মামলার রায় উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্টে কড়া নিরাপত্তা
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে সোমবার। এ মামলার অন্য দুই আসামি হলো- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এরমধ্যে সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
অভিযুক্ত ৩ অভিযোগ ৫
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য
হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা
চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা
আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে প্রথম বিচার শেষ হয়েছে এ মামলার এবং প্রথম মামলার রায় সোমবার ঘোষণা করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায়ের এই দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
প্রথম দিকে এ মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে এ তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগগুলো হলো- গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ।
এই পাঁচ অভিযোগে তিন আসামির মধ্যে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে আত্মসমর্পণ করতে গত ১৬ জুন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়। পরদিন সেই বিজ্ঞপ্তি দুটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়।
গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের দিন সাবেক আইজিপি মামুন গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। গত ১২ অক্টোবর এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২৩ অক্টোবর।
মামলার শুনানির সময় চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জুলাই আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদ- চান। দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন যুক্তিতর্কে এ মামলা থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের খালাস আবেদন করেন। রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুনেরও খালাস আবেদন করেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
গত বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ ঘোষণার পরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘আশা করছি, ১৭ নভেম্বর (সোমবার) আদালত তার সুবিবেচনা, তার প্রজ্ঞা প্রয়োগ করবেন। একটি সঠিক রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটা ইতি ঘটাবেন।
আইনানুযায়ী যা প্রাপ্য সেটা তাদের বুঝিয়ে দেয়া হবে মন্তব্য করে তাজুল বলেন, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, যারাই বাংলাদেশে যত শক্তিশালী হোক না কেন, যদি কেউ অপরাধ করে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, তাদের সঠিক পন্থায় বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সেই প্রক্রিয়ায় আমরা একটা দীর্ঘ যাত্রা শেষ করেছি।’
অন্যদিকে এ মামলায় ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন শুনানি শেষে সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা দেখেননি তিনি। তিনি বলেন, তাকে কেউ কোনো রকমের ইন্টারাপ্ট করেনি (বাধা দেয়নি)।
সাক্ষ্য গ্রহণসহ সবকিছু সমাপ্ত করে রায়ের দিন ধার্য করায় ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ও বিচারকদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা সাক্ষীদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আনতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা দালিলিক সাক্ষ্যে বিতর্ক (কন্ট্রোভার্সি) তৈরি করার চেষ্টা করেছেন এবং বিভিন্ন সময় দালিলিক সাক্ষীর ওপর বিতর্ক তৈরি হয়েছে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন।’ তিনি বিশ্বাস করেন, তার মক্কেলদ্বয় (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) খালাস পাবেন।
শুধু রাষ্ট্রপক্ষের নথিপত্র দিয়ে মামলা যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পেরেছেন কিনা এমন প্রশ্নে এই রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী তার সীমাবদ্ধতা থেকে তিনি চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেছেন। তার তরফ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না এবং তার চেষ্টায় কেউ কোনো বাধাও দেয়নি বলেও দাবি করেন আমির হোসেন। ‘আসামিরা উপস্থিত থাকলে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, যেসব ডকুমেন্টারি এভিডেন্স (প্রামাণ্য নথিপত্র) হয়তো তাকে তারা (আসামিরা) দিতে পারতেন, সেসব নিয়ে তিনি লড়াই করতে পারতেন। সেসব তিনি পাচ্ছেন না’ জানিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ এক জায়গায় কোনো একটা ঘটনার যেভাবে বর্ণনা দিয়েছে, সেই বর্ণনার বাইরেও হয়তো কোনো বর্ণনা থাকতে পারে। সেসব তিনি পাননি। এই জায়গায় তার কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল।’ সেই সীমাবদ্ধতা তার মক্কেলরা অনুপস্থিত থাকার কারণে বলেও দাবি তার।
এ মামলার আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন নিজে বাঁচার জন্য অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন আমির হোসেন। তিনি বলেন, ‘তার মক্কেলদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) ওপর ভর করে সাবেক আইজিপি এটি করেছেন।’
রায় সরাসরি সম্প্রচার হবে
