কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার একটি চিংড়ি ঘের। এবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে চিংড়ি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে -সংবাদ
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়িজোনের মৎস্যভান্ডার চলতি মৌসুমে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈরী আচরণে এবার বেশিরভাগ ঘেরে চিংড়িসহ রকমারি মাছ উৎপাদনে ব্যাপকহারে ধস নেমেছে। এতে করে হাজারো চিংড়ি চাষি উৎপাদিত মাছ বিক্রি করে বিনিয়োগকৃত টাকা উদ্ধারের বদলে এবছর ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে চিংড়িজোনে অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে মাছ চাষের সোনালী সুদিনের।
স্থানীয় ঘের মালিক ও চিংড়ি চাষিরা জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমে প্রকৃতি খুবই বৈরী আচরণ করেছে। তেমন বৃষ্টি হয়নি, গরম ছিল বেশি। বন্যাও হয়নি। ফলে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে চিংড়ি ঘেরে কয়েক দফা মড়ক দেখা দেয়। এছাড়া পলিমাটি জমে বেশিরভাগ চিংড়ি ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়ার কারণেও মাছ উৎপাদন আগেকার বছরগুলোর চেয়ে তুলনামূলক কমে গেছে। অন্যদিকে প্যারাবন নিধন করে এবং চিংড়িজোনের পানি নিষ্কাশনে সচল প্রবহমান খালগুলো কতিপয় প্রভাবশালী চক্র কর্তৃক দখল করে অবৈধভাবে বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ করার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে চিংড়িসহ রকমারি মাছ চাষের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
চকরিয়া উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনের রামপুর, বদরখালী, খুটাখালী, বহলতলী ও ডুলাহাজারা মৌজার ৬ হাজার ৮২৮টি ঘেরে ৮ হাজার ৪২০ টন, ২০২৩ সালে ৭ হাজার ৪৪৭টি ঘেরে ৯ হাজার ২১৬ টন, ২০২৪ সালে ৭ হাজার ৭৬৪টি ঘেরে ৯ হাজার ৫১৬ টন চিংড়ি এবং অন্য প্রজাতির মাছ উৎপাদন হয়।
কিন্তু চলতি মৌসুমে উল্লেখিত পরিমাণ ঘেরে মাছ চাষ করা হলেও প্রকৃতির বৈরী আচরণের কারণে মাছ উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় চিংড়ি চাষিরা। ইতোমধ্যে চলতি বছরের চিংড়ি চাষের মৌসুম প্রায় শেষ হয়ে গেছে। গত একমাস আগে থেকে চিংড়িজোনের বেশিরভাগ এলাকার ঘেরগুলো শুকিয়ে লবণ চাষের জন্য এবং কিছু কিছু ঘেরের সংস্কার কাজ করে আগামী বছরের জন্য ফের চাষের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চিংড়িজোনে বর্তমানে ৯ হাজার ৫৮৯টি মৎস্য ঘের সরকারিভাবে নিবন্ধিত রয়েছে। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে অর্থাৎ ৯ হাজার ৫৮৯টি ঘেরে আগেরবারগুলোতে আশাজাগানিয়া মাছ উৎপাদন হলেও এবছর বৈরী আবহাওয়া এবং ঘেরগুলোতে নির্ধারিত পরিমাণ গভীরতা না থাকায় চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন কমে গেছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার মধ্যে চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়িজোন এরিয়াটি ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর বা ৫৬ হাজার একর জমি নিয়ে পরিবেষ্টিত। এত বিশাল আয়তনের জমি মৎস্য ভান্ডারের অবস্থান আর দেশের কোথাও নেই।
এছাড়া চকরিয়ার চিংড়িজোন এরিয়াটি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর
থেকে চিংড়িসহ রকমারি মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এবছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছেন হাজারো মৎস্য চাষিরা।
জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ারুল আমিন বলেন, চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোন দেশের মধ্যে একটি বিশাল মৎস্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। অথচ এবছর প্রকৃতির বৈরী আচরণ, ঘের লাগোয়া প্রবহমান খাল বন্ধ করে কতিপয় মহলের অবৈধ চাষ, বেশিরভাগ ঘেরে গভীরতা কমে যাওয়া এবং পোনা সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাপকহারে কমে গেছে।