সবাই জানত কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু ঝড়ের সময় দক্ষিণ গাজার উপকূলে শত শত তাঁবুর বাসিন্দাদের তেমন কিছু করার ছিল না। ৬২ বছর বয়সী সাবাহ আল-ব্রিম তাঁর এক মেয়ে ও কয়েকজন নাতি-নাতনি নিয়ে তাদের বর্তমান আশ্রয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এটা ছিল ত্রিপল ও কাঠের তৈরি অস্থায়ী স্থাপনা। গত সপ্তাহে যখন গাজাজুড়ে প্রবল বাতাস ও বৃষ্টিপাত শুরু হয়, তখন তারা এভাবেই চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন।
পরিস্থিতির বর্ণনা করত গিয়ে সাবাহ বলেন, ‘সবকিছু ভেঙে পড়েছিল। আমরা আশ্রয়স্থল মেরামত করেছিলাম। কিন্তু রাতে প্রবল বৃষ্টিতে আবার তা ভেঙে পড়ে। আমাদের সব জিনিসপত্র ভিজে যায়। বাতাস বয়ে যাওয়ার দিনটি আমাদের জন্য একটি কালো দিন ছিল।’ মূলত খান ইউনিসের বাসিন্দা সাবাহ বলেন, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরুর পর থেকে তিনি একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
দক্ষিণ গাজার সংকীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল আল-মাওয়াসিতে তাঁবু বানিয়ে বসবাস করছেন প্রায় পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনি। তাদের জন্য আসন্ন শীত এক ভয়াবহ আতঙ্ক। কারণ, শীত মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেই তাদের। না আছে ঠান্ডা বাতাস ঠেকানোর ঘর, না কোনো গরম কাপড়।
গতকাল বৃহস্পতিবার দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সপ্তাহের ঝড় গাজার ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির মানবিক সংকটকে আরও একবার উন্মুক্ত করেছে। সহায়তা সংস্থাগুলো বলছে, এ বাস্তুচ্যুতদের জন্য আশ্রয় হলো সবচেয়ে জরুরি। গাজার বেশির ভাগ বাড়িঘর ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস, অথবা বাস অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অনেকের বাড়ি ইসরায়েলের দখল করা ‘হলুদ রেখা’র ভেতরে। ওই স্থানে তারা আর যেতে পারেন না। গাজার আয়তন এখন আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। চাষের জমি নেই; বাসেরও জায়গা নেই। ঝড়ের পর খালি পায়ে শিশুরা কাদাযুক্ত মাটিতে চলাফেরা করে; নারীরা খোলা আকাশের নিচে রান্না করেন। কেউ কেউ ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন, এমনকি যেসব ভবন ধসের ঝুঁকিতে ছিল, সেগুলোতেও তারা গেছেন। গাজার বাসিন্দা ও মানবিক সহায়তা কর্মকর্তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির ২০ দফায় গাজায় ‘পূর্ণ সহায়তা’ পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু যা পৌঁছাচ্ছে, তা একেবারেই অপর্যাপ্ত। আন্তর্জাতিক এক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা কি ভালো? হ্যাঁ, এই অর্থে যে, মানুষ আর অনাহারে মরছে না। এটা কি যথেষ্ট? একেবারেই না। আমাদের কাছে তাঁবু ও ত্রিপলের বিশাল মজুত আছে। কিন্তু আমরা সেগুলো (গাজার) ভেতরে আনতে পারছি না।’
ইসরায়েল মিসর থেকে রাফা স্থলবন্দর হয়ে গাজায় ত্রাণের ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেয় না। এ কারণে মিসর ও জর্ডান সীমান্তে শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক আটকে আছে। ফলে উপত্যকায় নিত্যপণ্যের জোগানের ঘাটতি রয়েই গেছে। ফিলিস্তিনিদের কাছে নগদ অর্থ নেই। খাবার, ওষুধ বা দুর্লভ রান্নার গ্যাস কিনতে পারছেন না।
আলজাজিরা জানায়, গাজায় গতকাল বৃহস্পতিবার এক দিনে ইসরায়েলের হামলায় ১২ শিশু, আট নারীসহ ৩২ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। আহত হয়েছেন ৮৮ জন। এর মধ্যে দক্ষিণ গাজার বানি সুহেইল এলাকায় বিমান হামলায় তিনজন নিহত হন। খান ইউনিসের আবাসান আল-ক্যাবিরায় একজন নিহত হয়েছেন। গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতির পর থেকে ইসরায়েল ৩১২ জনকে হত্যা করেছে; ৭৬০ জন আহত হয়েছেন।
