alt

সমান শ্রম-সময় দিয়েও মজুরি-মর্যাদায় পিছিয়ে নারীরা

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক : শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেড়েছে। পুরুষের সঙ্গে সমান সময় দিয়ে কাজও করেন।

কিন্তু মজুরি পান অপেক্ষাকৃত কম। আবার প্রমোশনের বেলায়ও মূল্যায়ন কম।

এ ছাড়া পরিবারে বেশি সময় দিয়েও এর অর্থনৈতিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। কৃষি খাতে অবদান রাখলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পান না মজুরি। সব মিলিয়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত-নির্বিশেষে কর্মক্ষেত্রে নারী এখনো বৈষম্যের শিকার। এসব তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

সংস্থাটির শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর তথ্য বলছে, দেশে এখন শ্রমক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ১৮ লাখ। এর মধ্যে সক্রিয়ভাবে শ্রমশক্তিতে যুক্ত আছে সাত কোটি ১৭ লাখ মানুষ। নারী শ্রমশক্তি দুই কোটিরও বেশি—মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ১০ বছর আগে এই হার ছিল মাত্র ২৭ শতাংশ, এখন বেড়ে প্রায় ৩৯ শতাংশে পৌঁছেছে।

এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক, কিন্তু একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় বড় এক ফারাকের কথা। পুরুষদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ যেখানে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ, সেখানে নারীদের হার অর্ধেকেরও কম। অর্থাৎ সক্ষম নারীদের বিশাল একটি অংশ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছে না।

আয়-ব্যয়ের সমীকরণে লুকানো বৈষম্য

একই কাজের বিনিময়ে সমান মজুরি—এমন আইন দেশে আছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, মাসিক গড় আয়ে পুরুষ শ্রমিক পান প্রায় ১৬ হাজার টাকা, নারীরা পান মাত্র ১২ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ নারীরা গড়ে পুরুষের তুলনায় এক-পঞ্চমাংশ কম আয় করছেন।

এ বৈষম্য শহর-গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। কৃষি খাতে নারীর শ্রমকে প্রায়ই ‘সহায়ক’ বলা হয়, ফলে তাঁদের আয়ের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে ধরা হয় না। আবার শিল্প বা সেবা খাতেও একই কাজের জন্য নারীরা পুরুষের চেয়ে কম বেতন পান।

এ বিষয়ে উইমেন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডব্লিউইএবি) সভাপতি নাসরিন ফাতেমা আউয়াল বলেন, কর্মক্ষেত্র ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি দেশের আর্থ-সামাজিক সক্ষমতার একটি ভালো অর্জন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছেন, কিন্তু উচ্চ পর্যায়ে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ জন্য নারী সহায়ক নীতি ও নারী সংবেদনশীল সমাজ গঠন করলে উচ্চ পদে নারীদের কাজের সুযোগ বাড়বে।

তৈরি পোশাক খাতের বাস্তবতা

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে বলা হয় নারীর কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। এই খাতেই কাজ করেন কয়েক লাখ নারী। কিন্তু এখানেও বেতনবৈষম্য সুস্পষ্ট। একাধিক গবেষণা বলছে, একই কাজ করেও নারী শ্রমিকের মূল বেতন পুরুষের চেয়ে ২২ থেকে ৩০ শতাংশ কম।

সাভারের একটি কারখানায় ছয় বছর ধরে একই পদে কাজ করেও সামান্য বেতন বৃদ্ধি ছাড়া কোনো প্রমোশন পাননি রেহানা আক্তার। তাঁর ভাষায়, ‘একই কাজ করি, কিন্তু সুযোগে আমরা পিছিয়ে। ’

অন্যদিকে একই কারখানার পুরুষ সহকর্মীরা নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ পান।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাংকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) ফ্যাক্টরিগুলোতে ‘জেন্ডার পে গ্যাপ’ বা লিঙ্গভেদে আয়ের পার্থক্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত লক্ষ করা গেছে। আরএমজি খাতে বেশির ভাগ কর্মী নারী হলেও ফ্যাক্টরির ম্যানেজারিয়াল পদে পুরুষরাই থাকেন। যোগ্যতা থাকলেও ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব পান না নারীরা। এর প্রধান কারণ সংসারের চাপে তাঁরা যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। সময় দিতে না পারার কারণে অনেক সময় পদোন্নতি পেলেও স্বেচ্ছায় সুযোগ ছেড়ে দেন।

