alt

সাময়িকী

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

নুরুন্নাহার মুন্নি

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫

সকাল নয়টা পাঁচ-এর ক্লাস। একানব্বই-বিরানব্বই এর টিএসসি। খোলা ধবধবে আকাশ। সমস্ত আলোর রং, সবুজের উড়াল, ধুলিমাখা নীরব সৌন্দর্য, কয়েকটি গাড়ির আনাগোনা, আর রিকশার টুংটাং বেলের শব্দ শুনতে শুনতে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে শুরু হয় ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের দমদার আর জোশ প্লেয়ার ফিরোজ। ফুটবল আর কেরামে তার দক্ষতা ঈর্ষণীয়। তাকে হারানোর মতো দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুধুমাত্র খেলাধুলা নয়, একজন দক্ষ বিতার্কিকও বটে। সেদিন হঠাৎ করেই সকাল-সকাল ক্লাসে এসে উপস্থিত এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি। মেধা যাচাই প্রশ্নের জবাবে এগিয়ে ফিরোজ, বোর্ড স্কলারশিপ স্টুডেন্ট যাচাই প্রশ্নে এগিয়ে ফিরোজ, ইউনিভার্সিটির বর্ষসেরা বিতার্কিক। ভদ্রলোকের প্রশ্নের এক একটি তীর ফিরোজকে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদ্ধ করতে পারছে না একটিও। হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের এক দুর্দান্ত মেধাবী ফিরোজ, এককথায় অলরাউন্ডার। ইন্টারন্যাশনাল ল নিয়ে তার থিসিস। ইউনিভার্সিটিতে বন্ধু সংখ্যা অগণিত। লাকসামের জুয়েল, কুমিল্লার রেবা, চাঁদপুরের শহীদ, মিন্টু, মতলবের তৌহিদ, মহিউদ্দিন, অরুণ, শামীম কিন্তু মেয়েদের সাথে অতটা নিগূঢ় ঘনিষ্ঠতা নেই। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সেরাদের সেরা ফিরোজ, পাতলা শারীরিক গঠন হলেও শত মেয়ের ক্রাশ। অপূর্ব সুন্দরী রমণীর লোভনীয় আকর্ষণীয় সুডৌল দেহের স্ফুলিঙ্গ তার মন ও মস্তিষ্ক ছুঁতে পারেনি। তার মাথায় ইন্টারন্যাশনাল হিস্ট্রি, আর্টিকেলস মেকিং হিস্ট্রি, এনড্রিও, জে উইলিয়ামস, ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ বুকস, রিসার্চ। ঐদিন ক্লাসে এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি সবার সামনে বলেই দিলেন নিঃসন্দেহে এই ছেলে কোন ল্যাংলিট ফ্যামিলিতে বিলং করে। মেয়েরা জোঁকের মতো একেকজন লেগে থাকে ফিরোজের গা ঘেঁষে অথচ ফিরোজের তাতে কোনো পাত্তা নেই, সবার সাথেই মিশছে বন্ধুর মতো। আমিও চুইনগামের আঠা। কুয়েত মৈত্রী হলে আলোচনার ইস্যু হয়ে ওঠে ফিরোজ। আমার রুমমেট শারমিনের ধ্যান, জ্ঞান সাধনায়, পড়াশোনা নেই শুধু ফিরোজ ভাই। এদিকে রগরগে আবেগের আঁচল বিছিয়ে আমারই কাছে বলে যাচ্ছে কীভাবে ফিরোজকে প্রেম প্রস্তাব দেয়া যায়। মহিউদ্দিন হেল্প করবে বলে শারমিনকে পাঠিয়ে দিলাম মহিউদ্দিনের কাছে। আমার বিষয়টি ফিরোজ না জানলেও মহিউদ্দিন সবটা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফিরোজ বুঝতে পারত কিনা জানি না তবে শারমিনের জরুরি তলব ,পরদিন বিকেলে মহিউদ্দিন আর ফিরোজ কুয়েত মৈত্রী হলে এসে উপস্থিত। ইয়ারমেট সবাই তবুও প্রেমের দরদী কন্ঠ, উতলা মন, সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে মেরিল স্প্রিংলিং শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে ম্যানোলা স্নো মেখে হলের উড়ন্ত হাওয়ায় খিলখিল করছে শারমিন। দেখে আমার গা জ্বলে ধোঁয়া বেরুচ্ছে তবুও কিছু বলতে পারছি না। সরষে হলুদ রঙের শাড়ি আর ম্যাচিং সবুজ ব্লাউজ যদিও ব্লাউজটা ধার দিয়েছিলাম আমিই। খানিকটা সময়ের জন্য বুকের ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে বন্যা বইছিল যেন। এত প্রেম এতটা আবেগ তাও ফিরোজের জন্য! পড়ন্ত বিকেলে মনের ভেতরে জটলা পাকা সমস্ত বাঁধার দড়ি ছিড়ে ধূসর ক্লান্ত দিনের বুকে রঙিন খামে চিঠি লিখবে বলে নিজের ছায়া ফেলে অপেক্ষার কামরায়। বসে আছে ফিরোজ আর মহিউদ্দিন। এতো সাজগোজ আর জরুরি তলবের রহস্য জানতে চাইলে প্রতিউত্তরে উপহার জখমের রক্তধারা। শারমিনের মুখে ফিরোজের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করতে দেখেই মহিউদ্দিন শারমিনকে থামিয়ে দেয়। রুপা তোকে কিছু বলেনি? রুপা তো ফিরোজকে ভালোবাসে! ওর সাথে কোন মেয়েকে প্রেম করতে দেখলে সেই মেয়ের খবর আছে! ফিরোজ তো অবাক! রুপা ভালোবাসে আমাকে? কই আমি জানি না তো! “মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে, যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে, যখনই জাগিবে তুমি তখনই সে পলাইবে ধেয়ে”। মজার ছলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তি বলতে বলতে বেরিয়ে গেল ফিরোজ। এদিকে কাঁচের টুকরোর মতো ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয় শারমিনের মন। ধূসর অমাবস্যার মতো মুখ নিয়ে প্রবেশ করে রুমে শারমিন। আমার চোখে চোখ মেলাতে পারে না। আকাশের কালো মেঘ যেন সমস্তটা আঁছড়ে পড়ছে ওর মুখে। বলছে না কিছুই। মলিন মুখে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। চোখের কোনে শিশির টলটল করছে, একটু হলেই গড়িয়ে পড়বে। ধীরে কাছে এগিয়ে গেলাম, আস্তে করে বলল আমার সাথে এই নাটকটা না করলেও পারতিস রুপা!! বলার কিছু নেই তবুও আমি চাই তুই আমার আর ফিরোজের ভালো বন্ধু হয়ে আজীবন আমাদের পাশে থাক। ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার শেষ সময় চলছে আমাদের। ফিরোজের ইচ্ছে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হবে তারপর স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে ভবিষ্যত। এর মধ্যে হঠাৎ হেমন্তের এক দুপুরে ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ভাই রাজিব ভাই সিঙ্গাপুর থেকে এসে উপস্থিত। রাজীব ভাইয়ের স্নেহধন্য ছিলাম আমরা। সিনিয়র হলেও আমাদের সাথে মিশতেন বন্ধুর মতো। বিকেলে টিএসসির মোড়ে ডেকে নিলেন সার্কেলের সবাইকে। উপহার সামগ্রী নিয়ে শামীম, রাজিব ভাই উপস্থিত।অরুণ, বিপাশা, তৌহিদ, জুয়েল, নাবিলাসহ আমিও উপস্থিত। অপেক্ষা শুধু মহিউদ্দিন আর ফিরোজের। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষার পর ফিরোজ, মহিউদ্দিন উপস্থিত হলো। রাজীব ভাই প্রশ্নের শেকলে পেঁচিয়ে ধরল। মজার ছলেই জিজ্ঞেস করল ‘কার প্রেম ছিনতাই করতে গিয়েছিলি’? ফিরোজের মাথা তখন নিচু। মহিউদ্দিন বলে উঠলো কয়েকদিন যাবত সীমাব রুপাকে খুব বিরক্ত করছিল, ওকে শায়েস্তা করে এলো। তার মানে রুপা তোর মনে মনে; প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফিরোজ ‘রাজীব ভাই কি উপহার এনেছেন দেন দেখি’ সবার হাতে হাতে রেপিং পেপারে মোড়ানো প্যাকেট। উৎসুক সবাই; কী আছে এতে? একে একে সবাই খুলতে শুরু করলাম। সবাই তো বেশ অবাক! চকোলেট আর বই। যে সে বই নয়, বইটির নাম “সাংরিলা উতুমার দেশে”। তৎকালীন সিঙ্গাপুরের সরকার প্রধানকে নিয়ে লেখা বইটির লেখক রাজীব ভাই নিজেই। বেশ অবাক সবাই। রাতের মধ্যেই বই পড়ে সকালেই আড্ডার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে “সাংরিলা উতুমার দেশে”। রাজীব ভাইয়ের উদ্যোগে হঠাৎ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় “হেমন্তের গ্রাম ভ্রমণের