alt

ভাঙন আতঙ্কে মাতামুহুরী তীরের বাসিন্দারা, টেকসই শাসন সংরক্ষণের দাবি

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া (কক্সবাজার) : শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

ভাটার সময় মাতামুহরীর ছবি। নদী ভরাটের প্রভাবে ভাঙছে পাড়। অপরিহার্য হয়ে উঠেছে নদীশাসন -সংবাদ

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার পথ সুগমের অন্যতম আশির্বাদ একসময়ের খরস্রোতা মাতামুহুরী নদী এখন প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে নেমে আসা পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

গেল দুইদশক ধরে পলিমাটি জমতে জমতে নদীর শতাধিক পয়েন্টে ছোট-বড় অসংখ্য ডুবোচর জেগে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে চির যৌবনা মাতামুহুরী নদী বর্তমানে ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কটে পড়েছে।

বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের কারণে নদীতে পানির প্রবাহ কিছুটা উচ্চতায় থাকলেও বর্ষা মৌসুম যেতে না যেতেই নদীতে জেগে উঠা চরের কারণে খেয়াঘাটের পারাপার, নৌ-চলাচল, কাঠ ও বাঁশ পরিবহনে যেন দুর্ভোগের অন্ত থাকেনা।

আবার বর্ষা মৌসুমে অবিরাম বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি জেগে উঠা চরের কারণে নদীতে সংকুলান না হওয়ায় তীর উপচে ঢুকে পড়ে লোকালয়গুলোয়। তাতে পানিবন্দী হয়ে জনদুর্ভোগ বাড়ে মানুষের।

অন্যদিকে পাহাড়ি ঢলের বন্যার ধকল শেষ হবার মুহুর্তেই নদীর দুইতীরের জনপদে শুরু হয় ভয়াবহ ভাঙন তা-ব। এতে মানুষের বাড়িঘর-ভিটে, ফসলি জমি, বেড়িবাঁধ এবং তীর জনপদের বিভিন্ন স্থাপনা তলিয়ে যায় নদীতে। এভাবে মাতামুহুরী বছরে একবার বর্ষা মৌসুমে তীর জনপদের মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ভয়াবহ নাব্যতা সংকটে নিমজ্জিত খরস্রোতা মাতামুহুরী নদীর টেকসই শাসন সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন পরিবেশ সচেতন মহল।

চকরিয়া উপজেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান মাহমুদ বলেন, মাতামুহুরী নদী একসময় মানুষের জীবন-জীবিকার পথ সুগমের অন্যতম আশির্বাদ হিসেবে ছিল। বছরে বারোমাস নদীর মিঠাপানির সেচ সুবিধা নিয়ে এলাকার কৃষকেরা চাষাবাদ করে অধিক ফসল উৎপাদন করতো। নদীতে দেশীয় সুস্বাদু মাছের অভয়াশ্রম ছিল। নদীতে সারি সারি নৌকা যোগে মাঝিরা পরিবহন করতো বিভিন্ন মালামাল।

কিন্তু গেল এক দশক সময়ের ব্যবধানে খরস্রোতা মাতামুহুরী নদী এখন মৃত্যু প্রায়। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে নেমে আসা পলিমাটি বালু জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে মাতামুহুরী নদী। নদীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য ডুবোচর। তাতে নদীতে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ নাব্যতা সংকট। তিনি মাতামুহুরী নদীর সুদিন ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের কাছে পরিকল্পিত ও টেকসই প্রকল্প গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি ভরাট মাতামুহুরী নদীকে সচল করতে ড্রেজিংসহ শাসন সংরক্ষণের জোর দিয়েছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তিস্থল হলো বান্দরবানের লামা উপজেলার মাইভার পর্বত, যা মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। এই নদীটি বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৭ কিলোমিটার (১৭৮ মাইল) আয়তনের এই নদীর দুই দশক আগেও গভীরতা ছিল ৩০-৪০ফুট, প্রস্থ ছিল ১৪শ’-১৫শ’ ফুট পর্যন্ত। নদীতে ছিল গভীর জলরাশি। সেজন্য নাম দেয়া হয় প্রমত্তা মাতামুহুরী।

