আবু জুবায়ের
অমর একুশে বইমেলা- এই দুটি শব্দ আমাদের বাঙালির কাছে শুধু একটা ইভেন্ট না, এটা যেন এক ধরনের জাতীয় অঙ্গীকার। পহেলা ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে যে উৎসবের ঢেউ লাগে, তা আমাদের ভাষা আন্দোলনের আত্মদান আর স্বাধীনতার চেতনার প্রতি আমাদের ঋণ স্বীকার। বছর বছর ধরে এই মেলার যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে, তা কোনো সরকারি বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয় হতে পারে না; এটা আমাদের মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার প্রতীক। আর ঠিক এই কারণেই, যখন জাতীয় নির্বাচন বা অন্য কোনো পরিস্থিতির অজুহাতে এর তারিখ বদলের কথা ওঠে, তখন সমাজের মননশীল অংশ গভীরভাবে আহত হয়। আমরা মনে করি, বইমেলার তারিখ ফেব্রুয়ারি থেকে সরালে শুধু একটা উৎসবের সময় বদল হয় না, গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে যায়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচন অপরিহার্য, কিন্তু নির্বাচন কেবল কাঠামোগত দিকটা দেখায়। একটা সত্যিকারের সুস্থ গণতন্ত্র টিকে থাকে তার সচেতন ও যুক্তিবাদী নাগরিক সমাজের ওপর ভর করে। এই সচেতনতা তৈরি হয় জ্ঞানচর্চা, মুক্ত আলোচনা আর সমালোচনামূলক বিতর্কের মাধ্যমে। আর বইমেলাই হলো সেই প্রক্রিয়াটার সবচেয়ে বড় কারখানা। এখানে লেখক তার নতুন ভাবনা তুলে ধরেন, পাঠক সেটা নিয়ে প্রশ্ন করেন, আলোচনা করেন। বিভিন্ন মত, পথ আর চিন্তাধারার অবাধ মিলন ঘটে এই মেলায়। এই পরিবেশ মানুষকে সহনশীল হতে, ভিন্ন মতকে সম্মান জানাতে শেখায়Ñযা গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। যে সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডা বন্ধ থাকে, সেখানে গুজব, উগ্রবাদ আর অসহিষ্ণুতা সহজেই ডালপালা মেলে। তখন গণতন্ত্র নামেই থাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পঙ্গু হয়ে যায়। তাই, যদি আমরা গণতন্ত্রের উত্তরণ চাই, তাহলে আগে এই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রকে সুরক্ষিত ও উন্মুক্ত রাখতে হবে। বইমেলা বন্ধ করা মানে কার্যত এই চিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করার একটা সুযোগ করে দেওয়া।
বইমেলার সঙ্গে ফেব্রুয়ারি মাসের সম্পর্কটা নিছক ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়, এটা ইতিহাসের সম্পর্ক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রক্তের বিনিময়ে আমরা ভাষার অধিকার পেয়েছি। সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করেই এই মেলার জন্ম। একুশের চেতনাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এই মেলার। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে একুশের প্রভাতফেরী পর্যন্ত যে আবেগ, যে সংকল্প আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়, তা অন্য কোনো মাসে পাওয়া সম্ভব না। এই কারণেই এর নাম ‘অমর একুশে বইমেলা’Ñঅন্য কোনো মাসের বইমেলা নয়।
ইতিহাস কিন্তু বলে, যখনই এই মেলা আক্রান্ত হয়েছে, তা কোনো না কোনোভাবে গণতন্ত্রের দুর্বল মুহূর্তেই ঘটেছে। স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে বইমেলা বন্ধ থাকার যে নজির রয়েছে, তা সেই সময়ের মুক্তচিন্তার কণ্ঠরোধের ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেলা মার্চ মাসে গেলেও, সংস্কৃতিপ্রেমীরা দেখেছেন যে ফেব্রুয়ারির প্রাণবন্ততা সেখানে কিছুটা হলেও অনুপস্থিত ছিল। আর বর্তমানে যখন জাতীয় নির্বাচন, প্রশাসনিক নিরাপত্তার উদ্বেগ বা রমজান মাসের দোহাই দিয়ে মেলাকে ডিসেম্বর বা অন্য কোনো মাসে সরানোর প্রস্তাব আসে, তখন বুঝতে হবে এই মেলা নিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক টালবাহানা চলছে। অথচ অতীতে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের মতো বড় রাজনৈতিক ঘটনার সময়ও কর্তৃপক্ষ ফেব্রুয়ারির ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে মেলা চালিয়ে যেতে পেরেছিল।
এই মেলা স্থানান্তরের ফল কিন্তু বহুমাত্রিক। প্রথমত, এটা প্রকাশনা শিল্পকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রকাশকরা সারা বছর এই একটা মাসের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ করেন, হাজার হাজার নতুন বই বের করার পরিকল্পনা করেন। মেলা সরলে তাদের বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়। দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক যে মাসব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণ তৈরি হয়, তা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের জাতীয় চেতনার মূলে আঘাত হানে। তাই, আমরা স্পষ্ট বলতে চাই, গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন যেমন জরুরি, তেমনি সংস্কৃতির প্রাণশক্তি হিসেবে একুশের বইমেলাও ফেব্রুয়ারিতেই হওয়া চাই। প্রশাসনকে বুঝতে হবে, নির্বাচন আর সংস্কৃতি একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহযাত্রী। এই ঐতিহ্যকে সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব, যা আমাদের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথকে মসৃণ করবে।
[লেখক: ফ্রান্স-প্রবাসী কবি]
আবু জুবায়ের
বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫
অমর একুশে বইমেলা- এই দুটি শব্দ আমাদের বাঙালির কাছে শুধু একটা ইভেন্ট না, এটা যেন এক ধরনের জাতীয় অঙ্গীকার। পহেলা ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে যে উৎসবের ঢেউ লাগে, তা আমাদের ভাষা আন্দোলনের আত্মদান আর স্বাধীনতার চেতনার প্রতি আমাদের ঋণ স্বীকার। বছর বছর ধরে এই মেলার যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে, তা কোনো সরকারি বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয় হতে পারে না; এটা আমাদের মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার প্রতীক। আর ঠিক এই কারণেই, যখন জাতীয় নির্বাচন বা অন্য কোনো পরিস্থিতির অজুহাতে এর তারিখ বদলের কথা ওঠে, তখন সমাজের মননশীল অংশ গভীরভাবে আহত হয়। আমরা মনে করি, বইমেলার তারিখ ফেব্রুয়ারি থেকে সরালে শুধু একটা উৎসবের সময় বদল হয় না, গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া রুদ্ধ হয়ে যায়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচন অপরিহার্য, কিন্তু নির্বাচন কেবল কাঠামোগত দিকটা দেখায়। একটা সত্যিকারের সুস্থ গণতন্ত্র টিকে থাকে তার সচেতন ও যুক্তিবাদী নাগরিক সমাজের ওপর ভর করে। এই সচেতনতা তৈরি হয় জ্ঞানচর্চা, মুক্ত আলোচনা আর সমালোচনামূলক বিতর্কের মাধ্যমে। আর বইমেলাই হলো সেই প্রক্রিয়াটার সবচেয়ে বড় কারখানা। এখানে লেখক তার নতুন ভাবনা তুলে ধরেন, পাঠক সেটা নিয়ে প্রশ্ন করেন, আলোচনা করেন। বিভিন্ন মত, পথ আর চিন্তাধারার অবাধ মিলন ঘটে এই মেলায়। এই পরিবেশ মানুষকে সহনশীল হতে, ভিন্ন মতকে সম্মান জানাতে শেখায়Ñযা গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। যে সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডা বন্ধ থাকে, সেখানে গুজব, উগ্রবাদ আর অসহিষ্ণুতা সহজেই ডালপালা মেলে। তখন গণতন্ত্র নামেই থাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পঙ্গু হয়ে যায়। তাই, যদি আমরা গণতন্ত্রের উত্তরণ চাই, তাহলে আগে এই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ক্ষেত্রকে সুরক্ষিত ও উন্মুক্ত রাখতে হবে। বইমেলা বন্ধ করা মানে কার্যত এই চিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করার একটা সুযোগ করে দেওয়া।
বইমেলার সঙ্গে ফেব্রুয়ারি মাসের সম্পর্কটা নিছক ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়, এটা ইতিহাসের সম্পর্ক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রক্তের বিনিময়ে আমরা ভাষার অধিকার পেয়েছি। সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করেই এই মেলার জন্ম। একুশের চেতনাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এই মেলার। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে একুশের প্রভাতফেরী পর্যন্ত যে আবেগ, যে সংকল্প আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়, তা অন্য কোনো মাসে পাওয়া সম্ভব না। এই কারণেই এর নাম ‘অমর একুশে বইমেলা’Ñঅন্য কোনো মাসের বইমেলা নয়।
ইতিহাস কিন্তু বলে, যখনই এই মেলা আক্রান্ত হয়েছে, তা কোনো না কোনোভাবে গণতন্ত্রের দুর্বল মুহূর্তেই ঘটেছে। স্বৈরাচারী সামরিক শাসক এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে বইমেলা বন্ধ থাকার যে নজির রয়েছে, তা সেই সময়ের মুক্তচিন্তার কণ্ঠরোধের ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনে ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেলা মার্চ মাসে গেলেও, সংস্কৃতিপ্রেমীরা দেখেছেন যে ফেব্রুয়ারির প্রাণবন্ততা সেখানে কিছুটা হলেও অনুপস্থিত ছিল। আর বর্তমানে যখন জাতীয় নির্বাচন, প্রশাসনিক নিরাপত্তার উদ্বেগ বা রমজান মাসের দোহাই দিয়ে মেলাকে ডিসেম্বর বা অন্য কোনো মাসে সরানোর প্রস্তাব আসে, তখন বুঝতে হবে এই মেলা নিয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক টালবাহানা চলছে। অথচ অতীতে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের মতো বড় রাজনৈতিক ঘটনার সময়ও কর্তৃপক্ষ ফেব্রুয়ারির ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে মেলা চালিয়ে যেতে পেরেছিল।
এই মেলা স্থানান্তরের ফল কিন্তু বহুমাত্রিক। প্রথমত, এটা প্রকাশনা শিল্পকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রকাশকরা সারা বছর এই একটা মাসের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ করেন, হাজার হাজার নতুন বই বের করার পরিকল্পনা করেন। মেলা সরলে তাদের বিশাল আর্থিক ক্ষতি হয়। দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক যে মাসব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণ তৈরি হয়, তা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের জাতীয় চেতনার মূলে আঘাত হানে। তাই, আমরা স্পষ্ট বলতে চাই, গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন যেমন জরুরি, তেমনি সংস্কৃতির প্রাণশক্তি হিসেবে একুশের বইমেলাও ফেব্রুয়ারিতেই হওয়া চাই। প্রশাসনকে বুঝতে হবে, নির্বাচন আর সংস্কৃতি একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহযাত্রী। এই ঐতিহ্যকে সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব, যা আমাদের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথকে মসৃণ করবে।
[লেখক: ফ্রান্স-প্রবাসী কবি]