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনের রামপুর মৌজায় ঘেরের চারদিকে ৭২ কিলোমিটার এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ এবং জোয়ার-ভাটার পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে ২৩টি আধুনিকমানের স্লুইসগেইট নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ঘেরের বাইরে বেড়িবাঁধে ইতোমধ্যে প্রায় ৩ লাখ বাইন ও কেওড়া গাছ লাগিয়ে প্যারাবন সৃজন করা হয়েছে। চলমান এসব উন্নয়ন কাজ অনেকটা সম্পন্ন হওয়ার পথে। এছাড়াও চিংড়ি ঘের এলাকার প্রবাহমান খালের দুপাশে প্যারাবন সৃষ্টির মাধ্যমে চিংড়ি চাষের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যও মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
প্রতিবছর চিংড়িজোনের রামপুর, বদরখালী, বহলতলী, খুটাখালী ও ডুলাহাজারা মৌজার অধীনে চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের চরণদ্বীপ, সাহারবিল ইউনিয়নের রামপুর, বদরখালী, ইলিশিয়া, দরবেশকাটা, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী ইউনিয়নের বহলতলী, বদরখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা ও কোনাখালী ইউনিয়নের অন্তত ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে চিংড়িসহ রকমারি মাছ চাষ হলেও দীর্ঘ বছর পর এবারই প্রকৃতির বৈরী আচরণের কারণে মাছ উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০০৫ সালে চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোন এলাকায় ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৯ হাজার ৫০৬ টন চিংড়ি উৎপাদন হতো, সেখানে বর্তমানে তা ৪ হাজার টনে এসে দাঁড়িয়েছে।
চকরিয়া উপজেলার রামপুর এলাকার চিংড়ি চাষি ও সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আজিজুল হাকিম বলেন, এক সময় প্রতি হেক্টর চিংড়ির জমিতে ৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হতো, যা বর্তমানে ২০০ কেজির নিচে নেমে এসেছে। ফলে বেশিরভাগ ঘের মালিক পুঁজি হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
উপজেলার পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়নের দরবেশকাটা এলাকার চিংড়ি চাষি মাওলানা শহিদুল ইসলাম বলেন, চিংড়ি ঘেরের ওপর দিয়ে প্রবাহমান প্রায় ১১টি খাল অবৈধ দখলদাররা দখল করে পানি চলাচল বন্ধ করে মাছ চাষ করছে। ফলে জোয়ার-ভাটার পানি চলাচল বন্ধ হয়ে চিংড়ি ঘেরে প্রয়োজনীয় লবণাক্ত পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে চিংড়ি চাষ প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একইসঙ্গে প্যারাবন নিধন করে অনেক চিংড়ি ঘের সম্প্রসারণ করার কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান মাহমুদ বলেন, একসময় চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে সুন্দরবনের চিংড়িসহ অন্য মাছ উৎপাদনের চমৎকার পরিবেশ ছিল। বর্তমানে সেখানে আগের পরিবেশ নেই।
রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় কতিপয় দখলবাজ চক্রের লোকজন ঘের লাগোয়া বেশিরভাগ প্যারাবন নিধন করে মাছ চাষের পরিধি বাড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে চিংড়িজোনে মাছ উৎপাদন আরও কমে যাবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ বছর মৎস্য বিভাগ ও কয়েকটি এনজিও সংস্থা কর্তৃক চিংড়িজোন এলাকায় গাছের চারা রোপণ করে প্যারাবন সৃষ্টির কাজ করেছেন।
চকরিয়া উপজেলার অন্যতম বৃহত্তর চিংড়ি চাষি ও কক্সবাজার জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আবু তৈয়ব বলেন, চলতি বছর প্রায় ১ হাজার একর জমিতে চিংড়ি চাষ করেছি। বিনিয়োগ করেছি প্রায় ১ কোটি টাকার বেশি। মৌসুমের শেষ সময় পর্যন্ত ঘের থেকে চিংড়ি ও অন্য প্রজাতির মাছ বিক্রি করে পেয়েছি ৭০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকার মতো। এ অবস্থায় এ বছর বিশাল অঙ্কের ঘাটতির মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি। অথচ গত মৌসুমে তিনি কোটি টাকার বেশি মাছ উৎপাদন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন।
মৎস্য চাষি আবু তৈয়ব বলেন, চলতি বছর অনাবৃষ্টির কারণে বেশিরভাগ ঘেরে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে কয়েক দফা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। আবার বৃষ্টি হলেও চলতি মৌসুমে বড় আকারে বন্যা হয়নি। ফলে অতিরিক্ত গরমের কারণে ঘেরের পানিতে তারতম্য সৃষ্টি হয়ে মড়কের প্রার্দুভাব দেখা দেয়। এতে করে মাছ উৎপাদনে ধস নেমেছে।
