যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইউরোপজুড়ে বিক্ষোভ, লন্ডনে ৫০০ গ্রেপ্তার
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ চলছে। গতকাল নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামেও বিক্ষোভ হয়েছে। এটি তারই ছবি
গাজায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নানা প্রচেষ্টা চললেও ইসরাইল গাজায় নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করেনি। ট্রাম্পের শান্তি আহ্বান উপেক্ষা করে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গতকাল শনিবার উপত্যকাটির বিভিন্ন এলাকায় হামলায় কমপক্ষে ৭০ জন নিহত হয়েছেন। রয়টার্স ও আল জাজিরা এ তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে ও যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইউরোপজুড়ে বড় বড় শহরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ-মিছিল করেছেন। যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালসহ বিভিন্ন দেশে এসব বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনে প্রায় ৫শ’ বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার দুর্ভিক্ষকবলিত গাজায় ইসরায়েলের হামলায় কমপক্ষে ৪৫ জন প্যালেস্টাইনি নিহত হন। কয়েক সপ্তাহ ধরেই ইসরায়েলি সেনারা শহরটিতে জোরালো অভিযান চালাচ্ছেন। এতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দক্ষিণের জনাকীর্ণ এলাকায় পালাতে বাধ্য হয়েছেন। চিকিৎসাকর্মীরা বলেছেন, গাজা সিটির তুফফাহ এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় ১৮ জন নিহত ও আরও কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এ সময়ে বোমা বিস্ফোরণে আশপাশের বেশ কয়েকটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে গাজার জরুরি পরিষেবা বিভাগ বলেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই মাস থেকে আট বছর বয়সী সাতটি শিশুও রয়েছে। ইসরায়েলি সেনারা দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকার একটি বাস্তুচ্যুত শিবিরকে লক্ষ্য করেও হামলা চালিয়েছেন। সেখানে ২ শিশু নিহত ও অন্তত ৮ জন আহত হয়েছেন।
রোববার জাওয়াইদা থেকে আল-জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খোদারি বলেন, মধ্যাঞ্চলীয় গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরসহ অন্য জায়গাতেও বিমান হামলা চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলো এত প্যালেস্টাইনিকে চিকিৎসা দিতে সক্ষম নয়।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ট্রাম্প তার দূত স্টিভ উইটকফ ও জামাতা জ্যারেড কুশনারকে মিসরে পাঠাবেন। সেখানে তারা জিম্মি মুক্তির কারিগরি দিকগুলো চূড়ান্ত করবেন এবং স্থায়ী শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা করবেন। মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে,
আগামীকাল (সোমবার) ইসরায়েল ও হামাসের প্রতিনিধিদলও মিসরে বসবে এবং বিষয়গুলো নিয়ে আরও আলোচনা করবে।
ডনাল্ড ট্রাম্প হামাসকে দ্রুত জিম্মিদের মুক্তি দিতে এবং যুদ্ধ বন্ধে তার শান্তি পরিকল্পনাসংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত করতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘না হলে সবই হাতছাড়া হয়ে যাবে।’ ট্রাম্প তার মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘আমি দেরি মেনে নেব না, যা অনেকেই ঘটবে বলে মনে করছেন। এমন কোনো ফলাফলও মেনে নেব না, যেখানে গাজা আবার হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এটা দ্রুত শেষ করি দ্রুত। সবার সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করা হবে।’
রোববার আলাদা একটি পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, ইসরায়েল প্রাথমিকভাবে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে সম্মত হয়েছে এবং তা হামাসকে জানানো হয়েছে। তিনি লেখেন, ‘হামাস এটা নিশ্চিত করলে যুদ্ধবিরতি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। জিম্মি ও বন্দীবিনিময় শুরু হবে এবং আমরা পরবর্তী ধাপের (ইসরায়েলি সেনা) প্রত্যাহারের জন্য শর্তগুলো তৈরি করব।’
হামাস ট্রাম্পের ২০ দফা প্রস্তাবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ মেনে নিয়েছে। এরমধ্যে আছে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং ইসরায়েলি জিম্মি ও প্যালেস্টাইনি বন্দীদের মুক্তির বিষয়টি। তবে হামাস অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত আছে কিনা- এ ধরনের কিছু বিষয় এখনও পরিষ্কার করেনি।
ইউরোপ জুড়ে বিক্ষোভ