লালমনিরহাটের বুড়িমারী ও কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দরে হাজারো নারী-পুরুষ প্রতিদিন পাথর ভাঙার কাজে যুক্ত হন। কাজের ধরন, সময় ও শ্রম এক হলেও মজুরিতে রয়েছে বড় ফারাক। পুরুষ শ্রমিক দিনে পান প্রায় ৫০০ টাকা, আর নারী শ্রমিকদের দেওয়া হয় মাত্র ৪০০ টাকা। প্রতিদিনের এই শত টাকার ব্যবধান মাস শেষে দাঁড়ায় বিশাল অঙ্কে।

উচ্চশিক্ষিত নারীরাও এই বৈষম্যের বাইরে নেই। স্নাতক বা এর বেশি ডিগ্রিধারী নারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ২৯ শতাংশ। একই শিক্ষাগত যোগ্যতার পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ১২ শতাংশ। অর্থাৎ যোগ্যতা, দক্ষতা ও ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও নারীরা কাজ পাচ্ছেন না। যাঁরা কাজ পাচ্ছেন, তাঁরাও সমান বেতন বা পদোন্নতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

অদৃশ্য যতœশ্রমের হিসাব

অর্থনীতির আরেকটি অন্ধকার দিক হলো অবৈতনিক যতœশ্রম। ঘর গোছানো, খাবার রান্না, শিশু ও বৃদ্ধের যতœ—এসব কাজে প্রতিদিন গড়ে ছয় ঘণ্টা ৪০ মিনিট ব্যয় করেন নারীরা। পুরুষরা এই কাজে সময় দেন গড়ে মাত্র দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট।

‘অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নশ্রম জরিপ ২০২৪’-এর হিসাব অনুযায়ী, শুধু এই শ্রম অর্থনীতিতে ধরা হলে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসত নারীর অবদানে। অথচ এই শ্রমের কোনো পারিশ্রমিক নেই, নেই স্বীকৃতি।

নারীর কাজকে এখনো পরিবারে ‘সহায়ক’ বা ‘অতিরিক্ত আয়’ হিসেবে দেখা হয়। কর্মক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার হন, অনেক সময় বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হয়। করপোরেট ও প্রশাসনিক পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি কম। সন্তান ও গৃহস্থালির দায়িত্বের ভার তাঁদের সুযোগ সীমিত করে দেয়। ফলে তাঁরা সমান শ্রম দিলেও সমান মর্যাদা পান না।

আন্তর্জাতিকভাবে নারীর শ্রম

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়েও আছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণত নারীর অংশগ্রহণ কম, বেকারত্ব বেশি এবং কাজগুলো হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। বাংলাদেশও সেই বাস্তবতা থেকে বের হতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা মূলত বাস্তবায়নে। সমান মজুরির আইন থাকলেও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীরা এই সুবিধা থেকে প্রায় পুরোপুরি বঞ্চিত। এই বৈষম্য দূর করতে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

নারীদের ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, গৃহস্থালিতে নারীরা যেসব কাজ করছেন তা সরকারি হিসাব বা জিডিপিতে প্রকাশিত হয় না। ফলে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে উপেক্ষা করা হচ্ছে, যার মূল্য অনেক।

নারীর অবদানকে যদি স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে নীতি নির্ধারণকারীরা সামাজিক সেবা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে আরো বাস্তবভিত্তিক বাজেট ও কর্মসূচি তৈরি করতে পারবেন।

এ বিষয়ে নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘বিবিএসের এই গবেষণা ভবিষ্যতে লিঙ্গ-প্রতিক্রিয়াশীল নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নে সহায়তা করবে।

আমরা নারীরা পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে, জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে সমতার সম্মান চাই। জানি, এটি সহজে পাওয়া যাবে না। তবে তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে সবাইকে এই সম্মান দেওয়ার বিষয়ে রাজি করাতে হবে। ’

