বাবুল রবিদাস
কালো জাদুর প্রতি বিশ্বাস এখনো অনেক মানুষের জীবনে বিভ্রান্তি ও বিপদ ডেকে আনছে। অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষ মনে করেন, কালো জাদুর মাধ্যমে সংসার ভাঙা যায়, ব্যবসায় উন্নতি আনা যায়, পরীক্ষায় ভালো ফল করা যায়Ñ এমনকি কাউকে মেরে ফেলার কাজও সম্ভব। কিন্তু যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানচিন্তার আলোয় এসব বিশ্বাস যে সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অলীক, তা আজ পরিষ্কার।
প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায় কালো জাদুর অভিযোগে মানুষকে পুড়িয়ে মারার খবর। আসলে কালো জাদু বলতে বোঝায় এমন এক জাদুচর্চা যা অন্যের অনিষ্টে বা নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। অনেকের মতে, ভূত, প্রেত, আত্মা বা প্রেতাত্মা ব্যবহার করেই এই জাদুর কাজ হয়। যারা এই কাজ করেন, তাদের কেউ ‘জাদুকর’, কেউ ‘ওঝা’, কেউ বা ‘তান্ত্রিক’ হিসেবে পরিচিত। এটি একটি অমানবিক, অশুভ এবং বর্বর প্রথা, যার ভিত্তি পুরোপুরি অলৌকিক ও ভিত্তিহীন।
বাম পথ ও ডান পথের মতো কিছু সংস্কার, যেমনÑডান দিক শুভ, বাম দিক অশুভÑএখনো সমাজে প্রচলিত আছে। এই ধরনের চিন্তায় ভূতের অস্তিত্বকে বাস্তব বলে মনে করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভূত বলে কিছু নেই। নেক্রোম্যান্সি বা মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ভবিষ্যৎ বলা বা কোনো কাজ সাধনÑএ-ও একধরনের কুসংস্কার। ভূতচর্চার ধারণার শিকড় হাইতি ও আফ্রিকার মতো অঞ্চলে, যেখানে আজও অনেকে ওঝার কাছে যায়, ডাক্তারের কাছে নয়।
কিন্তু সমস্যার আসল জায়গা হলোÑএই কুসংস্কারের শিকার হচ্ছেন সমাজের প্রান্তিক, দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষরা। চিকিৎসার অভাবে বা রোগের ভুল ব্যাখ্যায় রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে ওঝার কাছে নেয়া হয়। ফলে অনেকেই সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন বা মৃত্যুবরণ করেন।
কালো জাদু বিষয়ে সামাজিক বৈষম্য এবং জাতিগত বিদ্বেষেরও এক ভয়ানক রূপ রয়েছে। ভারতের একটি বইয়ের বর্ণনায় দেখা যায়, এক ব্রাহ্মণ রাজা শূদ্র শ্রেণীর মানুষদের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের নাম নেয়ার অভিযোগ এনে হত্যা করান। এটি দেখায়, কীভাবে ধর্ম ও কুসংস্কারকে ব্যবহার করে জাতিগত নিপীড়ন চালানো হয়।
সম্প্রতি বিহারের পূর্ণিয়া জেলার একটি আদিবাসী পল্লীতে এক শিশুর মৃত্যুকে কালো জাদুর ফল বলে ধরে নিয়ে একই পরিবারের পাঁচজনকে পিটিয়ে, পরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি শুধু বর্বর নয়, চরম বৈষম্যের উদাহরণ। এ ঘটনার পেছনে প্রভাবশালীদের ভূমিকা ছিল। এর আগে হাইতির একটি অঞ্চলে কালো জাদুর অভিযোগে ১১০ প্রবীণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতরা সবাই দরিদ্র ও সমাজের প্রান্তিক মানুষ।
এসব ঘটনার মূল কথা হলোÑকালো জাদুর মতো মিথ্যা অভিযোগ সমাজের সবচেয়ে দুর্বল মানুষদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়। ধনী ও ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে প্রমাণ না পেলে মিথ্যা অভিযোগ তুলে, তাদের ‘জাদুকর’ বা ‘ডাইনি’ বলে প্রচার করে হত্যা করা হয়। অথচ কেউ যদি প্রকৃত অপরাধী হয়, তাকে সঠিকভাবে তদন্ত করে আদালতের মাধ্যমে বিচার হওয়া উচিত। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কোনো যুক্তি নেই।
আমরা জানি, ‘সাত খুন মাফ’ কথাটি সমাজে ধনী ও ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু আধুনিক সভ্য সমাজে এই প্রবাদ অচল হয়ে গেছে। আইনের চোখে এখন সবাই সমান। তাই এই বর্বর, বৈষম্যপূর্ণ ও অমানবিক কালো জাদুর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। যারা মানুষ খুন করছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, শিক্ষাই এই অন্ধকার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। যুক্তিবোধ, বিজ্ঞানের চর্চা এবং মানবিক মূল্যবোধই পারে কালো জাদুর মতো কুসংস্কারকে সমাজ থেকে মুছে ফেলতে।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