এদিকে গাজায় ইসরায়লের গণহত্যার প্রতিবাদে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তুমুল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল করছেন শান্তিবাদী মানুষ। স্পেনের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর বার্সেলোনা ও রাজধানী মাদ্রিদে গতকাল শনিবার যে বিক্ষোভ হয়েছে তার ডাক দেয়া হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ আগেই। তবে ইতালির রোম ও পর্তুগালের লিসবনে বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয় গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’কে ইসরায়েল আটক করার পর।
এদিকে গাজার জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে গত শুক্রবার ইতালিতে একদিনের সাধারণ ধর্মঘটে ২০ লাখের বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। গত কয়েক সপ্তাহে স্পেনে প্যালেস্টাইনিদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশটির সরকার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করছে।
গত মাসে একটি সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ইসরায়েলি একটি দল স্পেনে গিয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। ফলে প্রতিযোগিতার আয়োজন ব্যাহত হয়। ওই সময় স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ গাজায় চলমান যুদ্ধকে ‘জাতিহত্যা’ বলে আখ্যা দেন এবং আন্তর্জাতিক সব ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ইসরায়েলি দলের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। বার্সেলোনার টাউন হল কর্তৃপক্ষ বলেছে, সেখানে গতকাল শনিবারের বিক্ষোভে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে ধারণা পুলিশের।
বিক্ষোভে অংশ নিতে অন্য একটি শহর থেকে এক ঘণ্টা যাত্রা করে বার্সেলোনা এসেছেন ৬৩ বছর বয়সী মারিয়া জেসুস পাররা। বিক্ষোভ-মিছিলে তিনি প্যালেস্টাইনি পতাকা উঁচু করে ধরে ছিলেন। মারিয়া বলেন, তিনি চান, তিনি টেলিভিশনে প্রতিদিন গাজায় নৃশংসতার যে ভয়াবহ চিত্র দেখেন তার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
মারিয়া বলেন, ‘১৯৪০-এর দশকে (ইউরোপে যেমন) দেখেছিলাম, তেমন একটি জাতিহত্যা এবার আমরা চোখের সামনে ঘটতে দেখছি, এও কীভাবে সম্ভব? এখন আর কেউ এটা বলতে পারবে না যে, সেখানে কী ঘটছে, তারা সেটা জানতেন না।’
ম্যানচেস্টারে একটি সিনাগগে প্রাণঘাতী হামলার পর পুলিশ লন্ডনে গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ স্থগিত করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন প্যালেস্টাইন অ্যাকশনের সমর্থনে লন্ডনে রোববার একটি বিক্ষোভ-মিছিল বের হয়। পুলিশ মিছিল থেকে অন্তত ৪৪২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। দ্য গার্ডিয়ান তার প্রতিবেদনে এ সংখ্যা ৫০০ বলে জানিয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই’ গাজায় থাকা জিম্মিদের মুক্তির ঘোষণা দিতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
টেলিভিশনে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘হামাসকে নিরস্ত্র করা হবে এবং গাজাকে সামরিক বাহিনী মুক্ত করা হবে- সহজ হোক আর কঠিন উপায়ে হোক, এটি অর্জিত হবেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি পরিকল্পনার আওতায় হামাস গত শুক্রবার বিবৃতিতে জিম্মিদেরকে মুক্তি দিতে রাজি হওয়ার পর নেতানিয়াহু এ মন্তব্য করলেন।
গাজায় হামলার পর হামাস গতকাল শনিবার বলেছে, ইসরায়েল হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ইসরায়েলের ওপর বিশ্বের চাপ আহ্বান করেছে। গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে আজ থেকে পক্ষগুলোর মধ্যে মিশরে পরোক্ষ আলোচনা শুরু হওয়ার কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০-দফা শান্তি প্রস্তাবে অবিলম্বে লড়াই বন্ধ করা ও ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির পাশাপাশি শত শত প্যালেস্টাইনি বন্দীর মুক্তির বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত আছে। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) জানিয়েছে, ট্রাম্পের প্রস্তাবের প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে প্রস্তুতির জন্য তারা একটি আদেশ জারি করেছে। এতে ইসরায়েলি সেনাদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে।
