ দেয়া হয় ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য ও অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’কে। পত্রিকাটির সম্পাদক হওয়ার সূত্রে আমি ও আমার সঙ্গে দৈনিক সংবাদের স্টাফ রিপোর্টার হাবিবুর রহমান স্বপন- ১৯ নভেম্বর কলকাতা গিয়ে ২১ নভেম্বর সন্ধ্যা ছ’টায় ইউনিভার্সিটি অব কলকাতার পাশে মহাবোধি সোসাইটির সভাঘরে যাই পুরস্কার গ্রহণের জন্য। পুরস্কার গ্রহণ শেষে পুরস্কারদাতা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক (প্রতিষ্ঠারটির কর্তধারও বটে) সন্দীপ দত্ত (সদ্য প্রয়াত) চুপিচুপি বললেন, ‘চলে গেলে কিন্তু বিরাট মিস করবে, অনুষ্ঠান শেষে গান করবেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়’ আমি বিস্মিত হয়ে যেন সংবিৎ ফিরে পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, এ কি সেই প্রতুল মুখোপাধ্যায় যিনি ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি গেয়ে বাঙালির চিরকালের হৃদয়ের আত্মীয় হয়ে আছেন! আজ আমি তাঁকে সরাসরি দেখতে পাবো, স্বকণ্ঠে সরাসরি গান শুনতে পাবো!!! মনে পড়ে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তাঁর একটি গান শুনে আমার চোখ ভিজে উঠেছিল তাঁর প্রতি ভালোবাসায়। যেমন ছিল কথাগুলি-

আলু বেচ ছোলা বেচ

বেচ বাখরখানি

বেচ না বেচ না বন্ধু

তোমার চোখের মণি

... ... ...

ঝিঙে বেচ পাঁচ সিকেতে

হাজার টাকায় সোনা

বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে

স্বপ্ন বেচ না

ঘরদোর বেচ ইচ্ছে হলে

করবো নাকো মানা-

হাতে কলম জনম দুখি

তাকে বেচ না।

পুরস্কার বিতরণী শেষে আমি দর্শক সারিতে প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে খুঁজে পেয়ে কিছুটা কাছাকাছি গিয়ে বসলাম। তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি আমি। আমার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে হো হো করে হেসে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি আমাকে চেন?’ আমি বাকরুদ্ধ হয়ে মাথা নেড়ে বললাম- চিনি। তারপর আস্তে আস্তে বলমাম আমি তাঁর কী কী গান শুনেছি। তিনি খুশি হলেন। তাঁকে আমার ‘ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি’ বইটি উপহার দিলাম। তিনি আরো খুশি হলেন। তিনি আমার ‘শালুক’ পত্রিকাটির একটি কপি চাইলেন। সঙ্গে না থাকায় দিতে পারিনি।

গান শুরু করবেন প্রতুলদা। বললাম, ‘দাদা, আলু বেচ ছোলা বেচ গানটি শোনাবেন?’ তিনি মঞ্চে গিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ওবায়েদ আকাশ, তিনি আমার কাছে একটি গান শুনতে চেয়েছেন, আমি তো আর তাঁকে নিরাশ করতে পারি না! এটি গাওয়ার পর আপনাদের আরো দু’একটা গান শোনাবো।’ তখনো আমি তাঁর এ কথার অর্থ বুঝতে পারিনি। এ গানটি শেষ হওয়ার পর বললাম, ‘আমি বাংলায় গান গাই গানটি শোনান’। তখন ক্ষাণিকটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘না, ওটা তো হয়েই গেছে।’ তখনও আমি ভালো করে বুঝতে পারলাম না তাঁর কথা। যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত গানটি আমাদের শুনিয়েছেন।