তবে এখন সেই মাতামুহুরী এখন মরা নদীতে রূপ নিয়েছে। নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রজনন স্থান (অভয়াশ্রম) ধ্বংস হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মৎস্য ভান্ডারও বিলুপ্ত হচ্ছে। তাতে দেখা দিয়েছে দেশীয় মাছের আকাল। এতে মাছ আহরণে নিয়োজিত জেলে পরিবারগুলোয় দেখা দিয়েছে চরম উৎকণ্ঠা ও হতাশা।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দাবি করেছে, মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা সংকট এবং ভাঙনের ভয়াবহতা রোধকরতে হলে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে জমে থাকা পলি অপসারণ করতে হবে। বিশেষ করে মাতামুহুরী ব্রিজের চিরিঙ্গা পয়েন্ট থেকে ড্রেজিং শুরু করে উজানে মানিকপুর-সুরাজপুর ও কাকারা পয়েন্ট এবং নিচে বেতুয়া বাজার থেকে কুরিইল্যারকুম এবং আনিছপাড়া থেকে পালাকাটা রাবার ড্যাম পর্যন্ত এলাকায় পলি জমে ভরাট হওয়া মাতামুহুরী নদী নতুন করে ড্রেজিং করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাতামুহুরী নদীর উজানে পার্বত্য লামা-আলীকদমে পাহাড়ি এলাকা থেকে দুই দশক ধরে পাহাড়ে ব্যাপক হারে বৃক্ষনিধন, বাঁশকর্তন ও পাহাড়ে জুমচাষের কারণে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পড়ছে নদীতে। ফলে নদীর তলদেশ প্রতিবছর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও পাহাড় কাটা, ঝিরি খুঁড়ে ও বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবাধে

পাথর উত্তোলনের কারণে পাহাড়ি পলি নদীতে ভেসে এসে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এতেকরে প্রতি বর্ষাকালে নদীতে পানির প্রবাহ কমে যায়। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই পাহাড়ি ঢলে নদীর দুই তীরে নতুন নতুন এলাকায় ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ইতোপূর্বেকার ভয়বহ বন্যায় চকরিয়া উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে জনবসতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

২০১৫ সালে চকরিয়া উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ ও মাতামুহুরী নদীর ভাঙন পরিদর্শন করেন সেসময়ের পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। পরিদর্শন শেষে তিনি মাতামুহুরী নদীতে ড্রেজিং করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।

মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নির্দেশে ২০১৮ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় মাতামুহুরী নদী শাসন সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিং করতে একটি প্রকল্প গ্রহন করেন। সেসময় ৬ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড পাইলট প্রকল্পের অধীনে চকরিয়ার বেতুয়াবাজারস্থ নদীর ৩ কিলোমিটার পয়েন্টে ড্রেজিং কাজও শুরু করে। কিন্তু একবছর পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সাতবছর ধরে বন্ধ রয়েছে মাতামুহুরী নদী ড্রেজিং প্রকল্পের অগ্রগতি। যার ফলে জনগণের দুর্ভোগ লাঘবও হয়নি।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্ট বলেন, বিগত সময়ে অপরিকল্পিত উন্নয়ন করতে গিয়ে নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে বর্ষায় বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ের বালু মাটি এসে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মাতামুহুরী নদী তার চেনা যৌবন হারিয়েছে। এই যৌবন ফেরাতে হলে নদী খনন করতে হবে। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

তিনি বলেন, মাতামুহুরী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ডুবোচর ও পাহাড়ি ঢলের পানির ধাক্কায় নদীর দুইতীরে ভয়াবহ নতুন করে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় দ্রুত সময়ের মধ্যে নদীর শাসন সংরক্ষণের কাজ করা না গেলে সামনে বর্ষা মৌসুমে ফের দুর্ভোগ পোহাতে হবে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক জনগোষ্টিকে।

