গোলাম মোস্তফা
প্রতিদিন মাঠে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এটি আমাদের সমাজের একটি করুণ বাস্তবতা। আমরা হয়তো ধরে নিয়েছি, এটাই নিয়ম, এভাবেই চলবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মাগুরার আট বছর বয়সী কন্যাশিশু আছিয়ার মৃত্যু আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও আছিয়াকে বাঁচানো যায়নি। তার নিকটজনের বিভৎস আচরণে সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনায় মুখর হয়েছে। একই সঙ্গে অপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঢাবিসহ রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠেছে।
সরকার তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং বিচারপ্রক্রিয়া চলমান। উক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আইনের সংস্কারের কথা ভাবছে। আগে যেখানে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার কথা বলা হতো, সেখানে এখন ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ধর্ষণের তদন্ত ১৫ দিনের মধ্যে সম্পাদন এবং সংশোধিত আইনের প্রস্তাবে ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে বিচার শেষ না হওয়ার অজুহাতে কোন জামিন দেয়া যাবে না। এছাড়া নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, কটুক্তি, ইভটিজিং, হেনস্তা, যৌন হয়রানি বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হটলাইন সেবা চালু করেছে।
নারীরা আমাদের আপনজনÑকন্যা, ভগ্নি, মাতা, খালা। তাদের নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করতে আমরা আসলে কি করছি? বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে। তারপরও কেন থামানো যাচ্ছে না ধর্ষণ? অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পরিবার গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে বিষয়টির মীমাংসা করতে চায় বা করতে বাধ্য হয়। আমাদের সমাজে এখনও কিছু কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতা রয়ে গেছে, যা নারীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করছে। এটি শুধু ভুক্তভোগীর জীবনই নয়, অন্য নারীদের জীবনকেও চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে।
ধর্ষণ মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার প্রস্তাব নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় একটি সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু এর সফলতা নির্ভর করবে আইনের সঠিক প্রয়োগ, বিচার বিভাগের সক্ষমতা এবং সামাজিক সচেতনতার ওপর। শুধু কঠোর আইন নয়, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয় অপরিহার্য।
আইনের সংশোধনী ধর্ষণ মামলায় ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। তবে শুধু সময়সীমা কমালেই চলবে না, তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত বাজেট, প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং জনবল নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, দ্রুত বিচার চাইতে গিয়ে যেন ন্যায়বিচার বিসর্জন না দেয়া হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অভিযুক্তের সুষ্ঠু বিচারের অধিকারও সংবিধানের মৌলিক নীতি।
বাংলাদেশের আদালতগুলোতে মামলার চাপ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবলের ঘাটতি রয়েছে। তাই ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন করা কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, ফরেনসিক ল্যাব আধুনিকীকরণ এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর আইন, দ্রুত বিচার, ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা ও সহায়তা এবং বিচার ও পুলিশ প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধিÑএই পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য। শুধু আইন প্রণয়ন করলেই চলবে না, এর সঠিক প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
একটি নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধে রাষ্ট্র, সমাজ এবং প্রতিটি ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি নিরাপদ ও সমতাপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে নারীরা স্বাধীনতা ও সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবেন।
[লেখক : শিক্ষক]
গোলাম মোস্তফা
শনিবার, ০৯ আগস্ট ২০২৫
প্রতিদিন মাঠে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এটি আমাদের সমাজের একটি করুণ বাস্তবতা। আমরা হয়তো ধরে নিয়েছি, এটাই নিয়ম, এভাবেই চলবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মাগুরার আট বছর বয়সী কন্যাশিশু আছিয়ার মৃত্যু আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও আছিয়াকে বাঁচানো যায়নি। তার নিকটজনের বিভৎস আচরণে সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনায় মুখর হয়েছে। একই সঙ্গে অপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঢাবিসহ রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠেছে।
সরকার তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেছে এবং বিচারপ্রক্রিয়া চলমান। উক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আইনের সংস্কারের কথা ভাবছে। আগে যেখানে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার কথা বলা হতো, সেখানে এখন ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ধর্ষণের তদন্ত ১৫ দিনের মধ্যে সম্পাদন এবং সংশোধিত আইনের প্রস্তাবে ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে বিচার শেষ না হওয়ার অজুহাতে কোন জামিন দেয়া যাবে না। এছাড়া নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, কটুক্তি, ইভটিজিং, হেনস্তা, যৌন হয়রানি বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হটলাইন সেবা চালু করেছে।
নারীরা আমাদের আপনজনÑকন্যা, ভগ্নি, মাতা, খালা। তাদের নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করতে আমরা আসলে কি করছি? বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে। তারপরও কেন থামানো যাচ্ছে না ধর্ষণ? অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পরিবার গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে বিষয়টির মীমাংসা করতে চায় বা করতে বাধ্য হয়। আমাদের সমাজে এখনও কিছু কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতা রয়ে গেছে, যা নারীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করছে। এটি শুধু ভুক্তভোগীর জীবনই নয়, অন্য নারীদের জীবনকেও চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে।
ধর্ষণ মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার প্রস্তাব নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় একটি সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু এর সফলতা নির্ভর করবে আইনের সঠিক প্রয়োগ, বিচার বিভাগের সক্ষমতা এবং সামাজিক সচেতনতার ওপর। শুধু কঠোর আইন নয়, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয় অপরিহার্য।
আইনের সংশোধনী ধর্ষণ মামলায় ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। তবে শুধু সময়সীমা কমালেই চলবে না, তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত বাজেট, প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং জনবল নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, দ্রুত বিচার চাইতে গিয়ে যেন ন্যায়বিচার বিসর্জন না দেয়া হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অভিযুক্তের সুষ্ঠু বিচারের অধিকারও সংবিধানের মৌলিক নীতি।
বাংলাদেশের আদালতগুলোতে মামলার চাপ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবলের ঘাটতি রয়েছে। তাই ৯০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন করা কতটুকু বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, ফরেনসিক ল্যাব আধুনিকীকরণ এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর আইন, দ্রুত বিচার, ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা ও সহায়তা এবং বিচার ও পুলিশ প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধিÑএই পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য। শুধু আইন প্রণয়ন করলেই চলবে না, এর সঠিক প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
একটি নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধে রাষ্ট্র, সমাজ এবং প্রতিটি ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি নিরাপদ ও সমতাপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে নারীরা স্বাধীনতা ও সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবেন।
[লেখক : শিক্ষক]