অনুষ্ঠান শেষে যাবার প্রাক্কালে যখন আমারা তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন তিনি কথায় কথায় বলছিলেন, ‘আই শ্যাল নেভার গো টু বাংলাদেশ’। আর যতবারই তিনি কথাগুলো বলছিলেন, ততবারই যেন লজ্জায় মিশে যাচ্ছিলাম ধুলায়। বুঝলাম ‘আমি বাংলায় গান গাই’ বাংলাদেশের একজন তরুণ শিল্পী তাঁর বিনা পারমিশনে সুর কিছুটা এদিকওদিক করে গেয়েছেন বলেই শুধু তাঁর ক্ষোভ নয়, এ নিয়ে দেশ-বিদেশে আরো অনেক ঘটনা ঘটে গেছে- যা তাঁর ক্ষোভের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

অনুষ্ঠান শেষে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলেন শিল্পী। কিছুক্ষণ বাদে আমরাও রাস্তায় নেমে দেখি তিনি একা একা দাঁড়িয়ে আছেন। একটু সংকোচ নিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘দাদা, আপনার কি গাড়ি আসবে?’ হো হো করে হেসে দিয়ে বললেন, আমার তো গাড়ি নেই।’ তৎক্ষণাৎ দ্রুতবেগে হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন চলে গেলেন একা একা।

আমরা আমাদের কলেজ স্ট্রীটের রেস্ট হাউসের দিকে যাচ্ছি। প্রেসিডেন্সি কলেজের মোড়ে এসে দেখি তিনি তখনো একা একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাদের দেখে আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। গল্প জুড়ে দিলাম আমরা। সে-অনেক সময়। অসংখ্য দেশাত্মবোধক, গণসঙ্গীত ও আধুনিক গানের শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘তোমার ওপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমারও বাড়ি বাংলাদেশে। আমি এও শুনেছি, আমার ফ্যান সোসাইটি আছে বাংলাদেশে। আমাকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে দেড়শ’বার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু আমি আর কখখোনো যাবো না বাংলাদেশে।’ এই বাংলাদেশ একদিকে যেমন তাঁকে জন্ম দিয়ে ঋণী করেছে, আবার সেই বাংলাদেশই তাঁর গুণের কদর না করে অপমানের সাগরে নিমজ্জিত করেছে। এমন একজন চিরকালের কমিটেড শিল্পীর এই কি ছিল তাঁর নিজ দেশের কাছে প্রাপ্য?

এরপরও তিনি আবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। আসলে তিনি যে আর বাংলাদেশে আসবেন না, এটা ছিল তাঁর নিতান্ত ক্ষোভের কথা। তাছাড়া এত বড় মাপের মানুষ, ক্ষমা করে দেয়াই তো তাঁর মহৎ গুণ। তিনি সেই তরুণ শিল্পীকে অবশ্যই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া যে দেশে তাঁর জন্ম, যেখানে কেটেছে শৈশবের কিছুটা সময়, সেই দেশই তো তাঁর প্রকৃত দেশ। তাঁর প্রতি অভিমান করে কতক্ষণ থাকা যায়। তাঁকে যথার্থ সম্মান দিয়েই ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন তাঁর শুভাকাক্সক্ষীগণ। তিনিও এসেছিলেন নিজের দেশে, নিজের মনে করে।

বললেন তিনি, ‘তবে আমার সঙ্গীত জীবনে অনেক পেয়েছি আমি। একবার এক শ্রমজীবী- সে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বাথরুমের গন্ধবিনাশী দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করে। আমাকে দেখে হুড়মুড় করে এসে প্রণাম করলো এবং আমাকে দেখে সে বিস্মিত হয়ে গিয়ে কথা বলতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে তার মোবাইল থেকে তার স্ত্রীকে ফোন করে বলল, দেখ, আমি কার সঙ্গে কথা বলছি! তারপর বলল, আমাকে তো ভুলে যাবেন আপনি। তার হাত থেকে একটি গন্ধবিনাশী দ্রব্য আমাকে দিয়ে বলল, আপনি এটা নিয়ে যান, যখন আপনি এটা ব্যবহার করবেন, তখন আমার কথা মনে পড়বে। আমি তাকে বললাম, তুমি দাম নাও। সে কিছুতেই দাম না নিয়ে চলে গেল।

