মহিবুল আলম
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে সাধারণত গ্রীষ্মকালে খুব একটা বৃষ্টি হয় না, শীতকালে হয়। কিন্তু আজ হলো। ঝুম বৃষ্টি। গোল্ড কোস্ট শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নিরাং নদীর ডকে বসে আজ পূষনের সঙ্গে গ্রীষ্মের বৃষ্টিতে খুব করে ভিজলাম। ভিজতে ভিজতে আমার তিন দশক আগের একটি গল্পটি মনে পড়ে গেল। গল্পটি পূষনের। তবে গল্পে পূষনকে ছাপিয়ে সেদিন আনিস ভাইয়াই প্রধান হয়ে উঠেছিলেন।
বন্ধুরা, তাহলে গল্পটি এবার শুরু থেকেই বলি।
হ্যাঁ, সত্যি তাই, আনিস ভাই সেই ত্রিশ বছর আগে একদিন একটা খামে ভরা চিঠি খুলে সত্যি রাজপুত্র হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি ছিলেন নিতান্ত সাধারণ একটা ছেলে। তালি দেওয়া চপ্পলের তল ঘষে ঘষে মহল্লার এপাশ-ওপাশ ঘুরতেন। ছাত্র পড়াতেন। পায়ে হেঁটে সারুলিয়া থেকে ডেমরার বাসস্ট্যান্ডে যেতেন। বাদুরঝোলা হয়ে এই শহরতলি থেকে শহরে গিয়ে চাকুরিপাড়ার অলিগলি চষে বেড়াতেন। চাকুরির বয়স শেষধাপে, এক ধরনের হতাশা তার গায়ে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিল। এমনটা মনে হয়েছিল, বাকি জীবনটা তার মানুষের বাসার কড়া নেড়েই কাটিয়ে দিতে হবে। মহল্লার মানুষও তাই ভেবে নিয়েছিল।
পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও আনিস ভাইয়ের একটা অনাকাক্সিক্ষত দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। রফিক ভাই একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। এক মাস বেতন পান তো, তিন মাস তার বেতনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না। তারপরও সেখানে চাকরি করছেন কোথাও আর চাকরি পাচ্ছেন না বলে। কমল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাদের ছোটবোন রুমিন তো পরিবারে খেটেই মরে। মা বিছানায়। তাদের বাবা আজমল কাকা অবসরে। সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রাফটসম্যানের চাকরি করতেন। উপড়ি ছিল না কখনই। টেনেটুনে সংসার চালাতেন।
আনিস ভাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়েন, তখনই আজমল কাকা অবসরে যান। আনিস ভাইয়ের ওপর ভরসা করেছিলেন যে, পাস করে ছেলেটার চাকরি হবে, সংসারে সচ্ছলতা আসবে। কিন্তু চাকরির বয়সসীমা যখন শেষধাপে, কোথাও চাকরি হচ্ছিল না, তখন আজমল কাকা ভেতরে-বাইরে ফুঁসে ওঠেন, যেন আনিস ভাই ইচ্ছে করেই চাকরি নিচ্ছিলেন না।
আর ঠিক তখনই বিধাতা যেন আনিস ভাইয়ের দুঃখে উদ্বেলিত হয়ে আড়ালে হাসেন। তারপর তার ওপর এমন বর দেন, রাতারাতি তিনি হয়ে ওঠেন রাজপুত্র। কমপক্ষে সমাজ ও কালের এহেন পরিস্থিতিতে চরম শত্রুও স্বীকার করবে, হ্যাঁ, রাজপুত্রই তো বটে।
কিন্তু আনিস ভাই হঠাৎ করে রাজপুত্র হয়ে কেমন পরিবর্তন হয়ে যান। কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গিমায়, এমনকি হাঁটাচলাও। সর্বোপরি তিনি একজন বিসিএস ক্যাডার, সহকারি পুলিশ কমিশনার। ট্রেনিং শেষে পাশের জেলায় এসে যোগ দিয়েছেন। কয়েকটা থানা তার অধীনে। তিনি যখন গাড়ি নিয়ে সারুলিয়াতে আসেন, শহরতলির এই রাস্তা দিয়ে গটগট করে হেঁটে যান, তখন মহল্লার সবাই কেমন সমীহই করে।
সমীহ শুধু আনিস ভাইকেই করে না, তার বাবা আজমল কাকাকেও মহল্লায় এখন বাড়তি সম্মান দেয়। দোকানে মজলিশে চেয়ারটা বাড়িয়ে দেয়। রফিক ভাই ও কমল এখন রাজপুত্রের গর্বিত ভাই। রুমিন চুলা ঠ্যালার চিরায়ত ভূমিকায় পড়ে রইলেও তার মধ্যেও একটা পরিবর্তন এসেছে। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে কমল ও আনিস ভাইয়ের বড় বোনজামাই মিজান ভাইয়ের মধ্যে। নিতু’পার বর মিজান ভাই শুধু লাফাচ্ছেন আর লাফাচ্ছেন। আর আমি তো তাদেরই প্রতিবেশী।
দুই
সারুলিয়ার এই দিকটায় মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত বা বড়জোর মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক বাস করে। সমাজ বিচারে তারা গড়েও উঠেছে সেরকমভাবে। এরই মধ্যে দুই-চারজন ভালো মানুষ ঢুকে নিতান্তই বেকায়দায় পড়ে গেছে। তারা না পারছে এদের সঙ্গে মিশতে, না পারছে এদেরকে ছেড়ে যেতে।
রাজধানীর কাছাকাছি হয়েও শহরতলিতে এখনও সেই গ্রামের আচার-ব্যবস্থা রয়ে গেছে। সবাই সব ঘরের হাঁড়ির খবর রাখে। অনেক ছোট ঘটনা নিয়ে তোলপাড় করে, আবার অনেক বড় ঘটনা অনায়াসে ঢেকে দেয়। ব্যাপারটা তেমন কোনো গুরুত্ব বহন না করলেও আনিস ভাই সত্যি আজকাল আলোচনায় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সুন্দরী কন্যার পিতা কিংবা মাঝারি মানের কন্যার পয়সাওয়ালা বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসছেন। ঘটকও ভিড় জমিয়েছে দু’চারজন। কিন্তু আনিস ভাই মাথা নাড়ছেন। তিনি আরও দেখবেন, আরও যাচাই করবেন, এরই মধ্যে রাজকন্যাকে খুঁজে নিবেন।
ওদিকে প্রতিটা কন্যাপক্ষও এ ব্যাপারে বেশ উৎসাহী। এমন একজন রাজপুত্র! তাই আনিস ভাইয়ের পাত্রী বেছে নিতে অসুবিধা কি? রাজপুত্রের জন্য রাজকন্যা না হলে কি মানায়? তাই রাজপুত্রের বাবা-মা, ভাইবোন সবাই রাজপুত্রের পাত্রী পছন্দ করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমিও তাদের প্রতিবেশী হিসেবে একই ব্যস্ততায় ভুগছি।
আমাদের বাসা ও কমলদের বাসা খুব কাছাকাছি। মাঝখানে ইট-সুড়কির সরুপথ, অতি সামান্য ঘাসের দৃষ্টি, তারপরই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুই পরিবারের অর্ধ-সমাপ্ত দালান। একই রঙের ফটক। সবুজ রঙ। এই সবুজ রঙের ফটকের মুখোমুখি সম্পর্কটার মতোই আমাদের দুই পরিবারের প্রতিটা মানুষের সম্পর্ক। বন্ধন নেই, তবুও বিরাট বন্ধন। মাঝেমধ্যে সম্পর্কের ওঠানামা, একটু আলোড়ন, তারপরই আবার সময়টা এক হয়ে যায় নির্দিষ্ট ধারায় ও নির্দিষ্ট নিয়মে। আর এদিকে কমল ও আমি? সেতো বলারই অপেক্ষা রাখে না। এক সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। এক সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কমল ভূগোল বিষয়ে আর আমি বাংলা সাহিত্যে।
ঘনিষ্ঠ পড়শি হিসেবে হোক আর কমলের বন্ধু হিসেবেই হোক, আনিস ভাইয়ের জন্য এ পর্যন্ত যতগুলো পাত্রীর মুখ দেখা হয়েছে, প্রায় প্রতিটা পাত্রীর মুখদর্শন অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আশ্চর্য ব্যাপার, এমন উত্তর-আধুনিক সময়কালে আমরা এখনও সেই ঊষাকালের গন্ধ পাই। এখনও একটা মেয়েকে পণ্য হিসেবে দেখি। যেন মেয়েরা মানুষ নয়, প্রাণময় সুদর্শন বস্তু, রূপের সওদা হয়। স্পষ্ট দৃশ্যমান একটা মেয়ের জড়সড় চেহারা। ঘোমটা উগলে মুখ দেখা। ছোটখাটো প্রশ্ন করা। হাত টিপে দেখা। একটু হাঁটতে বলা। চুল দেখা। পায়ের গোড়ালি দেখা...! তারপর পাঁচশো এক টাকা দেওয়া। কোথাও কোথাও সালামির টাকা না দিয়েই চলে আসা। মেয়ে নিখুঁত হলেও বাসায় এসে কথা উঠবে, ‘আরে মেয়ের খড়ম-পা। দেখেছিস, মেয়ের নাকের নথটা কেমন বাঁকা...?’