হামাস ট্রাম্পের প্রস্তাব গ্রহণের জন্য চাপের মুখে পড়েছে। তারা সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে এবং গাজা টেকনোক্র্যাট শাসিত হবে বলে মেনে নিয়েছে। তবে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে হামাস কিছু বলেনি, যা ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান দাবি। গাজা ও ইসরায়েল- উভয়পক্ষেই একটি সতর্ক আশাবাদ আছে যে, চলমান উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তিতে গড়াতে পারে।
যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য আছে, তার মধ্যে আছে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি। যুদ্ধ শেষ করেছেন এমন একজন হিসেবে তিনি স্মরণীয় ও পুরস্কৃত হতে চান। তিনি প্রকাশ্যে হামাসকে আহ্বান জানাচ্ছেন, আরও সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছেন। সম্প্রতি ইসরায়েলের নেতৃত্বের সঙ্গে ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান অস্বস্তিরও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তবে এটি এখনও স্পষ্ট নয় যে, ট্রাম্প-প্রভাব যথেষ্ট হবে কিনা।
এখন যেসব বাধা দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আগেও ছিল। হামাস সব সময় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর পূর্ণ প্রত্যাহার চেয়ে আসছে। জিম্মি মুক্তির পর ইসরায়েল আবার যুদ্ধ শুরু করবে না এমন নিশ্চয়তাও চায় তারা। গোষ্ঠীটি জানে জিম্মি হাতে রাখা ছাড়া এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। গাজার প্যালেস্টাইনিদের মধ্যে শান্তি প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় আশা ও গভীর সন্দেহ দেখা যাচ্ছে। গাজায় অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, হামাস ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে। আবার অন্যরা মনে করছেন, দুই বছরের সংঘাত শেষ করতে এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ।
প্যালেস্টাইনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার মধ্যে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও প্যালেস্টাইনি বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলি জিম্মিদের ছেড়ে দেয়াসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের প্রায় দুই বছরের টানা হামলা ৬৭ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছে ভূখণ্ডটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এর তিন গুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইউরোপজুড়ে বিক্ষোভ, লন্ডনে ৫০০ গ্রেপ্তার
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ চলছে। গতকাল নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামেও বিক্ষোভ হয়েছে। এটি তারই ছবি
রোববার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫
গাজায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নানা প্রচেষ্টা চললেও ইসরাইল গাজায় নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করেনি। ট্রাম্পের শান্তি আহ্বান উপেক্ষা করে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গতকাল শনিবার উপত্যকাটির বিভিন্ন এলাকায় হামলায় কমপক্ষে ৭০ জন নিহত হয়েছেন। রয়টার্স ও আল জাজিরা এ তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে ও যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে ইউরোপজুড়ে বড় বড় শহরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ-মিছিল করেছেন। যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেন ও পর্তুগালসহ বিভিন্ন দেশে এসব বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনে প্রায় ৫শ’ বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার দুর্ভিক্ষকবলিত গাজায় ইসরায়েলের হামলায় কমপক্ষে ৪৫ জন প্যালেস্টাইনি নিহত হন। কয়েক সপ্তাহ ধরেই ইসরায়েলি সেনারা শহরটিতে জোরালো অভিযান চালাচ্ছেন। এতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দক্ষিণের জনাকীর্ণ এলাকায় পালাতে বাধ্য হয়েছেন। চিকিৎসাকর্মীরা বলেছেন, গাজা সিটির তুফফাহ এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় ১৮ জন নিহত ও আরও কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এ সময়ে বোমা বিস্ফোরণে আশপাশের বেশ কয়েকটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে গাজার জরুরি পরিষেবা বিভাগ বলেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুই মাস থেকে আট বছর বয়সী সাতটি শিশুও রয়েছে। ইসরায়েলি সেনারা দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকার একটি বাস্তুচ্যুত শিবিরকে লক্ষ্য করেও হামলা চালিয়েছেন। সেখানে ২ শিশু নিহত ও অন্তত ৮ জন আহত হয়েছেন।