আবার একটি মেয়ের নতুন বিয়ে হয়েছে, সে হয়তো তার ননদদের নিয়ে রাস্তায় হাঁটছে। দৌড়ে এসে আমাকে প্রণাম করল। আমি তাকে বললাম, আরে তুমি করছ কী? সে আমাকে বলল, এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। আজ পূরণ হলো। তো এগুলোই তো জীবনের বড় পাওয়া। আমার কাছে নোবেল প্রাইজের চেয়ে বড় পাওয়া।’

অনেক বাস-ট্যাক্সি যাতায়াত করছে, হঠাৎ একটি বাস দেখে কলকাতার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে দশটায় তিনি ২০/২৫ গজ রাস্তা দৌড়ে গিয়ে ঐ বাসে উঠে পড়লেন।

প্রিয় প্রতুলদা, ঐ বাসে চড়ে কিংবা অদৃশ্য কোনো হাওয়ার গাড়িতে চড়ে আপনি যত দূরেই যান না কেন, আমরা যারা বাংলায় কথা বলি, বাংলাকে ভালোবাসি, তাদের হৃদয়ে আপনি চিরটাকালই আপনের চেয়ে আপন হয়ে বেঁচে থাকবেন।

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ভ্রম

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

রফিক আজাদের কবিতা

ছবি

ধূসর পাণ্ডুলিপি পরিবহন

ছবি

চৈত্রের কোনো এক মধ্যরাতে

ছবি

দেশভাগের বিপর্যয় ও ‘জলপাইহাটি’র জীবনানন্দ দাশ

ছবি

সামান্য ভুল

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথাভাঙা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ছবি

ধুলোময় জীবনের মেটাফর

ছবি

স্কুলটি ছোট্ট বটে

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

আদোনিসের কবিতা

ছবি

আড়াই লেনের কৃষ্ণচূড়া

ছবি

গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক ইতিহাস ও দেশপ্রেম

ছবি

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

ছবি

বইমেলায় আসছে নতুন বই

ছবি

সরল প্রাণের সোপান

ছবি

হাসান আজিজুল হকের দর্শনচিন্তা

ছবি

শীতের পদাবলি

tab

সাময়িকী

প্রতুল মুখোপাধ্যায়

‘আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন’

ওবায়েদ আকাশ

প্রতুল মুখোপাধ্যায় / ২৫ জুন ১৯৪২; মৃত্যু: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের বরিশালের সন্তান। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের একই আকাশ, একই জলবায়ু আর প্রায় একই কৃষ্টি-আচারে অভ্যস্ত জীবন কাটান। সঙ্গীতাঙ্গনে তাঁর মতো এমন নিবেদিত, সাহসী, কমিটেড, বিপ্লবী, নিয়ত পরিবর্তনে বিশ্বাসী আর প্রচলিত গৎবাঁধা জীবনের উজান ঠেলে চলা মানুষের সংখ্যা তো সব সময় হাতেগোনা কয়েকজনই। নমস্য এই কিংবদন্তি শিল্পী যখন এই শ্যামল বাংলার ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে- এই বাংলার নদী মাঠ আর বনবনানীর চোখে চোখ রেখে কণ্ঠে তোলেন-

আমি বাংলায় গান গাই

আমি বাংলার গান গাই

আমি আমার আমিকে চিরদিন

এই বাংলায় খুঁজে পাই।

আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন

আমি বাংলায় বাঁধি সুর

আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে

হেঁটেছি এতটা দূর।

বাংলা আমার জীবনানন্দ

বাংলা প্রাণের সুখ

আমি একবার দেখি

বারবার দেখি

দেখি বাংলার মুখ

আমি বাংলায় কথা কই

আমি বাংলার কথা কই

আমি বাংলায় ভাসি

বাংলায় হাসি

বাংলায় জেগে রই...