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলার রায় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম রোববার,(১৬ নভেম্বর ২০২৫) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘রায়ের যে অংশটুকু ট্রাইব্যুনাল পড়ে শোনাবেন, সে অংশটুকু ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং তাদের মাধ্যমে দেশের অন্য সব গণমাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।’
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা উপলক্ষে সোমবার ঢাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ঢাকা লকডাউন’ ঘোষণা করেছিল। সেদিন বিভিন্ন স্থানে ককটেল নিক্ষেপ ও যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। সোমবার রায় ঘোষণার দিনও বিভিন্ন মাধ্যমে ‘ঢাকা লকডাউন’ ঘোষণা করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘিরে বিশৃঙ্খলার কোনো শঙ্কা দেখছেন না। তবে দেশজুড়ে অতিরিক্ত সতর্কতা বজায় থাকবে।
রায় ঘোষণার দিন ককটেল হামলা ও আগুনসন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধে সারাদেশে পুলিশ সুপারদের (এসপি) বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে চোখে পড়ছে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সতর্ক অবস্থান। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আশপাশের এলাকায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। গত শুক্রবার রাজধানীসহ আশপাশের জেলায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১২ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ১৭ নভেম্বর (সোমবার) সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। নাশকতা ঠেকাতে পুলিশের চেকপোস্ট জোরদার করা হবে। ফুট প্যাট্রলিং ও মোবাইল প্যাট্রলিং বাড়ানো হয়েছে। সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে সম্ভাব্য সব জায়গায়। রাজধানীর হোটেল-মোটেল, মেস ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বাসাবাড়িতেও রেড দেয়া হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগুনসন্ত্রাসসহ রায় ঘিরে যে কোনো নাশকতা ঠেকাতে প্রতিদিনই জেলা এসপিদের কড়া নির্দেশনা অব্যাহত রাখা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা শহর থেকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঢাকামুখী যাত্রা ঠেকাতে আগে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, সেটি বহাল রাখা হয়েছে।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মামলার রায় উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্টে কড়া নিরাপত্তা
রোববার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে সোমবার। এ মামলার অন্য দুই আসামি হলো- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এরমধ্যে সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
অভিযুক্ত ৩ অভিযোগ ৫
শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য
হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা
চানখাঁরপুলে ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা
আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে প্রথম বিচার শেষ হয়েছে এ মামলার এবং প্রথম মামলার রায় সোমবার ঘোষণা করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায়ের এই দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
প্রথম দিকে এ মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। একাধিকবার সময় বাড়ানোর পর চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে এ তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগগুলো হলো- গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান; হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ।
এই পাঁচ অভিযোগে তিন আসামির মধ্যে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে আত্মসমর্পণ করতে গত ১৬ জুন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়। পরদিন সেই বিজ্ঞপ্তি দুটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়।
গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের দিন সাবেক আইজিপি মামুন গণঅভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। গত ১২ অক্টোবর এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২৩ অক্টোবর।
মামলার শুনানির সময় চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জুলাই আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদ- চান। দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন যুক্তিতর্কে এ মামলা থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের খালাস আবেদন করেন। রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুনেরও খালাস আবেদন করেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
গত বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ ঘোষণার পরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘আশা করছি, ১৭ নভেম্বর (সোমবার) আদালত তার সুবিবেচনা, তার প্রজ্ঞা প্রয়োগ করবেন। একটি সঠিক রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটা ইতি ঘটাবেন।