ছবি

স্বর্ণের ভরি ছাড়ালো ২ লাখ টাকা

ছবি

পাচারকৃত অর্থ আনতে আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির পরামর্শ বাংলাদেশ ব্যাংকের

ছবি

সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম দেড়শ’ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব পেট্রোবাংলার

ছবি

বাজারে সেলসফোর্স এর ‘মিউলসফট এজেন্ট ফেব্রিক’

ছবি

বাংলাদেশের বাজারে ভিভো’র নতুন স্মার্টফোন ভি৬০ লাইট উন্মোচন

ছবি

মুদ্রাস্ফীতি : বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়

ছবি

সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক রফতানি কমেছে ৫.৬৬ শতাংশ

ছবি

আইএমএফের প্রতিনিধিদল আসছে এ মাসে, রাজস্ব আয়ের শর্ত পূরণ হয়নি.

ছবি

ইসলামী ব্যাংকে অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তদের অপসারণে আল্টিমেটাম ও মানববন্ধন

ছবি

পোশাক শিল্পে ডিএফপি চালু করতে চায় বিজিএমইএ ও ডিবিপি

ছবি

গার্ডিয়ান লাইফ ও ক্লিনিকলের চুক্তি

ছবি

বিদেশে খরচ চালাতে বছরে ৩ হাজার ডলার পাঠাতে পারবে এসএমই প্রতিষ্ঠান

ছবি

উত্তরা ফাইন্যান্সে মূলধন ঘাটতি ৭১২ কোটি টাকা

ছবি

সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এলো ২.৬৮ বিলিয়ন ডলার

ছবি

বাংলাদেশি কসমেটিকস শিল্পে বৈশ্বিক আগ্রহ

ছবি

ট্রাম্পের প্রতিকৃতি সংবলিত ১ ডলারের মুদ্রা ছাড়ার পরিকল্পনা

ছবি

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিউট ও হাসপাতালে এবি ব্যাংকের কালেকশন বুথ উদ্বোধন

ছবি

ভালো শেয়ারেও বাজার মন্দা, কাটছে না খরা

ছবি

বাংলাদেশ-সৌদি আরব বিজনেস সামিট শুরু হচ্ছে সোমবার

ছবি

স্বর্ণের দামে রেকর্ড, ভরি ১ লাখ ৯৭ হাজার

ছবি

রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করছে এমজেএল বাংলাদেশ

ছবি

রেমিট্যান্স সংক্রান্ত মাস্টার সার্কুলার জারি করলো বাংলাদেশ ব্যাংক

ছবি

ভারত থেকে আমদানি বাড়াবে রাশিয়া, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের ফল

ছবি

মাকে ৩৬ কোটি টাকার শেয়ার উপহার দিলেন মির্জা আব্বাসের ছেলে

ছবি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক ১৯ কর্মকর্তার বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে দুদক

ছবি

প্রাইম ব্যাংকের নারী গ্রাহকদের জন্য গো গার্লস ভ্রমণ প্যাকেজে ছাড়

ছবি

এবার ‘অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তদের’ চাকরি বাতিল চেয়ে ইসলামী ব্যাংকের সামনে মানববন্ধন

ছবি

মুনাফা কমলেও রেকর্ড লভ্যাংশ দেবে ইবনে সিনা ফার্মা

ছবি

ফাঁকি রোধে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়াচ্ছে এনবিআর

ছবি

কুমিল্লা ইপিজেডে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী বিদেশিরা, প্রয়োজন আরো প্লট

ছবি

সোনালী ব্যাংকের ৯০ দিনের বিশেষ কর্মসূচি

ছবি

বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমেছে: এফএও

ছবি

শাটডাউন সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটে নতুন রেকর্ড

ছবি

উদ্ধারের ৪ ঘণ্টা পর ফের হ্যাকড ইসলামী ব্যাংকের ফেসবুক পেজ

ছবি

বৃষ্টি ও আমদানি বন্ধ থাকায় কাঁচা মরিচের কেজি ৪৫০ টাকা

ছবি

প্রযুক্তি খাতের উত্থানে চাঙ্গা এশিয়ার বাজার

tab

সমান শ্রম-সময় দিয়েও মজুরি-মর্যাদায় পিছিয়ে নারীরা

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেড়েছে। পুরুষের সঙ্গে সমান সময় দিয়ে কাজও করেন।

