পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন কেনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রায় ৩৩২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে—এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্মস্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এই ভবনটি কেনায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
বুধবার এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি যাচাই-বাছাই করতে দুদক অভিযান চালায় এবং প্রাপ্ত তথ্য-নথির ভিত্তিতে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, “গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে রোজ গার্ডেন কেনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ৩৩২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দুদকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেই কমিশন ব্যবস্থা নেবে।”
রোজ গার্ডেন কেনা ও সরকারি প্রক্রিয়া
২০১৮ সালে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সংরক্ষিত পুরাকীর্তি রোজ গার্ডেন ভবনটি কিনে নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ জন্য ব্যয় হয় ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৯০০ টাকা।
ওই বছরের ৮ আগস্ট সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ভবনটি অধিগ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এরপর সরকার ব্যক্তিমালিকানাধীন এ পুরাকীর্তি কিনে নেয়।
রাজনৈতিক ইতিহাসে রোজ গার্ডেন
রোজ গার্ডেন শুধু স্থাপত্য নিদর্শন নয়; এটি রাজনৈতিক ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ভবনটিতে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী সম্মেলন থেকেই আত্মপ্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, যা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নামে পরিচিতি পায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই দলই পরবর্তীতে স্বাধিকার আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়।
রোজ গার্ডেনের স্থাপত্য ও নির্মাণ ইতিহাস
১৯৩১ সালে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ঋষিকেশ দাস পুরান ঢাকায় ২২ বিঘা জমির ওপর বাগানবাড়িটি নির্মাণ করেন। পশ্চিমমুখী দোতলা এই ভবনটি করিন্থীয়–গ্রীক শৈলীতে তৈরি, যার আয়তন প্রায় সাত হাজার বর্গফুট।
এর দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি বৃহৎ জলসা ঘর, যার মেঝেতে সাদা পাথর এবং সিলিংয়ে সবুজ কাচের ফুলের নকশা ব্যবহৃত হয়েছে। ঋষিকেশ দাস দেশ–বিদেশ থেকে আনা বিরল প্রজাতির গোলাপের বাগান, পাথরের ভাস্কর্য, সুদৃশ্য ফোয়ারা ও সামনের পুকুর দিয়ে ভবনটিকে অলংকৃত করেন। সে সময় রোজ গার্ডেন ছিল ঢাকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
তবে নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই ঋষিকেশ দেউলিয়া হয়ে পড়েন। ১৯৩৬ সালে তিনি বাড়িটি ঢাকার বই ব্যবসায়ী খান বাহাদুর মৌলভী কাজী আবদুর রশিদের কাছে বিক্রি করেন।
মালিকানা পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা
রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয় বিখ্যাত প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি, যার মালিক ছিলেন কাজী আবদুর রশিদ।
১৯৬৬ সালে ভবনের মালিকানা পান তার ভাই কাজী হুমায়ূন। তার নামেই এটি তখন ‘হুমায়ূন সাহেবের বাড়ি’ নামে পরিচিতি পায়।
১৯৭০ সালে কাজী হুমায়ূন ভবনটি মোশন পিকচার্স লিমিটেডের কাছে ভাড়া দেন, যা পরে বেঙ্গল স্টুডিও নামে জনপ্রিয় হয়।
১৯৯৩ সালে বেঙ্গল স্টুডিও চলে যাওয়ার পর ভবনটি আবার কাজী হুমায়ূন পরিবারের কাছে ফিরে আসে।
তিনি মারা যাওয়ার পর মালিকানা পান তার বংশধর কাজী রকিব।
১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রোজ গার্ডেনকে সংরক্ষিত ভবন ঘোষণা করলেও পরে মালিকানা ফেরত দেওয়া হয় মূল মালিকদের।