সাহারবিল ইউনিয়নের রামপুর এলাকার চিংড়ি চাষি নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি ২০০ একর জমিতে চিংড়ি চাষ করে মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার মাছ পেয়েছেন। এর মধ্যে চিংড়ি ২০০ কেজির বেশি হবে না।
তিনি দাবি করেন, গত মৌসুমে লবণের ন্যায্যমূল্যও পাননি। চলতি মাছ মৌসুমে উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ করা পুঁজি ওঠানো সম্ভব হবে না। তিনি এ পরিমাণ জমিতে চিংড়ি চাষাবাদ করে অন্য বছর ৩০-৪০ লাখ টাকা আয় করতেন।
চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনে মাছ চাষে সুদিন ফেরানোর দাবি জানিয়েছেন উপকুলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা ও চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্ট। তিনি বলেন, চিংড়ি ঘেরে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা উন্নতি ও ঘের মালিক চাষিদের জিম্মি করে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে চিংড়ি ঘেরে প্রতি জো-তে চাঁদাবাজি ও ডাকাতের তাণ্ডব বন্ধ করা সম্ভব হলে চিংড়িজোনে সোনালী সুদিন ফিরে আসবে।
উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়িজোনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে চকরিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, চিংড়িজোনের নানাবিধ অপরাধ-অপকর্মের বিষয়ে পুলিশ সর্বদা সজাগ রয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতিতে ঘের মালিক চাষিরা ক্ষতির শিকার হলে অভিযোগ পাওয়া মাত্র অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, চিংড়িজোন এরিয়াটি পানি পথ হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থা অনেকটা অনুন্নত। তাই পুলিশ ইচ্ছে করলেই নিয়মিত সেখানে টহলে যেতে পারে না। তারপরও আমরা চিংড়িজোনে টহল তৎপরতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার একটি চিংড়ি ঘের। এবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে চিংড়ি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে -সংবাদ
শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়িজোনের মৎস্যভান্ডার চলতি মৌসুমে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈরী আচরণে এবার বেশিরভাগ ঘেরে চিংড়িসহ রকমারি মাছ উৎপাদনে ব্যাপকহারে ধস নেমেছে। এতে করে হাজারো চিংড়ি চাষি উৎপাদিত মাছ বিক্রি করে বিনিয়োগকৃত টাকা উদ্ধারের বদলে এবছর ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে চিংড়িজোনে অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে মাছ চাষের সোনালী সুদিনের।
স্থানীয় ঘের মালিক ও চিংড়ি চাষিরা জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমে প্রকৃতি খুবই বৈরী আচরণ করেছে। তেমন বৃষ্টি হয়নি, গরম ছিল বেশি। বন্যাও হয়নি। ফলে পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে চিংড়ি ঘেরে কয়েক দফা মড়ক দেখা দেয়। এছাড়া পলিমাটি জমে বেশিরভাগ চিংড়ি ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়ার কারণেও মাছ উৎপাদন আগেকার বছরগুলোর চেয়ে তুলনামূলক কমে গেছে। অন্যদিকে প্যারাবন নিধন করে এবং চিংড়িজোনের পানি নিষ্কাশনে সচল প্রবহমান খালগুলো কতিপয় প্রভাবশালী চক্র কর্তৃক দখল করে অবৈধভাবে বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ করার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে চিংড়িসহ রকমারি মাছ চাষের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
চকরিয়া উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনের রামপুর, বদরখালী, খুটাখালী, বহলতলী ও ডুলাহাজারা মৌজার ৬ হাজার ৮২৮টি ঘেরে ৮ হাজার ৪২০ টন, ২০২৩ সালে ৭ হাজার ৪৪৭টি ঘেরে ৯ হাজার ২১৬ টন, ২০২৪ সালে ৭ হাজার ৭৬৪টি ঘেরে ৯ হাজার ৫১৬ টন চিংড়ি এবং অন্য প্রজাতির মাছ উৎপাদন হয়।
