রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তাতে একগুচ্ছ সুপারিশ রয়েছে। এরমধ্যে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা, ক্যাপিটাল সিটি সরকার, মন্ত্রণালয়ের কলেবর কমিয়ে আনা, সরকারি সেবার প্রাপ্যতা নিয়ে গণশুনানির আয়োজনসহ নানা বিষয় রয়েছে।
বুধবার ৫ফেব্রুয়ারি দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ প্রতিবেদন তুলে দেন কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। পরে সেখানে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন কমিশন প্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমরা স্বল্পমেয়াদি কিছু সুপারিশ করেছি যেগুলো ছয় মাসের মধ্যে করা যাবে, মধ্যমেয়াদি কিছু সুপারিশ করেছি যেগুলো এক থেকে দুই বছরের মধ্যে করা যাবে। দীর্ঘমেয়াদি কিছু সুপারিশ আছে যেগুলো পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে দেখা যেতে পারে।’
একই দিন বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে দেন। পরে যমুনার লনে দুই কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ব্রিফিং করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সেখানে উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদারও উপস্থিত ছিলেন।
বাধ্যতামূলক অবসর বাতিল
কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৫ বছর চাকরি করলেই সব সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারবেন, এমন সুবিধা রাখার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। বর্তমানে ২৫ বছর চাকরি করলে পেনশন-সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ পান কর্মকর্তারা। এমনকি সরকার ইচ্ছা করলে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে পারেন। বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিশন।
১৫ বছর চাকরি করার পর সব সুবিধাসহ অবসরের অনুমতি দেয়ার সুপারিশে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বলেছে, এটি কর্মজীবন পরিবর্তনের সুবিধা দেবে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি না করার সুপারিশ করেছে। কমিশন বলছে, কোনো ওএসডি কর্মকর্তাকে কাজ না দিয়ে বেতন-ভাতা দেয়ার পরিবর্তে তাদের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে শিক্ষকতা বা প্রশিক্ষণকেন্দ্রে সাময়িকভাবে পদায়ন করা যেতে পারে।
স্থায়ী বেতন কমিশন
কমিশন বলছে, দেশের মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া ইনডেক্স বিশ্লেষণ করে মূল বেতন প্রতিবছর বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তবে তা ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এ উদ্দেশ্যে একটি স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে উপসচিবদের গাড়ি কেনা ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এ সুযোগ সচিবালয়ের বাইরে অন্যান্য সার্ভিসের কর্মকর্তাদের জন্য নেই। এ ব্যবস্থা বাতিল করার সুপারিশ করা হলো। এতে বৈষম্য দূর হবে এবং সরকারের ব্যয় কমবে।
এ ছাড়া শূন্যপদ ছাড়া পদোন্নতি না দেয়া, প্রশাসনিক ন্যায়পাল নিয়োগ করা, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কমানোসহ আরও বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
সচিবালয় চলবে এসইএসে
বিদ্যমান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারকে ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস’ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এই ক্যাডার সার্ভিসের পদগুলো মাঠ প্রশাসনেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর সচিবালয় চলবে সব সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস)’-এর কর্মকর্তাদের দিয়ে। এখানে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদের কর্মকর্তারা থাকবেন। ‘এসইএসে’ উপসচিব পদে প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য সার্ভিসের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখা হবে।