নাম”। সবার সম্মতিতে দশ জনের টিম যাবে ফিরোজের গ্রামে। তিন দিনের ট্যুর। গন্তব্য ঢাকা টু চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার রারিকান্দি গ্রাম। দশ জনের সাথে আরো যোগ হলো জাহাঙ্গীরনগরের জহির, ইমু ,আলমগীর, আপেল। জার্নিটা দীর্ঘ হলেও বেশ আরামদায়ক ছিল ইউনিভার্সিটির বাসে সদরঘাট তারপর ছোট লঞ্চযোগে মতলব। সবাই মিলে পড়ন্ত বিকেলে পৌঁছে গেলাম রারিকান্দি গ্রাম। অসাধারণ আর অপূর্ব সবুজের আগুন যেন সলতে বিছিয়ে দিয়ে সুন্দরকে ছিটিয়ে দিচ্ছে সূর্যের আলো। বাঁধানো রাস্তার দুধারে সবুজ আর পাঁকা ধানের হলদে ফসলী মাঠ, দূর্বার উপর ভেসে ওঠা শিশির পা ধুইয়ে দিলো যেন; প্রেমে পড়ে গেলাম। পিচ্ছিল মন আর ফিরোজকে ঘিরে বুনে চলা আমার অফুরন্ত প্রেম, বোঝাতে চাইছে, বলতে চাইছে কিছু মন। চোখের দৃষ্টি কিন্তু ফিরোজ! অদ্ভুত! কখনোও রোমান্টিসিজম নিয়ে তাকায়ইনি! অথচ, আমার যে কোন বিপদে এগিয়ে আসা একমাত্র ব্যক্তি হলে সেটা ফিরোজই ছিল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আমরাও বাড়িতে ঢুকবো। পাখিদের ঘরে ফেরার সময়, ঝোপঝাড়ে সান্ধ্যযাপনের মহড়া চলছে প্রকৃতির। দূর গ্রামে ডাহুক ডাকছে, দেবদারু গাছে ঘুঘুর চিৎকার, হ্যাজাকের আলো একটু একটু জ্বলে উঠছে, গ্রামের আবহ টের পাচ্ছি। দূর থেকেই এক রাজকীয় স্টাইলের বাড়ি চোখে পড়লো। চমৎকারভাবে সাজানো গোছানো। বাড়ির সবার সাথে পরিচয় পর্ব শেষ। ক্ষুধার্ত সবাই। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই খোলা ছাদে জ্যোৎস্নার নিচে বসে পড়লাম ফিরোজের বাবা মানে রশীদ আংকেলের গল্প শোনার জন্য। কথা প্রসঙ্গে এলো ফিরোজের ছেলেবেলার গল্প। করাচি গিয়েছিলেন একবার তিনি। ত্রিপুরার নায়েবে নাজির ছিল রশীদ আংকেলের বন্ধু। করাচিতে তখন দ্বৈত শাসন প্রচলিত। তিনি ফিরোজের জন্য একটি ফিডার এবং মৃগনাভী উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। মৃগনাভীর ঘ্রানে তার খাওয়ার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। একটা সময় শেষ হয়ে গেল মৃগনাভী। ফিরোজের খাওয়ার আগ্রহ গেল কমে। অসুস্থ হয়ে পড়ল ফিরোজ। মৃগনাভীর পরিবর্তে পেঁয়াজের রস ব্যবহার করার পরামর্শ দিলেন তাঁর চাচা সোলায়মান। তিনি একটু আধাত্মিক ঘরানার মানুষ ছিলেন। তাতেই পরবর্তীতে অভ্যস্ত হয়ে গেল ফিরোজ। সবাই অবাক আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে প্রায় অর্ধেক রাত কেটে গেল আমাদের জোৎস্নার প্লাবনে। মনের ভেতর অদ্ভুত সুখানুভূতি, ফিরোজের বাড়ির সবাই এতো ভালো আর মিশুক প্রকৃতির; মহিউদ্দীন বেশ টিপ্পনী কেটে বলে উঠলোÑ কীরে একেবারে থেকে যাবি নাকি রুপা? লজ্জা পেলাম, তবুও কথাটি মনের গভীরে কোথায় গিয়ে যেন বকুলের মালার মতো গেঁথে রইলো। হেমন্তের নতুন ধানের পিঠে, খাওয়া দাওয়া, মাঞ্জা মেরে বিকেলের ঘুরাঘুরি জমে উঠলো। পড়ন্ত বিকেলের শিশির ভেজা আলপথ। ঘাসের ওপর জমা বিন্দুগুলো মাড়াতে বেশ লাগছিল। সবাই মিলে হাঁটছি নতুন ফসল রোয়া ক্ষেতের আল ধরে। হঠাৎ এক বৃদ্ধ ফিরোজকে ডেকে বললো! কিরে ফিরোজ “এগুন কেরা রে? আর যাছ কই? এগুন আমার বন্ধু চাচা। যামু আর কই? এই একটু এমিল হেমিল যাই আর কি।” আমরা সবাই হা করে তাকিয়ে ফিরোজের দিকে। রাজীব ভাই জিজ্ঞেস করলো, “ফিরোজ হোয়াট ইজ এমিল হেমিল”? ফিরোজ হাসতে হাসতে জবাব দিল ‘নাথিং’। দেটস্ মিন-উইথআউট ডেসটিনেশান। বেশ কাটলো আমাদের তিনটি দিন। ভার্সিটি যোগ দিতেই হঠাৎ নতুন কিছু ?মুখ সামনে। একটু ওভার এক্টিং করতে দেখে ফিরোজের ডাক। সিগারেট একটা মুখে পুরে একে একে নাম ঠিকানা, জ্ঞাতি গোষ্ঠী উদ্ধার করার মতো অবস্থা। একপ্রকার ইতস্তত সবাই। ভাইয়াÑ আমি অমুক কলেজ, আমি তমুক কলেজ থেকে এসেছি। আজই আমাদের মাস্টার্সের প্রথম ক্লাস। ও আচ্ছাÑ তো তোমরা সব কল পিলু? তাইতো বলি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কলু পিলু ছাড়া এমন ওভার স্মার্টনেস আর কারা দেখাবে? কলু-পিলুদের একদমই পছন্দ করতো না ফিরোজ। কলু পিলুরা আবার ছাত্র! ওরাতো পড়শোনাই করে না। না কালচার জানে না পড়াশোনা। বেশ ইগনোর আর প্রশ্নবানে বিদ্ধ করে নাজেহাল করে যাচ্ছিল। একজন সাহস করে বলে উঠলো ‘ভাইয়া এই যে আমাদের এভাবে কলু-পিলু বলে অপদস্ত করছেন, কলু-পিলু আসলে জিনিসটা কী? এই একটা ছেলে মনে হয় কিছুটা পড়াশোনা জানে, তার জানার আগ্রহ আছে। এদিকে আসো বাবা, তোমাকে বুঝাই হোয়াট ইট কলু-পিলু? এই যেমন: কলেজ থেকে অনার্স-মার্স্টাস অথবা কলেজ থেকে অনার্স কিন্তু ইউনিভাসিটিতে মাস্টার্স অথবা এমফিল পিএসডি করতে আসা তোমরা হচ্ছো কলু; কলেজ থেকে ডিগ্রি পড়ে, ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে যারা এসেছ তারা হচ্ছো পিলু। এবার তোমরাই ঠিক করো কে কলু কে পিলু। দূর থেকে দাঁড়িয়ে একজন খুব সূক্ষ্মভাবে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ করে এক ছেলে এসে নিজ উদ্যোগে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলতে শুরু করালো আমি হাবিবুর রহমান পিলু বাগেরহাট পিসি কলেজ। ছেলেটার এমন কান্ডে আমরা না হেসে পারলাম না। ফিরোজ দাঁড়িয়ে ওকে বুকে টেন নিল। তুইই পারবি আমাদের উপযুক্ত শিষ্য হতে। পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে ফিরোজের মুখে উৎফুল্লের হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল। চলে গেল ওরা সবাই। ফিরোজের কিছু আচরণ পাগলামি মনে হলেও জানি না কেন যেন মনে হতো এসব ওকে মানিয়ে যায় বরং এই পাগলামিগুলো ছাড়াই ও বেমানান। ইউনিভার্সিটিতে সময় কাটানোর সময় ফুরিয়ে আসছে। দুতিন দিন ফিরোজের দেখা নেই। সীমাব আমি মহিউদ্দীন, শারমিন গিয়ে উপস্থিত হলাম জহুরুল হক হলে। এমন উস্কোখুস্কো আর মনমরা ফিরোজকে আমরা কখনোই দেখিনি। অনেক পীড়াপীড়িতেও বললো নাÑ কী কারণ। একসময় জানতে পারলাম, যে বড় ভাই ওর পড়াশোনার খরচ চালাতো বেশ কয়েক মাস যাবৎ টাকাপয়সা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বড় ভাই দেশের বাহিরে থাকায় আর্থিক লেনদেন ভাবীর হাত ধরেই। ভাবীর অর্থ এখন অনত্র জমা হচ্ছে। ফিরোজও ভেতর থেকে ভেঙে পড়ে। এখন আর বাবার সেই অবস্থাও নেই। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। ইউনিভার্সিটির ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করে ফিরোজ। এতো ভালো রেজাল্ট! ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল শুরু থেকেই। টপার হওয়া ছাত্রকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া ডিপার্টমেন্টের জন্যও গৌরবের। কিন্তু না! শুরু হলো রাজনীতি! ইউনিভার্সিটিতে পরাকালীন সময়ে ছাত্র রাজনীতির সাথে একনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল ফিরোজ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাত বদলের পর দলীয় কোন্দলের স্বীকার হয়ে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন চিরতরে ভেস্তে যায়। শুরু হয় দেশের বাইরের ইউনিভার্সিটিগুলোতে ওর লেটার অব মোটিভেশন অথবা সোপ পাঠানো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর কিউ এস ওয়ার্ল্ড রেংকি, (সিজিপিএ), (সিসিএ), রিসার্চ স্কিল, রিসার্চ সফ্টওয়্যার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তাই ( সোপ) পাঠানোর পর স্কলারশীপ পেতে ওর কোন অসুবিধাই হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন ইউনিভাসিটিতে স্কলারশীপ পেয়ে যায় ফিরোজ। একদিকে আনন্দ অন্যদিকে কষ্টের নীলনকশা আঁকা হচ্ছিল আমার ভেতরে ভেতরে। ফিরোজ প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই তো আমি চেয়েছি তবে কেন এতোটা কষ্ট! কিসের এতো যন্ত্রণা? ভাবছি এবার ফিরোজকে সরাসরি প্রপোজ করবো। প্রায় এক সপ্তাহ ফিরোজ নিরুদ্দেশ। হলের ভেতর রাখা ওর কিছু বই আর জামাকাপড় পড়ে আছে। সবাই যার যার মতো করে খুঁজে চলেছি কিন্তু ফিরোজ নিখোঁজ। এদিকে রেজাল্টের পর বাবা বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খুঁজছে। আমাদের কুমিল্লার কয়েকজন ভার্সিটিতে এসে নাকি আড়ালে দেখেটেখেও গেছে। অথচ আমার পুরো আত্মাটা জুড়ে যে ফিরোজ। ফিরোজকে কেউই খুঁজে পাচ্ছি না। বন্ধুদের সাথে হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে সমস্ত রকমের যোগাযোগ। এদিকে সীমাব জোঁকের মতো লেগে আছে আমার সাথে। কতো অপমান যে করেছি ওকে। তবুও সরেনি। বন্ধুদের না বলে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে ফিরোজ এটাও ভাবা যায় না। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সময় পেরিয়ে গেল। প্রায় এক বছর পর তৌহিদের সাথে দেখা। তৌহিদ আমার ব্যাপারে জানতো সবটাই। কথা প্রসঙ্গে এলো ফিরোজের কথা। ফিরোজ দেশেই আছে শুনে অবাক হলাম। এতো ভালো অপর্চুনিটি কেউ মিস করে! আর্শ্চয হলাম। ‘ওর খবর কাউকে দিতে নিষেধ করেছে এমনকি তোকেও না’ আমাকেও নাহ! এতো কষ্ট মনে হয় জীবনে আগে কোনদিন পাইনি। ফিরোজ জানতো আমি ওকে খুঁজে বের করবোই যে কোনো মূল্যে। তৌহিদও নাছোরবান্দা। তৌহিদ খুঁজতে খুঁজতে একদিন পৌঁছে যায় সাভার ইপিজেড-এর কাছাকাছি বলিভদ্র বাজারে। আমাকে দেখে ওতো অবাক! ওকে দেখে আমিও। এতো স্মার্ট এবং ব্রিলিয়েন্ট একটা ছেলের এ কী- অবস্থা? একটা স্যাঁতসেঁতে রুম, তার ভেতর কিছু বই আর জামাকাপড়, সিগারেটের এস্ট্রেটা ঠিক আছে। খায় কোথায়, কী করে কিছুই বললো না। একমনে শুনে যাচ্ছিলাম তৌহিদের কথা। রুপাকে কি ফিরোজ ভুলে গেছে তৌহিদ? ও কি জিজ্ঞেস করেছে আমি কেমন আছি? আমি তো একজন মেয়ে। আমার চাকরি হয়েছে। ঢাকার বাহিরে আমার পোস্টিং। বাবা অস্থির হয়ে গেছে আমার বিয়ে দেবার জন্য। “দেখ, ওর কোনো মোটিভ বোঝা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে ও এই পৃথিবীর কোন আশা, মোহ এসবের মধ্যেই নেই; বলেছে, সবার কথাই জিজ্ঞেস করেছে । জিজ্ঞেস করছিল তোর বিয়ে হয়েছে কিনা। কোথায় থাকিস ইত্যাদি”। আমি বাকরুদ্ধ! যাকে নিয়ে স্বপ্নের উচুঁ পাহাড় তৈরি করেছিলাম মনে মনে সে তো কোনদিন আমার হয়ই নি ! চোখের পানি বাঁধ মানছিলো না। অপ্রতিরোধ্য গতিতে বয়েই চলেছে। পরদিন সকাল সকাল গিয়ে হাজির হলাম ওখানে অথচ সবটাই শূন্য। বেশ বিচক্ষণ আর মেধাবী ছিল যে! হয়তো ও বুঝে গিয়েছিল আমি ঠিক পৌঁছাবো। আহত হলাম। ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলাম। পুরোপুরি বুঝতে পারলাম। আমার মনে ও ছিল আজো আছে ঠিকই কিন্তু ওর মনে আমি কোনদিন প্রেমিকার অবস্থানে ছিলামই না। তারপর চেনা পরিচিত কোনো জায়গায় ফিরাজকে দেখা যায়নি প্রায় দশ বছর। কেউ তার কোনো খোঁজ পায়নি। ইতোমধ্যে জানা গেলো মতলব দক্ষিণের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে জয়েন করেছেন বেশ নিরহংকারী এবং সুন্দরী একজন ভদ্রমহিলা। গরিব, এতিম মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির বিষয়ে এক লোক অপেক্ষা করছে ইউ.এন.ও অফিসারের অফিস করিডোরে। অদ্ভুত এক লোক ! চুল দাড়িতে মুখ সম্পূর্ণ ঢাকা। লাল একটি সেলাইবিহীন কাপড়ে আমাদমম্ভক মোড়ানো। ছিপছিপে হাড্ডিসার দেহের অধিকারী অথচ বাচনভঙ্গি এবং আচার আচরণে বেশ দূর থেকে স্পষ্ট র্স্মাটনেস বা মুখোমুখি বসেও বোঝার উপায় নেই কে এই লোক! মনে হবে কোন সাধু সন্ন্যাসী, মূর্খ আর গরিব। ইউ.এন.ও অফিসে ঢোকা মাত্রই চোখ আটকে গেলো বেশ ব্যাতিক্রম এই ব্যক্তিকে দেখে। পাশে বসা সাত আটজন অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে। ইউ.এন.ও অফিস সহকারীকে দিয়ে সর্বপ্রথমে ডেকে পাঠালেন লোকটিকে।রুমে ঢুকেই লোকটি অবাক! ইউ. এন.ও একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। আর সেই লোকের দৃষ্টি তার মুখের দিকে। আটসাট শাড়ি, কপালে টিপ, হালকা টমেটো লাল লিপস্টিক, মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণে বেশ বিমোহিত মনে হঠাৎ বলে ওঠে; জারুল রং তো আপনার খুব পছন্দ ছিলো। জারুল লিপস্টিক, জারুল রংয়ের শাড়ি, জারুল ফুল। তবে এখন কেন আপেল টমেটো রং? আপনার হাজব্যান্ড বুঝি আপেলের মতো দেখতে? কি সব বাজে বকছেন! এতো রাগ করছেন কেন? রাগের মাথায় কোনো কাজ সঠিকভাবে করা যায় না। সিদ্ধান্তে ভুল হয়ে যায়। রাগের মাথায় নিজের প্রেমিককে হারিয়ে বান্ধবীর প্রেমিককে জব্দ করতে গিয়ে তো নিজেই জব্দ হয়েছিলেন। এরপর বিয়েটা কার সাথে হলো! আপনাকে যে প্রাণভরে ভালোবাসতো তার সাথেই তো! মাঝখান থেকে বেচারাকে নিয়ে খেললো স্বর্ণা। এখন আর এই সন্ন্যাসী টাইপ লোকটার সামনে থেকে চোখ সরাতে পারছেন না ইউ.এন.ও। সব কেমন যেন হানড্রেড পারসেন্ট মিলে যাচ্ছে। উনি কি তবে সত্যি কোনো সাধু সন্ন্যাসী? সব জানেন কী করে? আর এতো ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলে যাচ্ছেন। অনেকক্ষণ কথা বলার পর ইউ.এন.ও জিজ্ঞেস করলো আপনি কে সত্যি করে বলুন তো? কেন আমাকে কি আপনার চেনা মনে হচ্ছে? দেখুন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করা আমার একদম পছন্দ না। আগে তো এতো রাগ করতে নাহ কথায় কথায়! এখন কি পাওয়ারে বদলে গেছ? সারাদেশে এত জায়গা থাকতে সেই দিনাজপুর থেকে এখানে ট্রান্সফার হয়ে এলে যে? এতো ভালোবাসতে তাকে যার টানে তার এলাকার ভালো মন্দের দায়িত্ব নিতে চলে এলে? বিয়েতো তাকেই করেছ যে তোমাকে ভালোবাসতো। পৃথিবাটা কতো স্বার্থপর তাই না শারমিন!এবার চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেল ইউ.এন.ও শারমিন রহমান। কে আপনি? আপনি এতো কিছু জানেন কিভাবে? কর্মক্ষেত্রে হাজারো কঠোরতা দেখালেও মেয়েদের মন একটু কোমলতায় ভরপুর থাকে সর্বদা। অনেক কিছু ভাবা হয়ে গেছে এতোক্ষণে ! আবারও প্রশ্নটা রিপিট করলো। তুমি আমাকে সত্যিই চিনতে পারছো না নাহ! তবে আপনার কণ্ঠ, বাচনভঙ্গি আমার খুব চেনা কিন্তু আমি যাকে ভাবছি সে আপনি নন। হতেই পারে না। ‘কেন পারে না।আমি কি আপনার ভালোবাসার মানুষ নই?’ এবার সত্যি সত্যি পাগল বলে একপ্রকার অপমান করার অবস্থা। কুল কুল বলে ইউ.এন.ও শারমিন রহমানকে শান্ত করে সন্ন্যাসী বললো! আমার উপর আপনার রাগের কারণ হচ্ছে আপনি আমার সাথে ফিরোজকে মিলাতে পারছেন না। তাই তো! এবার শারমিনের চোখ বড় বড়, প্রেসার বাড়ছে। ফিরোজের নাম এই লোক জানে কী করে। আর কী কী জানে। সন্ন্যাসীর জিজ্ঞাসা, আপনি আমার ছেলেমেয়েগুলোকে বিনাখরচে ভর্তি এবং পড়াশুনার একটা ব্যবস্থা করে দিন। আমি আপনার সমস্যার সমাধান দিচ্ছি। আপনার কাগজপত্র দেখে আমি সিদ্ধান্ত দেব। তবে দুএকদিন পর জানাতে পারবো। ঠিক আছে তবে আমিও দুএকদিন পর এসে আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাব। উঠে যাওয়ার উপক্রম হলে ইউ.