এদিকে,আল-জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খুদারি বৃহস্পতিবার গাজা সিটি থেকে জানান, ইসরায়েলি সৈন্যরা শুজায়েয়ার পূর্বাঞ্চলে নতুন অবস্থান চিহ্নিত করতে হলুদ রঙের ব্লক ও সাইনবোর্ড বসাচ্ছিল। খুদারি বলেন, ‘তবে পুরো সীমানা চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে অনেক ফিলিস্তিনি জানেই না ঠিক কোথায় রয়েছে এই লাইন।’ এই প্রতিবেদক আরও বলেন, ‘শুজায়েয়ায় নতুন অগ্রসরতার ফলে আরও বেশি মানুষ তাদের ঘরে ফিরতে পারছে না। মানুষ বলছে, তাদের ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে ঠেলে এক খাঁচার মধ্যে আটকে ফেলা হচ্ছে।’
হলুদ রেখা লঙ্ঘনের এই খবর নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে পুরো গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা ফের তীব্র হয়ে উঠেছে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় নতুন আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৩২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আরও ৮৮ জন।
চিকিৎসকরা জানান, খান ইউনিসের পূর্বে বানি সুউহেইলার এক বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তিনজন নিহত হয়েছে, নিহতদের মধ্যে এক শিশু কন্যাও ছিল। আহত হয়েছে আরও ১৫ জন। আল-জাজিরার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে ইসরায়েল অন্তত ৪০০ বার এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। ৩৬ বছর বয়সী বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি মোহাম্মদ হামদুন্না এএফপিকে বলেন, ‘প্রতিদিনই মানুষ মরছে, গোলাবর্ষণ থামে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো তাঁবুতে থাকি। শহরগুলো ধ্বংসস্তূপ, সব সীমান্ত বন্ধ, জীবনের ন্যূনতম চাহিদাগুলোও নেই।’
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫
সবাই জানত কী ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু ঝড়ের সময় দক্ষিণ গাজার উপকূলে শত শত তাঁবুর বাসিন্দাদের তেমন কিছু করার ছিল না। ৬২ বছর বয়সী সাবাহ আল-ব্রিম তাঁর এক মেয়ে ও কয়েকজন নাতি-নাতনি নিয়ে তাদের বর্তমান আশ্রয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এটা ছিল ত্রিপল ও কাঠের তৈরি অস্থায়ী স্থাপনা। গত সপ্তাহে যখন গাজাজুড়ে প্রবল বাতাস ও বৃষ্টিপাত শুরু হয়, তখন তারা এভাবেই চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন।
পরিস্থিতির বর্ণনা করত গিয়ে সাবাহ বলেন, ‘সবকিছু ভেঙে পড়েছিল। আমরা আশ্রয়স্থল মেরামত করেছিলাম। কিন্তু রাতে প্রবল বৃষ্টিতে আবার তা ভেঙে পড়ে। আমাদের সব জিনিসপত্র ভিজে যায়। বাতাস বয়ে যাওয়ার দিনটি আমাদের জন্য একটি কালো দিন ছিল।’ মূলত খান ইউনিসের বাসিন্দা সাবাহ বলেন, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরুর পর থেকে তিনি একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
দক্ষিণ গাজার সংকীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল আল-মাওয়াসিতে তাঁবু বানিয়ে বসবাস করছেন প্রায় পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনি। তাদের জন্য আসন্ন শীত এক ভয়াবহ আতঙ্ক। কারণ, শীত মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেই তাদের। না আছে ঠান্ডা বাতাস ঠেকানোর ঘর, না কোনো গরম কাপড়।
