নানা কারণেই এ বছর বর্ষবরণ নিয়ে চলছে আলোচনা। এর মধ্যে একভাবে নেয়া হচ্ছে প্রস্তুতি। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে তোলা ছবি -সোহরাব আলম
বাংলা বর্ষবরণ আয়োজনে বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম বড় আকর্ষণ ছিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। তবে এবার সেই নাম থাকছে না। পরিবর্তে নতুন নাম দেয়া হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
শুক্রবার বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে চারুকলা অনুষদের ডিন আজহারুল ইসলাম মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। তিনি ঘোষণা করেন ‘শোভাযাত্রার নতুন নাম হলো ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। তিনি বলেন, ‘সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এবারের শোভাযাত্রা আনন্দময় হবে। এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’।’
পহেলা বৈশাখের ঠিক তিন দিন আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে এই শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। এই নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত অবশ্য আগেই পাওয়া গিয়েছিল। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে নাম পরিবর্তন নিয়ে মন্তব্য করলেও বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছিল। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অতীত ঐতিহ্য অনুযায়ী, ১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে যে শোভাযাত্রার সূচনা হয়, সেটিই পরবর্তীতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিতি পায়। ২০১৬ সালে এই আয়োজনটি ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করে।
চারুকলা অনুষদ থেকেও প্রস্তুতির খবর জানাতে সাংবাদিকদের যে আমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়েছে, সেখানেও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ না লিখে, কেবল ‘শোভাযাত্রার’ কথা লেখা হয়েছিল।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আজহারুল বলেন, “আগেও পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রাটি হতো, তার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। সেটি পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল। আমরা আবার ‘আনন্দ শোভাযাত্রায়’ ফিরে গেলাম। এটাকে পুনরুদ্ধার বলা যেতে পারে।”
চারুকলার ডিন বলেন, “অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাপক এই আয়োজনের লক্ষ্যে শোভাযাত্রার নামকরণ করা হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’, যার ছায়াতলে দেশের সব বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটবে। প্রতিফলিত হবে বর্তমানের সব শ্রেণীর মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা এবং ফুটে উঠবে শোভাযাত্রার প্রকৃত আনন্দ।”
পয়লা বৈশাখে ফি বছর চারুকলা অনুষদ আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেছেন, ‘আমরা নাম পরিবর্তন করছি না। আমরা পুরনো নাম এবং ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি, যেটা দিয়ে চারুকলার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।’ সংবাদ
সম্মেলনে উপাচার্য বলেন, ‘এই শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্যে দুটো মেসেজ (বার্তা) আছে। একটি হচ্ছে, একটি নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান। রাজনৈতিক ও সামাজিক নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, সেই বিষয়টি তুলে ধরা। কিছু মোটিফ সেই কাজটি করছে। আর দ্বিতীয় যে অংশটি আছে, সেটি হচ্ছে মূলত ঐক্যের ডাক, সম্প্রীতির ডাক। এই শোভাযাত্রায় এই দুটো বার্তাকে তারা একসঙ্গে দিতে যাচ্ছেন।’
চারুকলা ১৯৮৯ সাল থেকে পয়লা বৈশাখে শোভাযাত্রা করে আসছে। শুরুতে নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে।