এরপর ভবনটির দেখভাল চলছিল কাজী রকিব পরিবারের তত্ত্বাবধানে। লায়লা রকিব ও তার সন্তানদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন দলিলমূলে ভবনটি কিনে নেয় সরকার।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন কেনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রায় ৩৩২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে—এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্মস্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এই ভবনটি কেনায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
বুধবার এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি যাচাই-বাছাই করতে দুদক অভিযান চালায় এবং প্রাপ্ত তথ্য-নথির ভিত্তিতে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, “গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে রোজ গার্ডেন কেনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ৩৩২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দুদকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেই কমিশন ব্যবস্থা নেবে।”
রোজ গার্ডেন কেনা ও সরকারি প্রক্রিয়া
২০১৮ সালে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সংরক্ষিত পুরাকীর্তি রোজ গার্ডেন ভবনটি কিনে নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ জন্য ব্যয় হয় ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৯০০ টাকা।
ওই বছরের ৮ আগস্ট সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ভবনটি অধিগ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এরপর সরকার ব্যক্তিমালিকানাধীন এ পুরাকীর্তি কিনে নেয়।
রাজনৈতিক ইতিহাসে রোজ গার্ডেন
রোজ গার্ডেন শুধু স্থাপত্য নিদর্শন নয়; এটি রাজনৈতিক ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ভবনটিতে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী সম্মেলন থেকেই আত্মপ্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, যা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নামে পরিচিতি পায়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই দলই পরবর্তীতে স্বাধিকার আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়।
রোজ গার্ডেনের স্থাপত্য ও নির্মাণ ইতিহাস
১৯৩১ সালে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ঋষিকেশ দাস পুরান ঢাকায় ২২ বিঘা জমির ওপর বাগানবাড়িটি নির্মাণ করেন। পশ্চিমমুখী দোতলা এই ভবনটি করিন্থীয়–গ্রীক শৈলীতে তৈরি, যার আয়তন প্রায় সাত হাজার বর্গফুট।
এর দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি বৃহৎ জলসা ঘর, যার মেঝেতে সাদা পাথর এবং সিলিংয়ে সবুজ কাচের ফুলের নকশা ব্যবহৃত হয়েছে। ঋষিকেশ দাস দেশ–বিদেশ থেকে আনা বিরল প্রজাতির গোলাপের বাগান, পাথরের ভাস্কর্য, সুদৃশ্য ফোয়ারা ও সামনের পুকুর দিয়ে ভবনটিকে অলংকৃত করেন। সে সময় রোজ গার্ডেন ছিল ঢাকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
তবে নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই ঋষিকেশ দেউলিয়া হয়ে পড়েন। ১৯৩৬ সালে তিনি বাড়িটি ঢাকার বই ব্যবসায়ী খান বাহাদুর মৌলভী কাজী আবদুর রশিদের কাছে বিক্রি করেন।
মালিকানা পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা
রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয় বিখ্যাত প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি, যার মালিক ছিলেন কাজী আবদুর রশিদ।
১৯৬৬ সালে ভবনের মালিকানা পান তার ভাই কাজী হুমায়ূন। তার নামেই এটি তখন ‘হুমায়ূন সাহেবের বাড়ি’ নামে পরিচিতি পায়।
১৯৭০ সালে কাজী হুমায়ূন ভবনটি মোশন পিকচার্স লিমিটেডের কাছে ভাড়া দেন, যা পরে বেঙ্গল স্টুডিও নামে জনপ্রিয় হয়।
১৯৯৩ সালে বেঙ্গল স্টুডিও চলে যাওয়ার পর ভবনটি আবার কাজী হুমায়ূন পরিবারের কাছে ফিরে আসে।
তিনি মারা যাওয়ার পর মালিকানা পান তার বংশধর কাজী রকিব।
১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রোজ গার্ডেনকে সংরক্ষিত ভবন ঘোষণা করলেও পরে মালিকানা ফেরত দেওয়া হয় মূল মালিকদের।
এরপর ভবনটির দেখভাল চলছিল কাজী রকিব পরিবারের তত্ত্বাবধানে। লায়লা রকিব ও তার সন্তানদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন দলিলমূলে ভবনটি কিনে নেয় সরকার।