কিন্তু মজুরি পান অপেক্ষাকৃত কম। আবার প্রমোশনের বেলায়ও মূল্যায়ন কম।

এ ছাড়া পরিবারে বেশি সময় দিয়েও এর অর্থনৈতিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। কৃষি খাতে অবদান রাখলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পান না মজুরি। সব মিলিয়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত-নির্বিশেষে কর্মক্ষেত্রে নারী এখনো বৈষম্যের শিকার। এসব তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

সংস্থাটির শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর তথ্য বলছে, দেশে এখন শ্রমক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ১৮ লাখ। এর মধ্যে সক্রিয়ভাবে শ্রমশক্তিতে যুক্ত আছে সাত কোটি ১৭ লাখ মানুষ। নারী শ্রমশক্তি দুই কোটিরও বেশি—মোট শ্রমশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ১০ বছর আগে এই হার ছিল মাত্র ২৭ শতাংশ, এখন বেড়ে প্রায় ৩৯ শতাংশে পৌঁছেছে।

এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক, কিন্তু একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় বড় এক ফারাকের কথা। পুরুষদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ যেখানে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ, সেখানে নারীদের হার অর্ধেকেরও কম। অর্থাৎ সক্ষম নারীদের বিশাল একটি অংশ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছে না।

আয়-ব্যয়ের সমীকরণে লুকানো বৈষম্য

একই কাজের বিনিময়ে সমান মজুরি—এমন আইন দেশে আছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, মাসিক গড় আয়ে পুরুষ শ্রমিক পান প্রায় ১৬ হাজার টাকা, নারীরা পান মাত্র ১২ হাজার ৬০০ টাকা। অর্থাৎ নারীরা গড়ে পুরুষের তুলনায় এক-পঞ্চমাংশ কম আয় করছেন।

এ বৈষম্য শহর-গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। কৃষি খাতে নারীর শ্রমকে প্রায়ই ‘সহায়ক’ বলা হয়, ফলে তাঁদের আয়ের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে ধরা হয় না। আবার শিল্প বা সেবা খাতেও একই কাজের জন্য নারীরা পুরুষের চেয়ে কম বেতন পান।

এ বিষয়ে উইমেন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডব্লিউইএবি) সভাপতি নাসরিন ফাতেমা আউয়াল বলেন, কর্মক্ষেত্র ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি দেশের আর্থ-সামাজিক সক্ষমতার একটি ভালো অর্জন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছেন, কিন্তু উচ্চ পর্যায়ে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ জন্য নারী সহায়ক নীতি ও নারী সংবেদনশীল সমাজ গঠন করলে উচ্চ পদে নারীদের কাজের সুযোগ বাড়বে।

তৈরি পোশাক খাতের বাস্তবতা

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে বলা হয় নারীর কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। এই খাতেই কাজ করেন কয়েক লাখ নারী। কিন্তু এখানেও বেতনবৈষম্য সুস্পষ্ট। একাধিক গবেষণা বলছে, একই কাজ করেও নারী শ্রমিকের মূল বেতন পুরুষের চেয়ে ২২ থেকে ৩০ শতাংশ কম।

সাভারের একটি কারখানায় ছয় বছর ধরে একই পদে কাজ করেও সামান্য বেতন বৃদ্ধি ছাড়া কোনো প্রমোশন পাননি রেহানা আক্তার। তাঁর ভাষায়, ‘একই কাজ করি, কিন্তু সুযোগে আমরা পিছিয়ে। ’

অন্যদিকে একই কারখানার পুরুষ সহকর্মীরা নিয়মিত পদোন্নতির সুযোগ পান।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাংকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি) ফ্যাক্টরিগুলোতে ‘জেন্ডার পে গ্যাপ’ বা লিঙ্গভেদে আয়ের পার্থক্য ৩০ শতাংশ পর্যন্ত লক্ষ করা গেছে। আরএমজি খাতে বেশির ভাগ কর্মী নারী হলেও ফ্যাক্টরির ম্যানেজারিয়াল পদে পুরুষরাই থাকেন। যোগ্যতা থাকলেও ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব পান না নারীরা। এর প্রধান কারণ সংসারের চাপে তাঁরা যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। সময় দিতে না পারার কারণে অনেক সময় পদোন্নতি পেলেও স্বেচ্ছায় সুযোগ ছেড়ে দেন।