জানালা গলে কমলকে দেখি, আমাদের বাসার গেট ঠেলে সে ঢুকছে। ওদিকে বিকেলটা বাইরে কোথাও যেন থেমে রয়েছে। আমি আমার পড়ার রুমে। বেশ কিছু মশা উড়ছে এদিক-ওদিক। দু’একটা মশা বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকছে। রুমের ভেতর খানিকটা আবছা অন্ধকার।
কমল আমার রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে, অন্ধকারে বসে আছিস কেন? কবিতার ভাব আনছিস নাকি?’
আমি হাসি।
কমল নিজ থেকেই রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে বলে, ‘দেখছিস, কী পরিমাণ মশা তোর রুমে ঢুকেছে? জানালা বন্ধ কর’।
আমি নড়ি না।
কমল বসা থেকে উঠে গিয়ে জানালা টেনে বন্ধ করে। আবার চেয়ারে বসতে বসতে বলে, ‘শোন, কাল বিকালে একটা মেয়ে দেখতে যাব’।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কোথায়?’
‘আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে’।
‘অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ মানে?’
কমল রহস্যের হাসি হাসে। বলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে। আগামীকাল বিকেল সাড়ে চারটায় কনের বোনজামাই কনেকে নিয়ে অপরাজের বাংলার পাদদেশে আসবে। আনিস ভাই, মিজান ভাই, তুই ও আমি সেখানে থাকব’।
আমি বলি, ‘রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখা, কেমন বেখাপ্পা ঠেকছে না?’
কমল আবার হাসে। বলে, ‘তুই কোন দুনিয়াতে আছিস?’
‘কেন কী হয়েছে?’
‘আজকাল তো রাস্তাঘাটে, কলেজ-ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে, শপিংমলেই মেয়ে দেখাদেখি বেশি হয়। এভাবে মেয়ে দেখাটাই ভালো। মেয়ে দেখে আমাদের আর টাকা দিতে হবে না। আর মেয়েপক্ষও খরচ থেকে বেঁচে যাবে। এদেরকেও তো আমাদের উপলক্ষে ছোটখাটো একটা আয়োজন করতে হয়’।
আমি মাথা ঝাঁকাই। এমনিই। বিড়বিড় করে বলি, ‘তা হয়। সেটা জানি। কিন্তু আনিস ভাইয়ের মতো এমন একজন রাজপুত্রের জন্য এভাবে মেয়ে দেখা...!’
কমল বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বললি? বুঝতে পারলাম না’।
আমি হেসে বলি, ‘না, তেমন কিছু না’।
তিন
সেদিনের বিকেলটা বেশ জীবন্ত ছিল। নরম রোদের মধ্যে সূর্যের কোনো অস্থিরতা ছিল না। দিঘল বৃক্ষছায়া। টুং টাং রিকশার শব্দ। গ্রীষ্মের প্রায় শেষ। এক ধরনের সন্ধি বর্ষাঋতুর সঙ্গে। কিছুটা নরম হাওয়া, কিছুটা নরম রোদ।
যদিও বিকেল ছিল, কিন্তু দুপুরের আক্রান্তিটা রয়ে গিয়েছিল স্পষ্ট সূর্যের মধ্যে। আর ছিল বৈকালিক ক্লাসের মৃদু কোলাহল ও গুঞ্জন ছড়িয়ে এক এক করে ছাত্র-ছাত্রীরা চলে যাওয়া।
আমরা চারজনই নীরব। এরই মধ্যে প্রায় পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। অথচ ওরা তখনও আসেনি।
আমি ভাবতে বসি, ওরা এত দেরি করছে কেন?
আনিস ভাইকে কেমন অসহায় লাগছিল। কমল বেশ বিব্রত। নিতুপা’র বর মিজান ভাই এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিলেন। তার চকচকে টাকের পেছনের কয়েকটা চুল এলোমেলোভাবে ঝুলছিল। খাটো মানুষ, মোটা চেহারা, মিজান ভাইকে দেখা যাচ্ছিল অদ্ভুত।
কমল আমার দিকে তাকায়। মুখটা একটু নড়ে। মনে হয়, কিছু জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করে না।
একটা কাক আমাদের পেছন ছোঁয়া ভাস্কর্য তিনটার মধ্যে একটার মাথায় বসে। বিরক্তির কা-কা-কঁ-কঁ রব। কিন্তু আমরা কেউ এটাকে তাড়াবার তাগিদ অনুভব করিনি। একজোড়া ছেলেমেয়ে আমাদের সামনে দিয়ে একে অপরের হাত ধরে মল চত্বরের দিকে এগিয়ে যায়।
আমরা স্বভাবতই আশা করেছিলাম আনিস ভাইয়ের দর্শনে পাত্রী ও পাত্রীর বড় বোনজামাই সময়ের একটু আগেই চলে আসবে। রাজপুত্রকে দেখা, কম কথা! সেজন্য সময়ের একটু আগে আমরাও চলে এসেছিলাম। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যখন পাঁচটা পেরিয়ে প্রায় সোয়া পাঁচটার ঘরে, আমি নিজে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যাই। বিশেষ করে রাজপুত্র আনিস ভাইয়ের জন্যই আমার অস্বস্তিবোধ বেশি লাগে।
কমল ভাঙা গলায় বলে, ‘ওদের এত দেরি?’
আনিস ভাই কমল হয়ে আমার দিকে তাকান।
মিজান ভাই বলেন, ‘আমারও তো একই কথা’।
কমল বলে, ‘ওরা মনে হয় আসবে না’।
আমি আশ্বস্ত করার জন্য বলি, ‘এখনও তো বেলা পড়তে অনেক সময় বাকি। আরও কিছুক্ষণ দেখা যাক না’।
কমল বলে, ‘সেটাই’।
মিজান ভাই টাক মাথা নেড়ে বিরক্তিতে কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখনই দেবদূতের মতো এক লোক এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়।
আনিস ভাই চোখ বড় করে তাকান।
মিজান ভাই রাগী গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘কী ব্যাপার, এত দেরি কেন?’
কমল বিরক্তির গলায় বলে, ‘আপনারা...!’