চকরিয়া পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মুজিবুল হক মুজিব বলেন, মাতামুহুরী নদী জনগণের জন্য আর্শিবাদ হলেও বর্তমানে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যার কারণে নদীর দুই তীর এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ভয়াবহ ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রতিবছর শুস্ক মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা মাতামুহুরী নদীর পানি আটকিয়ে চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলার ৬০ হাজার কৃষক সেচ সুবিধা নিয়ে ইরি, বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করে আসছে। মাতামুহুরী নদীর সুফল নিয়ে কৃষকরা বিভিন্ন ফসলের চাষ করে ইতোমধ্যে অনেকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে এবং চাষাবাদের মাধ্যমে প্রতিবছর জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন এখানকার কৃষকরা।

মাতামুহুরী নদী শাসন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কাজ তদারকিতে একসঙ্গে দায়িত্বে রয়েছেন কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বিভাগের দুটি ডিভিশন।

জানতে চাইলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ (বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের) নির্বাহী প্রকৌশলী অরুপ চক্রবর্তী বলেন, মাতামুহুরী নদীর ড্রেজিং ও বন্যার পানি নিষ্কাশনের জন্য জাপানি সংস্থা জাইকা একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। জাইকা থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দিলে তা সরকারের কাছে পাঠানো হবে। আশা করি আগামী অর্থ বছরের মধ্যে জাইকার সমীক্ষা প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার -১ এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডি চকরিয়া উপজেলা জোন) মো. জামাল মুর্শিদ বলেন, চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদী এবং বুড়া মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, ভাঙন রোধকল্পে জাইকা কর্তৃক সমীক্ষার আলোকে পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন হলে আগামীতে নদী ভাঙন, নাব্যতা সংকট কেটে যাবে। পাশাপাশি বন্যার দুর্যোগ দুর্ভোগ থেকে চকরিয়া উপজেলার জনসাধারণ স্থায়ীভাবে পরিত্রাণ পাবে বলে আশা করছি।

ছবি

রাজধানীতে গভীর রাতে সড়কে নারীর মৃত্যু

ছবি

ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় মায়ের লাশ দেখতে না দেয়ায় সংঘর্ষ, নিহত ১

ছবি

জেনে-বুঝে সংগ্রাম জারি রাখতে হবে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যুব সম্মেলনে বক্তারা

ছবি

দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ৩১ বাংলাদেশিকে ফেরত দিলো বিএসএফ

ছবি

নিম্নচাপে রূপ নিলো লঘুচাপ, ১ নম্বর সতর্কতা

ছবি

‘বৈষম্যের শিকার’ বিসিএস ২৫ ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দাবি

ছবি

তিস্তা সেতুর তলদেশ এখন গো-চারণ ভূমি

ছবি

সালমান শাহ হত্যা মামলা: আসামিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে ‘ইমিগ্রেশনে’ পুলিশের চিঠি

ছবি

ভোলায় উচ্ছেদ অভিযানে সংঘর্ষ: তিনটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, আহত ১৫

ছবি

দামুড়হুদায় শীতের আগমনে লেপ তৈরীর কারিগরদের ব্যস্ততা

ছবি

তিন ছেলে থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধা মায়ের ঠাঁই হলো গোয়ালঘরে

ছবি

মহেশপুর ভৈরবা বাজারে ঐতিহ্যবাহী ‘ঝাঁপান খেলা’ অনুষ্ঠিত

ছবি

নগেশ্বরীতে বউ-শাশুড়ী মেলা

ছবি

শেরপুরে মিনি রাতারগুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধতা খুঁজছেন শত শত পর্যটক

ছবি

বেনাপোল-পেট্রাপোলে সন্ধ্যা ৬টার পর আমদানি-রপ্তানি বন্ধ, বিপাকে ব্যবসায়ীরা

ছবি

সুবর্ণচরে পাচারকালে ৩০০ বস্তা ইউরিয়া সার জব্দ

ছবি

টুঙ্গিপাড়ায় পুলিশের সহায়তায় হাফিজ ফিরে পেল একমাত্র জীবিকার অবলম্বন

ছবি

বিএনপিতে ফিরলেন গঙ্গাচড়ার সাবেক চেয়ারম্যান সুজন

ছবি

শহীদ ময়েজউদ্দিন সেতুতে বিনা রশিদে টোল আদায়

ছবি

দশমিনায় দেশি প্রজাতির মাছের উৎপাদন কম

ছবি

ইবিতে লোডশেডিং হলেই বন্ধ হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক-ইন্টারনেট

