আব্দুল মজিদ
সর্বজনবিদিত একটা প্রবাদ রয়েছে, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদ-’। কথাটা যদি সত্য হয়, তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা সেটির প্রথম এবং প্রধান ভিত্তি। সময় পাল্টেছে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে সর্ব ক্ষেত্রেই। প্রাথমিক শিক্ষায় যে পরিবর্তন হয়নি, তা বলছি না। তবে জনগণের প্রত্যাশা অর্জনের জন্য আরো বেশি কিছু প্রয়োজন। এক সময় ছিলনা কোন আধুনিক অবকাঠামো, বসার আসন, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ইত্যাদি। আমরা নিজেরাই এক সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাকা বিল্ডিং কল্পনা করতে পারিনি। বছরের পর বছর ধরে জোড়া-তালি দেয়া বেঞ্চ ব্যবহার করতে হয়েছে। শিক্ষকের চেয়ার-টেবিলগুলোর দৈন্যদশা বর্ণনাতীত। বিদ্যুৎ তো ছিলোই না। কখনোবা বৃষ্টি এলে অপেক্ষাকৃত বৃষ্টি না পড়া কক্ষে জড়ো হতে হতো বর্ষার সময়ে। দিন পাল্টেছে। পাশাপাশি বড়ো ধরণের কিছু না করতে পারলেও, যে কোন সরকারই কিছুই যে করছেন না, তা কিন্তু নয়। বিগত তিন দশকে চেষ্টা চলছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে নানান পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। বিদ্যালয় গুলোতে হচ্ছে নতুন নতুন বিল্ডিং, দৃষ্টিনন্দন প্রবেশ তোরণসহ বাউ-ারি ওয়াল, আধুনিক সুবিধাযুক্ত ওয়াশব্লক, খেলাধুলার সরঞ্জাম, বাগান, সংযোগ রাস্তা ইত্যাদি।
শুধু কী তাই, প্রায় সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, সাউন্ড সিস্টেম, ইন্টারনেট ব্যবস্থার উপকরণ, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের এ্যাসেসটিভ ডিভাইস ইত্যাদি। বই, খাতা-কলমের অভাবে শিশুরা বিদ্যালয়ে পড়তে যেতে চায়না; এমন অবস্থাও নেই। এখন আর গাছতলায় সমবেত কণ্ঠে ধারাপাত পড়তে হয়না কিংবা প্রাকৃতিক ডাকে ঝোপে-ঝাড়ে দৌড়াতে হয়না। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে শতভাগ শিশু ভর্তি, শিশুর আনুসাঙ্গিক ব্যয়ের চাপ কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্ত করতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুকে ধরে রাখার জন্য উপবৃত্তি, মিড-ডে মিল ব্যবস্থা খুব চমৎকার এবং সময়োপযোগি পদক্ষেপ। বর্তমানে সার্বিক পরিবেশের উন্নতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করছেন মেধাবী মুখ। তবুও প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তির হিসেব ততোটা উল্লসিত হবার পর্যায়ে আসতে পারিনি আমরা।
যদিও বা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় আমরা সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে, তবু সীমিত সম্পদের এই রাষ্ট্রে যতোটুকু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তারই সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে এগিয়ে যেতে হবে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কাজ করতে হবে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে। শিক্ষকগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য আরো সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, একথা যেমনটি ন্যায্য এবং যুক্তিসংগত, তেমনি এটির অভাবে সৃষ্ট মনোঃকষ্টের কারণ যাতে শিক্ষার্থীর উপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকে সচেতন থাকা উচিত। শিক্ষকের নিজস্ব সৃষ্টিশীল উদ্ভাবণী শক্তি শিখন প্রক্রিয়াকে বেগবান ও স্থায়ী করতে পারে। বিদ্যালয়ের ভৌত পরিবেশ অনেকটাই শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন চাই, শিখণ প্রক্রিয়াকে আনন্দদায়ক এবং গ্রহণ উপযোগী করে উপস্থাপন করা। এক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়া ভিত্তিক পাঠদান কার্যক্রম অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি উপায়।