মিজান ভাই জিজ্ঞেস করেন, ‘মেয়ে কোথায়?’
আমি বুঝতে পারি, লোকটা ঘটক।
ঘটক সামলিয়ে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আসছে। ঐ তো’।
আমরা সবাই দৃষ্টিটা তুলে ক্যাম্পাসের দক্ষিণে তাকাই। দেখি, একটা খালি রিকশার সামনে এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আরেকটা রিকশা থেকে একটা মেয়ে ও একজন মধ্যবয়স্ক লোক নামছে।
আমরা উঠে দাঁড়াই।
ওরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসে।
মিজান ভাই খানিকটা এগিয়ে যান। সঙ্গে ঘটক।
আমি ও কমল পেছনে পেছনে যাই।
আনিস ভাই যথাস্থানেই বসে থাকেন।
চার.
মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে সবুজ সেলোয়ার কামিজ। ওড়নাটাও সবুজ। মাঝারি গড়ন। ক্লিপে আটকে সাধারণভাবে ছেড়ে দেওয়া চুল। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙ। রীতিমতো সুন্দরী।
আমি মেয়ের বাবার দিকে তাকাই।
মেয়ের বাবাকে দেখতে কেমন একটা অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোকের এই অসহায় ভাবটা যেন মেয়েকে পাত্রস্থ করা নিয়ে। কিন্তু এমন একটা মেয়ের তো পাত্রের অভাব হওয়ার কথা নয়? তবে কি আনিস ভাইয়ের মতো এমন রাজপুত্র মেলা ভার?
আমি মেয়ের বাবাকে দেখতে দেখতে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দৃষ্টি ফেলি। সত্যি গোবেচারা ধরনের তিনি। পরনে সাধারণ পায়জামা-পাঞ্জাবি। কিন্তু পায়জামা-পাঞ্জাবির মধ্যে এমন চাপ দিয়ে ইস্ত্রি করা হয়েছে যে, মনে হচ্ছে একটু টান পড়লেই কাপড়টা ফেটে যাবে। পায়ে পরেছেন মোটা তলির বাটার চামড়ার সেন্ডেল। তিনি থেমে থেমে হাসছেন। অত্যন্ত করুণ আবেগমিশ্রিত গলায় কথা বলেছেন।
মিজান ভাই কেমন বিতৃষ্ণার দৃষ্টি নিয়ে মেয়ের বাবার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছিল, মেয়ের বাবাকে তার পছন্দ হয়নি।
ঘটক জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় বসবেন?’
কমল বলে, ‘ওখানটায় বসি, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে?’
মেয়ের দুলাভাই ঘাড় নেড়ে সায় দেন।
মেয়ের বাবা বিষণœ হেসে বিব্রত ভঙ্গিতে বিদায় নেন। যেতে যেতে বলে যান, ঘণ্টা খানেক পর তিনি ফিরে আসবেন। ঘটকও মেয়ের বাবার সঙ্গে চলে যায়। আমি মনে মনে বলি, এখানে মেয়ের বাবার আসার কী দরকার ছিল?
মেয়েটা তার বাবাকে দেখতে দেখতে কমল ও আমার দিকে একবার তাকায়। এক ঝলক। আমি অবাক হয়ে দেখি, মেয়েটার চোখ দুটো আশ্চর্য সুন্দর!
আমরা ধীর পায়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এসে বসি। আমরা বসি অর্ধ-বৃত্তাকারে, উপর-নিচ হয়ে। সবাই নীরব। বিকেলটা হেলে পড়েছিল। সূর্যের কাঁচাসোনা রোদ। প্রকৃতির বিশুদ্ধ প্রশান্তি। ঝিরঝির বাতাস। ঝরা পাতার উপর হাঁটাচলার মর্মর শব্দ। ক্যাম্পাসের বৈকালিক জুটির আনাগোনা। সবার মধ্যে চাহনির ভাঙন। দৃষ্টির নিস্পৃহতাও।
মিজান ভাই প্রথম মুখ খোলেন। রাজনীতির প্রসঙ্গ। সেই প্রসঙ্গ ছাপিয়ে ঢাকা শহরের যানজট। এর পরই আসল প্রসঙ্গের দিকে কথার মোড় নেয়।
মিজান ভাই মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার নাম কী?’
প্রথম আলাপেই মেয়েটির প্রতি মিজান ভাইয়ের ‘তুমি’ সম্বোধন আমার কাছে অসৌজন্য মনে হয়। মেয়েটি এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার চোখ তোলে। সবার চোখে তাকিয়ে আনিস ভাইয়ের দিকে এক ঝলক তাকায়। তারপর মিজান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খানিকটা জড়তার সঙ্গে বলে, পূষন।
আমি বলি, ‘পূষন! বেশ সুন্দর নাম তো!’
মেয়েটা আমার দিকে তাকায়। ছোট্ট ও মিষ্টি করে হাসে।
কমল আমার কথায় সায় দিয়ে বলে, ‘আসলেই আপনার নামটা সুন্দর’।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার নামের অর্থ জানেন?’
মেয়েটা বলে, ‘জি, জানি। সূর্য’।
‘সূর্য, বাহ!’ -কমল হাসে।
আমি বলি, ‘শুধু সূর্য নয়, সূর্য পূজার ঘট। সূর্যের সহচরও বলতে পারেন’।
মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়।
আমি আরেকটু পা-িত্য দেখানোর জন্য বলি, ‘শুধু সূর্য পূজার ঘট বা সূর্যের সহচর নয়, আরেক অর্থে বৈদিক দেবতা। আদিত্য’।
মিজান ভাই আমাদের কথার মাঝখানে থামিয়ে দেন। বলেন, ‘এসব কথাবার্তায় শুধু শুধু সময় নষ্ট করছ কেন? আমাকে প্রশ্ন করতে দাও’।
আমি খানিকটা বিব্রত হই, কিন্তু কিছু বলি না।
মিজান ভাই মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমাদের ভাইবোন কয়জন?’
মেয়ের হয়ে মেয়ের দুলাভাই মিজান ভাইয়ের প্রশ্নের জবাব দেন, ‘ওরা চার ভাই তিন বোন। পূষন বোনদের মধ্যে মেজ।
‘ওরা কে কোথায়?’- মিজান ভাইয়ের গম্ভীর গলা।
মেয়ের দুলাভাই বলেন, ‘পূষন ইডেনে পড়ে। বড়জন তো আমার কাছেই। ছোটজন এবার আইএ পড়েছে। পূষনের বড় ভাই এমএ পাস করে একটা প্রাইভেট ফার্মে আছে। মেজভাই এবার মাস্টার্স দেবে, চিটাগাঙ ইউনিভার্সিটিতে, ম্যানেজমেন্টে। আর ছোটভাই দুটো স্কুলে পড়ে।
‘কোন সাবজেক্ট পড় তুমি?’ -মিজান ভাইয়ের আগের মতোই গম্ভীর গলা।
‘বাংলা সাহিত্যে’।-পূষনের ছোট্ট উত্তর।
‘কোন ইয়ারে?’
‘অনার্স ফাইনাল ইয়ারে’।
কমল হাসে। আমাকে দেখিয়ে বলে, ‘আরে, আমার এই বন্ধুও তো বাংলা সাহিত্যে পড়ে। এবার মাস্টার্স দিবে’।
আমি হাসি। কিছু বলি না।
পূষনও মৃদু হাসে।
কমল জিজ্ঞেস করে, ‘বাংলা সাহিত্যে পড়েন, অনেকেই তো বাংলা সাহিত্যে পড়ে লেখালেখি করে। আপনার কি লেখালেখির হাত আছে?’
