বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন তারেক রহমান
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নির্বাসনে। আছেন যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর এই প্রথম কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন তারেক রহমান। এক সময় ছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। এখন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিবিসি বাংলাকে।
দেশে ফেরা নিয়ে বললেন, ‘বিভিন্ন রকম শঙ্কার কথা আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তো শুনেছি। সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও তো অনেক সময় অনেক শঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীত্ব: ‘এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের’
শারীরিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে খালেদা জিয়া নির্বাচন করবেন কিনা
রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না, সমর্থনের ভিত্তিতে হয়
‘দল বা ব্যক্তি নন, জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের জনগণ
’
প্রায় ৪৫ মিনিটের এ সাক্ষাৎকারে এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কেন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেননি, কবে ফিরছেন দেশে, নির্বাচন, পারিবারিক নেতৃত্ব- এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান।
গণমাধ্যমের সঙ্গে এই দীর্ঘ সময় কেন কথা বলেননি- এ প্রশ্নে তারেক বলেন, ‘ব্যাপারটা বোধ হয় এ রকম নয়, ব্যাপারটা বোধ হয় একটু ভিন্ন। আসলে আমি কথা ঠিকই বলেছি। আমি দীর্ঘ ১৭ বছর এখানে আছি, এই দেশে, প্রবাস জীবনে, তবে আমার ওপরে যখন দলের দায়িত্ব এসে পড়েছে, তারপর থেকে আমি গ্রামে-গঞ্জে আমার নেতাকর্মীসহ তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষ যখন যেভাবে অংশগ্রহণ করেছে, আমি সবার সঙ্গে কথা বলেছি।’
‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় আদালত থেকে রীতিমতো একটা আদেশ দিয়ে আমার কথা বলার অধিকারকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমি যদি গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাইতাম, হয়তো গণমাধ্যমের ইচ্ছা ছিল ছাপানোর, গণমাধ্যম সেটি ছাপাতে পারতো না।’
একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তারেক বলেন, তিনি একবার প্রেসক্লাবে কথা বলেছিলেন। পরের দিন প্রেসক্লাবের ‘তখনকার কমিটি’ একটি বৈঠক ডেকে একটি সিদ্ধান্ত নেয়। তারা তখন তাকে আইনের দৃষ্টিতে ‘ফেরারি’ উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, ‘এ রকম কোনো ব্যক্তিকে তারা প্রেসক্লাবে কথা বলতে দেবে না।’ এভাবে তার কথা ‘বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করা’ হয়েছিল।
তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি কথা বলেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন পন্থায় আমি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, আমি ইনশাআল্লাহ পৌঁছেছি মানুষের কাছে। কাজেই গণমাধ্যমে যে কথা বলিনি, তা নয়। আমি কথা বলেছি। হয়তো আপনারা তখন কথা নিতে পারেননি অথবা শুনতে পারেননি। ইচ্ছা থাকলেও ছাপাতে পারেননি, হয়তো প্রচার করতে পারেননি। কিন্তু আমি বলেছি, আমি থেমে থাকিনি।’
কবে ফিরছেন?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। যারা হাসিনা সরকারের সময় দেশ ছেড়েছিলেন, অনেকেই ফিরে এসেছেন। এ সময়কালে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও ।নেক আলোচনা হয়েছে। তো এখনও দেশে ফেরেননি কেন?