এন.ও শারমিন রহমানের বাধা। এই দুই দিন টেনশনে আধমরা হয়ে যাবো নিজেই বিড়বিড় করছে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি কথা দিলাম আপনার কাজ আমি করে দিব। আচ্ছা বেশ। তবে আমার চোখের দিকে তাকাও। বুঝতে পারবে। ইম্পসিবল, আপনি কি আমাকে বোকা পেয়েছেন? এখন হিপ্নোটাইজ করে অনেক ক্রাইম হচ্ছে। আপনার উদ্দেশ্য ভালো না, আপনি আসুন। আর আপনি আমাকে তুমি সম্বোধন কেন করছেন? আমি চলে গেলে তোমার অস্থিরতা আরো বাড়বে সেটা কি ভালো হবে? জানতে ইচ্ছে করছেনা আমি এতো কিছু জানি কি করে? মাথা নীচু, তাহলে ভালো করে তাকাও আমার দিকে। তুমি মনে মনে যাকে ভাবছো তাকে মিলিয়ে দেখোতো আমার সাথে।পথে চলে যেতে কোথা কোনখানে তোমার পরশ আসে... রবীন্দ্রনাথের গানটি যেন আলতো করে ছুঁয়ে গেল মন। অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তুমি ফিরোজ ভাই! এ কী অবস্থা তোমার ! হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এলো দুজনেরই। কতো বছর পর তাই না! সেই এক বছরের বড় হয়ে তোমার ফিরোজ ভাই ই হয়ে রইলাম। তোমাকে কতোনা খুঁজেছি ! বিশেষ করে রুপা তোমার অপেক্ষায় থেকে থেকে পাঁচ বছর আগে সীমাবকে বিয়ে করলো। যাক শুনে খুশি হলাম। তুমি বিয়ে করোনি? আর এমন অবস্থা কেন তোমার? কোথায় থাক? কী কর? আরে ওয়েট ওয়েট। এতো প্রশ্নের জবাব এক সাথে কী করে দেব? প্রথমত আমি কিছুই করি না। মানে করি অনেক কিছুই কিন্তু তা নিজের জন্য না। আর বিয়ে! আমার মতো পাগল, সংসার ছাড়া ছন্ন জীবনে কে আসবে? কেন আসবে।তার চেয়েও বড় কথা হলো আমি আমৃত্যু চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কোথায় থাকি? আমার নির্দিষ্ট কোনো থাকার জায়গা নেই। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই। পাহাড়, বন-জঙ্গল, মসজিদ-মাদ্রাসায় মাঝে মাঝে আমাকে খুঁজে পাবে। এক অন্য জীবন! তুমি বুঝবে না। যখন এই জগতের মানুষ বিপদে পড়ে আমাকে ডাকে, আমি ধ্যান ভগ্ন হয়ে যাই। আমাকে তাদের কাছে আসতে হয় তাদের প্রয়োজনে। ফিরোজের অদ্ভুত কথা শুনে শরীরে কাটা দিচ্ছিল। তোমার এতো সুন্দর ভবিষ্যত থাকতে তুমি এই পথে কোনো গেলে! ভবিষ্যত! তুমি কী করে বুঝলে আমার সুন্দর ভবিষ্যত ছিল। এই যে আমাকে দেখছো তোমার হিসেব মতো আজকের এই বর্তমানটাই তো সেই সময়ের সুন্দর ভবিষ্যত। তাই না! তবে হ্যাঁ পার্থিব জীবনের মোহ থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি। আজকের পর হয়তো তোমার সাথে আর কখনো দেখাও হবে না; আবার হয়তো হবে। অনেক কথার গল্প শেষে ফিরোজ বিদায় নিল। এই যুগেও কেউ এমন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে কী করে? তাও আবার পাহাড়ের পাদদেশে গহীন অরণ্যে। কোথাও কেউ নেই এমন এমন জায়গায়। এরপর তিনবছর শারমিন কাজের ফাঁকে খুজঁতে থাকে প্রায়ই ফিরোজকে। গন্তব্যহীন ফিরোজ ফিরে আসেনি। এর মাঝে শারমিন ফোনে আমাকে সবটা জানায়। তার মা বাবা মারা গেছে দুজনই। খোঁজ নিয়ে ফিরোজের গ্রামের বাড়ি রারিকান্দি গিয়ে হাজির আমি আর শারমিন। এই সেই বাড়ি যেখানে একদিন আমরা সবাই মিলে হৈচৈ করতে করতে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি গিয়ে ফিরোজের এক চাচা ছাড়া আর কাউকেই পেলাম না। ওনার কাছ থেকে জানতে চাইলাম ফিরোজের নিরুদ্দেশ হওয়ার রহস্য! এক দীর্ঘশাস ছেড়ে বলতে শুরু করলেন, “এমন-মেধাবী তরতাজা ছেলেডা কেন যে এমন হইয়া গেলো, কিছুই কইতে পারমু না। ওর মায় একবার কইছিলো আমার লগে, অয় যহন ছয় মাসের পেডে তহন ওর মারে স্বপ্নে দেখাইছিলো খাজা আসছে তোর ঘরে। এই ছেলেরে তুই মাদ্রাসায় পড়াইবি। জন্মের পাঁচদিন পর যখন নাম রাখার দিন এলো তখন একেক জন একেক নাম রাখার প্রস্তাব দেয়। বাড়িত তহন কেউই আছিল না। ওর বাপ আর আমার ছোড এক ভাই সুজাতপুর বাজার গেল বাজার করতে। ফিরা আইসা শুনে অর নাম ঠিক হইয়া গেছে। সাঁঝের বেলায় অর মায় অরে কোলে নিয়া বইসা ছিল, হঠাৎ পশ্চিমের আকাশ থিকা দ্বৈব আওয়াজ এলো ‘খাজা খাইরুদ্দিন’। ‘খাজা খাইরুদ্দিন’। অর মায় দেখলো অর কপালে তহন জোনাকি পোকের মতো আলো জ্বলজল করতাছে! অর মায় ডরায়া গেলো। আবার স্বপ্নের কথা মনে করল। এই কথা প্রথ্থম আমারে জানাইলো। আমি সবাইরে কইলাম অর নাম খাজা খাইরুদ্দিন হউক, তাই হইল, কিন্তু অর বাপ আর আমার ছোট ভাই অরে মাদ্রাসায় পরাইতে রাজি হইলো না। এই ছেলেরে দুনিয়ার কোন কিছু টানে না, ছোডবেলা থিকাই মসজিদ মাদ্রাসায় সুযোগ পাইলেই চইলা যাইতো। আইতে চাইতো না। কী যে অইলো। অহন মাঝেমধ্যে আহে মন চাইলে। কই থাহে কিছুই কয় না। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুইরা বেড়ায়, ধ্যান করে। মসজিদ-মাদ্রাসায় মাঝে মধ্যে আরবি থিকা বাংলায় তরজমা কইরা মাইনসেরে বুঝায়। গরিব বাচ্চাগো সেবা করে। বাড়িত আইলে আমরা চাচা ভাতিজা খোলা আসমানের নিচে গল্প করতে করতে রাইত কাটাইয়া দেই”। প্রশ্ন করলাম, শেষবার কি গল্প হয়েছিল ফিরোজ মানে খাজার সাথে আপনার, মনে আছে? আছে। ওরে জিগাইছিলাম, বিয়ে সাদী করামু নাকি? কী বললো ! কইলো আমার জন্য সংসার না চাচা। শেষবার আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল আমেনা নামের একটি মেয়ে। ব্যর্থ হয়ে অনেক কেঁদেছে। আমার গুরুজির নাতনী। গুরুজি আমাকে পরীক্ষা করতে টানা কয়েক রাত ডেমরার কবরস্থানে ফেলে রেখেছিল ধ্যানসাধনায়। শারীরিক সমস্যা কিংবা জৈবিক চাহিদা জাগ্রত কিনা পরীক্ষার জন্য আমাকে ডক্তার দেখালেন। যৌন উত্তেজক ঔষধ খাওয়ালেন। কিছুতেই তিনি সফল হলেন না। মুন্সীগঞ্জের শাহালম গুরুজিকে বললো অতো বিশাল সমুদ্রে কয়েকটি ট্যাবলেট ফেলে কোন লাভ নেই গুরুজি। নির্জন একাকীত্ব সাধানায় খাজা খাইরুদ্দিন সফল। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে; কোন দিকে যাবো বুঝতে পারছি না। ফিরোজ কবে আসবো আর আসবো কিনা, কোনহানে আছে কিছু জানি না। কোন পাহাড়ের কোন নিরালায় বইসা ধ্যান করতাছে তোমরাই বার কর মা। আমি এই আছি তো এই নাই। খোদার ডাক আসলে কহন চইলা যাই! ফিরোজের চাচা হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে আমাদের বিদায় দিলেন আর বিড়বিড় করতে করতে একদিকে চলে গেলেন। আমার আর শারমিনের চোখের ওপর ঝাপসা আবরণ। কলাপাতার মতো বাতাসে দুলছে আমার সব ভাবনা। এতো মেধাবী ফিরোজ, কেনোইবা এতো ভালো রেজাল্ট করার পরও স্কলারশীপ পাওয়ার পরও সে সুযোগটা গ্রহণ করেনি? কেনো এমন একটা র্স্মাট দুরন্তপনায় হাতছানি দেয়া যুবক এলোমেলো হয়ে গেলো! কে এই গুরুজি? কেনোইবা ধ্যানমগ্ন পৃথিবীতে ও চলে গেল। এই পৃথিবীর মায়া মমতা থেকে বিচ্ছিন্ন ফিরোজের একবারও কি ?রুপার কথা মনে পড়ে না? হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে ভাবতে শারমিন আর আমি দূর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে,সূর্য তখন অস্তাচলে।