পূষন কিছুটা লজ্জা পাওয়ার মতো জড়িয়ে গিয়ে বলে, ‘জি’।
‘কী লিখেন, গল্প নাকি কবিতা?’
‘কবিতা’।
‘বাহ, চমৎকার তো, আপনি কবি!’
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কি পূষন নামেই লিখেন?’
‘জি, পূষন শাহনাজ’।
‘পূষন শাহনাজ...!’ -আমি একটু স্মৃতি হাতড়ে জিজ্ঞেস করি, আপনার নামটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। আপনার কবিতা কোথাও পড়েছি। আচ্ছা, গতমাসের রক্তপলাশে কি আপনার কবিতা ছাপা হয়েছে?’
পূষন বলল, ‘জি’।
‘বৃষ্টির গল্প’, তাই না?’
‘জি, আপনি ঠিকই বলেছেন’।
‘কবিতাটি দারুণ ছিল। আচ্ছা, কবিতাটির নাম ‘বৃষ্টির গল্প’ না দিয়ে ‘বৃষ্টির কবিতা’ তো দিতে পারতেন’।
‘আসলে কবিতারটির নাম ‘বৃষ্টির কবিতা’ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন কবিতাটি লিখি, তখন বাইরে ছন্দহীন গল্পের মতো বৃষ্টি পড়ছিল। তাই কবিতাটির নাম ‘বৃষ্টির গল্প’ দিয়েছি’।
আমি মুগ্ধ হওয়ার গলায় বলি, ‘বাহ, বেশ!’
কমল বলে, ‘ও হ্যাঁ, জাহিদ তো ভালো গল্প লেখে। সব কয়টা জাতীয় পত্রিকাতেই তার গল্প ছাপা হয়। এমনকি ঈদ সংখ্যাগুলোতেও তার গল্প চেয়ে নেয়। কত ভক্ত তার!’
আমি চোখ বড় করে কমলের দিকে তাকাই।
কমল দুষ্টামির হাসি হাসে, হি-হি, হি-হি।
মেয়ের দুলাভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী নামে লেখালেখি করেন?’
আমি বলি, ‘জাহিদ আলম’।
মেয়ের দুলাভাই বলেন, ‘তাই! মনে হয় এই নামে তো পত্রিকায় লেখা দেখেছি। আসলে গল্প তেমন পড়া হয় না আমার। পূষনের কারণে তার দু-একটা কবিতা পড়া হয়। কলেজে পদার্থ পড়াই, বোঝেনই তো!’
আমি এমনি হাসি।
মেয়েটা হঠাৎ বিস্ময়ের দৃষ্টি ঢেলে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি জাহিদ আলম?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ, কেন?’
‘আপনারও তো একটা গল্প ছিল গত মাসের মাসিক রক্তপলাশে। নামটা খুব সম্ভব ‘উত্তর দুয়ারি’!
আমি লজ্জা পাওয়ার মতো হেসে বলি, ‘হ্যাঁ’।
‘গল্পটা আমি পড়েছি’।
‘তাই?’
‘জি, বেশ চমৎকার একটা গল্প। তবে এক জায়গায় আপনি ইদ্দৎ ও হিল্লে বিষয়টা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন’।
‘তাই নাকি?’
‘জি। আর এই ভুলটা ধরিয়ে দেয়ার জন্য আমি মাসিক রক্তপলাশের সম্পাদকের অফিসে আপনার নামে একটা চিঠি পাঠিয়ে ছিলাম। পেয়েছেন?’
আমি অবাক হয়ে বলি, ‘চিঠি, না তো!’
মেয়ের দুলাভাই বলেন, ‘আজকাল ডাক বিভাগ আর ডাক পিয়নের কোনো গ্যারান্টি আছে? ওরা চিঠিপত্র বিলি না করে পুড়িয়ে ফেলে।
কমল সায় দেয়।
আমি পূষন শাহনাজের দিকে তাকাই। এ মুহূর্তে তার মধ্যে সেই আড়ষ্টতা নেই।
মিজান ভাই বিরক্তির গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কী সব আলাপ করছ? এখন কি এসব আলাপের সময়?
আমি মিজান ভাইয়ের কথার জবাব দিই না।
পূষনও কেমন চুপ হয়ে যায়।
ওদিকে আনিস ভাই প্রথম থেকেই একদম চুপচাপ ছিলেন। তখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি। আসলে এহেন পরিস্থিতিতে রাজপুত্রের কোনো কথা বলা মানায় না যে!
বিকেলটা ততক্ষণে পড়ে এসেছিল। দিনান্তের দৃঢ় টান, পশ্চিম ক্রমাগত এগিয়ে আসছিল। চারদিকে তাল হারানো নিঃশ্বাস- সড় সড়, সড় সড়। আমি অবাক হয়ে দেখি, কোনো একটা কবিতার মতোই পড়ন্ত বিকেলের এক চিলতে রোদ এসে পূষনের চেহারা ও তার অপূর্ব সুন্দর চোখে পড়েছে।
পাঁচ
মাস খানেক সময় নিলেও শেষ পর্যন্ত রাজপুত্রের কনে পছন্দ হয়। কনেটি অপরাজেয় বাংলার সেই মুখ, সেই সবুজ সুন্দরীটি। যার অপূর্ব সুন্দর চোখ সূর্য-দৃষ্টিকে হার মানায়। মেয়েটি পূষন।
সেই থেকে আবার ঘটক, ঘটকের যোগসূত্র। সেই সূত্র ধরেই একদিন রাজপুত্রের বাবা, রাজপুত্রের বড়ভাই, রাজপুত্রের দুলাভাই ও আমার বাবা কনে দর্শনে যান। এবার মুরুব্বিদের পালা। ওরা সব কথা পাকাপাকি করে আসবেন। এমনকি বিয়ের দিন তারিখও।
সেই থেকে রাজপুত্রের রাজনয়ন বর্ষণের ভেতর।
সেদিন ছিল শ্রাবণের প্রথম দিন। বৃষ্টিটা ভোর থেকেই শুরু হয়েছিল। ক্রমাগত বৃষ্টি। কখনও বাড়ছিল, কখনও কমছিল। কিন্তু থামার কোনো লক্ষণ ছিল না।
আমার দৃষ্টিও ছিল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ভেতর। আমার ভেতর পূষনকে নিয়ে বৃষ্টির গল্প। বারবার আমার মনে হচ্ছিল, আহা, সেদিনের মতো যদি আজ সূর্যেরপ্রহর মেঘের পাহারায় না থাকত?
সংশয় ও চাপা যন্ত্রণায় বৃষ্টির কান্না দেখতে দেখতে কখন যে বেলা হননে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছিল, খেয়ালই করিনি। পূষনকে দেখতে যাওয়া সেই মুরুব্বিরা বৃষ্টির দেহ গলে তখনই ফিরে আসেন। তাঁদের সবার কালো মুখ। এসেই বলেন, ‘নাহ, হলো না’।
আমি স্পষ্ট শুনতে পাই, পূষনের নাকি আনিস ভাইকে পছন্দ হয়নি। সত্যিই অবাক হই, এমন রাজপুত্রকে পূষনের পছন্দ হলো না! তাহলে?
আমি আনন্দে চমকে উঠি। আর তখনই আকাশের ভাঙন থেমে যায়। চারিদিকে মরা কটালের টান ও অল্পবিস্তর থেমে থাকা সময়। তারপরই মেঘের খোলস ভেঙে সূর্যটা বেরিয়ে আসে। আহা সেই পূষন, সূর্যের সহচর। আদিত্য পুরুষের সূর্য পূজার ঘটও বলা যায়!
কবি পূষন শাহনাজের কবিতায় ‘বৃষ্টির গল্প’ এমন করেই তো বলা ছিল...!