আইনানুযায়ী যা প্রাপ্য সেটা তাদের বুঝিয়ে দেয়া হবে মন্তব্য করে তাজুল বলেন, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, যারাই বাংলাদেশে যত শক্তিশালী হোক না কেন, যদি কেউ অপরাধ করে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, তাদের সঠিক পন্থায় বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সেই প্রক্রিয়ায় আমরা একটা দীর্ঘ যাত্রা শেষ করেছি।’
অন্যদিকে এ মামলায় ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন শুনানি শেষে সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা দেখেননি তিনি। তিনি বলেন, তাকে কেউ কোনো রকমের ইন্টারাপ্ট করেনি (বাধা দেয়নি)।
সাক্ষ্য গ্রহণসহ সবকিছু সমাপ্ত করে রায়ের দিন ধার্য করায় ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি ও বিচারকদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা সাক্ষীদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আনতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপন করা দালিলিক সাক্ষ্যে বিতর্ক (কন্ট্রোভার্সি) তৈরি করার চেষ্টা করেছেন এবং বিভিন্ন সময় দালিলিক সাক্ষীর ওপর বিতর্ক তৈরি হয়েছে বলেও তিনি বিশ্বাস করেন।’ তিনি বিশ্বাস করেন, তার মক্কেলদ্বয় (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) খালাস পাবেন।
শুধু রাষ্ট্রপক্ষের নথিপত্র দিয়ে মামলা যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পেরেছেন কিনা এমন প্রশ্নে এই রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী তার সীমাবদ্ধতা থেকে তিনি চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করেছেন। তার তরফ থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না এবং তার চেষ্টায় কেউ কোনো বাধাও দেয়নি বলেও দাবি করেন আমির হোসেন। ‘আসামিরা উপস্থিত থাকলে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, যেসব ডকুমেন্টারি এভিডেন্স (প্রামাণ্য নথিপত্র) হয়তো তাকে তারা (আসামিরা) দিতে পারতেন, সেসব নিয়ে তিনি লড়াই করতে পারতেন। সেসব তিনি পাচ্ছেন না’ জানিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ এক জায়গায় কোনো একটা ঘটনার যেভাবে বর্ণনা দিয়েছে, সেই বর্ণনার বাইরেও হয়তো কোনো বর্ণনা থাকতে পারে। সেসব তিনি পাননি। এই জায়গায় তার কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল।’ সেই সীমাবদ্ধতা তার মক্কেলরা অনুপস্থিত থাকার কারণে বলেও দাবি তার।
এ মামলার আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন নিজে বাঁচার জন্য অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন আমির হোসেন। তিনি বলেন, ‘তার মক্কেলদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) ওপর ভর করে সাবেক আইজিপি এটি করেছেন।’
রায় সরাসরি সম্প্রচার হবে
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলার রায় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম রোববার,(১৬ নভেম্বর ২০২৫) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘রায়ের যে অংশটুকু ট্রাইব্যুনাল পড়ে শোনাবেন, সে অংশটুকু ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং তাদের মাধ্যমে দেশের অন্য সব গণমাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।’
কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা উপলক্ষে সোমবার ঢাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ ঘোষণার দিন কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ঢাকা লকডাউন’ ঘোষণা করেছিল। সেদিন বিভিন্ন স্থানে ককটেল নিক্ষেপ ও যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। সোমবার রায় ঘোষণার দিনও বিভিন্ন মাধ্যমে ‘ঢাকা লকডাউন’ ঘোষণা করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘিরে বিশৃঙ্খলার কোনো শঙ্কা দেখছেন না। তবে দেশজুড়ে অতিরিক্ত সতর্কতা বজায় থাকবে।
রায় ঘোষণার দিন ককটেল হামলা ও আগুনসন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধে সারাদেশে পুলিশ সুপারদের (এসপি) বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে চোখে পড়ছে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সতর্ক অবস্থান। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আশপাশের এলাকায় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। গত শুক্রবার রাজধানীসহ আশপাশের জেলায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১২ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ১৭ নভেম্বর (সোমবার) সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। নাশকতা ঠেকাতে পুলিশের চেকপোস্ট জোরদার করা হবে। ফুট প্যাট্রলিং ও মোবাইল প্যাট্রলিং বাড়ানো হয়েছে। সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে সম্ভাব্য সব জায়গায়। রাজধানীর হোটেল-মোটেল, মেস ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বাসাবাড়িতেও রেড দেয়া হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগুনসন্ত্রাসসহ রায় ঘিরে যে কোনো নাশকতা ঠেকাতে প্রতিদিনই জেলা এসপিদের কড়া নির্দেশনা অব্যাহত রাখা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা শহর থেকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঢাকামুখী যাত্রা ঠেকাতে আগে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, সেটি বহাল রাখা হয়েছে।