এর মধ্যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে ও ধারণায়’ কিছু করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। তিনি বলেছেন, “নববর্ষের দিন মানুষ শালীনতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সমর্থিত পন্থায় নানা আয়োজন করতেই পারে। কিন্তু সেই দিন কোনো যাত্রা করলে তাতে মঙ্গল হবেÑ এমন বিশ্বাস করলে বা ধারণা করলে পরিষ্কারভাবে তা গুনাহের দিকে নিয়ে যাবে। তাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে কোনো কিছু অবশ্যই করা যাবে না। ‘মঙ্গল শব্দ ও ধারণা’ অবশ্যই বাদ দিতে হবে।”
আয়োজনে যা যা
এবার আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজনে থাকবে বড়, মাঝারি ও ছোট মোটিফ। এর মধ্যে বড় মোটিফ থাকবে ৬টি। সবার সামনে থাকবে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। নারীর দাঁতাল মুখাবয়বে মাথায় রয়েছে খাড়া দুটো শিং।
এই মোটিফটির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি দেখে কেউ যদি কারও সঙ্গে মিল খুঁজে পান, তা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা সামগ্রিকভাবে ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান তুলে ধরছি।’
শোভাযাত্রায় বড় মোটিফের মধ্যে থাকবে কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, ৩৬ জুলাই (টাইপোগ্রাফি), শান্তির পায়রা, পালকি, জুলাই আন্দোলনে নিহত মুগ্ধের পানির বোতল।
এছাড়া অন্যান্য মোটিফের মধ্যে থাকবে ১০টি সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, ৮০টি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, ২০টি রঙিন চরকি, ২০০টি বাঘের মাথা, ৮টি তালপাতার সেপাই, পলো ১০টি, ৫টি তুহিন পাখি, ৬টি মাছের চাঁই, ৪টি পাখা, ২০টি মাথাল, ২০টি ঘোড়া, ৫টি লাঙল, ৫টি মাছের ডোলা এবং ১০০ ফুট লোকজ চিত্রাবলির ক্যানভাস ১০০ ফুট থাকবে। চারুকলার সম্মুখভাগের দেয়ালে আঁকা হচ্ছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির মোটিফ। জয়নুল শিশু নিকেতন দেয়ালে আঁকা হচ্ছে সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়াল অমনরীতি অবলম্বনে চিত্র।
শোভাযাত্রায় প্যালেস্টাইনে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হবে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘তরমুজ প্যালেস্টাইনিদের কাছে প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের প্রতীক’। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে প্যালেস্টাইনিদের জন্য একটি প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও মূলত এটি তাদের পতাকা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, ফলটির বাইরের অংশের রং সবুজ। আর ভেতরের অংশগুলোর রং লাল, সাদা ও কালো। এ রংগুলো প্যালেস্টাইনের পতাকার রঙের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এবারের শোভাযাত্রায় অন্যান্য মোটিফের পাশাপাশি প্যালেস্টাইনের নিপীড়িত মুসলমানদের লড়াই ও সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তাদের প্রতীক হিসেবে তরমুজের মোটিফ থাকবে।
চৈত্রসংক্রান্তিতে চারুকলায় আয়োজিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ আয়োজন চলবে।
শোভাযাত্রার মোটিফের মধ্যে স্বৈরাচারের প্রতিকৃতি, বড় আকৃতির একটি ইলিশ মাছ, সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পীদের কাঠের বাঘ আর শান্তির পায়রার নির্মাণকাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন শিল্পীরা। বাঁশ-কাঠের কাজ প্রায় শেষ।
ফ্যাসিস্টের দৈত্যাকৃতির প্রতিকৃতির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। ইলিশ মাছ, বাংলার বাঘ ও পায়রার উচ্চতা হবে ১৬ ফুট। চারটি মোটিফের পাশাপাশি মীর মুগ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে একটি পানির বোতলও তৈরি করা হতে পারে।
তবে কোন মোটিফ শেষ পর্যন্ত থাকবে কিংবা কোন মোটিফ কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, তা নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছিলেন চারুকলার ডিন।
চারুকলা অনুষদ থেকে সকাল ৯টায় বের হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এ সময় শাহবাগ এবং টিএসসির মেট্রোরেল স্টেশনে ট্রেন থামবে না, তবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিকেল ৫টার পর প্রবেশ করা যাবে না। নগরীর অন্যান্য স্থানে সন্ধ্যার পরও বর্ষবরণের আয়োজন সন্ধ্যার পরও থাকবে, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকেল ৫টার মধ্যেই আয়োজন শেষ করা হবে।