মহিবুল আলম
শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে সাধারণত গ্রীষ্মকালে খুব একটা বৃষ্টি হয় না, শীতকালে হয়। কিন্তু আজ হলো। ঝুম বৃষ্টি। গোল্ড কোস্ট শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নিরাং নদীর ডকে বসে আজ পূষনের সঙ্গে গ্রীষ্মের বৃষ্টিতে খুব করে ভিজলাম। ভিজতে ভিজতে আমার তিন দশক আগের একটি গল্পটি মনে পড়ে গেল। গল্পটি পূষনের। তবে গল্পে পূষনকে ছাপিয়ে সেদিন আনিস ভাইয়াই প্রধান হয়ে উঠেছিলেন।
বন্ধুরা, তাহলে গল্পটি এবার শুরু থেকেই বলি।
হ্যাঁ, সত্যি তাই, আনিস ভাই সেই ত্রিশ বছর আগে একদিন একটা খামে ভরা চিঠি খুলে সত্যি রাজপুত্র হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি ছিলেন নিতান্ত সাধারণ একটা ছেলে। তালি দেওয়া চপ্পলের তল ঘষে ঘষে মহল্লার এপাশ-ওপাশ ঘুরতেন। ছাত্র পড়াতেন। পায়ে হেঁটে সারুলিয়া থেকে ডেমরার বাসস্ট্যান্ডে যেতেন। বাদুরঝোলা হয়ে এই শহরতলি থেকে শহরে গিয়ে চাকুরিপাড়ার অলিগলি চষে বেড়াতেন। চাকুরির বয়স শেষধাপে, এক ধরনের হতাশা তার গায়ে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিল। এমনটা মনে হয়েছিল, বাকি জীবনটা তার মানুষের বাসার কড়া নেড়েই কাটিয়ে দিতে হবে। মহল্লার মানুষও তাই ভেবে নিয়েছিল।
পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও আনিস ভাইয়ের একটা অনাকাক্সিক্ষত দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। রফিক ভাই একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। এক মাস বেতন পান তো, তিন মাস তার বেতনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না। তারপরও সেখানে চাকরি করছেন কোথাও আর চাকরি পাচ্ছেন না বলে। কমল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তাদের ছোটবোন রুমিন তো পরিবারে খেটেই মরে। মা বিছানায়। তাদের বাবা আজমল কাকা অবসরে। সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ড্রাফটসম্যানের চাকরি করতেন। উপড়ি ছিল না কখনই। টেনেটুনে সংসার চালাতেন।
আনিস ভাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়েন, তখনই আজমল কাকা অবসরে যান। আনিস ভাইয়ের ওপর ভরসা করেছিলেন যে, পাস করে ছেলেটার চাকরি হবে, সংসারে সচ্ছলতা আসবে। কিন্তু চাকরির বয়সসীমা যখন শেষধাপে, কোথাও চাকরি হচ্ছিল না, তখন আজমল কাকা ভেতরে-বাইরে ফুঁসে ওঠেন, যেন আনিস ভাই ইচ্ছে করেই চাকরি নিচ্ছিলেন না।
আর ঠিক তখনই বিধাতা যেন আনিস ভাইয়ের দুঃখে উদ্বেলিত হয়ে আড়ালে হাসেন। তারপর তার ওপর এমন বর দেন, রাতারাতি তিনি হয়ে ওঠেন রাজপুত্র। কমপক্ষে সমাজ ও কালের এহেন পরিস্থিতিতে চরম শত্রুও স্বীকার করবে, হ্যাঁ, রাজপুত্রই তো বটে।
কিন্তু আনিস ভাই হঠাৎ করে রাজপুত্র হয়ে কেমন পরিবর্তন হয়ে যান। কথাবার্তা ও ভাবভঙ্গিমায়, এমনকি হাঁটাচলাও। সর্বোপরি তিনি একজন বিসিএস ক্যাডার, সহকারি পুলিশ কমিশনার। ট্রেনিং শেষে পাশের জেলায় এসে যোগ দিয়েছেন। কয়েকটা থানা তার অধীনে। তিনি যখন গাড়ি নিয়ে সারুলিয়াতে আসেন, শহরতলির এই রাস্তা দিয়ে গটগট করে হেঁটে যান, তখন মহল্লার সবাই কেমন সমীহই করে।
সমীহ শুধু আনিস ভাইকেই করে না, তার বাবা আজমল কাকাকেও মহল্লায় এখন বাড়তি সম্মান দেয়। দোকানে মজলিশে চেয়ারটা বাড়িয়ে দেয়। রফিক ভাই ও কমল এখন রাজপুত্রের গর্বিত ভাই। রুমিন চুলা ঠ্যালার চিরায়ত ভূমিকায় পড়ে রইলেও তার মধ্যেও একটা পরিবর্তন এসেছে। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে কমল ও আনিস ভাইয়ের বড় বোনজামাই মিজান ভাইয়ের মধ্যে। নিতু’পার বর মিজান ভাই শুধু লাফাচ্ছেন আর লাফাচ্ছেন। আর আমি তো তাদেরই প্রতিবেশী।
দুই
সারুলিয়ার এই দিকটায় মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত বা বড়জোর মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক বাস করে। সমাজ বিচারে তারা গড়েও উঠেছে সেরকমভাবে। এরই মধ্যে দুই-চারজন ভালো মানুষ ঢুকে নিতান্তই বেকায়দায় পড়ে গেছে। তারা না পারছে এদের সঙ্গে মিশতে, না পারছে এদেরকে ছেড়ে যেতে।
রাজধানীর কাছাকাছি হয়েও শহরতলিতে এখনও সেই গ্রামের আচার-ব্যবস্থা রয়ে গেছে। সবাই সব ঘরের হাঁড়ির খবর রাখে। অনেক ছোট ঘটনা নিয়ে তোলপাড় করে, আবার অনেক বড় ঘটনা অনায়াসে ঢেকে দেয়। ব্যাপারটা তেমন কোনো গুরুত্ব বহন না করলেও আনিস ভাই সত্যি আজকাল আলোচনায় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সুন্দরী কন্যার পিতা কিংবা মাঝারি মানের কন্যার পয়সাওয়ালা বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসছেন। ঘটকও ভিড় জমিয়েছে দু’চারজন। কিন্তু আনিস ভাই মাথা নাড়ছেন। তিনি আরও দেখবেন, আরও যাচাই করবেন, এরই মধ্যে রাজকন্যাকে খুঁজে নিবেন।
ওদিকে প্রতিটা কন্যাপক্ষও এ ব্যাপারে বেশ উৎসাহী। এমন একজন রাজপুত্র! তাই আনিস ভাইয়ের পাত্রী বেছে নিতে অসুবিধা কি? রাজপুত্রের জন্য রাজকন্যা না হলে কি মানায়? তাই রাজপুত্রের বাবা-মা, ভাইবোন সবাই রাজপুত্রের পাত্রী পছন্দ করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমিও তাদের প্রতিবেশী হিসেবে একই ব্যস্ততায় ভুগছি।
আমাদের বাসা ও কমলদের বাসা খুব কাছাকাছি। মাঝখানে ইট-সুড়কির সরুপথ, অতি সামান্য ঘাসের দৃষ্টি, তারপরই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুই পরিবারের অর্ধ-সমাপ্ত দালান। একই রঙের ফটক। সবুজ রঙ। এই সবুজ রঙের ফটকের মুখোমুখি সম্পর্কটার মতোই আমাদের দুই পরিবারের প্রতিটা মানুষের সম্পর্ক। বন্ধন নেই, তবুও বিরাট বন্ধন। মাঝেমধ্যে সম্পর্কের ওঠানামা, একটু আলোড়ন, তারপরই আবার সময়টা এক হয়ে যায় নির্দিষ্ট ধারায় ও নির্দিষ্ট নিয়মে। আর এদিকে কমল ও আমি? সেতো বলারই অপেক্ষা রাখে না। এক সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। এক সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কমল ভূগোল বিষয়ে আর আমি বাংলা সাহিত্যে।
ঘনিষ্ঠ পড়শি হিসেবে হোক আর কমলের বন্ধু হিসেবেই হোক, আনিস ভাইয়ের জন্য এ পর্যন্ত যতগুলো পাত্রীর মুখ দেখা হয়েছে, প্রায় প্রতিটা পাত্রীর মুখদর্শন অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আশ্চর্য ব্যাপার, এমন উত্তর-আধুনিক সময়কালে আমরা এখনও সেই ঊষাকালের গন্ধ পাই। এখনও একটা মেয়েকে পণ্য হিসেবে দেখি। যেন মেয়েরা মানুষ নয়, প্রাণময় সুদর্শন বস্তু, রূপের সওদা হয়। স্পষ্ট দৃশ্যমান একটা মেয়ের জড়সড় চেহারা। ঘোমটা উগলে মুখ দেখা। ছোটখাটো প্রশ্ন করা। হাত টিপে দেখা। একটু হাঁটতে বলা। চুল দেখা। পায়ের গোড়ালি দেখা...! তারপর পাঁচশো এক টাকা দেওয়া। কোথাও কোথাও সালামির টাকা না দিয়েই চলে আসা। মেয়ে নিখুঁত হলেও বাসায় এসে কথা উঠবে, ‘আরে মেয়ের খড়ম-পা। দেখেছিস, মেয়ের নাকের নথটা কেমন বাঁকা...?’