তখন তিনি হয়ে ওঠেন প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালির প্রাণের আত্মীয়। তাঁর কণ্ঠের এমন মায়াবী সুর বলে দেয় কিংবদন্তি এই মানুষটি ঠিক কতটুকু ভালোবেসে ফেলেন এই বাংলাকে।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গীতে নিয়ত ভাঙচুর করেন। বদলে দেন শিল্পের ভাষা, সুরের ভাষা, কণ্ঠের ভাষা। আর এভাবে তিনি নিজেকেও বদলে নিতে নিতে করে তোলেন সময়োপযোগী। শুধু তাঁর কমিটমেন্ট, নিরাপোশী জীবনযাপন আর সত্য-ন্যায়ের পতাকা দৃঢ় হাতে ধরে রাখতে অবিচল তিনি। তাঁর নিরন্তর পরিশ্রম দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন সঙ্গীতকে, দেশপ্রেমকে। বিলাসী জীবনযাপনের চাকচিক্য একটুও স্পর্শ করেনি তাঁকে। নিজের বাহ্যিক জীবনাচারকে তুচ্ছ জ্ঞান করে অতি থেকে অতি সাধারণ জীবন কাটান আজও এই বৃদ্ধ বয়সে। প্রবলভাবে ভালোবাসেন লিটল ম্যাগাজিন-কর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতে। হয়তো সেই থেকেই এস্টাবলিশমেন্টের প্রতি তাঁর অনিহা। তিনি জানেন এই সব লিটল ম্যাগাজিনের মানুষরাই বিভিন্ন মাধ্যমে স্রোতের উজানে ঠেলে নিতে পারে তাঁদের চিন্তার প্রবহমানতাকে। কোনো তথাকথিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষ নন এই শিল্পী, কখনো প্রতিষ্ঠানের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে, অবক্ষয়িত মূল্যবোধের কাছে মাথা নোয়াননি বলে আজও মানুষটিকে দেখলে যে কোনো সত্যিকারের বাঙালির মাথা নুয়ে আসে শ্রদ্ধায়।

২০০৯ সাল। এই প্রথম সৌভাগ্য হলো মানুষটিকে এত কাছ থেকে দেখার। শুধু দেখা নয়, তাঁর বুকে বুক মেলাবার, তাঁকে জড়িয়ে ধরবার, পাশাপাশি বসবার, হাসবার, গল্প করবার। এ বছর ‘কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার’ দেয়া হয় ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য ও অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’কে। পত্রিকাটির সম্পাদক হওয়ার সূত্রে আমি ও আমার সঙ্গে দৈনিক সংবাদের স্টাফ রিপোর্টার হাবিবুর রহমান স্বপন- ১৯ নভেম্বর কলকাতা গিয়ে ২১ নভেম্বর সন্ধ্যা ছ’টায় ইউনিভার্সিটি অব কলকাতার পাশে মহাবোধি সোসাইটির সভাঘরে যাই পুরস্কার গ্রহণের জন্য। পুরস্কার গ্রহণ শেষে পুরস্কারদাতা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক (প্রতিষ্ঠারটির কর্তধারও বটে) সন্দীপ দত্ত (সদ্য প্রয়াত) চুপিচুপি বললেন, ‘চলে গেলে কিন্তু বিরাট মিস করবে, অনুষ্ঠান শেষে গান করবেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়’ আমি বিস্মিত হয়ে যেন সংবিৎ ফিরে পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, এ কি সেই প্রতুল মুখোপাধ্যায় যিনি ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি গেয়ে বাঙালির চিরকালের হৃদয়ের আত্মীয় হয়ে আছেন! আজ আমি তাঁকে সরাসরি দেখতে পাবো, স্বকণ্ঠে সরাসরি গান শুনতে পাবো!!! মনে পড়ে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তাঁর একটি গান শুনে আমার চোখ ভিজে উঠেছিল তাঁর প্রতি ভালোবাসায়। যেমন ছিল কথাগুলি-

আলু বেচ ছোলা বেচ

বেচ বাখরখানি

বেচ না বেচ না বন্ধু

তোমার চোখের মণি

... ... ...