কিন্তু চলতি মৌসুমে উল্লেখিত পরিমাণ ঘেরে মাছ চাষ করা হলেও প্রকৃতির বৈরী আচরণের কারণে মাছ উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় চিংড়ি চাষিরা। ইতোমধ্যে চলতি বছরের চিংড়ি চাষের মৌসুম প্রায় শেষ হয়ে গেছে। গত একমাস আগে থেকে চিংড়িজোনের বেশিরভাগ এলাকার ঘেরগুলো শুকিয়ে লবণ চাষের জন্য এবং কিছু কিছু ঘেরের সংস্কার কাজ করে আগামী বছরের জন্য ফের চাষের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চিংড়িজোনে বর্তমানে ৯ হাজার ৫৮৯টি মৎস্য ঘের সরকারিভাবে নিবন্ধিত রয়েছে। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে অর্থাৎ ৯ হাজার ৫৮৯টি ঘেরে আগেরবারগুলোতে আশাজাগানিয়া মাছ উৎপাদন হলেও এবছর বৈরী আবহাওয়া এবং ঘেরগুলোতে নির্ধারিত পরিমাণ গভীরতা না থাকায় চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন কমে গেছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার মধ্যে চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়িজোন এরিয়াটি ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর বা ৫৬ হাজার একর জমি নিয়ে পরিবেষ্টিত। এত বিশাল আয়তনের জমি মৎস্য ভান্ডারের অবস্থান আর দেশের কোথাও নেই।
এছাড়া চকরিয়ার চিংড়িজোন এরিয়াটি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর
থেকে চিংড়িসহ রকমারি মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এবছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছেন হাজারো মৎস্য চাষিরা।
জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ারুল আমিন বলেন, চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোন দেশের মধ্যে একটি বিশাল মৎস্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। অথচ এবছর প্রকৃতির বৈরী আচরণ, ঘের লাগোয়া প্রবহমান খাল বন্ধ করে কতিপয় মহলের অবৈধ চাষ, বেশিরভাগ ঘেরে গভীরতা কমে যাওয়া এবং পোনা সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাপকহারে কমে গেছে।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনের রামপুর মৌজায় ঘেরের চারদিকে ৭২ কিলোমিটার এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ এবং জোয়ার-ভাটার পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে ২৩টি আধুনিকমানের স্লুইসগেইট নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ঘেরের বাইরে বেড়িবাঁধে ইতোমধ্যে প্রায় ৩ লাখ বাইন ও কেওড়া গাছ লাগিয়ে প্যারাবন সৃজন করা হয়েছে। চলমান এসব উন্নয়ন কাজ অনেকটা সম্পন্ন হওয়ার পথে। এছাড়াও চিংড়ি ঘের এলাকার প্রবাহমান খালের দুপাশে প্যারাবন সৃষ্টির মাধ্যমে চিংড়ি চাষের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যও মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
প্রতিবছর চিংড়িজোনের রামপুর, বদরখালী, বহলতলী, খুটাখালী ও ডুলাহাজারা মৌজার অধীনে চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের চরণদ্বীপ, সাহারবিল ইউনিয়নের রামপুর, বদরখালী, ইলিশিয়া, দরবেশকাটা, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী ইউনিয়নের বহলতলী, বদরখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা ও কোনাখালী ইউনিয়নের অন্তত ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে চিংড়িসহ রকমারি মাছ চাষ হলেও দীর্ঘ বছর পর এবারই প্রকৃতির বৈরী আচরণের কারণে মাছ উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০০৫ সালে চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোন এলাকায় ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৯ হাজার ৫০৬ টন চিংড়ি উৎপাদন হতো, সেখানে বর্তমানে তা ৪ হাজার টনে এসে দাঁড়িয়েছে।
চকরিয়া উপজেলার রামপুর এলাকার চিংড়ি চাষি ও সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আজিজুল হাকিম বলেন, এক সময় প্রতি হেক্টর চিংড়ির জমিতে ৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হতো, যা বর্তমানে ২০০ কেজির নিচে নেমে এসেছে। ফলে বেশিরভাগ ঘের মালিক পুঁজি হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