এই আয়োজনকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে বর্ণনা করে চারুকলার ডিন আজহারুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা এবং মননের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে অন্ধকার কাল থেকে, উত্তীর্ণ হবার বার্তা দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এবারের নববর্ষের আয়োজন সব অন্যায্যতাকে বিনাশ করে ন্যায্য ও সত্যকে নব আলোর গতিধারায় একত্রবদ্ধ করবে গোটা সমাজকে। বৈশাখে ধ্বংস এবং সৃষ্টির সুর দুইই গতিপ্রাপ্ত হয়। নববর্ষ পালন জীর্ণ জীবনকে সৃষ্টি দ্বারা বিদীর্ণ করে বেঁচে থাকবার প্রেরণা তৈরি করে দেয়। আর সেজন্যই ফ্যাসিবাদের বিনাশ নতুন আলোর পথটাকে উন্মুক্ত করে দেবে, অন্ধকার ছায়াকে বিদায় জানাবে।’
এবারের বৈশাখ ‘সবার হবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূ-খ-ে বসবাসরত সব জাতিগোষ্ঠী এবারের বৈশাখ বরণের অংশীদারিত্ব অর্জন করেছে। পাহাড় থেকে সমতল সবাই একসঙ্গে বর্ষবরণ উদ্যাপন করব। এবারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে একপেশে সংস্কৃতি চর্চার সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে আমরা বাংলাদেশের সংস্কৃতির উদার ও শুদ্ধ চর্চার দিকে অগ্রসর হতে পারব বলে আশা করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমদ খান, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ এম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদ্যাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য-সচিব ও চারুকলা অনুষদের ডিন মো. আজহারুল ইসলাম শেখ, শোভাযাত্রার উপ-কমিটির সদস্য-সচিব এ এ এম কাওসার হাসান, প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ এবং কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি ও বিভিন্ন উপ-কমিটি সদস্যরা।
নানা কারণেই এ বছর বর্ষবরণ নিয়ে চলছে আলোচনা। এর মধ্যে একভাবে নেয়া হচ্ছে প্রস্তুতি। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে তোলা ছবি -সোহরাব আলম
শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫
বাংলা বর্ষবরণ আয়োজনে বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম বড় আকর্ষণ ছিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। তবে এবার সেই নাম থাকছে না। পরিবর্তে নতুন নাম দেয়া হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
শুক্রবার বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে চারুকলা অনুষদের ডিন আজহারুল ইসলাম মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। তিনি ঘোষণা করেন ‘শোভাযাত্রার নতুন নাম হলো ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। তিনি বলেন, ‘সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এবারের শোভাযাত্রা আনন্দময় হবে। এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’।’
পহেলা বৈশাখের ঠিক তিন দিন আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে এই শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। এই নাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত অবশ্য আগেই পাওয়া গিয়েছিল। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে নাম পরিবর্তন নিয়ে মন্তব্য করলেও বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছিল। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, নাম রাখার সিদ্ধান্ত নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অতীত ঐতিহ্য অনুযায়ী, ১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে যে শোভাযাত্রার সূচনা হয়, সেটিই পরবর্তীতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিতি পায়। ২০১৬ সালে এই আয়োজনটি ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করে।