তারেক রহমানের জবাব, ‘কিছু সংগত কারণে হয়তো ফেরাটা হয়ে ওঠেনি এখনও। তবে সময় তো চলে এসেছে মনে হয়। ইনশাআল্লাহ, দ্রুতই ফিরে আসবো।’
কবে ফিরতে পারেন? তারেক বললেন, ‘দ্রুতই মনে হয়। দ্রুতই, ইনশাআল্লাহ।’
আগামী নির্বাচনের আগে দেশে ফিরবেন কিনা- এ প্রশ্নে তারেক, ‘রাজনীতি যখন করি, যেখানে জনগণের প্রত্যাশিত একটি নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকব? আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ইচ্ছা থাকবে, আগ্রহ থাকবে সেই প্রত্যাশিত নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে, জনগণের সঙ্গে জনগণের মধ্যেই থাকব, ইনশাআল্লাহ।’
বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে তারেকের দেশে না ফেরার পেছনে নিরাপত্তা শঙ্কার কথা বলেছেন। তিনি কোনো ধরনের শঙ্কাবোধ করেন কিনা, তাতে তারেক বললেন, ‘বিভিন্ন রকম শঙ্কার কথা আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তো শুনেছি। সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও তো অনেক সময় অনেক শঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীত্ব: কী বললেন
তিনি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রত্যাশী কিনা এ প্রশ্নে তারেক বলেন, ‘দেখুন, আমি মনে করি, এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের। এটি তো আমার সিদ্ধান্ত নয়।’
নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা- তার উত্তরে বলেন, ‘জি, ইনশাআল্লাহ।’
বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সেটা নিশ্চিত কিনা- তখন তারেকের উত্তর, ‘সে ক্ষেত্রে তো এটি দল সিদ্ধান্ত নেবে। দল কীভাবে করবে, এটি তো দলের সিদ্ধান্ত।’
# খালেদা জিয়া এবং উত্তরাধিকার
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় থাকবেন কিনা, প্রশ্নে তারেক বলেন, ‘শারীরিক সক্ষমতা থাকলে’ তিনি ‘নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ভূমিকা রাখবেন।’
তবে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা- সেই প্রশ্নে তারেক রহমান বলেন, ‘এটি আমি এখনও বলতে পারছি না। তার শারীরিক অ্যাবিলিটির (সক্ষমতা) ওপর বিষয়টি কিছুটা হলেও নির্ভর করছে।’
জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন বিএনপি। তিনিই ছিলেন দলের নেতা। তাকে হত্যা করার পর একপর্যায়ে দলের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। চার দশক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন বিএনপির শীর্ষ নেতা তাদেরই ছেলে তারেক রহমান।
তো এই দলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে পরিবারের প্রভাব কতটা থাকবে- তাতে তারেকের উত্তর, ‘আপনি যদি আমাকে ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে এভাবে আমি বলব যে দেখুন বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনীতি যারা করেন, বিগত ১৭ বছরে যেমন দেখা গেছে, তার আগেও দেখা গেছে, রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হ্যারাসমেন্টের (হয়রানির) শিকার হন। মিথ্যা মামলার শিকার হন। আমাদের অনেক নেতাকর্মী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, জেল-জুলুম খেটেছে, ঘরবাড়ি ভেঙে দেয়া হয়েছে। যে কয়টা উদাহরণ দিলাম আমি মাত্র, আপনি কি বলতে পারবেন এর কোনোটার মধ্যে দিয়ে আমি যাইনি? এর প্রতিটার ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি। প্রতিটি স্তর পার করে এসেছি আমি। আমি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি। যে নির্যাতনের চিহ্ন এখনও কখনো কখনো আমাকে সহ্য করতে হয়। জেল-জুলুম খেটেছি আমি। বিভিন্নভাবে মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়েছি আমি। সবকিছুর ভেতর দিয়েই আমি পেরিয়ে এসেছি।’
‘এজন্য এ কথাগুলো আমি বললাম যে রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না। এটি সমর্থনের ভিত্তিতে হয়। কাজেই যে অর্গানাইজ (সংগঠিত) করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে, সে এগিয়ে যেতে পারবে। কেউ যদি এগিয়ে যেতে না পারে, তাহলে সে এগিয়ে যেতে পারবে না। সময় ও পরিস্থিতি সবকিছু প্রমাণ করে দেবে।’
তার স্ত্রী, কন্যা বা পরিবারের অন্য কারও রাজনীতিতে আসার আগ্রহ বা সম্ভাবনা আছে কিনা- তা ‘সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে’ বলে জানালেন তারেক।