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বায়োস্কোপ

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ছবি

বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

ছবি

প্রেম, দর্শন ও অখণ্ডতা

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

ছবি

‘আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ভ্রম

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

রফিক আজাদের কবিতা

ছবি

ধূসর পাণ্ডুলিপি পরিবহন

ছবি

চৈত্রের কোনো এক মধ্যরাতে

ছবি

দেশভাগের বিপর্যয় ও ‘জলপাইহাটি’র জীবনানন্দ দাশ

ছবি

সামান্য ভুল

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথাভাঙা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ছবি

ধুলোময় জীবনের মেটাফর

ছবি

স্কুলটি ছোট্ট বটে

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

tab

সাময়িকী

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

নুরুন্নাহার মুন্নি

বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫

সকাল নয়টা পাঁচ-এর ক্লাস। একানব্বই-বিরানব্বই এর টিএসসি। খোলা ধবধবে আকাশ। সমস্ত আলোর রং, সবুজের উড়াল, ধুলিমাখা নীরব সৌন্দর্য, কয়েকটি গাড়ির আনাগোনা, আর রিকশার টুংটাং বেলের শব্দ শুনতে শুনতে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে শুরু হয় ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা। শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের দমদার আর জোশ প্লেয়ার ফিরোজ। ফুটবল আর কেরামে তার দক্ষতা ঈর্ষণীয়। তাকে হারানোর মতো দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুধুমাত্র খেলাধুলা নয়, একজন দক্ষ বিতার্কিকও বটে। সেদিন হঠাৎ করেই সকাল-সকাল ক্লাসে এসে উপস্থিত এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি। মেধা যাচাই প্রশ্নের জবাবে এগিয়ে ফিরোজ, বোর্ড স্কলারশিপ স্টুডেন্ট যাচাই প্রশ্নে এগিয়ে ফিরোজ, ইউনিভার্সিটির বর্ষসেরা বিতার্কিক। ভদ্রলোকের প্রশ্নের এক একটি তীর ফিরোজকে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিদ্ধ করতে পারছে না একটিও। হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের এক দুর্দান্ত মেধাবী ফিরোজ, এককথায় অলরাউন্ডার। ইন্টারন্যাশনাল ল নিয়ে তার থিসিস। ইউনিভার্সিটিতে বন্ধু সংখ্যা অগণিত। লাকসামের জুয়েল, কুমিল্লার রেবা, চাঁদপুরের শহীদ, মিন্টু, মতলবের তৌহিদ, মহিউদ্দিন, অরুণ, শামীম কিন্তু মেয়েদের সাথে অতটা নিগূঢ় ঘনিষ্ঠতা নেই। ঢাকা ইউনিভার্সিটির সেরাদের সেরা ফিরোজ, পাতলা শারীরিক গঠন হলেও শত মেয়ের ক্রাশ। অপূর্ব সুন্দরী রমণীর লোভনীয় আকর্ষণীয় সুডৌল দেহের স্ফুলিঙ্গ তার মন ও মস্তিষ্ক ছুঁতে পারেনি। তার মাথায় ইন্টারন্যাশনাল হিস্ট্রি, আর্টিকেলস মেকিং হিস্ট্রি, এনড্রিও, জে উইলিয়ামস, ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ বুকস, রিসার্চ। ঐদিন ক্লাসে এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি সবার সামনে বলেই দিলেন নিঃসন্দেহে এই ছেলে কোন ল্যাংলিট ফ্যামিলিতে বিলং করে। মেয়েরা জোঁকের মতো একেকজন লেগে থাকে ফিরোজের গা ঘেঁষে অথচ ফিরোজের তাতে কোনো পাত্তা নেই, সবার সাথেই মিশছে বন্ধুর মতো। আমিও চুইনগামের আঠা। কুয়েত মৈত্রী হলে আলোচনার ইস্যু হয়ে ওঠে ফিরোজ। আমার রুমমেট শারমিনের ধ্যান, জ্ঞান সাধনায়, পড়াশোনা নেই শুধু ফিরোজ ভাই। এদিকে রগরগে আবেগের আঁচল বিছিয়ে আমারই কাছে বলে যাচ্ছে কীভাবে ফিরোজকে প্রেম প্রস্তাব দেয়া যায়। মহিউদ্দিন হেল্প করবে বলে শারমিনকে পাঠিয়ে দিলাম মহিউদ্দিনের কাছে। আমার বিষয়টি ফিরোজ না জানলেও মহিউদ্দিন সবটা সম্পর্কে অবগত ছিল। ফিরোজ বুঝতে পারত কিনা জানি না তবে শারমিনের জরুরি তলব ,পরদিন বিকেলে মহিউদ্দিন আর ফিরোজ কুয়েত মৈত্রী হলে এসে উপস্থিত। ইয়ারমেট সবাই তবুও প্রেমের দরদী কন্ঠ, উতলা মন, সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে মেরিল স্প্রিংলিং শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে ম্যানোলা স্নো মেখে হলের উড়ন্ত হাওয়ায় খিলখিল করছে শারমিন। দেখে আমার গা জ্বলে ধোঁয়া বেরুচ্ছে তবুও কিছু বলতে পারছি না। সরষে হলুদ রঙের শাড়ি আর ম্যাচিং সবুজ ব্লাউজ যদিও ব্লাউজটা ধার দিয়েছিলাম আমিই। খানিকটা সময়ের জন্য বুকের ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে বন্যা বইছিল যেন। এত প্রেম এতটা আবেগ তাও ফিরোজের জন্য! পড়ন্ত বিকেলে মনের ভেতরে জটলা পাকা সমস্ত বাঁধার দড়ি ছিড়ে ধূসর ক্লান্ত দিনের বুকে রঙিন খামে চিঠি লিখবে বলে নিজের ছায়া ফেলে অপেক্ষার কামরায়। বসে আছে ফিরোজ আর মহিউদ্দিন। এতো সাজগোজ আর জরুরি তলবের রহস্য জানতে চাইলে প্রতিউত্তরে উপহার জখমের রক্তধারা। শারমিনের মুখে ফিরোজের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করতে দেখেই মহিউদ্দিন শারমিনকে থামিয়ে দেয়। রুপা তোকে কিছু বলেনি? রুপা তো ফিরোজকে ভালোবাসে! ওর সাথে কোন মেয়েকে প্রেম করতে দেখলে সেই মেয়ের খবর আছে! ফিরোজ তো অবাক! রুপা ভালোবাসে আমাকে? কই আমি জানি না তো! “মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে, যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে, যখনই জাগিবে তুমি তখনই সে পলাইবে ধেয়ে”। মজার ছলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তি বলতে বলতে বেরিয়ে গেল ফিরোজ। এদিকে কাঁচের টুকরোর মতো ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয় শারমিনের মন। ধূসর অমাবস্যার মতো মুখ নিয়ে প্রবেশ করে রুমে শারমিন। আমার চোখে চোখ মেলাতে পারে না। আকাশের কালো মেঘ যেন সমস্তটা আঁছড়ে পড়ছে ওর মুখে। বলছে না কিছুই। মলিন মুখে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। চোখের কোনে শিশির টলটল করছে, একটু হলেই গড়িয়ে পড়বে। ধীরে কাছে এগিয়ে গেলাম, আস্তে করে বলল আমার সাথে এই নাটকটা না করলেও পারতিস রুপা!! বলার কিছু নেই তবুও আমি চাই তুই আমার আর ফিরোজের ভালো বন্ধু হয়ে আজীবন আমাদের পাশে থাক। ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার শেষ সময় চলছে আমাদের। ফিরোজের ইচ্ছে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হবে তারপর স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে ভবিষ্যত। এর মধ্যে হঠাৎ হেমন্তের এক দুপুরে ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ভাই রাজিব ভাই সিঙ্গাপুর থেকে এসে উপস্থিত। রাজীব ভাইয়ের স্নেহধন্য ছিলাম আমরা। সিনিয়র হলেও আমাদের সাথে মিশতেন বন্ধুর মতো। বিকেলে টিএসসির মোড়ে ডেকে নিলেন সার্কেলের সবাইকে। উপহার সামগ্রী নিয়ে শামীম, রাজিব ভাই উপস্থিত।অরুণ, বিপাশা, তৌহিদ, জুয়েল, নাবিলাসহ আমিও উপস্থিত। অপেক্ষা শুধু মহিউদ্দিন আর ফিরোজের। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষার পর ফিরোজ, মহিউদ্দিন উপস্থিত হলো। রাজীব ভাই প্রশ্নের শেকলে পেঁচিয়ে ধরল। মজার ছলেই জিজ্ঞেস করল ‘কার প্রেম ছিনতাই করতে গিয়েছিলি’? ফিরোজের মাথা তখন নিচু। মহিউদ্দিন বলে উঠলো কয়েকদিন যাবত সীমাব রুপাকে খুব বিরক্ত করছিল, ওকে শায়েস্তা করে এলো। তার মানে রুপা তোর মনে মনে; প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফিরোজ ‘রাজীব ভাই কি উপহার এনেছেন দেন দেখি’ সবার হাতে হাতে রেপিং পেপারে মোড়ানো প্যাকেট। উৎসুক সবাই; কী আছে এতে? একে একে সবাই খুলতে শুরু করলাম। সবাই তো বেশ অবাক! চকোলেট আর বই। যে সে বই নয়, বইটির নাম “সাংরিলা উতুমার দেশে”। তৎকালীন সিঙ্গাপুরের সরকার প্রধানকে নিয়ে লেখা বইটির লেখক রাজীব ভাই নিজেই। বেশ অবাক সবাই। রাতের মধ্যেই বই পড়ে সকালেই আড্ডার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে “সাংরিলা উতুমার দেশে”। রাজীব ভাইয়ের উদ্যোগে হঠাৎ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় “হেমন্তের গ্রাম ভ্রমণের নাম”। সবার সম্মতিতে দশ জনের টিম যাবে ফিরোজের গ্রামে। তিন দিনের ট্যুর। গন্তব্য ঢাকা টু চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার রারিকান্দি গ্রাম। দশ জনের সাথে আরো যোগ হলো জাহাঙ্গীরনগরের জহির, ইমু ,আলমগীর, আপেল। জার্নিটা দীর্ঘ হলেও বেশ আরামদায়ক ছিল ইউনিভার্সিটির বাসে সদরঘাট তারপর ছোট লঞ্চযোগে মতলব। সবাই মিলে পড়ন্ত বিকেলে পৌঁছে গেলাম রারিকান্দি গ্রাম। অসাধারণ আর অপূর্ব সবুজের আগুন যেন সলতে বিছিয়ে দিয়ে সুন্দরকে ছিটিয়ে দিচ্ছে সূর্যের আলো। বাঁধানো রাস্তার দুধারে সবুজ আর পাঁকা ধানের হলদে ফসলী মাঠ, দূর্বার উপর ভেসে ওঠা শিশির পা ধুইয়ে দিলো যেন; প্রেমে পড়ে গেলাম। পিচ্ছিল মন আর ফিরোজকে ঘিরে বুনে চলা আমার অফুরন্ত প্রেম, বোঝাতে চাইছে, বলতে চাইছে কিছু মন। চোখের দৃষ্টি কিন্তু ফিরোজ! অদ্ভুত! কখনোও রোমান্টিসিজম নিয়ে তাকায়ইনি! অথচ, আমার যে কোন বিপদে এগিয়ে আসা একমাত্র ব্যক্তি হলে সেটা ফিরোজই ছিল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আমরাও বাড়িতে ঢুকবো। পাখিদের ঘরে ফেরার সময়, ঝোপঝাড়ে সান্ধ্যযাপনের মহড়া চলছে প্রকৃতির। দূর গ্রামে ডাহুক ডাকছে, দেবদারু গাছে ঘুঘুর চিৎকার, হ্যাজাকের আলো একটু একটু জ্বলে উঠছে, গ্রামের আবহ টের পাচ্ছি। দূর থেকেই এক রাজকীয় স্টাইলের বাড়ি চোখে পড়লো। চমৎকারভাবে সাজানো গোছানো। বাড়ির সবার সাথে পরিচয় পর্ব শেষ। ক্ষুধার্ত সবাই। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই খোলা ছাদে জ্যোৎস্নার নিচে বসে পড়লাম ফিরোজের বাবা মানে রশীদ আংকেলের গল্প শোনার জন্য। কথা প্রসঙ্গে এলো ফিরোজের ছেলেবেলার গল্প। করাচি গিয়েছিলেন একবার তিনি। ত্রিপুরার নায়েবে নাজির ছিল রশীদ আংকেলের বন্ধু। করাচিতে তখন দ্বৈত শাসন প্রচলিত। তিনি ফিরোজের জন্য একটি ফিডার এবং মৃগনাভী উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। মৃগনাভীর ঘ্রানে তার খাওয়ার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। একটা সময় শেষ হয়ে গেল মৃগনাভী। ফিরোজের খাওয়ার আগ্রহ গেল কমে। অসুস্থ হয়ে পড়ল ফিরোজ। মৃগনাভীর পরিবর্তে পেঁয়াজের রস ব্যবহার করার পরামর্শ দিলেন তাঁর চাচা সোলায়মান। তিনি একটু আধাত্মিক ঘরানার মানুষ ছিলেন। তাতেই পরবর্তীতে অভ্যস্ত হয়ে গেল ফিরোজ। সবাই অবাক আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে প্রায় অর্ধেক রাত কেটে গেল আমাদের জোৎস্নার প্লাবনে। মনের ভেতর অদ্ভুত সুখানুভূতি, ফিরোজের বাড়ির সবাই এতো ভালো আর মিশুক প্রকৃতির; মহিউদ্দীন বেশ টিপ্পনী কেটে বলে উঠলোÑ কীরে একেবারে থেকে যাবি নাকি রুপা? লজ্জা পেলাম, তবুও কথাটি মনের গভীরে কোথায় গিয়ে যেন বকুলের মালার মতো গেঁথে রইলো। হেমন্তের নতুন ধানের পিঠে, খাওয়া দাওয়া, মাঞ্জা মেরে বিকেলের ঘুরাঘুরি জমে উঠলো। পড়ন্ত বিকেলের শিশির ভেজা আলপথ। ঘাসের ওপর জমা বিন্দুগুলো মাড়াতে বেশ লাগছিল। সবাই মিলে হাঁটছি নতুন ফসল রোয়া ক্ষেতের আল ধরে। হঠাৎ এক বৃদ্ধ ফিরোজকে ডেকে বললো! কিরে ফিরোজ “এগুন কেরা রে? আর যাছ কই? এগুন আমার বন্ধু চাচা। যামু আর কই? এই একটু এমিল হেমিল যাই আর কি।” আমরা সবাই হা করে তাকিয়ে ফিরোজের দিকে। রাজীব ভাই জিজ্ঞেস করলো, “ফিরোজ হোয়াট ইজ এমিল হেমিল”? ফিরোজ হাসতে হাসতে জবাব দিল ‘নাথিং’। দেটস্ মিন-উইথআউট ডেসটিনেশান। বেশ কাটলো আমাদের তিনটি দিন। ভার্সিটি যোগ দিতেই হঠাৎ নতুন কিছু ?মুখ সামনে। একটু ওভার এক্টিং করতে দেখে ফিরোজের ডাক। সিগারেট একটা মুখে পুরে একে একে নাম ঠিকানা, জ্ঞাতি গোষ্ঠী উদ্ধার করার মতো অবস্থা। একপ্রকার ইতস্তত সবাই। ভাইয়াÑ আমি অমুক কলেজ, আমি তমুক কলেজ থেকে এসেছি। আজই আমাদের মাস্টার্সের প্রথম ক্লাস। ও আচ্ছাÑ তো তোমরা সব কল পিলু? তাইতো বলি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কলু পিলু ছাড়া এমন ওভার স্মার্টনেস আর কারা দেখাবে? কলু-পিলুদের একদমই পছন্দ করতো না ফিরোজ। কলু পিলুরা আবার ছাত্র! ওরাতো পড়শোনাই করে না। না কালচার জানে না পড়াশোনা। বেশ ইগনোর আর প্রশ্নবানে বিদ্ধ করে নাজেহাল করে যাচ্ছিল। একজন সাহস করে বলে উঠলো ‘ভাইয়া এই যে আমাদের এভাবে কলু-পিলু বলে অপদস্ত করছেন, কলু-পিলু আসলে জিনিসটা কী? এই একটা ছেলে মনে হয় কিছুটা পড়াশোনা জানে, তার জানার আগ্রহ আছে। এদিকে আসো বাবা, তোমাকে বুঝাই হোয়াট ইট কলু-পিলু? এই যেমন: কলেজ থেকে অনার্স-মার্স্টাস অথবা কলেজ থেকে অনার্স কিন্তু ইউনিভাসিটিতে মাস্টার্স অথবা এমফিল পিএসডি করতে আসা তোমরা হচ্ছো কলু; কলেজ থেকে ডিগ্রি পড়ে, ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে যারা এসেছ তারা হচ্ছো পিলু। এবার তোমরাই ঠিক করো কে কলু কে পিলু। দূর থেকে দাঁড়িয়ে একজন খুব সূক্ষ্মভাবে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ করে এক ছেলে এসে নিজ উদ্যোগে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলতে শুরু করালো আমি হাবিবুর রহমান পিলু বাগেরহাট পিসি কলেজ। ছেলেটার এমন কান্ডে আমরা না হেসে পারলাম না। ফিরোজ দাঁড়িয়ে ওকে বুকে টেন নিল। তুইই পারবি আমাদের উপযুক্ত শিষ্য হতে। পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে ফিরোজের মুখে উৎফুল্লের হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল। চলে গেল ওরা সবাই। ফিরোজের কিছু আচরণ পাগলামি মনে হলেও জানি না কেন যেন মনে হতো এসব ওকে মানিয়ে যায় বরং এই পাগলামিগুলো ছাড়াই ও বেমানান। ইউনিভার্সিটিতে সময় কাটানোর সময় ফুরিয়ে আসছে। দুতিন দিন ফিরোজের দেখা নেই। সীমাব আমি মহিউদ্দীন, শারমিন গিয়ে উপস্থিত হলাম জহুরুল হক হলে। এমন উস্কোখুস্কো আর মনমরা ফিরোজকে আমরা কখনোই দেখিনি। অনেক পীড়াপীড়িতেও বললো নাÑ কী কারণ। একসময় জানতে পারলাম, যে বড় ভাই ওর পড়াশোনার খরচ চালাতো বেশ কয়েক মাস যাবৎ টাকাপয়সা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বড় ভাই দেশের বাহিরে থাকায় আর্থিক লেনদেন ভাবীর হাত ধরেই। ভাবীর অর্থ এখন অনত্র জমা হচ্ছে। ফিরোজও ভেতর থেকে ভেঙে পড়ে। এখন আর বাবার সেই অবস্থাও নেই। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। ইউনিভার্সিটির ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করে ফিরোজ। এতো ভালো রেজাল্ট! ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল শুরু থেকেই। টপার হওয়া ছাত্রকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া ডিপার্টমেন্টের জন্যও গৌরবের। কিন্তু না! শুরু হলো রাজনীতি! ইউনিভার্সিটিতে পরাকালীন সময়ে ছাত্র রাজনীতির সাথে একনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল ফিরোজ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাত বদলের পর দলীয় কোন্দলের স্বীকার হয়ে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন চিরতরে ভেস্তে যায়। শুরু হয় দেশের বাইরের ইউনিভার্সিটিগুলোতে ওর লেটার অব মোটিভেশন অথবা সোপ পাঠানো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর কিউ এস ওয়ার্ল্ড রেংকি, (সিজিপিএ), (সিসিএ), রিসার্চ স্কিল, রিসার্চ সফ্টওয়্যার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তাই ( সোপ) পাঠানোর পর স্কলারশীপ পেতে ওর কোন অসুবিধাই হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন ইউনিভাসিটিতে স্কলারশীপ পেয়ে যায় ফিরোজ। একদিকে আনন্দ অন্যদিকে কষ্টের নীলনকশা আঁকা হচ্ছিল আমার ভেতরে ভেতরে। ফিরোজ প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই তো আমি চেয়েছি তবে কেন এতোটা কষ্ট! কিসের এতো যন্ত্রণা? ভাবছি এবার ফিরোজকে সরাসরি প্রপোজ করবো। প্রায় এক সপ্তাহ ফিরোজ নিরুদ্দেশ। হলের ভেতর রাখা ওর কিছু বই আর জামাকাপড় পড়ে আছে। সবাই যার যার মতো করে খুঁজে চলেছি কিন্তু ফিরোজ নিখোঁজ। এদিকে রেজাল্টের পর বাবা বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খুঁজছে। আমাদের কুমিল্লার কয়েকজন ভার্সিটিতে এসে নাকি আড়ালে দেখেটেখেও গেছে। অথচ আমার পুরো আত্মাটা জুড়ে যে ফিরোজ। ফিরোজকে কেউই খুঁজে পাচ্ছি না। বন্ধুদের সাথে হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে সমস্ত রকমের যোগাযোগ। এদিকে সীমাব জোঁকের মতো লেগে আছে আমার সাথে। কতো অপমান যে করেছি ওকে। তবুও সরেনি। বন্ধুদের না বলে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে ফিরোজ এটাও ভাবা যায় না। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সময় পেরিয়ে গেল। প্রায় এক বছর পর তৌহিদের সাথে দেখা। তৌহিদ আমার ব্যাপারে জানতো সবটাই। কথা প্রসঙ্গে এলো ফিরোজের কথা। ফিরোজ দেশেই আছে শুনে অবাক হলাম। এতো ভালো অপর্চুনিটি কেউ মিস করে! আর্শ্চয হলাম। ‘ওর খবর কাউকে দিতে নিষেধ করেছে এমনকি তোকেও না’ আমাকেও নাহ! এতো কষ্ট মনে হয় জীবনে আগে কোনদিন পাইনি। ফিরোজ জানতো আমি ওকে খুঁজে বের করবোই যে কোনো মূল্যে। তৌহিদও নাছোরবান্দা। তৌহিদ খুঁজতে খুঁজতে একদিন পৌঁছে যায় সাভার ইপিজেড-এর কাছাকাছি বলিভদ্র বাজারে। আমাকে দেখে ওতো অবাক! ওকে দেখে আমিও। এতো স্মার্ট এবং ব্রিলিয়েন্ট একটা ছেলের এ কী- অবস্থা? একটা স্যাঁতসেঁতে রুম, তার ভেতর কিছু বই আর জামাকাপড়, সিগারেটের এস্ট্রেটা ঠিক আছে। খায় কোথায়, কী করে কিছুই বললো না। একমনে শুনে যাচ্ছিলাম তৌহিদের কথা। রুপাকে কি ফিরোজ ভুলে গেছে তৌহিদ? ও কি জিজ্ঞেস করেছে আমি কেমন আছি? আমি তো একজন মেয়ে। আমার চাকরি হয়েছে। ঢাকার বাহিরে আমার পোস্টিং। বাবা অস্থির হয়ে গেছে আমার বিয়ে দেবার জন্য। “দেখ, ওর কোনো মোটিভ বোঝা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে ও এই পৃথিবীর কোন আশা, মোহ এসবের মধ্যেই নেই; বলেছে, সবার কথাই জিজ্ঞেস করেছে । জিজ্ঞেস করছিল তোর বিয়ে হয়েছে কিনা। কোথায় থাকিস ইত্যাদি”। আমি বাকরুদ্ধ! যাকে নিয়ে স্বপ্নের উচুঁ পাহাড় তৈরি করেছিলাম মনে মনে সে তো কোনদিন আমার হয়ই নি ! চোখের পানি বাঁধ মানছিলো না। অপ্রতিরোধ্য গতিতে বয়েই চলেছে। পরদিন সকাল সকাল গিয়ে হাজির হলাম ওখানে অথচ সবটাই শূন্য। বেশ বিচক্ষণ আর মেধাবী ছিল যে! হয়তো ও বুঝে গিয়েছিল আমি ঠিক পৌঁছাবো। আহত হলাম। ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলাম। পুরোপুরি বুঝতে পারলাম। আমার মনে ও ছিল আজো আছে ঠিকই কিন্তু ওর মনে আমি কোনদিন প্রেমিকার অবস্থানে ছিলামই না। তারপর চেনা পরিচিত কোনো জায়গায় ফিরাজকে দেখা যায়নি প্রায় দশ বছর। কেউ তার কোনো খোঁজ পায়নি। ইতোমধ্যে জানা গেলো মতলব দক্ষিণের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে জয়েন করেছেন বেশ নিরহংকারী এবং সুন্দরী একজন ভদ্রমহিলা। গরিব, এতিম মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির বিষয়ে এক লোক অপেক্ষা করছে ইউ.এন.ও অফিসারের অফিস করিডোরে। অদ্ভুত এক লোক ! চুল দাড়িতে মুখ সম্পূর্ণ ঢাকা। লাল একটি সেলাইবিহীন কাপড়ে আমাদমম্ভক মোড়ানো। ছিপছিপে হাড্ডিসার দেহের অধিকারী অথচ বাচনভঙ্গি এবং আচার আচরণে বেশ দূর থেকে স্পষ্ট র্স্মাটনেস বা মুখোমুখি বসেও বোঝার উপায় নেই কে এই লোক! মনে হবে কোন সাধু সন্ন্যাসী, মূর্খ আর গরিব। ইউ.এন.ও অফিসে ঢোকা মাত্রই চোখ আটকে গেলো বেশ ব্যাতিক্রম এই ব্যক্তিকে দেখে। পাশে বসা সাত আটজন অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে। ইউ.এন.ও অফিস সহকারীকে দিয়ে সর্বপ্রথমে ডেকে পাঠালেন লোকটিকে।রুমে ঢুকেই লোকটি অবাক! ইউ. এন.ও একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। আর সেই লোকের দৃষ্টি তার মুখের দিকে। আটসাট শাড়ি, কপালে টিপ, হালকা টমেটো লাল লিপস্টিক, মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণে বেশ বিমোহিত মনে হঠাৎ বলে ওঠে; জারুল রং তো আপনার খুব পছন্দ ছিলো। জারুল লিপস্টিক, জারুল রংয়ের শাড়ি, জারুল ফুল। তবে এখন কেন আপেল টমেটো রং? আপনার হাজব্যান্ড বুঝি আপেলের মতো দেখতে? কি সব বাজে বকছেন! এতো রাগ করছেন কেন? রাগের মাথায় কোনো কাজ সঠিকভাবে করা যায় না। সিদ্ধান্তে ভুল হয়ে যায়। রাগের মাথায় নিজের প্রেমিককে হারিয়ে বান্ধবীর প্রেমিককে জব্দ করতে গিয়ে তো নিজেই জব্দ হয়েছিলেন। এরপর বিয়েটা কার সাথে হলো! আপনাকে যে প্রাণভরে ভালোবাসতো তার সাথেই তো! মাঝখান থেকে বেচারাকে নিয়ে খেললো স্বর্ণা। এখন আর এই সন্ন্যাসী টাইপ লোকটার সামনে থেকে চোখ সরাতে পারছেন না ইউ.এন.ও। সব কেমন যেন হানড্রেড পারসেন্ট মিলে যাচ্ছে। উনি কি তবে সত্যি কোনো সাধু সন্ন্যাসী? সব জানেন কী করে? আর এতো ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলে যাচ্ছেন। অনেকক্ষণ কথা বলার পর ইউ.এন.ও জিজ্ঞেস করলো আপনি কে সত্যি করে বলুন তো? কেন আমাকে কি আপনার চেনা মনে হচ্ছে? দেখুন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করা আমার একদম পছন্দ না। আগে তো এতো রাগ করতে নাহ কথায় কথায়! এখন কি পাওয়ারে বদলে গেছ? সারাদেশে এত জায়গা থাকতে সেই দিনাজপুর থেকে এখানে ট্রান্সফার হয়ে এলে যে? এতো ভালোবাসতে তাকে যার টানে তার এলাকার ভালো মন্দের দায়িত্ব নিতে চলে এলে? বিয়েতো তাকেই করেছ যে তোমাকে ভালোবাসতো। পৃথিবাটা কতো স্বার্থপর তাই না শারমিন!এবার চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেল ইউ.এন.ও শারমিন রহমান। কে আপনি? আপনি এতো কিছু জানেন কিভাবে? কর্মক্ষেত্রে হাজারো কঠোরতা দেখালেও মেয়েদের মন একটু কোমলতায় ভরপুর থাকে সর্বদা। অনেক কিছু ভাবা হয়ে গেছে এতোক্ষণে ! আবারও প্রশ্নটা রিপিট করলো। তুমি আমাকে সত্যিই চিনতে পারছো না নাহ! তবে আপনার কণ্ঠ, বাচনভঙ্গি আমার খুব চেনা কিন্তু আমি যাকে ভাবছি সে আপনি নন। হতেই পারে না। ‘কেন পারে না।আমি কি আপনার ভালোবাসার মানুষ নই?’ এবার সত্যি সত্যি পাগল বলে একপ্রকার অপমান করার অবস্থা। কুল কুল বলে ইউ.এন.