ভালুকা (ময়মনসিংহ) : গাছের মাথা পরিষ্কার ও ছাল ছাড়ানোর কাজ ব্যস্ত গাছিরা -সংবাদ
ভালুকার গ্রামে গ্রামে মিষ্টি মধুর খেজুর রস সংগ্রহের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে শুরু হয়েছে গাছের মাথা পরিষ্কার ও ছাল ছাড়ানোর কাজ।
ষড় ঋতুর আবাহমান বাংলার সবুজ শ্যামল গ্রামের প্রকৃতি ঋতুচক্রে ভরে উঠে মৌসুমী ফল ফসল, বৃক্ষনিসৃত সুমিষ্ট রস সহ নানা খাদ্য সম্ভারে। পরন্ত বিকেলে হেমন্তের হালকা হিমশীতল হাওয়া আর সূর্যোদয়ে ঘাসের উপর জমে থাকা রুপালি শিশিরবিন্দু জানান দেয় শীতের আগমনি বার্তা। এ সময় গাছকাটা ছেনদাও দড়ি ও বাঁশের ডাংগি নিয়ে খেজুর গাছ তৈরী করতে সাতসকালে বেড়িয়ে যান গাছিরা। ক্ষেতের আইলে,বিলের ধারে, রাস্তার কিনারে, বাড়ীর আঙ্গিনায়, চালা টিলায় ঝুপড়ি মাথায় দাড়িয়ে থাকা খেজুর গাছে উঠে ডাংগি লাগিয়ে কোমড়ে দড়ি বেধেঁ গাছের এক পাশের ডাল ছাড়িয়ে চেছে মসৃণ কাঠ বের করা হয়। এ অবস্থায় ১০ থেকে ১৫ দিন থাকার পর গাছে রসের জোয়ার আসে। প্রতিদিন দুপুর হতেই খেজুর গাছ পাতলা করে চেছে বাঁশের চোঙ্গি দিয়ে মাটির হাঁড়ি পেতে দেয়া হয়। সারা রাত ফোটা ফোটা রস জমে সকালে হাঁড়ি ভরে যায়। কুয়াশায় ভেজা গাছ বেয়ে গাছিরা রসের হাঁড়ি নামিয়ে বড় চুলায় ড্রাম কাটা পাত্রে ঢেলে কয়েক ঘন্টা জ্বাল করে পাকা রস তৈরী করেন। পাতলা পাকা রস অধিক জ্বাল করে নির্দিষ্ট সময় পর ঘন হলে কাঠের হাতলে কিছু সময় ঘুটা দিয়ে পাত্রে ঢাললে ঠান্ডা হয়ে সুস্বাদু মিষ্টি মধুর পাটালি গুড় হয়ে যায়। আবার অনেকে পাড়া মহল্লা হাট বাজারে ফেরি করে কাঁচা রস বিক্রি করে থাকেন। শীতের সকালে কাঁচা রসের হাঁড়ি নিয়ে বসে থাকা বিক্রেতাদের সামনে জগ গ্লাস নিয়ে রস খাওয়ার জন্য ভীড় জমায় ছেট বড় সকলেই। পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের রাতে গাছ থেকে চুরি করে রস খাওয়ার ঘটনা আদিকাল কাল হতে প্রচলিত প্রথার মত বিরাজমান। এটিকে গ্রামের লোকরা এক সময় হাস্যরসে উড়িয়ে দিলেও এখন আর কেউ মেনে নিতে চায়না।
ভালুকার মরচি গ্রামে খেজুর গাছে উঠে ডাংগি লাগিয়ে কোমড়ে দড়ি বেধেঁ গাছের এক পাশের ছাল ছাড়িয়ে গাছ প্রস্তুত করছিলেন গাছি হুরমত উল্লাহ (৬০)। খেজুর গাছ কাটায় এলাকায় তিনি হুরমত গাছি নামে অধিক পরিচিত। রস বিক্রির টাকায় তিনি স্ত্রী সন্তানের খাবার জোগার করেন। প্রতিবছর শীতের শুরুতেই খেজুর গাছ কেটে রস নামাতে ব্যস্ত হয়ে পরেন তিনি। কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে খেজুর গাছের কান্ডভাগে বিশেষ পদ্ধতিতে কাঁটাসহ ডাল কেটে কিছু অংশের ছাল ছাড়িয়ে নেয়া হয়। ছাল কাটা অংশ কয়েকদিন রেখে দিলে তাতে রস আসতে শুরু করে। গাছের ছাল ছাড়ানো কাটা অংশ প্রতিদিন ধারালো দা দিয়ে সামান্য চেঁছে বাঁশের চুঙ্গি বসিয়ে নীচে মাটির হাঁড়ি পাতা হয় যেখানে টপ টপ করে সারা রাত ফোটা ফোটা রস জমে হাঁড়ি ভরে যায়।