সুপারিশ অনুযায়ী, মাঠপর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের শুরুর পদের নাম এখনকার মতো সহকারী কমিশনার। মাঠপর্যায়ে তাদের শীর্ষ পদ হবে বিভাগীয় কমিশনার; যাদের পদমর্যাদা হবে গ্রেড-১; যা সচিবের সমান। তবে এই সার্ভিসের জন্য একটি শীর্ষ পদ থাকবে, নাম হবে ‘প্রধান কমিশনার’; যিনি বিশেষ গ্রেড পাবেন; যা মুখ্য সচিবের সমান। এর সঙ্গে মিল রেখে অন্যান্য সার্ভিসের জন্যও ভিন্ন নামে পদ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। বিসিএসের আওতায় বিদ্যমান একীভূত ‘ক্যাডার সার্ভিস’ বাতিল করে সার্ভিসের ধরন অনুযায়ী আলাদা নামকরণের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২৬টি ক্যাডারকে কমিয়ে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সার্ভিসগুলোর পদসোপান কেমন হবে, তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসন সার্ভিসের শুরুর পদ হবে সহকারী কমিশনার। তারপর পর্যায়ক্রমে জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার ও উপজেলা কমিশনার (এখনকার ইউএনও), যাদের বেতন গ্রেড হবে ৬; তারপর অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (এখনকার এডিসি), যাদের বেতন গ্রেড-৫; তারপর জেলা কমিশনার (এখনকার ডিসি), যাদের বেতন গ্রেড-৩, অর্থাৎ যুগ্ম সচিবের সমান। বর্তমানে তাদের বেতন গ্রেড-৫। তার ওপরের পদ হবে অতিরিক্তি বিভাগীয় কমিশনার, যাদের বেতন গ্রেড হবে ২। তারপর বিভাগীয় কমিশনার।
অনুরূপভাবে অন্যান্য সার্ভিসের পদগুলো হবে পর্যায়ক্রমে সহকারী পরিচালক, উপজেলা প্রধান, অতিরিক্ত পরিচালক, পরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও মহাপরিচালক। এর বাইরে প্রতিটি সার্ভিসের জন্য একটি শীর্ষ পদ থাকবে। যেমন ‘চিফ অব হেলথ সার্ভিস’। প্রতিটি সার্ভিসের কর্মকর্তারা পরীক্ষার মাধ্যমে ওই সব পদে পদোন্নতি পাবেন।
সব সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস)’-এ নিয়োগ পেতে পারবেন। এই কর্মকর্তারা সচিবালয়ে দায়িত্ব পালন করবেন, যেখানে বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই সচিবালয় চালাচ্ছেন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বলছে, প্রশাসন সার্ভিসের যেসব কর্মকর্তা এসইএসে যাওয়ার জন্য পরীক্ষা দেবেন না বা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবেন, তারাও নিজ সার্ভিসের পদগুলো, অর্থাৎ অতিরিক্ত জেলা কমিশনার, জেলা কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার ও প্রধান কমিশনার পদে পদোন্নতির সুযোগ পাবেন।
*৪ প্রদেশ, ক্যাপিটাল সিটি সরকার*
ভারতের রাজধানীর দিল্লির মতো বাংলাদেশেও ‘ঢাকা ক্যাপিটাল সিটি সরকার’ গঠনের প্রস্তাব সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করাসহ জেলা প্রশাসকদের পদবি পরিবর্তন করাও প্রস্তাব এসেছে।
কমিশন প্রধান মুয়ীদ চৌধুরীর বলেন, ‘এখন মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও ৬১টি বিভাগ আছে। আমরা মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগের সীমাবদ্ধ করতে বলেছি। পাঁচটি গুচ্ছে মন্ত্রণালয়গুলোকে ভাগ করার জন্য আমরা বলেছি।’
প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়ে কমিশন প্রধান বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করার একটা প্রস্তাব করেছি। আমাদের লোকসংখ্যার কারণে সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন খুব একটা কার্যকর থাকে না।
তিনি বলেন, ‘যদি চারটা প্রদেশ করা যায়, তাহলে একদিকে এই সমস্যাগুলো যেমন দূর হবে, তেমনি রাজনৈতিক দিক থেকেও একটা প্রভাব আসবে। কারণ, একটা কেন্দ্রীয় সরকার একবার বসে গেলে সে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। প্রদেশ হলে আমরা মনে করি সেটা সম্ভব হবে না। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল বিভিন্ন দেশে এই ব্যবস্থা আছে।’
ঢাকার সাভার, গাজীপুরের টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে একটা ক্যাপিটাল সিটি গভর্মেন্ট বা অথরিটি করার সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, ‘জেলা পরিষদ বাতিল করার জন্য বলেছি। বিভিন্ন ক্যাডারকে কোনো জায়গায় একত্রিত বা একীভূত করার সুপারিশ করেছি। সুপিরিয়র্স এক্সিকিউটিভ সার্ভিস গঠন করার সুপারিশ করেছি। যাতে শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ সবার হয়। বাইর থেকেও অর্থাৎ বিদেশে অবস্থান করছেÑ এমন কোনো প্রতিভাবান যেন আসতে পারে।’
*কমিশন সদস্য*
গত বছরের ৩ অক্টোবর আট সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনে সদস্য হিসেবে রয়েছেন সাবেক সচিব মোহাম্মদ তারেক এবং মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান, সাবেক যুগ্ম সচিব রিজওয়ান খায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এ ফিরোজ আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা অধ্যাপক সৈয়দা শাহীনা সোবহান, নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ, শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ আমিনুর রহমান ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহেদী হাসান।
৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করতে বলা হয়। এরপর তিন দফা বাড়িয়ে কমিশনের মেয়াদ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় আগেই প্রতিবেদন জমা দিলো কমিশন।
বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তাতে একগুচ্ছ সুপারিশ রয়েছে। এরমধ্যে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা, ক্যাপিটাল সিটি সরকার, মন্ত্রণালয়ের কলেবর কমিয়ে আনা, সরকারি সেবার প্রাপ্যতা নিয়ে গণশুনানির আয়োজনসহ নানা বিষয় রয়েছে।
বুধবার ৫ফেব্রুয়ারি দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ প্রতিবেদন তুলে দেন কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। পরে সেখানে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন কমিশন প্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমরা স্বল্পমেয়াদি কিছু সুপারিশ করেছি যেগুলো ছয় মাসের মধ্যে করা যাবে, মধ্যমেয়াদি কিছু সুপারিশ করেছি যেগুলো এক থেকে দুই বছরের মধ্যে করা যাবে। দীর্ঘমেয়াদি কিছু সুপারিশ আছে যেগুলো পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে দেখা যেতে পারে।’
একই দিন বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে দেন। পরে যমুনার লনে দুই কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ব্রিফিং করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সেখানে উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদারও উপস্থিত ছিলেন।
বাধ্যতামূলক অবসর বাতিল
কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৫ বছর চাকরি করলেই সব সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে পারবেন, এমন সুবিধা রাখার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। বর্তমানে ২৫ বছর চাকরি করলে পেনশন-সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ পান কর্মকর্তারা। এমনকি সরকার ইচ্ছা করলে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে পারেন। বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিশন।
১৫ বছর চাকরি করার পর সব সুবিধাসহ অবসরের অনুমতি দেয়ার সুপারিশে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বলেছে, এটি কর্মজীবন পরিবর্তনের সুবিধা দেবে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি না করার সুপারিশ করেছে। কমিশন বলছে, কোনো ওএসডি কর্মকর্তাকে কাজ না দিয়ে বেতন-ভাতা দেয়ার পরিবর্তে তাদের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে শিক্ষকতা বা প্রশিক্ষণকেন্দ্রে সাময়িকভাবে পদায়ন করা যেতে পারে।
স্থায়ী বেতন কমিশন
কমিশন বলছে, দেশের মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া ইনডেক্স বিশ্লেষণ করে মূল বেতন প্রতিবছর বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তবে তা ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এ উদ্দেশ্যে একটি স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে উপসচিবদের গাড়ি কেনা ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এ সুযোগ সচিবালয়ের বাইরে অন্যান্য সার্ভিসের কর্মকর্তাদের জন্য নেই। এ ব্যবস্থা বাতিল করার সুপারিশ করা হলো। এতে বৈষম্য দূর হবে এবং সরকারের ব্যয় কমবে।
এ ছাড়া শূন্যপদ ছাড়া পদোন্নতি না দেয়া, প্রশাসনিক ন্যায়পাল নিয়োগ করা, মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা কমানোসহ আরও বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
সচিবালয় চলবে এসইএসে
বিদ্যমান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারকে ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস’ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এই ক্যাডার সার্ভিসের পদগুলো মাঠ প্রশাসনেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর সচিবালয় চলবে সব সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস)’-এর কর্মকর্তাদের দিয়ে। এখানে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদের কর্মকর্তারা থাকবেন। ‘এসইএসে’ উপসচিব পদে প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য সার্ভিসের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখা হবে।
সুপারিশ অনুযায়ী, মাঠপর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের শুরুর পদের নাম এখনকার মতো সহকারী কমিশনার। মাঠপর্যায়ে তাদের শীর্ষ পদ হবে বিভাগীয় কমিশনার; যাদের পদমর্যাদা হবে গ্রেড-১; যা সচিবের সমান। তবে এই সার্ভিসের জন্য একটি শীর্ষ পদ থাকবে, নাম হবে ‘প্রধান কমিশনার’; যিনি বিশেষ গ্রেড পাবেন; যা মুখ্য সচিবের সমান। এর সঙ্গে মিল রেখে অন্যান্য সার্ভিসের জন্যও ভিন্ন নামে পদ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। বিসিএসের আওতায় বিদ্যমান একীভূত ‘ক্যাডার সার্ভিস’ বাতিল করে সার্ভিসের ধরন অনুযায়ী আলাদা নামকরণের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২৬টি ক্যাডারকে