গতকাল বৃহস্পতিবার দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সপ্তাহের ঝড় গাজার ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির মানবিক সংকটকে আরও একবার উন্মুক্ত করেছে। সহায়তা সংস্থাগুলো বলছে, এ বাস্তুচ্যুতদের জন্য আশ্রয় হলো সবচেয়ে জরুরি। গাজার বেশির ভাগ বাড়িঘর ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস, অথবা বাস অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অনেকের বাড়ি ইসরায়েলের দখল করা ‘হলুদ রেখা’র ভেতরে। ওই স্থানে তারা আর যেতে পারেন না। গাজার আয়তন এখন আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। চাষের জমি নেই; বাসেরও জায়গা নেই। ঝড়ের পর খালি পায়ে শিশুরা কাদাযুক্ত মাটিতে চলাফেরা করে; নারীরা খোলা আকাশের নিচে রান্না করেন। কেউ কেউ ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন, এমনকি যেসব ভবন ধসের ঝুঁকিতে ছিল, সেগুলোতেও তারা গেছেন। গাজার বাসিন্দা ও মানবিক সহায়তা কর্মকর্তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির ২০ দফায় গাজায় ‘পূর্ণ সহায়তা’ পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু যা পৌঁছাচ্ছে, তা একেবারেই অপর্যাপ্ত। আন্তর্জাতিক এক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা কি ভালো? হ্যাঁ, এই অর্থে যে, মানুষ আর অনাহারে মরছে না। এটা কি যথেষ্ট? একেবারেই না। আমাদের কাছে তাঁবু ও ত্রিপলের বিশাল মজুত আছে। কিন্তু আমরা সেগুলো (গাজার) ভেতরে আনতে পারছি না।’
ইসরায়েল মিসর থেকে রাফা স্থলবন্দর হয়ে গাজায় ত্রাণের ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেয় না। এ কারণে মিসর ও জর্ডান সীমান্তে শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক আটকে আছে। ফলে উপত্যকায় নিত্যপণ্যের জোগানের ঘাটতি রয়েই গেছে। ফিলিস্তিনিদের কাছে নগদ অর্থ নেই। খাবার, ওষুধ বা দুর্লভ রান্নার গ্যাস কিনতে পারছেন না।
আলজাজিরা জানায়, গাজায় গতকাল বৃহস্পতিবার এক দিনে ইসরায়েলের হামলায় ১২ শিশু, আট নারীসহ ৩২ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। আহত হয়েছেন ৮৮ জন। এর মধ্যে দক্ষিণ গাজার বানি সুহেইল এলাকায় বিমান হামলায় তিনজন নিহত হন। খান ইউনিসের আবাসান আল-ক্যাবিরায় একজন নিহত হয়েছেন। গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতির পর থেকে ইসরায়েল ৩১২ জনকে হত্যা করেছে; ৭৬০ জন আহত হয়েছেন।
এদিকে,আল-জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খুদারি বৃহস্পতিবার গাজা সিটি থেকে জানান, ইসরায়েলি সৈন্যরা শুজায়েয়ার পূর্বাঞ্চলে নতুন অবস্থান চিহ্নিত করতে হলুদ রঙের ব্লক ও সাইনবোর্ড বসাচ্ছিল। খুদারি বলেন, ‘তবে পুরো সীমানা চিহ্নিত করা হয়নি। ফলে অনেক ফিলিস্তিনি জানেই না ঠিক কোথায় রয়েছে এই লাইন।’ এই প্রতিবেদক আরও বলেন, ‘শুজায়েয়ায় নতুন অগ্রসরতার ফলে আরও বেশি মানুষ তাদের ঘরে ফিরতে পারছে না। মানুষ বলছে, তাদের ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে ঠেলে এক খাঁচার মধ্যে আটকে ফেলা হচ্ছে।’
হলুদ রেখা লঙ্ঘনের এই খবর নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে পুরো গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা ফের তীব্র হয়ে উঠেছে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় নতুন আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৩২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আরও ৮৮ জন।
চিকিৎসকরা জানান, খান ইউনিসের পূর্বে বানি সুউহেইলার এক বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তিনজন নিহত হয়েছে, নিহতদের মধ্যে এক শিশু কন্যাও ছিল। আহত হয়েছে আরও ১৫ জন। আল-জাজিরার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে ইসরায়েল অন্তত ৪০০ বার এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। ৩৬ বছর বয়সী বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি মোহাম্মদ হামদুন্না এএফপিকে বলেন, ‘প্রতিদিনই মানুষ মরছে, গোলাবর্ষণ থামে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো তাঁবুতে থাকি। শহরগুলো ধ্বংসস্তূপ, সব সীমান্ত বন্ধ, জীবনের ন্যূনতম চাহিদাগুলোও নেই।’