প্রতিদিন সকালে সূর্য উঠার আগ মুহূর্ত হতে গাছিরা রসের হাঁড়ি নামাতে শুরু করেন। সকালের মিষ্টিরোদে বসে খেজুরের কাঁচা রস খেতে সবাই পছন্দ করে। ভালুকা উপজেলার প্রায় অধিকাংশ গ্রামেই কম বেশী খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতি বছর মৌসুম এলে বাজারে কাঁচা ও জ্বাল দেয়া খেজুর রস, খেজুরের পাটালি গুড় বেচাকেনা হয়। জ্বালের রস ও পাটালি গুড় খুবই সুস্বাদু হওয়ায় এর অনেক চাহিদা থাকে। খেজুর রসের খীর পায়েশ,রসের পিঠা, জ্বাল করা রস দিয়ে চিতই পিঠা, রসের মোয়া রসনা বিলাসীদের প্রিয় খাবার। প্রাকৃতিক উপায়ে জন্মানো খেজুর গাছ হতে প্রতি বছর সুস্বাদু রস সংগ্রহ করে প্রচুর অর্থ পাওয়া যায়। গত রোববার বিকালে ছাল ছাড়িয়ে গাছ প্রস্তুত করছিলেন গাছি হুরমত উল্লাহ। তিনি জানান প্রায় ২০ বছন ধরে খেজুর গাছ কেটে রস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। এ বছর তিনি ৩০ টি খেজুর গাছ একদিন মালিক দুই দিন নিজের বর্গা হিসাবে হাঁড়ি দেয়ার জন্য নিয়েছেন। বয়স বেড়ে যাওয়ায় আগের মত বেশী গাছ বাইতে পারেননা। তাই প্রতিদিন ১৫ টির মত গাছে হাঁড়ি দিতে পারেন। গত বছর প্রতি কেজি জ্বালের রস ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি বাজারে বিক্রি করেছেন। এ বছরও দাম ভাল পাওয়ার আশা করছেন। স্থানীয় ভাবে খেজুরের রস দিয়ে ভেজালমুক্ত পাটালি গুড় তৈরী করা হয় যা বাজারে ৩৫০ টাকা হতে ৪০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। খেজুরের পাটালি গুড় অনেক দিন ঘরে রাখলেও নষ্ট হয়না। রস ও গুড়ের দাম বেশী হওয়ার কারন হিসেবে এলাকাবাসী জানান সব গ্রামেই খেজুর গাছের সংখ্যা আনুপাতিক হারে আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এর প্রধান কারন হলো নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন। এক সময় বাড়ীর আনাচে কানাচে, ক্ষেতের আইলে ,পুকুর পাড়ে, বিলের ধারে,মাঠে ময়দানে সর্বত্রই প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নেয়া খেজুর গাছ সাড়ি সাড়ি শোভা পেত যা এখন আর আগের মত চোখে পড়েনা। তাছারা জ্বালানী লাকড়ির দাম বাড়ায় রস জ্বাল করতে খরচ অনেক বেশী হয়। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে প্রতি মৌসুমে সারে তিন মাস গাছ কেটে রস সংগ্রহ করা যায়। এলাকার গাছিরা প্রতি বছর রস বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করে থাকেন। যা দিয়ে সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করে থাকেন তারা। প্রতি গ্রামে অনেক গাছী রয়েছেন যারা শীতের মৌসুম এলে খেজুর গাছ কেটে রস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ভালুকা (ময়মনসিংহ) : গাছের মাথা পরিষ্কার ও ছাল ছাড়ানোর কাজ ব্যস্ত গাছিরা -সংবাদ
বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫
ভালুকার গ্রামে গ্রামে মিষ্টি মধুর খেজুর রস সংগ্রহের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে শুরু হয়েছে গাছের মাথা পরিষ্কার ও ছাল ছাড়ানোর কাজ।
ষড় ঋতুর আবাহমান বাংলার সবুজ শ্যামল গ্রামের প্রকৃতি ঋতুচক্রে ভরে উঠে মৌসুমী ফল ফসল, বৃক্ষনিসৃত সুমিষ্ট রস সহ নানা খাদ্য সম্ভারে। পরন্ত বিকেলে হেমন্তের হালকা হিমশীতল হাওয়া আর সূর্যোদয়ে ঘাসের উপর জমে থাকা রুপালি শিশিরবিন্দু জানান দেয় শীতের আগমনি বার্তা। এ সময় গাছকাটা ছেনদাও দড়ি ও বাঁশের ডাংগি নিয়ে খেজুর গাছ তৈরী করতে সাতসকালে বেড়িয়ে যান গাছিরা। ক্ষেতের আইলে,বিলের ধারে, রাস্তার কিনারে, বাড়ীর আঙ্গিনায়, চালা টিলায় ঝুপড়ি মাথায় দাড়িয়ে থাকা খেজুর গাছে উঠে ডাংগি লাগিয়ে কোমড়ে দড়ি বেধেঁ গাছের এক পাশের ডাল ছাড়িয়ে চেছে মসৃণ কাঠ বের করা হয়। এ অবস্থায় ১০ থেকে ১৫ দিন থাকার পর গাছে রসের জোয়ার আসে। প্রতিদিন দুপুর হতেই খেজুর গাছ পাতলা করে চেছে বাঁশের চোঙ্গি দিয়ে মাটির হাঁড়ি পেতে দেয়া হয়। সারা রাত ফোটা ফোটা রস জমে সকালে হাঁড়ি ভরে যায়। কুয়াশায় ভেজা গাছ বেয়ে গাছিরা রসের হাঁড়ি নামিয়ে বড় চুলায় ড্রাম কাটা পাত্রে ঢেলে কয়েক ঘন্টা জ্বাল করে পাকা রস তৈরী করেন। পাতলা পাকা রস অধিক জ্বাল করে নির্দিষ্ট সময় পর ঘন হলে কাঠের হাতলে কিছু সময় ঘুটা দিয়ে পাত্রে ঢাললে ঠান্ডা হয়ে সুস্বাদু মিষ্টি মধুর পাটালি গুড় হয়ে যায়। আবার অনেকে পাড়া মহল্লা হাট বাজারে ফেরি করে কাঁচা রস বিক্রি করে থাকেন। শীতের সকালে কাঁচা রসের হাঁড়ি নিয়ে বসে থাকা বিক্রেতাদের সামনে জগ গ্লাস নিয়ে রস খাওয়ার জন্য ভীড় জমায় ছেট বড় সকলেই। পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের রাতে গাছ থেকে চুরি করে রস খাওয়ার ঘটনা আদিকাল কাল হতে প্রচলিত প্রথার মত বিরাজমান। এটিকে গ্রামের লোকরা এক সময় হাস্যরসে উড়িয়ে দিলেও এখন আর কেউ মেনে নিতে চায়না।
ভালুকার মরচি গ্রামে খেজুর গাছে উঠে ডাংগি লাগিয়ে কোমড়ে দড়ি বেধেঁ গাছের এক পাশের ছাল ছাড়িয়ে গাছ প্রস্তুত করছিলেন গাছি হুরমত উল্লাহ (৬০)। খেজুর গাছ কাটায় এলাকায় তিনি হুরমত গাছি নামে অধিক পরিচিত। রস বিক্রির টাকায় তিনি স্ত্রী সন্তানের খাবার জোগার করেন। প্রতিবছর শীতের শুরুতেই খেজুর গাছ কেটে রস নামাতে ব্যস্ত হয়ে পরেন তিনি। কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে খেজুর গাছের কান্ডভাগে বিশেষ পদ্ধতিতে কাঁটাসহ ডাল কেটে কিছু অংশের ছাল ছাড়িয়ে নেয়া হয়। ছাল কাটা অংশ কয়েকদিন রেখে দিলে তাতে রস আসতে শুরু করে। গাছের ছাল ছাড়ানো কাটা অংশ প্রতিদিন ধারালো দা দিয়ে সামান্য চেঁছে বাঁশের চুঙ্গি বসিয়ে নীচে মাটির হাঁড়ি পাতা হয় যেখানে টপ টপ করে সারা রাত ফোটা ফোটা রস জমে হাঁড়ি ভরে যায়।