কিন্তু পাশাপাশি একথাও বলে রাখতে চাই; অনেক শিক্ষক আছেন, যারা নিজেরাই তাদের মেধা কাজে লাগিয়ে গোটা ক্লাসকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন। একথা সত্য, বাধ্য-বাধকতা দিয়ে কখনোই কোনো কাজে ভালো ফলাফল করা যায়না, এটি যুগে যুগে প্রমাণিত। স্বপ্রণোদিত ও স্বতঃস্ফুর্ত কাজই প্রকৃত অর্থে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে পাঠদান করার বিষয়টিকে শিক্ষকগণের কাছে যেনো আরোপিত না হয়ে, স্বপ্রণোদিত হয় ; এমন পরিবেশ তৈরি করা। তবেই ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে, এমনটিই দাঁড়ায়; যে শিক্ষক মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পাঠদান করবেন, তাকে প্রেষণা দিতে হবে। এজন্য তার কাজের স্বীকৃতিতে অর্থ কিংবা অন্য কোন জিনিস পুরস্কার দেয়া যেতে পারে। তবে তা কখনই দেরিতে নয়; যতো দ্রুত সম্ভব এবং শিক্ষকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের বহুল উপস্থিতির মাধ্যমে। এটি যেমন তাকে প্রেষণা যোগাবে, অন্যদের তা উৎসাহ দিবে। এ ধরনের পদক্ষেপ পেশাগত জীবনসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তাকে এক উচ্চতা মর্যাদা দান করবে। ছোট-খাটো সীমাবদ্ধতা কারণে শতভাগ না হলেও এর ফলাফল হবে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এবং কার্যকর।
তাই বলা যায়, শিক্ষকের আন্তরিকভাবে পাঠদান নিশ্চিতই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাঠদান প্রক্রিয়াকে উন্নত, বিজ্ঞানসম্মত এবং ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে এযাবৎ শিক্ষক প্রশিক্ষণও এযাবত কম হয়নি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে যারা এটি প্রতিপালন করছেন তাঁদেরকে একইভাবে সন্মানিত করা যেতে পারে। এভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাতে করে শিক্ষকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাড়ে, সেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত করে অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে বরাদ্দ প্রদান কিংবা অন্যান্য খাতে ব্যয় সংকোচন করে এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আশা করা যায়, সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবেন।
[লেখক : শিক্ষক]
আব্দুল মজিদ
মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট ২০২৫
সর্বজনবিদিত একটা প্রবাদ রয়েছে, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদ-’। কথাটা যদি সত্য হয়, তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা সেটির প্রথম এবং প্রধান ভিত্তি। সময় পাল্টেছে। অনেক পরিবর্তন হয়েছে সর্ব ক্ষেত্রেই। প্রাথমিক শিক্ষায় যে পরিবর্তন হয়নি, তা বলছি না। তবে জনগণের প্রত্যাশা অর্জনের জন্য আরো বেশি কিছু প্রয়োজন। এক সময় ছিলনা কোন আধুনিক অবকাঠামো, বসার আসন, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ইত্যাদি। আমরা নিজেরাই এক সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাকা বিল্ডিং কল্পনা করতে পারিনি। বছরের পর বছর ধরে জোড়া-তালি দেয়া বেঞ্চ ব্যবহার করতে হয়েছে। শিক্ষকের চেয়ার-টেবিলগুলোর দৈন্যদশা বর্ণনাতীত। বিদ্যুৎ তো ছিলোই না। কখনোবা বৃষ্টি এলে অপেক্ষাকৃত বৃষ্টি না পড়া কক্ষে জড়ো হতে হতো বর্ষার সময়ে। দিন পাল্টেছে। পাশাপাশি বড়ো ধরণের কিছু না করতে পারলেও, যে কোন সরকারই কিছুই যে করছেন না, তা কিন্তু নয়। বিগত তিন দশকে চেষ্টা চলছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে নানান পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। বিদ্যালয় গুলোতে হচ্ছে নতুন নতুন বিল্ডিং, দৃষ্টিনন্দন প্রবেশ তোরণসহ বাউ-ারি ওয়াল, আধুনিক সুবিধাযুক্ত ওয়াশব্লক, খেলাধুলার সরঞ্জাম, বাগান, সংযোগ রাস্তা ইত্যাদি।