চারুকলা অনুষদ থেকেও প্রস্তুতির খবর জানাতে সাংবাদিকদের যে আমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়েছে, সেখানেও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ না লিখে, কেবল ‘শোভাযাত্রার’ কথা লেখা হয়েছিল।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আজহারুল বলেন, “আগেও পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রাটি হতো, তার নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। সেটি পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়েছিল। আমরা আবার ‘আনন্দ শোভাযাত্রায়’ ফিরে গেলাম। এটাকে পুনরুদ্ধার বলা যেতে পারে।”
চারুকলার ডিন বলেন, “অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাপক এই আয়োজনের লক্ষ্যে শোভাযাত্রার নামকরণ করা হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’, যার ছায়াতলে দেশের সব বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটবে। প্রতিফলিত হবে বর্তমানের সব শ্রেণীর মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা এবং ফুটে উঠবে শোভাযাত্রার প্রকৃত আনন্দ।”
পয়লা বৈশাখে ফি বছর চারুকলা অনুষদ আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেছেন, ‘আমরা নাম পরিবর্তন করছি না। আমরা পুরনো নাম এবং ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি, যেটা দিয়ে চারুকলার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।’ সংবাদ
সম্মেলনে উপাচার্য বলেন, ‘এই শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্যে দুটো মেসেজ (বার্তা) আছে। একটি হচ্ছে, একটি নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান। রাজনৈতিক ও সামাজিক নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, সেই বিষয়টি তুলে ধরা। কিছু মোটিফ সেই কাজটি করছে। আর দ্বিতীয় যে অংশটি আছে, সেটি হচ্ছে মূলত ঐক্যের ডাক, সম্প্রীতির ডাক। এই শোভাযাত্রায় এই দুটো বার্তাকে তারা একসঙ্গে দিতে যাচ্ছেন।’
চারুকলা ১৯৮৯ সাল থেকে পয়লা বৈশাখে শোভাযাত্রা করে আসছে। শুরুতে নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে।
এর মধ্যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে ও ধারণায়’ কিছু করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। তিনি বলেছেন, “নববর্ষের দিন মানুষ শালীনতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সমর্থিত পন্থায় নানা আয়োজন করতেই পারে। কিন্তু সেই দিন কোনো যাত্রা করলে তাতে মঙ্গল হবেÑ এমন বিশ্বাস করলে বা ধারণা করলে পরিষ্কারভাবে তা গুনাহের দিকে নিয়ে যাবে। তাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে কোনো কিছু অবশ্যই করা যাবে না। ‘মঙ্গল শব্দ ও ধারণা’ অবশ্যই বাদ দিতে হবে।”
আয়োজনে যা যা
এবার আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজনে থাকবে বড়, মাঝারি ও ছোট মোটিফ। এর মধ্যে বড় মোটিফ থাকবে ৬টি। সবার সামনে থাকবে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। নারীর দাঁতাল মুখাবয়বে মাথায় রয়েছে খাড়া দুটো শিং।
এই মোটিফটির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি দেখে কেউ যদি কারও সঙ্গে মিল খুঁজে পান, তা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা সামগ্রিকভাবে ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান তুলে ধরছি।’
শোভাযাত্রায় বড় মোটিফের মধ্যে থাকবে কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, ৩৬ জুলাই (টাইপোগ্রাফি), শান্তির পায়রা, পালকি, জুলাই আন্দোলনে নিহত মুগ্ধের পানির বোতল।
এছাড়া অন্যান্য মোটিফের মধ্যে থাকবে ১০টি সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, ৮০টি ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, ২০টি রঙিন চরকি, ২০০টি বাঘের মাথা, ৮টি তালপাতার সেপাই, পলো ১০টি, ৫টি তুহিন পাখি, ৬টি মাছের চাঁই, ৪টি পাখা, ২০টি মাথাল, ২০টি ঘোড়া, ৫টি লাঙল, ৫টি মাছের ডোলা এবং ১০০ ফুট লোকজ চিত্রাবলির ক্যানভাস ১০০ ফুট থাকবে। চারুকলার সম্মুখভাগের দেয়ালে আঁকা হচ্ছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ির মোটিফ। জয়নুল শিশু নিকেতন দেয়ালে আঁকা হচ্ছে সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়াল অমনরীতি অবলম্বনে চিত্র।