ঝিঙে বেচ পাঁচ সিকেতে

হাজার টাকায় সোনা

বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে

স্বপ্ন বেচ না

ঘরদোর বেচ ইচ্ছে হলে

করবো নাকো মানা-

হাতে কলম জনম দুখি

তাকে বেচ না।

পুরস্কার বিতরণী শেষে আমি দর্শক সারিতে প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে খুঁজে পেয়ে কিছুটা কাছাকাছি গিয়ে বসলাম। তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি আমি। আমার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে হো হো করে হেসে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি আমাকে চেন?’ আমি বাকরুদ্ধ হয়ে মাথা নেড়ে বললাম- চিনি। তারপর আস্তে আস্তে বলমাম আমি তাঁর কী কী গান শুনেছি। তিনি খুশি হলেন। তাঁকে আমার ‘ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি’ বইটি উপহার দিলাম। তিনি আরো খুশি হলেন। তিনি আমার ‘শালুক’ পত্রিকাটির একটি কপি চাইলেন। সঙ্গে না থাকায় দিতে পারিনি।

গান শুরু করবেন প্রতুলদা। বললাম, ‘দাদা, আলু বেচ ছোলা বেচ গানটি শোনাবেন?’ তিনি মঞ্চে গিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ওবায়েদ আকাশ, তিনি আমার কাছে একটি গান শুনতে চেয়েছেন, আমি তো আর তাঁকে নিরাশ করতে পারি না! এটি গাওয়ার পর আপনাদের আরো দু’একটা গান শোনাবো।’ তখনো আমি তাঁর এ কথার অর্থ বুঝতে পারিনি। এ গানটি শেষ হওয়ার পর বললাম, ‘আমি বাংলায় গান গাই গানটি শোনান’। তখন ক্ষাণিকটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘না, ওটা তো হয়েই গেছে।’ তখনও আমি ভালো করে বুঝতে পারলাম না তাঁর কথা। যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত গানটি আমাদের শুনিয়েছেন।

অনুষ্ঠান শেষে যাবার প্রাক্কালে যখন আমারা তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন তিনি কথায় কথায় বলছিলেন, ‘আই শ্যাল নেভার গো টু বাংলাদেশ’। আর যতবারই তিনি কথাগুলো বলছিলেন, ততবারই যেন লজ্জায় মিশে যাচ্ছিলাম ধুলায়। বুঝলাম ‘আমি বাংলায় গান গাই’ বাংলাদেশের একজন তরুণ শিল্পী তাঁর বিনা পারমিশনে সুর কিছুটা এদিকওদিক করে গেয়েছেন বলেই শুধু তাঁর ক্ষোভ নয়, এ নিয়ে দেশ-বিদেশে আরো অনেক ঘটনা ঘটে গেছে- যা তাঁর ক্ষোভের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

অনুষ্ঠান শেষে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলেন শিল্পী। কিছুক্ষণ বাদে আমরাও রাস্তায় নেমে দেখি তিনি একা একা দাঁড়িয়ে আছেন। একটু সংকোচ নিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘দাদা, আপনার কি গাড়ি আসবে?’ হো হো করে হেসে দিয়ে বললেন, আমার তো গাড়ি নেই।’ তৎক্ষণাৎ দ্রুতবেগে হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন চলে গেলেন একা একা।