উপজেলার পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়নের দরবেশকাটা এলাকার চিংড়ি চাষি মাওলানা শহিদুল ইসলাম বলেন, চিংড়ি ঘেরের ওপর দিয়ে প্রবাহমান প্রায় ১১টি খাল অবৈধ দখলদাররা দখল করে পানি চলাচল বন্ধ করে মাছ চাষ করছে। ফলে জোয়ার-ভাটার পানি চলাচল বন্ধ হয়ে চিংড়ি ঘেরে প্রয়োজনীয় লবণাক্ত পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে চিংড়ি চাষ প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একইসঙ্গে প্যারাবন নিধন করে অনেক চিংড়ি ঘের সম্প্রসারণ করার কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান মাহমুদ বলেন, একসময় চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলে সুন্দরবনের চিংড়িসহ অন্য মাছ উৎপাদনের চমৎকার পরিবেশ ছিল। বর্তমানে সেখানে আগের পরিবেশ নেই।
রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় কতিপয় দখলবাজ চক্রের লোকজন ঘের লাগোয়া বেশিরভাগ প্যারাবন নিধন করে মাছ চাষের পরিধি বাড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে চিংড়িজোনে মাছ উৎপাদন আরও কমে যাবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ বছর মৎস্য বিভাগ ও কয়েকটি এনজিও সংস্থা কর্তৃক চিংড়িজোন এলাকায় গাছের চারা রোপণ করে প্যারাবন সৃষ্টির কাজ করেছেন।
চকরিয়া উপজেলার অন্যতম বৃহত্তর চিংড়ি চাষি ও কক্সবাজার জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আবু তৈয়ব বলেন, চলতি বছর প্রায় ১ হাজার একর জমিতে চিংড়ি চাষ করেছি। বিনিয়োগ করেছি প্রায় ১ কোটি টাকার বেশি। মৌসুমের শেষ সময় পর্যন্ত ঘের থেকে চিংড়ি ও অন্য প্রজাতির মাছ বিক্রি করে পেয়েছি ৭০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকার মতো। এ অবস্থায় এ বছর বিশাল অঙ্কের ঘাটতির মুখোমুখি হচ্ছেন তিনি। অথচ গত মৌসুমে তিনি কোটি টাকার বেশি মাছ উৎপাদন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন।
মৎস্য চাষি আবু তৈয়ব বলেন, চলতি বছর অনাবৃষ্টির কারণে বেশিরভাগ ঘেরে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে কয়েক দফা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। আবার বৃষ্টি হলেও চলতি মৌসুমে বড় আকারে বন্যা হয়নি। ফলে অতিরিক্ত গরমের কারণে ঘেরের পানিতে তারতম্য সৃষ্টি হয়ে মড়কের প্রার্দুভাব দেখা দেয়। এতে করে মাছ উৎপাদনে ধস নেমেছে।
সাহারবিল ইউনিয়নের রামপুর এলাকার চিংড়ি চাষি নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি ২০০ একর জমিতে চিংড়ি চাষ করে মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার মাছ পেয়েছেন। এর মধ্যে চিংড়ি ২০০ কেজির বেশি হবে না।
তিনি দাবি করেন, গত মৌসুমে লবণের ন্যায্যমূল্যও পাননি। চলতি মাছ মৌসুমে উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ করা পুঁজি ওঠানো সম্ভব হবে না। তিনি এ পরিমাণ জমিতে চিংড়ি চাষাবাদ করে অন্য বছর ৩০-৪০ লাখ টাকা আয় করতেন।
চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনে মাছ চাষে সুদিন ফেরানোর দাবি জানিয়েছেন উপকুলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা ও চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্ট। তিনি বলেন, চিংড়ি ঘেরে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা উন্নতি ও ঘের মালিক চাষিদের জিম্মি করে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে চিংড়ি ঘেরে প্রতি জো-তে চাঁদাবাজি ও ডাকাতের তাণ্ডব বন্ধ করা সম্ভব হলে চিংড়িজোনে সোনালী সুদিন ফিরে আসবে।
উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়িজোনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে চকরিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, চিংড়িজোনের নানাবিধ অপরাধ-অপকর্মের বিষয়ে পুলিশ সর্বদা সজাগ রয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতিতে ঘের মালিক চাষিরা ক্ষতির শিকার হলে অভিযোগ পাওয়া মাত্র অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, চিংড়িজোন এরিয়াটি পানি পথ হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থা অনেকটা অনুন্নত। তাই পুলিশ ইচ্ছে করলেই নিয়মিত সেখানে টহলে যেতে পারে না। তারপরও আমরা চিংড়িজোনে টহল তৎপরতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।