শুধু কী তাই, প্রায় সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, সাউন্ড সিস্টেম, ইন্টারনেট ব্যবস্থার উপকরণ, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের এ্যাসেসটিভ ডিভাইস ইত্যাদি। বই, খাতা-কলমের অভাবে শিশুরা বিদ্যালয়ে পড়তে যেতে চায়না; এমন অবস্থাও নেই। এখন আর গাছতলায় সমবেত কণ্ঠে ধারাপাত পড়তে হয়না কিংবা প্রাকৃতিক ডাকে ঝোপে-ঝাড়ে দৌড়াতে হয়না। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে শতভাগ শিশু ভর্তি, শিশুর আনুসাঙ্গিক ব্যয়ের চাপ কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্ত করতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুকে ধরে রাখার জন্য উপবৃত্তি, মিড-ডে মিল ব্যবস্থা খুব চমৎকার এবং সময়োপযোগি পদক্ষেপ। বর্তমানে সার্বিক পরিবেশের উন্নতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করছেন মেধাবী মুখ। তবুও প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তির হিসেব ততোটা উল্লসিত হবার পর্যায়ে আসতে পারিনি আমরা।
যদিও বা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় আমরা সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে, তবু সীমিত সম্পদের এই রাষ্ট্রে যতোটুকু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তারই সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে এগিয়ে যেতে হবে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কাজ করতে হবে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে। শিক্ষকগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য আরো সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, একথা যেমনটি ন্যায্য এবং যুক্তিসংগত, তেমনি এটির অভাবে সৃষ্ট মনোঃকষ্টের কারণ যাতে শিক্ষার্থীর উপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকে সচেতন থাকা উচিত। শিক্ষকের নিজস্ব সৃষ্টিশীল উদ্ভাবণী শক্তি শিখন প্রক্রিয়াকে বেগবান ও স্থায়ী করতে পারে। বিদ্যালয়ের ভৌত পরিবেশ অনেকটাই শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন চাই, শিখণ প্রক্রিয়াকে আনন্দদায়ক এবং গ্রহণ উপযোগী করে উপস্থাপন করা। এক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়া ভিত্তিক পাঠদান কার্যক্রম অত্যন্ত ফলপ্রসূ একটি উপায়।
কিন্তু পাশাপাশি একথাও বলে রাখতে চাই; অনেক শিক্ষক আছেন, যারা নিজেরাই তাদের মেধা কাজে লাগিয়ে গোটা ক্লাসকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন। একথা সত্য, বাধ্য-বাধকতা দিয়ে কখনোই কোনো কাজে ভালো ফলাফল করা যায়না, এটি যুগে যুগে প্রমাণিত। স্বপ্রণোদিত ও স্বতঃস্ফুর্ত কাজই প্রকৃত অর্থে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করে পাঠদান করার বিষয়টিকে শিক্ষকগণের কাছে যেনো আরোপিত না হয়ে, স্বপ্রণোদিত হয় ; এমন পরিবেশ তৈরি করা। তবেই ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে, এমনটিই দাঁড়ায়; যে শিক্ষক মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পাঠদান করবেন, তাকে প্রেষণা দিতে হবে। এজন্য তার কাজের স্বীকৃতিতে অর্থ কিংবা অন্য কোন জিনিস পুরস্কার দেয়া যেতে পারে। তবে তা কখনই দেরিতে নয়; যতো দ্রুত সম্ভব এবং শিক্ষকসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের বহুল উপস্থিতির মাধ্যমে। এটি যেমন তাকে প্রেষণা যোগাবে, অন্যদের তা উৎসাহ দিবে। এ ধরনের পদক্ষেপ পেশাগত জীবনসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তাকে এক উচ্চতা মর্যাদা দান করবে। ছোট-খাটো সীমাবদ্ধতা কারণে শতভাগ না হলেও এর ফলাফল হবে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এবং কার্যকর।
তাই বলা যায়, শিক্ষকের আন্তরিকভাবে পাঠদান নিশ্চিতই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাঠদান প্রক্রিয়াকে উন্নত, বিজ্ঞানসম্মত এবং ফলপ্রসূ করার ক্ষেত্রে এযাবৎ শিক্ষক প্রশিক্ষণও এযাবত কম হয়নি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে যারা এটি প্রতিপালন করছেন তাঁদেরকে একইভাবে সন্মানিত করা যেতে পারে। এভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাতে করে শিক্ষকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বাড়ে, সেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত করে অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে বরাদ্দ প্রদান কিংবা অন্যান্য খাতে ব্যয় সংকোচন করে এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আশা করা যায়, সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবেন।
[লেখক : শিক্ষক]