ছবি

স্বাস্থ্যসেবায় রংপুর বিভাগে দ্বিতীয় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

ছবি

অর্থাভাবে চিকিৎসা বন্ধ, যুবক আলমগীরের ‘জীবন এখন শিকলবন্দি’

ছবি

ডিমলার ধুম নদীর বিধ্বস্ত ব্রিজ যেন মরণ ফাঁদ

ছবি

সিরাজগঞ্জের কৃষকরা এখন শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত

ছবি

নোয়াখালীতে ইয়াবাসহ বাসের সুপারভাইজার গ্রেপ্তার

ছবি

চৌগাছায় ট্রলির সাথে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে দুই কিশোর নিহত

ছবি

বোয়ালমারীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত, আহত ৫

মোহনগঞ্জে যাত্রাপথে আনন্দ গান মেঠোসুর পরিষদের কর্মশালা

ছবি

বেগমগঞ্জে গাঁজাসহ মাদক কারবারী গ্রেপ্তার

ছবি

যশোরে ফেনসিডিলের মামলায় তিনজনের যাবজ্জীবন

ছবি

গরু চুরির সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ১,আহত ৩

ছবি

যশোরের রং ও কেমিক্যাল দিয়ে আইসক্রিম তৈরি, জরিমানা

ছবি

নড়াইলে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি

ছবি

উলিপুরে বিরোধের জেরে অবরুদ্ধ এক পরিবার

ছবি

নালিতাবাড়ীতে পানির বোরিংয়ে মিলল গ্যাস, চাঞ্চল্যে স্থানীয়রা

tab

ভাঙন আতঙ্কে মাতামুহুরী তীরের বাসিন্দারা, টেকসই শাসন সংরক্ষণের দাবি

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া (কক্সবাজার)

ভাটার সময় মাতামুহরীর ছবি। নদী ভরাটের প্রভাবে ভাঙছে পাড়। অপরিহার্য হয়ে উঠেছে নদীশাসন -সংবাদ

শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার পথ সুগমের অন্যতম আশির্বাদ একসময়ের খরস্রোতা মাতামুহুরী নদী এখন প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে নেমে আসা পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

গেল দুইদশক ধরে পলিমাটি জমতে জমতে নদীর শতাধিক পয়েন্টে ছোট-বড় অসংখ্য ডুবোচর জেগে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে চির যৌবনা মাতামুহুরী নদী বর্তমানে ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কটে পড়েছে।

বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের কারণে নদীতে পানির প্রবাহ কিছুটা উচ্চতায় থাকলেও বর্ষা মৌসুম যেতে না যেতেই নদীতে জেগে উঠা চরের কারণে খেয়াঘাটের পারাপার, নৌ-চলাচল, কাঠ ও বাঁশ পরিবহনে যেন দুর্ভোগের অন্ত থাকেনা।

আবার বর্ষা মৌসুমে অবিরাম বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি জেগে উঠা চরের কারণে নদীতে সংকুলান না হওয়ায় তীর উপচে ঢুকে পড়ে লোকালয়গুলোয়। তাতে পানিবন্দী হয়ে জনদুর্ভোগ বাড়ে মানুষের।

অন্যদিকে পাহাড়ি ঢলের বন্যার ধকল শেষ হবার মুহুর্তেই নদীর দুইতীরের জনপদে শুরু হয় ভয়াবহ ভাঙন তা-ব। এতে মানুষের বাড়িঘর-ভিটে, ফসলি জমি, বেড়িবাঁধ এবং তীর জনপদের বিভিন্ন স্থাপনা তলিয়ে যায় নদীতে। এভাবে মাতামুহুরী বছরে একবার বর্ষা মৌসুমে তীর জনপদের মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ভয়াবহ নাব্যতা সংকটে নিমজ্জিত খরস্রোতা মাতামুহুরী নদীর টেকসই শাসন সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন পরিবেশ সচেতন মহল।