কালো জাদুর প্রতি বিশ্বাস এখনো অনেক মানুষের জীবনে বিভ্রান্তি ও বিপদ ডেকে আনছে। অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষ মনে করেন, কালো জাদুর মাধ্যমে সংসার ভাঙা যায়, ব্যবসায় উন্নতি আনা যায়, পরীক্ষায় ভালো ফল করা যায়Ñ এমনকি কাউকে মেরে ফেলার কাজও সম্ভব। কিন্তু যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানচিন্তার আলোয় এসব বিশ্বাস যে সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অলীক, তা আজ পরিষ্কার।
প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায় কালো জাদুর অভিযোগে মানুষকে পুড়িয়ে মারার খবর। আসলে কালো জাদু বলতে বোঝায় এমন এক জাদুচর্চা যা অন্যের অনিষ্টে বা নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। অনেকের মতে, ভূত, প্রেত, আত্মা বা প্রেতাত্মা ব্যবহার করেই এই জাদুর কাজ হয়। যারা এই কাজ করেন, তাদের কেউ ‘জাদুকর’, কেউ ‘ওঝা’, কেউ বা ‘তান্ত্রিক’ হিসেবে পরিচিত। এটি একটি অমানবিক, অশুভ এবং বর্বর প্রথা, যার ভিত্তি পুরোপুরি অলৌকিক ও ভিত্তিহীন।
বাম পথ ও ডান পথের মতো কিছু সংস্কার, যেমনÑডান দিক শুভ, বাম দিক অশুভÑএখনো সমাজে প্রচলিত আছে। এই ধরনের চিন্তায় ভূতের অস্তিত্বকে বাস্তব বলে মনে করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভূত বলে কিছু নেই। নেক্রোম্যান্সি বা মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ভবিষ্যৎ বলা বা কোনো কাজ সাধনÑএ-ও একধরনের কুসংস্কার। ভূতচর্চার ধারণার শিকড় হাইতি ও আফ্রিকার মতো অঞ্চলে, যেখানে আজও অনেকে ওঝার কাছে যায়, ডাক্তারের কাছে নয়।
কিন্তু সমস্যার আসল জায়গা হলোÑএই কুসংস্কারের শিকার হচ্ছেন সমাজের প্রান্তিক, দরিদ্র ও অশিক্ষিত মানুষরা। চিকিৎসার অভাবে বা রোগের ভুল ব্যাখ্যায় রোগীকে হাসপাতালে না নিয়ে ওঝার কাছে নেয়া হয়। ফলে অনেকেই সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন বা মৃত্যুবরণ করেন।
কালো জাদু বিষয়ে সামাজিক বৈষম্য এবং জাতিগত বিদ্বেষেরও এক ভয়ানক রূপ রয়েছে। ভারতের একটি বইয়ের বর্ণনায় দেখা যায়, এক ব্রাহ্মণ রাজা শূদ্র শ্রেণীর মানুষদের বিরুদ্ধে ঈশ্বরের নাম নেয়ার অভিযোগ এনে হত্যা করান। এটি দেখায়, কীভাবে ধর্ম ও কুসংস্কারকে ব্যবহার করে জাতিগত নিপীড়ন চালানো হয়।
সম্প্রতি বিহারের পূর্ণিয়া জেলার একটি আদিবাসী পল্লীতে এক শিশুর মৃত্যুকে কালো জাদুর ফল বলে ধরে নিয়ে একই পরিবারের পাঁচজনকে পিটিয়ে, পরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি শুধু বর্বর নয়, চরম বৈষম্যের উদাহরণ। এ ঘটনার পেছনে প্রভাবশালীদের ভূমিকা ছিল। এর আগে হাইতির একটি অঞ্চলে কালো জাদুর অভিযোগে ১১০ প্রবীণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতরা সবাই দরিদ্র ও সমাজের প্রান্তিক মানুষ।
এসব ঘটনার মূল কথা হলোÑকালো জাদুর মতো মিথ্যা অভিযোগ সমাজের সবচেয়ে দুর্বল মানুষদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়। ধনী ও ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে প্রমাণ না পেলে মিথ্যা অভিযোগ তুলে, তাদের ‘জাদুকর’ বা ‘ডাইনি’ বলে প্রচার করে হত্যা করা হয়। অথচ কেউ যদি প্রকৃত অপরাধী হয়, তাকে সঠিকভাবে তদন্ত করে আদালতের মাধ্যমে বিচার হওয়া উচিত। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কোনো যুক্তি নেই।
আমরা জানি, ‘সাত খুন মাফ’ কথাটি সমাজে ধনী ও ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু আধুনিক সভ্য সমাজে এই প্রবাদ অচল হয়ে গেছে। আইনের চোখে এখন সবাই সমান। তাই এই বর্বর, বৈষম্যপূর্ণ ও অমানবিক কালো জাদুর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। যারা মানুষ খুন করছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বোপরি, শিক্ষাই এই অন্ধকার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। যুক্তিবোধ, বিজ্ঞানের চর্চা এবং মানবিক মূল্যবোধই পারে কালো জাদুর মতো কুসংস্কারকে সমাজ থেকে মুছে ফেলতে।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]