বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের ভাণ্ডারে লুকিয়ে আছে অসংখ্য অনালোচিত অধ্যায়, যার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো শ্রীহট্টের (সিলেট) লৌহশিল্প ঐতিহ্য এবং তার শ্রেষ্ঠ কারিগর জনার্দ্ধন কর্মকার। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক অচ্যুৎচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি প্রণীত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে পাওয়া যায় এ শিল্পীর বিস্ময়কর কীর্তির বিস্তারিত বিবরণ, যা আজও শ্রীহট্ট তথা সিলেটের ঐতিহ্যের গৌরব বহন করছে। মুর্শিদাবাদের তোপখানায় শ্রীহট্টের দান তত্ত্বনিধির লেখায় জানা যায়, মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত দুই কামান জাহান কোষা ও বাচ্চাওয়ালী তোপ উভয়ই প্রস্তুত হয়েছিল ঢাকায় (তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর) এবং উভয়েরই কারিগর ছিলেন শ্রীহট্টের পাঁচগাঁওয়ের শিল্পী জনার্দ্ধন কর্ম্মকার। জাহান কোষা অর্থ জগতের ধ্বংসকারী। ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে (১০৪৭ হিজরী, জমাদিউস সানি মাসে) দিল্লীর বাদশাহ শাহজাহানের রাজত্বকালে, ইসলাম খাঁর সুবেদারির সময় জাহাঙ্গীরনগরে দারোগা শের মহম্মদ ও হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে জনার্দ্ধন কর্ম্মকার এই বিশাল কামানটি নির্মাণ করেন। কামানটির ওজন ছিল ২১২ মণ, দৈর্ঘ্য ১৭ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং পরিধি ৫ ফুট। এটি নির্মিত হয় অষ্টধাতু—সোনা, রূপা, দস্তা, তামা, জিঙ্ক, টিন, লোহা ও পারদ—মিশ্রণে। তাই আজও এই কামান মরিচাহীন অবস্থায় দণ্ডায়মান। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ যখন রাজধানী ঢাক্কা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন, তখন এই কামানকেও জলপথে এনে মুর্শিদাবাদের অস্ত্রাগারে স্থাপন করা হয়। আজও তা ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী। বাচ্চাওয়ালী তোপ এক কিংবদন্তির নাম অপর বিখ্যাত কামান বাচ্চাওয়ালী তোপ-ও জনার্দ্ধন কর্ম্মকারের সৃষ্টি। মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারীর উত্তর দিকে মদিনার পাশে অবস্থান করছে এই তোপ। কথিত আছে, হাজারদুয়ারীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন এই তোপ একবার দাগা হয়েছিল। প্রচণ্ড শব্দে আশপাশের বহু গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটে বলে কামানটির নাম হয় বাচ্চাওয়ালী তোপ। তিন কক্ষবিশিষ্ট এই তোপ দাগাতে লাগত আটাশ সের বারুদ, এবং দশ মাইল দূর থেকেও এর আওয়াজ শোনা যেত। সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পর আর কখনো এটি দাগা হয়নি। পাঁচগাঁওয়ের লৌহশিল্প ঐতিহ্য ঐতিহাসিক জনার্দ্ধন কর্ম্মকারের জন্মস্থান পাঁচগাঁও, বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার অন্তর্গত। এই গ্রাম শুধু কামানকারই নয়, অসংখ্য দক্ষ লৌহশিল্পীর জন্মভূমি। জনার্দ্ধনের বংশ জনাইর গোষ্ঠী নামে পরিচিত, যারা আজও পূর্বপুরুষের এই ঐতিহ্যে গর্ববোধ করে।
পাঁচগাঁওয়ের তৈরি লৌহ দ্রব্য একসময় ‘রাজনগরের জিনিষ’ নামে খ্যাত ছিল। এখানকার কারিগররা তৈরি করতেন খড়গ, বটি, ছরতা, বুকিদা প্রভৃতি অস্ত্র, যেগুলোর উপর রূপা ও পিতলের কারুকাজ ছিল অসাধারণ। ১৮৮২ সালের কলকাতা শিল্প প্রদর্শনীতে পাঁচগাঁওয়ের কমলচরণ ধর ও কিশোররাম ধর কর্ম্মকার লৌহ দ্রব্য প্রেরণ করে পুরস্কৃত হন। আবার ১৯০৬ সালের কৃষিশিল্প প্রদর্শনীতেও প্রাণকৃষ্ণ ধর, মধুসুদন ধর ও শম্ভুনাথ ধর প্রমুখ শিল্পী তাঁদের নিপুণ কারিগরির জন্য প্রশংসিত হন।