চকরিয়া উপজেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান মাহমুদ বলেন, মাতামুহুরী নদী একসময় মানুষের জীবন-জীবিকার পথ সুগমের অন্যতম আশির্বাদ হিসেবে ছিল। বছরে বারোমাস নদীর মিঠাপানির সেচ সুবিধা নিয়ে এলাকার কৃষকেরা চাষাবাদ করে অধিক ফসল উৎপাদন করতো। নদীতে দেশীয় সুস্বাদু মাছের অভয়াশ্রম ছিল। নদীতে সারি সারি নৌকা যোগে মাঝিরা পরিবহন করতো বিভিন্ন মালামাল।

কিন্তু গেল এক দশক সময়ের ব্যবধানে খরস্রোতা মাতামুহুরী নদী এখন মৃত্যু প্রায়। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে নেমে আসা পলিমাটি বালু জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে মাতামুহুরী নদী। নদীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য ডুবোচর। তাতে নদীতে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ নাব্যতা সংকট। তিনি মাতামুহুরী নদীর সুদিন ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের কাছে পরিকল্পিত ও টেকসই প্রকল্প গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি ভরাট মাতামুহুরী নদীকে সচল করতে ড্রেজিংসহ শাসন সংরক্ষণের জোর দিয়েছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তিস্থল হলো বান্দরবানের লামা উপজেলার মাইভার পর্বত, যা মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। এই নদীটি বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৭ কিলোমিটার (১৭৮ মাইল) আয়তনের এই নদীর দুই দশক আগেও গভীরতা ছিল ৩০-৪০ফুট, প্রস্থ ছিল ১৪শ’-১৫শ’ ফুট পর্যন্ত। নদীতে ছিল গভীর জলরাশি। সেজন্য নাম দেয়া হয় প্রমত্তা মাতামুহুরী।

তবে এখন সেই মাতামুহুরী এখন মরা নদীতে রূপ নিয়েছে। নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রজনন স্থান (অভয়াশ্রম) ধ্বংস হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মৎস্য ভান্ডারও বিলুপ্ত হচ্ছে। তাতে দেখা দিয়েছে দেশীয় মাছের আকাল। এতে মাছ আহরণে নিয়োজিত জেলে পরিবারগুলোয় দেখা দিয়েছে চরম উৎকণ্ঠা ও হতাশা।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দাবি করেছে, মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা সংকট এবং ভাঙনের ভয়াবহতা রোধকরতে হলে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে জমে থাকা পলি অপসারণ করতে হবে। বিশেষ করে মাতামুহুরী ব্রিজের চিরিঙ্গা পয়েন্ট থেকে ড্রেজিং শুরু করে উজানে মানিকপুর-সুরাজপুর ও কাকারা পয়েন্ট এবং নিচে বেতুয়া বাজার থেকে কুরিইল্যারকুম এবং আনিছপাড়া থেকে পালাকাটা রাবার ড্যাম পর্যন্ত এলাকায় পলি জমে ভরাট হওয়া মাতামুহুরী নদী নতুন করে ড্রেজিং করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাতামুহুরী নদীর উজানে পার্বত্য লামা-আলীকদমে পাহাড়ি এলাকা থেকে দুই দশক ধরে পাহাড়ে ব্যাপক হারে বৃক্ষনিধন, বাঁশকর্তন ও পাহাড়ে জুমচাষের কারণে পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পড়ছে নদীতে। ফলে নদীর তলদেশ প্রতিবছর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও পাহাড় কাটা, ঝিরি খুঁড়ে ও বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবাধে

পাথর উত্তোলনের কারণে পাহাড়ি পলি নদীতে ভেসে এসে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এতেকরে প্রতি বর্ষাকালে নদীতে পানির প্রবাহ কমে যায়। নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই পাহাড়ি ঢলে নদীর দুই তীরে নতুন নতুন এলাকায় ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ইতোপূর্বেকার ভয়বহ বন্যায় চকরিয়া উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে জনবসতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

২০১৫ সালে চকরিয়া উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ ও মাতামুহুরী নদীর ভাঙন পরিদর্শন করেন সেসময়ের পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। পরিদর্শন শেষে তিনি মাতামুহুরী নদীতে ড্রেজিং করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।

মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নির্দেশে ২০১৮ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় মাতামুহুরী নদী শাসন সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিং করতে একটি প্রকল্প গ্রহন করেন। সেসময় ৬ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড পাইলট প্রকল্পের অধীনে চকরিয়ার বেতুয়াবাজারস্থ নদীর ৩ কিলোমিটার পয়েন্টে ড্রেজিং কাজও শুরু করে। কিন্তু একবছর পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সাতবছর ধরে বন্ধ রয়েছে মাতামুহুরী নদী ড্রেজিং প্রকল্পের অগ্রগতি। যার ফলে জনগণের দুর্ভোগ লাঘবও হয়নি।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্ট বলেন, বিগত সময়ে অপরিকল্পিত উন্নয়ন করতে গিয়ে নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে বর্ষায় বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ের বালু মাটি এসে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। মাতামুহুরী নদী তার চেনা যৌবন হারিয়েছে। এই যৌবন ফেরাতে হলে নদী খনন করতে হবে। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

তিনি বলেন, মাতামুহুরী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ডুবোচর ও পাহাড়ি ঢলের পানির ধাক্কায় নদীর দুইতীরে ভয়াবহ নতুন করে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় দ্রুত সময়ের মধ্যে নদীর শাসন সংরক্ষণের কাজ করা না গেলে সামনে বর্ষা মৌসুমে ফের দুর্ভোগ পোহাতে হবে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক জনগোষ্টিকে।

চকরিয়া পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মুজিবুল হক মুজিব বলেন, মাতামুহুরী নদী জনগণের জন্য আর্শিবাদ হলেও বর্তমানে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যার কারণে নদীর দুই তীর এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ভয়াবহ ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে।

জানা গেছে, প্রতিবছর শুস্ক মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা মাতামুহুরী নদীর পানি আটকিয়ে চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলার ৬০ হাজার কৃষক সেচ সুবিধা নিয়ে ইরি, বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করে আসছে। মাতামুহুরী নদীর সুফল নিয়ে কৃষকরা বিভিন্ন ফসলের চাষ করে ইতোমধ্যে অনেকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে এবং চাষাবাদের মাধ্যমে প্রতিবছর জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন এখানকার কৃষকরা।

মাতামুহুরী নদী শাসন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কাজ তদারকিতে একসঙ্গে দায়িত্বে রয়েছেন কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বিভাগের দুটি ডিভিশন।

জানতে চাইলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ (বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের) নির্বাহী প্রকৌশলী অরুপ চক্রবর্তী বলেন, মাতামুহুরী নদীর ড্রেজিং ও বন্যার পানি নিষ্কাশনের জন্য জাপানি সংস্থা জাইকা একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। জাইকা থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দিলে তা সরকারের কাছে পাঠানো হবে। আশা করি আগামী অর্থ বছরের মধ্যে জাইকার সমীক্ষা প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার -১ এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডি চকরিয়া উপজেলা জোন) মো. জামাল মুর্শিদ বলেন, চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদী এবং বুড়া মাতামুহুরী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, ভাঙন রোধকল্পে জাইকা কর্তৃক সমীক্ষার আলোকে পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন হলে আগামীতে নদী ভাঙন, নাব্যতা সংকট কেটে যাবে। পাশাপাশি বন্যার দুর্যোগ দুর্ভোগ থেকে চকরিয়া উপজেলার জনসাধারণ স্থায়ীভাবে পরিত্রাণ পাবে বলে আশা করছি।

back to top