কমিয়ে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সার্ভিসগুলোর পদসোপান কেমন হবে, তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসন সার্ভিসের শুরুর পদ হবে সহকারী কমিশনার। তারপর পর্যায়ক্রমে জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার ও উপজেলা কমিশনার (এখনকার ইউএনও), যাদের বেতন গ্রেড হবে ৬; তারপর অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (এখনকার এডিসি), যাদের বেতন গ্রেড-৫; তারপর জেলা কমিশনার (এখনকার ডিসি), যাদের বেতন গ্রেড-৩, অর্থাৎ যুগ্ম সচিবের সমান। বর্তমানে তাদের বেতন গ্রেড-৫। তার ওপরের পদ হবে অতিরিক্তি বিভাগীয় কমিশনার, যাদের বেতন গ্রেড হবে ২। তারপর বিভাগীয় কমিশনার।
অনুরূপভাবে অন্যান্য সার্ভিসের পদগুলো হবে পর্যায়ক্রমে সহকারী পরিচালক, উপজেলা প্রধান, অতিরিক্ত পরিচালক, পরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও মহাপরিচালক। এর বাইরে প্রতিটি সার্ভিসের জন্য একটি শীর্ষ পদ থাকবে। যেমন ‘চিফ অব হেলথ সার্ভিস’। প্রতিটি সার্ভিসের কর্মকর্তারা পরীক্ষার মাধ্যমে ওই সব পদে পদোন্নতি পাবেন।
সব সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস)’-এ নিয়োগ পেতে পারবেন। এই কর্মকর্তারা সচিবালয়ে দায়িত্ব পালন করবেন, যেখানে বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই সচিবালয় চালাচ্ছেন।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বলছে, প্রশাসন সার্ভিসের যেসব কর্মকর্তা এসইএসে যাওয়ার জন্য পরীক্ষা দেবেন না বা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবেন, তারাও নিজ সার্ভিসের পদগুলো, অর্থাৎ অতিরিক্ত জেলা কমিশনার, জেলা কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার ও প্রধান কমিশনার পদে পদোন্নতির সুযোগ পাবেন।
*৪ প্রদেশ, ক্যাপিটাল সিটি সরকার*
ভারতের রাজধানীর দিল্লির মতো বাংলাদেশেও ‘ঢাকা ক্যাপিটাল সিটি সরকার’ গঠনের প্রস্তাব সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করাসহ জেলা প্রশাসকদের পদবি পরিবর্তন করাও প্রস্তাব এসেছে।
কমিশন প্রধান মুয়ীদ চৌধুরীর বলেন, ‘এখন মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও ৬১টি বিভাগ আছে। আমরা মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা হ্রাস করে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগের সীমাবদ্ধ করতে বলেছি। পাঁচটি গুচ্ছে মন্ত্রণালয়গুলোকে ভাগ করার জন্য আমরা বলেছি।’
প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়ে কমিশন প্রধান বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করার একটা প্রস্তাব করেছি। আমাদের লোকসংখ্যার কারণে সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন খুব একটা কার্যকর থাকে না।
তিনি বলেন, ‘যদি চারটা প্রদেশ করা যায়, তাহলে একদিকে এই সমস্যাগুলো যেমন দূর হবে, তেমনি রাজনৈতিক দিক থেকেও একটা প্রভাব আসবে। কারণ, একটা কেন্দ্রীয় সরকার একবার বসে গেলে সে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। প্রদেশ হলে আমরা মনে করি সেটা সম্ভব হবে না। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল বিভিন্ন দেশে এই ব্যবস্থা আছে।’
ঢাকার সাভার, গাজীপুরের টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে একটা ক্যাপিটাল সিটি গভর্মেন্ট বা অথরিটি করার সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, ‘জেলা পরিষদ বাতিল করার জন্য বলেছি। বিভিন্ন ক্যাডারকে কোনো জায়গায় একত্রিত বা একীভূত করার সুপারিশ করেছি। সুপিরিয়র্স এক্সিকিউটিভ সার্ভিস গঠন করার সুপারিশ করেছি। যাতে শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়ার সুযোগ সবার হয়। বাইর থেকেও অর্থাৎ বিদেশে অবস্থান করছেÑ এমন কোনো প্রতিভাবান যেন আসতে পারে।’
*কমিশন সদস্য*
গত বছরের ৩ অক্টোবর আট সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনে সদস্য হিসেবে রয়েছেন সাবেক সচিব মোহাম্মদ তারেক এবং মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান, সাবেক যুগ্ম সচিব রিজওয়ান খায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এ ফিরোজ আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা অধ্যাপক সৈয়দা শাহীনা সোবহান, নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ, শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খোন্দকার মোহাম্মদ আমিনুর রহমান ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহেদী হাসান।
৯০ দিনের (৩ মাস) মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করতে বলা হয়। এরপর তিন দফা বাড়িয়ে কমিশনের মেয়াদ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় আগেই প্রতিবেদন জমা দিলো কমিশন।