# ‘মাস্টারমাইন্ড’ কে?
গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতন হয়। লন্ডনে থাকলেও আন্দোলনের বিভিন্নপর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। সেই ভূমিকার জন্য গত এক বছরে কেউ কেউ তাকে এ আন্দোলনের ‘একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে তারেক নিজেকে জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ মনে করেন না।
তারেক বলেন, ‘কোনো দল বা ব্যক্তি নন, জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।’
‘এ আন্দোলন সফল হয়েছে জুলাই মাসে, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে কিন্তু অনেক বছর আগে থেকে। এ আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হোক, যারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাদের নেতাকর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে। আমি মনে করি, জুলাই-আগস্ট মাসে (২০২৪ সাল) এসে জনগণ সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সেদিন মাদ্রাসার ছাত্ররা, তারা ছিলেন এ আন্দোলনের মাঠে। আমরা দেখেছি, গৃহিণীরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সন্তানের পেছনে। আমরা দেখেছি, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজিচালক, ছোট দোকান কর্মচারী বা দোকানমালিক থেকে আরম্ভ করে গার্মেন্টসকর্মী- তারা নেমে এসেছিলেন। আমরা দেখেছিলাম, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেমে এসেছিলেন এ আন্দোলনে। এমন অনেক সাংবাদিক, যারা স্বৈরাচারের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে দেশ থেকে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তারা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এ আন্দোলনে। কাজেই কারও ভূমিকাকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই না, খাটো করে দেখতে চাই না।’
‘এ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তারা এ আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। কোনো দল, কোনো ব্যক্তি নয়, এ আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।’
জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে তার কতটা যোগাযোগ ছিল- এই প্রশ্নে তারেক বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে আমি যেহেতু বাইরে থেকে কাজ করছি, আমাকে যোগাযোগটা অনলাইনের মাধ্যমে রাখতে হয়েছে। সেই দিনগুলোতে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে টেলিফোন সিস্টেম বা অনলাইন সিস্টেমের কী অবস্থা করেছিল স্বৈরাচার। আপনি যোগাযোগের যেটি কথা বলেছেন, এ যোগাযোগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্নভাবে আমাদের করতে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে করতে হয়েছে। যোগাযোগটা যে খুব স্মুথ সব সময় থেকেছে, তা নয়। প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছি আমরা।’
বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন তারেক রহমান
সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নির্বাসনে। আছেন যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর এই প্রথম কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন তারেক রহমান। এক সময় ছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। এখন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিবিসি বাংলাকে।
দেশে ফেরা নিয়ে বললেন, ‘বিভিন্ন রকম শঙ্কার কথা আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তো শুনেছি। সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও তো অনেক সময় অনেক শঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীত্ব: ‘এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের’
শারীরিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে খালেদা জিয়া নির্বাচন করবেন কিনা
রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না, সমর্থনের ভিত্তিতে হয়
‘দল বা ব্যক্তি নন, জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের জনগণ
’
প্রায় ৪৫ মিনিটের এ সাক্ষাৎকারে এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কেন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেননি, কবে ফিরছেন দেশে, নির্বাচন, পারিবারিক নেতৃত্ব- এমন নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান।