জানালা গলে কমলকে দেখি, আমাদের বাসার গেট ঠেলে সে ঢুকছে। ওদিকে বিকেলটা বাইরে কোথাও যেন থেমে রয়েছে। আমি আমার পড়ার রুমে। বেশ কিছু মশা উড়ছে এদিক-ওদিক। দু’একটা মশা বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকছে। রুমের ভেতর খানিকটা আবছা অন্ধকার।
কমল আমার রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে, অন্ধকারে বসে আছিস কেন? কবিতার ভাব আনছিস নাকি?’
আমি হাসি।
কমল নিজ থেকেই রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে বলে, ‘দেখছিস, কী পরিমাণ মশা তোর রুমে ঢুকেছে? জানালা বন্ধ কর’।
আমি নড়ি না।
কমল বসা থেকে উঠে গিয়ে জানালা টেনে বন্ধ করে। আবার চেয়ারে বসতে বসতে বলে, ‘শোন, কাল বিকালে একটা মেয়ে দেখতে যাব’।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কোথায়?’
‘আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে’।
‘অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ মানে?’
কমল রহস্যের হাসি হাসে। বলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে। আগামীকাল বিকেল সাড়ে চারটায় কনের বোনজামাই কনেকে নিয়ে অপরাজের বাংলার পাদদেশে আসবে। আনিস ভাই, মিজান ভাই, তুই ও আমি সেখানে থাকব’।
আমি বলি, ‘রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখা, কেমন বেখাপ্পা ঠেকছে না?’
কমল আবার হাসে। বলে, ‘তুই কোন দুনিয়াতে আছিস?’
‘কেন কী হয়েছে?’
‘আজকাল তো রাস্তাঘাটে, কলেজ-ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে, শপিংমলেই মেয়ে দেখাদেখি বেশি হয়। এভাবে মেয়ে দেখাটাই ভালো। মেয়ে দেখে আমাদের আর টাকা দিতে হবে না। আর মেয়েপক্ষও খরচ থেকে বেঁচে যাবে। এদেরকেও তো আমাদের উপলক্ষে ছোটখাটো একটা আয়োজন করতে হয়’।
আমি মাথা ঝাঁকাই। এমনিই। বিড়বিড় করে বলি, ‘তা হয়। সেটা জানি। কিন্তু আনিস ভাইয়ের মতো এমন একজন রাজপুত্রের জন্য এভাবে মেয়ে দেখা...!’
কমল বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বললি? বুঝতে পারলাম না’।
আমি হেসে বলি, ‘না, তেমন কিছু না’।
তিন
সেদিনের বিকেলটা বেশ জীবন্ত ছিল। নরম রোদের মধ্যে সূর্যের কোনো অস্থিরতা ছিল না। দিঘল বৃক্ষছায়া। টুং টাং রিকশার শব্দ। গ্রীষ্মের প্রায় শেষ। এক ধরনের সন্ধি বর্ষাঋতুর সঙ্গে। কিছুটা নরম হাওয়া, কিছুটা নরম রোদ।
যদিও বিকেল ছিল, কিন্তু দুপুরের আক্রান্তিটা রয়ে গিয়েছিল স্পষ্ট সূর্যের মধ্যে। আর ছিল বৈকালিক ক্লাসের মৃদু কোলাহল ও গুঞ্জন ছড়িয়ে এক এক করে ছাত্র-ছাত্রীরা চলে যাওয়া।
আমরা চারজনই নীরব। এরই মধ্যে প্রায় পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। অথচ ওরা তখনও আসেনি।
আমি ভাবতে বসি, ওরা এত দেরি করছে কেন?
আনিস ভাইকে কেমন অসহায় লাগছিল। কমল বেশ বিব্রত। নিতুপা’র বর মিজান ভাই এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিলেন। তার চকচকে টাকের পেছনের কয়েকটা চুল এলোমেলোভাবে ঝুলছিল। খাটো মানুষ, মোটা চেহারা, মিজান ভাইকে দেখা যাচ্ছিল অদ্ভুত।
কমল আমার দিকে তাকায়। মুখটা একটু নড়ে। মনে হয়, কিছু জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করে না।
একটা কাক আমাদের পেছন ছোঁয়া ভাস্কর্য তিনটার মধ্যে একটার মাথায় বসে। বিরক্তির কা-কা-কঁ-কঁ রব। কিন্তু আমরা কেউ এটাকে তাড়াবার তাগিদ অনুভব করিনি। একজোড়া ছেলেমেয়ে আমাদের সামনে দিয়ে একে অপরের হাত ধরে মল চত্বরের দিকে এগিয়ে যায়।
আমরা স্বভাবতই আশা করেছিলাম আনিস ভাইয়ের দর্শনে পাত্রী ও পাত্রীর বড় বোনজামাই সময়ের একটু আগেই চলে আসবে। রাজপুত্রকে দেখা, কম কথা! সেজন্য সময়ের একটু আগে আমরাও চলে এসেছিলাম। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যখন পাঁচটা পেরিয়ে প্রায় সোয়া পাঁচটার ঘরে, আমি নিজে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যাই। বিশেষ করে রাজপুত্র আনিস ভাইয়ের জন্যই আমার অস্বস্তিবোধ বেশি লাগে।
কমল ভাঙা গলায় বলে, ‘ওদের এত দেরি?’
আনিস ভাই কমল হয়ে আমার দিকে তাকান।
মিজান ভাই বলেন, ‘আমারও তো একই কথা’।
কমল বলে, ‘ওরা মনে হয় আসবে না’।
আমি আশ্বস্ত করার জন্য বলি, ‘এখনও তো বেলা পড়তে অনেক সময় বাকি। আরও কিছুক্ষণ দেখা যাক না’।
কমল বলে, ‘সেটাই’।
মিজান ভাই টাক মাথা নেড়ে বিরক্তিতে কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখনই দেবদূতের মতো এক লোক এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়।
আনিস ভাই চোখ বড় করে তাকান।
মিজান ভাই রাগী গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘কী ব্যাপার, এত দেরি কেন?’
কমল বিরক্তির গলায় বলে, ‘আপনারা...!’