শোভাযাত্রায় প্যালেস্টাইনে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হবে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘তরমুজ প্যালেস্টাইনিদের কাছে প্রতিরোধ ও অধ্যবসায়ের প্রতীক’। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে প্যালেস্টাইনিদের জন্য একটি প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও মূলত এটি তাদের পতাকা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর কারণ হলো, ফলটির বাইরের অংশের রং সবুজ। আর ভেতরের অংশগুলোর রং লাল, সাদা ও কালো। এ রংগুলো প্যালেস্টাইনের পতাকার রঙের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
এবারের শোভাযাত্রায় অন্যান্য মোটিফের পাশাপাশি প্যালেস্টাইনের নিপীড়িত মুসলমানদের লড়াই ও সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তাদের প্রতীক হিসেবে তরমুজের মোটিফ থাকবে।
চৈত্রসংক্রান্তিতে চারুকলায় আয়োজিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এ আয়োজন চলবে।
শোভাযাত্রার মোটিফের মধ্যে স্বৈরাচারের প্রতিকৃতি, বড় আকৃতির একটি ইলিশ মাছ, সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পীদের কাঠের বাঘ আর শান্তির পায়রার নির্মাণকাজ অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন শিল্পীরা। বাঁশ-কাঠের কাজ প্রায় শেষ।
ফ্যাসিস্টের দৈত্যাকৃতির প্রতিকৃতির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। ইলিশ মাছ, বাংলার বাঘ ও পায়রার উচ্চতা হবে ১৬ ফুট। চারটি মোটিফের পাশাপাশি মীর মুগ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে একটি পানির বোতলও তৈরি করা হতে পারে।
তবে কোন মোটিফ শেষ পর্যন্ত থাকবে কিংবা কোন মোটিফ কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, তা নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছিলেন চারুকলার ডিন।
চারুকলা অনুষদ থেকে সকাল ৯টায় বের হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এ সময় শাহবাগ এবং টিএসসির মেট্রোরেল স্টেশনে ট্রেন থামবে না, তবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিকেল ৫টার পর প্রবেশ করা যাবে না। নগরীর অন্যান্য স্থানে সন্ধ্যার পরও বর্ষবরণের আয়োজন সন্ধ্যার পরও থাকবে, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকেল ৫টার মধ্যেই আয়োজন শেষ করা হবে।
এই আয়োজনকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে বর্ণনা করে চারুকলার ডিন আজহারুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা এবং মননের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে অন্ধকার কাল থেকে, উত্তীর্ণ হবার বার্তা দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এবারের নববর্ষের আয়োজন সব অন্যায্যতাকে বিনাশ করে ন্যায্য ও সত্যকে নব আলোর গতিধারায় একত্রবদ্ধ করবে গোটা সমাজকে। বৈশাখে ধ্বংস এবং সৃষ্টির সুর দুইই গতিপ্রাপ্ত হয়। নববর্ষ পালন জীর্ণ জীবনকে সৃষ্টি দ্বারা বিদীর্ণ করে বেঁচে থাকবার প্রেরণা তৈরি করে দেয়। আর সেজন্যই ফ্যাসিবাদের বিনাশ নতুন আলোর পথটাকে উন্মুক্ত করে দেবে, অন্ধকার ছায়াকে বিদায় জানাবে।’
এবারের বৈশাখ ‘সবার হবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূ-খ-ে বসবাসরত সব জাতিগোষ্ঠী এবারের বৈশাখ বরণের অংশীদারিত্ব অর্জন করেছে। পাহাড় থেকে সমতল সবাই একসঙ্গে বর্ষবরণ উদ্যাপন করব। এবারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে একপেশে সংস্কৃতি চর্চার সংকীর্ণতা থেকে বের হয়ে আমরা বাংলাদেশের সংস্কৃতির উদার ও শুদ্ধ চর্চার দিকে অগ্রসর হতে পারব বলে আশা করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমদ খান, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ এম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদ্যাপনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য-সচিব ও চারুকলা অনুষদের ডিন মো. আজহারুল ইসলাম শেখ, শোভাযাত্রার উপ-কমিটির সদস্য-সচিব এ এ এম কাওসার হাসান, প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ এবং কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি ও বিভিন্ন উপ-কমিটি সদস্যরা।