প্রতিদিন সকালে সূর্য উঠার আগ মুহূর্ত হতে গাছিরা রসের হাঁড়ি নামাতে শুরু করেন। সকালের মিষ্টিরোদে বসে খেজুরের কাঁচা রস খেতে সবাই পছন্দ করে। ভালুকা উপজেলার প্রায় অধিকাংশ গ্রামেই কম বেশী খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতি বছর মৌসুম এলে বাজারে কাঁচা ও জ্বাল দেয়া খেজুর রস, খেজুরের পাটালি গুড় বেচাকেনা হয়। জ্বালের রস ও পাটালি গুড় খুবই সুস্বাদু হওয়ায় এর অনেক চাহিদা থাকে। খেজুর রসের খীর পায়েশ,রসের পিঠা, জ্বাল করা রস দিয়ে চিতই পিঠা, রসের মোয়া রসনা বিলাসীদের প্রিয় খাবার। প্রাকৃতিক উপায়ে জন্মানো খেজুর গাছ হতে প্রতি বছর সুস্বাদু রস সংগ্রহ করে প্রচুর অর্থ পাওয়া যায়। গত রোববার বিকালে ছাল ছাড়িয়ে গাছ প্রস্তুত করছিলেন গাছি হুরমত উল্লাহ। তিনি জানান প্রায় ২০ বছন ধরে খেজুর গাছ কেটে রস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি। এ বছর তিনি ৩০ টি খেজুর গাছ একদিন মালিক দুই দিন নিজের বর্গা হিসাবে হাঁড়ি দেয়ার জন্য নিয়েছেন। বয়স বেড়ে যাওয়ায় আগের মত বেশী গাছ বাইতে পারেননা। তাই প্রতিদিন ১৫ টির মত গাছে হাঁড়ি দিতে পারেন। গত বছর প্রতি কেজি জ্বালের রস ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা কেজি বাজারে বিক্রি করেছেন। এ বছরও দাম ভাল পাওয়ার আশা করছেন। স্থানীয় ভাবে খেজুরের রস দিয়ে ভেজালমুক্ত পাটালি গুড় তৈরী করা হয় যা বাজারে ৩৫০ টাকা হতে ৪০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। খেজুরের পাটালি গুড় অনেক দিন ঘরে রাখলেও নষ্ট হয়না। রস ও গুড়ের দাম বেশী হওয়ার কারন হিসেবে এলাকাবাসী জানান সব গ্রামেই খেজুর গাছের সংখ্যা আনুপাতিক হারে আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এর প্রধান কারন হলো নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন। এক সময় বাড়ীর আনাচে কানাচে, ক্ষেতের আইলে ,পুকুর পাড়ে, বিলের ধারে,মাঠে ময়দানে সর্বত্রই প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নেয়া খেজুর গাছ সাড়ি সাড়ি শোভা পেত যা এখন আর আগের মত চোখে পড়েনা। তাছারা জ্বালানী লাকড়ির দাম বাড়ায় রস জ্বাল করতে খরচ অনেক বেশী হয়। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে প্রতি মৌসুমে সারে তিন মাস গাছ কেটে রস সংগ্রহ করা যায়। এলাকার গাছিরা প্রতি বছর রস বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আয় করে থাকেন। যা দিয়ে সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করে থাকেন তারা। প্রতি গ্রামে অনেক গাছী রয়েছেন যারা শীতের মৌসুম এলে খেজুর গাছ কেটে রস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।