লালমনিরহাটের বুড়িমারী ও কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দরে হাজারো নারী-পুরুষ প্রতিদিন পাথর ভাঙার কাজে যুক্ত হন। কাজের ধরন, সময় ও শ্রম এক হলেও মজুরিতে রয়েছে বড় ফারাক। পুরুষ শ্রমিক দিনে পান প্রায় ৫০০ টাকা, আর নারী শ্রমিকদের দেওয়া হয় মাত্র ৪০০ টাকা। প্রতিদিনের এই শত টাকার ব্যবধান মাস শেষে দাঁড়ায় বিশাল অঙ্কে।

উচ্চশিক্ষিত নারীরাও এই বৈষম্যের বাইরে নেই। স্নাতক বা এর বেশি ডিগ্রিধারী নারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ২৯ শতাংশ। একই শিক্ষাগত যোগ্যতার পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ১২ শতাংশ। অর্থাৎ যোগ্যতা, দক্ষতা ও ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও নারীরা কাজ পাচ্ছেন না। যাঁরা কাজ পাচ্ছেন, তাঁরাও সমান বেতন বা পদোন্নতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

অদৃশ্য যতœশ্রমের হিসাব

অর্থনীতির আরেকটি অন্ধকার দিক হলো অবৈতনিক যতœশ্রম। ঘর গোছানো, খাবার রান্না, শিশু ও বৃদ্ধের যতœ—এসব কাজে প্রতিদিন গড়ে ছয় ঘণ্টা ৪০ মিনিট ব্যয় করেন নারীরা। পুরুষরা এই কাজে সময় দেন গড়ে মাত্র দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট।

‘অবৈতনিক গৃহস্থালি ও যত্নশ্রম জরিপ ২০২৪’-এর হিসাব অনুযায়ী, শুধু এই শ্রম অর্থনীতিতে ধরা হলে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসত নারীর অবদানে। অথচ এই শ্রমের কোনো পারিশ্রমিক নেই, নেই স্বীকৃতি।

নারীর কাজকে এখনো পরিবারে ‘সহায়ক’ বা ‘অতিরিক্ত আয়’ হিসেবে দেখা হয়। কর্মক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার হন, অনেক সময় বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হয়। করপোরেট ও প্রশাসনিক পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি কম। সন্তান ও গৃহস্থালির দায়িত্বের ভার তাঁদের সুযোগ সীমিত করে দেয়। ফলে তাঁরা সমান শ্রম দিলেও সমান মর্যাদা পান না।

আন্তর্জাতিকভাবে নারীর শ্রম

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ কিছু ক্ষেত্রে এগিয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়েও আছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাধারণত নারীর অংশগ্রহণ কম, বেকারত্ব বেশি এবং কাজগুলো হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। বাংলাদেশও সেই বাস্তবতা থেকে বের হতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা মূলত বাস্তবায়নে। সমান মজুরির আইন থাকলেও তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীরা এই সুবিধা থেকে প্রায় পুরোপুরি বঞ্চিত। এই বৈষম্য দূর করতে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

নারীদের ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, গৃহস্থালিতে নারীরা যেসব কাজ করছেন তা সরকারি হিসাব বা জিডিপিতে প্রকাশিত হয় না। ফলে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে উপেক্ষা করা হচ্ছে, যার মূল্য অনেক।

নারীর অবদানকে যদি স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে নীতি নির্ধারণকারীরা সামাজিক সেবা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে আরো বাস্তবভিত্তিক বাজেট ও কর্মসূচি তৈরি করতে পারবেন।

এ বিষয়ে নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘বিবিএসের এই গবেষণা ভবিষ্যতে লিঙ্গ-প্রতিক্রিয়াশীল নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নে সহায়তা করবে।

আমরা নারীরা পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে, জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে সমতার সম্মান চাই। জানি, এটি সহজে পাওয়া যাবে না। তবে তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে সবাইকে এই সম্মান দেওয়ার বিষয়ে রাজি করাতে হবে। ’

back to top