রোববার জাওয়াইদা থেকে আল-জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খোদারি বলেন, মধ্যাঞ্চলীয় গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরসহ অন্য জায়গাতেও বিমান হামলা চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলো এত প্যালেস্টাইনিকে চিকিৎসা দিতে সক্ষম নয়।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ট্রাম্প তার দূত স্টিভ উইটকফ ও জামাতা জ্যারেড কুশনারকে মিসরে পাঠাবেন। সেখানে তারা জিম্মি মুক্তির কারিগরি দিকগুলো চূড়ান্ত করবেন এবং স্থায়ী শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা করবেন। মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে,
আগামীকাল (সোমবার) ইসরায়েল ও হামাসের প্রতিনিধিদলও মিসরে বসবে এবং বিষয়গুলো নিয়ে আরও আলোচনা করবে।
ডনাল্ড ট্রাম্প হামাসকে দ্রুত জিম্মিদের মুক্তি দিতে এবং যুদ্ধ বন্ধে তার শান্তি পরিকল্পনাসংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত করতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘না হলে সবই হাতছাড়া হয়ে যাবে।’ ট্রাম্প তার মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘আমি দেরি মেনে নেব না, যা অনেকেই ঘটবে বলে মনে করছেন। এমন কোনো ফলাফলও মেনে নেব না, যেখানে গাজা আবার হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এটা দ্রুত শেষ করি দ্রুত। সবার সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করা হবে।’
রোববার আলাদা একটি পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, ইসরায়েল প্রাথমিকভাবে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে সম্মত হয়েছে এবং তা হামাসকে জানানো হয়েছে। তিনি লেখেন, ‘হামাস এটা নিশ্চিত করলে যুদ্ধবিরতি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। জিম্মি ও বন্দীবিনিময় শুরু হবে এবং আমরা পরবর্তী ধাপের (ইসরায়েলি সেনা) প্রত্যাহারের জন্য শর্তগুলো তৈরি করব।’
হামাস ট্রাম্পের ২০ দফা প্রস্তাবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ মেনে নিয়েছে। এরমধ্যে আছে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং ইসরায়েলি জিম্মি ও প্যালেস্টাইনি বন্দীদের মুক্তির বিষয়টি। তবে হামাস অস্ত্র সমর্পণ করতে প্রস্তুত আছে কিনা- এ ধরনের কিছু বিষয় এখনও পরিষ্কার করেনি।
ইউরোপ জুড়ে বিক্ষোভ
এদিকে গাজায় ইসরায়লের গণহত্যার প্রতিবাদে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তুমুল বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল করছেন শান্তিবাদী মানুষ। স্পেনের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর বার্সেলোনা ও রাজধানী মাদ্রিদে গতকাল শনিবার যে বিক্ষোভ হয়েছে তার ডাক দেয়া হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ আগেই। তবে ইতালির রোম ও পর্তুগালের লিসবনে বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয় গাজা অভিমুখী ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’কে ইসরায়েল আটক করার পর।
এদিকে গাজার জনগণের প্রতি সংহতি জানিয়ে গত শুক্রবার ইতালিতে একদিনের সাধারণ ধর্মঘটে ২০ লাখের বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। গত কয়েক সপ্তাহে স্পেনে প্যালেস্টাইনিদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশটির সরকার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করছে।
গত মাসে একটি সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ইসরায়েলি একটি দল স্পেনে গিয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। ফলে প্রতিযোগিতার আয়োজন ব্যাহত হয়। ওই সময় স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ গাজায় চলমান যুদ্ধকে ‘জাতিহত্যা’ বলে আখ্যা দেন এবং আন্তর্জাতিক সব ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ইসরায়েলি দলের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। বার্সেলোনার টাউন হল কর্তৃপক্ষ বলেছে, সেখানে গতকাল শনিবারের বিক্ষোভে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে ধারণা পুলিশের।
বিক্ষোভে অংশ নিতে অন্য একটি শহর থেকে এক ঘণ্টা যাত্রা করে বার্সেলোনা এসেছেন ৬৩ বছর বয়সী মারিয়া জেসুস পাররা। বিক্ষোভ-মিছিলে তিনি প্যালেস্টাইনি পতাকা উঁচু করে ধরে ছিলেন। মারিয়া বলেন, তিনি চান, তিনি টেলিভিশনে প্রতিদিন গাজায় নৃশংসতার যে ভয়াবহ চিত্র দেখেন তার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
মারিয়া বলেন, ‘১৯৪০-এর দশকে (ইউরোপে যেমন) দেখেছিলাম, তেমন একটি জাতিহত্যা এবার আমরা চোখের সামনে ঘটতে দেখছি, এও কীভাবে সম্ভব? এখন আর কেউ এটা বলতে পারবে না যে, সেখানে কী ঘটছে, তারা সেটা জানতেন না।’