গণমাধ্যমের সঙ্গে এই দীর্ঘ সময় কেন কথা বলেননি- এ প্রশ্নে তারেক বলেন, ‘ব্যাপারটা বোধ হয় এ রকম নয়, ব্যাপারটা বোধ হয় একটু ভিন্ন। আসলে আমি কথা ঠিকই বলেছি। আমি দীর্ঘ ১৭ বছর এখানে আছি, এই দেশে, প্রবাস জীবনে, তবে আমার ওপরে যখন দলের দায়িত্ব এসে পড়েছে, তারপর থেকে আমি গ্রামে-গঞ্জে আমার নেতাকর্মীসহ তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষ যখন যেভাবে অংশগ্রহণ করেছে, আমি সবার সঙ্গে কথা বলেছি।’
‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় আদালত থেকে রীতিমতো একটা আদেশ দিয়ে আমার কথা বলার অধিকারকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমি যদি গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাইতাম, হয়তো গণমাধ্যমের ইচ্ছা ছিল ছাপানোর, গণমাধ্যম সেটি ছাপাতে পারতো না।’
একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তারেক বলেন, তিনি একবার প্রেসক্লাবে কথা বলেছিলেন। পরের দিন প্রেসক্লাবের ‘তখনকার কমিটি’ একটি বৈঠক ডেকে একটি সিদ্ধান্ত নেয়। তারা তখন তাকে আইনের দৃষ্টিতে ‘ফেরারি’ উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, ‘এ রকম কোনো ব্যক্তিকে তারা প্রেসক্লাবে কথা বলতে দেবে না।’ এভাবে তার কথা ‘বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করা’ হয়েছিল।
তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি কথা বলেছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন পন্থায় আমি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, আমি ইনশাআল্লাহ পৌঁছেছি মানুষের কাছে। কাজেই গণমাধ্যমে যে কথা বলিনি, তা নয়। আমি কথা বলেছি। হয়তো আপনারা তখন কথা নিতে পারেননি অথবা শুনতে পারেননি। ইচ্ছা থাকলেও ছাপাতে পারেননি, হয়তো প্রচার করতে পারেননি। কিন্তু আমি বলেছি, আমি থেমে থাকিনি।’
কবে ফিরছেন?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। যারা হাসিনা সরকারের সময় দেশ ছেড়েছিলেন, অনেকেই ফিরে এসেছেন। এ সময়কালে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও ।নেক আলোচনা হয়েছে। তো এখনও দেশে ফেরেননি কেন?
তারেক রহমানের জবাব, ‘কিছু সংগত কারণে হয়তো ফেরাটা হয়ে ওঠেনি এখনও। তবে সময় তো চলে এসেছে মনে হয়। ইনশাআল্লাহ, দ্রুতই ফিরে আসবো।’
কবে ফিরতে পারেন? তারেক বললেন, ‘দ্রুতই মনে হয়। দ্রুতই, ইনশাআল্লাহ।’
আগামী নির্বাচনের আগে দেশে ফিরবেন কিনা- এ প্রশ্নে তারেক, ‘রাজনীতি যখন করি, যেখানে জনগণের প্রত্যাশিত একটি নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকব? আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ইচ্ছা থাকবে, আগ্রহ থাকবে সেই প্রত্যাশিত নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে, জনগণের সঙ্গে জনগণের মধ্যেই থাকব, ইনশাআল্লাহ।’
বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে তারেকের দেশে না ফেরার পেছনে নিরাপত্তা শঙ্কার কথা বলেছেন। তিনি কোনো ধরনের শঙ্কাবোধ করেন কিনা, তাতে তারেক বললেন, ‘বিভিন্ন রকম শঙ্কার কথা আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তো শুনেছি। সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও তো অনেক সময় অনেক শঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রীত্ব: কী বললেন
তিনি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রত্যাশী কিনা এ প্রশ্নে তারেক বলেন, ‘দেখুন, আমি মনে করি, এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের। এটি তো আমার সিদ্ধান্ত নয়।’
নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা- তার উত্তরে বলেন, ‘জি, ইনশাআল্লাহ।’
বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সেটা নিশ্চিত কিনা- তখন তারেকের উত্তর, ‘সে ক্ষেত্রে তো এটি দল সিদ্ধান্ত নেবে। দল কীভাবে করবে, এটি তো দলের সিদ্ধান্ত।’
# খালেদা জিয়া এবং উত্তরাধিকার
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় থাকবেন কিনা, প্রশ্নে তারেক বলেন, ‘শারীরিক সক্ষমতা থাকলে’ তিনি ‘নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ভূমিকা রাখবেন।’
তবে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা- সেই প্রশ্নে তারেক রহমান বলেন, ‘এটি আমি এখনও বলতে পারছি না। তার শারীরিক অ্যাবিলিটির (সক্ষমতা) ওপর বিষয়টি কিছুটা হলেও নির্ভর করছে।’
জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন বিএনপি। তিনিই ছিলেন দলের নেতা। তাকে হত্যা করার পর একপর্যায়ে দলের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। চার দশক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন বিএনপির শীর্ষ নেতা তাদেরই ছেলে তারেক রহমান।