গোবিন্দরাম ধর নামের এক কারিগর তৈরি করেছিলেন এমন এক অভিনব তালা—যা বাক্সের ঢাকনা ফেললেই নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যেত, কেবল খোলার জন্য চাবির প্রয়োজন হত। পাঁচগাঁওয়ের জাহাজ শিল্পের বিস্ময় শুধু অস্ত্রই নয়, পাঁচগাঁওয়ের কর্ম্মকাররা জাহাজ নির্মাণেও দক্ষ ছিলেন। তাঁদের হাতে তৈরি “দ্যা রাইনোসার” নামক জাহাজে ১৫০০ বস্তা চাল বরিশাল থেকে মাদ্রাজে পাঠানো হয়েছিল। অন্যদিকে “দ্যা আগুস্টা” নামের যুদ্ধজাহাজে একসঙ্গে ১৮টি কামান বসানো যেত—যা পাঁচগাঁওয়ের প্রযুক্তিগত দক্ষতার এক অনন্য উদাহরণ।
সুরমা তীরের স্মৃতি ও উত্তরাধিকার : এক সময় সিলেট শহরের সুরমা নদীর তীরবর্তী তোপখানা এলাকায় পাঁচগাঁওয়ের বহু কর্ম্মকারের দোকান ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তাঁদের একটি বড় অংশ ভারতে পাড়ি জমায়, ফলে ধীরে ধীরে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যায়।
তবুও ইতিহাসের পাতায়, পুরোনো কামানের গায়ে, এবং জনাইর গোষ্ঠীর গর্বভরা মুখে আজও বেঁচে আছে সেই জনার্দ্ধন কর্ম্মকার—যিনি শ্রীহট্টের লৌহশিল্পকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বাংলার মাটিতে কারিগরি, শিল্প ও সৃজনশীলতার যে ধারাবাহিকতা প্রাচীনকাল থেকে বিকশিত হয়েছে, জনার্দ্ধন কর্ম্মকার ও তাঁর উত্তরসূরিরা তারই এক অনন্য অধ্যায়। তাঁদের হাতে গড়া লোহা শুধু কামান নয়, গৌরবের প্রতীক—শ্রীহট্টের ঐতিহ্যের অমর স্মারক।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের ভাণ্ডারে লুকিয়ে আছে অসংখ্য অনালোচিত অধ্যায়, যার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো শ্রীহট্টের (সিলেট) লৌহশিল্প ঐতিহ্য এবং তার শ্রেষ্ঠ কারিগর জনার্দ্ধন কর্মকার। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক অচ্যুৎচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি প্রণীত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে পাওয়া যায় এ শিল্পীর বিস্ময়কর কীর্তির বিস্তারিত বিবরণ, যা আজও শ্রীহট্ট তথা সিলেটের ঐতিহ্যের গৌরব বহন করছে। মুর্শিদাবাদের তোপখানায় শ্রীহট্টের দান তত্ত্বনিধির লেখায় জানা যায়, মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত দুই কামান জাহান কোষা ও বাচ্চাওয়ালী তোপ উভয়ই প্রস্তুত হয়েছিল ঢাকায় (তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর) এবং উভয়েরই কারিগর ছিলেন শ্রীহট্টের পাঁচগাঁওয়ের শিল্পী জনার্দ্ধন কর্ম্মকার। জাহান কোষা অর্থ জগতের ধ্বংসকারী। ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে (১০৪৭ হিজরী, জমাদিউস সানি মাসে) দিল্লীর বাদশাহ শাহজাহানের রাজত্বকালে, ইসলাম খাঁর সুবেদারির সময় জাহাঙ্গীরনগরে দারোগা শের মহম্মদ ও হরবল্লভ দাসের তত্ত্বাবধানে জনার্দ্ধন কর্ম্মকার এই বিশাল কামানটি নির্মাণ করেন। কামানটির ওজন ছিল ২১২ মণ, দৈর্ঘ্য ১৭ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং পরিধি ৫ ফুট। এটি নির্মিত হয় অষ্টধাতু—সোনা, রূপা, দস্তা, তামা, জিঙ্ক, টিন, লোহা ও পারদ—মিশ্রণে। তাই আজও এই কামান মরিচাহীন অবস্থায় দণ্ডায়মান। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ যখন রাজধানী ঢাক্কা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন, তখন এই কামানকেও জলপথে এনে মুর্শিদাবাদের অস্ত্রাগারে স্থাপন করা হয়। আজও তা ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী। বাচ্চাওয়ালী তোপ এক কিংবদন্তির নাম অপর বিখ্যাত কামান বাচ্চাওয়ালী তোপ-ও জনার্দ্ধন কর্ম্মকারের সৃষ্টি। মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারীর উত্তর দিকে মদিনার পাশে অবস্থান করছে এই তোপ। কথিত আছে, হাজারদুয়ারীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন এই তোপ একবার দাগা হয়েছিল। প্রচণ্ড শব্দে আশপাশের বহু গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটে বলে কামানটির নাম হয় বাচ্চাওয়ালী তোপ। তিন কক্ষবিশিষ্ট এই তোপ দাগাতে লাগত আটাশ সের বারুদ, এবং দশ মাইল দূর থেকেও এর আওয়াজ শোনা যেত। সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পর আর কখনো এটি দাগা হয়নি। পাঁচগাঁওয়ের লৌহশিল্প ঐতিহ্য ঐতিহাসিক জনার্দ্ধন কর্ম্মকারের জন্মস্থান পাঁচগাঁও, বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর থানার অন্তর্গত। এই গ্রাম শুধু কামানকারই নয়, অসংখ্য দক্ষ লৌহশিল্পীর জন্মভূমি। জনার্দ্ধনের বংশ জনাইর গোষ্ঠী নামে পরিচিত, যারা আজও পূর্বপুরুষের এই ঐতিহ্যে গর্ববোধ করে।
পাঁচগাঁওয়ের তৈরি লৌহ দ্রব্য একসময় ‘রাজনগরের জিনিষ’ নামে খ্যাত ছিল। এখানকার কারিগররা তৈরি করতেন খড়গ, বটি, ছরতা, বুকিদা প্রভৃতি অস্ত্র, যেগুলোর উপর রূপা ও পিতলের কারুকাজ ছিল অসাধারণ। ১৮৮২ সালের কলকাতা শিল্প প্রদর্শনীতে পাঁচগাঁওয়ের কমলচরণ ধর ও কিশোররাম ধর কর্ম্মকার লৌহ দ্রব্য প্রেরণ করে পুরস্কৃত হন। আবার ১৯০৬ সালের কৃষিশিল্প প্রদর্শনীতেও প্রাণকৃষ্ণ ধর, মধুসুদন ধর ও শম্ভুনাথ ধর প্রমুখ শিল্পী তাঁদের নিপুণ কারিগরির জন্য প্রশংসিত হন।
গোবিন্দরাম ধর নামের এক কারিগর তৈরি করেছিলেন এমন এক অভিনব তালা—যা বাক্সের ঢাকনা ফেললেই নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যেত, কেবল খোলার জন্য চাবির প্রয়োজন হত। পাঁচগাঁওয়ের জাহাজ শিল্পের বিস্ময় শুধু অস্ত্রই নয়, পাঁচগাঁওয়ের কর্ম্মকাররা জাহাজ নির্মাণেও দক্ষ ছিলেন। তাঁদের হাতে তৈরি “দ্যা রাইনোসার” নামক জাহাজে ১৫০০ বস্তা চাল বরিশাল থেকে মাদ্রাজে পাঠানো হয়েছিল। অন্যদিকে “দ্যা আগুস্টা” নামের যুদ্ধজাহাজে একসঙ্গে ১৮টি কামান বসানো যেত—যা পাঁচগাঁওয়ের প্রযুক্তিগত দক্ষতার এক অনন্য উদাহরণ।
সুরমা তীরের স্মৃতি ও উত্তরাধিকার : এক সময় সিলেট শহরের সুরমা নদীর তীরবর্তী তোপখানা এলাকায় পাঁচগাঁওয়ের বহু কর্ম্মকারের দোকান ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তাঁদের একটি বড় অংশ ভারতে পাড়ি জমায়, ফলে ধীরে ধীরে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যায়।
তবুও ইতিহাসের পাতায়, পুরোনো কামানের গায়ে, এবং জনাইর গোষ্ঠীর গর্বভরা মুখে আজও বেঁচে আছে সেই জনার্দ্ধন কর্ম্মকার—যিনি শ্রীহট্টের লৌহশিল্পকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বাংলার মাটিতে কারিগরি, শিল্প ও সৃজনশীলতার যে ধারাবাহিকতা প্রাচীনকাল থেকে বিকশিত হয়েছে, জনার্দ্ধন কর্ম্মকার ও তাঁর উত্তরসূরিরা তারই এক অনন্য অধ্যায়। তাঁদের হাতে গড়া লোহা শুধু কামান নয়, গৌরবের প্রতীক—শ্রীহট্টের ঐতিহ্যের অমর স্মারক।