সাঈদ চৌধুরী
যারা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয় কিন্তু পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে আসে ওরা দেখে যে শুধু ভালো ছাত্র-ছাত্রীরাই পুরস্কার গ্রহন করছে তখন তাদের অনুভূতি কেমন হয় ?
এ বিষয়টা নিয়ে তেমন কথা হয়নি কখনও । আমরা শিশুদের মানসিকতা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করলেও এখনও যে অনেক কিছুই ভাবিনা বা এড়িয়ে যাই এ বিষয়টি তেমনই ।
বানিয়ারচালা গ্রামের একটি স্কুল চাইল্ড কেয়ার । এই স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম । বরাবরই এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ফজর আলী ভাই আমাকে স্কুলে যেতে বলেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে । ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল ঘোষনা হচ্ছে আর প্রথম দিককার ছেলে মেয়েরা আনন্দে হইহুল্লোর করছে ।
তাদের জন্য সাজানো রয়েছে ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট । প্রতিটি বিদ্যালয়, প্রতিটি প্রতিযোগিতার জায়গায় এমনটাই হয় ।
আমি গিয়েই ফজর আলী ভাইকে বললাম; ভাই এবার আমি একেবারে পেছনের বেঞ্চের শিক্ষার্থী যে ভালো ফলাফল করতে পারেনি তাদেরকে পুরস্কার দেবো । তিনি বললেন ভালো হবে ভাই, আমি ব্যবস্থা করে দেবো ।
তার আগে বলে নেই আমার ছোট বেলার কথা । বেশির ভাগ সময় নয় দশের দিকে রোল নম্বর থাকতো আমার । যখন বন্ধুরা পুরস্কার নিত তখন না দেখার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতাম । অনেক সময় বাবাও মঞ্চে থাকতেন, পুরস্কার তুলে দিতেন বন্ধুদের হাতে । অজানা একটা কষ্ট ভেতরে থাকতো কিন্তু যোগ্য না হয়ে উঠলে পুরস্কার পাবোনা এটা মেনে নিতেই হবে -এটাইতো বড় শিক্ষা !
এরকম সময় আমার চেয়ে যারা খারাপ ছাত্র তাদের মধ্যে কারও কারও মন খারাপ হতে দেখেছি আবার কারও দেখেছি পাত্তা না দেয়া । সব সুবিধা না পাওয়া একজন বন্ধু ছিলো আমাদের । যে প্রথম হল সে পুরস্কার হিসেবে এক রীম কাগজ পাওয়ার পর ঐ বন্ধুটি বলল “দেখ সাঈদ অরা ভালো ফলাফল করে দেইখা অরাই খালি কাগজ কলম পায়, আমরা ট্যাহার অভাবে কিনবারও পারিনা, পাইওনা” !
কথাটি আমার এখনও মনে হয় । বৎসর শেষে একটা পুরস্কারের দিনে যে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে তারই পুরস্কার পাওয়া দরকার । পড়াশোনা ছাড়া যে যে ধরণের যোগ্য তাকে সে ধরণের একটা করে হলেও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ।
এতে করে খারাপ ফলাফল করা শিক্ষার্থী হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াতেও পারে । সে ভবিষ্যতে তাকে মেলে ধরতেও পারে । অপ্রাপ্তির মন খারাপ নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা শিশুরা দিন দিনই নিজেদের গুটিয়ে নেয়, তারা এক সময় ভাবে আমরা পারবোই না ! পারার শক্তিকে বের করে আনতে না পারলে সে ব্যর্থতাতো আমাদেরও !
যাই হোক, বলছিলাম চাইল্ড কেয়ার স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের কথা । কথা অনুযায়ী সব পুরস্কারের শেষে ডাকা হল যারা ভালো ফলাফল করেনি এমন পাঁচজনকে ।
তাদের মধ্যে একজনের শরীরে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে । তার অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নয় । ও আমার পাশে এসে দাঁড়ালো । বাকী চারজনকেও আনা হল । আমি তাদেও হাতে আমার মেয়ে নিতু চৌধুরীর লেখা বইটি পুরস্কার হিসেবে তুলে দিয়ে বললাম এই বইয়ে তোমাদের প্রতিষ্ঠান প্রধান ফজর আলী স্যারের জীবনের কথা লেখা আছে । তিনি কত কষ্ট করে জীবনটা এগিয়ে নিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা তোমরা জানলে তোমাদেরও বড় হতে ইচ্ছে করবে ।
বইটি পেয়ে এবং স্যারের কথা লেখা আছে জেনে ওরা খুশি হল । বলে আসলাম আমি আবার এসে দেখে যাবো তোমরা আমার কথা শুনে ভালো ছাত্র হওয়ার, ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো কিনা !
যাই হোক, পুরস্কার মানুষের মনকে আনন্দিত করে । তাই শিশুদের কোনো অনুষ্ঠানে পুরস্কার দিতে হলে ছোট ছোট হলেও সবাইকে পুরস্কার দেয়াই প্রয়োজন ।
সরকার সরকারি স্কুলে এ ধরণের আয়োজন চালু করতে পারে । তাহলে শিশুদের মধ্যে হীনমন্যতা কমবে এবং তারা নিজেদের মেলে ধরতে আরেকটু বেশী সক্ষম হবে বলে মনে করি । সেদিন অনুষ্ঠানে এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ সমাজ সেবক হিসেবে পরিচিত ফিরোজ ভাইও আমার কথা সাথে একমত হয়েছেন এবং বলেছেন তিনিও কাজটি করতে চেষ্টা করবেন । ভাবনার জায়গা প্রসারিত করলে সুশিক্ষিত, আত্ম নির্ভরশীল দেশ পাওয়া তেমন কঠিন হবার নয় ।
[লেখক: রসায়নবিদ]
সাঈদ চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২২
যারা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয় কিন্তু পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে আসে ওরা দেখে যে শুধু ভালো ছাত্র-ছাত্রীরাই পুরস্কার গ্রহন করছে তখন তাদের অনুভূতি কেমন হয় ?