ম্যানচেস্টারে একটি সিনাগগে প্রাণঘাতী হামলার পর পুলিশ লন্ডনে গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ স্থগিত করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন প্যালেস্টাইন অ্যাকশনের সমর্থনে লন্ডনে রোববার একটি বিক্ষোভ-মিছিল বের হয়। পুলিশ মিছিল থেকে অন্তত ৪৪২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। দ্য গার্ডিয়ান তার প্রতিবেদনে এ সংখ্যা ৫০০ বলে জানিয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই’ গাজায় থাকা জিম্মিদের মুক্তির ঘোষণা দিতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
টেলিভিশনে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘হামাসকে নিরস্ত্র করা হবে এবং গাজাকে সামরিক বাহিনী মুক্ত করা হবে- সহজ হোক আর কঠিন উপায়ে হোক, এটি অর্জিত হবেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি পরিকল্পনার আওতায় হামাস গত শুক্রবার বিবৃতিতে জিম্মিদেরকে মুক্তি দিতে রাজি হওয়ার পর নেতানিয়াহু এ মন্তব্য করলেন।
গাজায় হামলার পর হামাস গতকাল শনিবার বলেছে, ইসরায়েল হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ইসরায়েলের ওপর বিশ্বের চাপ আহ্বান করেছে। গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে আজ থেকে পক্ষগুলোর মধ্যে মিশরে পরোক্ষ আলোচনা শুরু হওয়ার কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০-দফা শান্তি প্রস্তাবে অবিলম্বে লড়াই বন্ধ করা ও ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির পাশাপাশি শত শত প্যালেস্টাইনি বন্দীর মুক্তির বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত আছে। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) জানিয়েছে, ট্রাম্পের প্রস্তাবের প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে প্রস্তুতির জন্য তারা একটি আদেশ জারি করেছে। এতে ইসরায়েলি সেনাদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে।
হামাস ট্রাম্পের প্রস্তাব গ্রহণের জন্য চাপের মুখে পড়েছে। তারা সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে এবং গাজা টেকনোক্র্যাট শাসিত হবে বলে মেনে নিয়েছে। তবে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে হামাস কিছু বলেনি, যা ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান দাবি। গাজা ও ইসরায়েল- উভয়পক্ষেই একটি সতর্ক আশাবাদ আছে যে, চলমান উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তিতে গড়াতে পারে।
যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য আছে, তার মধ্যে আছে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি। যুদ্ধ শেষ করেছেন এমন একজন হিসেবে তিনি স্মরণীয় ও পুরস্কৃত হতে চান। তিনি প্রকাশ্যে হামাসকে আহ্বান জানাচ্ছেন, আরও সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছেন। সম্প্রতি ইসরায়েলের নেতৃত্বের সঙ্গে ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান অস্বস্তিরও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তবে এটি এখনও স্পষ্ট নয় যে, ট্রাম্প-প্রভাব যথেষ্ট হবে কিনা।
এখন যেসব বাধা দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আগেও ছিল। হামাস সব সময় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর পূর্ণ প্রত্যাহার চেয়ে আসছে। জিম্মি মুক্তির পর ইসরায়েল আবার যুদ্ধ শুরু করবে না এমন নিশ্চয়তাও চায় তারা। গোষ্ঠীটি জানে জিম্মি হাতে রাখা ছাড়া এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। গাজার প্যালেস্টাইনিদের মধ্যে শান্তি প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় আশা ও গভীর সন্দেহ দেখা যাচ্ছে। গাজায় অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে, হামাস ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে। আবার অন্যরা মনে করছেন, দুই বছরের সংঘাত শেষ করতে এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ।
প্যালেস্টাইনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার মধ্যে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও প্যালেস্টাইনি বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলি জিম্মিদের ছেড়ে দেয়াসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের প্রায় দুই বছরের টানা হামলা ৬৭ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছে ভূখণ্ডটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এর তিন গুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।