মিজান ভাই জিজ্ঞেস করেন, ‘মেয়ে কোথায়?’
আমি বুঝতে পারি, লোকটা ঘটক।
ঘটক সামলিয়ে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আসছে। ঐ তো’।
আমরা সবাই দৃষ্টিটা তুলে ক্যাম্পাসের দক্ষিণে তাকাই। দেখি, একটা খালি রিকশার সামনে এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আরেকটা রিকশা থেকে একটা মেয়ে ও একজন মধ্যবয়স্ক লোক নামছে।
আমরা উঠে দাঁড়াই।
ওরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসে।
মিজান ভাই খানিকটা এগিয়ে যান। সঙ্গে ঘটক।
আমি ও কমল পেছনে পেছনে যাই।
আনিস ভাই যথাস্থানেই বসে থাকেন।
চার.
মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে সবুজ সেলোয়ার কামিজ। ওড়নাটাও সবুজ। মাঝারি গড়ন। ক্লিপে আটকে সাধারণভাবে ছেড়ে দেওয়া চুল। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙ। রীতিমতো সুন্দরী।
আমি মেয়ের বাবার দিকে তাকাই।
মেয়ের বাবাকে দেখতে কেমন একটা অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোকের এই অসহায় ভাবটা যেন মেয়েকে পাত্রস্থ করা নিয়ে। কিন্তু এমন একটা মেয়ের তো পাত্রের অভাব হওয়ার কথা নয়? তবে কি আনিস ভাইয়ের মতো এমন রাজপুত্র মেলা ভার?
আমি মেয়ের বাবাকে দেখতে দেখতে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দৃষ্টি ফেলি। সত্যি গোবেচারা ধরনের তিনি। পরনে সাধারণ পায়জামা-পাঞ্জাবি। কিন্তু পায়জামা-পাঞ্জাবির মধ্যে এমন চাপ দিয়ে ইস্ত্রি করা হয়েছে যে, মনে হচ্ছে একটু টান পড়লেই কাপড়টা ফেটে যাবে। পায়ে পরেছেন মোটা তলির বাটার চামড়ার সেন্ডেল। তিনি থেমে থেমে হাসছেন। অত্যন্ত করুণ আবেগমিশ্রিত গলায় কথা বলেছেন।
মিজান ভাই কেমন বিতৃষ্ণার দৃষ্টি নিয়ে মেয়ের বাবার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছিল, মেয়ের বাবাকে তার পছন্দ হয়নি।
ঘটক জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় বসবেন?’
কমল বলে, ‘ওখানটায় বসি, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে?’
মেয়ের দুলাভাই ঘাড় নেড়ে সায় দেন।
মেয়ের বাবা বিষণœ হেসে বিব্রত ভঙ্গিতে বিদায় নেন। যেতে যেতে বলে যান, ঘণ্টা খানেক পর তিনি ফিরে আসবেন। ঘটকও মেয়ের বাবার সঙ্গে চলে যায়। আমি মনে মনে বলি, এখানে মেয়ের বাবার আসার কী দরকার ছিল?
মেয়েটা তার বাবাকে দেখতে দেখতে কমল ও আমার দিকে একবার তাকায়। এক ঝলক। আমি অবাক হয়ে দেখি, মেয়েটার চোখ দুটো আশ্চর্য সুন্দর!
আমরা ধীর পায়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এসে বসি। আমরা বসি অর্ধ-বৃত্তাকারে, উপর-নিচ হয়ে। সবাই নীরব। বিকেলটা হেলে পড়েছিল। সূর্যের কাঁচাসোনা রোদ। প্রকৃতির বিশুদ্ধ প্রশান্তি। ঝিরঝির বাতাস। ঝরা পাতার উপর হাঁটাচলার মর্মর শব্দ। ক্যাম্পাসের বৈকালিক জুটির আনাগোনা। সবার মধ্যে চাহনির ভাঙন। দৃষ্টির নিস্পৃহতাও।
মিজান ভাই প্রথম মুখ খোলেন। রাজনীতির প্রসঙ্গ। সেই প্রসঙ্গ ছাপিয়ে ঢাকা শহরের যানজট। এর পরই আসল প্রসঙ্গের দিকে কথার মোড় নেয়।
মিজান ভাই মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার নাম কী?’
প্রথম আলাপেই মেয়েটির প্রতি মিজান ভাইয়ের ‘তুমি’ সম্বোধন আমার কাছে অসৌজন্য মনে হয়। মেয়েটি এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার চোখ তোলে। সবার চোখে তাকিয়ে আনিস ভাইয়ের দিকে এক ঝলক তাকায়। তারপর মিজান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খানিকটা জড়তার সঙ্গে বলে, পূষন।
আমি বলি, ‘পূষন! বেশ সুন্দর নাম তো!’
মেয়েটা আমার দিকে তাকায়। ছোট্ট ও মিষ্টি করে হাসে।
কমল আমার কথায় সায় দিয়ে বলে, ‘আসলেই আপনার নামটা সুন্দর’।
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার নামের অর্থ জানেন?’
মেয়েটা বলে, ‘জি, জানি। সূর্য’।
‘সূর্য, বাহ!’ -কমল হাসে।
আমি বলি, ‘শুধু সূর্য নয়, সূর্য পূজার ঘট। সূর্যের সহচরও বলতে পারেন’।
মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়।
আমি আরেকটু পা-িত্য দেখানোর জন্য বলি, ‘শুধু সূর্য পূজার ঘট বা সূর্যের সহচর নয়, আরেক অর্থে বৈদিক দেবতা। আদিত্য’।
মিজান ভাই আমাদের কথার মাঝখানে থামিয়ে দেন। বলেন, ‘এসব কথাবার্তায় শুধু শুধু সময় নষ্ট করছ কেন? আমাকে প্রশ্ন করতে দাও’।
আমি খানিকটা বিব্রত হই, কিন্তু কিছু বলি না।
মিজান ভাই মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমাদের ভাইবোন কয়জন?’
মেয়ের হয়ে মেয়ের দুলাভাই মিজান ভাইয়ের প্রশ্নের জবাব দেন, ‘ওরা চার ভাই তিন বোন। পূষন বোনদের মধ্যে মেজ।
‘ওরা কে কোথায়?’- মিজান ভাইয়ের গম্ভীর গলা।
মেয়ের দুলাভাই বলেন, ‘পূষন ইডেনে পড়ে। বড়জন তো আমার কাছেই। ছোটজন এবার আইএ পড়েছে। পূষনের বড় ভাই এমএ পাস করে একটা প্রাইভেট ফার্মে আছে। মেজভাই এবার মাস্টার্স দেবে, চিটাগাঙ ইউনিভার্সিটিতে, ম্যানেজমেন্টে। আর ছোটভাই দুটো স্কুলে পড়ে।
‘কোন সাবজেক্ট পড় তুমি?’ -মিজান ভাইয়ের আগের মতোই গম্ভীর গলা।
‘বাংলা সাহিত্যে’।-পূষনের ছোট্ট উত্তর।
‘কোন ইয়ারে?’
‘অনার্স ফাইনাল ইয়ারে’।
কমল হাসে। আমাকে দেখিয়ে বলে, ‘আরে, আমার এই বন্ধুও তো বাংলা সাহিত্যে পড়ে। এবার মাস্টার্স দিবে’।
আমি হাসি। কিছু বলি না।
পূষনও মৃদু হাসে।
কমল জিজ্ঞেস করে, ‘বাংলা সাহিত্যে পড়েন, অনেকেই তো বাংলা সাহিত্যে পড়ে লেখালেখি করে। আপনার কি লেখালেখির হাত আছে?’