আমরা আমাদের কলেজ স্ট্রীটের রেস্ট হাউসের দিকে যাচ্ছি। প্রেসিডেন্সি কলেজের মোড়ে এসে দেখি তিনি তখনো একা একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাদের দেখে আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। গল্প জুড়ে দিলাম আমরা। সে-অনেক সময়। অসংখ্য দেশাত্মবোধক, গণসঙ্গীত ও আধুনিক গানের শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘তোমার ওপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমারও বাড়ি বাংলাদেশে। আমি এও শুনেছি, আমার ফ্যান সোসাইটি আছে বাংলাদেশে। আমাকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে দেড়শ’বার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু আমি আর কখখোনো যাবো না বাংলাদেশে।’ এই বাংলাদেশ একদিকে যেমন তাঁকে জন্ম দিয়ে ঋণী করেছে, আবার সেই বাংলাদেশই তাঁর গুণের কদর না করে অপমানের সাগরে নিমজ্জিত করেছে। এমন একজন চিরকালের কমিটেড শিল্পীর এই কি ছিল তাঁর নিজ দেশের কাছে প্রাপ্য?

এরপরও তিনি আবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। আসলে তিনি যে আর বাংলাদেশে আসবেন না, এটা ছিল তাঁর নিতান্ত ক্ষোভের কথা। তাছাড়া এত বড় মাপের মানুষ, ক্ষমা করে দেয়াই তো তাঁর মহৎ গুণ। তিনি সেই তরুণ শিল্পীকে অবশ্যই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া যে দেশে তাঁর জন্ম, যেখানে কেটেছে শৈশবের কিছুটা সময়, সেই দেশই তো তাঁর প্রকৃত দেশ। তাঁর প্রতি অভিমান করে কতক্ষণ থাকা যায়। তাঁকে যথার্থ সম্মান দিয়েই ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন তাঁর শুভাকাক্সক্ষীগণ। তিনিও এসেছিলেন নিজের দেশে, নিজের মনে করে।

বললেন তিনি, ‘তবে আমার সঙ্গীত জীবনে অনেক পেয়েছি আমি। একবার এক শ্রমজীবী- সে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বাথরুমের গন্ধবিনাশী দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করে। আমাকে দেখে হুড়মুড় করে এসে প্রণাম করলো এবং আমাকে দেখে সে বিস্মিত হয়ে গিয়ে কথা বলতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে তার মোবাইল থেকে তার স্ত্রীকে ফোন করে বলল, দেখ, আমি কার সঙ্গে কথা বলছি! তারপর বলল, আমাকে তো ভুলে যাবেন আপনি। তার হাত থেকে একটি গন্ধবিনাশী দ্রব্য আমাকে দিয়ে বলল, আপনি এটা নিয়ে যান, যখন আপনি এটা ব্যবহার করবেন, তখন আমার কথা মনে পড়বে। আমি তাকে বললাম, তুমি দাম নাও। সে কিছুতেই দাম না নিয়ে চলে গেল।

আবার একটি মেয়ের নতুন বিয়ে হয়েছে, সে হয়তো তার ননদদের নিয়ে রাস্তায় হাঁটছে। দৌড়ে এসে আমাকে প্রণাম করল। আমি তাকে বললাম, আরে তুমি করছ কী? সে আমাকে বলল, এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। আজ পূরণ হলো। তো এগুলোই তো জীবনের বড় পাওয়া। আমার কাছে নোবেল প্রাইজের চেয়ে বড় পাওয়া।’

অনেক বাস-ট্যাক্সি যাতায়াত করছে, হঠাৎ একটি বাস দেখে কলকাতার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে দশটায় তিনি ২০/২৫ গজ রাস্তা দৌড়ে গিয়ে ঐ বাসে উঠে পড়লেন।

প্রিয় প্রতুলদা, ঐ বাসে চড়ে কিংবা অদৃশ্য কোনো হাওয়ার গাড়িতে চড়ে আপনি যত দূরেই যান না কেন, আমরা যারা বাংলায় কথা বলি, বাংলাকে ভালোবাসি, তাদের হৃদয়ে আপনি চিরটাকালই আপনের চেয়ে আপন হয়ে বেঁচে থাকবেন।

back to top