এ বিষয়টা নিয়ে তেমন কথা হয়নি কখনও । আমরা শিশুদের মানসিকতা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করলেও এখনও যে অনেক কিছুই ভাবিনা বা এড়িয়ে যাই এ বিষয়টি তেমনই ।
বানিয়ারচালা গ্রামের একটি স্কুল চাইল্ড কেয়ার । এই স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম । বরাবরই এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ফজর আলী ভাই আমাকে স্কুলে যেতে বলেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে । ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল ঘোষনা হচ্ছে আর প্রথম দিককার ছেলে মেয়েরা আনন্দে হইহুল্লোর করছে ।
তাদের জন্য সাজানো রয়েছে ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট । প্রতিটি বিদ্যালয়, প্রতিটি প্রতিযোগিতার জায়গায় এমনটাই হয় ।
আমি গিয়েই ফজর আলী ভাইকে বললাম; ভাই এবার আমি একেবারে পেছনের বেঞ্চের শিক্ষার্থী যে ভালো ফলাফল করতে পারেনি তাদেরকে পুরস্কার দেবো । তিনি বললেন ভালো হবে ভাই, আমি ব্যবস্থা করে দেবো ।
তার আগে বলে নেই আমার ছোট বেলার কথা । বেশির ভাগ সময় নয় দশের দিকে রোল নম্বর থাকতো আমার । যখন বন্ধুরা পুরস্কার নিত তখন না দেখার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতাম । অনেক সময় বাবাও মঞ্চে থাকতেন, পুরস্কার তুলে দিতেন বন্ধুদের হাতে । অজানা একটা কষ্ট ভেতরে থাকতো কিন্তু যোগ্য না হয়ে উঠলে পুরস্কার পাবোনা এটা মেনে নিতেই হবে -এটাইতো বড় শিক্ষা !
এরকম সময় আমার চেয়ে যারা খারাপ ছাত্র তাদের মধ্যে কারও কারও মন খারাপ হতে দেখেছি আবার কারও দেখেছি পাত্তা না দেয়া । সব সুবিধা না পাওয়া একজন বন্ধু ছিলো আমাদের । যে প্রথম হল সে পুরস্কার হিসেবে এক রীম কাগজ পাওয়ার পর ঐ বন্ধুটি বলল “দেখ সাঈদ অরা ভালো ফলাফল করে দেইখা অরাই খালি কাগজ কলম পায়, আমরা ট্যাহার অভাবে কিনবারও পারিনা, পাইওনা” !
কথাটি আমার এখনও মনে হয় । বৎসর শেষে একটা পুরস্কারের দিনে যে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে তারই পুরস্কার পাওয়া দরকার । পড়াশোনা ছাড়া যে যে ধরণের যোগ্য তাকে সে ধরণের একটা করে হলেও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ।
এতে করে খারাপ ফলাফল করা শিক্ষার্থী হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াতেও পারে । সে ভবিষ্যতে তাকে মেলে ধরতেও পারে । অপ্রাপ্তির মন খারাপ নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা শিশুরা দিন দিনই নিজেদের গুটিয়ে নেয়, তারা এক সময় ভাবে আমরা পারবোই না ! পারার শক্তিকে বের করে আনতে না পারলে সে ব্যর্থতাতো আমাদেরও !
যাই হোক, বলছিলাম চাইল্ড কেয়ার স্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের কথা । কথা অনুযায়ী সব পুরস্কারের শেষে ডাকা হল যারা ভালো ফলাফল করেনি এমন পাঁচজনকে ।
তাদের মধ্যে একজনের শরীরে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে । তার অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নয় । ও আমার পাশে এসে দাঁড়ালো । বাকী চারজনকেও আনা হল । আমি তাদেও হাতে আমার মেয়ে নিতু চৌধুরীর লেখা বইটি পুরস্কার হিসেবে তুলে দিয়ে বললাম এই বইয়ে তোমাদের প্রতিষ্ঠান প্রধান ফজর আলী স্যারের জীবনের কথা লেখা আছে । তিনি কত কষ্ট করে জীবনটা এগিয়ে নিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা তোমরা জানলে তোমাদেরও বড় হতে ইচ্ছে করবে ।
বইটি পেয়ে এবং স্যারের কথা লেখা আছে জেনে ওরা খুশি হল । বলে আসলাম আমি আবার এসে দেখে যাবো তোমরা আমার কথা শুনে ভালো ছাত্র হওয়ার, ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো কিনা !
যাই হোক, পুরস্কার মানুষের মনকে আনন্দিত করে । তাই শিশুদের কোনো অনুষ্ঠানে পুরস্কার দিতে হলে ছোট ছোট হলেও সবাইকে পুরস্কার দেয়াই প্রয়োজন ।
সরকার সরকারি স্কুলে এ ধরণের আয়োজন চালু করতে পারে । তাহলে শিশুদের মধ্যে হীনমন্যতা কমবে এবং তারা নিজেদের মেলে ধরতে আরেকটু বেশী সক্ষম হবে বলে মনে করি । সেদিন অনুষ্ঠানে এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ সমাজ সেবক হিসেবে পরিচিত ফিরোজ ভাইও আমার কথা সাথে একমত হয়েছেন এবং বলেছেন তিনিও কাজটি করতে চেষ্টা করবেন । ভাবনার জায়গা প্রসারিত করলে সুশিক্ষিত, আত্ম নির্ভরশীল দেশ পাওয়া তেমন কঠিন হবার নয় ।
[লেখক: রসায়নবিদ]