ও শারমিন রহমানকে শান্ত করে সন্ন্যাসী বললো! আমার উপর আপনার রাগের কারণ হচ্ছে আপনি আমার সাথে ফিরোজকে মিলাতে পারছেন না। তাই তো! এবার শারমিনের চোখ বড় বড়, প্রেসার বাড়ছে। ফিরোজের নাম এই লোক জানে কী করে। আর কী কী জানে। সন্ন্যাসীর জিজ্ঞাসা, আপনি আমার ছেলেমেয়েগুলোকে বিনাখরচে ভর্তি এবং পড়াশুনার একটা ব্যবস্থা করে দিন। আমি আপনার সমস্যার সমাধান দিচ্ছি। আপনার কাগজপত্র দেখে আমি সিদ্ধান্ত দেব। তবে দুএকদিন পর জানাতে পারবো। ঠিক আছে তবে আমিও দুএকদিন পর এসে আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাব। উঠে যাওয়ার উপক্রম হলে ইউ.এন.ও শারমিন রহমানের বাধা। এই দুই দিন টেনশনে আধমরা হয়ে যাবো নিজেই বিড়বিড় করছে। আচ্ছা ঠিক আছে আমি কথা দিলাম আপনার কাজ আমি করে দিব। আচ্ছা বেশ। তবে আমার চোখের দিকে তাকাও। বুঝতে পারবে। ইম্পসিবল, আপনি কি আমাকে বোকা পেয়েছেন? এখন হিপ্নোটাইজ করে অনেক ক্রাইম হচ্ছে। আপনার উদ্দেশ্য ভালো না, আপনি আসুন। আর আপনি আমাকে তুমি সম্বোধন কেন করছেন? আমি চলে গেলে তোমার অস্থিরতা আরো বাড়বে সেটা কি ভালো হবে? জানতে ইচ্ছে করছেনা আমি এতো কিছু জানি কি করে? মাথা নীচু, তাহলে ভালো করে তাকাও আমার দিকে। তুমি মনে মনে যাকে ভাবছো তাকে মিলিয়ে দেখোতো আমার সাথে।পথে চলে যেতে কোথা কোনখানে তোমার পরশ আসে... রবীন্দ্রনাথের গানটি যেন আলতো করে ছুঁয়ে গেল মন। অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তুমি ফিরোজ ভাই! এ কী অবস্থা তোমার ! হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এলো দুজনেরই। কতো বছর পর তাই না! সেই এক বছরের বড় হয়ে তোমার ফিরোজ ভাই ই হয়ে রইলাম। তোমাকে কতোনা খুঁজেছি ! বিশেষ করে রুপা তোমার অপেক্ষায় থেকে থেকে পাঁচ বছর আগে সীমাবকে বিয়ে করলো। যাক শুনে খুশি হলাম। তুমি বিয়ে করোনি? আর এমন অবস্থা কেন তোমার? কোথায় থাক? কী কর? আরে ওয়েট ওয়েট। এতো প্রশ্নের জবাব এক সাথে কী করে দেব? প্রথমত আমি কিছুই করি না। মানে করি অনেক কিছুই কিন্তু তা নিজের জন্য না। আর বিয়ে! আমার মতো পাগল, সংসার ছাড়া ছন্ন জীবনে কে আসবে? কেন আসবে।তার চেয়েও বড় কথা হলো আমি আমৃত্যু চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কোথায় থাকি? আমার নির্দিষ্ট কোনো থাকার জায়গা নেই। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই। পাহাড়, বন-জঙ্গল, মসজিদ-মাদ্রাসায় মাঝে মাঝে আমাকে খুঁজে পাবে। এক অন্য জীবন! তুমি বুঝবে না। যখন এই জগতের মানুষ বিপদে পড়ে আমাকে ডাকে, আমি ধ্যান ভগ্ন হয়ে যাই। আমাকে তাদের কাছে আসতে হয় তাদের প্রয়োজনে। ফিরোজের অদ্ভুত কথা শুনে শরীরে কাটা দিচ্ছিল। তোমার এতো সুন্দর ভবিষ্যত থাকতে তুমি এই পথে কোনো গেলে! ভবিষ্যত! তুমি কী করে বুঝলে আমার সুন্দর ভবিষ্যত ছিল। এই যে আমাকে দেখছো তোমার হিসেব মতো আজকের এই বর্তমানটাই তো সেই সময়ের সুন্দর ভবিষ্যত। তাই না! তবে হ্যাঁ পার্থিব জীবনের মোহ থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি। আজকের পর হয়তো তোমার সাথে আর কখনো দেখাও হবে না; আবার হয়তো হবে। অনেক কথার গল্প শেষে ফিরোজ বিদায় নিল। এই যুগেও কেউ এমন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে কী করে? তাও আবার পাহাড়ের পাদদেশে গহীন অরণ্যে। কোথাও কেউ নেই এমন এমন জায়গায়। এরপর তিনবছর শারমিন কাজের ফাঁকে খুজঁতে থাকে প্রায়ই ফিরোজকে। গন্তব্যহীন ফিরোজ ফিরে আসেনি। এর মাঝে শারমিন ফোনে আমাকে সবটা জানায়। তার মা বাবা মারা গেছে দুজনই। খোঁজ নিয়ে ফিরোজের গ্রামের বাড়ি রারিকান্দি গিয়ে হাজির আমি আর শারমিন। এই সেই বাড়ি যেখানে একদিন আমরা সবাই মিলে হৈচৈ করতে করতে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি গিয়ে ফিরোজের এক চাচা ছাড়া আর কাউকেই পেলাম না। ওনার কাছ থেকে জানতে চাইলাম ফিরোজের নিরুদ্দেশ হওয়ার রহস্য! এক দীর্ঘশাস ছেড়ে বলতে শুরু করলেন, “এমন-মেধাবী তরতাজা ছেলেডা কেন যে এমন হইয়া গেলো, কিছুই কইতে পারমু না। ওর মায় একবার কইছিলো আমার লগে, অয় যহন ছয় মাসের পেডে তহন ওর মারে স্বপ্নে দেখাইছিলো খাজা আসছে তোর ঘরে। এই ছেলেরে তুই মাদ্রাসায় পড়াইবি। জন্মের পাঁচদিন পর যখন নাম রাখার দিন এলো তখন একেক জন একেক নাম রাখার প্রস্তাব দেয়। বাড়িত তহন কেউই আছিল না। ওর বাপ আর আমার ছোড এক ভাই সুজাতপুর বাজার গেল বাজার করতে। ফিরা আইসা শুনে অর নাম ঠিক হইয়া গেছে। সাঁঝের বেলায় অর মায় অরে কোলে নিয়া বইসা ছিল, হঠাৎ পশ্চিমের আকাশ থিকা দ্বৈব আওয়াজ এলো ‘খাজা খাইরুদ্দিন’। ‘খাজা খাইরুদ্দিন’। অর মায় দেখলো অর কপালে তহন জোনাকি পোকের মতো আলো জ্বলজল করতাছে! অর মায় ডরায়া গেলো। আবার স্বপ্নের কথা মনে করল। এই কথা প্রথ্থম আমারে জানাইলো। আমি সবাইরে কইলাম অর নাম খাজা খাইরুদ্দিন হউক, তাই হইল, কিন্তু অর বাপ আর আমার ছোট ভাই অরে মাদ্রাসায় পরাইতে রাজি হইলো না। এই ছেলেরে দুনিয়ার কোন কিছু টানে না, ছোডবেলা থিকাই মসজিদ মাদ্রাসায় সুযোগ পাইলেই চইলা যাইতো। আইতে চাইতো না। কী যে অইলো। অহন মাঝেমধ্যে আহে মন চাইলে। কই থাহে কিছুই কয় না। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুইরা বেড়ায়, ধ্যান করে। মসজিদ-মাদ্রাসায় মাঝে মধ্যে আরবি থিকা বাংলায় তরজমা কইরা মাইনসেরে বুঝায়। গরিব বাচ্চাগো সেবা করে। বাড়িত আইলে আমরা চাচা ভাতিজা খোলা আসমানের নিচে গল্প করতে করতে রাইত কাটাইয়া দেই”। প্রশ্ন করলাম, শেষবার কি গল্প হয়েছিল ফিরোজ মানে খাজার সাথে আপনার, মনে আছে? আছে। ওরে জিগাইছিলাম, বিয়ে সাদী করামু নাকি? কী বললো ! কইলো আমার জন্য সংসার না চাচা। শেষবার আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল আমেনা নামের একটি মেয়ে। ব্যর্থ হয়ে অনেক কেঁদেছে। আমার গুরুজির নাতনী। গুরুজি আমাকে পরীক্ষা করতে টানা কয়েক রাত ডেমরার কবরস্থানে ফেলে রেখেছিল ধ্যানসাধনায়। শারীরিক সমস্যা কিংবা জৈবিক চাহিদা জাগ্রত কিনা পরীক্ষার জন্য আমাকে ডক্তার দেখালেন। যৌন উত্তেজক ঔষধ খাওয়ালেন। কিছুতেই তিনি সফল হলেন না। মুন্সীগঞ্জের শাহালম গুরুজিকে বললো অতো বিশাল সমুদ্রে কয়েকটি ট্যাবলেট ফেলে কোন লাভ নেই গুরুজি। নির্জন একাকীত্ব সাধানায় খাজা খাইরুদ্দিন সফল। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে; কোন দিকে যাবো বুঝতে পারছি না। ফিরোজ কবে আসবো আর আসবো কিনা, কোনহানে আছে কিছু জানি না। কোন পাহাড়ের কোন নিরালায় বইসা ধ্যান করতাছে তোমরাই বার কর মা। আমি এই আছি তো এই নাই। খোদার ডাক আসলে কহন চইলা যাই! ফিরোজের চাচা হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে আমাদের বিদায় দিলেন আর বিড়বিড় করতে করতে একদিকে চলে গেলেন। আমার আর শারমিনের চোখের ওপর ঝাপসা আবরণ। কলাপাতার মতো বাতাসে দুলছে আমার সব ভাবনা। এতো মেধাবী ফিরোজ, কেনোইবা এতো ভালো রেজাল্ট করার পরও স্কলারশীপ পাওয়ার পরও সে সুযোগটা গ্রহণ করেনি? কেনো এমন একটা র্স্মাট দুরন্তপনায় হাতছানি দেয়া যুবক এলোমেলো হয়ে গেলো! কে এই গুরুজি? কেনোইবা ধ্যানমগ্ন পৃথিবীতে ও চলে গেল। এই পৃথিবীর মায়া মমতা থেকে বিচ্ছিন্ন ফিরোজের একবারও কি ?রুপার কথা মনে পড়ে না? হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে ভাবতে শারমিন আর আমি দূর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে,সূর্য তখন অস্তাচলে।

back to top