পূষন কিছুটা লজ্জা পাওয়ার মতো জড়িয়ে গিয়ে বলে, ‘জি’।
‘কী লিখেন, গল্প নাকি কবিতা?’
‘কবিতা’।
‘বাহ, চমৎকার তো, আপনি কবি!’
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কি পূষন নামেই লিখেন?’
‘জি, পূষন শাহনাজ’।
‘পূষন শাহনাজ...!’ -আমি একটু স্মৃতি হাতড়ে জিজ্ঞেস করি, আপনার নামটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। আপনার কবিতা কোথাও পড়েছি। আচ্ছা, গতমাসের রক্তপলাশে কি আপনার কবিতা ছাপা হয়েছে?’
পূষন বলল, ‘জি’।
‘বৃষ্টির গল্প’, তাই না?’
‘জি, আপনি ঠিকই বলেছেন’।
‘কবিতাটি দারুণ ছিল। আচ্ছা, কবিতাটির নাম ‘বৃষ্টির গল্প’ না দিয়ে ‘বৃষ্টির কবিতা’ তো দিতে পারতেন’।
‘আসলে কবিতারটির নাম ‘বৃষ্টির কবিতা’ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন কবিতাটি লিখি, তখন বাইরে ছন্দহীন গল্পের মতো বৃষ্টি পড়ছিল। তাই কবিতাটির নাম ‘বৃষ্টির গল্প’ দিয়েছি’।
আমি মুগ্ধ হওয়ার গলায় বলি, ‘বাহ, বেশ!’
কমল বলে, ‘ও হ্যাঁ, জাহিদ তো ভালো গল্প লেখে। সব কয়টা জাতীয় পত্রিকাতেই তার গল্প ছাপা হয়। এমনকি ঈদ সংখ্যাগুলোতেও তার গল্প চেয়ে নেয়। কত ভক্ত তার!’
আমি চোখ বড় করে কমলের দিকে তাকাই।
কমল দুষ্টামির হাসি হাসে, হি-হি, হি-হি।
মেয়ের দুলাভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী নামে লেখালেখি করেন?’
আমি বলি, ‘জাহিদ আলম’।
মেয়ের দুলাভাই বলেন, ‘তাই! মনে হয় এই নামে তো পত্রিকায় লেখা দেখেছি। আসলে গল্প তেমন পড়া হয় না আমার। পূষনের কারণে তার দু-একটা কবিতা পড়া হয়। কলেজে পদার্থ পড়াই, বোঝেনই তো!’
আমি এমনি হাসি।
মেয়েটা হঠাৎ বিস্ময়ের দৃষ্টি ঢেলে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি জাহিদ আলম?’
আমি বলি, ‘হ্যাঁ, কেন?’
‘আপনারও তো একটা গল্প ছিল গত মাসের মাসিক রক্তপলাশে। নামটা খুব সম্ভব ‘উত্তর দুয়ারি’!
আমি লজ্জা পাওয়ার মতো হেসে বলি, ‘হ্যাঁ’।
‘গল্পটা আমি পড়েছি’।
‘তাই?’
‘জি, বেশ চমৎকার একটা গল্প। তবে এক জায়গায় আপনি ইদ্দৎ ও হিল্লে বিষয়টা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন’।
‘তাই নাকি?’
‘জি। আর এই ভুলটা ধরিয়ে দেয়ার জন্য আমি মাসিক রক্তপলাশের সম্পাদকের অফিসে আপনার নামে একটা চিঠি পাঠিয়ে ছিলাম। পেয়েছেন?’
আমি অবাক হয়ে বলি, ‘চিঠি, না তো!’
মেয়ের দুলাভাই বলেন, ‘আজকাল ডাক বিভাগ আর ডাক পিয়নের কোনো গ্যারান্টি আছে? ওরা চিঠিপত্র বিলি না করে পুড়িয়ে ফেলে।
কমল সায় দেয়।
আমি পূষন শাহনাজের দিকে তাকাই। এ মুহূর্তে তার মধ্যে সেই আড়ষ্টতা নেই।
মিজান ভাই বিরক্তির গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কী সব আলাপ করছ? এখন কি এসব আলাপের সময়?
আমি মিজান ভাইয়ের কথার জবাব দিই না।
পূষনও কেমন চুপ হয়ে যায়।
ওদিকে আনিস ভাই প্রথম থেকেই একদম চুপচাপ ছিলেন। তখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি। আসলে এহেন পরিস্থিতিতে রাজপুত্রের কোনো কথা বলা মানায় না যে!
বিকেলটা ততক্ষণে পড়ে এসেছিল। দিনান্তের দৃঢ় টান, পশ্চিম ক্রমাগত এগিয়ে আসছিল। চারদিকে তাল হারানো নিঃশ্বাস- সড় সড়, সড় সড়। আমি অবাক হয়ে দেখি, কোনো একটা কবিতার মতোই পড়ন্ত বিকেলের এক চিলতে রোদ এসে পূষনের চেহারা ও তার অপূর্ব সুন্দর চোখে পড়েছে।
পাঁচ
মাস খানেক সময় নিলেও শেষ পর্যন্ত রাজপুত্রের কনে পছন্দ হয়। কনেটি অপরাজেয় বাংলার সেই মুখ, সেই সবুজ সুন্দরীটি। যার অপূর্ব সুন্দর চোখ সূর্য-দৃষ্টিকে হার মানায়। মেয়েটি পূষন।
সেই থেকে আবার ঘটক, ঘটকের যোগসূত্র। সেই সূত্র ধরেই একদিন রাজপুত্রের বাবা, রাজপুত্রের বড়ভাই, রাজপুত্রের দুলাভাই ও আমার বাবা কনে দর্শনে যান। এবার মুরুব্বিদের পালা। ওরা সব কথা পাকাপাকি করে আসবেন। এমনকি বিয়ের দিন তারিখও।
সেই থেকে রাজপুত্রের রাজনয়ন বর্ষণের ভেতর।
সেদিন ছিল শ্রাবণের প্রথম দিন। বৃষ্টিটা ভোর থেকেই শুরু হয়েছিল। ক্রমাগত বৃষ্টি। কখনও বাড়ছিল, কখনও কমছিল। কিন্তু থামার কোনো লক্ষণ ছিল না।
আমার দৃষ্টিও ছিল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ভেতর। আমার ভেতর পূষনকে নিয়ে বৃষ্টির গল্প। বারবার আমার মনে হচ্ছিল, আহা, সেদিনের মতো যদি আজ সূর্যেরপ্রহর মেঘের পাহারায় না থাকত?
সংশয় ও চাপা যন্ত্রণায় বৃষ্টির কান্না দেখতে দেখতে কখন যে বেলা হননে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছিল, খেয়ালই করিনি। পূষনকে দেখতে যাওয়া সেই মুরুব্বিরা বৃষ্টির দেহ গলে তখনই ফিরে আসেন। তাঁদের সবার কালো মুখ। এসেই বলেন, ‘নাহ, হলো না’।
আমি স্পষ্ট শুনতে পাই, পূষনের নাকি আনিস ভাইকে পছন্দ হয়নি। সত্যিই অবাক হই, এমন রাজপুত্রকে পূষনের পছন্দ হলো না! তাহলে?
আমি আনন্দে চমকে উঠি। আর তখনই আকাশের ভাঙন থেমে যায়। চারিদিকে মরা কটালের টান ও অল্পবিস্তর থেমে থাকা সময়। তারপরই মেঘের খোলস ভেঙে সূর্যটা বেরিয়ে আসে। আহা সেই পূষন, সূর্যের সহচর। আদিত্য পুরুষের সূর্য পূজার ঘটও বলা যায়!
কবি পূষন শাহনাজের কবিতায় ‘বৃষ্টির গল্প’ এমন করেই তো বলা ছিল...!