তো এই দলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে পরিবারের প্রভাব কতটা থাকবে- তাতে তারেকের উত্তর, ‘আপনি যদি আমাকে ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে এভাবে আমি বলব যে দেখুন বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনীতি যারা করেন, বিগত ১৭ বছরে যেমন দেখা গেছে, তার আগেও দেখা গেছে, রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হ্যারাসমেন্টের (হয়রানির) শিকার হন। মিথ্যা মামলার শিকার হন। আমাদের অনেক নেতাকর্মী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, জেল-জুলুম খেটেছে, ঘরবাড়ি ভেঙে দেয়া হয়েছে। যে কয়টা উদাহরণ দিলাম আমি মাত্র, আপনি কি বলতে পারবেন এর কোনোটার মধ্যে দিয়ে আমি যাইনি? এর প্রতিটার ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি। প্রতিটি স্তর পার করে এসেছি আমি। আমি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি। যে নির্যাতনের চিহ্ন এখনও কখনো কখনো আমাকে সহ্য করতে হয়। জেল-জুলুম খেটেছি আমি। বিভিন্নভাবে মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়েছি আমি। সবকিছুর ভেতর দিয়েই আমি পেরিয়ে এসেছি।’
‘এজন্য এ কথাগুলো আমি বললাম যে রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না। এটি সমর্থনের ভিত্তিতে হয়। কাজেই যে অর্গানাইজ (সংগঠিত) করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে, সে এগিয়ে যেতে পারবে। কেউ যদি এগিয়ে যেতে না পারে, তাহলে সে এগিয়ে যেতে পারবে না। সময় ও পরিস্থিতি সবকিছু প্রমাণ করে দেবে।’
তার স্ত্রী, কন্যা বা পরিবারের অন্য কারও রাজনীতিতে আসার আগ্রহ বা সম্ভাবনা আছে কিনা- তা ‘সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে’ বলে জানালেন তারেক।
# ‘মাস্টারমাইন্ড’ কে?
গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতন হয়। লন্ডনে থাকলেও আন্দোলনের বিভিন্নপর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। সেই ভূমিকার জন্য গত এক বছরে কেউ কেউ তাকে এ আন্দোলনের ‘একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে তারেক নিজেকে জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ মনে করেন না।
তারেক বলেন, ‘কোনো দল বা ব্যক্তি নন, জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।’
‘এ আন্দোলন সফল হয়েছে জুলাই মাসে, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে কিন্তু অনেক বছর আগে থেকে। এ আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হোক, যারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাদের নেতাকর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে। আমি মনে করি, জুলাই-আগস্ট মাসে (২০২৪ সাল) এসে জনগণ সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সেদিন মাদ্রাসার ছাত্ররা, তারা ছিলেন এ আন্দোলনের মাঠে। আমরা দেখেছি, গৃহিণীরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সন্তানের পেছনে। আমরা দেখেছি, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজিচালক, ছোট দোকান কর্মচারী বা দোকানমালিক থেকে আরম্ভ করে গার্মেন্টসকর্মী- তারা নেমে এসেছিলেন। আমরা দেখেছিলাম, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেমে এসেছিলেন এ আন্দোলনে। এমন অনেক সাংবাদিক, যারা স্বৈরাচারের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে দেশ থেকে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তারা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এ আন্দোলনে। কাজেই কারও ভূমিকাকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই না, খাটো করে দেখতে চাই না।’
‘এ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তারা এ আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। কোনো দল, কোনো ব্যক্তি নয়, এ আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।’
জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে তার কতটা যোগাযোগ ছিল- এই প্রশ্নে তারেক বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে আমি যেহেতু বাইরে থেকে কাজ করছি, আমাকে যোগাযোগটা অনলাইনের মাধ্যমে রাখতে হয়েছে। সেই দিনগুলোতে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে টেলিফোন সিস্টেম বা অনলাইন সিস্টেমের কী অবস্থা করেছিল স্বৈরাচার। আপনি যোগাযোগের যেটি কথা বলেছেন, এ যোগাযোগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্নভাবে আমাদের করতে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে করতে হয়েছে। যোগাযোগটা যে খুব স্মুথ সব সময় থেকেছে, তা নয়। প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছি আমরা।’